উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

নয় । ভিসুভিয়াসের জাগরণ

নয় । ভিসুভিয়াসের জাগরণ

এলবা! ছোট্ট একটি পাহাড়ে-দ্বীপ। লোকসংখ্যা আঙুলে গুণে বলা যায়।

কর্সিকাও ছোট দ্বীপ। কিন্তু এলবার চেয়ে চল্লিশ গুণ বড়, তার লোকসংখ্যাও দশগুণ বেশি।

‘এর চেয়ে ওরা যদি আমাকে কর্সিকায় পাঠিয়ে দিত!’ নেপোলিয়ন মনে-মনে নিশ্চয়ই এই কথা ভেবেছিলেন।

এখনও তিনি সম্রাট, আর এই এলবা তাঁর সাম্রাজ্য—এই উইঢিপি!

তবু বাইরে তিনি কোনও প্রতিবাদ করলেন না। অস্ট্রিয়া ও ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি তাঁর উপরে নজর রাখবার জন্যে এলবাতেই বাসা বেঁধেছিলেন—তাঁরা দেখলেন তাঁর হাসিখুশি-মাখা মুখ! আহারে-বিহারে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে থাকবার জন্যে নেপোলিয়ন তাঁদের সাদর আমন্ত্রণ করতেও ভুললেন না!

এই একবিন্দু ‘সাম্রাজ্য’কে নিজের নামের যোগ্য করে তোলবার জন্যে তিনি বিপুল উৎসাহের সঙ্গে এলবার সর্বাঙ্গীন উন্নতিসাধনে নিযুক্ত হলেন।

অস্ট্রিয়া ও ইংল্যান্ডের প্রতিনিধিরা ভাবলেন, কী অস্বাভাবিক মানুষ এই নেপোলিয়ন! একখণ্ড জমি পেয়ে অমন বিরাট সাম্রাজ্যের কথা ভুলে গেলেন!

কিন্তু নেপোলিয়ন ভোলেননি। তাঁর হৃদয় এখন ভিসুভিয়াসের মতন। বাইরে পরম প্রশান্ত, কিন্তু যে-কোনও মুহূর্তে সর্বগ্রাসী অগ্নি-উদগিরণ করতে পারে।

মা লেটিজিয়া এলেন। সম্পদের দিনে লেটিজিয়া সহজে ছেলের কাছে আসতে রাজি হতেন না, কিন্তু বিপদের দিনে মা এসে বুক দিয়ে পড়লেন। আজ ছেলের কাছে থাকতে পেয়ে মায়ের মুখে হাসি ধরে না।

নেপোলিয়নের সবচেয়ে প্রিয় বোন সুন্দরী পলিনও এলেন। পলিন প্রজাপতির মতন চঞ্চল, পলিন শরীরিণী আনন্দঝরনা! তাকে পেয়ে নেপোলিয়নের গোপন দুঃখ অনেকটা হালকা হয়ে পড়ল।

আর এক বোন ক্যারোলিন—নেপলস-এর বিশ্বাসঘাতক রাজা মুরাটের স্ত্রী। মায়ের হুকুমে এ দ্বীপে তাঁর প্রবেশ নিষেধ! আর এলেন না ভাইয়েরা—যাঁদের জন্যে নেপোলিয়ন এত করেছেন!…

ফ্রান্সের নতুন রাজা অষ্টাদশ লুই। তিনি ‘গিলোটিনে’-মৃত ষোড়শ লুইয়ের ছোট ভাই। যে বুর্বন-বংশের জন্যে ফরাসি-বিপ্লবের রক্তগঙ্গার উৎপত্তি, সেই ঘৃণ্য বংশের আবার এক রাজাকে ঘাড়ে করে ফরাসি জনসাধারণ ভিতরে ভিতরে জ্বলতে লাগল যেন তুষানলে! তার উপরে এ রাজা ফ্রান্সের সিংহাসন দখল করেছেন বিদেশি শত্রুদের সাহায্যে! প্রজারা তাঁকে ভালোবাসবে কেন?’

পুরাতন বংশের সঙ্গে এল আবার পুরাতন ব্যভিচার। রাজা নিজে লোক মন্দ নন, কিন্তু কাজ করেন স্বার্থান্ধ সাঙ্গোপাঙ্গোদের পরামর্শে। যে-সব রীতিনীতিকে তাড়াবার জন্যে লক্ষ লক্ষ ফরাসি বুকের রক্ত ঢেলেছে, আবার হল সেইসব রীতি-নীতির পুনরাবির্ভাব! আবার সাধারণ লোকেদের মাথার উপরে উঠে দাঁড়াল অভিজাতরা, আবার আরম্ভ হল পুরোহিতদের অত্যাচার! পথে-পথে দু-একটা দাঙ্গা-হাঙ্গামাও হল।

লোকে আবার চুপিচুপি বলতে লাগল, ‘নেপোলিয়ন ছিলেন রাজার মতন রাজা!’

ফ্রান্সে নেপোলিয়নের চরের অভাব ছিল না। সব খবর যথাস্থানে গিয়ে হাজির হল।

নির্বাসনের পর দশমাস কেটে গিয়েছে।

মা লেটিজিয়া একদিন গিয়ে দেখলেন, নেপোলিয়ন একটি ডুমুর গাছের তলায় একলা দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

‘মা, তোমাকে একটা কথা বলব, আর কারুকে বোলো না। পলিনকেও না।’

মা চুপ।

‘কাল সন্ধ্যার সময়ে আমি চলে যাব।’

‘কোথায়, বাবা?’

‘প্যারিতে।’—অল্পক্ষণের নীরবতা।—’আমি তোমার পরামর্শ চাই।’

মায়ের বুক যেন পাথর হয়ে গেল। কিন্তু এ মা হচ্ছেন নেপোলিয়নের মা! যেমন তাঁর গর্ব, তেমনি বুদ্ধি! তাঁর ছেলে যা ধরেছে তা করবেই, বাধা দেওয়া বাহুল্য!

মা বললেন, ‘বাবা, তোমার নিয়তিকে অনুসরণ করো। বিষ খেয়ে বা অথর্ব বুড়ো হয়ে তুমি মরবে, নিশ্চয়ই ভগবানের সে-ইচ্ছা নেই। হয়তো তোমার মৃত্যু হবে তরবারি হাতে করেই। আমাদের ভরসা, মা মেরি।’

নেপোলিয়ন আবার ফ্রান্সে! সম্রাট প্রথম নেপোলিয়ন!

দিকে দিকে ছুটে গেল এই সুসংবাদ, হৃদয়ে হৃদয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ!

নেপোলিয়ন আসছেন রাজধানীতে! যে-পথ দিয়ে আসছেন, দুধারে তার কাতারে কাতারে লোক ভেঙে পড়ছে আর ঘন ঘন জয়ধ্বনি উঠছে—’সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন!’

কিন্তু ইতর জনতার জয়ধ্বনি নিয়ে সম্রাট তখন মাথা ঘামাচ্ছেন না—এলবার পথে তাদের জয়ধ্বনি গুপ্তকথা তিনি জেনেছেন।

সম্রাট খালি ভাবছেন, আমাকে দেখে সৈন্যরা কী বলবে? কী করবে?

বেশিক্ষণ ভাবতে হল না, পথিমধ্যেই রাজার সৈন্যদের সঙ্গে দেখা হল। সৈন্যদের নেতারা প্রতিজ্ঞা করে এসেছে, নেপোলিয়নকে তারা বধ করবেই!

রাজসৈন্যেরা নেপোলিয়নের সামনে এসে উপস্থিত। হাতে তাদের বন্দুক, মুখ তাদের মৌন, ভাব তাদের পাথরের পুতুলের মতন।

নেপোলিয়ন একাকী পায়ে-পায়ে এগিয়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অবিচলিত দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘সৈন্যগণ, তোমরা কি আমাকে চেনো না! তোমাদের দলে এমন কেউ যদি থাকে, যে তার সম্রাটকে বধ করতে চায়, তাহলে সে এগিয়ে আসুক, আমাকে বধ করুক। আমি এখানে হাজির!’ বলেই তিনি জামা খুলে নিজের বুক অনাবৃত করে ফেললেন।

অখণ্ড স্তব্ধতা, ভয়াবহ! এখনি কি ঘটবে?

হঠাৎ বাঁধ-ভাঙা ধ্বনি বন্যার মতন শোনা গেল, ‘সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন!’ তারপরেই বিপুল আনন্দের উচ্ছ্বাস, ‘রাজসৈন্য হল নেপোলিয়নের সৈন্য!’

সর্বত্রই এই দৃশ্যের পুনরভিনয়! নতুন রাজা সদলবলে রাজ্য ছেড়ে দৌড় মারলেন সমুদ্রের দিকে এবং সেখান থেকে ইংল্যান্ডে। নেপোলিয়ন আবার ফ্রান্সের সর্বেসর্বা! এমন পুনরুত্থানের আশ্চর্য কাহিনি উপন্যাসেও আর কখনও কল্পিত হয়নি (১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে)।

ফরাসিরা নেপোলিয়নকে গ্রহণ করলে বটে, কিন্তু সমগ্র ইউরোপ হয়ে উঠল খড়গহস্ত! তারা তাঁকে মানবজাতির শত্রু বলে প্রচার করলে। সারা ইউরোপে ‘সাজ সাজ’ রব উঠল।

সিংহাসনে ভালো করে বসতে না বসতেই নেপোলিয়ন খবর পেলেন, তাঁকে পদদলিত করবার জন্যে চারিদিক থেকে সমগ্র ইউরোপের দশ লক্ষ এগারো হাজার সৈন্য ছুটে আসছে! তাদের বাধা দেওয়ার জন্যে তিনিও তাড়াতাড়ি সৈন্যসংগ্রহ করতে লাগলেন; কিন্তু সময়াভাবের জন্যে তিন লক্ষ পঁচাত্তর হাজারের বেশি লোক জোগাড় করতে পারলেন না। তবু তিনি অটল। স্থির করলেন, শত্রুরা এক সঙ্গে সম্মিলিত হওয়ার আগেই একে-একে তাদের বাহিনী ধ্বংস করবেন। এটা তাঁর বহু পরীক্ষিত পুরাতন যুদ্ধরীতি।

সবচেয়ে কাছে আছে ইংরেজ ও প্রুশিয়ানরা। বেলজিয়মে ইংরেজ সেনাপতি ওয়েলিংটন কতক ইংরেজ, কতক জার্মান, কতক বেলজিয়ান ও কতক ওলন্দাজ সৈন্য নিয়ে প্রুশিয়ান সেনাপতি ব্লুচারের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।

নেপোলিয়ন প্যারিস থেকে বেরিয়ে ওয়েলিংটনের সঙ্গে মেলবার আগেই প্রুশিয়ানদের উপরে গিয়ে পড়লেন বেলজিয়মের চার্লেরই নগরের কাছে। প্রুশিয়ানরা লিগনি শহরের দিকে পশ্চাৎপদ হল। নেপোলিয়ন তাদের পিছনে পিছনে ছুটে গিয়ে আবার ব্লুচারকে আক্রমণ করলেন। সারাদিন ধরে চলল কামানের বজ্রগর্জন ও অস্ত্রে অস্ত্রে ঝনৎকার। ফরাসি ও জার্মানরা হচ্ছে পরস্পরের চিরশত্রু, সুতরাং যুদ্ধের ভীষণতা উঠল চরমে! রণক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ল বিশ হাজার জার্মান ও পনেরো হাজার ফরাসির মৃতদেহ। তারপর ব্লুচার আর সহ্য করতে না পেরে সসৈন্যে পলায়ন করলেন। প্রথম যুদ্ধে জয়ী নেপোলিয়ন (১৫ জুন, ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে)।

আবার ব্লুচার পালালেন—কিন্তু নেপোলিয়ন চেয়েছিলেন তাঁকে একেবারে সসৈন্যে ধ্বংস করতে। ঐতিহাসিকরা বলেন, ফরাসিদের বামপার্শ্বের সৈন্যদল যদি নেপোলিয়নের আদেশ পালন করতে পারত, তা হলে লিগনি-ক্ষেত্রেই হত ব্লুচারের পতন এবং ওয়েলিংটন একলা কখনওই নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করতেন না। ফলে ওয়াটার্লু যুদ্ধের ইতিহাস লেখবারও দরকার হত না।

ব্লুচারও মরতে মরতে কোনও গতিকে বেঁচে গিয়েছিলেন। অশ্বারোহী সৈন্যদের পুরোভাগে থেকে তিনি ফরাসিদের আক্রমণ করতে আসছিলেন; হঠাৎ তাঁর ঘোড়া গুলি খেয়ে তাঁকে নিয়ে ভূতলশায়ী হয় এবং তাঁর উপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় জার্মান ও ফরাসিরা—কিন্তু যুদ্ধের গোলমালে কোনও পক্ষই তাঁকে চিনতে পারেনি!

ব্লুচার পালিয়ে ওয়াটার্লুর পথ ধরলেন এবং নেপোলিয়নও তাঁর পিছনে পিছনে অনুসরণ করতে পাঠালেন সসৈন্যে সেনাপতি গ্রাউচিকে।

ওয়াটার্লুর যুদ্ধ হচ্ছে একটি বিচিত্র নাটকীয় দৃশ্যের মতো। পরের পরিচ্ছেদে তাই ওই যুদ্ধের একটি বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া হল।