আট
পরদিন সকালে লোকেনের মূৰ্ছা ভাঙল বটে, কিন্তু মুখে কোনও কথা ফুটল না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। সারাদিনই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা ছাড়া লোকেনের কাজ নেই। হাঁক-ডাক নেই, মুখে বাক্য নেই, শাসন-তর্জন নেই, এমনকি ওঠা নেই, হাঁটা নেই, হাসি নেই। লোকে বলাবলি করতে লাগল, লোকেনবাবুর হলো কী!
ডাক্তার, কবরেজ এলো, শুভানুধ্যায়ীরা এলো, বন্ধুবান্ধব এলো। লোকেন শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে তো চেয়েই থাকে। খাওয়ালে খায়, শোয়ালে শোয়, বসালে বসে, হাঁটালে হাঁটে, কিন্তু নিজে থেকে কিছু করে না। বাড়িতে কান্নার রোল উঠল, পাড়াপ্রতিবেশীরা আহা-উঁহু করল, আবার অনেকেই বলাবলি করতে লাগল, “ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন।”
সকালবেলায় বাগানে গোলাপ গাছের কলম বসিয়ে তার মাথায় গোবরের ঢিবলি দিচ্ছিল গোপাল, এমন সময় নরেশ পাল এসে বললেন, “রাসপতি নন্দীকে চেনেন কি?”
“না, কে তিনি?”
“সেদিন আলাপ হলো, বেশ রাশভারী লোক মশাই।”
“তা হবে।”
“অমন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন না। তিনি আপনার ঠাকুরদার ঠাকুরদা।”
“ওহ হ্যাঁ-হ্যাঁ মনে পড়েছে। তা কোথায় আলাপ হলো?”
“কেন, রোজই তো একতলার বারান্দায় পায়চারি করেন নিশুত রাতে।”
“বটে!”
“সেদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এ বাড়িতে ঘুরঘুর করো কেন বলো তো? গুপ্তধনের খোঁজে নাকি?’ তা আমি বললুম, ‘ঠিক ধরেছেন। এ বাড়িতে গুপ্তধনের অভাব কী? এই আপনারই তো সেই গুপ্তধন।’ তা শুনে বেজায় খুশি হলেন। বললেন, ‘বেশ-বেশ। লেগে থাকো। আরও এরকম গুপ্তধন মেলাই পাবে।’”
“তা পাচ্ছেন নাকি?”
“বিস্তর-বিস্তর। রোজই নতুন-নতুন কারও না-কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। আপনার বাড়ি মশাই গুপ্তধনের আড়ত।”
সুখলতা সকালে নাটমন্দির ঝাঁটপাট দিয়ে জিরোচ্ছিল। মন্দিরে হলধর চক্রবর্তী পুজোর আয়োজন করছেন। সুখলতা হেঁকে বলল, “বলি ও ঠাকুরমশাই!”
হলধরও হেঁকে বললেন, “কী বলছিস?”
“তুমি বাপু আজকাল মন দিয়ে পুজো করছ না। করলে কি শাঁখটা চুরি যেত?”
“দূর বোকা, মন্তরের জোর না থাকলে কি চুরি যাওয়া শাঁখ আবার ফেরত আসত?”
“আমি বলি কী, তুমি বরং একটা বন্ধনমন্ত্র দিয়ে শাঁখটাকে ভালো করে বেঁধে রাখো, যাতে আর চুরি-টুরি না যায়।”
“ওরে, ও শাঁখ নিজেই অনেক মন্ত্র জানে। আমি রোজ পুজোয় বসে শুনতে পাই, শাঁখের ভিতর থেকে মন্ত্রের শব্দ আসছে।”
“বটে? আমাকে একদিন শোনাবে?”
“তুই কি কানে ভালো শুনিস যে শুনবি!”
“আর কিছু তেমন না শুনলেও মন্তর শুনতে পাই।”
গায়ে নাড়া খেয়ে ঘুম ভেঙে নিশুত রাতে বিছানায় উঠে বসলেন মৃদঙ্গ।
“কে হে জগাই নাকি?”
“যে আজ্ঞে। কিন্তু একী করছেন কর্তা? আপনার যে হাতে-পায়ে ডুমো-ডুমো গুলি ফুটে উঠেছে, বুকের ছাতি ঠেলে বেরচ্ছে, গর্দানে গত্তি লেগেছে।”
মৃদঙ্গবাবু ভারী খুশি হয়ে বললেন, “হবে না? রোজ ডন-বৈঠক করছি, মুগুর ঘোরাচ্ছি, কসরত করছি, ছোলা খাচ্ছি। এখন তো আমার পাঁই পাঁই করে দৌড়তে ইচ্ছে করে, ধাঁই ধাঁই করে লাফাতে মন চায়, হা হা করে অট্টহাসি হাসতে ইচ্ছে যায় আর খুব মারপিট করার জন্য হাত-পা নিশপিশ করে।”
জগাই সভয়ে বলল, “ওই শেষ ইচ্ছেটা তো বড় বিপজ্জনক কর্তা।”
মৃদঙ্গবাবু একটু হতাশার গলায় বললেন, “কী করব বলো? এখন যে আমার মারপিট করার জন্য বড় আইঢাঁই হয়, নিজেকে সামলে রাখাই মুশকিল। রাস্তায় ঘাটে, হাটে-বাজারে লোকের সঙ্গে নানা ছুতোয় ঝগড়া লাগানোর চেষ্টা করি, কিন্তু কেউ তো তেড়ে আসে না তেমন। সবাই আমার চেহারা দেখে রণে ভঙ্গ দেয়। এ যেন ভেড়ুয়ার রাজত্ব। গুন্ডা, মস্তানগুলো গেল কোথায় বলো তো?”
“সর্বনাশ! আপনি যে বড্ড হন্যে হয়ে উঠেছেন কর্তা।”
“তা তো বটেই। ঘুসির জোর বেড়েছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখার খুব ইচ্ছে। কিন্তু সুযোগই তো হচ্ছে না। তাই সেদিন ভারী বিরক্ত হয়ে বারান্দার একটা থামের গায়েই দুম করে একটা ঘুসি মেরে বসলাম।”
“বটে! তারপর কী হলো?”
“থামটা বলে উঠল, ‘উঃ!’”