বারো
কাল সারারাত ঘুম হয়নি। দুপুরবেলা তাই অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল পল্টন। বিকেলে যখন ঘুম থেকে উঠল, শরীর তখন অনেক ঝরঝরে। কোনও ক্লান্তিবোধ আর নেই।
কাকুমণি অন্যের মুখে সব কিছু শুনলেও ওর মুখেও আবার নতুন করে শুনলেন সব। শুনে বললেন, তুমি যে মেয়েটির কথা বলছ ওকে আমি চিনি। খুব ছোট থেকেই ভিক্ষে করতে দেখছি ওকে। তা ও যদি সত্যি সত্যিই কোনও গেরস্থ বাড়িতে থাকতে চায় তা হলে আমিই ওকে থাকতে দিতে পারি। বাবলির বিয়ে হয়ে গেল। বাবা চলে গেলেন। ঘর তো আমার ফাঁকা। ছেলে নেই যে তার একটা বিয়ে দিয়ে বউ নিয়ে আসব। এই অবস্থায় আমি বাইরে থাকলে তোমার কাকিমার একা থাকতে অসহ্য লাগবে। অতএব মেয়েটিকে পেলে কিন্তু মন্দ হয় না।
পল্টন বলল, আপনার এখানে স্থান পেলে তো ওর পক্ষেও খুব ভাল হয়। কেন না এখানকার গঙ্গা এবং পাটনা শহর দুটোর কোনওটাকেই ছেড়ে থাকতে পারবে না ও।
কাকুমণি বললেন, আচ্ছা, ওকে এখানে আনার ব্যবস্থা করছি।
হিতৈষী কয়েকজন ছিলেন। তাঁরা সব শুনে বললেন, আনছ আনো, তবে কিনা ওইসব মেয়েকে পোষ মানানো বড়ই কঠিন ব্যাপার। কোনওদিন হয়তো চুরিচামারি করে পালাবে। না হলে বাইরের চোরডাকাতকে ঘরের সম্পত্তির কথা বলে দেবে। তা ছাড়া এই তো একটা মেয়েকে দু’দিনের জন্য রেখে কী কাণ্ড। আবার সেই কাজ করবে?
কাকুমণি এবার ভয় পেয়ে গেলেন। বললেন, তা অবশ্য ঠিক। শেষকালে আবার নতুন করে কোন ঝামেলা দেখা দেয় তা কে জানে?
পল্টন বলল, আবার কী ঝামেলা দেখা দেবে? আসল ঝামেলা যারা করত তাদের পাণ্ডা তো মরেছে। আর ও মেয়েও রাস্তার মেয়ে। ওকে কেউ বিরক্ত করলে সেও ছেড়ে কথা বলবে না।
তবুও আমাদের মতে ও পাপ ঘরে না-ঢোকানোই ভাল।
পল্টন বলল, বেশ। আমিই তা হলে ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাব। ও আমার মায়ের কাছেই থাকবে।
কাকুমণি বললেন, সেটা হলে তো খুবই ভাল হয়। তবে কি না তোমার মুখে যা শুনলাম তাতে ও যেতে চাইবে কি?
না যায় কী আর করব? চেষ্টা করব ওর ভাল করবার।
এরপর সন্ধে পর্যন্ত আরও অনেক লোকজন এল। কত কথাবার্তা হল। এই আকস্মিক বিপদের জন্য সহানুভূতি জানালেন অনেকে। সান্ত্বনা দিলেন। আগামীকাল বাবলিদির বউভাত। অথচ কী করে যে কী করবেন সত্যবাবু তা ভেবে পেলেন না। যদিও এখন আর তাঁর করণীয় কিছুই নেই। বরপক্ষের ওরা বলেই গেছে ব্যাপারটা ওরাই সেরে নেবে। তবুও মন কী মানে?
সন্ধের পরে সত্যবাবুর সেই ছাত্রটি এল, যে কিনা ওদের টাকা দিয়েছিল এবং যাদের বাড়ি টেলিফোন আছে।
সত্যবাবু বললেন, দিবাকর! তুমি একটু বেনারসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পার? ছেলেমেয়ে দুটো সেই ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে চলে গেল, কীভাবে পৌঁছুল না পৌঁছুল কিছুই জানতে পারলুম না। একবার দেখো না চেষ্টা করে, যদি লাইন পাওয়া যায়?
দেখছি। তবে বেনারসের লাইন খুব ডিসটার্ব করছে ক’দিন ধরে। পল্টন বলল, আমিও যাব তোমাদের বাড়ি। যদি লাইন পাওয়া যায়, তা হলে গৌতমের সঙ্গে কথা বলব একটু।
সত্যবাবু বললেন, বেশ তো যাও। তারপর দিবাকরকে বললেন, ওকে বরং তোমাদের বাড়িই রেখে দাও। আর এখানে পাঠিয়ে কাজ নেই। কাল বাবলির বউভাতে নিয়ে যেয়ো তোমাদের সঙ্গে। পরশু ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব। একা ছাড়বেন?
পল্টন বলল, একা ছাড়লে ক্ষতি কী? গুন্ডারা এসে আবার আমাকে ধরবে? অত ভয় আমি করি না। তা হলে ওদের কবল থেকে এইভাবে পালিয়ে আসতে পারতুম না। তা ছাড়া ট্রেনের কামরায় একবার ঢুকে পড়লে কে আমার কী করবে শুনি?
তুমি যদি যেতে পার আমার আপত্তি নেই। একা যদি যাও তা হলে রাতের গাড়ি নয়, দিনের বেলা তুফানে তোমাকে চাপিয়ে দেব। সকালে চাপলে সন্ধেবেলা হাওড়ায় পৌঁছে যাবে।
সেই ভাল। পারি তো ওই মেয়েটাকেও সঙ্গে নেব।
কাকুমণি হাসলেন।
দিবাকর বলল, কোন মেয়েটি?
যেতে যেতে তোমাকে সব বলব।
পল্টন ওর এবং গৌতমের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে দিবাকরের সঙ্গে সাইকেলে ওদের বাড়ির দিকে চলল, যেতে যেতেই সব কথা সবিস্তারে খুলে বলল দিবাকরকে।
দিবাকর বলল, বুঝেছি তুমি কোন মেয়েটির কথা বলছ। মেয়েটি সকালে ঘাটে ভিক্ষে করে আর সন্ধের পর মন্দিরের সামনে বসে দর্শনার্থীদের জুতো আগলায়। মেয়েটা ভাল। ঘরে নিয়ে যাবার মতো। বলতে গেলে ও শুধু তোমার কেন, তোমাদের দু’ বন্ধুরই উপকার করেছে। এমনকী গোপাকে ফিরে পাওয়ার মাধ্যমও ওই মেয়েটি।
ঠিক তাই।
আবার কদমকুঁয়ার কাছেই দিবাকরদের ফ্ল্যাটবাড়িতে এল ওরা। দিবাকররা এই ফ্ল্যাটের দোতলায় থাকে। গৌতমকে নিয়ে এর আগেই তো এখানে এসেছিল পল্টন। ওর কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল। ওর জামা-প্যান্ট-সোয়েটার নিয়েছিল। আবার এল। দিবাকর যদিও ওদের চেয়ে কয়েক বছরের বড়, কলেজে পড়ে, তবুও ওদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই ব্যবহার করেছিল।
সেই দিবাকরের বাড়িতে এসেই বারাণসীতে ট্রাঙ্ককল করল। টেলিফোন গোপাদেরও নেই। ওদের পাশের বাড়িতে আছে, যেখানে ফোন করলে ওদের পাওয়া যায়।
প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর লাইন পাওয়া গেল। ওধার থেকে উত্তর এল, হ্যালো……। একটু গোপাকে ডেকে দেবেন?
কে গোপা?
আপনাদের পাশের বাড়িতে থাকে। ও আর ওর মা।
আপনি কোথা থেকে ফোন করছেন?
পাটনা থেকে।
বুঝেছি। আপনি খুকুর কথা বলছেন?
কে খুকু! আমি তো জানি না। গোপাকে জানি। পাটনার দরিয়াপুরে সত্যসুন্দরবাবুর কাছে গান শেখে।
একটু ধরুন। ডেকে দিচ্ছি।
খানিক ধরে থাকার পরই এক মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল, হ্যালো! কে বলছেন?
তুমি কি গোপা?
আমি ওর মা ফোন করছি। আপনি কে?
আমাকে আপনি বলবেন না মাসিমা। আমি পল্টন। বাবলিদির বিয়েতে এসেছি।
তুমি পল্টন!
হ্যাঁ।
কী আশ্চর্য! তোমার জন্যে ছেলেমেয়ে দুটো ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছে। তোমার তো খুব বিপদ হয়ে গিয়েছিল। এখন কেমন আছ তুমি?
আপনার আশীর্বাদে ভালই আছি।
তোমরা দু’ বন্ধুতে আমার মেয়ের জন্যে যা করেছ তার তুলনা নেই। আমি কী বলে যে তোমাদের ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না। আমার বুকের মাণিক ফিরিয়ে দিয়েছ তোমরা। মাস্টারমশাইয়ের খবর কী?
একরকম। আমি এখন ও বাড়িতে নেই। যেখান থেকে ফোন করছি সেই বাড়িতে আছি।
দিবাকরদের বাড়ি। খুব ভাল ছেলে ও।
আপনি একবার গৌতমকে ডেকে দিন।
ওরা তো কেউ নেই। সারা দুপুর ঘুমিয়ে এখন একটু দশাশ্বমেধের দিকে গেছে।
সেটা আবার কী?
এখানকার একটা ঘাটের নাম। আমি আজই রাত্তিরে ফোন করতাম। তুমি যখন করলে তখন ভালই হল। তা বলছিলাম কী, তুমিই বা ওই বিষাক্ত পরিবেশে একা থেকে কী করবে? চলে এসো এখানে। দিনকতক থেকে ঘুরে বেরিয়ে যাও। আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক কাল কলকাতা যাচ্ছেন। আমি তাঁর হাত দিয়ে একটা চিঠি পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমাদের বাড়িতে। কাজেই কোনও চিন্তা নেই। তোমরা আনন্দে কিছুদিন ঘুরতে পারবে এখানে। তারপর আমি টিকিট কেটে রিজার্ভেশন করিয়ে গাড়িতে চাপিয়ে দেব। নির্ভাবনায় বাড়ি পৌঁছে যাবে। ওখানকার যা অবস্থা তাতে আর একদিনও ওখানে থাকা ঠিক নয় তোমার। আপনি যা বললেন সে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু আমি কখনও বেনারসে
যাইনি। কী করে যাব?
শোনো! তুমি দিবাকরকে বলো ভোরবেলা পঞ্জাব মেলে তোমাকে তুলে দিতে। তা ছাড়া এখনও সময় আছে। তুমি অমৃতসর এক্সপ্রেসটা যদি ধরতে পার তো খুব ভাল হয়। তা হলে একেবারে সকাল ন’টার মধ্যে বারাণসী পৌঁছে যাবে। গোপাকে নিয়ে আমি নিজে স্টেশনে থাকব। তোমার কাছে যদি গাড়ি ভাড়া না থাকে তা হলে দিবাকরকে বলো ও দিয়ে দেবে।
না না। এখন আমার কাছে টাকা আছে। আমরা তো ফিরে যাবার গাড়ি ভাড়া সঙ্গে নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম।
তা হলে আর দেরি কোরো না। এই বেলা তৈরি হয়ে নাও। রাত দুটো পঞ্চাশে অমৃতসর এক্সপ্রেস পাটনা থেকে ছাড়ে। বারোটা-একটা নাগাদ স্টেশনে চলে এসো। তবে একা এসো না, দিবাকরকে সঙ্গে নিয়েই এসো। ঠিক আছে। আমি যাবই।
তুমি একবার দিবাকরকে দাও।
পল্টন রিসিভারটা দিবাকরের হাতে দিয়ে বলল, গোপার মা।
দিবাকরের সঙ্গে ফোনে অনেক কথা হল।
দিবাকর বলল, বেশ তো, ওর জন্যে আপনি কোনও চিন্তা করবেন না। আমি নিজে গিয়ে ওকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসব।
ফোনে কথাবার্তা শেষ হলে পল্টন বলল, কত আনন্দ নিয়ে এখানে এসেছিলাম কিন্তু এখন আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে কতক্ষণে যাই।
দিবাকর বলল, আমারও মনে হয় তোমার চলে যাওয়াই ভাল। মাস্টারমশাইকে আমি বলে আসছি সেই কথা। তারপর তোমাকে অমৃতসর এক্সপ্রেসেই তুলে দিয়ে আসব।
পল্টন বলল, তার আগে একটা অনুরোধ। তোমাকে আমার একটা উপকার করতে হবে ভাই।
কী করতে হবে বলো?
তুমি যে ভাবেই হোক একবার ওই মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও। কার কথা বলছ?
দুলালির কথা বলছি।
কী হবে দেখা করে?
পল্টন বলল, তা ঠিক। তবে কি না এই শহরে আর তো আমি ভুলেও কখনও আসব না। তাই যাবার আগে একবার ওর সঙ্গে একটু কথা বলে নিতে চাই। কেন না ইতিমধ্যে যদি ও কোনওকারণে মনস্থির করে থাকে, তা হলে কিন্তু আমি আর না গেলে ও ভীষণ দুঃখ পাবে। ভাববে হয়তো কথার কথা বলেছি ওকে। অন্তর দিয়ে বলিনি। এখন যদি ও যেতে রাজি না হয় তা হলে নিজের কাছে আমি ঠিক থাকব। ও-ও আমাকে ভুল বুঝবে না। বা কোনও দোষারোপ করবে না।
দিবাকর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা অবশ্য ঠিক। তবে আমার মনে হয় ওসবের ভেতরে আর নিজেকে না-জড়ানোই ভাল। তা ছাড়া ওই জায়গায় আবার তুমি যাবে সেটা ঠিক নয়।
তা হলে এক কাজ করো না, তুমিই ওকে নিয়ে এসো না এখানে?
আমার বাড়ির লোক সেটা পছন্দ করবেন না।
পল্টন আহত হয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তা হলে কাকুমণিকে জানিয়ে এসো আমি আজই চলে যাচ্ছি।
দিবাকর ঘড়ি দেখে বলল, এখন সবে পৌনে আটটা। তুমি একটু বিশ্রাম নাও। মাকে বলে যাচ্ছি তোমার খাওয়া-দাওয়ার কোনও অসুবিধে হবে না। আমার তো এখন অনেক কাজ। মাস্টারমশাই আমাকে অনেক কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি দশটা-এগারোটা নাগাদ ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তবে হয়তো তার আগে তোমাকে একবার থানাতেও যেতে হতে পারে। কেন না পুলিশ জেনেছে তুমি নিখোঁজ হওনি।
পুলিশকে এ খবর কে দিল?
আমরাই দিয়েছি। না হলে অযথা ওরা তোমাকে খুঁজতে ড্রেনের ভেতর তোলপাড় করত।
আমি কোনও অবস্থাতেই পুলিশের কাছে যাব না। পুলিশের সাহায্য ছাড়াই যখন আমি বেঁচে ফিরেছি, তখন ওদের এড়িয়েই আমি চলে যাব।
পুলিশ চাইলে যেতে তোমাকে হবেই। তবে কি না একান্তই যদি যেতে হয় তা হলে পুলিশকে এই কথাটাই বলবে কার সাহায্যে এবং কীভাবে তুমি প্রাণে বেঁচেছ।
পল্টন বলল, তার মানে যে মেয়েটির দয়ায় আমি জীবন ফিরে পেলাম পুলিশের কাছে তার নামটি বলে তাকে আরও বিপদের জালে জড়িয়ে দেব। এই তো?
দিবাকর আর কিছু না বলে চলে গেল।
ও চলে গেলে পল্টন খস খস করে একটা চিঠি লিখে টেবিলের ওপর রেখে পেপারওয়েট চাপা দিল। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে শুধু টাকা ছাড়া অন্য কোনও কিছু না নিয়েই একেবারে বড় রাস্তায় এসে রিকশা ধরল। নেবার মধ্যে নিয়েছিল শুধু মাংকি ক্যাপটা। সেটাতে মুখ ঢেকে নিজেকে এমন করে নিল যে ওকে কারও চেনবার উপায়টি রইল না। আজ এবেলায় শীত একটু কম। তাই পথেও কোনও কষ্ট হল না।
ও ঠিক জায়গায় এসে টুপ করে রিকশা থেকে নামল। তারপর চুপিসাড়ে সেই ড্রেন পাইপগুলোর কাছে গিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও দুলালিকে দেখতে পেল না। হঠাৎ মনে হল রাত তো বেশি নয়। তা হলে ও তো এখন মন্দিরে থাকবে। কিন্তু মন্দিরটা কোথায়? ও অনুমানে গঙ্গার দিকে একটু এগোতেই ঢোল-খোলের শব্দ শুনতে পেল। সেই শব্দ লক্ষ্য করে খানিকটা যেতেই দেখতে পেল মন্দিরটা।
মন্দিরের কাছাকাছি আসতেই দেখল দুলালি একটা বিস্তীর্ণ চাতালের পাশে লাঠি হাতে বসে বসে বসে দর্শনার্থীদের জুতো পাহারা দিচ্ছে। মাঝে মাঝে গোরু-ছাগল এলে তাড়াচ্ছে। চারদিক বেশ জমজমাট।
পল্টন একটু কেশে ওর দিকে চোখ রেখে এক পা এক পা করে এগোতেই ওকে দেখতে পেল দুলালি।
ও কোনও কথা না বলে মাংকি ক্যাপটা একবার তুলে মুখটা বার করে দেখাল। তারপর আবার ঢেকে ফেলল মুখখানা।
দুলালি কেমন যেন ভয় পেয়ে ছুটে এল ওর কাছে। তারপর চাপা গলায় বলল, আরে! তুমি ইধার কিউ আয়া?
তোমার সঙ্গে দেখা করব বলে।
হিস্। ডিসুজাকা আদমি পূজা দেনে আয়া হিয়া পর। চলো চলো, উধার চলো।
দুলালি পল্টনের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল এক অন্ধকার নির্জনে।
পল্টন বলল, শোন, আমাকে আজই এখান থেকে বেনারসে চলে যেতে হচ্ছে। না হলে হয়তো পুলিশ আমাকে টানাহেঁচড়া করবে। যাবার আগে আমি শেষবারের মতো তোমার কাছে এসেছি। তুমি কী ভদ্রসুস্থ একটা জীবনকে বেছে নেবে? না এইভাবে ভিক্ষে করে দিন কাটাবে? তুমি বড় হচ্ছ। রাত্রিবেলা ড্রেনপাইপের ভেতরে লুকিয়ে আর কত রাত নিজেকে আড়ালে রাখবে?
হামকো শোচনে দো।
ভাববার সময় কিন্তু আর পাবে না। আমাকে যেতেই হবে। কেন না পুলিশের খপ্পরে আমি পড়ছি না। আর পাটনা শহরেও দ্বিতীয়বার আসছি না।
দুলালি কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, তুমি কি সত্যিই আমাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাও?
না হলে কি এই রাতদুপুরে আমি সিনেমা করতে এসেছি?
তো ঠিক হ্যায়। তুম স্টেশন পর চলা যাও। অকেলে। এক নম্বর খিড়কি পর ইন্তেজার করো। হাম যা রহেঁ। জলদি যাও।
পল্টন বলল, যদি টাকার দরকার থাকে নিতে পার। যাবার সময় কোনও দোকান থেকে একটা নতুন কিছু কিনে নিয়ো। এই ছেঁড়াটাকে ত্যাগ করতে হবে এবার।
দুলালি বলল, ম্যায় যানে কে লিয়ে তৈয়ার হুঁ। সব কুছ হ্যায় হামারা পাস তুম যাও।
পল্টন চলে গেল।
ওর চলে যাওয়া পথের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবল দুলালি। তারপর মন্দিরে এসে বজরঙ্গবলিকে একটা প্রণাম করে পাশের গলিতে হারিয়ে গেল।
পল্টনকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। ও যাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দুলালি গিয়ে হাজির হল। দুলালির সাজপোশাক দেখে তো প্রথমে চিনতেই পারেনি পল্টন। এ কাকে দেখছে ও? নতুন চুড়িদার পরা বন্যসৌন্দর্যে ভরা খুশি খুশি ঝলমলে একটি মেয়ে।
পল্টন অবাক হয়ে বলল, এমন ঝকঝকে মেয়ে তুমি। আর নিজেকে কী করে রেখেছিলে? কী চমৎকার দেখাচ্ছে তোমাকে তা জানো? সত্যি বলতে কী, তোমাকে দেখে এখন আমার একেবারে অন্যরকম লাগছে।
ট্রেন ক বাজে মিলেগা ?
রাত্রি দুটোর পর।
আভি দশ বাজ গিয়া হোগা?
সাড়ে দশটা। এখন চলো কোনও একটা হোটেলে ঢুকে পেট ভরে দুটো খেয়ে নিই। খিদে পাচ্ছে খুব।
দুলালি বলল, শোনো, তোমার সঙ্গে আমাকে দেখলে অনেকে হয়তো অন্যরকম ভাববে। কেউ খারাপ কথা বললে তুমি যেন কিছু বলবে না। রাগটা একটু সামলে রাখবে, কেমন?
ঠিক আছে।
ওরা বাইরের হোটেলে না খেয়ে রেলের ক্যান্টিনে খেল। পল্টনের প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল ধরা পড়বার। যদি ওর চিঠি পেয়ে দিবাকর বা কাকুমণি ছুটে আসেন, তা হলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তার ওপর এইরকম সুসজ্জিতা দুলালিকে দেখে অন্যরকম সন্দেহ করেন যদি? ভয় হল কাকুমণিকে। ও তো ঝোঁকের মাথায় ছিঁড়ে আনল এই বনফুল। তিনিও যদি অন্য রকম কিছু ভেবে বসেন?