উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

নবম। প্রত্যাদেশবাণী

নবম। প্রত্যাদেশবাণী

চিতার দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ালেন রাজশ্রী।

অরণ্যের অন্তরাল থেমে আত্মপ্রকাশ করছে দলে দলে অশ্বারোহী। অশ্বদের ধূলি-ধূসরিত দেহ এবং ফেনায়িত মুখ দেখলে বুঝতে বিলম্ব হয় না যে, বহু দূর থেকে অতি বেগে পথ অতিক্রম করে তারা এসে উপস্থিত হয়েছে এখানে।

অশ্বারোহীদের পুরোভাগে দেখা গেল হর্ষবর্ধনকে। এক লাফে মাটির উপরে নেমে পড়ে তিনি ছুটে এলেন রাজশ্রীর কাছে। ব্যাকুলভাবে নিজের দুই হাত দিয়ে ভগিনীর দুই হাত চেপে ধরে উচ্ছ্বসিত বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ‘দিদি, দিদি, এ কী দেখছি! তোমার সামনে জ্বলন্ত চিতা কেন?’

বিষাদ-মাখা হাসি হেসে রাজশ্রী ধীরে ধীরে বললেন, ‘ভাই, ওই চিতাই যে এখন আমার একমাত্র শয্যা।’

‘তা হয় না দিদি, তা অসম্ভব। তোমাকে হারালে এই পৃথিবীতে আমি যে হব একেবারে একলা।’

‘একবারে একলা? কেন, তোমার মাথার উপর তো আছেন রাজ্যবর্ধন।’

‘তিনি এখন স্বর্গে।’

রাজশ্রী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন।

হর্ষ বললেন, ‘মগধ-গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক তাঁকে হত্যা করেছে।’

খানিকক্ষণ স্তম্ভিতের মতো থেকে রাজশ্রী বললেন, ‘তুমি কী দুঃসংবাদ দিলে হর্ষ? এক বৎসরের মধ্যেই আমি মাতা, পিতা, ভ্রাতা আর স্বামীকে হারালুম? আর সেই পাষণ্ড দেবগুপ্ত এখন কোথায়?’

‘নরকে। তাকে পরাজিত আর নিহত করবার পরেই আমার দাদা মারা পড়েছেন দেবগুপ্তের বন্ধু শশাঙ্কের হাতে। সেই খবর পেয়েই আমি আগে তোমাকে উদ্ধার করতে ছুটে এসেছি। এরপর আমাকে যেতে হবে শশাঙ্কের পিছনে। সে নাকি সমগ্র আর্যাবর্তে আবার গুপ্তসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আগে কান্যকুব্জ অধিকার করে সে নাকি থানেশ্বরও আক্রমণ করবে। কিন্তু আমি তাকে সে সুযোগ দেব না।’

রাজশ্রী বললেন, ‘হর্ষ, সম্ভ্রান্ত রাজবংশে তোমার জন্ম! তুমি যে রাজকর্তব্য পালন করতে পারবে, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার স্বামীহন্তা শাস্তি পেয়েছে, আমি আর এ পৃথিবীতে থাকতে চাই না।’

‘কিন্তু দিদি, তোমার ভ্রাতৃহন্তা তো এখনও শাস্তি পায়নি।’

‘সে জন্যে তুমি রইলে হর্ষ।’

‘না দিদি, না! আমি যাব এখন শশাঙ্ককে শাসন করতে। আমার অবর্তমানে থানেশ্বরের শুভাশুভ দেখবে কে? যুদ্ধের পরিণাম অনিশ্চিত। রণক্ষেত্রে যদি আমারও মৃত্যু হয়? তখন তুমি ছাড়া পিতার বংশে রাজ্যচালনা করবার জন্যে তো আর কেউ থাকবে না।’

রাজশ্রী সবিস্ময়ে বললেন, ‘তুমি কী বলতে চাও হর্ষ। আমি রাজ্যচালনা করব? তুমি কি ভুলে গিয়েছ, আমি নারী?’

হর্ষ আবেগ-কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ‘কিছুই ভুলিনি দিদি, কিছুই ভুলিনি! তুমি নারী বটে, কিন্তু তুমি কি যে-সে নারী? পিতা বলতেন, বিদ্যা-বুদ্ধিতে তোমার সঙ্গে তুলনীয় কোনও পুরুষ তাঁর সমগ্র রাজ্যে নেই। আমার কথা রাখো দিদি! তুমি যদি থানেশ্বরের ভার গ্রহণ করো, আমি তাহলে নিশ্চিন্ত মনে শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে পারি।

দ্বিধা জড়িত কণ্ঠে রাজশ্রী বললেন, ‘ভাই হর্ষ—’

হর্ষ বাধা দিয়ে বললেন, ‘দিদি, এখনও তুমি সব কথা শোনোনি। রাজ্যে বিষম বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হয়েছে। বেশিরভাগ মন্ত্রীর ইচ্ছা নয় যে, আমি সিংহাসনে আরোহণ করি। তাঁদের মতে আমি নাবালক, রাজ্যচালনা করবার মতো বুদ্ধি বা শক্তি আমার নেই। কেবল আমার জ্ঞাতি-ভ্রাতা ভণ্ডী তাঁদের মুখ বন্ধ করে রেখেছেন। তিনি আমার পক্ষে না থাকলে থানেশ্বরের সিংহাসন এর মধ্যেই হয়তো আমার হাতছাড়া হয়ে যেত। দিদি, তোমার বিদ্যাবুদ্ধির কথা জানে না, রাজ্যে এমন লোক নেই। আমি চিরদিনই তোমার কাছ থেকে পেয়ে এসেছি মায়ের স্নেহ। এই দুঃসময়ে তুমি যদি আমার মাথার উপরে থাকো, তাহলে পরম শত্রুরাও বাধ্য হয়ে আমার আনুগত্য স্বীকার করবে।’

এখনও রাজশ্রীর দ্বিধার ভাব কাটল না! বাধোবাধো গলায় তিনি বললেন, ‘ভাই হর্ষ, তোমার প্রস্তাব শুনে আমি ভীত হচ্ছি।’

হর্ষ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, ‘ভয়’? কোনও ভয় নেই দিদি! তোমার কাছে আসবার আগেই আমি এক বৌদ্ধ মঠে গিয়েছিলুম নিজের ভবিষ্যৎ জানতে। দিদি, আমি কী প্রত্যাদেশবাণী পেয়েছি জানো। জম্বুদ্বীপে প্রথম সাম্রাজ্য ছিল মৌর্যরাজাদের। দ্বিতীয় সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন মহারাজাধিরাজ সমুদ্রগুপ্ত। তৃতীয় সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়েছিলেন হুনবিজেতা যশোধর্মদেব। প্রত্যাদেশবাণী যদি মানতে হয়, তাহলে আমিই হব নাকি এখানকার চতুর্থ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এই বিচিত্র বাণী শুনে পর্যন্ত অমার আশা হয়ে উঠেছে অনন্ত—সমস্ত চিত্ত আমার বিচরণ করছে অসীম আকাশে। দিদি, আমি কী স্থির করেছি তাও বলি শোনো। নিন্দুকদের মুখ বন্ধ করবার জন্যে আমি আপাতত ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধি গ্রহণ করব না। যত দিন না প্রাপ্তবয়স্ক হই, যত দিন না নিজের শক্তির পরিপূর্ণ পরিচয় দিতে পারি, তত দিন আমি রাজপুত্র শিলাদিত্য, এই নাম গ্রহণ করে নিজের কর্তব্যপালন করব। দিদি, আসলে রাজ্যচালনার ভার থাকবে তোমার উপরে, কেবল অস্ত্রচালনা করব আমি। এই খণ্ড খণ্ড আর্যাবর্তকে আবার আমি অখণ্ড করে তোলবার চেষ্টা করব। কিন্তু দিদি, তুমি সহায় না হলে আমার পক্ষে এই সুপবিত্র ব্রত উদযাপন করা সম্ভবপর হবে না।’

রাজশ্রী পূর্ণকণ্ঠে বললেন, ‘হর্ষ, তোমার কথায় দেশের মঙ্গলের জন্যেই আমার জীবনকে উৎসর্গ করলুম। ভগবানের ইচ্ছায় সফল হোক তোমার স্বপ্ন! সরদার, নিবিয়ে ফ্যালো চিতার আগুন।