নয় । কালোদেড়ের প্রভাতি ভোজ
ওদিকে তরুণ নৌসেনাপতি লেফটেন্যান্ট মেনার্ড প্রস্তুত হচ্ছিলেন যুদ্ধের জন্যে।
বোম্বেটেদের জাহাজ তখন বাহির-সমুদ্রে ছিল না, একটা খাঁড়ির (স্থলভাগে প্রবিষ্ট সমুদ্রের অপ্রশস্ত অংশ) ভিতরে গিয়ে নোঙর ফেলে যুদ্ধের জন্যে অপেক্ষা করছিল।
মেনার্ড বুঝলেন, তাঁর অধীনে ‘নাইম’ ও ‘পার্ল’ নামে যে দুখানা প্রকাণ্ড রণতরি আছে, গভীর সাগরের আনাগোনার উপযোগী করে তারা গঠিত। একে তো খাঁড়ির জলপথ সংকীর্ণ, উপরন্তু চড়া পড়েছে তার যেখানে-সেখানে—বড় জাহাজ ঢুকলেই চড়ায় আটকে অচল ও অকেজো হয়ে পড়বে।
কালোদেড়ের চালাকি বুঝে নিয়ে রণকুশল মেনার্ড তার ফাঁদে ধরা পড়তে রাজি হলেন না। তিনি ‘স্নুপ’ বা এক মাস্তুলের দুখানা অপেক্ষাকৃত ছোট ও হালকা জাহাজ নির্বাচন করলেন—তারা অগভীর জলেও চলাফেরা করতে পারবে অনায়াসেই। তার উপরে তাদের আরও হালকা করবার জন্যে ভারী ভারী কামানগুলোও সরিয়ে ফেলা হল। পরিবর্তে আমদানি করা হল গাদি গাদি বন্দুক—বড় কামানের অভাব পূরণ করবে তাদের সংখ্যাধিক্যই!
খবর নিয়ে জানা গেল, বোম্বেটেদের দলে পঁচিশজনের বেশি লোক নেই, কারণ কালোদেড়ে অতিরিক্ত লাভের লোভে দল অতিশয় হালকা করে ফেলেছে। মেনার্ড সঙ্গে নিলেন প্রায় পঞ্চাশজন সৈন্য। পঞ্চাশজন বন্দুকধারীর সামনে দাঁড়ালে পঁচিশজনকে পড়তে হবে যার-পর-নাই বেকায়দায়—এই ছিল তাঁর ধ্রুবধারণা।
অপরাহ্ন কাল।
খাঁড়ির বাঁকের মুখে আচম্বিতে দেখা গেল, দুখানা জাহাজের মাস্তুলের চূড়া।
বোম্বেটে জাহাজের প্রহরী চেঁচিয়ে উঠে বললে, ‘হুঁশিয়ার! দুখানা জাহাজ আসছে!’
লাফ মেরে পাটাতনের উপরে উঠে কালোদেড়ে এক নজরে যা দেখবার সব দেখে নিয়ে বললে, ‘হুঁ, রাজার অভিযান! কিন্তু আমার এখানে আসার মজাটা ওদের ভালো করেই টের পাইয়ে দেব। বাছারা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ তো দেখেনি!’ সে তখনও জানত না তার ফাঁদ আছে মেনার্ডের নখদর্পণে!
রাজার জাহাজ কাছে এসে পড়ল।
কালোদেড়ে হাঁকলে, ‘কে তোমরা?’
মেনার্ড উত্তরে ধীর স্বরে বললেন, ‘টের পাবে অবিলম্বেই।’
তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টি চালনা করে বুঝলেন যে, বোম্বেটেদের জাহাজখানা আকারে তাঁদের চেয়ে বিশেষ বড় না হলেও ওর মধ্যে নিশ্চয়ই গাদাগাদি করা আছে কামানের পর কামান। ওখানাও এমন হালকা ভাবে তৈরি যে এই বিপদসংকুল অগভীর জলেও অনায়াসেই আনাগোনা করতে পারে।
ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন মেনার্ড। ওদের পোতপার্শ্বের কামানগুলোর দারুণ অগ্নিবৃষ্টিতে মুষড়ে পড়লে চলবে না, তাঁকে একেবারে বোম্বেটে-জাহাজের পাশাপাশি গিয়ে পড়ে মুষলধারে গুলিবৃষ্টি করে প্রথমেই শত্রুদের রীতিমতো অভিভূত করে ফেলতে হবে। সৈন্য ও বন্দুকের সংখাধিক্যের উপরেই তাঁর প্রধান ভরসা।
কিন্তু জলে এখন ভাটার টান, সময়টা এখানকার যুদ্ধের পক্ষে উপযোগী নয়। জোয়ারের জন্যে কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে—এই স্থির করে মেনার্ড আজকের মতো নোঙর ফেলবার হুকুম দিলেন।
সেদিন রাতে বারে বারে মাতাল কালোদেড়ে পাটাতনের উপরে ছুটে এসেছিল এবং ভয়ানক গলাবাজি করে জানিয়েছিল—’ওরে রাজার চাকরগুলো, কাল প্রভাতি খানার সময় তোদের সকলকেই হতে হবে আমার শখের জলখাবার!’
মেনার্ড একবার খেপে গিয়ে উত্তরে বলেছিলেন, ‘ওরে শুয়োর, শোন! তোর ওই নোংরা উকুনভরা কালো দাড়িতে পেরেক মেরে তোকে আমার জাহাজের গায়ে লটকে দেব—এই আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা!’
রাজার জাহাজে নোঙর ফেলা হচ্ছে দেখে কালোদেড়ে আন্দাজে বুঝে নিলে যে, আপাতত বোম্বেটেরা নিরাপদ, কারণ সুচতুর শত্রুরা ভাটার সময়ে অগভীর জলে জাহাজ চালিয়ে বিপদে পড়তে চায় না। সকালে জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গেই শত্রুপক্ষের আক্রমণ শুরু হবে।
সে একজন বোম্বেটেকে কাছে ডেকে এনে, একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে তার চোখের কাছে নাড়তে নাড়তে ফিশফিশ করে বললে, ‘ওরে মুখ্যু, ভালো করে শুনে রাখ! যদি দেখিস আমরা হেরে যাচ্ছি আর রাজার সেপাইরা আমাদের জাহাজের উপরে উঠে পড়েছে, তখনই দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে আমাদের বারুদখানায় আগুন লাগিয়ে দিবি! তারপর কী মজা হবে জানিস তো? দড়াম করে এক দুনিয়া-কাঁপানো ধুন্ধুমারের সঙ্গে সঙ্গেই আমরা সবাই মিলে সরাসরি গিয়ে নরক গুলজার করে তুলব! কী রে, পারবি তো?’
এই ভয়ানক প্রস্তাব শুনে বোম্বেটে বাবাজির আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম! মুখরক্ষা করবার জন্যে তবু সে কোনওরকমে মাথা নেড়ে সায় দিলে।
কালোদেড়ে বললে, ‘যা তবে! বারুদখানায় গিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাক! কাল এসপার কি ওসপার!’
বোম্বেটে দুরুদুরু বুকে কাঁপতে কাঁপতে প্রস্থান করল।
চাঁদ উঠল। জ্যোৎস্না ফুটল। মদে শুকনো গলা ভিজয়ে নেওয়ার জন্যে কালোদেড়ে নিজের কামরার দিকে ছুটল এবং যেতে যেতে আর একবার গর্জিত কণ্ঠে জানিয়ে দিয়ে গেল যে—’ওরে রাজার দাসানুদাসের দল! শুনে রাখ তোরা! রাত পোয়ালেই আমি তোদের হাড় খাব, মাস খাব আর চামড়া নিয়ে ডুগডুগি বাজাব—হা হা হা হা হা হা !’