ছয়
দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর ভেতরবাড়িতে শুতে গেল ওরা। সদাশিববাবু বাইরের ঘরেই রইলেন। পল্টন আর গৌতম দু’জনেই শুয়ে শুয়ে নানারকম আলোচনা করতে লাগল। আলোচনাটা অবশ্যই গফুরকে নিয়ে। ওর কান কেটে সমুচিত শিক্ষা তো ওকে দিয়েছে। কিন্তু ওরা চলে গেলে এই ঝাপটাটা সত্যসুন্দরবাবু যে কী করে সামলাবেন সেটাও একটা ভাবনার বিষয়। আলোচনা করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়ল পল্টন।
গৌতম শুধুই এপাশ ওপাশ করতে লাগল। টেবিলের ওপর প্লাস্টিক জাগে জল ছিল। ঢক ঢক করে খেল খানিকটা। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ছাদে উঠল।
এখানে এখন কনকনে ঠান্ডা। অথচ ছাদে কত রোদ্দুর। আর খোলা আকাশের নীচে এই ছাদের ওপর থেকে আজকের পাটনা বা অতীতের পাটলিপুত্র কী অপরূপ।
ছাদে উঠেই গৌতম দেখল গোপা সেই মিঠেকড়া রোদে বসে নিশ্চিন্ত মনে কেমন চুল শুকোচ্ছে। গৌতমকে দেখেই খুশিতে উপচে পড়ে বলল, কী হল! ঘুম হল না বুঝি সাহেবের?
না। পল্টনটা যা নাক ডাকাচ্ছে তাতে ঘুম আর আসবে না। তা ছাড়া দিনে আমি ঘুমোতে পারি না।
ঠিক আমারই মতো।
তুমি তা হলে দিনের বেলা না ঘুমিয়ে ছাদে বসে চুল শুকোও?
সব সময় নয়। তারপর বলল, তবে যা বীরত্ব তুমি দেখিয়েছ, তাতে একটু ঘুমিয়ে পড়া তোমার উচিত ছিল। তোমাকে দেখে তখন আমার কী মনে হচ্ছিল জানো?
তোমার মনের কথা আমি কী করে জানব?
আমার মনে হচ্ছিল তুমি সেই সিনেমায় দেখা স্বপ্ন কি সওদাগর। ভয় লাগছিল। আবার ভালও লাগছিল।
তাই নাকি?
তবে অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারতে।
তোমার জন্যই তো করলাম। যেই শুনেছি তুমি আসার পর থেকেই ওরা তোমাকে অযথা বিরক্ত করছে, অমনি মাথাটা গেল গরম হয়ে। মেয়েদের কেউ বিরক্ত করলে আমার খুব রাগ হয়।
গোপা গৌতমকে ছাদের আলশের দিকে টেনে নিয়ে গেল। তারপর বলল, ভাগ্যে বাবলিদির বিয়ে উপলক্ষে এখানে এসেছিলাম, তাই তো তোমার মতো একজন বীরপুরুষের দেখা পেলাম। এখানে এসে একা একা কী বোর যে লাগছিল তা কী বলব। তার ওপরে ওই উপদ্রব। অথচ কাকুমণি বা দাদুভাইকে ফেলে যেতেও পারছিলাম না। আজ এই যে বিয়ে বাড়িতে যাব আর ফিরছি না। আমি এখান থেকেই পালাব কাল! মাসে একবার গান শিখতে আসতাম। তাও আর আসা হবে না পাপেদের জ্বালায়। কাকুমণি যখন আমাদের ওখানে যাবেন তখনই একটু তালিম নিয়ে নেব।
গৌতম বলল, সেই ভাল। এখানকার যা অবস্থা তাতে আর তোমার এখানে না-আসাই উচিত। এলেও মাকে নিয়ে আসবে।
আমার না খুব ইচ্ছে করছে আমার মায়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিতে। আমার বন্ধুদের দেখিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে যে, আজকালকার ছেলেরা সবাই কাপুরুষ নয়। আর সব গৌতমই, বুদ্ধদেব নয়। মগধের মাটিতে কলির গৌতমও পৌরুষে ঘা লাগলে চণ্ডাশোক হয়ে ওঠে। এতক্ষণ ছাদে বসে আমি তোমার কথা খুব বেশি করে ভাবছিলাম! আমার মতো এক অতি নগন্যা মেয়ের জন্যে আর একটু হলেই তুমি জীবন দিতে যাচ্ছিলে। যদি কোনও অঘটন ঘটত তা হলে কী হত বলো তো?
কী আবার হত? মরে যেতাম। সব মানুষই মরণশীল। তবে শত্রুর শেষ করে যদি মরতাম, তোমরা কিছুদিন শান্তিতে থাকতে। মনুষ্যত্বের বিকাশ তার বেঁচে থাকায় নয়, প্রতিরোধ করবার ক্ষমতা রাখায়।
গোপা অবাক হয়ে গেল গৌতমের কথা শুনে। এইটুকু একটা ছেলের মুখে এমন জ্ঞানের কথা কী করে আসে? কতই বা বয়স গৌতমের? এখনও স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি হয়তো। সবে গোঁফের রেখা দেখা দিয়েছে। ও অপলকে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে।
গোপার দিকে চেয়ে থাকতে গৌতমেরও ভাল লাগল খুব। গোপার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ওর মুখে। আজকাল ফ্রকের বদলে মেয়েরা স্কার্ট পরে। গোপাও তাই পরেছে। লম্বা বেণীটি পিঠ বেয়ে কোমরের কাছে দুলছে। ওর ফর্সা রং রোদের ছটায় ফুট ফুট করছে। ঠিক যেন একটি গন্ধরাজ অথবা ঝরে পড়া শিউলি ফুলটি।
মাথার ওপর দিয়ে একটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল কোথায়।
গোপা বলল, তুমি কলেজে পড়?
উঁহু! সামনের এপ্রিলে ফাইনাল দেব।
মাধ্যমিক?
হ্যাঁ। তুমি?
আমি দেব সামনের বছর।
তারপর আরও পড়বে নিশ্চয়ই?
হ্যা। আর্টস নিয়ে পড়ব। বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনেছ তো? শুনেছি। মদনমোহন মালব্য যার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আমি সেইখানেই ভরতি হব।
তোমার কী ভাগ্য।
তোমার ভাগ্যটাই বা খারাপ কী? বাঙালির ছেলে বাংলায় আছ। বাংলা পড়ছ। একাধিক স্কুল-কলেজ আছে। আমাদের তো সবই হিন্দি। তবে লেখাপড়ার মান খুব একটা খারাপ নয় আমাদের। ক’ ভাইবোন তোমরা?
আমি আর আমার বোন।
আমি একা। বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। শুধু মা আর আমি! অগস্তকুণ্ডার গলিতে একটা ছোট্ট বাড়ি আছে আমাদের। সেখানেই থাকি। তবে যে শুনলুম কাশীতে থাক।
বারাণসী। অগস্তকুণ্ডা কাশীরই একটা জায়গার কাশীতেই তো। যে কাশী সেই নাম। গোধুলিয়ার মোড়ের কাছে।
গোধুলিয়া! ভারী চমৎকার নাম তো।
কাশীর চৌরঙ্গি হল গোধুলিয়া। সবচেয়ে ব্যস্ত এবং যানজটের জায়গা। একবার এসো না আমাদের কাশীতে। খুব ভাল লাগবে তোমার। আমি তোমায় সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাব। গঙ্গার ওপারে ব্যাসকাশী নিয়ে যাব। সারনাথে গৌতমবুদ্ধ যেখানে পঞ্চশিষ্যকে সর্বপ্রথম উপদেশ দেন, সেখানে যাব।
আমি যাব। নিশ্চয়ই যাব।
যেয়ো। তোমার আমার বন্ধুত্ব যেন এখানেই শেষ না হয়ে যায়। আমার মাকে তোমার কথা বলব। এই শীতেই তোমার বাবা-মাকে নিয়ে চলে এসো কাশীতে। তোমরা আমাদের বাড়িতেই থাকবে। আমরা সবাই মিলে হইচই করব। তোমার বোন, আমি, তুমি সব সময় গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ঘুরব। বেণীমাধবের ধ্বজায় উঠব।
খুব ভাল হবে। তোমার ঠিকানাটা আমাকে দিয়ো। আমার ঠিকানা তুমি নিয়ো। তুমি আমাকে চিঠি লিখবে। আমি তোমাকে চিঠি লিখব। আসলে আমার অনেক ছেলেবন্ধু আছে। মেয়েবন্ধু একজনও নেই। তাই তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আমার খুব ইচ্ছে করছে। তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে ভালই হয়।
এমন সময় পল্টন এসে হাজির হল সেখানে। বলল, কী রে! ছাদে এসে কী করছিস?
গোপার সঙ্গে একটু গল্প করছিলাম।
এদিকে যে তিনটে বাজল। তৈরি হতে হবে না?
গোপা বলল, তিনটে বেজে গেছে? তা হলে আর নয়। চলো তোমাদের একটু চা করে খাওয়াই। দাদুভাইকে চা দিই।
পল্টন বলল, চা খাওয়াও আর যাই করো, কদমকুঁয়ায় গিয়ে বাবলিদির বিয়ের আসরে তোমার একটা গান কিন্তু আমরা শুনব।
নিশ্চয়ই শুনবে। একটা কেন? যত বলবে তত গাইব। তবে যে গান গাইব সে গান শুনলে তোমরা কিন্তু কানে আঙুল দেবে।
কেন?
সে দোষ অবশ্য আমার নয়। কাকুমণি তো আমাকে বাসরঘরে গাইবার গান শেখাননি। উনি শিখিয়েছেন উচ্চাঙ্গ সংগীত। খেয়াল-ঠুংরি এই সব।
গৌতম ও পল্টন হেসে উঠল হো হো করে।
ওপর থেকে নেমে এসেই ওদের সাজগোজের প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গেল। ওইটুকু মেয়ে। কিন্তু কী চটপটে। হিটারে চায়ের জল চাপিয়ে দুধ, চিনি, চা-পাতা এক সঙ্গে ফুটিয়ে চোখের পলকে করে ফেলল কয়েক কাপ চা। তারপর বাথরুমে ঢুকে একটু সাবান মেখে তৈরি হয়ে নিতে যেটুকু সময়।
সদাশিববাবু ধুতি-পাঞ্জাবি-শাল চড়িয়ে বললেন, নাতনির বিয়ে। কত আনন্দ করব, তার জায়গায় কী হয়ে গেল। এখন ঘর ফেলে বেরোতে ভয় করছে।
পল্টন বলল, কোনও ভয় নেই দাদুভাই। আজ সকালে যা হয়ে গেছে তারপরে আর কোনও মিয়া আসবে না এখানে ঝামেলা করতে। গফুরও তো এখন নার্সিংহোমে। আগে ও নিজের কান সামলাক। পরে অন্যের প্রাণ নেবে। ওরা ঘরে তালাচাবি দিয়ে বাড়ির বাইরে এল।
গলির মোড়ে যে পানওয়ালাটা ছিল সদাশিববাবু তাকে বললেন, তুমি তা হলে দোকান বন্ধ করে সময়মতো যেয়ো বচনভাই। আর একটু নজর রেখো বাড়িটার দিকে।
বচনভাই বলল, আপনি কোনও চিন্তা করবেন না বাবুজি। আজ আর কোনও ভয় নেই। যে মার খেয়েছে সব, ধারেকাছে কেউ নেই। আসলে এদের আমরা চিনি তো, এদের স্বরূপ দেখেছি। তাই ভয়ে কিছু বলতে পারি না। এই ছেলেদুটো হচ্ছে নতুন। উঠতি হিরো। টগবগে বয়স। কাজেই রাগের মাথায় দিয়েছে পিটিয়ে। তবে এই বয়সের ছেলে যে এত দুঃসাহসী হয়, তা কিন্তু ভাবিনি কেউ। গফুরের ইজ্জত একেবারে ধুলোয় লুটিয়েছে।
সদাশিববাবু একটু হেসে বড় রাস্তায় রিকশার দর করতে যেতেই একটা মোটর এসে থামল সেখানে। এক সুদর্শন যুবক সদাশিববাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকেই নিতে আসছিলাম। মাস্টারমশাই পাঠালেন।
তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলুম না বাবা!
আমি ওনার ছাত্র। প্রকাশ।
কিন্তু আমরা যে চার জন।
গাড়িতে আরও তিনজন ছিলেন। অবাঙালি। প্রকাশ বলল, দু’জন হতে পারে। দু’জন উঠে আসুন, আর দু’জন রিকশায় চলে যাক। পল্টন বলল, সেই ভাল। গোপাকে নিয়ে আপনি উঠে পড়ুন। আমরা রিকশায় যাই।
সদাশিববাবু আর গোপা মোটরে বসল।
পল্টন আর গৌতম চলল রিকশাতে। রিকশা এগিয়ে চলল, কদমকুঁয়ার পথে। বেশ কিছুটা পথ এসেছে এমন সময় অঘটন।
হঠাৎ কোথা থেকে হেলমেটপরা এক দানব স্কুটার চালিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে এল ওদের দিকে। তারপর পল্টনদের রিকশার চাকায় একটা ধাক্কা দিয়েই কেটে পড়ল চোখের পলকে।
হালকা রিকশা সেই আঘাত সহ্য করতে পারবে কেন? তাই ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গেই উলটে গেল রিকশাটা। পল্টন আর গৌতম দু’জনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ল রিকশা থেকে। পল্টন একেবারে ড্রেনের ওপর। আর গৌতম রাস্তার মাঝখানে। রিকশাওয়ালাও হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা লরির কাছে। ভাগ্য ভাল যে চাকার তলায় যায়নি।
আশপাশ থেকে অনেক লোক তখন একসঙ্গে হইহই করে ছুটে এল সেখানে। তারপর সবাই মিলে ধরাধরি করে ওদের টেনে তুলল। গৌতমের হাত-পা ছড়ে গেছে। জামাটাও ছিঁড়ে গেছে এক জায়গায়। শুধু তাই নয়, চিৎ হয়ে পড়ার জন্য মাথার পিছন দিকেও লেগেছে খুব। আর পল্টন? তার অন্য কিছু না হলেও ড্রেনের ময়লায় জামাপ্যান্ট মাখামাখি হয়ে গেছে।
পাশের একটি কল থেকে জল নিয়ে সেসব ধুয়েমুছে ফেললেও দাগ একটা রয়েই গেল। তার ওপর এই শীতকালে ভিজে জামাপ্যান্টে যেন কাঁপুনি ধরে গেল সারা শরীরে। একটি ওষুধের দোকানের কর্মচারীরা সহৃদয়ভাবে গৌতমকে একটু ফার্স্ট এড দিয়ে ছেড়ে দিল। সবই হল। এখন সমস্যা যেটা দাঁড়াল সেটা হল, এই অবস্থায় এই রকম ভেকে বিয়ে বাড়ি যাওয়া যায় কী করে?
যে রিকশায় ওরা আসছিল, সে রিকশার অনেক কিছুরই ক্ষতি হয়েছে। তাই সে আর যেতে চাইল না। ওরা তাই অন্য আর একটি রিকশা ভাড়া নিয়ে এগিয়ে চলল কদমকুঁয়ার পথে।
মিনিট দশেকের মধ্যেই কদমকুঁয়ায় পৌঁছে গেল ওরা।
তখন সন্ধে উত্তীর্ণ হয়েছে। সানাইয়ের পাগল করা সুরে সুরভিত আলোঝলমল একটি বিয়েবাড়ির সামনে ওরা রিকশা থেকে নামল।
সত্যবাবু কাছাকাছিই ছিলেন। অতিথি অভ্যাগতদের অভ্যর্থনা করছিলেন।
ওদের দেখেই ছুটে এলেন, কী ব্যাপার! এ কী অবস্থা তোমাদের? গৌতম বলল, আর বলবেন না। একটা স্কুটার এসে এমন ধাক্কা দিল রিকশাতে যে তার পরেই এই অবস্থা।
এঃ। তোমার তো অনেক জায়গাতেই চোট লেগেছে দেখছি। লোকটা ধরা পড়ল?
কে ধরবে? কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই তো হাওয়া। যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল তেমনই চলে গেছে।
সত্যবাবু পল্টনের হাত ধরে বললেন, এসো এসো, ভেতরে এসো। আপাতত আমার একটা ধুতি পরে শাল চাপাও গায়ে। না হলে এই ঠান্ডায় ভিজে পরে থাকলে অসুখ করে যাবে। বাবা কি তোমাদের সঙ্গেই আসছেন? না পরে আসবেন? আমি অত করে বলে এলাম একটু সকাল করে আসতে। বুড়োমানুষ। গৌতম বিস্মিত হয়ে বলল, সে কী! উনি আসেননি?
কই ননা—তো!
ওঁর তো আমাদের আগেই এসে যাওয়ার কথা। গোপাকে নিয়ে উনি মোটরে এসেছেন।
মোটর কোথায় পেলেন?
গৌতম আর পল্টন তখন সব বলল।
সত্যবাবু বললেন, সেরেছে। আমার ছাত্রদের কি বাবা চেনেন না? তা ছাড়া প্রকাশ নামে আমার কোনও ছাত্রই নেই।
গৌতম ও পল্টনের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
কাকিমা কান্নাকাটি করতে লাগলেন। সত্যবাবুকে দোষারোপ করে বললেন, যত নষ্টের গোড়া হচ্ছ তুমি। কী দরকার ছিল এত সব ঝামেলার? গফুরকে একটু বুঝিয়েবাঝিয়ে ওর কথাটা মেনে নিলেই তো ব্যাপারটা চুকে যেত। এখন সারাজীবন শত্রুতা করবে ও। বাবা বুড়োমানুষ। কোনওরকম হেনস্থাই তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তা ছাড়া গোপা পরের মেয়ে। ওর মাকে আমরা কী কৈফিয়ত দেব?
হঠাৎই বিয়েবাড়িতে একটা শোকের ছায়া নেমে এল। সানাইয়ের সুর নীরব হল। অতিথি অভ্যাগতদের মুখে কথা নেই।
এরই মধ্যে পল্টন ওর পোশাক পরিবর্তন করল।
বাবলিদি কী সুন্দর করে সেজেছিলেন। কিন্তু কান্নার অশ্রুতে সেই সাজের বাহার অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল। গৌতম আর পল্টনকে কাছে টেনে বাবলিদি বললেন, তোমরা এসেছ এ যে আমার কী আনন্দ। কিন্তু এই আনন্দের দিনে এমন এক নিরানন্দের ব্যাপার ঘটে গেল যে তোমাদের সঙ্গে ভাল করে কথাও বলতে পারছি না। কারা এ কাজ করল বল তো? গফুর, না আর কেউ?
পল্টন বলল, আর কেউ কেন হবে বাবলিদি?
আমার মনটা যেন তাই বলছে। আচ্ছা, প্রকাশ না কী যেন নাম বললে, কেমন দেখতে তাকে?
খুব সুন্দর। ভদ্র চেহারা। তা ছাড়া মোটরেও তিনজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। অবশ্য সবাই অবাঙালি। আমরা ভাবলাম তাঁরা নিশ্চয়ই বিয়ে বাড়িতেই আসছেন, তাই কোনও সন্দেহ হল না।
তবেই বোঝো। গফুরকে তো তোমরা দেখনি। তা হলে বুঝতে ওর সঙ্গে
কোনও ভদ্র-চেহারার মানুষের যোগাযোগই সম্ভব নয়।
পল্টন বলল, দেখিনি মানে? আমরা ওর কান কেটে ছেড়ে দিয়েছি আজ। পল্টনের কথা শুনে বাবলিদি অবাক। কাকিমা এবং সত্যবাবুও বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, কী রকম!
গৌতম বলল, আপনারা জানেন না? গফুরের ব্যাপার নিয়ে পাটনা শহর তোলপাড় হচ্ছে আজ।
সত্যবাবু বললেন, আমরা কেউ কিছু জানি না। আসলে সারাটা দিন বিয়ে বিয়ে করে ধকলটা যাচ্ছে, তার ঠ্যালা সামলাতেই অস্থির হয়ে উঠেছি। কোনও কথাই কানে আসেনি আমাদের। কোনওদিকেই মন দিতে পারছি না।
কাকিমা বললেন, কী হয়েছে আগাগোড়া সব ব্যাপারটা খুলে বলো তো? পল্টন আর গৌতম সবিস্তারে বলল সব।
শুনে কপাল টিপে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন সত্যবাবু। তাঁর মাথার ভেতরটা যেন ঝিমঝিম করতে লাগল।
বাবলিদি বললেন, এই যদি হয়ে থাকে তা হলে দাদুভাই আর গোপাকে যারা নিয়ে গেছে তারা গফুরের লোক নাও হতে পারে! গফুর নিজেই যেখানে আহত সেখানে এমন প্ল্যানমাফিক অপহরণ করবার মতো সাহস এবং বুদ্ধিটা জোগাবে কে? শুধু কী তাই? ওই রিকশার ব্যাপারটাও নিছক দুর্ঘটনা নয়। ওটাও পরিকল্পনামতো শয়তানি। শত্রুপক্ষ যেই হোক না কেন, সে ওদের দু’জনকেই মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
গৌতম বলল, তা যদি হয় এ তা হলে গফুরেরই কাজ। আমরা ওর কান কেটেছি। এর পরেও ও প্রতিশোধ নেবার চেষ্টা করবে না তা কী হয়? আমাদের ওপর রাগ হওয়াটা ওর পক্ষে স্বাভাবিক। এখানে অন্য কেউ আসে কোত্থেকে? বাবলিদি বললেন, গোপাকে যেভাবে কিডন্যাপ করা হয়েছে। তাতেই অন্য লোকের সন্দেহটা মনের মধ্যে উঁকি মারছে। বিশেষ করে আজ কয়েক বছর এইসব এলাকা থেকে ছেলেমেয়ে চুরির হিড়িক পড়ে গেছে একটা।
কিন্তু সেইসঙ্গে দাদুভাইকেও নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য কী?
সন্দেহমুক্ত হবার জন্য। ওরা শুধু গোপাকে নিতে চাইলে তোমরা কি যেতে দিতে?
না।
তা হলে?
এমন সময় গৌতম হঠাৎ বলল, আচ্ছা বাবলিদি, এমনকী হতে পারে না? মাথামোটা গফুরকে পরিচালনা করত হয়তো একটি বিশেষ দল! তারা হয়তো সমাজের কোনও বিশেষ প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা এমনভাবে সবার চোখের আড়ালে থাকত যে, তাদের সন্দেহও করত না কেউ। তারাই হয়তো গফুরকে দিয়ে খারাপ খারাপ কাজগুলো করিয়ে প্রোটেকশন দিত। এখন গফুর বেকাদায় পড়ায়, তারা ধরা পড়ার ভয়েই হোক বা গফুরের ইমেজ নষ্ট হলে নিজেদের স্বার্থে ঘা পড়বে ভেবেই হোক, নিজেরাই ফিল্ডে নেমে পড়েছে।
ঠিক। তোমার অঙ্কে এতটুকুও ভুল নেই। তুমি ঠিকই অনুমান করেছ গৌতম। এখন এই মুহূর্তে ওরা তোমাদের মেরে গোপাকে অপহরণ করে সমস্ত অপরাধগুলো গফুরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইছে। এখন যা কিছুই হোক-না-কেন সবাই সন্দেহ করবে গফুরকে। এমনকী পুলিশও এই সব অভিযোগের ভিত্তিতে গফুরকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য। অতএব ভেবে দেখতে হবে এই অলক্ষ্য শত্রুটি কে?
সত্যসুন্দরবাবু সব শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, শোনো আমাকে এখুনি একবার যেতেই হচ্ছে থানায়। তোমরা একটু সাবধানে থেকো। বর আসবারও সময় হয়েছে। তবু আমাকে যেতে হচ্ছে। আমি না-আসা পর্যন্ত বাইরের কোনও লোককে তোমরা ওপরে উঠতে দেবে না। যে কোনও একজনকে আমি সিঁড়ির মুখে মোতায়েন রাখছি। বাবলির ঘর ভেতর থেকে বন্ধ থাকবে। ও ঘরে কেউ যেন না ঢোকে। পল্টন আর গৌতম থাক বাবলির কাছে। ওর ঘরে টাকাকড়ি, গয়নাগাটি সব কিছুই আছে। ও জিনিস খোয়া গেলে বিয়েই বন্ধ হয়ে যাবে হয় তো।
গৌতম বলল, আপনি একা যাবেন? আমিও যাই না কাকুমণি আপনার সঙ্গে? খবরদার নয়। ওই শত্রুদের হাতে তোমাদের জীবনও বিপন্ন। ওরা যেখানে তোমাদের প্রাণনাশের চেষ্টা করছে, সেখানে এই রাতের অন্ধকারে কখনও বাইরে বেরোয়? ঘরেই থাকো তোমরা।
কাকিমা বললেন, তাই বলে তুমি একা যাবে? কাউকে অন্তত সঙ্গে নাও। রঘুরাইকে ডাকাব?
আমার জন্যে চিন্তা কোরো না।
সত্যবাবু আর একটুও দেরি না করে, সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামলেন। তাঁর কয়েকজন ছাত্রও তখন এসে উপস্থিত হয়েছে। সত্যবাবু তাদের সকলকেই খুলে বললেন সব কথা। তারপর বর এলে যাতে অভ্যর্থনার কোনও ত্রুটি না হয়, এই রকম পরামর্শ দিয়ে থানায় যাবার জন্য যেই-না স্কুটারে উঠতে যাবেন, অমনি একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল সেখানে।
একজন ইনস্পেক্টর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ আপনার মেয়ের বিয়ে। কিন্তু এই শুভদিনে একটা খুব খারাপ খবর নিয়ে আসতে হল আমাকে।
সত্যবাবু আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছল ছল চোখে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন, আমার বাবার ডেড বডিটা ওরা কোথায় ফেলে রেখেছে? আপনি জানতেন ব্যাপারটা?
হ্যাঁ। একটু আগেই খবর পেলাম। তা যাক। বলুন ডেড বডিটা কোথায় পাওয়া গেছে?
মহেন্দুঘাটের কাছে। তবে উনি মৃত নন। সম্ভবত ওনাকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
মেয়েটার খবর কী?
মেয়েটা! কোন মেয়েটা?
আমার ছাত্রী গোপা। চোদ্দো-পনেরো বছরের কিশোরী।
তা তো বলতে পারব না। তবে আপনার বাবাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তুলে এনে হসপিটালে ভরতি করা হয়েছে। উনি কথাই বলতে পারছেন না। কাজেই মেয়েটার ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না। জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ওঁর মুখে না শুনে তো কিছু করা যাবে না।
সত্যবাবু বললেন, বাবাকে যখন মহেন্দ্রঘাটের কাছে পাওয়া গেছে, তখন মেয়েটাকে নিশ্চয়ই ওরা কাছে রাখেনি। জলপথে পাচার করেছে। আপনারা যে ভাবেই হোক উদ্ধার করুন তাকে। পারলে গফুরগুন্ডাকে অ্যারেস্ট করুন।
মেয়েটার একটা ফটো দিতে পারবেন?
না। ফটো কোথায় পাব?
তা হলে তো কিছুই করতে পারব না আমরা।
বেশ। আপাতত গফুরকে অ্যারেস্ট করুন। ও-ই সব বলবে। এটা ওরই কাজ। দলের লোক দিয়ে করিয়েছে।
ইনস্পেক্টর বললেন, গফুরকে কোথায় পাব? সে তো আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সত্যবাবু হেসে বললেন, দেখুন মানুষের ধৈর্যের একটা সীমা আছে। আপনারাই তো আশকারা দিয়ে মাথায় তুলেছেন ওদের। নেলোগুন্ডা, গফুর— এরা আপনাদের মদত না-পেলে এত বাড় বাড়তে পারে? আমি কোনও কথা শুনতে চাই না। আপনি গফুরকে যে ভাবেই হোক ধরুন। ওকে ধরলেই মেয়েটাকে পেয়ে যাব।
দেখুন, গফুরকে ধরবার সাধ্য আমাদের নেই। তবে মেয়েটার ব্যাপারে আমরা খোঁজ খবর নিচ্ছি। এখন আসুন আপনি আমাদের সঙ্গে হসপিটালে। আপনার বাবার সঙ্গে দেখা করুন, আর থানায় গিয়ে আমাদের খাতায় একটা মিসিং ডায়েরি লিখিয়ে যান।
ততক্ষণে পল্টন-গৌতম সবাই নেমে এসেছিল নীচে। কাকিমাও এসেছিলেন। গৌতম বলল, চলুন তো। আমরাও আপনার সঙ্গে যাই। থানায় গিয়ে ও সি-র সঙ্গে দেখা করে বলি গফুরকে ধরতে, পুলিশের বাধাটা কোথায়?
ইনস্পেক্টর বললেন, ও সি কেন? স্বয়ং পুলিশ কমিশনার এলেও অ্যারেস্ট করতে পারবে না গফুরকে।
কেন?
সে অমরাবতী নার্সিং হোমে এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে খুন হয়েছে আজই দুপুরে। তার ডেড বড়ি এখন পুলিশমর্গে। প্রকাশ্য দিবালোকে আততায়ী নার্সিং হোমে ঢুকে বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে গেছে ওকে।
সত্যবাবু বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন, গফুর খুন হয়েছে! ওকে মারে এমন দুঃসাহস কার?
হয়তো আপনার। নয়তো যে সাহসী ছেলেদুটো ওর কান কেটে দিয়েছিল তাদের। তাও যদি না হয়, বিরুদ্ধ কোনও শক্তি কাজ করেছে ওর বিপক্ষে।
গৌতম বলল, গোপাকে যারা অপহরণ করেছে তাদের মধ্যে এক সুদর্শন যুবকও ছিল। নাম প্রকাশ।
সেটা তদন্ত সাপেক্ষ। আমার দিক থেকে আমি অবশ্য চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখব না।
সত্যবাবু বললেন, ধন্যবাদ। মেয়েটার জন্য কিছু অন্তত করুন। ওকে খুঁজে না পাওয়া গেলে হয়তো আমাকে সুইসাইড করতে হবে। বিধবার একমাত্র সন্তান। তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না আমি।
সত্যবাবু পুলিশের জিপেই চলে গেলেন। কাজেই স্কুটার নিয়ে যাবার প্রয়োজন আর হল না তাঁর।
সত্যবাবু চলে যাবার পরমুহূর্তেই বরের গাড়ি এসে হাজির হল। কাকিমাই চোখের জলে বরণ করলেন জামাইকে। এ বাড়ির বিপদের কথা তখন লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। বরকর্তা বললেন, আপনারা কোনওরকমেই নিজেদের অসহায় ভাববেন না। শুভ কাজ মিটিয়ে নেওয়ার দায়িত্বটা আমিই নিচ্ছি। পুরোহিতের কাজ পুরোহিত করুক।
কাকিমা যেন আশার আলো দেখতে পেলেন।