নয়নাগিরি অভিযান – ১৪

চোদ্দো

বিকেলবেলা চা-টা খেয়ে সবাই এল দশাশ্বমেধ ঘাটে। প্রচুর জনসমাগমে ঘাট তখন জমজমাট। অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই ঘাটগুলোর ধারে ধারে কত যে মন্দির তার যেন লেখাজোখা নেই। সামনেই নীল জলের গঙ্গা। কী চমৎকার। সেই গঙ্গার জলে সারি সারি নৌকা আর বজরা বাঁধা আছে। মন্দিরে মন্দিরে ঘণ্টা বাজছে। কত ভিখারি বসে আছে ঘাটের সিঁড়িতে। কত হিপি ও অন্যান্য বিদেশিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর আছে অগণিত ভ্রমণার্থী।

পল্টন মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, এই কাশী! এত সুন্দর!

গোপা বলল, হ্যাঁ, এই কাশী। অপর নাম বারাণসী। এর আরও একটা নাম আছে। গৌতম বলল, কী নাম!

অবিমুক্তক্ষেত্র।

পল্টন বলল, দুলালিকে যদি ওরা চুরি না করত, তা হলে আজকের এই পরিবেশ আমাদের কাছে আরও রমণীয় হয়ে উঠত।

গৌতম বলল, আমার এত ভাল লেগেছে যে মনে হচ্ছে এখুনি বাড়িতে একটা টেলিগ্রাম করে সবাইকে ডাকিয়ে আনি।

পল্টন বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে। কিছু না হোক মাকে একবার আনতেই হবে। আমার মায়ের অনেক দিনের আশা কাশীতে আসবার। আচ্ছা, বিশ্বনাথের মন্দিরটা কোথায়?

সন্ধের পর নিয়ে যাব। আগে চলো আমরা ঘুরঘুট্টি বাবার সঙ্গে দেখা করি। ওরা পায়ে পায়ে রাণামহলের ঘাটের দিকে এগোল।

পল্টন বলল, এরকম কতগুলো ঘাট আছে এখানে?

চারশো একটি। রাজঘাট থেকে অসিঘাট পর্যন্ত। গঙ্গা-বরুণা-অসি তিন নিয়ে বারাণসী। বরুণা নদী সারনাথ গেলে দেখতে পাবে।

গৌতম বলল, এবারে কিছুই দেখা হবে না। পরের বার সবাইকে নিয়ে আসব, দল বেঁধে হইহই করে ঘুরব সকলে।

রাণামহলে ঘাটের সিঁড়িতে ঘুরঘুট্টিবাবা বসে বসে তপজপ করছিলেন। ওদের দেখেই হাসিমুখে হাত নেড়ে কাছে ডাকলেন।

গোপা গৌতম পল্টন তাঁর কাছে দিয়ে বসল। গোপা বাবাজির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল পল্টনের। তারপর আসল কথায় এল।

গৌতম বলল, এ পর্যন্ত আপনি কতদেশ ঘুরেছেন বাবাজি!

ও তো মুঝে ইয়াদ নেহি বাবা। বহুত তীরথ ঘুমা ম্যায়নে। ইয়ে বাত কিউ পুছ রহে তুম?

পল্টন বলল, বাবা চা খাবেন?

খিলানে সে খায়গা জরুর, চা নেহি পিয়েঙ্গে তো জীয়েঙ্গে ক্যায়সে? পল্টন চা আনতে চলে গেল।

গোপা বলল, আপনি নয়নাগিরি গেছেন বাবাজি?

নয়নাগিরি! ও নাম তো ম্যায়নে কভি নেহি শুনা। ক্যা হ্যায় হুঁয়া পর? তা জানি না। কয়েকজন লোক বলাবলি করছিল কি না তাই।

এমন সময় কোথা থেকে এক বাঙালি সাধু এসে জুটে গেলেন সেখানে। বললেন, এলাহাবাদে গঙ্গাযমুনা সঙ্গমের এপারে হল নৈনি। ওইখানে অনেক ছোট ছোট বুনো পাহাড় আছে। বিন্ধ্যাচলের শাখাপ্রশাখা। তা ছাড়া বিন্ধ্যাচলের কাছেই আছে কালীকুঁয়া, সীতাকুণ্ড, পর পর। নয়নাগিরি ওইখানেই কোথাও হবে!

হ্যাঁ।

তা হলে এক কাজ করো, কাল সকালের বাসেই তোমরা বিন্ধ্যাচলে যাও। ওখানে বিন্দুবাসিনী দেখে সীতাকুণ্ড কালীকুঁয়া দর্শন করো। তবে একটা কথা, ওসব জায়গা কিন্তু খুব খারাপ। চোরডাকাতের আড্ডা ওখানে। দুষ্কৃতীরা ওখানে এমনই সক্রিয় যে জলজ্যান্ত একটা মানুষকেও হাপিস করে দিতে পারে। তোমরা বিন্ধ্যাচলে গিয়েই ছত্রী ধর্মশালায় উঠবে। খুব ভদ্র ব্যবহার ওদের। তারপর কালীকুঁয়ায় গিয়ে বজরঙ্গবাবা নামে একজন সাধুর সঙ্গে দেখা করবে। উনিই তোমাদের বলে দেবেন নয়নাগিরি কোথায়। তবে আমার মনে হয় ওইখানেই আশেপাশে হবে।

পল্টন তখন চা নিয়ে এসেছে। ওর ভাগেরটা সেই আগন্তুক সাধুকে দিয়ে ও নিজের জন্য এক কাপ আনতে গেল। চা খাওয়া হলে ঘুরঘুট্টিবাবাকে প্রণাম করে সন্ধে পর্যন্ত গঙ্গাবক্ষে ঘুরে বেড়াল একটা বজরা ভাড়া নিয়ে। এরপর অন্নপূর্ণা ও বিশ্বনাথ দর্শন করে ওরা থানায় এসে রিপোর্ট করল কালকের ঘটনাটা।

পুলিশ অফিসার সব শুনে যা বললেন তা হল এই উত্তরপ্রদেশের আয়তন দু’ লক্ষ চুরানব্বুই হাজার চারশো তেরো স্কোয়ার কিমি। এক বিশাল এলাকা। এখানকার ধারেকাছে নয়নাগিরি নামে কোনও পাহাড় আছে কি না তাঁদের জানা নেই। তা ছাড়া আদৌ ওরা দুলালিকে নয়নাগিরি নিয়ে গেছে কি না তাই কে জানে? বা ওই একই দল যে ওই কাজ করেছে তারই বা প্রমাণ কী?

গোপা বলল, তা হলে এক্ষেত্রে কি আপনাদের কিছুই করণীয় নেই? নেহি। বারাণসী পুলিশ কুছ নেহি কিয়েগা। ইয়ে বিহার-পুলিশ ঔর রেলওয়ে-পুলিশ কা কাম। হামারা কাম স্রেফ তুমকো অ্যারেস্ট করনা।

অ্যারেস্ট করবেন? আমাদের অপরাধ?

ও লেড়কিকো সাথ লেকে কৌন আয়া থা? পল্টন বলল, আমি।

অন্দর ঘুসো। বলে প্রায় ধাক্কা দিয়েই পল্টনকে লকআপে পুরে দিল পুলিশের লোকেরা।

পল্টনের চোখে তখন জল এসে গেছে।

পুলিশ বলল, এটা একটা নাবালিকা অপহরণের কেস।

গোপা বলল, কিন্তু মেয়েটির তো কেউ কোথাও নেই। স্বেচ্ছায় এসেছিল সে। আমরা কৃতজ্ঞতার নিদর্শন হিসেবে তাকে আমাদের পরিবারের মধ্যে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলাম।

ও হামলোগ নেহি সমঝে গা। মি. ত্রিবেদীকা রিপোর্ট মিলনেসে তব ছোড়ে গা। নেহি তো কোর্ট মে ভেজেঙ্গে কানুন মোতাবিক।

ঠালা সামলাও। অপমানে দুঃখে রাগে কী যে করবে পল্টন কিছু ঠিক করতে পারল না। হিতে বিপরীত একেই বলে।

গোপা ও গৌতম তখুনি ছুটল বাড়িতে। ওর মা এই দুঃসংবাদ পেয়েই একে ওকে তাকে ধরে অনেক চেষ্টা করলেন পল্টনকে ছাড়াবার। কিন্তু না, পুলিশ কোনও অবস্থাতেই ওকে জামিন দিতে রাজি হল না। আবার নতুন করে একটা দুশ্চিন্তার মেঘ ঘনিয়ে এল সকলের মনে।

সারারাত ঘুম হল না কারও।

গোপা আর গৌতম দু’জনেই পাটনায় ফোন করে সত্যসুন্দরবাবুকে পল্টনের অ্যারেস্ট হওয়ার খবরটা জানিয়ে দিল। এবং এও বলল এই ব্যাপারে মি. ত্রিবেদীকে একটু সাহায্য করতে।

অপহৃতা দুলালির খোঁজে বিন্ধ্যাচলে যাওয়া মাথায় উঠল ওদের। এখন থানা-পুলিশ কোর্ট-কাছারিতে জড়িয়ে পড়লে আরও অনেক কিছুই মাথায় উঠবে। আবার বিন্ধ্যাচলে গেলেই যে নয়নাগিরি যেতে পারবে তারও কোনও মানে নেই। তবু মনের ভেতরটা কেন কে জানে বার বার বলছে মেয়েটির খোঁজে একবার অন্তত যাওয়া উচিত। নয়নাগিরির খোঁজ পেলে শুধু দুলালি নয়, আরও অনেকের অনেক দুলালিরই মান রক্ষা হবে।

ভোরবেলা পুলিশ এসে পৌঁছে দিয়ে গেল পল্টনকে। মি. ত্রিবেদী সত্যসুন্দরবাবুর রিপোর্ট অনুযায়ী এখানকার থানায় বিশদ জানিয়েছেন। এবং এও জানিয়েছেন কাল রাতে ডিসুজার লোকেরা নাকি প্রাণনাশের চেষ্টা করেছিল মি. ত্রিবেদীর। শংকর, দয়াল এবং ডিসুজার নামে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই তিন কুখ্যাত শয়তান সম্ভবত উত্তরপ্রদেশেই গা ঢাকা দিয়েছে কোথাও। তা সে নয়নাগিরিতেই হোক বা যেখানেই হোক।

এখানকার পুলিশকেও তাই সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেছেন তিনি! পল্টনকে ফিরে পেয়ে আনন্দে অধীর হয়ে উঠল গৌতম।

পল্টন বলল, এখন আনন্দ প্রকাশের সময় নয়। যেভাবেই হোক আগে নয়নাগিরিতেই যাই চল।

গোপার মা বললেন, সেটা আবার কোথায়?

তা আমরাও জানি না। তবে এক সাধুর মুখে শুনেছি ওটা বিন্ধ্যাচলের কাছাকাছি। আমরা এখুনি যাব সেখানে।

কিন্তু যদি তোমাদের কোনও বিপদ হয়?

হোক। তবু যাব। তা ছাড়া দুলালিকে যদি আমাদেরই একজন বলে মনে করি তা হলে এ বিপদ তো আমাদেরই। বিশেষ করে মেয়েটি আমাদের ভরসাতেই তার দেশ ছেড়ে এসেছিল।

তবু আমার ভয় করে বাবা।

গৌতম বলল, ভয় করলেই ভয়। ভয় না পেলেই জয়। তা ছাড়া আপনার মেয়ের জন্যও তো আমরা জীবন বিপন্ন করে বিপদের ঝুঁকি নিয়েছিলাম। পল্টনের ব্যাপারটা একবার চিন্তা করে দেখুন তো?

মা এরপরে আর কোনও কথাই বললেন না। সঙ্গে সঙ্গে স্টোভ ধরিয়ে ওদের জলখাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন।

পল্টন আর গৌতম যাবার জন্য তৈরি হতেই গোপা বলল, আমিও যাব। মা বললেন, তুই কোথায় যাবি?

আমি যাবই।

গৌতম বলল, না গোপা। তোমার যাওয়া উপযুক্ত মনে করছি না আমরা। কীভাবে তোমাকে রক্ষা করেছিলাম বলো তো?

জানি। তবে আমি যদি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে না পড়তাম তা হলে কি পারতে আমাকে উদ্ধার করতে? ওই শয়তানদের উপযুক্ত শিক্ষা আমিই দেব। তোমরা দু’জনে শুধু আমার পাশে থাকবে। তারপর যা করবার করব আমি। তবে যাবার আগে—।

যাবার আগে কী?

এক মিনিট বসো। আমি এখনি আসছি।

গোপা কাউকে কোনও কথা না বলে তর তর করে নেমে গেল নীচে। অনেক পরে যখন সে ফিরে এল তখন ওর বেশ খুশি খুশি মুখ। আর চেহারাতেও পরিবর্তন হয়েছে অনেক। ওর এতদিনের লম্বা বেণীটাকে কেটে চাইনিজ কাট দিয়েছে চুলে। কেমন যেন একটা গোলাপি রঙের স্কার্ট পরে এসেছে কোনও এক বান্ধবীর কাছ থেকে চেয়ে। কী স্মার্ট যে দেখাচ্ছে ওকে তা বলবার নয়। এসেই বলল, শোনো, আমাদের বিন্ধ্যাচলে যাবার একটা ব্যবস্থা করে এলাম। বাস ধরবার জন্য সেই ময়দাগিনে ছুটতে হবে না। গোধূলিয়ার মোড় থেকে একটা ট্যুরিস্ট বাস ছাড়ছে চুনার বিন্ধ্যাচলের। আমরা সেই বাসেই যাব। ওরা আগে বিন্ধ্যাচল গিয়ে পরে চুনার যাবে। লাক্সারি বাস। আমরা বিন্ধ্যাচলে নেমে ওই বাস ছেড়ে দেব।

কত করে ভাড়া নেবে কিছু জেনেছ?

হ্যাঁ। আপ-ডাউনের ভাড়া পঞ্চাশ টাকা। আমাদের ত্রিশ টাকা করে দিলেই চলবে। এখুনি ছাড়বে বাস। এসো।

গোপা, গৌতম, পল্টন মাকে প্রণাম করে বিদায় নিল। মা শুধু ম্লান মুখে একবার ভগবানকে ডাকলেন, বাবা বিশ্বনাথ ওদের রক্ষা কোরো।

ওরা খুব জোরে পথ হেঁটে গোধূলিয়ার মোড়ে এল। বাস তখন ছাড়ব ছাড়ব করছে। বোধহয় ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই বিন্ধ্যাচলে পৌঁছে গেল ওরা। সেখানে তখন মন্দিরে পুজো দেবার দারুণ ভিড়। সমস্ত যাত্রীদের পূজাপাঠ শেষ হলে তবেই ছাড়বে বাস। অথচ এদের আর ধৈর্য নেই।

ছোট্ট একটি পাহাড়ের ওপর মা বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির। একান্নটি সতীপীঠের অন্তর্গত একটি পীঠ। তাই মহিমা এখানে খুব। এই পাহাড়ে কোনও গাছপালা নেই। শুধু ঘরবাড়ি আর দোকানপত্তর।

প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি হয়ে গেল এখানে। তারপর বাস এল সীতাকুণ্ডে। ঘন জঙ্গলে ভরা একটি পাহাড়ের পাদদেশে বাস থামতেই নেমে পড়ল যাত্রীরা। এইখান থেকেই পাহাড়ের মাথার ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে কালীকুঁয়ায়।

অতএব শুরু হল পর্বতারোহণ। পাহাড়ের ওপরে ওঠার ভাল ব্যবস্থা আছে। তবে অসংখ্য হনুমানের উপদ্রব এখানে। ওরা দলবদ্ধ ছিল তাই হনুমানগুলো ওদের আক্রমণ করল না। শুধু দাঁতমুখ খিঁচিয়েই ছেড়ে দিল।

সীতাকুণ্ডে একটি ঝরনা আছে। আর আছে একটি সাধুর আশ্রম। ওরা সহযাত্রীদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেই আশ্রমে বসে সাধুদের সঙ্গে গল্প জমাল। তারপর ঝরনার জল খেল পয়সা দিয়ে। একজন সাধুবাবা লোটা ডুবিয়ে জল খাওয়ালেন ওদের। এই কুণ্ড কোনও যাত্রীকে স্পর্শ করতে দেন না সাধুরা।

জলটল খেয়ে ওরা একজন সাধুকে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বাবা, এই যে পাহাড় এর নাম কী?

বিন্ধ্যাচল। অষ্টভূজা ভি কহা যাতা হ্যায়।

তা হলে নয়নাগিরিটা

কোথায়?

ও মুঝে মালুম নেহি।

এখানে বজরঙ্গবাবা নামে কেউ আছেন?

হাঁ হাঁ। কালীকুঁয়া চলা যাও। হুঁয়া মিল যায়ে গা।

ওরা আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে চলল। কিছু পথ যাবার পরই দেখল এক জায়গায় একটি সুবৃহৎ ঝরনা রয়েছে। দেখেই মনে হল বর্ষায় এর রূপ ভয়ংকর। এখন জলহীন হলেও তখন এখানে ঝরনা নয়, জলপ্রপাত হয়। বন-জঙ্গলে ভরা এখানকার চারদিক।

গোপা বলল, আমার মনে হয় আমরা ঠিক জায়গাতেই এসেছি।

গৌতম বলল, তুমি কি বলতে চাও এইটাই, এটা না হলেও এর ধারে কাছেই হবে।

নয়নাগিরি?

ওরা যখন এই সব আলোচনা করছে তেমন সময় জঙ্গলের ভেতর থেকে জটাধারী এক সন্ন্যাসী লোটা হাতে বেরিয়ে এলেন। এসেই বাজখাঁই গলায় বললেন, এ! তুম সব হিয়া ক্যা করতে হো?

আমরা বেড়াতে এসেছি এখানে।

ইধার মাত ঠারো। কালীকুঁয়া চলা যাও।

আামরা কালীকুঁয়াই যাচ্ছি, ওখানে বজরঙ্গবাবার সঙ্গে দেখা করতে।

বজরঙ্গবাবা? বজরঙ্গবাবা তো ম্যায় হুঁ। মেরা নাম কিনোনে বতায়া তুমকো? বেনারসের এক সাধুবাবা।

সমঝ গিয়া। ও বঙ্গালিবাবা প্রেমদাসনে বতায়া তুমকো। বোলো ক্যা মতলব? গৌতম বলতে যাচ্ছিল।

বজরঙ্গবাবা বললেন, হিয়া নেহি। আশ্রম পর চলো।

ওরা যাবার পথে এক অন্ধকার গুহায় অষ্টভূজার মূর্তি দর্শন করল। সে কী অন্ধকার। তায় আবার মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকতে হয়। ভয়ও লাগে। তারপর পাহাড় থেকে নেমে পাদদেশে কালীকুঁয়ায় এল। এক ভয়ংকরী দেবী হাঁ করে আছেন সেখানকার মন্দিরে। সেকালে ভাকাতরা নাকি নরবলি দিয়ে সেই রক্ত এই দেবীর হাঁ মুখে ঢেলে দিত। দেবী যদি সেই রক্ত পান করতেন, তবেই ডাকাতরা যেত ডাকাতি করতে, আর যদি সেই রক্ত দেবীর মুখ দিয়ে গল গল করে বেরিয়ে আসত, তা হলে আর ভয়ে যেত না। উঠল।

শুনে গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে বজরঙ্গবাবা বললেন, আগে তো এখানে মহারণ্য ছিল। বিশ পঁচিশ বছর আগেও এখানে যেসব ডাকাতরা ছিল, তারাও ছিল মারাত্মক। এখনও এখানে চোরডাকাত নেহাত কম নেই। বেশ কয়েক বছর আগে একবার বিকেলের দিকে মোটর বাইকে চেপে এক ভদ্রলোক এলেন এখানে পুজো দিতে। কোনও যাত্রী নেই। নির্জন চারদিক। সঙ্গে বহুরানি আর চার-পাঁচ সাল কি উমরের এক লেড়কা ছিল। তা ওদের মন্দিরে রেখে পুজোর ডালি কিনতে গেলেন ভদ্রলোক। ফিরে এসে দেখলেন কেউ নেই। মন্দিরের পূজারি সাধুরা বললেন, তু ঘর চলা যা বেটা, তেরা বহু-বাচ্চা নেহি মিলেগা। তা সেই ভদ্রলোক তো খুব কান্নাকাটি করলেন। তারপর পুজোর ডালি নিয়ে মোটর বাইক চেপে যেমন এসেছিলেন তেমনি চলে গেলেন। খানিক বাদেই হল কী এই সমস্ত এলাকাটা মিলিটারিতে ঘিরে ফেলল। আসলে ভদ্রলোক ছিলেন সেনাবাহিনীর এক পদস্থ অফিসার। সেটা কেউ জানত না, তাই ভুল জায়গাতেই হাত দিয়ে ফেলেছিল। তা এখানে যত পাণ্ডা আর সাধু ছিল সব ক’টাকে ধরে তখন সে কী মার। মারের চোটে তারা যখন সত্যিকথা বলল তখন দেখা গেল শিশুটিকে গলাটিপে মেরে এক জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। আর মহিলার গা থেকে গয়নাগাটি নেবার জন্য তাকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। সেই রাতে আমি এখানে ছিলাম না, তাই বেঁচে গেছি। না হলে এখানে যে যেখানে ছিল সবাইকে গুলি করে মেরেছিল তারা। একজনও প্রাণে বাঁচেনি। সেই এক রাতেই সমস্ত ডাকাতকে নির্মূল করে দিয়েছিল। কতদিন যে কার্ফু ছিল তার ঠিক নেই। পরে অবশ্য আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার অপরাধে সেই অফিসারকে সাসপেন্ড করেন কেন্দ্রীয় সরকার। এরপর মাঝে বেশ কয়েক বছর শান্ত ছিল জায়গাটা। আবার নতুন করে দুষ্টচক্র দানা বাঁধছে। বলেন কী!

এখন তোমরা বলো আমার কাছে কী জন্য এসেছ, ক্যা জাননে চাতা হ্যায় তুম?

আপনি তো দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে আছেন, বলতে পারেন নয়নাগিরিটা কোথায়?

বজরঙ্গবাবা চমকে উঠলেন। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল। ভয়ে নয়। এক অশুভ ইঙ্গিত পেয়ে। বললেন, তুমহারা কোঈ বিছোড় গিয়া?

পল্টন বলল, আপনি কী করে জানলেন বাবা?

বজরঙ্গবাবা হাসলেন, যব তুমনে নয়নাগিরিকা নাম পুছা তব হামে মালুম হো গিয়া। ও পাপ কা পীঠস্থান।

আমাদের একটি মেয়ে চুরি হয়ে গেছে। আমরা কোনওরকমে জানতে পেরেছি ওকে নয়নাগিরিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অথচ নয়নাগিরি যে কোথায় তা কেউ জানে না। তাই বলতেও পারছে না কেউ।

নয়নাগিরি নজদিকমেই হ্যায়।

গোপা বলল, বলুন না বাবা কোনখানে?

তুম উধার মাত যাও বেটি।

আমরা তিনজনেই যাব।

তুম বহুতই খুবসুরত লেড়কি। উধার তুমকো যানা ঠিক নেহি।

গৌতম বলল, ও না গেলেও আমাদের যেতেই হবে

। ফায়দা ক্যা। ও নেহি মিলেগা তুমকো।

তাঁর নিশ্চিত ধারণা দেখে ভয় পেয়ে গেল ওরা। তবে কি সত্যিই মেয়েটাকে উদ্ধার করা যাবে না? বজরঙ্গবাবা বললেন, ক্যা বিগড় গয়া তুমহারা সাচমুচ বতাও।

বজরঙ্গবাবার কথায় আশার আলো দেখতে পেলেও গৌতম আর পল্টন তখন সব কথা খুলে বলল বজরঙ্গবাবাকে। সব শুনে বজরঙ্গবাবা কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তারপর বললন, ও লেড়কি কাঁহা লোপাট হুয়া থা?

ঠিক বলতে পারব না। তবে বক্সার ও মুঘলসরাইয়ের মধ্যে।

কৌন সা গাড়ি থা?

ভাগলপুর বোম্বাই এক্সপ্রেস।

সাধুবাবা বললেন, ও লেড়কি মিল যায়ে গা।

আপনি কী করে জানলেন বাবাজি?

পাহাড় পর যাঁহা তুমহারা সাথ মুলাকাত হুয়া উধার দোনো আদমিকা বাতচিত শুনা। ও তুমহারে বারে মে কহতা থা। মালুম হোতা ওহি আদমিনে চুরায়া ও লেড়কি কো।

গৌতম বলল, ওই জঙ্গলে ওরা কী করছিল?

ও লোগ ও সি ত্রিবেদীকো মারনে গিয়া। পুলিশ পিছে পড়া তো ভাগকে চলা আয়া হিয়া পর।

গৌতম বলল, তা হলে তো এখনি গিয়ে আমরা পুলিশে খবর দিতে পারি। অ্যায়শা বুরবাকি কাম না করো। পহলে ও লেড়কি কা জানমান বাঁচাও, উসকে বাদ যো কুছ করনা হ্যায় করো। আভি সাম হোনে বালে। হামারা আশ্রমমে এক রাত আরাম করো। কাল সবেরে নয়নাগিরি চলা যাও। নয়নাগিরিটা কোথায়?

বজরঙ্গবালা বললেন, তুম চুনার গিয়া থা?

না।

ওই পর্বতকা নাম চরণাগড়। দূর সে এক চরণকা মাফিক নজর আতি হই। চরণাগড় সে চুনার হো গয়া। লেকিন রাজা ভর্তৃহরি নে ওই পর্বতপর যব কিলা বনায়া থা তব উসকা নাম থা নয়নাগিরি। এরপর বাবাজি আরও যা বললেন তাতে বোঝা গেল কারও মতে ওই পর্বতের প্রাকৃতিক অবস্থান চরণের মতো, কারও বা মতে নয়নের মতো। প্রাচীনকালে তাই ওই পর্বতের নাম ছিল নয়নাগিরি। এখন ও নাম কেউ জানেও না, বলেও না। এইখানে পাহাড়ের গায়ে গুপ্তযুগের একটি শিলালিপি আছে। পাহাড়ের ওপর যে দুর্গ আছে সেটি এখন সেনাবাহিনীর দখলে। এই পাহাড়ের পিছনদিকে বয়ে চলেছেন পুণ্যসলিলা ভাগীরথী। পাহাড়ের ওপর থেকে গঙ্গার দৃশ্য দেখলে মন যেন ভরে যায়। প্রাচীনকালে এই পাহাড়ের সঙ্গে গঙ্গার মধ্যে অনেকগুলি সুড়ঙ্গপথ ছিল। তারই একটির মধ্যে দুষ্কৃতীদের আস্তানা। ওরা ওদের কাজের সুবিধার জন্য সাংকেতিক হিসাবে প্রাচীন নামটিই বেছে নেয়।

শুনে গৌতম বলল, সে কী! সেনাবাহিনীর লোকেরা বাধা দেয় না?

না। তার কারণ হয় তাদের কারও সঙ্গে ওই দুষ্কৃতীদের কোনও গোপন আঁতাত আছে অথবা ব্যাপারটাই তারা জানে না।

গৌতম বলল, আমরা তা হলে ট্যুরিস্টদের দলে মিশে কাল সকালে ওখানে অভিযান চালাব। তবে আজ একবার জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে খুঁজে দেখব ওই দুই পলাতককে। মনে হচ্ছে ওরা শংকর ও দয়াল ছাড়া অন্য কেউ নয়।

বজরঙ্গবাবা বললেন, যো তুমহারা মর্জি ওহি করো। লেকিন লেড়কিকো লে যাও মাত।

তখন সন্ধে হয়ে আসছে। গৌতম ও পল্টন গোপাকে সাধুর আশ্রমে রেখে দু’জনে দুটো বল্লম নিয়ে আবার পাহাড়ে উঠল।

গোপা ওদের সঙ্গে না-গেলেও লোকজনের আনাগোনা দেখতে কালীকুঁয়ার মন্দিরের চাতালে বসল। পাহাড়ি এলাকা হলেও এখানে বিন্ধ্যাচল থেকে অনেক লোকজন আসে পুজো দিতে। একদল হনুমান চারদিকে প্রহরীর মতো বসে আছে। তারা যাত্রীদের কাছ থেকে হাত পেতে বাদাম, চানা, কলা ইত্যাদি নিচ্ছে। গোপা বসে বসে এই সব দেখতে লাগল।

এমন সময় হঠাৎ সেখানে একটা অ্যামবাসাডার এসে থামল। গাড়ি থেকে যিনি নামলেন তাঁকে দেখেই ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল ওর! সে কোনওরকমে উঠে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল একটা থামের আড়ালে। এই সময় গৌতম ও পল্টন কাছে থাকলে ও এতটা ভয় পেত না। ও সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেই কেমন যেন একটা বিপদের পদধ্বনি শুনতে পেল। ও দেখল লোকটা মন্দিরের দিকেই এগিয়ে আসছে।