নয়নাগিরি অভিযান – ১০

দশ

সম্ভবত গফুরের কান কেটেছিল যারা তাদেরই একজন। আর একজন কোথায়?

পালিয়েছে।

ডিসুজা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমরা এতজন, আর এরা দু’জন। তাতেও পালায় কী করে?

শংকর বলল, গফুরের কান কাটার মতো দুঃসাহস যারা রাখে তাদের অসাধ্য কি কিছু আছে?

চমৎকার। তা হলে আর আমার হাতে হাত মিলিয়ে লাভ কী? এদেরই লিডার করে তোমাদের কাজ কারবার চালিয়ে যাও।

সকলের মাথা তখন হেঁট।

ডিসুজা বললেন, এরা তোমাদের কোথা থেকে ফলো করছিল? তা তো জানি না।

দয়ালদা বলল, সম্ভবত মেয়েটার খোঁজেই এসেছিল এরা।

কিন্তু মেয়েটাকে যে তোমরাই কিডন্যাপ করেছ, তা এরা জানল কী করে? সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন বস।

ডিসুজা এবার এক পা-এক পা করে এগিয়ে এলেন পল্টনের দিকে। তারপর ওর চুলের মুঠি ধরে বললেন, কী নাম তোর?

পল্টন।

তোর আর এক বন্ধুর নাম?

গৌতম।

গফুরের কান তোরা কেটেছিলি?

হ্যাঁ।

হঠাৎ ওই ভূত চাপল কেন তোদের মাথায়?

ওর লোকেরা আমাদের এক বোনকে খুব বিরক্ত করছিল। সেইজন্যে তাদের আমরা শিক্ষা দিয়েছিলুম একটু। তা গফুর খবর পেয়ে আমাদের ওপর চড়াও হল। সেই রাগে আমরা ওকেও একটু শিক্ষা দিয়ে দিলুম।

তোদের সেই বোন এখন কোথায়?

গঙ্গার জলে।

তার মানে?

এই শয়তান শংকর তাকে কিডন্যাপ করে আপনার এখানে নিয়ে এসে তুলেছিল। পরে নয়নাগিরি না-কোথায় যেন পাচার করবার তালে ছিল। মেয়েটাকে লঞ্চে গঙ্গা পার করবার সময় সে ওদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারপরই নিখোঁজ।

বোমার মতো ফেটে পড়লেন ডিসুজা, হোপলেস। তারপর শংকর আর দয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, শোনো, তোমরা কিন্তু খুব শিগগির ফেঁসে যাবে। এইসব কাজের ঝুঁকি নেবার আগে ভাল করে আটঘাট বেঁধে নিতে হয়। এখন কোনওরকমে মেয়েটি যদি বেঁচে যায় তা হলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে জানো? বিশেষ করে এই ছেলে দুটি যখন বাড়ি চিনে গেছে, তখন কেলেঙ্কারি একটা করবেই। তার ওপর নয়নাগিরির নামও জেনেছে।

শংকর বলল, মেয়েটা নির্ঘাত মরেছে। এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত্ত থাকতে পারেন বস। আর পালালেও ছেলেটাকে ধরে আনার দায়িত্ব আমাদের।

থাক। আর অত কাজ দেখাতে হবে না। এখন ছেলেটা যদি পুলিশে খবর দিয়ে থাকে কিংবা বাড়ি পৌঁছে থাকে তা হলে ওকে ধরতে যাওয়া মানেই আর এক কেলেঙ্কারির ব্যাপার।

দয়ালদা বলল, আপাতত এটাকে তো ভোগে পাঠিয়ে দিই?

ডিসুজা বিদ্রূপের হাসি হেসে বললেন, ওটা তো খুব সহজ কাজ। এখন কঠিন কাজটা আগে করো দেখি?

কী কাজ বলুন?

যে ছেলেমেয়েগুলোকে ডার্করুমে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এখুনি তাদের সরিয়ে ফেলো এখান থেকে।

কোথায় সরাব?

যেখানে হোক। মনে রেখো মি. ত্রিবেদী কিন্তু আমাদের ঘোর শত্রু। অনেক চেষ্টা করেও আমি ওকে বাগে আনতে পারিনি। যদি কোনওরকমে খবর পায় তা হলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে। দলবল নিয়ে এসে খেয়ে ফেলবে একেবারে।

শংকর বলল, আপাতত ওদের শোনপুরেই পাঠিয়ে দিই।

ইডিয়ট। এতটুকু বুদ্ধিশুদ্ধি যদি থাকত মাথায়। ওদের খোঁজে পুলিশ যদি এতক্ষণে মহেন্দুঘাটে এসে থাকে তা হলে কী করবে?

আমরা লঞ্চে পার করব কেন? আঘাটায় নিয়ে গিয়ে নৌকোয় পাচার করব। মাঝিমাল্লারা যদি পুলিশকে বলে?

দয়ালদা বলল, তার চেয়ে একটা কাজ করা হোক। আপনি ডা. সাহানিকে একবার ফোন করে দিন। আপাতত ওনার নার্সিংহোমের কোনও একটা ঘরে এখনকার মতো ঢুকিয়ে দিক ওদের।

ডিসুজা দয়ালের কথাটা শুনলেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, এখন এছাড়া আর কোনও পথ নেই। বলেই বললেন, তুমি এখুনি চলে যাও সাহানির কাছে। গিয়ে সব বলে ওনার অ্যাম্বুলেন্সটা নিয়ে চলে এসো। দেরি কোরো না। পুলিশ আসবেই। কাজ হয়ে গেলে তোমরাও গা ঢাকা দাও। ফোনে কথা বলার চেয়ে সেইটাই কাজের কাজ হবে।

শংকর বলল, আমি তা হলে…?

তুমি একটা সাইকেল নিয়ে চলে যাও। ওই ভোজপুরী বলদদুটোকে এখুনি ধরে আনো। এই ছেলেটার ব্যবস্থা ওরাই করুক। তারপর বললেন, না থাক। তুমি যেয়ো না। আমি অন্য লোক পাঠাচ্ছি। বলে ভেতরঘরে ঢুকে গেলেন ডিসুজা। বললেন, অশোককে পাঠালাম।

অশোক হচ্ছে দলেরই একজন।

শংকর বলল, আমিও কি গাঢাকা দেব কিছুদিনের জন্য?

শুধু তুমি কেন? আমিও দেব। তবে ত্রিবেদীর সঙ্গে একটু মোকাবিলা করে।

তুমি যে বারণ করছ বস। না হলে কবে আমি ওটাকে শেষ করে দিতাম। তোমার ভবিষ্যৎ ভেবেই বারণ করেছি। ফাঁসির দড়িকে যদি ভয় না পাও, তা হলে ও কাজ করতে পারো। তুমি জেলের ঘানি টানবে আর আমি শত্রুমুক্ত হয়ে সমানে ব্যবসা চালিয়ে যাব। সেটা যদি পারো তা হলে বলো। ত্রিবেদী-হত্যা ব্যাপারে আমি তোমাকে বিশেষভাবে মদত করতে রাজি আছি।

আপনি একটু এস পি, ডি এস পি-কে সামলান।

তাতে লাভ কী? মি. ত্রিবেদীর নৌকোর কাছি আরও অনেক বড় গাছের ডালে বাঁধা আছে। সেন্ট্রালের একজন মিনিস্টারও নাকি ওঁর স্ত্রীর সম্পর্কে কে হন। তা ছাড়া খুন করার পর যদি তুমি কোনওরকমে একবার ধরা পড় তখন মারের চোটে আগে আমার নামটাই বলে দেবে। অত কাঁচা কাজ কখনও আমি করি? আমাকে আমার ব্যবসা করতে দাও, তুমি তোমার কাজ করো। তা মেয়েটাকে যে ধরলে এখুনি তাকে নয়নাগিরি পাঠাতে হল কেন?

শংকর বলল, এইরকম একটি মেয়ের কথা কৃষ্ণমূর্তিজি আমাকে বেশ কিছুদিন ধরেই বলছিলেন। ওঁর সেই জন্মান্ধ ছেলেটির বিয়ে দেবার জন্য কোনও মেয়ে পাচ্ছিলেন না। তা একবার দূর থেকে উনি মেয়েটিকে দেখে বলেছিলেন ঠিক এইরকম একটি মেয়েকে পেলে লক্ষাধিক টাকাতেও কিনে নিতে রাজি আছেন। তা ওই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবার উপযুক্ত মেয়ে পাওয়া গেলেও ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে একটিও পাওয়া যায়নি। সেইজন্যই আমি ওকে টার্গেট করেছিলাম। এমনকী দশ হাজার টাকা অ্যাডভান্সও নিয়েছি আমি।

বুঝেছি। কৃষ্ণমূর্তিজির উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ। মেয়েটা সুখেই থাকত। কিন্তু আমার এখানে কী মেয়ের অভাব ছিল?

না। এ মেয়েটির বয়স খুব কম। তা ছাড়া আরও একটা অন্য ব্যাপার আছে। কী ব্যাপার!

কৃষ্ণমূর্তিজীর সেই হারানো মেয়েটির সঙ্গে নাকি এই মেয়েটির মুখের এক আশ্চর্য রকমের মিল আছে। তাই একদিকে তিনি কিশোর পুত্রের জন্য কিশোরী বধূ, অপরদিকে নিজের মেয়ের শোক ভুলতেন এই মেয়েটিকে পেয়ে। এই অপহরণের মধ্যে কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। ওকে আমাদের কোনও ছবির কাজেও লাগাতাম না, বিদেশেও পাচার করা হত না। পরে অবশ্য কৃষ্ণমূর্তিজি সস্ত্রীক এসে ওর মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতেন। বা এই ব্যাপারটা ওর মাকে মেনে নিতে বলতেন।

আমিও তাই ভাবছি। কারণ কৃষ্ণমূর্তিজি আমাদের সঙ্গে অনেক আজেবাজে ব্যাপারে যুক্ত থাকলেও, মেয়েঘটিত কোনও ব্যাপারে ওনার দুর্নাম নেই। তা মেয়েটির বাবা নেই?

শুধু মা ছাড়া কেউ নেই। তাও এখানকার মেয়ে নয়। কাশীর একটা অন্ধকার গলিতে ওরা থাকে।

কথা বলতে বলতেই অ্যাম্বুলেন্স এসে গেল।

দয়ালদা ঘরে এসেই বলল, সাহানিকে ম্যানেজ করেছি বহু কষ্টে। ওদের আনা যেতে পারে এবার।

দয়ালদা, শংকর এবং আরও জনা দুই-তিন লোক মিলে বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে কয়েকজন নানাবয়সি ছেলেমেয়েকে বার করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠাল। ডিসুজা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করলেন।

পল্টন ও ডিসুজাকে একা পেয়ে একটা মতলব ঠিক করল। ডিসুজা যেই ওদের বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকেছেন ও অমনি একটা চিনা মাটির ফুলদানি নিয়ে ডিসুজার মাথায় মারবার জন্য ছুটে গেল দরজার কাছে।

এতক্ষণ সবকিছু শুনছিল দেখছিল। কেনও ঢুঁ শব্দটি করেনি। এইবার হাজার হলেও ডিসুজা ছিলেন পুলিশের লোক। এইরকম পরিস্থিতিতে ঠিক কী করা উচিত তা তিনি জানতেন। তাই পল্টন কিছু করবার আগেই অতর্কিতে ওর হাতের কবজিতে একটা ঝটকা দিতেই ফুলদানিটা ছিটকে পড়ল হাত থেকে। ছিটকে সেটা পাশের দেওয়ালে লেগে চুরমার হয়ে গেল।

আর ঠিক সেই সময়েই সাক্ষাৎ যমের মতো দরজার সামনে এসে দাঁড়াল সেই ভোজপুরীদুটো, ফরমাইয়ে সাব।

ডিসুজা বললেন, চেহারা দুটো তো তৈরি করেছ নৃসিংহ অবতারের মতো। বলি খুপরিতে কি কিছুই রাখনি?

ভোজপুরীদুটো অসহায়ভাবে বলল, গলতি হো গিয়া হুজুর। অ্যায়শা তো কভি নেহি হুয়া। আভি হামকো কাম দিজিয়ে।

পল্টনকে দেখিয়ে ডিসুজা বললেন, ইয়ে লেড়কাকো লে যাও। মার মারকে গন্ধি নালা মে ডাল দো। জিন্দা মাত ছোড় না। আউর ইয়াদ রাখো। পোলিশ আনেবালে। ও জরুর আ যায়ে গা।

ভোজপুরী দু’জন বেড়ালে যেমন ইঁদুর ধরে ঠিক সেইভাবে ধরল এসে পল্টনকে।

ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল পল্টনের।

অসহায়ভাবে ওদের শিকার হল।

ওরা মারতে মারতে গলির মুখে নিয়ে এল ওকে।

দু’-চার ঘা খেতেই অবসন্ন হয়ে পড়ল ও। তাই ইচ্ছে করেই একটু বেশি রকমের নেতিয়ে পড়ার ভান দেখাল।

ভোজপুরীদুটোর একজন করল কী একটা হাই ড্রেনের ঢাকনা খুলে ওকে ফেলে দিল তার ভেতর। দিয়েই মুখটা এঁটে দিল। তারপর এদিকসেদিক তাকিয়ে দ্রুত চলে গেল নিজেদের বস্তির দিকে।