নয়নাগিরি অভিযান – ১

এক

হঠাৎই অপ্রত্যাশিতভাবে কোনও শুভ সংবাদ যদি পেয়ে যায় কেউ, তা হলে কি আনন্দের আর শেষ থাকে? বন্যাপাড়ার মাঠে যযাতি সংঘের ফুটবল ম্যাচ ছিল, তাই দেখতেই গিয়েছিল গৌতম। এদিকে বাবার কড়া নিষেধ। যেখানে খুশি চলে যাও, ঘোরোফেরো কোনও আপত্তি নেই, শুধু সন্ধের আগে ঘরে ফিরো এবং বন্যাপাড়ায় যেয়ো না। বড় কুখ্যাত জায়গা ওটা। এক তো ওর চারদিক ঘিরে সমাজবিরোধীদের ঘাঁটি, তার ওপর শ্রাবণ মাসে জগৎগৌরীর মেলাতেও ওখানে সাপের কামড়ে একজন-দু’জন মরেই থাকে। তাই কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি লুকিয়েই এসেছিল গৌতম। কিন্তু ফেরার পথে বন্ধু পল্টনের মুখে এমন একটা খবর পেল যে আনন্দের উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে পারল না। চোখদুটো বড় বড় করে বলল, সত্যি !

পল্টন বলল, সত্যি না-তো কি মিথ্যে? কালই আমাদের যেতে হচ্ছে। কিন্তু তুই এত দেরি করলি কেন?

তোকে বলা হয়নি রে। আমি বন্যাপাড়ায় ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম।

আমিও আন্দাজ করেছিলাম তাই। সেইজন্যেই শোঁটেদার দোকানে ডিম-টোস্ট খেয়ে তোর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। তোদের বাড়ি গিয়ে শুনলুম তুই স্কুল থেকে এসে বইপত্তর রেখেই ছুটেছিস। জলখাবারও খাসনি। খিদে পায়নি তোর?

পেয়েছে। তুইও আয় আমাদের বাড়ি। এক সঙ্গে খাব।

যাবই তো। তোর বাবা আমাকে তোরই খোঁজে পাঠালেন। তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে না?

বাবা! এমন সময় বাবা কোত্থেকে আসবেন?

তা তো জানি না। তবে আমাকে দেখেই বললেন, বন্ধু তো বাড়ি নেই। যাও যেখান থেকে পারো ধরে নিয়ে এসো।

তারপর?

আমি তখন সাহস করে ভয়ে ভয়ে বলেই ফেললাম কথাটা।

কী বললেন উনি?

এক কথায় রাজি।

আমি কিন্তু এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না।

বিশ্বাস না হবার কথাই বটে। তোর বোন ঝুমুও যেতে চাইছিল। ঝুমুকে অবশ্য যেতে দেবেন না তোর মা। তবে তুই যাচ্ছিস।

কথা বলতে বলতেই ওরা বাড়ি এল।

ছোট্ট ঝুমু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল দাদাকে। বলল, এই দাদা, বাবলিদির বিয়েতে তুই নেমতন্ন যাচ্ছিস। আমাকে নিয়ে যাবি রে? আমাকেও নেমতন্ন করেছে।

মা শুনতে পেয়ে বললেন, শখ মন্দ নয়। এ যেন এপাড়া ওপাড়া। কোথায় হাওড়া, কোথায় পাটনা। তা ছাড়া এই তো সেদিন বম্বে থেকে ঘুরে এলি।

বাঃ রে। তা হলে দাদা যাচ্ছে কেন? দাদাও তো বম্বে গিয়েছিল। দাদার বেলায় দোষ নেই, যত দোষ আমার বেলায়?

বলতে লজ্জা করে না? দাদা সামনের বছর ফাইনাল দেবে। আর তুই? দশ বছরের মেয়ে এখনও রাত্তির বেলা বিছানায়…।

জোঁকের মুখে নুন। কাঠবিড়ালির মতো তুণ্ডুক করে লাফিয়ে পালাল ঝুমু। রোজ তো নয়, না হয় মাঝেমধ্যে একআধদিন রাত্তিরবেলা ঘুমের ঘোরে একটু হয়েই যায়, তাই বলে কি একেবারে পল্টনদার সামনে এইভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙতে হবে?

গৌতম হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকল।

বাবা বললেন, কী রে! কোথায় গিয়েছিলি?

কোথাও নয় বাবা। একটু পুলকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। পুলক হচ্ছে পল্টন ও গৌতমের বন্ধু। বাবা-মা সবাই ওকে চেনেন। এ বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াতও আছে। তাই আর কেউ কিছু বললেন না। ভাবলেন হবেও বা।

গৌতম বলল, তুমি আজ এত সকাল সকাল চলে এলে যে বাবা? মা জল খাবারের ডিশ হাতে ঘরে এসে বললেন, কেন উনি আসায় তুমি কি খুশি নও?

বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, আঃ। এইভাবে কখনও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলে? আমি তো রোজ এই সময় আসি না, তাই ও জিজ্ঞেস করেছে। এতে ওর দোষটা কোথায়? বলে গৌতমকে বললেন, আজ আমাদের অফিসের স্পোর্টস। সেইজন্যে দুটোর সময় ছুটি হয়ে গেছে। আমি তো খেলাধুলোর ভক্ত নই। তাই মাঠে না গিয়ে বাড়ি চলে এলাম। এসে শুনলাম তোমাদের বাবলিদির বিয়ে। আর সেই বিয়েতে যাবার জন্যে তোমাদের দু’ভাই-বোনেই নিমন্ত্রিত হয়েছ।

আমি যাব বাবা?

নিশ্চয়ই যাবে। বাবলিদির বিয়ে বলে কথা।

মা বললেন, বাবলির দেখাশোনা চলছিল অনেক দিন ধরেই। কিন্তু বিয়ে হচ্ছিল না। এবার মনে হয় রাতারাতি কোনও ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কিন্তু যতই রাতারাতি হোক। বিয়ে বলে কথা। কিছু দিনের একটা তোড়জোড় তো ছিলই।

সবই তো ছিল।

তা হলে? রেজেস্ট্রি করে চিঠি দেওয়া উচিত ছিল ওদের।

রেজেন্ট্রি চিঠিই তো এসেছে দশ দিন বাদে।

বাবা বললেন, এই জন্যেই আজকাল লোকে ক্যুরিয়ার সার্ভিসে চিঠি পাঠায়। এতে খরচও কম। চিঠিও তাড়াতাড়ি যায়।

ওদের জলখাবার খাওয়া হলে গৌতম বলল, আমি পল্টনের সঙ্গে একবার ওদের বাড়ি যাব মা?

এখন ক’টা বাজে জানো? পড়তে বসতে হবে না?

আজ একদম পড়ায় মন বসছে না, বিশ্বাস করো।

বাবা হেসে বললেন, ঠিক আছে যাও। ওদের বাড়িতে কী সব আলোচনা হয় শুনে এসো। বিয়ে বাড়ি যাচ্ছ। শুধুহাতে তো যাওয়া যায় না। কিছু একটা নিয়ে যেতে হবে। যদি সময় থাকে তা হলে আজ নয়তো কাল সকালেই কিনে ফেলতে হবে জিনিসটা। কী দেওয়া যায় বলো তো? বলে মায়ের দিকে তাকালেন বাবা।

মা বললেন, কী বলব বলো? এত তাড়াতাড়ি যে ভেবে দেখারও সময় পাব না। যা হোক কিছু দেবে। ছোট ছেলে। ভাইয়ের মতো।

গৌতম আর দেরি করল না। পল্টনের সঙ্গে ওদের বাড়ির দিকে চলল। খুব বেশি দূরে নয়। ওদের বাড়ি থেকে সোজা এগিয়ে দুটো মোড় পার হলেই পল্টনদের বাড়ি।

পল্টনের কাকামণি রুদ্রমশাই একজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। গানের গলা ভাল নয়। তবে গান জানেন। বাংলা এবং বিহারের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রী আছে। তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই রেডিয়ো বা টিভিতে গানটান গায়। সংগীত গুরু হিসেবেই তাঁর খ্যাতি। বিয়েথা করেননি। ভাইপো-ভাইঝিদের তিনি নিজের ছেলেমেয়ের মতোই দেখেন। সর্বাধিক স্নেহ করেন তিনি পল্টনকে।