উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

নবম । কবি হাফিজ ও সর্দার আক বোগা

নবম । কবি হাফিজ ও সর্দার আক বোগা

‘ভগবানের মা, রুশিয়াকে রক্ষা করো!’

মস্কো শহরের পথে পথে, আবালবৃদ্ধবনিতার মুখে মুখে জাগছে এই কাতর প্রার্থনা!

রুশরা দৃষ্টান্তের পর দৃষ্টান্ত দেখে বুঝেছে, অস্ত্রের দ্বারা তৈমুরকে বাধা দিতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। তাই তারা হল দেবতার দ্বারস্থ।

রুশরা বলে, ভগবানের মা তাদের প্রার্থনা ঠেলতে পারেননি। কারণ, রুশিয়ার সর্বময় কর্তা তোক্তামিসকে দমন করেই তৈমুর আবার নিজের দেশে ফিরে গেলেন। মস্কো শহরে তখন বাসিন্দার সংখ্যা ছিল মাত্র পঞ্চাশ হাজার। এমন একটা ছোট শহর তৈমুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল না।

মস্কো বাঁচল, কিন্তু রুশিয়ায় মোগল সাম্রাজ্যের পতন হল। তৈমুর শত্রুর বেশে রুশিয়ায় গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর আবির্ভাবের ফলেই রুশরা স্বাধীন ভাবে মাথা তুলে দাঁড়াবার প্রথম সুযোগ পায়।

রুশিয়ার পর পারস্যের পালা।

পারস্যের গৌরব-সূর্য তখন অস্তমিত। বহুকাল ধরে সৌভাগ্যের উচ্চশিখরে অলস ভাবে বসে থেকে তখন সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে পারস্যের পুরুষত্ব। তার যশ আছে, কিন্তু আত্মরক্ষার ক্ষমতা নেই। সম্রাট, আমির-ওমরাও ও রাজপুত্ররা বিপুল বিলাসে কালযাপন করেন, খোশামুদে কবিদের রচিত প্রশস্তি তাঁদের আত্মপ্রসাদকে আরও বাড়িয়ে তোলে, বড় বড় শহরের পথে পথে আরামে ঘুরে বেড়ায় রেশমি পোশাক পরা ভিখারিরা!

এরই মধ্যে কবি হাফিজের মুরুব্বি পারস্য সম্রাটের মৃত্যু হল। সমস্ত ইরান দেশ তখন খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে এক-একজন রাজকুমারের অধীন হয়ে পড়ল।

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ। শীতের ম্লান সূর্যের আলোকে আচম্বিতে একদিন দেখা গেল, ইরানের বুক মাড়িয়ে ইস্পাহানের দিকে এগিয়ে আসছে তৈমুরের দুর্দান্ত তাতার বাহিনী!

ইস্পাহানের কর্তারা বাধা দিলেন না, বরং হাসিমুখে এগিয়ে এলেন তৈমুরকে সাদর অভ্যর্থনা করতে।

তৈমুর বললেন, ‘ইস্পাহানিদের জীবন ভিক্ষা দিলুম। যদি নিষ্ক্রয়ের টাকা পাই, শহরও লুট করা হবে না।’

ইস্পাহানি আমির-ওমরাওরা বললেন, ‘অবশ্য, অবশ্য! নিষ্ক্রয় দেওয়া হবে বই কি!’

কিন্তু ইস্পাহানের সাধারণ বাসিন্দারা কর্তাদের এই কাপুরুষতা সমর্থন করলে না। এক ডানপিটে কামার কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে সকলকে উত্তেজিত করে তুললে। ইস্পাহানিরা খাপ্পা হয়ে তাতারীদের আক্রমণ করলে। শহরের পথে পথে ছুটল রক্তস্রোত। তিন হাজার তাতারী মারা পড়ল।

বিষবৃক্ষের ফল ফলতে দেরি হল না। বজ্রকঠিন স্বরে তৈমুর বললেন, ‘হত্যা করো! প্রত্যেক তাতারির হাতে আমি একটা করে ইস্পাহানি মুণ্ড দেখতে চাই।’

তারপর দেখা গেল ইস্পাহানের রাস্তায় রাস্তায় সাজানো রয়েছে সত্তর হাজার নরমুণ্ডের পাহাড়!

ইস্পাহানের পরে এল সিরাজনগরের পালা। কিন্তু সিরাজের বুদ্ধিমান বাসিন্দারা ইস্পাহানের দুর্দশা দেখে তাড়াতাড়ি চুকিয়ে দিলে নিষ্ক্রয়ের টাকা।

সিরাজে থাকতেন কবি হাফিজ। তাঁর নাম ফিরত দেশে দেশে। তৈমুর কাব্যের ভক্ত ছিলেন না। কিন্তু কৌতূহলী হয়ে একদিন কবিকে ডেকে পাঠালেন। কবিকে আসতে হল।

হাফিজ একটি কবিতায় এই মর্মে লিখেছিলেন—’সিরাজের সুন্দরী কন্যার পায়ের তলায় আমি বোখারা কি সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে পারি।’

তৈমুর কঠোর স্বরে বললেন, ‘এ কবিতা তুমি লিখেছ?’

কবি বললেন, ‘রাজার রাজা, ওটি আমারই রচনা বটে।’

তৈমুর বললেন, ‘কত যুদ্ধ করে কত কষ্টের পর আমি সমরখন্দ জয় করতে পেরেছি। আর তুমি কিনা এক কথায় তুচ্ছ এক নারীর পায়ে সমরখন্দ বিলিয়ে দিতে চাও?’

কবি হেসে বললেন, ‘হুজুর, এমনই অমিতব্যয়িতার ফলেই আজ আমি ভিখারির মতন দীন হয়ে আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি!’

কবির জবাব শুনে তৈমুর খুশি হলেন। হাফিজের ভাগ্যে জুটল নিষ্ঠুর তিরস্কার নয়, প্রচুর পুরস্কার!

বলা বাহুল্য, দেখতে দেখতে কয়েকটি ছোটখাটো যুদ্ধের পর সমস্ত ইরান দেশ হল তৈমুরের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত। মধ্য এশিয়ায় ও ইরান দেশে কেউ আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না (১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে)।

তৈমুরের বয়স এখন তিপ্পান্ন বৎসর। কেবল লোক দেখাবার জন্যে মাথার উপরে তিনি এখনও চেঙ্গিজের এক বংশধরকে রেখে পালন করছেন বটে, কিন্তু এই খাঁ-খানান হচ্ছেন তাঁর হাতের ক্রীড়াপুত্তলি মাত্র। তিনি গদির উপরে বসে নিশ্চিন্ত মনে ভালো ভালো খাবারদাবার খান, শিকারে যান বা খেলাধুলো আমোদ-প্রমোদ নিয়ে মেতে থাকেন।

কী রকম সব দুর্ধর্ষ লোক ছিলেন তৈমুরের সহচররা, এখানে তারও একটু পরিচয় দিলে মন্দ হবে না।

নাম তাঁর সর্দার আক বোগা—লম্বা-চওড়ায় চেহারাখানি তাঁর দানবের মতন বিরাট, তাঁকে দেখলেই বুকটা ভয়ে ধড়াস ধড়াস করতে থাকে। তাঁর প্রকাণ্ড ঢাল লোহায় তৈরি এবং ভারী ধনুকখানি হচ্ছে পাঁচ ফুট লম্বা।

একদিন ইরান দেশের এক পল্লিগ্রামে কোনও গৃহস্থের বাড়ির সামনে একলা বসে আক বোগা গোগ্রাসে পোলাও-কালিয়া কোপ্তা-কাবাব ধ্বংস করছেন, এমন সময়ে গাঁয়ের জনৈক মুরুব্বি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে খবর দিলে, পুকুরের ধারে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন ইরানি সৈনিকের উদয় হয়েছে।

আক বোগা নিশ্চিন্তভাবে মাংসের হাড় চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘বহুৎ আচ্ছা! যাও, গাঁয়ের লোকজন নিয়ে এসো, তারপর খানা খেয়ে আমি ওদের সঙ্গে লড়াই করব।’

মুরুব্বি বললে, ‘হুজুর, ওরা দলে ভারী, আপনি পালিয়ে গেলেই ভালো করবেন।’

আক বোগা বললেন, ‘আরে না, না, আমি আক্রমণ করে ওদের ঘোড়াগুলো কেড়ে নেব। ইরানিরা শেয়ালের পাল, আমার মতন নেকড়ে বাঘকে দেখলেই চম্পট দেবে।’

মুরুব্বি বোকা নন, বোগা সাহেবকে চটাতে ভরসা করলে না, গাঁয়ের জনকুড়ি লোককে কোনওরকমে ডেকে আনলে।

আক বোগা খাওয়াদাওয়া সেরে মুখ মুছতে মুছতে নিজের ঘোড়ার উপরে চড়ে এগিয়ে গেলেন এবং ইরানিদের দেখেই বিকট হই হই রবে চিৎকার করে উঠলেন।

ইরানি সৈনিকরা সবিস্ময়ে নিজের নিজের ঘোড়ার উপরে উঠে বসল!

তাই দেখেই গাঁয়ের লোকেরা দিলে টেনে লম্বা!

কিন্তু আক বোগা পালাবার ছেলে নন, তিনি একাই ঘোড়া ছুটিয়ে মাথার উপরে বন-বন করে তরবারি ঘোরাতে ঘোরাতে চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘হা রে রে রে রে, যুদ্ধং দেহি, যুদ্ধং দেহি!’

কিন্তু ইরানিরা যুদ্ধ দেবার নামও করলে না। তারা ভাবলে, এ লোকটা হচ্ছে দলের অগ্রদূত মাত্র, একা কখনও চল্লিশ-পঞ্চাশ জনকে আক্রমণ করতে আসে? আক বোগা যত জোরে হই হই করেন, তারাও তত বেগে ছুটে পালায়!

আক বোগা শেষটা হতাশ ভাবে গ্রামে ফিরে এসে ঘৃণা ভরা কণ্ঠে বললেন, ‘ইরানিরা হচ্ছে শেয়ালের পাল; কিন্তু এই গাঁয়ের লোকগুলো হচ্ছে ভিতু খরগোশ।’