নয়নাগিরি অভিযান – ২

দুই

পাটনা শহরের আর এক সংগীতগুরু সত্যসুন্দরবাবুর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। সত্যবাবু প্রবাসী বাঙালি। তিনি কলকাতায় এলে কাকামণির কাছে ওঠেন। কাকামণিও পাটনায় গিয়ে ওঠেন তাঁর বাড়িতে। প্রায় একটানা চল্লিশ বছর ধরে এইরকম চলছে। সেই সূত্রেই পরিচয়। বাবলিদি সত্যবাবুর একমাত্র মেয়ে। মেয়ে তো নয়, যেন দুর্গাপ্রতিমা। যেমনি রূপ, তেমনি গানের গলা। পাটনা রেডিয়ো সেন্টারে নিয়মিত গান গাইবার সুযোগ পান। গৌতমরা কতবার রেডিয়োর নব ঘুরিয়ে শুনেছে সেই গান।

কলকাতায় এলে কাকামণির সঙ্গে গৌতমদের বাড়িতেও কতবার এসেছেন বাবলিদি। পল্টনের মায়ের সঙ্গেও এসেছেন। সত্যবাবু কোনও কাজে কলকাতায় এলেই বাবলিদিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আসলে মেয়েকে ছেড়ে একদম থাকতে পারেন না তিনি। তা সেই বাবলিদির বিয়ে। আর সেই বিয়েতে যাবার জন্যে নিজে হাতে চিঠি লিখেছেন বাবলিদি। কাকামণিকে যে চিঠি লিখেছেন তারই একপাশে লেখা আছে, আপনাদের সকলেরই আসা চাই। আর বিশেষ অনুরোধ, পল্টনের বন্ধু গৌতম ও ঝুমুকেও সঙ্গে আনতে ভুলবেন না। ওরা যেন বাদ না যায়। গৌতম আশা করি নিশ্চয়ই আসবে। সেই সঙ্গে ঝুমুও! বিয়ের পরে আর কখনও ওদিকে যেতে পারব কি না জানি না। অনেক দূরে চলে যাব তো। তাই ওদেরও একটু দেখতে চাই।

এইরকম চিঠি পাবার পর কি না-গিয়ে থাকা যায়? এখন মুশকিল হল একটাই, পল্টনের কাকামণি রুদ্রমশাই বাড়িতে নেই। কী একটি বিশেষ কাজে তিনি এলাহাবাদ গেছেন। চিঠিটা যদি দিনকতক আগেও আসত তা হলে কোনও ভাবনা ছিল না। এল এমন সময় যখন তিনিই নেই।

পল্টন যখন খুব ছোট তখনই ওর বাবা মারা যান। বিধবা মা, দুই দিদি আর পল্টনের দায়িত্ব নেন কাকামণি। উনি বিয়ে-থা করেননি তাই রক্ষে। কঠিন হাতে সংসারের হাল ধরলেন।

সেই কাকামণির অভিন্নহৃদয় বন্ধু হলেন সত্যবাবু। তাঁর মেয়ে বাবলিদির বিয়ে, অথচ কাকামণি নেই। এর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কী-ই বা হতে পারে? এখন বাড়িসুদ্ধু সবাই চলে গেলে কাকামণি হঠাৎ করে যদি ফিরে আসেন তা হলে ঘরে ঢুকতে পারবেন না। অবশ্য তেমন হলে না হয় উনি কোনও ছাত্রছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে উঠবেন। কিন্তু পাটনা পর্যন্ত বাড়িসুদ্ধু সকলের যাওয়াটাই কী মুখের কথা?

গৌতমকে দেখে পল্টনের মা বললেন, এই যে এসেছিস বাবা, বেশ করেছিস। বাবলির বিয়ের চিঠি এসেছে। তোদের দু ভাইবোনকেই যেতে লিখেছে।

তা তো জানি। বোন যাবে না। তবে আমাকে বাবা যাবার অনুমতি দিয়েছেন।

কিন্তু পল্টনের চিন্তা হচ্ছে আপনি কী করে যাবেন? কাকামণি নেই।

ওই একটা চিন্তা তো আমারও। এতগুলো লোকের গাড়িভাড়া, দেওয়াথোয়ার ব্যাপার, কাকামণি থাকলে সামলাতে পারতেন। হয়তো একটা সোনার জিনিসই দিতেন। কিন্তু আমি কী করে কী করব?

গৌতম বলল, আমি একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না তো?

না না। কী মনে করব?

কাকামণি যখন নেই তখন আপনি বরং একবার আমার বাবার সঙ্গে দেখা করুন। দেওয়ার ব্যাপারটা না হয় কাকামণি এলেই হবে। এই বিয়েতে সবাই মিলে আনন্দ করে যাওয়াটা অন্তত হোক। আমাদের সকলের গাড়িভাড়ার টাকাটা বাবা যে করেই হোক ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। এখন না হয় তাঁর কাছ থেকে ধার হিসেবেই টাকাটা নিন। পরে কাকামণি এলে দিয়ে দেবেন।

মা বললেন, তা কি হয় বাবা? কাকামণি হঠাৎ ফিরে এসে যদি দেখেন আমরা নেই, তা হলে খুবই দুঃখ পাবেন। তা ছাড়া এ অনেকগুলো টাকার ব্যাপার। বিশেষ করে সবাই চলে গেলে বাড়ি একদম ফাঁকা থাকবে। তার চেয়ে তোমরাই দু’বন্ধুতে যাও।

তা হলে দিদিরাও যাক।

না বাবা। দিদিরা এখন বড় হয়েছে। কাদের ভরসায় যাবে ওরা? আমি থাকলে আলাদা কথা। তোমরা ছোট ছেলে।

কী যে বলেন কাকিমা? আমরা নাকি এখনও ছোট। সেদিন খেজুরবাগানে মোষওয়ালাটাকে পল্টন আমি কীরকম পিটিয়েছিলাম জানেন না তো? সে কী! শুনিনি তো? তোমরা দু’জনে মারপিট করে বেড়ােচ্ছ নাকি? কী সাংঘাতিক!

তাই বলছিলাম দিদিরা সঙ্গে গেলে কোনও অসুবিধাই নেই।

তা হয়তো নেই। তবে কাকামণি রাগ করবেন। তা ছাড়া ওরা আমাকে ছেড়ে যাবে না। বিয়েবাড়ি বলে কথা। কত লোকজন আসবে। তার ঠিক কী? বিশেষ করে আমরা কখনও কেউ যাইনি ওখানে। কীরকম জায়গা তাও জানি না। এ অবস্থায় অত বড় মেয়েদের তোমাদের ভরসায় ছাড়া যায় না! তোমরা দু’বন্ধুতেই যাও। তোমার বাবাকে বলো উনি যেন তোমাদের দু’বন্ধুকে কাল ট্রেনে তুলে দিয়ে আসেন।

সেই ডাল। কাকামণি যখন নেই আর বিয়েও যখন হঠাৎ করেই ঠিক হয়ে গেছে, বিশেষ করে চিঠিও এসেছে দেরিতে, তখন কিছুই আর করবার নেই। দু’বন্ধুতেই যাওয়া যাক। সত্যি, কী মজাটাই না হবে।

গৌতম বলল, তা হলে আমরা কালই যাব কাকিমা?

হ্যাঁ। কালই যেতে হবে। কেন না পরশু তো বিয়ে। কাল তা হলে কোন গাড়িতে যাব?

সকালে গেলে তুফানে যেতে পারো। আর রাতের গাড়িতে যদি যাও তা হলে পঞ্জাব মেলে। দানাপুর এক্সপ্রেস, দিল্লি এক্সপ্রেস, জনতা এক্সপ্রেস যাতে খুশি যাওয়া যায়। তোমার বাবাকে বলবে, উনিই গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবেন তোমাদের।

গৌতম লাফিয়ে উঠল, হুর্ রে।

পল্টন বলল, তা হলে তুমি একবার চলো না মা ওদের বাড়িতে। ওর বাবাকে একটু বলে আসবে।

হ্যা। যাব বইকী! আমি না গেলে হয়?

এরপর গৌতম ও পল্টনকে নিয়ে পল্টনের মা ওদের বাড়িতে গেলেন।

গৌতমের বাবা সব শুনে বললেন, না না। কাকামণি যখন নেই তখন একেবারে ঘর ফাঁকা রেখে চলে যাওয়াটা ঠিক নয়। ওরা দু’বন্ধুতেই যাক। আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আমি নিজে গিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসব।

কোন গাড়িতে যাবে তা হলে ওরা? সকালের গাড়িতে গেলে দশটার মধ্যে হাওড়ায় পৌঁছতে হবে ওদের। দশটা কত-র যেন ট্রেন!

সকালের গাড়িতে কেন যাবে? পরশু যখন বিয়ে তখন রাতের গাড়িতেই যাওয়া ভাল। সকালের গাড়িতে গেলে সেই রাতদুপুরে স্টেশনে নেমে ঠিকানা খুঁজে বার করতে অসুবিধে হয়ে যাবে। রাতের গাড়িতে গেলে ভোর ভোর পৌঁছবে। সারাটা দিন সময়। এর মধ্যে আমিও দেখি না চেষ্টা করে ওদের কোনও রিজার্ভেশন পাই কি না।

অতএব রাতের গাড়িতেই যাওয়া ঠিক হল।

পল্টনকে নিয়ে ওর মা চলে গেলে গৌতমের মা বললেন, আমার বাপু ভয় করে। দু’-দুটো ছেলে অত দূরে একটা নতুন জায়গায় যাবে। সঙ্গে বড় কেউ নেই। তাতে কী হয়েছে? কত লোক যাচ্ছে। পাটনায় নামবে, এমন অনেক লোক পাওয়া যাবে গাড়িতে। আমি ওদের গাড়িতে উঠিয়ে সকলকে বলেকয়ে দেব। পাটনায় নেমে যদি ওরা জায়গা ঠিক করতে না পারে?

খুব পারবে। স্টেশনের সামনেই অটো, রিকশা যা চাইবে তাই পাবে। তাদের হাতে ঠিকানা লেখা কাগজ ধরিয়ে দিলে তারাই পৌঁছে দেবে বাড়িতে। তা হলে কোনও ভয় নেই বলছ?

ভয় কী? ছেলেপুলেদের যত ঘরে আটকে রাখবে ততই ওরা ঘরকুনো হবে। আমি তো চাইছিলুম ছেলেটা এবার থেকে একটু করে ডানামেলে উড়তে শিখুক।

সে রাতটা প্রায় আনন্দের স্বপ্ন দেখেই কাটল। বাবলিদির বিয়ের জন্য যে ঠিক, তা নয়। পল্টনের সঙ্গে পাটনা যাবার আনন্দে। পাটনায় যাবার শখ কী ওর কম? ওদের বাড়ি যে গোয়ালাটা দুধ দিতে আসে তারও বাড়ি পাটনায়। গঙ্গার ওপারে ছাপরা জেলায়। প্রত্যেক বছর কার্তিক পূর্ণিমায় ওদের ওখানে শোনপুরের মেলা বসে। খুব নামকরা মেলা। সবাই বলে হরিহর ছত্রের মেলা। তা ওর মুখেই গল্প শুনে পাটনায় যাবার ইচ্ছেটা ওর খুব। ওখানে পুনপুন নামে একটি নদী আছে। ছোট্ট নদী। কিন্তু বর্ষায় নাকি এমনই হয় যে সেই নদীই ভয়ংকরী হয়ে ওঠে। তখন তাকে ধরে রাখা দায়। বাঁধভেঙে প্লাবন বইয়ে দেয় চারদিকে। আর আছেন পতিত পাবনী মা গঙ্গা। বাবলিদির মুখেও পাটনা শহরের কথা, গঙ্গার কথা কত শুনেছে গৌতম।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাই যাবার তোড়জোড়।

ঝুমুটার অবশ্য মুখ ভার। সে দূরে দাঁড়িয়ে আড়চোখে দেখছে দাদাকে, আর চোখে চোখ পড়লেই মুখ ঘুরিয়ে এমনভাবে চলে যাচ্ছে যে ভাবটা এই, এঃ তুমি যাচ্ছ তো আমার কী? আমি তো যাচ্ছি না। আমার আনন্দ করতে বয়েই গেছে।

সন্ধেবেলা হাওড়া স্টেশনে এসে বাবা ওদের পঞ্জাব মেলেই তুলে দিলেন। পঞ্জাব মেল মানে থ্রি জিরো জিরো ফাইভ আপ অমৃতসর মেল। না, কোনও গাড়িতেই কোনও রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি। তাই একটা কুলিকে টাকা দিয়ে জানলার ধারে মুখোমুখি দুটো সিটের ব্যবস্থা করলেন।

পল্টন ও গৌতম এতেই খুশি। একটা রাত বই তো নয়। দিব্যি গল্প করতে করতে কেটে যাবে। ঘুমোবার জন্য রোজ বাড়ির বিছানা আছে। ট্রেনে উঠে আবার ঘুম কী? তা ছাড়া ঘুমোবেই যদি তো দেখবে কখন? রাতের গাড়িতে সাঁ সাঁ করে ছুটে যেতে যেতে কালো ধূসর প্রকৃতির চেহারা না দেখলে কি দেখা হল? তা ছাড়া আসবার সময় মা বলে দিয়েছেন মধুপুর, জসিডি পেরোবার পর নাকি ছোট বড় অনেক পাহাড় আর ঘন বনানী চোখে পড়ে। রাতের অন্ধকারে সেই বনানীর ছায়ারূপ তো দেখতেই হবে।

যদিও ওরা খেয়ে এসেছিল তবুও রাতের খাবার দু’জনদের বাড়ি থেকেই পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মায়েরা। পল্টনের মা টিফিন কৌটো ভরতি করে লুচি, আলুর দম আর বোঁদে দিয়েছিলেন। গৌতমের মা দিয়েছিলেন লুচি, হালুয়া আর সন্দেশ। সেই সঙ্গে ওয়াটার বটল ভরতি করে জল। কত খাবে খাও না কেন?