নয়নাগিরি অভিযান – ১১

এগারো

সেই অন্তিম মুহূর্তে আতঙ্কে-ভয়ে পল্টনের মনের যে কী অবস্থা হয়েছিল তা ওইরকম বিপদের মুখোমুখি যে না-হয়েছে, সে ঠিক বুঝতে পারবে না। ওই আসুরিক শক্তির ধারক ভোজপুরীদুটোর হাতে মার খেয়ে ও সত্যিই নির্জীব হয়ে পড়েছিল। তারপর যে মুহূর্তে ওরা ওকে ম্যানহোলের ঢাকা খুলে একমানুষ গভীর ড্রেনের মধ্যে ফেলে দিল, তখন জীবনের আশা একেবারেই ছেড়ে দিল ও।

তবু জলমগ্ন ব্যক্তিও ডুবে মরার আগে একবার কুটো ধরে বাঁচতে চায়।

তাই সেও এই গর্তে নামার সময় পাছে বিষাক্ত গ্যাসটা সহসা ওর নাকে না যায় সেইজন্যে জীবনে শেষবারের মতো বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিল। তারপরই সব অন্ধকার।

কাদায়-পাঁকে কোমর পর্যন্ত এমনভাবে ডুবে গেল যে একেবারে মাখামাখি হয়ে গেল ও। ভেবেছিল ওরা চলে গেলে নীচে থেকে ঢাকনাটা খুলে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তা আর হল না। ড্রেনের দু’পাশের দেওয়াল এত দূরে যে পা গেল না। আর দমও রাখতে পারল না বেশিক্ষণ। নিশ্বাস ছেড়ে আর একবার দম নিতেই গা-মাথা ঘুলিয়ে কীরকম যেন হয়ে গেল। ঝিমঝিম করতে লাগল মাথাটা। বিষপ্রবাহ ঘটে গেল যেন সারা শরীরে।

এই নরকে মৃত্যুর পদধ্বনি শোনার আগে বড় বেশি করে মনে পড়ল মায়ের কথা।

এমন সময় হঠাৎই কোন জাদুতে খুলে গেল ঢাকনাটা।

ওর তখন সংজ্ঞাহীন হবার মতো অবস্থা।

একটা মুখ উঁকি দিল ওপর থেকে। কী যেন বলল। শুনতে পেল না। তারপরই নেমে এল একটা দড়ি।

এমন আশ্চর্যজনক ঘটনাও নাকি ঘটে?

ও সেই দড়ি ধরে কোনওরকমে কাদা-পাঁক থেকে নিজেকে মুক্ত করে ম্যানহোলের মুখের কাছে পৌঁছল। তারপর দু’হাতে ভর করে পায়ের বুড়ো আঙুলের টিপনিতে দড়িটা ধরে ওপরে উঠে এল। ওপরে উঠে আসার মুহূর্তেই একটি হাত টেনে তুলল ওকে।

বাইরের খোলা বাতাসে নিশ্বাস নেবার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন করে গা-মাথা আর একবার ঘুলিয়ে উঠল। হুড় হুড় করে বমি করল খানিকটা। তারপর কিছুই আর মনে নেই।

ঘোর কাটল অনেক পরে। যখন বুঝল কেউ যেন ওর শরীরের বোঝাটা অতিকষ্টে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। কতকগুলো রাস্তার কুকুরও ওদের সঙ্গে চলেছে।

ও ভয় পেয়ে বলল, কে! কে তুমি!

একটি মেয়েগলায় উত্তর এল, ঘাবড়াইয়ে মাত।

ওর তখন প্রচণ্ড শীত করছে।

মেয়েটি ওকে নামিয়ে দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে এক জায়গায় কতকগুলো ড্রেন পাইপের কাছে নিয়ে এসে বলল, অন্দর ঘুসো!

ড্রেন পাইপগুলো এত বড় বড় যে তার ভেতর দিব্যি শোয়াবসা যায়। তবে দাঁড়ানো যায় না।

অন্ধকারে মেয়েটির মুখ ভাল বোঝা যাচ্ছে না। অবশ্য এটুকু বোঝা যাচ্ছে এই মেয়েটি না-থাকলে ওকে ওই ভয়াবহ নরকেই পচে মরতে হত। কিন্তু কে এই রহস্যময়ী?

পল্টন কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কে তুমি! তোমার পরিচয় দাও আমাকে। তুমি আমার জীবন রক্ষা করেছ। আমার আরও কাছে এসো। একটু দেখি তোমায়।

মেয়েটি বলল, ম্যায়নে তো কুছ নেহি কিয়া। যো কুছ কিয়া ও উপরওয়ালানে।

ওইসব কথা আমাকে বোলো না। আমি জানতে চাই তুমি কে?

দুলালি।

কিন্তু কার ?

ম্যায় তো আসমান সে পয়দা হুয়া লেড়কি। ভগবান মেরা মা-বাপ। আমি ভগবানকা দুলালি।

তুমি নিশ্চয়ই ভগবানের দুলালি। শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ। তুমি হচ্ছ সেই অমৃতের পুত্রী। কোথায় থাকো তুমি?

এই তো, এইখানে। হিয়াপর।

পল্টন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শোনো দুলালি, যদি সত্যিই তোমার কেউ না থাকে তা হলে আজ থেকেই তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাও। আমার সঙ্গে থাকো। বাড়িতে আমার মা-দিদিরা আছেন, আমি তোমাকে বাড়ি নিয়ে গেলে তুমি তাদের কাছেই থাকবে।

সচ! কিন্তু দু’দিন বাদে যদি তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দাও?

এই ব্যাপারে তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। এতখানি বেইমানি আমরা করব না। আচ্ছা, তোমার যখন কেউ নেই তখন তোমার চলে কী করে? ভগবান চালিয়ে দেন। আমি ভিখ মেঙ্গে খাই।

তা হলে তোমার ভাবনা কী? আমরা যদি কখনও তোমাকে তাড়িয়ে দিই তখনই তুমি তোমার পুরনো ব্যবসায় আবার নতুন করে লেগে পড়তে পারবে। ও চাকরি ফিরে পেতে তো দেরি হবে না।

বেশ। আমি তোমার সঙ্গে যেতে রাজি আছি। এখন তোমার খুব শীত করছে নিশ্চয়ই? খুব যে কাঁপছ দেখছি।

হ্যাঁ। দারুণ শীত করছে আমার। সবই তো ভিজে গেছে।

তা হলে গায়ের জামাটামা খুলে এই চটগুলো তুমি চাপা দাও। বলে কোথা থেকে যেন এক বান্ডিল নোংরা ময়লা চট এনে পল্টনকে দিল।

পল্টন ওর জামাগেঞ্জি খুলে চট চাপা দিল গায়ে।

একটু আগুন করব?

কীসে করবে?

খড় আছে আমার কাছে। দিয়াশালাই আছে। সবকিছু আছে। এই ড্রেন পাইপের মধ্যেই আছে আমার ছোট্ট সংসার।

দুলালির কথা শুনে অবাক হয়ে গেল পল্টন। বলল, তা হলে একটু আগুন যদি করতে পারো তো মন্দ হয় না। বড্ড কাঁপ দিচ্ছে আমার!

দুলালি তখনই দেশলাই জ্বেলে খড়ের নুটি এনে আগুন করল সেই ড্রেন পাইপের ভেতরে।

এতক্ষণে মেয়েটির মুখ দেখতে পেল পল্টন। দেখে অবাক হয়ে গেল। এমন সুন্দর চোখমুখ। এই মেয়ে ভিক্ষে করে? গায়ের রং কালো, তা হোক। মাথায় ঘন চুল। খুবই ভাল লাগল পল্টনের।

আগুন জ্বালতেই গরম হয়ে উঠল ভেতরটা। তবে মুশকিল হল এই বদ্ধ জায়গায় ধোঁয়ার চোটে দম বন্ধ হয়ে গেল প্রায়। তাই নিভিয়ে দিতে পথ পেল না।

পল্টন বলল, তুমি একা থাক তোমার ভয় করে না? উঁহু।

সারাটা দিন তুমি কী করো?

সকাল থেকে গঙ্গার ঘাটে বসে ভিক্ষা করি। তারপর অনেক বেলা পর্যন্ত ভিক্ষে করে কোনও গাছতলায় বসে ডাল-ভাত একটু রেঁধে নিই। বিকেলে মন্দিরে যাই। সেখানেও ভিক্ষে করি। জুতো আগলাই। ভাল পয়সা পাওয়া যায়। সন্ধেবেলা কোনও হোটেলে ঢুকে মাংস-রুটি খাই। তারপর নাইট শো’তে একটা সিনেমা দেখে, যেখানে হোক পড়ে থাকি। তবে এখন বড় হচ্ছি তো, তাই রাত্রিবেলা যেখানে সেখানে থাকতে খুব ভয় করে। ইদানীং এই নিরাপদ জায়গাটা আমি বেছে নিয়েছি।

চমৎকার। ভিক্ষে করে তোমার কত রোজগার হয়?

কোনওদিন বিশ-পঁচিশ রুপাইয়া। কোনওদিন আরও বেশি। জুতো জমা নিয়ে পঞ্চাশ-একশো রুপিয়া পাই। আর পালেপার্বণে এক এক দিনে দু’-পাঁচশোও হয়ে যায়।

বলো কী! এত টাকা তুমি কী করো?

আমি একটা পোস্ট অফিসে জমিয়ে রাখি। আমার এখন অনেক টাকা। জানো?

তবু তুমি ভিক্ষে করো?

বাঃ রে। এতে যে আমার অনেক লাভ। খাটতে হয় না, কষ্ট করতে হয় না। অথচ বসে বসে রোজগার। তবে আমার আরও অনেক অনেক টাকা হলে তখন ভেবে দেখব কী করব।

পল্টন বলল, তা না হয় করলে। কিন্তু এইরকম ছেঁড়া একটা ফ্রকপরে ড্রেন পাইপের ভেতরে একা একা থেকে নিজেকে কষ্ট দাও কেন?

এসব আমার জন্ম থেকেই সয়ে গেছে দোস্ত।

নিদেন কোথাও একটা ছোটখাটো ঘরও তো ভাড়া নিতে পারো?

কী হবে? সাজগোছ করলে খারাপ লোকে নজর দেবে। ঘরভাড়া নিয়ে থাকলে লোকে ঝিয়ের কাম করতে বলবে। কেউ ভিক্ষে দেবে না। আমার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে। তা ছাড়া এসব আমার সয়ে গেছে। তবে দোস্ত! আমি লোকের কাছে হাত পেতে ভিক্ষে করলেও খারাপ মেয়ে নই। আর ঘর ভাড়া নিয়ে থাকার কথা বলছ? আমাকে ঘরভাড়া দেবেই বা কে? সবাই তো আমাকে চেনে। তা ছাড়া ঘরভাড়া করলে রুপিয়া লাগবে না? আমার পুঁজি ফুরিয়ে যাবে তখন। তুমি যে পোস্ট অফিসে টাকা রাখ তোমার পাস বই আছে?

হ্যাঁ। ওসব আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি। কাল সকালে আমি তোমাকে সব দেখাব।

ঠিক আছে দেখিয়ো। আজকাল পোস্ট অফিসে টাকা জমা রাখলে পাঁচ-ছ’ বছর বাদে তা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আমি তোমাকে সেইসব নিয়মগুলো বলে দেব। পোস্টমাস্টার মশাইও আমাকে অনেকবার বলেছিলেন ওইভাবে টাকা রাখতে। আমি রাখিনি।

ভুল করেছ। তা যাক, আমাকে একটা কথা ঠিক করে বল তো, আমি ওই ড্রেনের মধ্যে ছিলাম তুমি কী করে জানলে?

বাঃ রে। আমি যে নিজের চোখে সব দেখলাম। তাই যেই দেখলাম তোমাকে ওরা ওর ভেতরে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তখুনি আমি ছুটে গেলাম তোমাকে বাঁচাতে। এখানে দড়ির অভাব নেই। তাই নামিয়ে দিলাম একটা। আমি না-থাকলে তুমি মরে যেতে। ওর ভেতর বেশিক্ষণ থাকা যায় না। দম বন্ধ হয়ে যায়।

পল্টন বলল, তুমি না-গেলে মরে আমি যেতাম ঠিকই। কিন্তু আমি যে বেঁচে আছি তুমি সেটা বুঝলে কী করে?

ওরা যে তোমাকে মারতে মারতে নিয়ে এল তাই। মরাকে কেউ মারে? তোমার ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না। আমি তোমাকে বাড়ি নিয়ে

গেলে আমার মা তোমাকে খুব ভালবাসবেন। এত রাত্রে যদি তুমি জেগে না-থাকতে তা হলে আমার অবস্থাটা যে কী হত তা একবার ভেবে দেখেছ? আমি তোমার জন্যই জেগে ছিলাম। আমার জন্য?

হ্যাঁ। তোমার দোস্তের সঙ্গে আমার মুলাকাত হয়েছে। তোমাদের একটি মেয়েকে গুন্ডারা নিয়ে পালিয়েছিল। তারও খোঁজ পাওয়া গেছে। তোমার দোস্তই আমাকে তোমার কথা বলেছিল। ডিসুজার লোকেরা নাকি তোমাকে ওই বাড়ির ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল। তাই আমি, তোমার দোস্ত আর ওই মেয়েটাকে কদমকুঁয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে এখান থেকে ওই বাড়িটার দিকে লক্ষ রাখছিলাম। এমন সময় দেখতে পেলাম তোমাকে ওইভাবে মারতে মারতে নিয়ে আসছে। তারপর ওরা তোমাকে ফেলে দিয়ে পালাতেই ছুটে গেলাম আমি। ভাগ্যে তুমি ভেতরেই অজ্ঞান হয়ে যাওনি। তা হলে তোমাকে বাঁচাতে পারতাম না। আমি তো নামতে পারতাম না ওর ভেতরে। নামলে আমিও উঠতে পারতাম না। দম বন্ধ হয়ে মরে যেতাম।

ঠিক। ওর ভেতরে যে কী বিচ্ছিরি একটা গ্যাস, তা তোমাকে কী করে বলব। আমি একবার শ্বাস নিয়েই বুঝেছি। গা-মাথা যেন ঘুরে উঠল। তাই তো ওপরে উঠেই জ্ঞান হারালাম। এরপর তুমি যে আমাকে নিয়ে কীভাবে কী করলে তা কিছুই জানি না।

আমি তোমাকে বহু কষ্টে আমার পিঠে করে বয়ে নিয়ে গেলাম গঙ্গার ঘাটে। তবে আঘাটায়। সেইখানে গঙ্গার জলে তোমার সমস্ত কাদা ধুয়ে পরিষ্কার করলাম। তারপর আমার ঘরে তোমাকে নিয়ে আসছি এমন সময় আবার জ্ঞান ফিরল তোমার।

কথা বলতে বলতেই ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটে উঠল।

পল্টন বলল, শোনো, আর দেরি করে লাভ নেই। আমি এখন একটু সুস্থ হয়েছি। কাল সারাটা রাত যা ধকল গেছে আমার ওপর তা কী বলব। শুধু রাত কেন? বিকেল থেকেই তো চলছে। এবার বেরিয়ে পড়া যাক।

তুমি চলে যাবে?

বাঃ রে। যেতে হবে না? আমার জন্যে ওরা কত চিন্তা করছে বলো তো? তা ছাড়া সকাল হলে দিনের আলোয় যদি আবার ধরা পড়ে যাই?

তা হলে যাও। কিন্তু তোমার জামাপ্যান্ট সব তো ভিজে।

তা কী করব। তুমি তো মেয়ে। ছেলে হলে না হয় তোমারই একটা কিছু পরতাম।

তাড়াতাড়ি পরে নাও তা হলে। মোড়ের দোকানে তোমাকে একটু চা খাইয়ে দিই। কাল রাতে তোমায় তো কিছু খেতে দিতে পারলাম না। আমার ঘরেও কিছুই নেই। সারারাত নিশ্চয়ই খাওয়া হয়নি তোমার?

না। এসেছিলাম বিয়েবাড়ি নেমন্তন্ন খেতে। তার জায়গায় মারধোর খেয়ে মরলাম। সবই কপাল।

দুলালি হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এল। ওর পিছু পিছু চটমুড়ি দিয়ে পল্টন। এ কী! এই অবস্থায় যাবে নাকি তুমি?

তা ছাড়া উপায় নেই। ভিজেগুলো পরতে পারছি না!

দুলালি ফিক করে হাসল। বলল, চলো।

তুমি যাবে না?

আমি কোথায় যাব?

আমার সঙ্গে?

দুলালি ঘাড় নাড়ল, নেহি। তারপর বলল, তুমি আগে বাড়ি যাও। তোমার বাড়িতে গিয়ে আমার কথা বলো। তোমার মা-বাবা যদি সব শুনে আমাকে নিয়ে যান তা হলে ভেবে দেখব। না হলে আমি যেমন আছি তেমনি থাকি।

তুমি তা হলে আমাকে বিশ্বাস করছ না?

হামকো বুরা মাত সমঝো। তুমি এখন যেখানে যাচ্ছ তারা এইখানকারই লোক। আমাকে দেখলেই চিনতে পারবে। আর দূর দূর করে তাড়াবে!

এত সস্তা নাকি? তুমি চলোই না আমার সঙ্গে। তারপর দেখি কে কী বলে? কী পাগলামি করছ বলো তো তুমি? আমি একটা ভিখিরির মেয়ে। আর তুমি

লিখাপড়া জানা ভদ্দরলোকের ছেলে।

পল্টন ওই অবস্থায় নিজের জামাসোয়েটার বগলদাবা করে দুলালির হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল।

দুলালি বলল, হাত ছাড়ো। চলো আগে মোড়ের দোকানে একটু চা খাই। তারপর যেখানে বলবে সেখানেই যাব। তোমাদের দু’ বন্ধুর একটু শিক্ষা হওয়া দরকার। তোমরা দু’জনেই আমাকে নিয়ে যেতে চাইছ। লেকিন একবারও ভেবে দেখছ না, ইয়ে নেহি হো সকতা।

গৌতমও তোমাকে নিয়ে যাবার কথা বলেছিল বুঝি? হ্যাঁ।

বলবেই তো। তোমার মতো মেয়ে হয় না।

দুলালি বলল, তোমরা বলছ বটে। কিন্তু এখানে আমি কেমন স্বাধীনভাবে ছিলাম বলো তো? ভিক্ষেদুঃখু করে যা পাই তাই খেয়ে গাছতলায় শুয়ে কেমন সুন্দরভাবে দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছিলাম। এখন তোমরা দয়া করে দুটি খেতে দিলে তবে তো খেতে পাব।

সেরকম বুঝলে পালিয়ে আসবে তুমি।

ওরা বড় রাস্তার ধারে একটা দোকানে এসে দেখল এরই মধ্যে চায়ের দোকান জমজমাট। শিঙাড়া, জিলিপি ভাজা হয়েছে। চা হচ্ছে।

পল্টনের ওইরকম অবস্থা দেখে সবাই তাকাতে লাগল ওর দিকে। কেউ কেউ দুলালিকেও দেখল।

পল্টনের কাছে টাকা ছিল। ও চায়ের অর্ডার দিয়ে শিঙাড়া, জিলিপি নিয়ে অর্থেক দুলালিকে দিয়ে, অর্থেক নিজে খেল।

একজন পল্টনকে দেখে বলল, এ হাল ক্যায়সে হুয়া ভাই?

দুলালি বলল, পানিমে গির গিয়া।

গঙ্গাজিমে?

হ্যাঁ।

চা খাওয়া হলে দাম দিতে গেল পল্টন। কিন্তু দুলালি কিছুতেই তা দিতে দিল না। এবং ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে দোকানদারও দাম নিল না। বলল, ঠিক হ্যায় বাবা। পহলে তুম ঘর তো চলা যাও।

অগত্যা একটা রিকশা ডেকে তাইতেই উঠে পড়ল পল্টন। দুলালিকেও প্রায় জোর করে টেনে তুলল রিকশায়। কিন্তু সে গেল না। রিকশায় উঠেই লাফিয়ে পড়ল। বলল, মুঝে সরম লাগতা। তুমি যাও দোস্ত। আমি না। বলে ছুটে চলে গেল গলির মোড়ে। সেখান থেকেই একবার হাত নেড়ে হারিয়ে গেল কোথায় যেন।

দুলালির এই চপলতা ওর এই সরলতা খুবই ভাল লাগল পল্টনের। ও মনে মনে ঠিক করল গৌতমকে সঙ্গে নিয়েই দুলালিকে নিতে আসবে কাল। এমন একটি জীবন কিছুতেই অবহেলায় ঝরে যেতে দেবে না।

রিকশাওয়ালা বলল, কিধার যানে হোগা বাবু?

কদমকুঁয়া।

রিকশা তরতরিয়ে এগিয়ে চলল কদমকুঁয়ার দিকে। আকাশ এখনও ভাল করে ফর্সা হয়নি।

রাস্তায় আলো এখনও জ্বলছে।

চট জড়ানো পল্টনও রিকশায় বসে শীতে কাঁপছে ঠকঠক করে। কদমকুঁয়া পৌঁছতে খুব একটা বেশি সময় লাগল না।

ওকে ওইরকম চট মুড়ি দেওয়া অবস্থায় রিকশা থেকে নামতে দেখেই ছুটে এল সকলে। যারা এল তাদের অনেককেই অবশ্য ও চেনে না। এদের কেউ কাকুমণির ছাত্র, কেউ বা বরযাত্রীর লোক।

ও কিন্তু কারও দিকে না তাকিয়ে হনহন করে উঠে গেল ওপরে।

কাকিমা ওকে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন, এই তো! এই তো ফিরে এসেছে

পল্টন। বাবা বিশ্বনাথ। আমি কাশী গিয়ে তোমার পুজো দিয়ে আসব বাবা। পরের ছেলে, পরের বাড়ি নেমন্তন্ন খেতে এসে যদি গুন্ডা-বদমাশের পাল্লায় পড়ে, তবে এর চেয়ে দুশ্চিন্তার কিছু আছে কি? সারাজীবনের জন্য দায়ী থেকে যেতুম আমরা।

বাবলিদি বললেন, তোকে নিয়ে যে কী দুর্ভাবনা হয়েছিল আমাদের তা কী বলব। কিন্তু তোর এই দশা কী করে হল? জামা-প্যান্ট-সোয়েটারের বদলে চটমুড়ি দিয়ে, ব্যাপারটা কী?

বলব বলব, সব বলব। কাকুমণি কোথায়?

কাকিমা বাবলিদি দু’জনেই কেঁদে ফেললেন এবার, দাদুভাইকে আনতে গেছে হাসপাতাল থেকে।

দাদুভাই…… !

দাদুভাই মারা গেছেন। গুন্ডারা গোপা আর দাদুভাইকে চুরি করে নিয়ে পালাবার সময় গাড়ি থেকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল দাদুভাইকে। তাতে আঘাত পেয়েছিলেন খুব। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা গেছেন ইন্টারন্যাল হ্যামারেজ হয়ে। কোমরের হাড়ও ভেঙেছিল।

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল পল্টনের বুক থেকে। বলল, সে কী! গৌতম কই? গোপাকে দেখছি না কেন?

ওদের বেনারসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বেনারসে! কার সঙ্গে গেল?

গৌতমই নিয়ে গেছে গোপাকে। না হলে ওকে একা তো ছাড়তে পারি না। ভাল করেছেন। কখন গেল?

ভোরবেলা, পঞ্জাব মেলে। তা তোমার ব্যাপার কী বলো তো? তুমি কীভাবে রেহাই পেলে ওদের খপ্পর থেকে? তোমার কাকুমণির মুখে যা শুনলাম সেটা অত্যন্ত খারাপ খবর। তোমাকে নাকি আধমরা করে ওরা ড্রেনের ভেতর ফেলে দিয়েছিল?

হ্যা। খুবই ভুল করেছিল ওরা। ওদের সেই ভুলের জন্যেই আমি এখন এখানে।

বাবলিদি বললেন, কীভাবে কী হয়েছিল শুনি?

পল্টন তখন আগাগোড়া সব কথা খুলে বলল, কাকিমা ও বাবলিদিকে।

কাকিমা বললেন, আহারে! কত কষ্টই না পেয়েছিস তুই। তবে ভিখিরির মেয়ে হোক, ওই দুলালি না কী যেন নাম বললি, ওই তোর ভাগ্যলক্ষ্মী। ও না থাকলে তোকে বেঁচে ফিরতে হত না।

ওর ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না কাকিমা। আমার জীবনরক্ষার জন্য ভগবান ওকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ও ঋণ কী শোধ করা যায়?

বাবলিদি বললেন, পল্টন! আমি তোমার দিদির মতো। আমি বলছি ওই হতভাগীকে কোনওমতেই পথের ধুলোয় ঝরে যেতে দিয়ো না। যেভাবেই হোক বুঝিয়ে বাঝিয়ে নিয়ে এসো তুমি। ওর জন্যে কিছু করা তোমার একটা পবিত্র কর্তব্য। তোমার দিদিরা আছেন। যদি ওর বয়সি তোমার আর একটি বোনই থাকত, তা হলে? মনে করবে ও— ও তোমার এক দুখিনি বোন।

আমি তো ওকে নিয়েই যেতে চাই। কিন্তু ও না এলে? তা ছাড়া বাবলিদি, আর একটা কথা। আমি তো ইস্কুলে পড়ি। চাকরি বাকরি কিছুই করি না এখন। বড় হয়ে এই বাজারে আদৌ চাকরি পাব কি না তাও জানি না। এখন কাকামণিই আমাদের ভরসা। উনি কি ঘরে নেবেন ওকে?

কাকিমা বললেন, তোমার কাকামণিকে তুমি আজও চেননি তা হলে। ওঁর মতো মানুষ হয় না। বিশেষ করে যে মেয়ের জন্যে তোমার জীবন রক্ষা হয়েছে, তাকে ঘরে ঠাঁই দেবেন না মানে? যদি না দেন তখন আমি তো আছি। বাবলি চলে গেলে তো ঘর আমার ফাঁকা। আমি ওকে আমার কাছে রাখব। অত বড় মেয়ে একা একা যেখানে সেখানে পড়ে থাকবে। ভিক্ষে করবে। তাই কখনও হয়? তুমি আজই ওকে এখানে নিয়ে এসো।

বাবলিদি বললেন, এখন থাক। আর তুমি বাইরে বেরিয়ো না। ওরা জানে তুমি মৃত। সেই জানাটুকুই ওদের অভ্রান্ত হোক। আর পরোপকার করতে গিয়ে নিজের বিপদ বাড়িয়ো না।

পল্টন এইসব কথাবার্তার ফাঁকেই ওর পোশাক পরিবর্তন করল।

সারারাত খাওয়াদাওয়া নেই বেচারির।

কাকিমা তাই ওকে নিজে হাতে ওর পছন্দমতো বাসি

খাবার দই-মিষ্টি সব পেট ভরে খাইয়ে দিলেন।

কিছুক্ষণ পরে চোখের জলে বিদায় নিতে হল বাবলিদিকে।

সত্যবাবু তখন শ্মশানে।

বাবলিদি চলে গেলে একটা অটো ডেকে কাকিমা পল্টনকে নিয়ে চলে এলেন দরিয়াপুরের বাড়িতে।

চারদিক তখন শান্ত। কোথাও কোনও উত্তেজনা নেই।

অনেক বেলায় শ্মশান থেকে ফিরে এসে পল্টনকে একবার আড়চোখে দেখলেন সত্যবাবু। তবে চমকালেন না। কেন না ছাত্রদের মুখে শ্মশানে বসেই তিনি পল্টনের ফিরে আসার সংবাদ পেয়েছেন। তাই শুধু আদর করে ওর গায়েমাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। তারপর বাবার বিছানায় লুটিয়ে পড়ে শিশুর মতো সে কী কান্না।