নয়নাগিরি অভিযান – ৯

নয়

ও সি বলরাম ত্রিবেদী সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, ও শয়তান ডিসুজা যব তক জিয়েগা তব তক সবকো জ্বালায়গা। বহুত খতরনক ও আদমি। পুলিশকো ভি ট্রাবল দেতা। আদমি কো ভি। ঠিক হ্যায়…। বলে এস আইকে বললেন, যাও মকান সার্চ করো। জলদি যাও। লেকিন…।

ডরো মাত।

এস আইকে তবুও ইতস্তত করতে দেখে ত্রিবেদী দারুণ রেগে গেলেন। তারপর নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সমঝ গিয়া। ম্যায় যা রহা হুঁ।

এস আই বললেন, হামকো গলদ মাত সমঝিয়ে স্যার। ও হামরা ডিপার্টমেন্ট কা এক বড়া অফিসার থা

লেকিন আভি ও এক মোস্ট অর্ডিনারি ক্রিমিনাল।

এস আই মাথা হেঁট করলেন।

ত্রিবেদী বললেন, চলুন। দেখি কোথায় ওরা আপনাদের ছেলেকে আটকে রেখেছে।

পুলিশের গাড়ি ঝড়ের বেগে ছুটে চলল রাজপথ ধরে। গৌতম সঙ্গে থাকলেও সে বুঝতে পারল না কোথা দিয়ে এবং কীভাবে ওরা পৌঁছে গেল সেই গলির মুখে।

একদল পুলিশ সহ মি. ত্রিবেদী, সত্যবাবু ও গৌতমকে সঙ্গে নিয়ে সেই কুখ্যাত বাড়িটার কাছে এসে হাজির হল।

বাড়ির দরজায় নক করতেই এক বৃদ্ধ চাকর এসে দরজা খুলে দিল।

ঘরের ভেতর ঢুকতেই সকলে দেখল দানবাকৃতি এক মধ্যবয়সি ভারিক্কি চেহারার লোক দু’জন বন্ধুর সঙ্গে তাস খেলছেন। ত্রিবেদীকে দেখেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আরে ত্রিবেদীজি। আপ খুদ চলে আয়ে মেরে গরিবখানে পর? আইয়ে আইয়ে বয়ঠিয়ে।

ত্রিবেদী বললেন, আমি এখানে বসবার জন্য আসিনি মি. ডিসুজা। আমি জানতে এসেছি আপনি আপনার ওই নোংরা ব্যবসাটা এবার বন্ধ করবেন কি না? ডিসুজা হো হো করে হেসে বললেন, ত্রিবেদীসাব, আপ তো কানুন কা ধর্মাবতার। লেকিন ইতনা কলঙ্ক মুঝ পর মাত দিজিয়ে।

গৌতম বলল, কলঙ্ক তো আপনি নিজেই নিজের গায়ে মাখছেন মশাই। আমার এক বন্ধুকে আপনার লোকেরা নিয়ে এসে লুকিয়ে রেখেছে এখানে। তা ছাড়া আপনার দুই সাগরেদ শংকর আর দয়ালদার মুখে শুনেছি কয়েকটি ছেলেমেয়েকেও আটকে রেখেছেন আপনার এই বাংলোতে।

ডিসুজা এবার চোখ লাল করে বললেন, শয়তান কা বাচ্চা। অ্যায়শা কাম ম্যায় নেহি করতা। তেরা দোস্ত ইধার চোরি করনে আয়া তো মার মারকে উসকো জাহান্নমমে ভেজ দিয়া। বলে ত্রিবেদীকে বললেন, আপ অন্দর যাইয়ে। সার্চ করকে দেখিয়ে। লেকিন এক বাত। ফির কভি অচানক আকে হামকো ডিসটার্ব মাত কর না, সমঝা?

ত্রিবেদী বললেন, মি. ডিসুজা, আপনার এখানে সার্চ করে আমি যে কিছুই পাব না তা আমি জানি। তবু অভিযোগের ভিত্তিতে এখানে এসেছি। তবে একটা কথা মনে রাখবেন এখন কিন্তু আপনি আর এস পি নন। নিজের দোষে নিজের নাম সরকারি ব্ল্যাক লিস্টে উঠিয়ে সাসপেন্ড হয়ে বসে আছেন। আজ যারা আপনাকে মদত দিচ্ছে— এতটুকু স্বার্থে ঘা লাগলে কাল কিন্তু তারাই আপনাকে ব্ল্যাকমেল করবে। আর সেদিন আমি নিজে এসে আপনার হাতে হাতকড়া পরাব। এবং সেদিনেরও খুব বেশি দেরি নেই। আচ্ছা গুড বাই। বলে সকলকে বললেন, চলুন।

সত্যবাবু বললেন, একবার একটু খুঁজে দেখবেন না ছেলেটাকে যদি কোথাও লুকিয়ে রেখে থাকে?

কী লাভ? ও এখানে নেই। যেভাবেই হোক আমার আসার খবর পেয়ে পাচার করে দিয়েছে ছেলেটাকে। সেই সঙ্গে অন্য মেয়েদেরও। দেখছেন না উনি নিজের থেকেই জোর গলায় সার্চ করতে বলছেন।

এবার গৌতম বলল, আচ্ছা, নয়নাগিরিটা কোথায়?

ত্রিবেদী বললেন, নয়নাগিরি? ও নাম তো কখনও শুনিনি।

ওদের মুখে শুনেছি ওরা ওইখানেই সকলকে পাচার করে। সেখান থেকেই যা হবার হয়।

তা হলে অন্য কোনও স্টেটে। বিহারে নয়। তবে নামটা যখন কানে এসেছে তখন খোঁজখবর আমি নেবই।

সত্যবাবু বললেন, আপনি বাঙালি স্যার?

হ্যাঁ। অবশ্য বাংলার বাঙালি নই। প্রবাসী বাঙালি। আমার দেশ ছিল পূর্ববঙ্গে। যশোর জেলায়।

ছেলেটার ব্যাপারে তা হলে কী হবে?

চেষ্টা করব। ওরা নিজেরাই যখন ওদের ফাঁদে পা দিয়েছে, তখন ফল ভোগ করতেই হবে। ডিসুজা তো বলেই দিল জাহান্নমে পাঠিয়ে দিয়েছে। তা ওর জাহান্নম নয়নাগিরিও হতে পারে, আবার বুকে পাথর বাঁধা অবস্থায় গঙ্গার নীচেটাও হতে পারে। ছেলেটাকে আদৌ বাঁচিয়ে রেখেছে কিনা তাই বা কে জানে? এক এক সময় মনে হয় গুপ্তঘাতক দিয়ে মেরে ফেলি শয়তানটাকে। কিন্তু ওর সার্কেলটা এমনই যে, সব জেনেশুনেও আমরা অসহায়। আমিও ফ্যামিলিম্যান তো?

গৌতম বলল, আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না? মহেন্দুঘাটের বস্তিতে ভোজপুরী লোকদুটিকে ঢুকতে দেখেছিলাম, মানে যারা গোপাকে নিয়ে পালাচ্ছিল বা যাদের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিল গোপা। সেই লোকদুটোকে মোচড় দিয়ে কোনও কথা আদায় করা যায় না?

ত্রিবেদী বললেন, হ্যাঁ। সেটা অবশ্য করা যায়। চলো তো দেখি।

ওরা মহেন্দুঘাটে এসে যখন পৌঁছল তখন নিস্তব্ধ চারদিক। কেউ কোথাও নেই। একে তো শীতকাল। তায় রাতও গভীর। সবাই ঘরের ভেতর দরজা জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে যে যার।

তারই মধ্যে পুলিশ নিয়ে ঠিক জায়গায় গিয়ে হাজির হল গৌতম। কিন্তু হলে কী হবে? বাড়ি ঠিক করতে পারল না।

ত্রিবেদী নিজেই এবার চিৎকার করে উঠলেন, পুলিশ পুলিশ। তারপর ঢিসুম ডুসুম করে দুটো বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করালেন একজন কনস্টেবলকে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। বেশ কয়েকজন লোক কাঁচা ঘুম ভেঙে ঘর থেকে বেরিয়ে এল বাইরে। তাদের সঙ্গে সেই ভোজপুরী দুটোকেও দেখা গেল।

গৌতম দেখেই চিনতে পারল তাদের। বলল, ওই তো। ওই সেই লোকদুটো। পুলিশ দেখেই ওরা ছুটতে গেল।

ত্রিবেদী হুংকার দিলেন, হল্ট।

একজন থামল আর একজন যেই পালাতে গেল ত্রিবেদী বললেন, ফায়ার। কনস্টেবলরা গুলি করল।

গুলি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল লোকটি।

যে লোকটি ধরা দিল ত্রিবেদী তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে বললেন, ক্যা নাম তুমহারা।

মেরা নাম যজ্ঞেশ্বর।

সামকো তুম ও লেড়কিকো কাঁহা লেকে ভাগা?

বাবু, মেরা বাত তো শুনিয়ে…।

ঠাস করে গালে একটা চড়।

কতদিন করছ এইসব নোংরা কাজ? কিতনা রুপিয়া মিলতা তুমকো?

রুপিয়া নেহি মিলতা বাবু। ও ডিসুজা সাব কা আদমি শংকরবাবু শোনপুরমে ভেজা থা। হাম দোনো ভাই মিল কর গিয়া। শংকরবাবুকা বাত নেহি শুননেসে ও হামকো বস্তিসে নিকাল দেগা।

শোনপুরে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?

নেহি গিয়া সাব। ও লেড়কি অচানক পানিমে কুদ পড়ি তো হাম বাপস আয়ি। শোনপুরকা পতা?

ও তো মুঝে মালুম নেহি। শংকরজিনে কহা থা তুম স্টেশন পর চলা যাও, হুঁয়া আদমি মিলেগা।

ওই আদমিকে তুমি চেনো?

জি সাব।

কী নাম?

নাম নেহি মালুম। লেকিন ম্যায়নে বহুত দফে দেখা উনকো।

তোমরা কি আজ শুধু মেয়েই পাচার করছিলে? না কোনও ছেলেও পাচার করেছ?

ম্যায়নে তো এক আধা মুর্দা লেড়কা কো হাই ড্রেনমে ফিক দিয়া। ও মাই গড। কাঁহা পর?

চলিয়ে ম্যায় দিখাতা হুঁ!

যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে সকলেই চলল হাই ড্রেনের দিকে। গৌতম তখন কেঁদে ফেলেছে। বাড়ি ফিরে কী বলবে ওর মাকে? অর্ধমৃত পল্টন হাইড্রেনের অন্ধকূপে বিষাক্ত গ্যাসে এতক্ষণে মরেই গেছে হয়তো।

সত্যবাবুর চোখে জল। কী থেকে কী হয়ে গেল। সংকট এমনই একটা দিকে মোড় নিয়েছে যে মৃত্যুপথযাত্রী বাবার কাছে মুখে একটু জল দেবার জন্যও থাকবার উপায় নেই।

হাইড্রেনের কাছে গিয়ে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে যজ্ঞেশ্বর বলল, এর্হি পর ফিক দিয়া ও লেড়কাকো।

পুলিশ নাকে রুমাল চাপা দিয়ে টর্চের আলো ফেলেও ভেতরে পাঁক আর নোংরা জল ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। পল্টনের কোনও অস্তিত্বই সেখানে নেই।

সত্যবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কতক্ষণ আগে ফেলেছ তোমরা ছেলেটাকে? এক-দেড় ঘণ্টা পহলে।

ত্রিবেদী হতাশ হয়ে বললেন, চলুন থানায় চলুন। ও ছেলের আশা ছেড়ে দিন। কাল সকালের আগে আর কিছু হবে না। সকালবেলা ভেতরে লোক নামিয়ে চেষ্টা করব ডেড বডিটা উদ্ধার করবার।

পুলিশের গাড়িতে চেপেই ফিরে এলেন সকলে।

এস আই সত্যবাবুকে বললেন, আপ ঘর চলা যাইয়ে। আপকা পিতাজিক৷ নিধন হো গিয়া।

শিশুর মতন ডুকরে কেঁদে উঠলেন সত্যবাবু, বাবা নেই!

না। আভি খবর আয়া। সবেরে আদমি লেকে হসপিটাল চলা আইয়ে। ডেড বডি মিল যায়ে গা।

সত্যবাবুর চোখের সামনে সমস্ত চরাচরটা যেন দুলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে গৌতমকে নিয়ে একটা অটোয় করে চলে এলেন কদমকুঁয়ায়।

এরই মধ্যে সত্যবাবু অসম্ভব রকমের শক্ত করে নিলেন নিজেকে। গৌতমকে বললেন, শোনো, হাতে আর আধঘণ্টা সময় আছে। তুমি এখুনি গোপাকে নিয়ে চলে যাও এখান থেকে।

অসম্ভব। আপনি কী বলছেন কাকুমণি!

ঠিকই বলছি বাবা। পল্টনের নিয়তি ওকে কোথায় টেনে নিয়ে গেছে জানি না। মেয়েটাও যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। আর এতটুকু রিস্ক নিতে আমি চাইছি না। গোপাও ছুটে এসেছে তখন। সে করুণভাবে বলল, এই সময় আমাদের চলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

যাবার এই তো সময় মা। আর একটু পরেই আমাদের এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। এখন আমাদের শোকতাপ কান্নাকাটির পালা। সারাদিন আমরা বাবার শেষকৃত্য নিয়ে মেতে থাকব। ওই সময় তোমাদের দেখাশোনা করবে কে? আমাদের দেখবার লোকের অভাব হবে না। তোমরা এই বিশ্রী পরিবেশ থেকে সরে যাও। তা ছাড়া বলা যায় না ইতিমধ্যে আবার কী অঘটন ঘটে। বলে মানিব্যাগ বার করে দুটো একশো টাকার নোট গৌতমের হাতে দিয়ে বললেন, গোপাকে একা ছাড়তে সাহস পাচ্ছি না, তাই তোমাকে পাঠালাম। নিজের বোনের মতো সঙ্গে করে নিয়ে যেয়ো। তা ছাড়া এই পরিবেশে তোমারও থাকা চলে না। তুমি কাশীতে ওদের বাড়ি দু’-চারদিন থাকো। আমি তোমার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলে নেব। যাতে তিনি গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসেন সেইরকম ব্যবস্থাই করব। পল্টনের জন্য দুঃখ কোরো না। ওইরকম দুর্ভাগ্য তোমারও হতে পারত।

গৌতম ও গোপা প্রণাম করতে গেল সত্যবাবুকে। উনি বললেন, আমার অশৌচ অবস্থা। এ সময় আমাকে প্রণাম করতে নেই।

ওরা বাবলিদির সঙ্গে দেখা করতে গেল। কিন্তু বাবলিদি তখন আর প্রকৃতিস্থ নেই। কাকিমাকে জড়িয়ে ধরে ফুলে ফুলে কাঁদছেন বাবলিদি। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো দেহটা যেন ওঠা-নামা করছে।

গোপা আর গৌতম স্তব্ধ হয়ে গেল।

ওদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা জামাকাপড়ের ব্যাগ ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিসপত্তর সব দরিয়াপুরে কাকুমণির বাড়িতেই রয়ে গেছে। তা থাক। জিনিসপত্তরের চেয়ে নিরাপত্তা বড়। ওরা আর বিলম্ব না করে বড় রাস্তায় এসে দাঁড়াল।

কাকুমণির সেই ছাত্রটি যে ওদের টাকা দিয়েছিল সে-ই তৎপর হয়ে অটোর ব্যবস্থা করে দিল।

গৌতম বলল, তোমার কাছে আমরা দুই বন্ধু ঋণী রয়ে গেলাম।

কী জন্য ভাই? ওই টাকাটার ব্যাপারে?

ঠিক তাই। আমাদের সব কিছুই তো কাকুমণির বাড়িতে।

ওর জন্যে তোমরা চিন্তা কোরো না। বিদেশে বিভুঁয়ে এরকম হতেই পারে। এখন তোমরা নিরাপদে নির্বিঘ্নে পৌঁছলে আমরা সবচেয়ে বেশি খুশি হব। ওখানে গিয়েই কিন্তু পৌঁছনো সংবাদ দিয়ো।

গৌতম বলল, কীভাবে দেব?

আমাদের বাড়ি ফোন আছে।

গোপা বলল, আমার মা জানেন। উনি তো মাঝে মাঝে ফোন করেন কাকুমণিকে। ফোনেই খবর দেব আমি। আপনারা একটু দেখবেন দাদুভাইয়ের শেষকাজটা যাতে ভালভাবে হয়।

গৌতম বলল, যেতে মন চাইছে না তবু যেতেই হবে।

থেকেই বা কী করবে? তার চেয়ে চলে যাওয়াই ভাল। এইরকম শোকতাপের পরিবেশে না-থাকাই উচিত।

গৌতম বলল, তা ছাড়া গোপাকে তো আর এখানে রাখা ঠিক নয়। হারানিধি যখন একবার ফিরে পাওয়া গেছে, তখন ওকে ওর মায়ের কাছেই পৌঁছে দিতে হবে।

আমি কি স্টেশন পর্যন্ত যাব তোমাদের সঙ্গে?

গোপা বলল, কোনও দরকার নেই। আপনি বরং কাকুমণিকে দেখুন। বাবলিদি যাতে নির্বিঘ্নে শ্বশুরবাড়ি যেতে পারেন সেই ব্যবস্থা করুন। অটো স্টার্ট নিল।

ওরা হাত নেড়ে টা টা করে বিদায় জানাল।

অটো এ-পথ, সে-পথ করে ফাঁকা রাস্তায় ছুটে চলল স্টেশনের দিকে।

বেশ খানিকটা এসেছে এমন সময় হঠাৎ বুঝতে পারল একটা স্কুটার ভয়ংকর গতিতে এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। তাই না দেখে তো, ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল ওদের।

সর্বনাশ। দুর্ঘটনা ঘটবে না তো?

গৌতম অটো ড্রাইভারকে বলল, মেহেরবানি করকে জেরা হুঁশিয়ারিসে চালাইয়ে ভাই।

কুছ নেহি হোগা।

উধার দেখিয়ে।

স্কুটারটা তখন আরও কাছে এগিয়ে আসছে। একেবারে মুখোমুখি। তবে ধাক্কাটাক্কা না দিয়েই পাশ কাটিয়ে সোঁ করে বেরিয়ে গেল সেটা।

তারই মধ্যে আরোহীকে দেখে চমক উঠল গৌতম। সেই ভীষণ দানবাকৃতি শয়তানটা। যে ওদের রিকশায় ধাক্কা দিয়ে পালিয়েছিল।

গৌতম বলল, আবার বোধহয় আমরা একটা জালে জড়াতে যাচ্ছি। কীরকম।

ওই স্কুটারই আমাদের ধাক্কা দিয়েছিল কাল বিকেলে কদমকুঁয়ায় যাবার পথে। এখন আবার আমাদের টার্গেট করছে।

সে কী! তা হলে তো ভয়ানক ব্যাপার? আবার কী আমরা ওদের খপ্পরে পড়ে গেলাম?

মনে হচ্ছে তাই।

কী হবে তা হলে?

জানি না। এখন তোমাকে নিয়েই আমার ভয়।

গোপা সভয়ে জড়িয়ে ধরল গৌতমকে। দু’ চোখ বুজে ওর কোলে মুখ লুকল।

গৌতম বলল, ভয় পেয়ো না। এই সময় অসীম ধৈর্য এবং সাহস সঞ্চয় করতে না পারলে সমূহ বিপদ। ওরা যে ভাবেই হোক টের পেয়ে গেছে আমরা পালাচ্ছি বলে।

কিন্তু কীভাবে পেল?

হয়তো বা ওদের কোনও চর ঘুরঘুর করছিল আমাদের আশপাশে।

ওই ওই আসছে। আবার আসছে।

সত্যিই এল। সেই দানব আবার ধেয়ে এল ওদের দিকে। এবং পাশ কাটিয়ে চলেও গেল।

ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলল, দুশমন হামকো টার্গেট করতা কিউ?

গৌতম বলল, ওর টার্গেট তুমি নও। আমরা।

সঙ্গে সঙ্গে অটো থামাল ড্রাইভার। বলল, উতারো।

গৌতম ভয় পেয়ে বলল, এই আধোঅন্ধকারে নির্জন পথে তুমি আমাদের নামিয়ে দেবে?

হ্যাঁ। ওই লোকের টার্গেট যখন তোমরা, তখন হামকো ছোড় দিজিয়ে। ওর সঙ্গে দুশমনি আমি করব না। ও অ্যাকসিডেন্ট করেগা তো হামারা গাড়ি টুট যায়েগা।

কিন্তু এইভাবে বাঘের মুখে ছেড়ে দিলে ও আমাদের মেরে ফেলবে যে।

তুমহারা বদনসিবমে যে হোগা ও-তো হোগাই।

স্কুটার তখন আবার সজোরে ছুটে এসেছে এদের দিকে।

অটো থেকে ওরা তখন নেমে পড়েছে। না-নামা ছাড়া উপায়ই বা কী? যতক্ষণ ওর খোশামোদ করবে ততক্ষণ আত্মরক্ষার অন্য কোনও উপায় ঠিক করে নেবে।

ওরা নামতেই স্কুটার এসে থামল ওদের পাশে।

নেলো বলল, কী হল, গাড়ি খারাপ হয়ে গেল নাকি?

গোপা-গৌতমের মুখে কথা নেই।

ড্রাইভার অটো নিয়ে পালাচ্ছিল। নেলো ঘুরে গিয়ে ধরল তাকে। একেবারে অটোর সামনে এমনভাবে স্কুটারটাকে নিয়ে গেল যে আর এগোতে পারল না সে।

নেলো স্কুটার থেকে নেমে এসে ড্রাইভারকে বলল, কাঁহা ভাগতা তুম? ড্রাইভার বলল, ও সব ঝুট ঝামেলাকি কাম হামি না করবে নেলোদাদা। ইসি লিয়ে নিকাল দিয়া দোনো কো। আভি তুম সামালো। ও লড়কা কিসিকা লেড়কি লেকে ভাতা কৌন জানে?

নেলো তখন ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিয়েছে ড্রাইভারের গালে। ড্রাইভার গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, মেরা ক্যা কসুর?

উঠাও উসকো। কাঁহা যা রহে ও?

স্টেশন পর।

লে চলো।

কিন্তু কাদের নিয়ে যাবে?

গৌতম ও গোপা তখন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে।

কালো রাত শেষ হয়ে এলেও আলোর আভাস নেই। স্ট্রিট লাইট এবং অন্যান্য যানবাহনের আলোয় পিচ ঢালা পথ যেন অজগরের পিঠ। তারই ওপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে দু’জনে। গৌতম একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে গোপার। মাঝে মাঝে পিছু ফিরে দেখছে।

অটো আর স্কুটার দুটোই ওদের অনুসরণ করল।

ওরা কোনদিকে যাবে, কোথায় যে লুকোবে, কিছু ঠিক করতে পারল না। নেলো স্কুটার নিয়ে ওদের সামনে এসে পথ রোধ করল। থমকে দাঁড়াল ওরা।

নেলো বলল, পালাচ্ছ কেন তোমরা? এইভাবে ছুটে হেঁটে কি স্টেশনে যাওয়া যায়?

গৌতম বলল, পালাচ্ছি তার কারণ আছে। কাল বিকেলে তুমিই-না আমাদের রিকশাতে ধাক্কা দিয়েছিলে?

হ্যা দিয়েছিলাম। তখন অন্য একটা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এখন আর প্রয়োজন নেই তার। তখন ভেবেছিলাম আমার দোষটা অন্যের ঘাড়ে চাপাতে পারব। কিন্তু এখন দেখছি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গেছে। তা ছাড়া তোমাদের ওপর তো আমার কোনও রাগ নেই। তাই অযথা তোমাদের কষ্ট দিতে চাই না। গফুর আমার দীর্ঘদিনের শত্রু। ওর সমুচিত শিক্ষা তোমরা দিয়েছ। আমিও ওকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি। এখন নির্ভয়ে তোমরা স্টেশনে চলে যাও।

সেই অটো ওদের কাছে এসে বলল, উঠিয়ে

গোপা দু’হাতে গৌতমকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে লাগল থরথর করে। বলল, না উঠো না গৌতম। এসবই এদের ছলচাতুরি।

নেলো বলল, ভয় নেই। আমি তোমাদের ক্ষতি করব না। ওঠো। এমন সময় স্টেশনে যাচ্ছ যখন নিশ্চয়ই তোমরা পঞ্জাব মেল ধরবে? তাড়াতাড়ি যাও। গোপা বলল, না না না।

গৌতম বলল, তুমি যা বলছ তা যদি সত্যি হয়। তবুও যে তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না ভাই।

আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না। তবে তোমাদের মতো বীরকে আমি খুব শ্রদ্ধা করি।

তোমার মনে কোনও মতলব না থাকলে এই শেষরাতে তুমি আমাদের পিছু নিলে কেন?

আমার মনে মতলব থাকলে এতক্ষণে আমি আমার কাজ করেই ফেলতাম। আসলে কাল বিকেলে আমি যেমন দুর্ঘটনা ঘটাতে চেয়েছিলাম, এখন আমি তার উলটোটাই করছি। এখন তোমাদের বডি গার্ড হয়ে এসেছি।

গোপার চোখে জল। বলল, মিথ্যে কথা।

গৌতম বলল, হঠাৎ এই পরিবর্তনের কারণ?

কারণ একটাই, গফুরের সামনে যারা বুকফুলিয়ে রুখে দাঁড়ায় তারা আমার সত্যিকারের দোস্ত। তোমরা ওর কান কাটলে, আর আমি তোমাদের প্রাণ নেব? তা ছাড়া আমি জানি তোমরা পালাতে গেলেই ডিসুজার লোক তোমাদের পিছু নেবে। হয়তো গুলি চালাবে। তাই সেসব কিছু যাতে না হয়, সেইজন্য আমি তোমাদের পিছু নিয়েছি। না হলে তো কখন ধাক্কা মেরে উলটে দিতাম অটোটা। নাও তাড়াতাড়ি করো।

গৌতম বলল, ডিসুজার লোক কি আমাদের পিছু নিয়েছে?

চোখে তো পড়েনি। বলেই রিভলভার বার করে বলল, এই দেখো, আমি একেবারে তৈরি হয়েই বেরিয়েছি। এই ডিসুজা শয়তানটা আমার পথের কাঁটা। আর ওর ওই চামচা দুটো। ওদের মেরে আমি গাড়োয়ালের দিকে পালাব। এখন তোমরা পালাও।

গোপা ও গৌতম অটোয় বসল।

নেলো ড্রাইভারকে বলল, এদের কাছ থেকে ভাড়া নেবে না।

নেহি লেগা।

এতক্ষণ এদের সঙ্গে আমার কী কথাবার্তা হল কিছু শুনলে?

কুছ না শুনেছি আমি।

ভেরি গুড। যদি কিছু শুনে থাক তা হলে—। বলেই রিভলভার দেখাল ড্রাইভারকে।

ড্রাইভার ভয়ে চোখ বুজল।

আ আবার চলতে শুরু করলে নেলো সেই একইভাবে ওদের অনুসরণ করল। তারপর স্টেশন এলাকায় এসে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে কেটে পড়ল সে।

ওরা অটো থেকে নামতেই ভাড়া না-নিয়ে পালাল অটোওয়ালা। ওরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

গোপা প্রায়ই আসা-যাওয়া করে, তাই লেডিজ কাউন্টার চেনে। গৌতমের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছুটে গিয়ে দুটো টিকিট করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল।

ট্রেন তখন এসে ছেড়ে যাবার সময় হয়েছে। খুব একটা ভিড় ছিল না তাই রক্ষে। ওরা ট্রেনে উঠে একটু বসবারও জায়গা পেয়ে গেল।

ট্রেন ছুটে চলল ঝড়ের বেগে।

অন্ধকার দূর হয়ে তখন একটু একটু করে ফর্সা হচ্ছে আকাশটা।

গোপা মনে মনে নেলোর ব্যাপারে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও, গৌতমের কিন্তু বারবার মনে পড়তে লাগল পল্টনের কথা। ওর মায়ের মুখখানিও চোখের সামনে ফুটে উঠল। এই মর্মান্তিক সংবাদ পেলে ওর মা নিশ্চয়ই আছাড়কাছাড় করে কাঁদবেন। দিদিরাও। আর বৃদ্ধ কাকামণি ইলাহাবাদ থেকে ফিরে এসে যখন শুনবেন এই খবরটা, তখন কী যে করবেন তা কি ভাবা যায়? অথচ নাটকের দৃশ্যের মতো পরপর ঘটনাগুলো এমনভাবে ঘটে গেল যে, ওরা যেন নীরব দর্শক। গৌতমের মা-বাবাই বা কীভাবে নেবেন ব্যাপারটা তাই বা কে জানে? বাবা কি সত্যি সত্যিই ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কাশীতে ছুটে আসবেন? এইসব কত কীর কথা চিন্তা করতে করতে দু’চোখ বুজে এল গৌতমের। সারাটা দিন দুপুর, রাত্রিতে এতটুকু শোয়াবসার সময় পায়নি। তাই যত রাজ্যের ঘুম নেমে এল দু’চোখ জুড়ে।

গোপাও বসে বসে ঢুলতে লাগল।

এবারে পল্টনের কথায় আসা যাক।

গৌতম তো ওদের খপ্পর থেকে কোনওরকমে পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু পল্টন বেচারি ধরা পড়ে গেল শয়তানদের হাতে। আসলে মাথায় ইটটা না লাগলে ও ছোটা থামাত না। ইটটা লাগতেই ওর গা-মাথা কেমন যেন ঘুলিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ‘উঃ বাবারে’ করে বসে পড়ল। আর যেই না বসে পড়া, ওমনি ওরা এসে ধরে ফেলল ওকে।

এরপর পাঁজাকোলা করে ওকে ওরা তুলে নিয়ে গেল ডিসুজার বাংলোয়। শংকর আর দয়াল বলল, এই ছেলেটা আমাদের ফলো করছিল বস। ডিসুজা বলল, তাই নাকি! কে ছেলেটি?