তিন
যথা সময়ে ট্রেন ছাড়ল।
বাবা বিদায় নিলেন। যাবার আগে বলে গেলেন, কাল সকালের আগে ভুলেও যেন কোনও স্টেশনে না নামে।
এখন নভেম্বর মাস। তাই শীত শীত ভাব আছে। বিহারে নাকি কলকাতার চেয়ে এখন অনেক বেশি ঠান্ডা। গাড়িতেই ওরা ট্রেন ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সোয়েটার ইত্যাদি পরে নিল। পল্টনের ঠান্ডার ধাত বেশি। তাই গলায় মাফলার জড়িয়ে বসে রইল চুপ চাপ। গৌতমের সঙ্গে মাংকি ক্যাপ ছিল। কিন্তু সেটা সে পরল না। কেন না এখনও এত শীত পড়েনি যে এরই মধ্যে মাংকি ক্যাপ চাপাতে হবে। ও পকেট থেকে একটি ছোট্ট নোটবুক বার করে পল্টনের হাতে দিয়ে বলল, এই দেখ।
কী ওটা?
বল দিকিনি ওটা কী? ভাল করে দেখ।
পল্টন নোটবুকটা হাতে নিয়ে বলল, এটা তো একটা নোটবুক।
খুলে দেখ আগে।
পল্টন নোটবুকটা খুলে দেখল কতকগুলো জায়গার নাম ওর নোটবুকে নোট করা আছে। এই নামগুলোর প্রত্যেকটিই ওর পরিচিত। বলল, এই নামগুলো এতে টুকে রাখার মানে?
মানে একটাই। রথ দেখার সঙ্গে সঙ্গে কলা বেচাও হবে। অর্থাৎ বাবলিদির বিয়েতে গিয়ে আমরা কি শুধুই নেমন্তন্ন খাব আর হই হুল্লোড় করব? মোটেই না। পাটনা শহরটা চষে বেড়াব আমরা। কখনও রিকশায়, কখনও অটোয়, কখনও পায়ে হেঁটে। পাটনা হচ্ছে বিহারের রাজধানী। ষোড়শ শতাব্দীতে শের শাহের হাতে এই শহরের গোড়াপত্তন। এই পাটনাই প্রাচীন মগধ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অজাতশত্রু রাজত্ব করেছেন এখানে। সম্রাট অশোকের রাজধানী।
অশোক তো পাটলিপুত্রের রাজা ছিলেন।
সেই পাটলিপুত্ৰই আজকের পাটনা। মৌর্যযুগের রাজধানী।
বলিস কী রে! জানতাম না তো?
সবাই জানে। বিশেষ করে আমার আগে তোরই জানা উচিত ছিল।
তা হলে নিশ্চয়ই সেকালের নিদর্শনও কিছু দেখতে পাব আমরা!
এক বাঙালি ভদ্রলোক সামনের দিকের বাঙ্কের ওপর ঘুমনোর ভান করে শুয়েছিলেন। এদের কথাবার্তা শুনে বললেন, পেতে। যদি না, ১৫৩৪ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে সবকিছু চাপা পড়ে যেত। গৌতম বলল, আপনি কি পাটনায় থাকেন? না। আমি থাকি দানাপুরে।
পাটনায় দেখবার কী কী আছে বলুন তো?
দেখবার মতো আহামরি কিছুই নেই ওখানে। মিউজিয়াম, হরমন্দির, গোলঘর এইসব দেখতে পারো। তা ছাড়া সদাকত আশ্রমটা দেখো। আচ্ছা, গোলঘরটা কী জিনিস?
গোলঘর কী জানো, এটি একটি শষ্যাগার। অনেকটা মৌচাকের মতো গড়ে ওঠা একটি ঘর। ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দের দুর্ভিক্ষের স্মৃতি মনে রেখে ক্যাপটেন জন গারস্টিন এই শষ্যাগারটি ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে তৈরি করান। এর মাথায় ওঠবার সিঁড়ি আছে। সেখান থেকে পাটনা শহরের দৃশ্য এবং গঙ্গার সৌন্দর্য খুব ভাল করে দেখা যায়।
আমাদের উঠতে দেবে?
কেন দেবে না। সবাই ওঠে।
ওটা তা হলে মনুমেন্ট বলুন?
ঠিক তাই।
ওখানে আর কিছু দেখার নেই?
ওখানেই আছে, হরিমন্দির বা হরমন্দির। আগে ওটা ছিল একটা মস্ত বড় হাবেলি। নাম জহুরি শালিস রায়ের হাবেলি। এই জহুরি ছিলেন খুব হরিভক্ত। ওই হাবেলিতে তিনি দানধ্যান করতেন। হরি সংকীর্তন করতেন। তোমরা নিশ্চয়ই শিখদের দশম গুরু, গুরু গোবিন্দ সিং-এর নাম শুনেছ? তাঁর জন্মস্থান ছিল পাটনা। সেই কথা স্মরণে রেখেই পঞ্জাব কেশরী রণজিত সিং এখানে একটি গুরদোয়ারা তৈরি করে দেন। গম্বুজাকৃতি এই গুরুদ্বার বা গুরদোয়ারাটি পাঁচতলা উঁচু। শ্বেত পাথরে তৈরি। সোনা দিয়ে মোড়া এর প্রধান দ্বার। শিখদের পবিত্র তীর্থ। ওই গুরদোয়ারাটা কিন্তু তোমরা দেখো।
আর এক ভদ্রলোক এক পাশে বসেছিলেন। তিনি বললেন, তবে তুমি ওই যে তখন বললে পাটলিপুত্রের কথা, তা অশোকের আগেও মানে আজ থেকে প্রায় দু’হাজার তিনশো বছর আগে আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাশকে যিনি পরাজিত করেছিলেন সেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজধানী ছিল পাটনা। তাঁর পুত্র অশোক তো পরে রাজত্ব করেন। আর একটা জিনিস তোমরা নোট করে নাও, খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে ভগবান বুদ্ধ এখানে এসেছিলেন।
কথা বলতে বলতে কত সময় যে কীভাবে কেটে গেল তা কেউ টের পেল না। ট্রেন এসে বর্ধমানে থামল।
থেমেই ছাড়ল। মেল ট্রেন তো। বেশিক্ষণ থামে না।
সবাই যে যার খাবার দাবার বার করে খেতে লাগল।
পল্টন ও গৌতমও বাদ গেল না। অনেক খাবার। এত কী খাওয়া যায়?
কয়েকজন দেহাতি আশপাশে বসে বসে খইনি টিপছিল। পল্টন কিছু খাবার ওদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এগুলো খেয়ে নাও দেখি?
কমতি হো ওরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে বলল, লেকিন তুমহারা যায়েগা না?
না বাবা। আমাদের পেট কী মধ্যে জায়গা নেই। সেই জন্যেই তুম সবাইকে খিলাতা হ্যায়।
পল্টনের হিন্দি শুনে ফিক করে হেসে ফেলল গৌতম। হিন্দি সে-ও খুব একটা ভাল বলতে পারে না। তবে এতটা খারাপ বলে না।
দেহাতিদের খাবার দিয়ে নিজেরাও খেতে লাগল।
ট্রেন ছুটছে ঝড়ের বেগে। কী ভাল যে লাগছে। ট্রেনের দুলুনিতে বসে থাকতে থাকতেই এক সময় ঘুমে দু’চোখ লুটিয়ে এল ওদের। রাত জেগে আঁধারের প্রকৃতি দেখা মাথায় উঠল।
ওরা আর থাকতে না পেরে মেঝেতেই বেডসিটটা পেতে নিয়ে শুয়ে পড়ল টান হয়ে। তারপর নাক ডাকিয়ে সে কী ঘুম।