সাত
সত্যবাবুর ছাত্রদের মধ্যে কাছাকাছি বাড়ি ছিল একজনের। সেসব শুনেটুনে পল্টন ও গৌতমকে নিয়ে গেল ওদের বাড়ি। তারপর নিজের প্যান্টজামা, সোয়েটার ইত্যাদি পল্টনকে পরতে দিল।
পল্টন বলল, তুমি যখন এতই করলে ভাই, তখন কিছু টাকার ব্যবস্থা আমাদের করে দাও। সঙ্গে রাখি। দাদুভাইকে যখন মহেন্দুঘাটের কাছাকাছি পাওয়া গেছে তখন ওরা নিশ্চয়ই গঙ্গার ওপারে পাচার করেছে গোপাকে।
হতে পারে। ওপারে ছাপরা জেলা। হয়তো বা শোনপুরের ভেতর দিয়ে পাচার করেছে উত্তরপ্রদেশে বা অন্য কোথাও। কিন্তু তোমরা দু’জনে এই অচেনা জায়গায় রাতদুপুরে ওদের খোঁজে যাবে নাকি?
ইচ্ছেটা তাই।
খুব সাবধান। মহেন্দ্রঘাটের এলাকাটা মোটেই ভাল নয়।
আমরা এমনভাবে যাব যাতে কেউ টেরও পাবে না।
কিন্তু তোমরা তো আদৌ চেনোই না জায়গাটা।
যদি নতুন করে তোমাদেরই কোনও বিপদ হয়?
খোঁজখবর করে যেতে গিয়ে
কী আর করা যাবে? তবু আমরা একটু চেষ্টা করে দেখি যদি কোনও ক্লু পাই। অর্থাৎ মেয়েটাকে ওরা ওইখান দিয়েই নিয়ে গেছে কি না বা যদিও নিয়ে গিয়ে থাকে তা হলে কীভাবে এবং ঠিক কতক্ষণ আগে—একটু জানবার চেষ্টা করি। ছেলেটি বলল, মাস্টারমশাই ফিরে এসে যদি জানতে চান তোমাদের কথা, তা হলে কী বলব?
সত্যি কথাই বলবে।
পল্টন ও গৌতম আর দেরি না করে কদমকুঁয়ার মোড় থেকে একটা রিকশা নিয়ে মহেন্দুঘাটে এল। আলোঝলমল পাটনা শহরের পথঘাট তখনও জমজমাট। ঘাটের কাছে একটি হনুমানমন্দিরে তখন ঢোল-খোল পিটিয়ে জোরে গানবাজনা হচ্ছে। এখানটা কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার। ওরা রিকশা থেকে নেমে চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে রাখতে লঞ্চঘাটের দোতলা কফি হাউসে উঠে এল। আর ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল ওরা।
প্রকাশ নামের সেই সুদর্শন যুবক তখন এক কোণে বসে এক সর্দারজির সঙ্গে চাপা গলায় কী যেন বলছে ফিসফিস করে আর কফি খাচ্ছে।
ওরা ইচ্ছে করেই সেদিকে না তাকানোর ভান করে ওদের দিকে পিছু হয়ে দু’কাপ কফির অর্ডার দিল।
এই শীতেও যেন গায়ে ঘাম দিচ্ছে ওদের।
এরই ফাঁকে ওরা আড়চোখে দেখে নিল প্রকাশের চেয়ারের পাশে মেঝেয় একটা অ্যাটাচি রাখা আছে।
পল্টন বলল, যে ভাবেই হোক ওই অ্যাটাচিটা ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতেই হবে।
গৌতম বলল, কী ভাবে নিবি?
পল্টন বলল, তোর কাছে কিছু টাকা রাখ। একটু পরেই আমরা দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয়ে আশপাশে কোথাও অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকব। তারপর ওরা যেই উঠে আসবে অমনি তুই একটা ল্যাং দিবি লোকটাকে। অথবা পড়ে যাওয়ার ভান করবি। সেই সুযোগে আমি ওটা ছিনিয়ে নিয়ে পালাব।
পারবি তো?
পারতেই হবে।
যদি ধরা পড়িস?
তা হলে ও নিশ্চয়ই আমাকে পুলিশে দেবে। আর পুলিশে দিলে, পুলিশকেই আমরা সব কথা খুলে বলব।
গৌতম বলল, আমার কাছে এখন সবচেয়ে রহস্যের ব্যাপার কী জানিস? কী?
এইরকম একজন অপরাধী একটি খুন, একটি আধা খুন এবং মেয়েচুরির মতো নোংরা কাজ করেও শহরের বুকে এমন প্রকাশ্য জায়গায় বসে আছে কী করে?
তার একমাত্র কারণ ও ধরেই নিয়েছে ওকে চেনা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। গফুরকে খুন করেছে ওদের পোষা গুন্ডা। দাদুভাইকে চলন্ত মোটর থেকে যেভাবে ফেলে দিয়েছে, তাতে ওরা ধরেই নিয়েছে সেই মহাপতনেই বৃদ্ধের মৃত্যু ঘটবে। আর গোপাকে অপরহরণ? ও তো শুধু নিয়েই এসেছে। তাকে নিয়ে গেছে অন্য লোক। ওর কাজ হয়তো শেষ। তা ছাড়া ওর চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে রীতিমতো ধনী লোকের ছেলে ও। কাজেই ওকে সন্দেহ করা বা ওর নাগাল পাওয়া একটা রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। টাকার পাহাড় দিয়ে ওর সমস্ত অপরাধ হয়তো ওর বাবা ঢেকে দেবে।
ওরা যখন এই সব আলোচনা করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ওরা দু’জনে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। সর্দারজি আর প্রকাশ।
পল্টন ও গৌতম সতর্ক হয়ে সরে দাঁড়াল অন্ধকার ঘেঁষে একপাশে।
ওপার থেকে একটি লঞ্চ এপারে আসছে। হয়তো ওরা পার হবে এই লঞ্চে। গৌতম বলল, এখনই আক্রমণ না করে ওদের পিছু নে পল্টন। লঞ্চে গেলে ওদের ফলো করতে অসুবিধা হবে না। মোটরে গেলেই বিপদ।
তবে ওরা লঞ্চ এপারে এলেও ধরবার জন্য এগোল না। গেটের কাছে থমকে দাঁড়াল।
দু’জন ভোজপুরী সভয়ে এগিয়ে এল ওদের দিকে। প্রকাশ বলল, সব ঠিক হ্যায়?
বহুত গড়বড় হো গয়া শংকরজি।
ক্যা হুয়া?
ও অচানক পানিমে কুদ পড়ি। ইম্পসিবল!
ইচ্ছা করকে কুদ পড়ি ও। লাফিয়ে পড়েছে।
তুমি টেলিফোন কিঁউ নেহি কিয়া?
ফোন নাম্বার তো মুঝে মালুম নেহি।
সর্দারজি বাংলায় বলল, আরে বাবা লঞ্চের কাউন্টারে গেলে তো এপারে রিং করে দিত। তা ছাড়া তোমরাও তো সঙ্গে সঙ্গে জলে লাফিয়ে পড়তে পারতে? আন্ধেরিমে কুছ মালুম নেহি হুয়া ও কীধার গিরে হুয়ে।
তুমহারে লিয়ে ইয়ে দশ হাজার রুপাইয়া হামারা লুকসান হো গিয়া। আব ম্যায় ক্যা করু?
ভোজপুরী দু’জন নীরব।
সর্দারজি বলল, শেঠকো এ রুপিয়া বাপস দে দো শংকরভাইয়া। আউর উধার নয়নাগিরিমে ফোন কর দো মাল নেহি পঁহুছেঙ্গে।
শংকর বলল, তুম এক কাম করো। রাতভর চক্কর লাগাও। ও ডেড বডি পুলিশকো নেহি মিলনা চাইয়ে।
সর্দারজি বলল, মিলনে সে ভি লুকসান ক্যা হোগা? দিস ইজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট। আমরা তো ওকে মার্ডার করে ফেলে দিইনি। কাজেই পুলিশি ঝামেলা কিছু হবে না।
আরে তুমি বুঝছ না কেন দয়ালদা, মার্ডার আমরা না করলেও কিডন্যাপ তো করেছি। এদিকে গফুরের কেসটা আমাদের ঘাড়ে চাপছে। ওকে মার্ডারই বা করল কে?
নেলোর দল, আবার কে? গফুরের জন্য মাথা তুলতে পারছিল না। এখন এই ব্যাপারটাতেও আমরা জড়িয়ে পড়লাম। পুলিশ ভাববে কোনও পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধ নিতেই বুঝি আমরা ওকে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছি। তার মানে দু’ দুটো মার্ডার কেস।
আর মেয়েগুলো কোথায়?
ডিসুজার বাংলোয় আছে। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ওদের। গফুরের খুনের ব্যাপারটা না ঘটলে আজই পাচার করে দিতাম। তবে ওদের পাচার করতে হবে মুখখোলা কফিনে পুরে ওষুধের ভ্যান গাড়িতে।
ওরা কথা বলতে বলতেই সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামল।
ওরা নেমে যাওয়ার পর পল্টন ও গৌতমও নেমে এল। ভোজপুরীদুটো গিয়ে ঢুকল একটা বস্তির খোলার ঘরে। গৌতম ও পল্টন ভিলেনদের পিছু নিল।
যেতে যেতে চাপা গলার কথাবার্তা শুনতে পেল ওরা। প্রকাশ ওরফে শংকর বলল, মেয়েটার ওপর অনেকদিন ধরেই নজর ছিল আমার। চমৎকার মেয়ে। বয়স কম। বেনারসে থাকে। লুকিয়ে ওর বাড়িও আমি দেখে এসেছি। কৃষ্ণমূর্তিজি যেমনটি চাইছিলেন ঠিক সেইরকম। বেনারসে সুবিধে করতে পারিনি। তাই এখানেই কতদিন ওত পেতেছিলাম। আজকেই মওকা মিলল। বাবার বিজনেস পার্টনারদের নিয়ে রুবি হাউসে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি মাস্টারজির বাবা মেয়েটিকে নিয়ে রিকশা খুঁজছেন। দুটো ছেলেও ছিল সঙ্গে। গফুরের কান কেটে দিয়ে যে ছেলেদুটো?
সম্ভবত। আমিও একটা টোপ ফেলে দেখলাম লাগে কি না। ভাগ্য ভাল। বঁড়শিতে মাছ গিথল। ওরা গাড়িতে উঠতেই আমি করলুম কী, রুবি হাউসে পার্টনাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ছোটালাম মহেন্দ্রঘাটের দিকে। বুড়োটা চেঁচিয়ে পুলিশ ডাকতে গেল। তাই দিলাম এক ঝটকায় গাড়ি থেকে ফেলে। মেয়েটাকে বললাম, খুব সাবধান। চেঁচালেই বিপদ হবে। তা মেয়েটা তখনকার মতো চুপ করে গেল। আমি ওকে সোজা নিয়ে গিয়ে তুললাম ডিসুজার বাংলোয়। ডিসুজা আগের মেয়েগুলোকে তখনও বাগে আনতে পারেনি। তার ওপর কোত্থেকে দুটো ছেলেকে ধরে নিয়ে এসেছে। সব এক সঙ্গে পাঠাতে চায়।
সর্দারজি ওরফে দয়ালদা বলল, ডিসুজার দিকটা উনি সামলান। তুমি এক কাজ করো, এই মেয়েটার ব্যাপারে একটু নজর রাখো। মেয়েটি জলে ঝাঁপ দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু যদি ও কোনওরকমে প্রাণে বাঁচে তা হলে কিন্তু ঘোর বিপদ।
বিপদ কীসের?
বিপদের রাস্তাটা তুমিই তো দেখিয়েছ ভাই। ওকে ডিসুজার বাংলোয় নিয়ে যেতে তোমাকে কে বলেছিল? তা ছাড়া এতদিন এ লাইনে আছ, এখনও বুঝলে না, যারা বাধা না দিয়ে ভাল মানুষের মতো চুপচাপ থাকে, তারাই সবচেয়ে সাংঘাতিক হয়। মেয়েটি ভয় পাওয়ার ভান করে চুপ হয়ে গিয়েছিল। আর তুমি ভাবছিলে ও পোষা হরিণের মতো তোমার বাধ্য হয়ে গেছে। তা ছাড়া এও জেনে রেখো, জল এমন মারাত্মক জিনিস যে সাঁতার জানে না সে কখনওই নিজের থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়বে না।
তোমার এ যুক্তিটা আমি মানতে পারলাম না। মেয়েটি আত্মহত্যার জন্যেও তো জলে ঝাঁপ দিতে পারে?
তা যদি হয় তবেই মঙ্গল। না হলে ও যদি বেঁচে ফিরে আসে তা হলে ডিসুজার বাংলোর খবর ও পুলিশকে দেবেই।
ডিসুজার বাংলো ও চিনবে না।
চোদ্দো বছরের মেয়ে। বয়সটা নেহাত ফেলনা নয়। এই বয়সে কত মেয়ের বিয়েই হয়ে যায়। ওদের স্মৃতিশক্তি এবং অনুসন্ধান করবার ক্ষমতা তোমার আমার চেয়েও ঢের বেশি।
কথা বলতে বলতে বেশ খানিকটা পথ যাবার পর একটা গলির ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা।
গলির মুখেই মস্ত একটি বাংলো। সেই বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপে ওরা অপেক্ষা করতে লাগল।
এমন সময় ওদের মধ্য থেকে হঠাৎই একজন দেখতে পেল ওদের। পল্টন ও গৌতম তখন গলির মুখে দাঁড়িয়ে দুষ্কৃতীদের গতিবিধি লক্ষ করছিল।
দুষ্কৃতীরা দেখামাত্রই ছুটে এল ওদের দিকে।
পল্টন হঠাৎ শংকরের দিকে একটা পা এগিয়ে দিতেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সে।
আর গৌতম করল কী, ছদ্মবেশী দয়ালদার দাড়িধরে ঝুলে পড়তেই নকল দাড়িগোঁফ সব খুলে গেল তার। কিন্তু সে কিছু করবার আগেই গৌতম ওর চোখ লক্ষ্য করে সজোরে একটা ঘুসি ছুড়ল।
দয়ালদা তখন চোখে হাত দিয়ে বসে পড়েছে সেখানে। ঘুসিটা বেশ মোক্ষম জায়গাতেই লেগেছে মনে হচ্ছে।
এদিকে যে বাড়ির দরজায় কলিং বেল টেপা হয়েছিল সেই বাড়ি থেকেও দু’-তিনজন লোক বেড়িয়ে ওই রকম দৃশ্য দেখে ছুটে এল ওদের দিকে।
পল্টন আর গৌতম তখন উপায়ান্তর না দেখে প্রাণপণে ছুটে চলল যে পথে এসেছিল সেই পথে। গৌতম পল্টনের আগে আগে ছুটছে। পল্টন পিছনে।
ছুটতে ছুটতে পল্টন বলল, আগুপিছু তাকাবি না। যেদিকে সুবিধে বুঝবি পালাবি।
গৌতম বলল, কিন্তু আমরা কি এইভাবে ছুটে পারব ওদের খপ্পর থেকে নিজেদের বাঁচাতে?
পারতেই হবে।
শত্রুরা তখন বুলডগের মতো ছুটে আসছে। ভাবটা এই, পেলেই যেন ছিঁড়ে খাবে।
হঠাৎ একটা ইট এসে লাগল পল্টনের মাথায়।
ও আর ছুটতে পারল না। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করতে লাগল। মাথায় হাত দিয়ে ‘বাবারে’ বলে বসে পড়ল পল্টন।
ওরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর।
গৌতম দেখেও থামল না। ছোটার গতি আরও একটু বাড়িয়ে দিল। বলা যায় না, থামতে গিয়ে যদি বা ধরা পড়ে! এখন ওকে পালাতেই হবে। পালিয়ে বাঁচতে হবে। না হলে কেউ-ই উদ্ধার হবে না।
পল্টনকে যখন ওরা ধরল, শংকরও তখন উঠে এসেছে।
শংকর বলল, আর একটা কই? আর একটা? তারপর পলায়মান গৌতমকে দেখে বলল, ওই তো! ওই—ওই…পালাচ্ছে। ধর ধর।
গৌতম তখন অনেক দূরে চলে এসেছে। ও যেখানে এসেছে সেখানেই মোড়ের মাথায় এক জায়গায় কতকগুলো কংক্রিটের ড্রেন পাইপ জড়ো করা ছিল।
ও তারই একটার মধ্যে ঢুকে পড়ল।
ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মুখের ওপর একটা লাথি এসে পড়ল। সেই সঙ্গে অশ্রাব্য গালাগালি।
গৌতম নিরুপায় হয়ে মুখটাকে চেপে ধরল তার। যাতে আর না চেঁচায়।
শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড ধ্বস্তাধ্বস্তি। আর তারই ফলে ড্রেন পাইপগুলো দুড়দাড় করে পড়তে আর গড়াতে লাগল। ফলে হল কী, ধ্বস্তাধস্তির বদলে নিজেদের রক্ষা করতে দু’জনেই দু’জনকে জড়িয়ে ধরল।
গৌতম বুঝল প্রতিপক্ষ একটি মেয়ে। মেয়েটি বুঝল আগন্তুক একটি ছেলে।
গৌতম চাপা গলায় বলল, তুই মেয়েটা এত রাত্তিরে এর ভেতরে কী করছিস রে?
তু কৌন হো পুছনেবালি?
গৌতম বলল, কয়েকজন লোক আমাকে ধরবে বলে তাড়া করেছে। তাই আমি ভয়ে এর ভেতর ঢুকে পড়েছি। কিন্তু তুই যে এর ভেতরে থাকবি তা কী করে জানব? ওঃ। যা জোরে একটা লাথি মেরেছিস না?
মুঝে মাফ কর দো ভাইয়া। ম্যায় বুরা সমঝা তুমকো।
গৌতম বলল, কে তুই?
মেয়েটি বলল, বাঙালিদাদা, আমি রাস্তার মেয়ে। বেওয়ারিশ লেড়কি আছি। ,
আমার মা-বাবাকে আমি কখনও চোখে দেখি নাই। ভিখ মেঙে খাই। রাতে বিরেতে কত রকম লোক ঘুরে বেড়ায় চারদিকে। যদি কেউ আমাকে নিয়ে পালায় তখুন আমি কী করব। সেই ডরসে ভাগে হুয়ে আমি এইসব জায়গায় লুকিয়ে থাকি। আমি জেগে থাকব তো, আমার গায়ে কেউ হাত দিতে এলে তাকে আর আস্ত রাখব না। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে তো আমি জানব না কিছুই?
গৌতম বলল, ঠিক আছে। তোর কোনও ভয় নেই। তবে তোর পক্ষে এই জায়গাটাও খুব নিরাপদ নয়! তার কারণ এখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে যে একটা বাড়ি আছে, ওই বাড়িটা হল শয়তানের ঘাঁটি। ওখানে তোর মতো মেয়েদের কিছু লোক চুরি করে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখে। পরে নয়নাগিরি না কোথায় যেন পাচার করে দেয়।
মেয়েটি বলল, সমঝ গিয়া। ও লোগ একরোজ ধান্দা লেকে হামারা পাস ভি আয়া থা।
তারপর?
হামকো কাম করনে বোলা ও আদমিকা সাথ। ম্যায় তো মু’পর থু কর দিয়া। কেন?
আরে বুরাই কা কাম। দেখো ভাইয়া, ম্যায় ইনসান সে পয়দা হুয়া লেড়কি। ভগবান মেরা মা-বাপ। শয়তানকা কাম কিউ করেগি? ম্যায় ভিখ মাংতা। লেকিন কিসিকা কোই চিজ চোরি করতা নেহি।
গৌতম বলল, তুই গরিব হলেও তোর মনটা খুব ভালরে। কী নাম তোর? মেরা নাম দুলালি।
গৌতম বলল, দেখ দুলালি, আমারই এক বন্ধুকে ওরা ওই বাড়ির ভেতরে আটকে রেখেছে। আমাদের পরিচিত একটি মেয়েকে নিয়ে ওরা পালিয়ে এসেছিল বলে আমরা ওদের পিছু নিয়েছিলুম। এখন বন্ধুকে কী করে উদ্ধার করি বল দেখি? তুই ওই বাড়ির ভেতর গেছিস কখনও?
নেহি তো।
তা হলে উপায়?
দুলালি কী যেন ভাবল। তারপর বলল, আচ্ছা বাহার তো নিকাল পহলে। ওরা হামাগুড়ি দিয়ে ড্রেন পাইপের বাইরে এল দু’জনে।
তখন বেশ রাত হয়েছে। তাই চারদিক নিঝুম। এই নোংরা গলিপথে রাস্তার কুকুরগুলো ছাড়া জনপ্রাণী নেই। ড্রেন পাইপ থেকে বেরিয়ে এসে গৌতম দেখল ভিখারিণী দুলালি, ওদেরই বয়সি একটি মেয়ে। ঘন কালো গায়ের রং। এত কালো যে সচরাচর দেখা যায় না। আর তেমনি সাদা ওর চোখদুটো। রুপোলি মাছের মতো যেন চক চক করছে। লম্বা একটি বেণী দুলছে পিঠের ওপর।
শতছিন্ন মলিন একটি ফ্রকপরে আছে। সম্ভবত নিয়মিত স্নান করে। তাই গা-হাত-পা বেশ পরিষ্কার।
দুলালি বলল, আভি বতাও তামাশা ক্যা।
গৌতম আগাগোড়া সব কথা খুলে বলল ওকে।
সব শুনে দুলালি বলল, দেখো ভাইয়া ও আদমি পুলিশকা এক জবরদস্ত অফিসার থা। আভি ও নোকরি নেহি করতা।
অবসর নিয়েছেন বুঝি?
হো সকতা। ও তো মুঝে মালুম নেহি। লেকিন কাম বহুত খারাবি করতা। করুক। ওর খপ্পর থেকে আমার বন্ধুটিকে কী করে উদ্ধার করি বল তো?
তা দুলালি কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর গৌতমকে বলল, আও মেরা সাথ। বলে গলির পর গলি, তস্য গলি পার হয়ে আবার যখন মহেন্দুঘাটের কাছে এল, তখন সেখানে একজন পানওয়ালা দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করছে। দুলালিকে দেখেই বেশ আদুরে গলায় বলল, ক্যারে দুলালিয়া। ক্যা ভৈল তেরি? ইতনা রাত হো গৈল, তোহরকা নিদ না আয়ি?
দুলালি ছুটে গিয়ে সব কথা বলল পানওয়ালাকে।
পানওয়ালা একবার দেখল গৌতমকে। তারপর বলল, এক মিলে গা তুমকো। লেকিন দুসরা নেহি মিলেগা!
গৌতম বলল, এক মিলেগা মানে?
আও মেরা সাথ।
বেশ খানিকটা ওর সঙ্গে যাবার পর একটা অনুন্নত এলাকায় এল ওরা। পানওয়ালা ওদের নিয়ে একটা বাড়ির ভেতর ঢুকতেই চমকে উঠল গৌতম। ছোট্ট একটি ঘরের মধ্যে এক খটিয়া পরিবারের লোকেদের সঙ্গে ময়লা
একটি ডুরে শাড়ি পরে বসে আছে গোপা।
গৌতমকে দেখেই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল সে।
গৌতমও অবাক, এ কী! গোপা তুমি এখানে?
হঠাৎ দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল গোপা। বলল, আমি আর কখনও এখানে আসব না। চাই না আমি গান শিখতে। তুমি আমাকে আমার মায়ের কাছে দিয়ে আসবে চলো লক্ষ্মীটি। তোমার দুটি পায়ে পড়ি।
গৌতম বলল, অবুঝ মেয়ের মতো কাঁদে না। এখানে তুমি কী করে এলে? আমাদের কত বিপদ তা জানো?
এইবার একটু আশ্বস্ত হয়ে গোপা বলল, কী বিপদ তোমাদের?
দাদুভাইকে ওরা গাড়ি থেকে ফেলে দিয়েছিল তা নিশ্চয়ই জানো? জানি। উনি কি বেঁচে আছেন?
হয়তো মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। আমরা এই খবর শুনে তোমার খোঁজে মহেন্দুঘাটে আসি। এখানে এসে শুনি তুমি ওদের চোখে ধুলো দিয়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছ। কিন্তু তুমি যে প্রাণে বাঁচবে তা ভাবতেও পারিনি।
আমার বেঁচে থাকবার কথা নয়। যেমনি ঠান্ডা এখানকার গঙ্গার জল, তেমনি হচ্ছে জলের টান। কী ভাগ্যিস এই বাড়ির মেয়েরা তখন ঘাটের ধারে ছিল। তাই এদের এখানেই উঠেছি। এরা আমাকে একটু বেশি রাতে কদমকুঁয়ায় পৌঁছে দেবে বলেছে। তা ভালই হয়েছে তুমি এসে পড়েছ। আমি আর কদমকুঁয়ায় যাব না। ওই অভিশপ্ত জায়গায় আর না যাওয়াই ভাল। তুমি আমাকে এখুনি নিয়ে চলো স্টেশনে। আমাকে আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসো!
গৌতম বলল, তাই কী হয়? বাড়ি যে যাবে গাড়ি ভাড়া আছে সঙ্গে? টাকা চাই না? তা ছাড়া কাকুমণি কী ভাববেন? তাঁরা বুঝি চিন্তা করছেন না আমাদের কথা? তাঁদের না জানিয়ে এইভাবে ছেলেমানুষের মতো কি চলে যাওয়া উচিত? তা ছাড়া আমাদের বিপদের কথা তো তুমি শোনইনি। তোমার খোঁজে এসে দু’জন দুষ্কৃতীর পিছু নিতে গিয়ে আমাদের কী অবস্থা হয়েছে জান? ওরা আমাদের এমন তাড়া করেছে যে আমি পালাতে সক্ষম হলেও পল্টন বেচারি আহত হয়ে ওদের কবজায় পড়ে গেছে।
শিউরে উঠল গোপা, তা হলে কী হবে?
যেভাবেই হোক ওকে শয়তানের খপ্পর থেকে ছিনিয়ে আনতে হবে। এখনই গিয়ে পুলিশকে বলতে হবে কথাটা।
দুলালি বলল, পুলিশবালে মদত নেহি করে গা।
গোপা বলল, তুমি কে?
গৌতম বলল, ও বেচারা বড় দুঃখী। ও ছিল বলেই তো এমন নাটকীয়ভাবে তোমাকে পেলাম।
ও কী করে জানল আমি এখানে আছি?
পানওয়ালাকে দেখিয়ে গৌতম বলল, ও আমাকে পল্টনের ব্যাপারে সাহায্যের আশায় এই দাদার কাছে নিয়ে আসে। ওনার কাছে এসেই তোমাকে পেলাম। তার আগে কেউই জানতাম না তুমি কোথায় আছ।
পানওয়ালা বলল, দেখো ভাই, একটা কথা। আমরা গরিব লোক। আর ওরা হল রাজা উজির। ওদের সঙ্গে লেগে আমরা পেরে উঠব না। ওই ডিসুজাসাহেব একজন সাসপেন্ড হওয়া জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। অনেক তাবড় তাবড় লোক ওঁদের চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। কাজেই থানা-পুলিশ করেও খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। এখানকার পুলিশ সব জানে। তাই ভয়ে ওদের এড়িয়ে চলে। এরা সব মাফিয়াচক্রের লোক। এখন তোমরা যেভাবেই হোক গা-ঢাকা দিয়ে পালাও। ওদের শিকারকে আমরা ঘরে ঢোকাই না। তবে আমি তো বাঙালির ছেলে। বহুদিন এই দেশে আছি। এখানকার মেয়ে বিয়ে করে ঘরসংসার করছি। এখন আর আমার মধ্যে কোনও বাঙালিয়ানা নেই। রীতিমতো খটিয়া বনে গেছি। তবু মেয়েটার বিপদের কথা শুনে ওকে আশ্রয় দিলাম। এখন যাও, চুপি চুপি চলে যাও তোমরা এখান থেকে। দুলালি তোমাদের পথ চিনিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসবে।
কিন্তু আমার বন্ধুর কী হবে?
তা কী করে বলব? ওকে উদ্ধার করবার চেষ্টা তোমরা অন্য কোনও উপায়ে কোরো। কিন্তু দয়া করে যেন আমাদের জড়িয়ো না। এখন ভালয় ভালয় মেয়েটিকে নিয়ে পালাও। যদি ওরা কোনওরকমে জানতে পারে আমরা মেয়েটিকে এখানে আশ্রয় দিয়েছি, তা হলেও হয়তো আমাদের বিপদ হবে।
গৌতম বলল, না না। কোনও ভয় নেই তোমাদের। এই বিপদের দিনে তোমরা যা করেছ তার তুলনা হয় না। কেউ জানতে পারবে না এখানকার কথা। এমনকী পুলিশও না। পুলিশ জিজ্ঞেস করলে ও বলবে অতি কষ্টে সাঁতার কেটে ডাঙায় উঠে নিজেই চলে এসেছে ও।
তা হলে আর দেরি নয়। এই বেলা চলে যাও। গলি থেকে বেরিয়েই বড় রাস্তা পাবে। সেখানে অটো, রিকশা সব কিছুই পেয়ে যাবে তোমরা।
ওরা তখনই রওনা হল। এখানে থাকার প্রয়োজনটাই বা কী আর? এখন ঘরে ফেরা একান্ত দরকার।
দুলালিও চলল ওদের সঙ্গে।
বড় রাস্তার মুখে এসে গৌতম ওর পকেট থেকে দশটা টাকা বার করে দুলালির হাতে দিয়ে বলল, তুই এটা রেখে দে দুলালি। আর ভিক্ষে করা ছেড়ে দে। তুই খুব ভাল মেয়ে। ভালভাবে বাঁচবার চেষ্টা কর। ভিক্ষে না করে ঝি-গিরি কর।
দুলালি হেসে বলল, এ রুপিয়া তু রাখ দে ভাইয়া।
কেন? রেখে দেব কেন? আমি তোর দাদা হই। তোকে মিষ্টি খেতে দিলুম। আর শোন, তোর তো কেউ কোথাও নেই। আমাদের এইসব ঝামেলা মিটে গেলে আমি তোকে আমাদের দেশে নিয়ে যাব।
দুলালি হেসে বলল, নেহি ভাইয়া। ইয়ে শহর ছোড়কর ম্যায় কঁহি নেহি যাউঙ্গি। ইয়ে মেরা জনমভূমি হ্যায়। গঙ্গাজি মেরা মা। পাটনা মেরা বাপ। আচ্ছা ঠিক আছে। দেখা যাবে যাস কি না স। আমারও একটা বো
আছে। তোর চেয়ে অবশ্য অনেক ছোট। সে বড় হলে তার যখন বিয়ে দেব তখনও কী সে তার জন্মভূমির দোহাই দিয়ে শ্বশুরবাড়ি না-গিয়ে মা-বাবার কাছে পড়ে থাকবে ভেবেছিস? ওরে তুই একটা মেয়ে। তুই তো একদিন আরও বড় হবি। তুই কি চিরকাল ফুটপাথে পড়ে থাকবি আমরা থাকতে? আমার মা-বাবা তোর মা-বাবা হবে। আমি তোর দাদা হব। তোর মতো মেয়েকে কখনও ভেসে যেতে দিই? আজ এই মুহূর্তে তোর জন্যে কিছু করতে না পারলেও ঝামেলাটা একটু মিটতে দে। তারপর দেখবি কী করি। দুলালি অস্ফুটে উচ্চারণ করল, ভাইয়া!
গৌতম বলল, আসছিরে।
গোপা ততক্ষণে একটা অটোকে দাঁড় করিয়েছে। ওরা অটোয় চেপেই বলল, কদমকুঁয়া।
গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দুলালিকে হাত নেড়ে বিদায় জানাল ওরা। তারপর প্রশস্ত রাজপথের ওপর দিয়ে ছুটে চলল কদমকুঁয়ার পথে।