নয়নাগিরি অভিযান – ১৫

পনেরো

পল্টন ও গৌতম সাহসে ভর করে সেই অন্ধকার নির্জনে এগিয়ে চলল গিরিপথ ধরে। জঙ্গল খুব একটা ঘন না হলেও পাহাড়ের আকৃতি ভয়াবহ। ওরা ধীরে ধীরে সেই বড় ঝরনাটার কাছে এসে থমকে দাড়াল। দু’জন লোকের অস্পষ্ট কথা বলার আওয়াজ ওদের কানে এল। ওরা পাথরের খাঁজে পা দিয়ে একটু উচ্চস্থানে  উঠে দেখল একটি পাথরের চাতালে বসে দু’জন লোক নিশ্চিন্তে বিড়ি ফুঁকছে। ওরা দেখেই বুঝতে পারল এদের একজন হচ্ছে শংকর, অপরজন দয়াল। ওরা নিঃশব্দে চতুর বেড়ালের মতো ওদের অনেকটা কাছাকাছি এসে বড় একটা পাথর গড়িয়ে দিল ওদের দিকে।

.

আচমকা এই রকমটা হয়ে যাওয়ায় চমকে উঠল দু’জনে। কিন্তু সেই আধো অন্ধকারে ওরা বুঝতে পারল না কোথা থেকে এবং কীভাবে পড়ল পাথরটা। তাই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কে! কে ওখানে?

গৌতম বলল, আমি ত্রিবেদী। তোদের দু’জনকে ফাঁসির দড়িতে লটকাব বলে এখানে এসেছি।

ওরা দু’জনেই লাফিয়ে উঠেছে তখন। দু’জনের হাতেই চলে এসেছে রিভলভার।

পল্টন বলল, রিভলভার দেখিয়ে খুব একটা সুবিধে হবে না। অজস্র পুলিশ এই পাহাড়টাকে ঘিরে আছে। এখন ভাল চাও তো বলো, ট্রেনের কামরা থেকে পরশু রাতে ওই মেয়েটাকে চুরি করে তোমরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?

শংকর বলল, ওকে আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। এমনই জায়গায় পাচার করেছি যে ওকে আর ফিরে পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই পল্টন একটা পাথর ছুড়ে মারল একজনের মুখে। একেবারে মোক্ষম টিপ যাকে বলে। নাক-মুখ ফেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে লাগল সেই পাথরের ঘায়ে। পাথরটা লেগেছে দয়ালকে।

শংকর তখন আন্দাজে ভর করেই গুলি চালিয়েছে একটা। এই নির্জনে গুলির শব্দ ভয়ংকর শোনাল। তবে পাথরের আড়ালে থাকায় গুলি লাগল না কাউকেই। গৌতম বলল, কোথায় কতদূরে পাচার করেছিস তাকে?

শংকর বলল, যদি ক্ষমতা থাকে আমাকে অ্যারেস্ট করো। কোর্টে দাঁড়িয়ে যা বলবার বলব। ত্রিবেদীর গলার স্বর আমি চিনি। এই পাহাড় যদি অজস্র পুলিশে ঘিরে থাকে তা হলে তাদেরও আসতে বলো। আমি একাই মোকাবিলা করব তাদের।

গৌতম বলল, ওই দেখ তোর পিছনে যম এসে দাঁড়িয়েছে।

শংকর পিছু ফিরতেই পল্টন আর একটা পাথর ছুড়ে দিল শংকরের দিকে। কিন্তু গাথরটা তাকে লাগল না। তবে সেই মুহূর্তে সত্যি সত্যিই যমের মতো একজন এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল।

শংকর বলল, এ কী! তুই এখানে?

তোদের খোঁজে এলাম। তোরা ত্রিবেদীর ভ্যানে বোমা ছুড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস। ত্রিবেদী মরেনি। তোরাও এমন কাঁচা কাজ করলি যে আর কখনও ভুলেও তোরা পাটনা শহরের ধারেকাছে যেতে পারবি না। তোর বাবা নিজে চাইছেন পুলিশ তোকে অ্যারেস্ট করুক। গফুরকে মেরেছি। এখন আমার টার্গেট হল ডিসুজা। ওর বাড়িতে চড়াও হয়ে ওকে পেলাম না। তবে ওর চাকরবাকরদের মোচড় দিয়ে জানতে পারলাম তোরা নয়নাগিরি অথবা এইখানে লুকিয়ে আছিস। এখন তোদের দেখা পেলেও নয়নাগিরির খোঁজ পাইনি। বল সেই শয়তানের ঘাঁটিটা কোথায়?

শংকর বলল, বলব না।

বল তোরা একটি অসহায় মেয়েটাকে রাতদুপুরে ট্রেন থেকে নামিয়ে নিলি কেন?

ওই শয়তান মেয়েটা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিল।

তোদের ধারণা ভুল। আসলে পাপের ভারা এখন এত বেশি হয়েছে যে তোরা তোদের নিজেদের ছায়া দেখেও ভয় পাচ্ছিস।

শংকর বলল, দেখ নেলো, আমরা এখন মরিয়া। আমাদের সঙ্গে লাগতে আসিস না।

আসতুম না। যদি না তোরা এই মেয়েটার গায়ে হাত দিতিস। কত ছোট থেকে দেখেছি ওকে। তোরা কিনা শেষকালে ওর গায়ে হাত দিলি? লজ্জা করল না?

নেলো! পথ ছাড় বলছি।

শুনলি না একটু আগেই ওরা কী বলল তোকে? যম এসে দাঁড়িয়েছে। আমি সেই যম। যম কারও পথও ছাড়ে না, ফিরে যেতেও জানে না। তোর হাতে রিভলভার আছে। আমি রিভলভার সঙ্গে নিয়েও শুধু হাতে আছি। কেন বল তো?

ক্যা—ক্যা—কেন?

তোরই রিভলভার দিয়ে তোকে গুলি করে মারব বলে।

নেলোর কথা শেষ হওয়ামাত্রই ওর দিকে রিভলভার তাগ করল শংকর। নেলো চকিতে ওর হাতটা ধরে মট করে মটকে দিল একটু।

যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল শংকর।

ওর হাত থেকে রিভলভারটা তখন কেড়ে নিল নেলো। তারপর ওর দিকে সেটা তাগ করে বলল, গফুরকে ঠিক যেভাবে মেরেছিলুম, তোকেও সেইভাবেই মারব। তোদের দু’জনকেই।

শংকর বলল, আ-আ আমাকে ছেড়ে দে নেলো। আমার হাত ভেঙে দিয়েছিস তুই। এর চেয়ে কঠিন শাস্তি আর কী দিবি?

ওকে কোথায় রেখেছিস?

এই পাহাড়ের পিছন দিকে একটা গুহায়। আমাকে ক্ষমা কর ভাই। ছেড়ে দে এবারের মতো।

নেলো হাসল। বলল, একেবারেই ছেড়ে দেব। বলেই ট্রিগারে চাপ দিল ‘গুড়ুম’। আবার একটা চাপ। শংকরের দেহটা ছিটকে লাফিয়ে উঠল। তারপর পাথরের চটানে পড়ে স্থির হয়ে গেল একসময় সেই সঙ্গে আরও একটা গুলির শব্দ শোনা গেল। আর সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল নেলো।

ওরা ছুটে গিয়ে নেলোকে ধরতেই আবার একটা গুলি এসে লাগল নেলোর বুকে।

আহত দয়ালদা এইরকম অবস্থাতেও শত্রুর শেষ রাখল না। দুটি বুলেট খরচা করে মরণ কামড় দিল।

গৌতম তখন লাফিয়ে পড়েছে দয়ালের ওপর। ওর হাতটাকে পা দিয়ে টিপে ধরে কবজি শিথিল করে দিল।

দয়ালদা হেসে বলল, ওতে আর গুলিই নেই।

পল্টন তখন নেলো আর দয়ালদার হাত থেকে রিভলভার দুটো কেড়ে নিয়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী নেলো গৌতমকে বলল, দোস্ত ! একটু পানি পিয়াও। বড্ড জলতেষ্টা পেয়েছে।

গৌতম তখুনি ছুটে গেল ঝরনার কাছে। খুব সামান্য একটু জল ছির ছির করে পড়ছিল একদিকে। তাই থেকে এক আঁজলা জল এনে ওর মুখে দিতেই একটু দূরের দিকে আঙুল তুলে কী যেন দেখাল নেলো। তারপর জল খেয়ে আঃ করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল।

ওরা সেই ঝরনা পাথরের পিছন দিকের একটা মোচাকৃতি পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে কাকে যেন উঠতে দেখল তখন। যে উঠছে সে একটি মেয়ে। দেখেই মনে হল জীবন বিপন্ন করে প্রাণভয়ে পালাচ্ছে বেচারি। এবং এই মেয়ে দুলালি ছাড়া কেউ নয়।

ওরা এবড়ো খেবড়ো পাথরে পা দিয়ে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল সেখানে।

পল্টন বলল, দুলালি নেমে এসো। আমরা এসে গেছি। কোনও ভয় নেই তোমার, আমাদের শত্রুর, নিপাত গেছে।

দুলালি বলল, আমি নামতে পারব না। আমার হাত-পা কাঁপছে। গির পড়ি *তো মুঝে বচায়গা কৌন?

গৌতম বলল, ঠিক আছে। তুই যেমন আছিস থাক। একদম নড়াচড়া করবি

না। আমি এখুনি লোকজন ডেকে আনছি। পল্টন, তুই ততক্ষণ পাহারা দে ওকে। গৌতমকে অবশ্য বেশি দূরে যেতে হল না। খানিক যাবার পরই দেখল বজরঙ্গবাবা একদল লোক নিয়ে ওদের খোঁজে আসছেন। যারা আসছে তাদের কারও হাতে বন্দুক, কারও হাতে ভোজালি, কেউ বা লাঠি, বল্লমও নিয়েছে কেউ। আসলে গুলির শব্দ শুনেই সতর্ক হয়েছে সবাই এবং বজরঙ্গবাবার মুখে আরও কিছু শুনে তৈরি হয়ে এসেছে। এসেই যা দেখল তাতেই তো চক্ষুস্থির। একজনকে অর্ধমৃত এবং দু’জনের মৃতদেহ দেখে শিউরে উঠল সবাই। পল্টন আর গৌতম সব কথা খুলে বলল সকলকে।

দয়ালদার হাত-পা বেঁধে কয়েকজন টানতে টানতে তাকে নিয়ে গেল পাহাড়ের নীচে। মৃতদেহ অবশ্য ছুঁল না কেউ। পুলিশ এসে যা করবার করুক। ওরা সবাই মিলে তখন অসহায় দুলালিকে উদ্ধার করবার জন্য ছুটে গেল। গাছের ডালে, বড় পাথরে দড়ি বেঁধে কী কাণ্ড করে যে নামানো হল তাকে সে এক বিপজ্জনক ব্যাপার। তবুও যা হোক করে মেয়েটাকে উদ্ধার তো করা হল।

সবচেয়ে খুশি হল পল্টন। ও সযত্নে ধরে ধরে বজরঙ্গবাবার আশ্রমে নিয়ে চলল দুলালিকে। দুলালি এখন ক্ষুধায় তৃষ্ণায় পরিশ্রমে ক্লান্ত। খুবই অবসন্ন হয়ে পড়েছে তাই।

ওরা যখন আশ্রমে ফিরে এল চারদিক তখন নিশুতি হয়ে গেছে। অথচ রাত বেশি নয়, সবে সাড়ে সাতটা। কালীমায়ের মন্দিরে আরতির শঙ্খ-ঘণ্টা বাজছে। কিন্তু গোপা কই? কোথায় গেল মেয়েটা? না মন্দিরে, না সাধুর আশ্রমে, কোনওখানেই পাওয়া গেল না তাকে। বিপদের পর বিপদ আবার নতুন করে দেখা দিল।

একটি ছোট ছেলে কালীমন্দিরের সামনে দোকানে বসে ফুল বিক্রি করছিল। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করতে সে বলল, এক আদমি আয়া থা। টোপি ঔর চশমাবালা। ও লেকে ভাগা।

বজরঙ্গবাবা বহুত আদমি থা। লেকিন উনকো হাতমে রিভলভার থা, ইসি লিয়ে সব চুপ চাপ হো গিয়া।

বললেন, আউর আদমি নেহি থা হিয়া পর?

ও আদমি কৌন থা?

মুঝে না মালুম।

সব যখন ফাঁস হয়ে গেল তখন মুখ খুলল অনেকেই। সবাই বলল মেয়েটি বোধহয় আগন্তুককে চিনত। তাই ভয়ে লুকিয়ে পড়েছিল একটি থামের আড়ালে। যে এসেছিল সে সবার চোখের সামনে পকেটের শিশি থেকে কী একটা ওষুধ রুমালে মাখিয়ে নাকে চেপে ধরল মেয়েটার। তারপর সকলকে রিভলভার দেখিয়ে বলল, কিসিকো মাত বোল না। বলে তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল।

গৌতম বজরঙ্গবাবাকে বলল, এই আগন্তুক ডিসুজা ছাড়া কেউ নয়। আমি এখুনি নয়নাগিরি যাব। আপনারা দয়ালটাকে নজরে রাখুন। পুলিশে খবর দিন। দেখবেন ও যেন পালাতে না পারে।

পালাবে কী? দয়ালকে তখন পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছে স্থানীয় লোকেরা।

মন্দিরের সামনেই একটি টাঙ্গা ছিল। ওরা তাতে করেই বিন্ধ্যাচলে এল। সেখান থেকে বাসে মির্জাপুরে।

গৌতম পল্টনকে বলল, তুই দুলালিকে নিয়ে এখানকার জি আর পিতে চলে যা। সেখানে তোর তো ডায়েরি করাই আছে। তাই পুলিশকে গিয়ে সব কথা খুলে বল, আর পারিস তো কিছু পুলিশ সঙ্গে নিয়ে নয়নাগিরিতে চলে আয়।

দুলালি বলল, ভাইয়া আমি কিছুতেই থানা-পুলিশের ঝামেলায় যাব না। আমি তোমার সঙ্গে যাব। আমার দোস্ত বরং পুলিশে খবর দিক। তুম হামকো সাথ লে চলো।

পল্টন বলল, সেই ভাল। কেন না এই যাত্রায় আমার ভাগ্য যেভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে তাতে আমি আর কাউকেই সঙ্গে নিতে ভরসা পাচ্ছি না। তুই ওকে নিয়েই যা। তবু একজন সঙ্গী পাবি। আমি পুলিশ নিয়ে কখন যাব তার ঠিক কী। তা ছাড়া জি আর পি মানেই রেল পুলিশ। রেলের আওতার বাইরে আদৌ তারা যাবে কিনা তাই বা কে জানে?

তবুও তুই গিয়ে সব কথা খুলে বল। ওরা না গেলেও লোক্যাল পুলিশকে জানিয়ে দেবে সব কথা। আমিও যেতাম তোর সঙ্গে। কিন্তু আর এক মুহূর্ত দেরি করতে আমার মন চাইছে না। তা ছাড়া পুলিশ দেখলে ওরা হয়তো সতর্ক হয়ে যাবে! আবার আমাদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সাহায্যও দরকার। আমরা ততক্ষণে কোনও ক্লু পাই কি না দেখি। জ্যোৎস্না রাত, পথ চলার অসুবিধে খুব একটা হবে না। সারারাত ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরব চারদিক।

এই রাতদুপুরে ওই দুর্গ পাহাড়ে যেতে গিয়ে কোনও বিপদ ঘটাবি না তো? বিপদ যে কোনও মুহূর্তেই ঘটতে পারে।

তা আমি বলছিলাম কী, আর অযথা থানা-পুলিশ না করে আমরা তিনজনেই এক সঙ্গে গেলে কেমন হয়?

অতটা ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। এ পথে পরিবহনের অভাব নেই। পুলিশে খবর দিয়েই চলে আয় তুই। আর যদি পারিস তো পুলিশ সঙ্গে নিয়ে আসিস।

পল্টন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

ও চলে গেলে দুলালি বলল, দশ মিনিট ইন্তেজার করো না ভাইয়া। দোস্ত কো আনে দো।

গৌতম বলল, বেশ! দশ মিনিট অপেক্ষা করছি। অবশ্য এখুনি যে বাস পাব চুনারের তারও ঠিক নেই।

দশ মিনিটের জায়গায় কুড়ি মিনিট হয়ে গেল। তবুও পল্টন ফিরল না দেখে দুলালিকে নিয়ে গৌতম বারাণসীর বাসে চাপল। এই বাসই চুনার হয়ে বেনারস যাবে।

প্রায় ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগল বাসে। ওরা যখন চুনারে পৌঁছুল তখন চারদিকে জমাজমাট অন্ধকার।

গৌতম বলল, আজকের এই নৈশ অভিযান আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে করতে হবে এই কাজটুকু। ডিসুজাকে কোনওরকমে ফাঁদে ফেলতে পারলেই আমাদের অভিযান সফল হবে। তা ছাড়া গোপাকে উদ্ধার করতেই হবে।

জরুর হবে। ভাইয়া, তুমি যদি গোঁসা না করো তো একটা কথা বলি। কী কথা?

তোমাকে আর গোপাকে এক সঙ্গে দেখলে আমার খুব ভাল লাগে। তোমরা দু’জনেই খুব সুন্দর। তাই বলছিলাম কী—

থাক, আর বলতে হবে না। তুই কী বলবি তা আমি জানি। তুই যে একটা পাকলু মেয়ে তা আমি বেশ বুঝতে পারছি।

তা হলে তুমি গোপার জন্য এত করছ কেন?

কর্তব্যের খাতিরে। আমরা সবাই যে এখন একসূত্রে গাঁথা। বন্ধুর মতো। ওসব কথা থাক। চল আগে কোনও একটা হোটেলে দুটো খেয়ে নিই। খিদে পাচ্ছে খুব।

ওরা দু’জনে একটা হোটেলে বসে পেট ভরে মাংস-ভাত খেল। তারপর একজন বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালাকে ডেকে বলল চারদিক ভাল করে ঘুরিয়ে দিতে।

টাঙ্গাওয়ালা বলল, লেকিন দাদাবাবু এখন তো তোমরা গড় পর চড়তে পারবে না।

গৌতম বলল, কেন?

কিল্লা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সামকো পাঁচ বাজকে বাদ উধার কা খিড়কি বন্ধ হো যাতা।

তা হলে?

কিলা কি অন্দর যানে নেহি দেঙ্গে ও লোগ। লেকিন গঙ্গা কি কিনারে মে তো চলো।

গৌতম নকসা করে বলল, এই রাতদুপুরে গঙ্গার ধারে কোনও ভয় নেই তো? বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালা এক চোখ টিপে বলল, দাদাবাবু। আমার নাম আছে রহমত। যবতক আমি জিন্দা থাকব তবতক কারও সাধ্যি হবে না রহমতের সওয়ারির গায়ে হাত দেয়।

বেশ! তুমি কী নেবে বলো?

কিতনা টাইম ঘুমোগে তুম?

ধরো সারারাত।

রহমত অবাক চোখে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে। তারপর বলল, হাম দো ঘণ্টেসে জায়দা নেহি ঘুমায়েঙ্গে। পঁচিশ রুপিয়া লেগা। হ্যায় তুমহারা পাস? হ্যাঁ! চলো উস তরফ।

চাঁদনি রাতে পাথুরে রাস্তায় টগবগ টগবগ করে টাঙ্গা ছুটে চলল। পূর্ণিমার গোল চাঁদটা যেন আকাশ থেকেই হাতছানি দিয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল ওদের। জ্যোৎস্নালোকে চুনার দুর্গ ওদের কাছে ভয়বহ এবং বিভীষিকাময় বলে মনে হল। কোথাও কোনও গাছপালা নেই, কিছু নেই, শুধু পাথর আর পাথর। যেন পাথরের খাড়াই দেওয়াল একটা আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা গঙ্গার ধারে এসে মুগ্ধ এবং অভিভূত হয়ে গেল। তবু মনের মধ্যে রইল দারুণ একটা উৎকণ্ঠা।

রহমত ওদের দেখাতে লাগল এই পাহাড়ের উপরিভাগে যে দুর্গ আছে তার সঙ্গে গোপন সুড়ঙ্গপথে এই গঙ্গার সাথে প্রাচীন কালের যোগাযোগের নিদর্শনগুলো। ওরা তীক্ষ্ণ চোখে সব কিছু দেখল। কিন্তু সেখানে সন্দেহজনক কিছুই পেল না।

প্রায় ঘণ্টা দুই পরে রহমত বলল, আভি হামকো ছুট্টি দে দো। হামকো ঘর যানা হ্যায়।

গৌতম তিরিশটা টাকা রহমতের হাতে দিয়ে বলল, এই নাও।

রহমত বলল, হামকো পঁচিশ রুপিয়া চাহিয়ে।

পাঁচ টাকা বকশিশ দিলাম তোমাকে।

রহমত হেসে বলল, মেরা পাপ্পু মেহনত কা দাম লেতা বকশিশ নেহি। কিন্তু পাপ্পুর বাবা রহমতকে যদি আমরা চা খেতে দিই তা হলে? তব ভি নেহি।

গৌতম রহমতের কাছ থেকে দশ টাকা ফেরত নিয়ে পাঁচ টাকা দিল। রহমত বলল, এক বাত পুছেগা তুমকো?

কী কথা বলো?

এত রাতে তোমরা এখানে কী করতে এসেছ? তোমাদের বয়সি ছেলেমেয়ে রাত্তিরে এইখানে ঘুরেবেড়ালে পুলিশ তোমাদের পাকড়ে লিবে।

গৌতম বলল, দেখো রহমত, তোমাকে দেখেই বুঝেছি তুমি একজন সাচ্চা আদমি। তোমার কাছে লুকোব না, আমরা কিন্তু কোনও খারাপ মতলব নিয়ে এখানে আসিনি। এমনকী বেড়াতেও আসিনি এখানে। আমরা বিন্ধ্যাচল গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের দলের একটি মেয়েকে দুষ্টচক্রের লোকেরা অপহরণ করে। আমরা জানতে পেরেছি এইখানেই কোথাও এনে ওরা লুকিয়ে রেখেছে তাকে।

রহমত বলল, ইয়ে বাত? তো তুম পহলে কিঁউ নেহি বতায়া? তোমরা তো গলদ রাস্তায় চলে এসেছে।

এটা নয়নাগিরি নয় ?

ইয়ে নয়নাগিরি, চরণাদ্রি, চুনার। সব কুছ। উঠো উঠো জলদি উঠো। ওরা উঠে বসতেই টাঙ্গা ঘুরে গেল এই পাহাড়ের উলটো দিকে।

এক জায়গায় টাঙ্গা থামিয়ে রহমত বলল, থোড়া দূর পয়দাল চলা যাও। হাম রোড পর যা রহে। পোলিশবালে আনেসে হাম উধার ভেজ দেঙ্গে। তুম দোনো উধার নজর রাখো। ও রহেগা তো উধারই রহে গা।

ওরা রহমতের কথামতো টাঙ্গা থেকে নেমে সোজাপথ না-ধরে খাড়াই পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল। এক জায়গায় বড় একটি পাথরের আড়াল থেকে দেখল বেশ কিছু দূরে একটি গুহার সামনে একটি অ্যামবাসাডার দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সামনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ডিসুজা। তবে দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যাবার উপক্রম করছেন।

গৌতমের বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। ডিসুজা গোপাকে নিয়ে কোথাও পালাবার তাল করছেন না তো? গৌতম দুলালির কানের কাছে মুখ এনে চাপা গলায় বলল, তুই যেভাবেই হোক একবার মেইন রোডে চলে যা। গিয়ে রহমতকে খবর দে। ও নিশ্চয়ই লোকজন নিয়ে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে।

দুলালি বলল, আমি একা যাব ভাইয়া? পথ যে অনেক দূর। যদি আমাকে একা পেয়ে আবার কেউ চুরি করে নেয়?

গৌতম বলল, ঠিক বলেছিস। তুই বরং এক কাজ কর, এইখানেই কোথাও ঘাপটি মেরে থাক। আমি চুপি চুপি গিয়ে বাধা দেবার চেষ্টা করি ওকে। পল্টন পুলিশ নিয়ে এলে এদিকে পাঠিয়ে দিস।

তুমি কীভাবে যাবে ওখানে? চারদিক ফাঁকা। তুমি গেলেই ও দেখতে পাবে তোমাকে।

তবু যেতে হবে।

গৌতম সবে এক পা এগিয়েছে অমনি দেখল সেই গুহামুখের দরজার পাল্লা খুলে দু’জন লোক কাকে যেন পাঁজাকোলা করে নিয়ে এল। আসামাত্রই ডিসুজা তাকে কাঁধের ওপর শুইয়ে নিলেন। তারপর এক হাতে রিভলভার ধরে পাহাড়ের ঢালুতে নেমে চললেন হন হন করে।

লোকদুটো আবার গুহায় ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজাটা।

গৌতম তখন ওদের নাগাল পাবার জন্য প্রাণপণে ছুটছে। ডিসুজাও পাহাড়ের একটি বাঁকের আড়ালে। ও ছুটে ছুটে যখন সেই গুহামুখের কাছে এল তখন দেখল এটা একটা মোটর মেরামতির ঘাঁটি ছাড়া কিছুই নয়। ওপরে একটা সাইনবোর্ডও রয়েছে সেইরকম। অর্থাৎ লোকের চোখে ধুলো দেবার একটা সহজ উপায় মাত্র। তবে এটা যে একটা শয়তানের ঘাঁটি তা হয়তো অনেকেই জানে। না হলে রহমত এত সহজে এই ঠেকটা ওদের চিনিয়ে দিতে পারত না। সেই গুহামুখ পার হয়ে বাঁকের মুখে এসেই দেখল ডিসুজা রিভলভার হাতে গোপাকে কাঁধে নিয়ে এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে গঙ্গার দিকে চলেছে। কিন্তু মুশকিল হল এই যে, শুধুমাত্র গোপার জন্যই হাতের মুঠোয় পেয়েও ডিসুজাকে আক্রমণ করতে পারল না ও।

হঠাৎ একটা কালপ্যাঁচা এমন বিশ্রীভাবে কর্কশ ডাকে ডেকে উঠে উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে যে চমকে উঠলেন ডিসুজা। প্যাঁচাটা আর একবার ডাকতেই সেটাকে লক্ষ্য করে ‘ডিস্যুম’ করে গুলি করলেন একটা।

আর সেই মুহূর্তে গৌতম একটা ভয়াবহ চিৎকার করে উঠল, আ—আ আ—-।

থমকে দাঁড়ালেন ডিসুজা। ব্যাপারটা যে কী হল কিছু ভেবে পেলেন না। গুলি করলেন প্যাঁচাকে, কিন্তু তার প্রত্যুত্তরে মানুষের আর্তনাদ ভেসে আসে কী করে? অচৈতন্য গোপাকে শুইয়ে রেখে ব্যাপারটা কী হল দেখবার জন্য এগিয়ে আসতেই গৌতম একটি পাথরের খাঁজে সেট হয়ে দাঁড়াল। তারপর যেই না ডিসুজা এসে হাজির হলেন সেখানে অমনি সেই অন্ধকারের আড়াল থেকে একটা ল্যাং মারল ওঁকে। ডিসুজা কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন পাশের খাদে। এবার ওরই গলা দিয়ে একটা মরণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল—আ—আ—আ।

শয়তানের খেলা শেষ।

গৌতম ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল গোপার কাছে। তারপর ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে ধীর পায়ে নেমে এল গঙ্গার ধারে। বড় একটি পাথরের ওপর ওকে শুইয়ে পর পর কয়েকবার ওর চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিতেই চোখ মেলে তাকাল ও। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি কোথায়?

গৌতম বলল, তুমি আমি দু’জনেই এখন নয়নাগিরিতে। আর আমাদের কোনও ভয় নেই। আমাদের অভিযান সফল হয়েছে। এখন দু’চোখ মেলে গঙ্গার দৃশ্য দ্যাখো। এমন শোভ৷ কিন্তু কাশীতেও নেই।

গোপা আদুরে মেয়ের মতো বলল, লক্ষ্মীটি, তুমি কাশীর সঙ্গে কারও তুলনা কোরো না। প্লিজ।

গৌতম বলল, চলো, আমরা দু’জনে একটা নৌকায় চেপে গঙ্গার মাঝখান থেকে ঘুরে আসি। খুব ভাল লাগবে কিন্তু।

তাই কী হয়? তোমার বন্ধু খোঁজ করবে না? দুলালিই বা কী ভাববে? ওরা সব কোথায়?

ওরা এখানেই আছে। চলো ওঠা যাক।

গোপার একটি হাত ধরে গৌতম যখন ফিরে আবার উপক্রম করছে, তখনই দেখতে পেল একদল পুলিশ নিয়ে পল্টন আসছে লাফাতে লাফাতে। ওর সঙ্গে দুলালিও আছে।

দেখা হতেই পল্টন গৌতমকে এবং দুলালি গোপাকে জড়িয়ে ধরল।

পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, কাঁহা হ্যায় ও বদমাশ?

গৌতম আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, উপর।

তারপর গৌতম ওদের সকলকে নিয়ে ঠিক জায়গাটিতে এসে খাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে সকলকে বলল, ওই দেখুন।

খাদটা খুব একটা গভীর নয়। তবু মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভেঙে অবস্থা কাহিল হয়েছে ডিসুজার। মাথা ফেটে, নাকেমুখে আঘাত পেয়ে রক্তে যেন স্নান করেছে। অথচ পালাতেও পারছে না।

একদল পুলিশ সেই খাদে নেমে তুলে আনল ডিসুজাকে। তারপর ওপরে এনে হাতকড়া পরাল।

এরপর পুলিশের লোকেরা সেই গুহাচক্রে হানা দিয়ে পঞ্চাশটিরও বেশি ছেলেমেয়েকে উদ্ধার করল। আর সুন্দর একটি সরকারি রেস্ট হাউসে সে রাতে আশ্রয় পেল গৌতমরা। তবে ওরা কিন্তু না-ঘুমিয়ে সারারাত জেগে, জ্যোৎস্নালোকে এখানকার পার্বত্য প্রকৃতি ও নয়নাভিরাম গঙ্গার সৌন্দর্য উপভোগ করল।

পরদিন সকালে বিখ্যাত চুনার দুর্গ ঘুরে দেখল সেনাবাহিনীর লোকেদের সাথে। তারপর রহমতের টাঙ্গায় চেপে চারদিক ঘুরে, চিনামাটির ফুলদানি থেকে শুরু করে নানারকম কেনাকাটা করে আবার ফিরে এল বারাণসীতে।