নসরুদ্দিন খোজা (হোকা)

নসরুদ্দিন খোজা (হোকা)

ইস্তাম্বুল থেকে রয়টারের খবরে প্রকাশ, রসিক এবং মূর্খচুড়ামণি নসূরুদ্দিন খোজার সপ্তশত জন্মদিবস মহা-আড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়েছে।

ইংরেজি বর্ণমালার কল্যাণে ‘খোজা’ কিন্তু বাঙলায় ‘হোকা’রূপে আত্মপ্রকাশ করেছেন। অধুনা তুর্কি ভাষা ইংরেজি (লাতিন) হরফে লেখা হয় বলে তার রূপ hoca; কিন্তু তুর্করা ‘এচ’ অক্ষরের নিচে একটি অর্ধচন্দ্র বা উল্টো প্রথম বন্ধনী দেয় এবং তার উচ্চারণ অনেকটা স্কচ ‘লখ’, জর্মন ‘বাখ’ বা ফারসি ‘খবরে’র মতো কিন্তু ‘হ’ ভাগটা বেশি এবং ‘সি’ অক্ষরের উপরে হুক দেয়– এবং তার উচ্চারণ হয় পরিষ্কার ‘জ’। ঠিক সেইরকম বাংলা শব্দ (আসলে আরবি) ‘খারিজ’ তুর্কি ভাষায় haic লেখা হয়, অবশ্য ‘হ’-এর নিচে পূর্বোল্লিখিত অর্ধচন্দ্র এবং ‘সি’-র উপরে হুক দেয়। ‘পররাষ্ট্রনীতি’ তাই তুর্কিতে ‘সিয়াসত খারিজ’।

রয়টারের টেলিগ্রামে এই অর্ধচন্দ্র ও হুক বাদ পড়াতে ‘খোজা’ হোকা হয়ে গিয়েছেন। খাজা নাজিমুদ্দিনের ‘খাজা’ ও আগা খানের ‘খোজা (সম্মানিত) সম্প্রদায়ের নামও একই শব্দ– এটি আমাদের সম্পূর্ণ অজানা নয়।

এই ধ্বনি পরিবর্তনে আমাদের রাগত হওয়ার কারণ নেই। ক্রিকেটার মাঁকড়ের নাম যখন আমরা হামেশাই ‘মনকদ’, ‘মানকদ’ অনেক কিছুই লিখে থাকি, এবং ফড়কর-কে ‘ফাদকর’ ‘ফদকর’ লিখি, এমনকি এই কলকাতা শহরেই গোখলে-কে ‘গোখেল’ লিখি এবং উচ্চারণ করি, তখন রসিকবর খোজা যে হোকা হয়ে আমাদের ধোঁকা দেবেন তাতে আর আশ্চর্য কী?

খোজার জন্মদিন যে-বাইশ তারিখে উদযাপিত হচ্ছিল সেইদিনই ইস্তাম্বুল থেকে রয়টার আরেকটি তার পাঠিয়েছেন; তাতে খবর এসেছে যে ওইদিন পাঁচ শ বছর পরে তুর্কিতে এক সুপ্ত অগ্নিগিরি জেগে উঠে হা-হা করে হেসে উঠেছে।(১)

তা হলে বোঝা গেল মা ধরণীর পাকা দু শো বছর লেগেছে খোজার রসিকতার মর্ম গ্রহণ করতে; তাই বোধহয় হাসতে হাসতে তার নাড়িভুড়ি এখন ভূগর্ভ থেকে ছিঁড়ে বেরিয়েছে!

.

এদেশে আরবি এবং ফারসি চর্চা একদা প্রচুর হয়েছিল। আকবর বাদশাহের আমলে ইরানের এমনই দুরবস্থা যে সেখানকার পনেরোআনা কবি দিল্লি ধাওয়া করেছিলেন। আকবরের সভাকবি আব্দুর রহিম খানাখানা নিজেই গা গণ্ডা ইরানি কবি পুষেছিলেন, আর স্বয়ং আকবর যে কবি ‘আমি’ ‘তুমি’ মিল দিয়ে ‘কবিতা’ রচনা করত তাকে পর্যন্ত নিরাশ করতে চাইতেন না।

ভারতবর্ষের ফারসি নাম হিন্দ বা হিন্দুস্তান। ‘হিন্দ’ শব্দের অর্থ কালো। তাই এক কবি তার দৈন্যের কালরাত্রি ইরানে ফেলে পূর্বাচল ভারতবর্ষ রওয়ানা হওয়ার সময় লিখলেন,

দুর্ভাবনার কালিমা ত্যজিয়া
চলিনু হিন্দুস্তান
কালোর দেশেতে কালো আমি কেন
করিতে যাইব দান?

তাই এক ইয়োরোপীয় ঐতিহাসিক ইরানের ওই যুগকে শব্দার্থে ‘ইন্ডিয়ান সামার’ বলেছেন। কারণ এরপরই ইরানি সাহিত্যের পতন আরম্ভ হয়।

তুর্কি ভাষার কিছুটা চর্চাও এদেশে হয়েছিল, কারণ বাবুর, হুমায়ুন এঁদের সকলেরই মাতৃভাষা তুর্কি। শেষ মোগল বাদশা-সালামৎ বাহাদুর শাহের হারেমেও কথাবার্তা তুর্কি ভাষাতেই হতো এবং তুর্কিসাহিত্যের সর্বোকৃষ্ট না হলেও অন্যতম অত্যুকৃষ্ট কেতাব বাবুর বাদশার আত্মজীবনী। কিন্তু এ তুর্কি ভাষা মুস্তাফা-কামালের টার্কির ওসমানলি তুর্কি নয়, বাবুরের ভাষা চুগতাই (বা জগতাই) তুর্কি। কোরমা, দোলমা এবং লড়াই-হাতিয়ারের মতো কিছু শব্দ চুগতাই তুর্কি থেকে বাঙলাতে এসেছে। ওদিকে মোগল দরবার ফারসিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন বলে তাঁদের তুর্কি এদেশে প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। যদিও প্রাচীন বাঙলাতে ‘তুর্ক’ বলতে মুসলমান বোঝাত এবং তামিল ভাষাতে মুসলমান বোঝাতে হলে এখনও ‘তুরস্কম’ শব্দ ব্যবহার করা হয়। বাঙালি বেকার এখনও চাকরির সন্ধানে ‘তুর্কি নাচন’ নাচে।

আমরা ইংরেজি-ফরাসি পড়ি, রাশান কথাসাহিত্যও আমাদের অজানা নয়, স্পেন পর্তুগাল দেনমার্কের লোক এদেশে এসেছিল এবং আরও অনেকেই– কিন্তু আশ্চর্য ওসমানলি তুর্কি ভাষা এবং সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের কণামাত্র পরিচয় নেই। আমার জানামতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে পাবনা জেলার কবি ইসমাঈল হোসেন শিরাজী নজরুল ইসলাম এর কাছে একাধিক বিষয়ে ঋণী বলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন) তুর্কিকে সাহায্য করার জন্য একটি মেডিকেল মিশন নিয়ে সে দেশে গিয়েছিলেন এবং তুর্কি রাজনীতি, সমাজ, আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে বাঙলায় একাধিক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তুর্কির সভাকবি হামিদ পাশার সঙ্গে সে সময়ে তাঁর হৃদ্যতা হয়, কিন্তু তুর্কিসাহিত্যের সঙ্গে বাঙলার পরিচয় করিয়ে দেবার পূর্বেই ইংরেজের চাপে তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়।(২)

তুর্কির বাইরে ইরান, আফগানিস্থান, উজবেক, আজারবাইজান, তথা গ্রিস, বুলগারিয়া, রুমানিয়া ইত্যাদি দেশে নসরুদ্দিন খোজা সুপরিচিত। ইরানের স্বর্ণযুগের একাধিক সুরসিক কবির ওপর তার প্রভাব সুস্পষ্ট। বন্ধানের বাইরে ইয়োরোপে তিনি জর্মনিতে সবচেয়ে বেশি ভক্ত পাঠক পেয়েছেন। ইংরেজি এনসাইক্লোপিডিয়াতে তাঁর নাম নেই, জর্মন সাইক্লোপিডিয়া আকারে ইংরেজির অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও সেটাতে তাঁর সম্বন্ধে কয়েক ছত্র আছে। আর একাধিক অনুবাদ জর্মন ভাষাতে তো আছেই। অবশ্য আজকের দিনের রুচি দিয়ে বিচার করলে তাঁর বহু জিনিস শুধু কুট্টনীরসাশ্রিত লাতিনেই অনুবাদ করা যায়!

খোজার জীবনী নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করার উপায় নেই। কারণ তাঁর জীবন ও তাঁর হরেক রকমের রসিকতা এমনই জড়িয়ে গিয়েছে যে তার জট ছাড়ানো অসম্ভব। তাঁর সম্বন্ধে প্রচলিত দু আনা পরিমাণ কিংবদন্তি বিশ্বাস করলে আমাদের কালিদাস সম্বন্ধে প্রচলিত সবকটাই বিশ্বাস করতে হয়। এমনকি তিনি পাঁচ শ না সাত শ বছর আগে জন্মেছিলেন সেই সমস্যারই চূড়ান্ত সমাধান এযাবৎ হয়নি। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে খোর্তো গ্রামে তাঁর জন্ম সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এবং আকশেহিরে তাঁর মকবরহ বা সমাধিসৌধ দেখানো হয়। ইনি যে সুপণ্ডিত এবং সুকবি ছিলেন সে-বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই, কারণ ধর্মশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি না থাকলে ‘ইমাম’ (ইংরেজিতে অন্ততপক্ষে বিশপ) হওয়া যায় না। অন্যান্য একাধিক ব্যাপারেও তিনি সমাজের অগ্রণীরূপে তুর্কি এবং তুর্কির বাইরে সুপরিচিত ছিলেন।

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে তাঁর নামে প্রচলিত গল্পের কটি তাঁর নিজস্ব ও কটি উদোর শিরনি বুধোর দর্গায় সে বিচার অসম্ভব। দেশ-বিদেশের পণ্ডিতগণ হার মেনে বিক্রমাদিত্যের নামে প্রচলিত গল্প যে ‘বিক্রমাদিত্য সাইকল’, খৈয়ামের নামে চলিত-অচলিত চতুষ্পদী ‘খৈয়াম চক্র’ নামে অভিহিত করেছেন, ঠিক সেইরকম এখন খোজার নামে লিখিত, পঠিত, শ্ৰত গল্পকে ‘খোজা চক্র’ নাম দিয়ে দায়মুক্ত হয়। কিন্তু গল্পগুলো বিশ্লেষণ করে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে তার অনেকগুলোই আরবভূমি প্রাচীন ইরান ও ভারতবর্ষ থেকে গিয়েছে। সিরিয়াক এবং প্রাচীন বন্ধানেও এর অনেকগুলো প্রচলিত ছিল। অবশ্য এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে সেসব বাদ দিলেও খোজার তহবিলে প্রচুর হাস্যরসের উপাদান উদ্বৃত্ত থেকে যায়। এবং তার চেয়েও বড় কথা– সুখে-দুঃখে, উৎসবে-ব্যসনে, মসজিদে-সরাইয়ে, বাজারে-বৈঠকখানায় খোজা যেভাবে তাঁর গল্পে, আচরণে, ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেছেন তারই একটি অতি সুস্পষ্ট হাস্যময়, সদানন্দ, দরদী ছবি তুর্কিদের বুকের ভিতর আঁকা। আজ যদি বেহশত থেকে ফিরিশতা (দেবদূত) ইস্তাম্বুলে নেমে বিশ্বজনের কাছে সপ্রমাণ করে যান যে ইমাম নসরুদ্দিন খোজা নামক কোনও ব্যক্তি এ ধরায় জন্মগ্রহণ করেননি তবুও তুর্কির লোক অচঞ্চল চিত্তে সেই তসবিরই ধারণ করবে, বিদেশির সঙ্গে পরিচয় হওয়ার কয়েক লহমার ভিতরেই খোজার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেবে এবং যদি সেখানে একাধিক তুর্ক উপস্থিত থাকে, এবং আপনি যে খোজাকে চেনেন না সেকথা বুঝতে পারে তবে আপসে পাল্লা লেগে যাবে কে কত বেশি খোজার গল্প বলতে পারে। এদেশে যেমন বিস্তর রবীন্দ্রভক্ত আছেন যাঁরা প্রত্যেক ঋতু-পরিবর্তন এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির রূপরসগন্ধস্পর্শ বিবর্তন রবীন্দ্রনাথের কোনও না কোনও গান, বা একাধিক গান দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন, ঠিক তেমনি জীবনের সুখ-দুঃখ, বিপদ-আপদ, দুর্ঘটনা, লটারি লাভ– সবকিছুই খোজার কোনও না কোনও গল্প দিয়ে রসরূপে প্রকাশ করা যায়। কারণ খোজা শুধু এলোপাতাড়ি রসসৃষ্টি করে যাননি তার মারফতে খোজার পরিপূর্ণ জীবনদর্শন বা ‘ভেল্টআনশাউঙ’ পাওয়া যায়।

খোজার গল্প তিন রকমের। সহজেই অনুমান করা যায়, তিনি যেখানে চালাকি করে অন্যকে বোকা বানাচ্ছেন, কিংবা মারাত্মক উত্তর দিয়ে প্রতিপক্ষকে নিরস্ত্র করেছেন তার সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এন্তের গল্প আছে যেখানে তিনি একটি পয়লা নম্বরের ইডিয়েট, গাড়লস্য কুত্ত্বমিনার। এবং তৃতীয় শ্রেণি থেকে বোঝা যায় না, তিনি বোকা না আমরা বোকা।

যেমন মনে করেন, খোজাকে অমাবস্যার রাতে শুধানো হল পূর্ণিমার চাঁদ গেল কোথায়? খোজা একগাল হেসে উত্তর দিলেন, ‘তা-ও জানো না, পূর্ণিমার চাঁদকে প্রতি রাত্রে ফালি ফালি করে কেটে নেওয়ার পর এখন সেগুলো গুঁড়ো করে আকাশের তারা করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’

খোজা বোকা বনতে চান, না বানাতে চান?

অবশ্য খোজার গীতিরস বা লিরিকরস অসাধারণ ছিল। এই কবিতৃময় ব্যাখ্যাটি দিয়ে তিনি যে গীতির সৃষ্টি করতে চাননি, বা যেসব কবি অসম্ভব অসম্ভব তুলনা দিয়ে কাব্যরস সৃষ্টি করতে চান তাদের নিয়ে মশকরা করতে চাননি একথা বলা কঠিন। কারণ আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্রেও আছে–

‘প্রিয়ে, আকাশে চন্দ্রের মুখ দেখে
মনে হল তোমার মুখ,
তাই আমি চাঁদের পিছনে পিছনে ছুটছি।’

এ ধরনের তুলনাকে ‘অসম্ভব তুলনা’ বলে আলঙ্কারিক দণ্ডিন কাব্যাদর্শে নিন্দা করেছেন। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় যে এতে হাস্যরসের অবতারণা হওয়া বিচিত্র নয়। কথা নেই, বার্তা নেই, একটা লোক যদি চাঁদের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাকিয়ে হঠাৎ খোয়াই-ভাঙা মাঠ-ময়দান ভেঙে ছুটতে আরম্ভ করে আর বলতে থাকে ‘ওই আমার প্রিয়া, ওই আমার প্রিয়া’, তা হলে পাড়ার ডন জোয়ানদেরও হেসে ওঠা অসম্ভব নয়।

তবু না-হয় মেনে নেওয়া গেল, চাঁদকে গুঁড়ো করে খোজা ইচ্ছা করেই বোকা বনেছেন। কিন্তু এখন যেটা বলছি সেটাতে খোজা কী?

দোস্তের বাড়ির দাওয়াতে খোজা খেলেন এক নতুন ধরনের মিশরি কাবাব। অতি সযত্নে একটুকরো কাগজে লিখে নিলেন তার রেসিপি কিংবা পাকপ্রণালি কিংবা যাই বলুন। ততোধিক সযত্নে, ব-তরিবৎ সেটি রাখলেন জোব্বার ভিতরে গালাবিয়ার বুকপকেটে। রাস্তায় বেরিয়েই গেলেন তার প্যারা কসাইয়ের দোকানে। আজ সন্ধ্যায়ই গিন্নিকে শিখিয়ে দেবেন কী করে এই অমূল্যনিধি রাঁধতে হয়। আর খাবেনও পেট ভরে। বন্ধুর বাড়িতে মেকদারটা একটু কম পড়েছিল। গোশত কিনে খোজা রাস্তায় নামলেন।

হঠাৎ চিল এসে ছোঁ মেরে মাংস নিয়ে হাওয়া।

খোজা চিলের পিছনে ছুটতে ছুটতে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে চিলকে বলতে লাগলেন, ‘আরে কোরছ কী? শুধু মাংসটা নিয়ে তোমার হবে কী? রেসিপিটা যে পকেটে রয়ে গেছে। কী উৎপাত! দাঁড়াও না।’

কিন্তু এভাবে গল্পের পর গল্প বলতে থাকলে খোজার সম্পূর্ণ গ্রন্থ নকল করে দিতে হয়। সম্পাদক আপত্তি জানাবেন।

এবারে তা হলে যে ধরনের গল্পের জন্য খোজা সুপ্রসিদ্ধ তারই একটি নিবেদন করি।

কথিত আছে, একদা খোজা জন্মভূমি তুর্কির প্রতি বিরক্ত হয়ে দেশত্যাগ করে ইরান দেশে চলে যান। এতে আশ্চর্য হবার মতো কিছুই নেই। কারণ খোজা ছিলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন পরোপকারী–আমাদের বিদ্যাসাগরের মতো দাগা খাওয়া বিচিত্র নয়।

তা সে যাই হোক লোকমুখে ইরানের রাজা সে খুশখবর শুনে বে-এক্তেয়ার। তড়িঘড়ি লোকলশূকরসহ উজির-ই আলাকে পাঠিয়ে দিলেন খোজাকে পরম যত্নসহকারে রাজদরবারে নিয়ে আসতে। খোজা আসামাত্র তখৃত্-ই-সুলেমান ত্যাগ করে বাদশা তাঁকে আলিঙ্গন করে পাশে বসালেন। মাথায় সোনার তাজ পরিয়ে দিলেন, গায়ে কাশ্মিরি শাল জড়িয়ে দিলেন, কোমরবন্ধে দমশকি তলওয়ার ঝুলিয়ে দিলেন। চতুর্দিকে জয়জয়কার।

সভাভঙ্গের পর বাদশা নিভতে ইতি-উতি করে, আশ-কথা পাশ-কথা কাড়ার পর অতি সন্তর্পণে তাঁর জাগিরের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। খোজা করজোড়ে ‘সে কী শাহ ইন-শাহ, আপনার যে পূত পবিত্র… ইত্যাদি(৩) বলে তিনি নিবেদন করলেন, রাজসম্মানই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট।

বাদশাহ বিস্তর চাপাচাপি করার পর খোজা বললেন,’ হুজুরের যখন নিতান্তই এ হেন বাসনা তবে হুকুম জারি করে দিন কাল সকাল থেকে যারা বউকে ডরায় তারা আমাকে একটি করে ডিম প্রতি সকালে দেবে।’

দিন দুনিয়ার মালিক বাদশা তো তাজ্জব। ‘ওতে আপনার কী হবে? আমি খবর পেয়েছি, আপনি দান-খয়রাতে দাতাকর্ণ।’

খোজা এলবুর্জ পাহাড়ের মতো অচল অটল। তবে তাই সই। ইরানি ভাষায় বলতে গেলে আলোচনার কার্পেট তখন রোল করে গুটিয়ে ঘরের কোণে খাড়া করে রেখে দেওয়া হল।

পরদিন ফজরের নমাজের সময় থেকেই হৈ-হৈ-রৈরৈ। এস্তেক রাজবাড়িতেও মমলেট-অমলেট নেই। কী ব্যাপার? যাদের বাড়িতে মুরগি নেই তারা ফজরের আজানের পূর্বে ছুটেছে বাজারপানে। ডিম কিনে ধাওয়া করেছে খোজার ডেরার দিকে।

সেখানে ডাঁই ডাঁই হুদো হুদো আণ্ডার ছয়লাপ! আণ্ডার নবীন ব্রহ্মাণ্ড।

পাইকিরি ব্যবসায়ীরা চতুর্দিকে বসে!

সাতদিন যেতে-না-যেতে খোজা ঢাউস তেতলা হাওয়া-মঞ্জিল হাঁকালেন। পক্ষাধিককাল মধ্যেই বোখারার কার্পেট, সমরকন্দের রেশমি তাকিয়া, মুরাদাবাদি আতরদান, গোলাপ-পাশ, বিদরি আলবোলা, রাজস্থানের গোলাপি মার্বেলের ফোয়ারা, সরণ-দীপের (স্বর্ণদ্বীপ সিংহল) হাতির দাঁতের চামর, ব্যজনী!

বাদশা তো আজব তাজ্জব মানলেন।

কুলোকে বলে, দু একজন অমিতবীর্য সাহসী শের-দিল রুস্তম নাকি ডিম নিয়ে যায়নি। দেখে তাদের (অথবা তার স্ত্রী নাকি শুধিয়েছিল, ‘ও! তুমি বুঝি আমাকে ডরাও না?’ তার পর আর দেখতে হয়নি!

ইরানের বাদশা খুশিতে তুর্কির খাস খলিফাকে ছাড়িয়ে গেছেন।

এমন সময় রাজার মস্তকে বজ্রাঘাত। খোজা তিন-মাসের ছুটি চান দেশ থেকে বউ-বাচ্চা নিয়ে আসবেন বলে। খোজা মারাত্মক একদারনিষ্ঠ। রাজা আর কী করেন, অতি অনিচ্ছায় ছুটি দিলেন, অবশ্য, তিন মাস রিট্রেঞ্চ করে দু মাসের তরে। যাবার সময় বললেন ‘দোস্ত! দেরি করবেন না, আপনার বিরহে আমার’- বাদশার গলা জড়িয়ে এল। ততদিনে তাঁদের সম্পর্ক আর রাজা-প্রজায় নয়–দোস্তিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

দু মাসের কয়েকদিন পূর্বেই খোজা রাজসভায় পুনরায় উপস্থিত। রাজা পরমানন্দে রাজোচিত ভাষায় শুধালেন, ‘তবে কি পুণ্যশ্লোকা বেগম-সাহেবা স্ব-ভবনে অবতীর্ণ হয়েছেন?’

খোজা বললেন, ‘হ্যাঁ, হুজুর! তবে কি না, ভবনটি তার উপর অবতীর্ণ হলেই হত আরও ভালো।’

তদ্দণ্ডেই সভাভঙ্গের হুকুম হল। বাদশা নিয়ে গেলেন খোজাকে অন্দরমহলে।

‘শতেক বছর পরে বঁধুয়া আসিল ঘরে–’

বাদশার তখন ওই হাল। দোস্তের সঙ্গে নিভৃতে দুঁহু দুঁহু হয়ে কুহু কুহু করবেন।

দু পাত্র শিরাজি খেয়ে বাদশা খোজার কাছে ঘেঁষে বললেন, ‘দোস্ত! রাজ্যের আর সকলের সঙ্গে আমার রাজা-প্রজার সম্বন্ধ। তারা আমার কাছ থেকে চায়; আমি তাদের দিই। কিন্তু আপনি আমার দোস্ত আপনার সঙ্গে দোস্তির সম্পর্ক। দোস্ত যখন দেশে ফেরে তখন দোস্তের জন্য– ’ বাদশা গলা সাফ করে বললেন, ‘এই, ইয়ে, মানে, কোনওকিছু একটা সওগাত আনে। আপনি তো আনেননি।’

বলে বাদশা খ্যাঁক খ্যাঁক করে বিশ্রী রকমের হাসতে লাগলেন।

না-হক বেইজ্জত হলে মানুষ যেরকম বেদনাতুর কণ্ঠে ককিয়ে ওঠে, খোজা সেইরকম বললেন, ‘জাঁহাপনা কুল্লে দুনিয়ার ইমান-ইনসাফের মালিক, এ সংসারে আল্লা-তালার ছায়া (জিল্লুল্লা) আমার ওপর অবিচার করবেন না। এনেছি, আলবৎ এনেছি। দেশে পৌঁছে সক্কলের পয়লা হুজুরেরই সওগাত সংগ্রহ করেছি। আজ সঙ্গে আনিনি। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হয়। কাল সন্ধ্যায় নিয়ে আসব।’

একেই বলে দোস্ত!

উগ্রীব হয়ে রাজা শুধালেন, ‘কী? কী? আমার যে তর সইছে না। আহ্, জীবনে এই প্রথম কিছু-একটা পেলুম।’

খোজা বললেন, ‘নিজের আনা সওগাতের প্রশংসা করতে বাধছে, কিন্তু সত্যি হুজুর অপূর্ব, অতুলনীয়। একটি অপরূপ সুন্দরী তুর্কি তরুণী আপনার জন্য এনেছি হুজুর।’(৪)

ঝঙ্কারের জন্য ফারসিটা শুনুন :

‘অগর আন্ তুর্ক-ই শিরাজি
বদস্ত আরদ দিল-ই মারা
ব-খাল-ই হিন্দো ওণ বখ শম্
সমরকন্দ ওয়া বুখারারা।’ (৫)

 কথিত আছে এ দোঁহা লিখে হাফিজকে তিমুর লেনের সামনে বিপদে পড়তে হয়েছিল। সেটা বারান্তরে হবে।

তার পর খোজা উচ্ছ্বসিত হয়ে সেই তরুণীর রূপবর্ণনা আরম্ভ করলেন, একেবারে আমাদের বিদ্যাপতি স্টাইলে, নখ থেকে শির পর্যন্ত– যাকে বলে নখশির বর্ণন। ‘ওহো হো হো,–একটি তন্বঙ্গী চিনার গাছ হেন! কী দোলন, কী চলন!’

বাদশা বললেন, ‘আস্তে।’

কিন্তু খোজাকে তখন পায় কে, তিনি মৌজে। গলা চড়িয়ে বললেন, ‘চিকুর কেশ তো নয়, যেন অমা-যামিনীর স্বপ্নজাল– আর্দ্র, স্নিগ্ধ, মৃগনাভি সম।’

উৎসাহের তোড়ে খোজা তখন উঠে দাঁড়িয়েছেন। যেন রাজকবি দরবারের সবাইকে শুনিয়ে কবিতা পাঠ করছেন।

বাদশা ব্যাকুল হয়ে খোজার জোব্বা টেনে কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘চুপ, চুপ, আস্তে আস্তে– পাশের ঘরে বেগম-সায়েবা রয়েছেন।’

ঝুপ করে বসে পড়ে খোজা বিনয় কণ্ঠে বললেন, ‘হুজুর, কাল সকাল থেকে একটি করে আণ্ডা পাঠিয়ে দেবেন। আমার পাওনা।’

এইখানেই খোজা-কাহিনী শেষ করলে ঠিক হত। কিন্তু তা হলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। তিনি পরলোকগমনের পূর্বে যে শেষ রসিকতাটি করে গিয়েছেন, সেটি বাদ পড়ে যায়। কারণ সেটি আজও প্রথমদিনের মতো তাজা, অতিশয় নব ফারসিতে যাকে বলে ‘তাজা ব-তাজা, নৌ-ব-নৌ’, দ্বিতীয়ত, আণ্ডার গল্পটি আমি শুনেছি আমার সর্বকনিষ্ঠা ভগিনী লুৎফুন্নিসার কাছ থেকে। আমার মতো তার পায়েও চক্কর আছে। সে শুনেছে লাহোর না পেশাওয়ার কোথায় যেন। এর থেকে এটাও বোঝা যায়, খোজার গল্প মুখে-মুখে কতখানি ছড়িয়ে পড়েছে। এখন বাঙলা দেশেও পৌঁছল। সপ্তদশ অশ্বারোহী গাঁজা; দশ বাদ দিয়ে সপ্ত শতাব্দীতেই হয়।

এবারে শেষ গল্প। এটাতে আপনি-আমি সবাই আছি।

যেমন মনে করুন, দৈবযোগে আপনি পৌঁছেছেন আশেহিরে, স্বভাবতই আপনার মনে বাসনা, দিলে ইরাদা জাগবে খোজার গোরস্তান দেখবার জন্য। একাই বেরিয়ে পড়ুন; কিচ্ছুটি ভাবনা নেই, সবাই রাস্তা চেনে।

সেখানে গিয়ে দেখবেন, সামনে এক বিরাট দেউড়ি– প্রবেশদ্বার। কোথায় লাগে তার কাছে ফতেহ-পুর-সিক্রিতে আকবর বাদশার বুলন্দ-দরওয়াজ। একেবারে শিশু। তা না-হয় হল, কিন্তু অবাক হবেন দেখে যে বন্ধ-দরজায় এক বিরাট তিন মণ ওজনের তালা!

গোরস্তানে আছেই-বা কী, যাবেই-বা কী? এই ভারতবর্ষেই লুটতরাজের ফলে যা-কিছু ইমারত বেঁচে আছে, সেগুলো হয় কবর নয় মসজিদ– ওসবে লুটের কিছু নেই বলে। তিনমণি তালা দিয়ে খোজার দেহরক্ষা–অন্যার্থে– করা হচ্ছে, মিশরি মমির মতো? কিন্তু ইসলামে তো হেন ব্যবস্থা নেই।

নাচার হয়ে তালাটা বন্ধ দোরে বারকয়েক ঠুকলেন, এদিক-ওদিক গলা বাড়িয়ে চেল্লাচেল্লি করলেন।

তখন দরাজ-দেউড়ির একপাশ দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে বেরিয়ে এল পাহারাওলা। আপনাকে সবিনয় নিবেদন করবে, ‘কী হবে ওই বিরাট তালা খুলে। ওটা কখনও খোলা হয়নি। চলুন পাঁচিল ডিঙিয়ে যাই।’

মানে?

একশ ফুট উঁচু দেউড়ি– চতুর্দিকের পঁচিল উঁচুতে এক ফুট হয় কি-না হয়।

 মানে?

খোজার আখেরি-শেষ মশকরা। উইলে এইভাবে তৈরি করবার আদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন।

বলতে চেয়েছিলেন, ‘এ জীবনে আমরা সামনের দিকটা আগলাতেই ব্যস্ত। ইতোমধ্যে আর সবদিক দিয়ে যে বেবাক কিছু চলে যায়, তার খবর রাখিনে।’

***

আমি আকশেহির যাইনি। কাজেই হলফ খেয়ে বলতে পারব না, খোজার দর্গা এই পদ্ধতিতে নির্মিত কি না। যদি না হয় তবে বুঝব খোজা আরও মোক্ষম রসিক। বিন-খর্চায় আমাদের এখনও হাসাচ্ছেন আর বোকা বানাচ্ছেন।

————

১. VOLCANIC ERUPTION AFTER FIVE CENTURIES

Istambul July 22–Mount Soutlubiyan, in the Kars Province of Turkey has burst into what is believed to be Turkey’s first volcanic eruption since the 15th century. A spokesman at the office of the Governor of Kars said the erup tion of rock and smoke had caused anxiety and excitement among people liv ing nearby, but there had been no serious damage yet.

২. সুপ্রভাত’ পত্রিকার সম্পাদিকা শ্রীমতী কুমুদিনী মিত্রকে (ইনি ‘সঞ্জীবনী’ সম্পাদক শ্রীঅরবিন্দের মেসোমশাই কৃষ্ণকুমার মিত্রের বড় মেয়ে) শিরাজী একটি কবিতা ও ছবি পাঠালে পর তিনি (কুমুদিনী) লেখেন, ‘আপনার কবিতা ও ছবি পাইয়া আমি পরম পুলকিত হইয়াছি। আপনার কবিতাটি “সুপ্রভাতে” প্রকাশিত হইবে। তুরস্কের নারীদিগের অতীত ও বর্তমান অবস্থা, স্বদেশের কার্যে ও উন্নতিতে তাহাদের সাহায্যদান, তাহাদের শিক্ষা ও স্বদেশপ্রেম প্রভৃতি সম্বন্ধে লেখা শীঘ্রই অনুগ্রহ করিয়া পাঠাইবেন। ভারতবর্ষ হইতে যে সকল যুবক আহতদিগের সেবার জন্য তথায় গমন করিয়াছেন, তাহাদের কার্যের বিবরণ লিখিবেন।’

বাঙলা একাডেমী পত্রিকা, প্রথম বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, পৃ. ৫৭।

৩, ইরানে বাদশার সামনে কোন মন্ত্র দিয়ে নিবেদন আরম্ভ করতে হয়, তার পুরো বিবরণের জন্য ‘দেশে-বিদেশে’ অধ্যায় পশ্য।

৪. ইরানে তুর্কি রমণীর বড়ই কদর।

‘হে তরুণী, হে তুরস্কী, হে সুন্দরী সাকি
এমনি হৃদয় মুগ্ধ করিয়াছ তুমি,
 তব কপোলর ওই কৃষ্ণ তিল লাগি
বোখারা সমরকন্দ দিতে পারি আমি।

অনুবাদটি ভালো নয়। কিন্তু হাফিজের এই কবিতাটি এতই বিখ্যাত যে, তার একাধিক ইংরেজি অনুবাদ আছে–

‘If that unkindly Shirazi Turk
 would take my heart in her hand
 I’d give Bukhara for the mole upon
her cheek, and Samarkand.’

কিংবা

‘Sweet maid, if thou wouldst charm my sight;
 And bid these arms thy neck infold;
That rosy cheek, thy lily hand
Would give thy poet more delight
Than all Bokharas vaunted gold.
Than all the gems of Samarkhand.

 ৫. সত্যেন দত্তের অনুবাদ আছে।