চার
শেষরাতে ট্রেন এসে থামল পাটনা জংশনে! ঘড়ির কাঁটায় তখন চারটে। একে ঠিক শেষরাত নয়, ভোরই বলা উচিত। ওরা ঘুমোচ্ছিল। কে যেন একজন ডেকে
তুলে দিল ওদের, কী গো ভাইয়েরা, পাটনা তো এসে গেছে। নামবে না? পল্টন-গৌতম দু’জনেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। তারপর যে যার ঝোলাব্যাগ সামলে নেমে পড়ল টুক করে।
আলো ঝলমল পাটনা জংশনে তখন শুধুই লোকের ব্যস্ততা।
ওরা গেটে টিকিট জমা দিয়ে স্টেশনের বাইরে এল। এত ভোরেও স্টেশন এলাকাটা জমজমাট।
অটো, রিকশা, বাস কী না নেই সেখানে?
একজন চাওয়ালা জ্বলন্ত উনুনের ওপর বড় একটা কেতলি বসিয়ে চা তৈরি করছিল। ওরা সেখানে গিয়ে সেই চা, এক ভাঁড় করে খেল। সে চায়ের স্বাদই আলাদা। চায়ের দোকানের রেডিয়োয় লতা মঙ্গেশকরের ‘মেরা নাম হ্যায় চামেলি’ গান হচ্ছে। ওরা চা খেয়ে চারদিকে পায়চারি করতে লাগল।
তারপর একটু একটু করে আলো ফুটলে ওরা একটা রিকশায় চেপে বলল, দরিয়াপুর!
রিকশাওয়ালা বলল, তিন রুপিয়া লাগে গা। চলে তো।
রিকশা ‘পিকু পিঁকু’ করে ভেঁপু বাজিয়ে ওদের নিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে চলল রাজপথ ধরে। অজানা দেশ, অচেনা জায়গা। তবু কী ভাল যে লাগল, তা বলবার নয়। ভাল লাগবে নাই বা কেন? হাজার হলেও রাজধানী শহর তো। বিহারের রাজধানী। তার একটা ঐতিহ্য আছে বইকী। কত উন্নতমানের ঘরবাড়ি যে ওদের নজরে পড়ল তার যেন শেষ নেই।
ওরা এ পথ সে পথ করে এক সময় দরিয়াপুর এসে পৌঁছুল। একটি নোংরা গলির মুখে রিকশা থামলে, ওরা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাল। তারপর একটি পানের দোকানে গিয়ে সত্যসুন্দরবাবুর নাম করতেই দোকানদার বলল, মাস্টারজিকা মকান?
পল্টন বলল, হ্যাঁ!
ইস গলি কা অন্দর।
ওরা দু’জনে গলির ভেতরে ঢুকে যেতেই বাঁদিকে বহুদিনের পুরনো একটি কোঠা বাড়ি নজরে পড়ল। সাবেক কালের বাড়ি। তার পাঁচিলটাই দশ ইঞ্জি ইটের গাঁথনি দেওয়া। পাঁচিলের গায়ে অজস্র ঘুঁটে। তারই একপাশে খটিয়া বস্তি।
একটি পেয়ারা গাছ, তার ডালে কেমন পেয়ারা হয়েছে দেখাবার জন্যই বুঝি পাঁচিল টপকে ঝুঁকে পড়েছে রাস্তার ওপর। পল্টন বলল, এই বাড়ি।
ওরা দরজায় কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে গুরুগম্ভীর একটা স্বর ভেসে এল, কে?
পল্টন বলল, আমি ! বলেই গৌতমের দিকে তাকিয়ে বলল, কাকুমণির বাবা। সদাশিববাবু। কাকামণির বন্ধু বলে সত্যসুন্দরবাবুকে ওরা কাকুমণি বলে!
গৌতম বলল, ওরে বাবা! কাকুমণির বাবা মানে তো অনেক বয়স। এখনও বেঁচে আছেন?
বেঁচে আছেন বলেই তো সাড়া দিচ্ছেন। কীরকম লম্বাচওড়া দশাসই চেহারা দেখবি। ঠিক যেন সম্রাট সাজাহান।
আমি কে? ভেতর থেকে আবার সাড়া এল,
আমি পল্টন। হাওড়া থেকে আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সত্যসুন্দরবাবু। বললেন, তা হলে? আর সব কই? চিঠি পেয়েছ আর কেউ নেই। শুধু আমরাই দু’জনে এসেছি।
সে কী! রুদ্রদা, তোমার মা, বোনেরা কেউ এল না?
কী করে আসবে? কাকামণিই যে বাড়িতে নেই। কোথায় গেছেন?
ইলাহাবাদে।
অ। বুঝেছি। প্রয়াগ সংগীত সম্মেলনের ব্যাপার।
আপনার চিঠিটা আর কিছুদিন আগে পেলেই হত। এমন সময় পেলাম যে এক তো কাকামণি নেই, তায় বিয়েটা একেবারে মাথায় মাথায়।
এসো এসো। ভেতরে এসো।
ওরা বাইরের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল।
ভেতরদিকে বাড়ির বাইরের অংশে একটি চালাঘর আছে। সেই ঘরে সত্যসুন্দরবাবু ক্লাস করেন। রেওয়াজ করেন। বাইরের গেস্টরা এলে থাকতে দেন। পল্টন আর গৌতমকে নিয়ে সেই ঘরে গেলেন তিনি।
সাজাহানের মতো শুভ্রকেশ ও দাড়িওয়ালা দীর্ঘ উন্নত সদাশিববাবু এগিয়ে এসে বললেন, তোমাদের বাড়ি খুঁজে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? পল্টন বলল, কিছুমাত্র না।
ওরা দু’জনেই সদাশিববাবু ও সত্যসন্দুরবাবুকে প্রণাম করল।
সদাশিববাবু বললেন, তুমি পল্টন, তোমাকে তো চিনলাম। কিন্তু ও ছেলেটি কে? গৌতম বুঝি?
গৌতম বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন। কিন্তু আমাকে তো আপনি দেখেননি কখনও, আমার নাম জানলেন কী করে?
তোমার কথা বাবলির মুখে কী কম শুনেছি আমি? তোমার বোনের নাম ঝুমু। ঠিক কি না?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
পল্টন বলল, যাই। ভেতরে গিয়ে বাবলিদি আর কাকিমার সঙ্গে দেখা করে আসি। ওঁরা এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠেছেন নিশ্চয়ই?
সত্যবাবু বললেন, ওরা তো কেউ নেই। বাড়ি একেবারে ফাঁকা।
সে কী? কেউ নেই কেন?
বিয়ের জন্যে আমি
এত বড় বাড়ি থাকতে?
কদমকুঁয়ায় একটা অন্য বাড়ি ভাড়া নিয়েছি।
এই নোংরা গলির ভেতর পুরনো ভাঙা বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তা ছাড়া আমার নিমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যাও অনেক। তাই সবাইকে সরিয়ে দিয়ে শুধু বাবা আর আমি পাহারা দিচ্ছি। এখানে চোরের উপদ্রব খুব। কেউ বাড়িতে না থাকলে তালা ওরা ভাঙবেই।
গৌতম বলল, বাবলিদির কোথায় বিয়ে হচ্ছে কাকুমণি?
ফৈজাবাদে।
সে তো অনেকদূর।
হ্যাঁ। তবে ভালই হয়েছে। রুদ্রদা অবশ্য দেখেছেন ছেলেটিকে। তা যাক। তোমরা সারারাত ট্রেন জার্নি করে এসেছ। ক্লান্ত শরীর তোমাদের। এখন মুখহাত ধুয়ে একটু চা-টা খেয়ে নাও। পরে তোমাদের কদমকুঁয়ায় পাঠিয়ে দেব।
সদাশিববাবু বললেন, এখন ওদের কদমকুঁয়ায় যাবার দরকারটাই বা কী? একেবারে সন্ধেবেলা যাবে, ওই হইহট্টগোলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাবে ওদের। তার চেয়ে বরং চারদিক একটু ঘুরে দেখুক ওরা।
সে ওরা যা ভাল বুঝবে।
সত্যবাবু ওদের বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে বাইরে চলে গেলেন।
ওরা দাঁত মাজতে মাজতে উঠোনময় ঘোরাঘুরি করে বাথরুমের কাজ সেরে বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিল। তারপর ঘরে এসে পোশাক পালটে কৌচে হেলান দিয়ে বসে যখন সদাশিববাবুর সঙ্গে গল্পে মেতেছে, তেমন সময় একটি মেয়ে ওদের জন্য চা-জলখাবার নিয়ে এল। জলখাবার মানে বড় বড় কচুরি-লাড্ডু-গজা আর অমৃতি। সেই সঙ্গে ধূমায়িত চা।
পল্টন ও গৌতম অবাক হয়ে গেল খুব অবাক হবার কারণও অবশ্য যথেষ্ট ছিল। যেখানে বাড়িসুদ্ধু লোক সবাই চলে গেছে সেখানে এই মেয়েটি এল কোত্থেকে? তা ছাড়া মেয়েটি কে? মেয়েটির সুন্দর মুখ, শরীরস্বাস্থ্য, ফুটফুটে চেহারা আর গায়ের রং দেখে তাকে মেয়ে বলেও মনে হয় না। তা হলে?
স্কার্টপরা চোদ্দো-পনেরো বছরের ভদ্র মেয়েটি, বেশ লাজুক লাজুক মুখে খাবারের জায়গাগুলো ওদের সামনের চা-টেবিলে রেখে অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটু পরেই একেবারে বেরোবার জন্য তৈরি হয়ে সত্যসুন্দরবাবু এলেন। এসে বললেন, তোমরা তা হলে যখন হোক চলে যেয়ো। কদমকুঁয়ায় গিয়ে পড়লে বিয়েবাড়ি চিনে নিতে অসুবিধে হবে না। যদি এ বেলা যাও, তা হলে ওখানেই খাওয়াদাওয়া করে নিতে পারো। আর যদি বিকেলে যাও তা হলে গোপাকে বলে দিয়ো ও দুটো ঝোল ভাত রেঁধে দেবে তোমাদের। বাবার জন্যে তো রান্না করবেই। অমনি তোমাদেরও হয়ে যাবে।
পল্টন বলল, গোপা কে কাকুমণি?
সত্যসুন্দরবাবু হাসি হাসি মুখে বললেন, বড় ভাল মেয়ে। ওর মা আমার কাছে গান শিখত। এখন ও শেখে। ওর গানের গলা শুনলে অবাক হয়ে যাবে। আচমকা শুনলে মনে হবে রেডিয়োয় গাইছে বুঝি কেউ। বাবার তো বিয়েবাড়ির ভিড়ভাট্টা সহ্য হবে না আর গুরুপাক খাওয়াও চলবে না। সেইজন্যে বাবার দেখাশোনা করছে ও।
সে কী! ও তা হলে বিয়েবাড়ি যাবে না?
কেন যাবে না? বিকেলবেলা বাবাকে নিয়ে যাবে ও। তোমরা কী করবে বলো?
সদাশিববাবুই ওদের হয়ে বললেন, কী আবার করবে? ওরা এতখানি জার্নি করে এসেছে, এখন একটু ঠান্ডা হোক। দুপুরে এখানেই ঝোলভাত খেয়ে নিক দুটো। একটু ঘুমিয়ে নিক। তারপর বিকেলে বিয়েবাড়ি যাবে। দু’বেলাই গুরুপাক খেলে শরীর খারাপ করবে যে।
গৌতম বলল, উনি ঠিক কথাই বলেছেন কাকুমণি। আমরা বিকেলেই যাব। এখন একটু রেস্টের খুবই দরকার।
আমি তা হলে গোপাকে বলে যাই। বলে ভেতর বাড়িতে চলে গেলেন সত্যসুন্দরবাবু। তারপর যাবার সময় আর একবার দেখা করতে এলেন সদাশিববাবুর সঙ্গে, আপনি তা হলে একটু সাবধানে থাকবেন বাবা। বেলাবেলি গোপাকে নিয়ে চলে যাবেন।
সদাশিববাবু বললেন, আমার জন্য চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক সময়েই যাব। সত্যসুন্দরবাবু চলে গেলেন। এখন তাঁর কত কাজ। হাজার হলেও কন্যাদায় বলে কথা। সব কিছুর তদারকি তো তাঁকেই করতে হবে।