নয়নাগিরি অভিযান – ৮

আট

অটো একেবারে বিয়েবাড়ির সামনে এসে থামল। নিমন্ত্রিতরা প্রায় সকলেই বিদায় নিয়েছে তখন। বরযাত্রীরা আছে। আছে কিছু পুলিশ। তবু যেন শ্মশানের নীরবতা। কারও মুখে কথাটি নেই।

ওরা যেতেই হই হই করে উঠল সকলে।

সত্যবাবু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। এসেই গোপাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের ভেতর। বললেন, তোকে যে আর কখনও ফিরে পাব ত! স্বপ্নেও ভাবিনি মা। কীভাবে কী হল শুনি? তারপরই হঠাৎ কী মনে পড়তে বললেন, পল্টন কোথায়? ওকে দেখছি না কেন?

গৌতম কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, গোপাকে উদ্ধার করার মধ্যে কোনও কৃতিত্ব নেই। শুধু ভাগ্যজোরে ফিরে পেয়েছি ওকে। তবে—। তবে কী !

পল্টনকে হারিয়েছি।

তার মানে?

পুলিশের লোকেরাও তখন হেঁকে ধরেছে গৌতমকে। সচ মুচ বতাইয়ে ক্যা হুয়া থা?

গৌতম বলল, এক মিনিট। মেয়েটাকে আগে যথাস্থানে রেখে আসি। তারপর সব বলছি।

গোপার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতেই ওপরে নিয়ে এল গৌতম।

শুভকার্য তখন সম্পন্ন হয়েছে।

বাসরঘর আলো করে বাবলিদি বসে আছেন। কাকিমাও ছিলেন আশপাশেই। গৌতম গোপাকে কাকিমার হাতে তুলে দিয়ে বলল, বহু কষ্টে গোপাকে ফিরিয়ে এনেছি কাকিমা। তবে পল্টনের খুব বিপদ। ও একেবারে শয়তানদের হাতে পড়ে গেছে। ওর খোঁজেই যাব এবার। গোপাকে সাবধানে রাখুন।

কাকিমা বললেন, সে কী! ওকে ফিরে পাব তো?

ভগবান জানেন। আমি আসছি। কাকুমণি নীচে আছেন।

গৌতম আর একটুও সময় নষ্ট না করে তরতর করে নীচে নেমে এল! তারপর ‘আগাগোড়া যা যা ব্যাপার ঘটেছিল সব খুলে বলল সকলকে। শুধু দুলালির ব্যাপারটাই যা চেপে গেল। এবং বলল না কীভাবে উদ্ধার করেছে গোপাকে। শুধু এইটুকুই বলল, তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসবার সময় হঠাৎ করে গঙ্গার ধারে অসহায় অবস্থায় আবিষ্কার করেছে গোপাকে।

গৌতমের কথা সকলে যেমন বিশ্বাস করল, তেমনি ভয় পেল ডিসুজার কথা শুনে।

কী ভাগ্যিস কাকুমণি জিজ্ঞেস করেননি, যে মেয়েটি চুড়িদার পরে উধাও হয়েছিল সে হঠাৎ ডুরে শাড়িটি পরে ফিরে এল কী করে?

পুলিশের যে এস আই এখানে ছিলেন তিনি সব শুনে বললেন, গফুরকে নেলোর দল খুন করবে এটা অবশ্য ভাবতে পারিনি। তবে আলোচনাটা যা শুনেছে এরা তাতে পরিষ্কার হয়ে গেছে একাজ নেলোই করেছে। এখন শংকর ও দয়ালদা নামের যে লোকটার কথা বলছে তাতে তো কেসটা আরও জটিল হয়ে গেল। বিশেষ করে ডিসুজার নাম শুনে তো নার্ভাস হয়ে পড়েছি। একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ হয়ে গেছে। ডিসুজা এই অঞ্চলের সন্ত্রাস এবং কুখ্যাত ব্যক্তি। শংকর এবং দয়ালের সঙ্গে ডিসুজার যোগাযোগ অপ্রত্যাশিত। কেন না এই দুই ক্রিমিনালকে হত্যা করবার জন্য একসময়ে ডিসুজা উঠেপড়ে লেগেছিলেন। অথচ এরই মধ্যে এমন জোট, ধারণার বাইরে। ডিসুজাকে চ্যালেঞ্জ করাও বুকের পাটার দরকার। শংকর আর দয়াল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত। মাঝেমধ্যে ভাল ভাল ছেলেমেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওদের ছবির কাজে লাগায়। কিন্তু ডিসুজার কাজ হল ছেলেমেয়ে বিদেশে পাচার করা। সেটা আরও বিপজ্জনক। এখন শংকর ও দয়াল ওর সঙ্গে হাত মেলালে তো রক্ষে নেই।

সত্যবাবু বললেন, গৌতমের সাক্ষ্য নিয়ে ডিসুজার বাড়ি সার্চ করতে আমাদের অসুবিধেটা কোথায়? ডিসুজার গায়ে হাত না-দেওয়া যায়, শংকর ও দয়ালকে তো অ্যারেস্ট করা যাতে পারে?’

পারে। কিন্তু ওদের জামিনে বেরিয়ে আসাটা আটকাবেন কী করে? শংকর কে জানেন?

কে?

এস আই সত্যবাবুর কানের কাছে মুখ এনে কী যেন বললেন।

সত্যবাবু চোখদুটো বড় বড় করে বললেন, ওরে বাবা!

তা হলেই বুঝছেন তো কোথাকার জল কোথায় গড়িয়েছে? ভাগ্যবিপর্যয়ে এই কালচক্রে জড়িয়ে পড়েছেন আপনারা। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়েছে। বিপদটা আপনাদের ক্ষেত্রেও যেমনি চরম, আমাদের ক্ষেত্রেও কম নয়। তা হলে কী হবে?

কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না। আপাতত থানায় চলুন। ও সি কী নির্দেশ দেন দেখি। তাই চলুন তা হলে।

দু’জনেই গাড়িতে উঠুন।

সত্যবাবু গৌতমকে নিয়ে ভ্যানে উঠলেন। পল্টনকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ঘোর সংশয় দেখা দিল সত্যবাবুর মনে। যেতে যেতেই উনি বললেন, ছুটোছুটি আর উত্তেজনায় তোমার তো কিছুই খাওয়া হল না বাবা। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

গৌতম বলল, অন্যদিন হলে খিদেয় পেট ছিঁড়ে যেত এতক্ষণে। আজ কিন্তু একটুও খিদে পায়নি। যা টেনশন যাচ্ছে। এতে কি খিদে পায়? তা অবশ্য ঠিক।

দাদুভাইকে কেমন দেখে এলেন?

ভাল নয়। শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি। এত দুর্যোগ সত্ত্বেও বাবলির বিয়েটা ভালয় ভালয় মিটে গেছে। সব চেয়ে বড় কথা গোপাকে তুমি ফিরিয়ে আনতে পেরেছ। তুমি যে আমার কী উপকার করেছ তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। ওকে ফিরে না পেলে ওর মাকে আমি কী কৈফিয়ত দিতাম? তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার মতো মুখও থাকত না আমার। ওই মেয়েটি ছাড়া ওর মায়ের কেউ নেই আর। একমাত্র মেয়ে। পরের মেয়ের দায়িত্ব যে কত, তা আজ বুঝলাম। তাই বলি বাব৷ যত কষ্টই হোক, ভোরের ট্রেনেই তুমি ওকে রেখে এসো ওর মায়ের কাছে। আমাকে দায়মুক্ত করো।

কিন্তু কাকুমণি, পল্টনের কোনও খোঁজখবর না-পেলে আমি কী করে যাব? ও যে এখন শত্রুর কবলে।

জানি। তবুও বলি, ঝামেলা যা কিছু তা গোপাকে নিয়েই। পল্টনকে নিয়ে নয়। তা ছাড়া শয়তানের ঘাঁটিটা যখন তুমি পুলিশকে বলে দিতে পেরেছ তখন ভয় কী? ও যদি বেঁচে থাকে তা হলে ওকে উদ্ধার আমরা করবই। কিন্তু মেয়েটাকে এক্ষুনি সরিয়ে না ফেললে নয়। তার কারণ শত্রুপক্ষ জানে মেয়েটা জলে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মরেছে। কিন্তু পুলিশ জেনে গেছে ওকে আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। তা হলেই বুঝতে পারছ তো ব্যাপারটা জানাজানি হতে খুব একটা দেরি হবে না। আর তখন হবে কী ওকে হয়তো এই শহর থেকেই বার করতে পারব না আমরা।

গৌতম বলল, বেশ, তাই করব। আপনি পল্টনের ব্যাপারটা দেখবেন তা হলে?

নিশ্চয়ই দেখব। ওকে না দেখলে রুদ্রদাকে আমি কৈফিয়ত দেব কী? তুমি ভোরের ট্রেনেই ওকে নিয়ে চলে যাও। তারপর ওইখান থেকে সোজা বাড়ি ফিরে যেয়ো। ইতিমধ্যে আমি বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমাদের বাড়িতে টেলিফোন আছে?

না। তবে আমাদের পাশের বাড়িতে আছে।

ফোন নম্বরটা মনে আছে তোমার?

হ্যাঁ। কাগজ দিন, লিখে দিচ্ছি।

সত্যবাবু একটা হিসেব লেখা কাগজ গৌতমের দিকে এগিয়ে দিলে তাইতে ফোন নম্বরটা লিখে দিল গৌতম। এরপর উৎকণ্ঠার নীরবতা। ভ্যান এসে থামল পুলিশের হেড কোয়ার্টারে।