নন্দীবাড়ির শাঁখ – ৭

সাত

কুস্তিগিরদের একটা মুশকিল হলো তাদের চেহারাটা বড়সড়। ফলে হাটুরে মারের পক্ষে সুবিধে হয়। অনেকটা জায়গা পাওয়া যায়। রোগা-শুঁটকো সরু চেহারা হলে হাটুরে মার যারা মারে, তারা ততটা জায়গা পায় না। এই সার সত্যিটা পরশুদিনই প্রথম টের পেল জগাই।

বিষ্ণু দারোগা একদিন দুঃখ করে বলেছিলেন, “তুই তো চোর নোস। তা হলে রাতবিরেতে মানুষের বাড়িতে ঢুকিস কেন?”

জগাই মাথা চুলকে বলেছিল, “আজ্ঞে, কে কেমন আছে সেই খোঁজখবর করতেই ঢুকি। মানুষকে কুশল প্রশ্ন করা আর কী।”

“বেশ তো, ভালো কথা। তা কুশল প্রশ্ন করতে দিনমান কী দোষ করল।”

“আজ্ঞে, দিনমানে দেখেছি লোককে গিয়ে যদি জিজ্ঞেস করি, ‘কেমন আছেন?’ তা হলে প্রশ্নটা গায়ে মাখে না। বরং আঁশটে মুখ করে অনিচ্ছের সঙ্গে বলে, ‘এই চলে যাচ্ছে।’ কিন্তু নিশুত রাতে তার ঘরে ঢুকে যদি ঘুম ভাঙিয়ে ওই একই প্রশ্ন করি তখন কেঁপে-ঝেঁপে হাতজোড় করে বলবে, ‘ভালো আছি বাবা, ভালো আছি। তুমি ভালো তো!’”

“তখন যদি তোকে চোর বলে ধরে ফাটকে দেয়, তখন? চুরির জন্য না হোক, বেআইনি অনুপ্রবেশের জন্যও কিন্তু জেল হয়। মনে রাখিস।”

“কিন্তু বিষ্ণুবাবু, ব্রজ কর্মকারের বাড়ির দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দ্বিতীয় ধাপটা যে আসলে একটা বাক্স এবং তার মধ্যে যে বিশুর সোনাদানা আছে সে খবর কি আপনাকে আমি দিইনি? জয়শংকরের বড় মেয়ে যখন নিশুত রাতে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়তে যাচ্ছিল তখন আমি গিয়ে হাজির না হলে কী হত বলুন দেখি। পরমেশ্বর সাহা যে রোজ রাতে ছাদে উঠে আশপাশের বাড়িতে ঢিল মারে এ কি কেউ ধরতে পেরেছিল কোনওদিন? আপনি কি কোনওদিন জানতে পারতেন যে নিবারণ মুৎসুদ্দি তার চৌবাচ্চায় কুমির পুষছে? আর কেউ কি খবর রাখে যে ধরবাড়ির রাঙাদিদা রোজ রাতে চুপিচুপি নিজের গোঁফ কামান? পাঁচু সরখেল যে গ্যাঁড়া ডাকাতকে তার চিলেকোঠার লুকিয়ে রেখেছিল তা কি এই শৰ্মা ছাড়া আপনি জানতে পারতেন? আর লোকেনবাবুর খবরের তো লেখাজোখা নেই।”

“সেটা ঠিকই। তোর জন্যই এই তল্লাটের সকলের হাঁড়ির খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু তুই একজন পালোয়ান মানুষ। শেষে কি চোর বলে বদনাম কিনবি?”

শুয়ে-শুয়ে এসব কথাই এখন ভাবছে জগাই। উঠবার, হাঁটবার ক্ষমতা নেই তার। সর্বাঙ্গে নানা রকমের পুলটিশ আর মাঝে-মাঝেই রাম কবিরাজ বিচিত্র এবং বিটকেল সব বড়ি আর পাঁচন গেলাচ্ছেন। শুয়ে থাকতে-থাকতে বিরক্ত হয়ে সে মাঝে-মাঝে বলে, “একটা ভালো ওষুধ দিয়ে চাঙা করে দিন না। কতদিন এরকম পড়ে থাকব?”

রাম কবিরাজ ভ্রু কুঁচকে বলে, “মরা মানুষ জ্যান্ত করতে তো সময় লাগবেই রে বাপু। তোর দেহে প্রাণটুকুই যা যাই-যাই করছিল। শুধু ফুরুৎ করার অপেক্ষা। সেটা যে করেনি সেই রক্ষে।”

সেটা জগাই ভালোই জানে।

লোকেনের দলবল যখন গজু ওস্তাদের আখড়ায় হামলা করেছিল, তখনও একবার মার খেয়েছিল বটে জগাই। তবে তাতে তেমন চোট হয়নি। গতু বারণ না করলে গুন্ডাদের তারা পাটপাট করে দিতে পারত। সেবার পালটি নিতে পারেনি, ফলে জগাইয়ের ভিতরে এখনও জ্বালা আছে। সেই থেকে সে লোকেনের জাত-শত্রু। তবে গজু ওস্তাদের কাছে কুস্তি ছাড়া আর যে শিক্ষাটা সে পেয়েছে তা হলো, পালোয়ান মানে কিন্তু গুন্ডা মস্তান নয়।

সেদিন সকালেবেলা মুগুর ভাঁজছিল জগাই। এমন সময়ে মহাদেবদা এসে হাজির। চুল উসকোখুসকো, চোখে জল। প্রথমে কথাই বলতে পেরে উঠছিল না। খানিক জিরিয়ে একটু সামলে উঠে বলল, “এবার যে সবর্নাশ হয়ে যাবে রে জাগাই। বিষ্ণুর শাঁখ চুরি হয়ে গিয়েছে।”

খবরটা তার অজানা ছিল না। নীলমণির কাছে শুনেছে। তবু মাথায় বজ্রাঘাত হলো জগাইয়ের। শাঁখের বৃত্তান্ত সে জানে। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছে। বহুকাল আগে গোপালের দাদু গোবিন্দ নন্দী খুব অভাবকষ্টের সময় বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে পড়েছিলেন। এক সাহেব শাঁখটার জন্য এক লাখ টাকা কবুল করায় তিনি ঠিক করছিলেন শাঁখটা বেচে দেবেন। সিদ্ধান্তের কথা বাড়ির সবাইকে জানিয়ে রাতে শুতে গিয়েছিলেন। ভোরবেলা সেই শাঁখ আপনা থেকে বেজে উঠেছিল। আর সেদিনই রাতে বাড়িতে ডাকাত পড়ে। গোবিন্দ নন্দী মারা পড়েন। ভয়ে শাঁখটা বিক্রির কথা আর কেউ তোলেনি।

মহাদেব কাঁদতে-কাঁদতে বলল, “আজ ভোররাতে শাঁখের শব্দ শুনেই বুঝেছিলুম সর্বনাশ হতে আর বাকি নেই।”

মুগুর রেখে জগাই পোশাক পরতে-পরতে বলল, “তুমি কেঁদো না মহাদেবদা, এলাকার চোরডাকাতদের আমি ভালোই চিনি।”

চোর কে হতে পারে তা সে জানে। অ ভজিয়ে নেওয়ার জন্য একবার গয়ারামের কাছে গেল। চোরের পাত্তা লাগিয়ে দিল গয়ারাম, সব চোরের ঠিকুজি-কুষ্ঠি যার জানা, গতিবিধি মুখস্থ। শুনেই বলল, “উ তো নয়া চোর আছে রে নিতাই। উকে তো লাগিয়েছে লোকেনবাবু। হুঁশিয়ারসে আগে বড়না, কিঁউ কি লোকেনবাবু বহোৎ খতরনাক আদমি।”

“লোকেন চোরকে কাজে লাগাল কেন? তার নিজের লোকই তো ছিল।”

“লোকেনবাবুকে বুরবক পেয়েছিস কি? নিজের লোক পাকড়া গেলে মুসিব্বৎমে গিরেগা।”

অনাথের মিষ্টির দোকান যে চোরদের আস্তানা তা সবাই জানে। সেইখানেই নিতাইকে পেয়ে গিয়েছিল জগাই। তারপর তক্কে-তক্কে ছিল।

গ্যাঁড়াপোতার বৈরাগী দিঘির ধারে রতন আর নিতাই আলাদা হলো। আর তখনই সুযোগ এলো জগাইয়ের। বেশি কিছু করতে হয়নি। পিছন থেকে হাতের কানা দিয়ে একবার মারতেই ঢলে পড়ে গেল।

তবে চালে একটু ভুল হয়েছিল। রতন যে বেশি দূর যায়নি এটা খেয়াল ছিল না। দূর থেকে সে কাণ্ডটা দেখেই ছুট লাগায়। খবরটা যে সে অবিলম্বে লোকেনের কাছে পৌঁছে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। বিপদ বুঝে জগাইকে পালাতে হলো।

শেষরক্ষা কি হলো? জগাইয়ের মনে হচ্ছে, খানিকটা হলো, খানিকটা হলো না। শাঁখটার সন্ধান পাওয়া কি লোকেনবাবুর পক্ষে খুব শক্ত হবে? কে জানে। শাঁখটা আপাতত বাঁচলেও সে আর-একটু হলেই খরচের খাতায় লেখা হয়ে যাচ্ছিল।

ভুজঙ্গবাবুদের বাড়ি থেকে বেরনোর সময় শেষ রাতে দেওয়াল টপকে পিছনের রাস্তায় নেমেছিল সে। অন্ধকার ছিল। একটু কুয়াশাও ছিল। এলাকাটা প্রায় পেরিয়েও গিয়েছিল সে। কিন্তু বৈরাগী দিঘির ধারেই তার গায়ে পাবড়া ছুঁড়ে মেরেছিল কে যেন! পড়ে যেতেই দুমদাম লাঠি আর চেন, সঙ্গে দায়ের কোপ। পালোয়ান হলেও সে তো অতিমানব নয়। মারের শেষে গড়িয়ে জলে ফেলে দেওয়া হলো তাকে, এ পর্যন্ত জগাই টের পেয়েছিল। তারপর আর মনে নেই। তার ভাগ্য ভালো যে, মাথাটা দিঘির ধারে একটা কাঁচা ঘাটের পৈঠায় আটকে গিয়েছিল বলে শ্বাসটা বন্ধ হয়নি। সকালে লোকজন দেখতে পেয়ে তাকে তোলে। তাদের মধ্যে রাম কবিরাজও ছিলেন। নাড়ি দেখে বলেন, “ওরে, একে হাসপাতালে নিলে মুর্দাবরে পাঠিয়ে দেবে। তার চেয়ে আমার বাড়িতে নিয়ে চল। দেখি চেষ্টা করে বাঁচাতে পারি কিনা।”

প্রাণ ফিরে পাওয়া ইস্তক তার মনে হচ্ছে, শরীরটা যেন আর তার নেই। দেহ যেন ছাড়ি-ছাড়ি অবস্থা।

তৃতীয় দিন সকালে রাম কবিরাজ তার নাড়ি ধরে রোজকার মতোই আধঘণ্টা চোখ বুজে চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, “ক্ষত বিষিয়ে যায়নি, রক্তক্ষরণ বন্ধ। এ যাত্রায় বৈতরণীর খেয়াটা আর পেরোতে হচ্ছে না তোকে।”

“আমাকে এবার খাড়া করে দিন কবরেজমশাই।”

“তুই তো পালোয়ান, দাঁড়াবি তার ভাবনা কী? আর-একটা দিন সবুর কর বাপু।”

জগাইয়ের মনটা বড় ছটফট করছে। মৃদঙ্গবাবু ভেড়ুয়া সোক। শাঁখটা রক্ষা করার মতো তাকত নেই। লোকেন পাজি এবং বুদ্ধিমান। দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে তার দেরি হবে না।

চতুর্থ দিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সে বুঝতে পারল, শরীরে ব্যথাবেদনা আছে বটে, কিন্তু শরীরটা তার নিজের বলেই মনে হচ্ছে। বিছানা থেকে নেমে সে একটু হাঁটাহাঁটিও করল। না, মাথা চক্কর দিচ্ছে না বা হাত-পা কাঁপছে না।

কবরেজমশাই ফের আধঘণ্টা নাড়ি ধরে বসে থাকার পর একটা শ্বাস ছেড়ে বললেন, “যদি কথা দিস যে বেশি হুড়যুদ্ধ করবি না, তা হলে তোকে ছেড়ে দেব। বাড়ি গিয়ে ক’দিন একটু ভালো করে জিরো। অনেকটা রক্ত গিয়েছে তোর, বাড়ি গিয়ে খুব কুলেখাড়া, শাকসবজি আর খেজুর খাস।”

“বাঁচালেন কবরেজমশাই।”

গায়ের ব্যথায় মৃদঙ্গবাবু বড় কাহিল হয়ে সকালবেলায় উঠে “উঃ আঃ” করছিলেন। তাঁকে কখনও বাঘে কামড়ায়নি বটে। কিন্তু বাঘে কামড়ালে কী হতে পারে তা-ই যেন হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছিলেন তিনি। মাত্র দু’দিন ডন-বৈঠক করলে যে এরকম হাড় মড়মড় ব্যথা হয় তা জানা ছিল না তাঁর। তবে গজু পালোয়ান বলেছে, ব্যথা জব্দ করার ওষুধ হলো ডন-বৈঠক চালিয়ে যাওয়া। তাঁর কুস্তির আখড়ায় ভর্তি হওয়ার খবর শুনে তাঁর মা গজু পালোয়ানকে শাপশাপান্ত করছেন, তাঁর বউ মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছেন, ভাই গৌরাঙ্গ বলেছে, “দাদাকে সাইকিক্রিয়াটিস্ট দেখানো উচিত।” শুধু তাঁর বাবা ভুজঙ্গবাবুই যা একটু উৎসাহ দেখিয়েছেন। ভ্রু তুলে বলেছেন, “মগজটা তো আর খুলবে না, তবু যা হোক শরীর আর স্বাস্থ্যটা একটু খুলুক। বাড়িতে একজন দরোয়ান বা পাহারাদার গোছের লোকও তো থাকা দরকার।”

সকালে ছাদে উঠে স্কিপিং করার চেষ্টা করেছিলেন মৃদঙ্গবাবু। বারকয়েক পায়ে দড়ি জড়িয়ে আছাড় খেয়েছেন, তাতে হাঁটুর নুনছাল উঠে গিয়েছে। কিন্তু সাধনা ছাড়া যে এ জিনিস সম্ভব নয় তাও বুঝতে পেরেছেন।

এমন সময়ে রামু এসে খবর দিল, “সেই যে বোয়াল মাছের মতো মুখওয়ালা লোকটা, সে দেখা করতে এসেছে।”

“বোয়াল মাছের মতো মুখ! কে রে লোকটা?”

“ওই যে শীতল মান্না না কী যেন নাম।”

নামটা শুনে মোটই খুশি হলেন না মৃদঙ্গবাবু। তবে একটু হাঁফ ছাড়ার জন্য নিচে নামলেন তিনি।

আজও শীতল মান্নার মুখে বড়-বড় দাঁতের বিগলিত হাসি।

“শুনলাম, ব্যায়াম করছিলেন।”

“ওই একটু-আধটু।”

“বাহ, বাহ, ব্যায়াম করা খুব ভালো জিনিস মশাই। নিয়মিত ব্যায়াম করলে খিদে বাড়ে, মেধা বাড়ে, ছাতি বাড়ে, ঘুম হয়।”

“সেরকমই শোনা যায় বটে।”

“তবে একটা কথা বলি, কিছু মনে করবেন না যেন।”

“কথাটা কী?”

“ব্যায়াম করুন খুব ভালো কথা। কিন্তু ওই গজু গুন্ডার আখড়ায় ভর্তি হয়ে কি আপনি ঠিক কাজ করলেন?”

“গজু ওস্তাদ কি গুন্ডা নাকি?”

“আর বলবেন না মশাই, শুধু গুন্ডা? ওই আখড়া তো গুন্ডা তৈরির কারখানা। এই শহরে যত মারপিট, খুন খারাপি হয় সবার পিছনে তো গজু গুন্ডার দলবল মশাই।”

“তাই নাকি? আমার জানা ছিল না।”

“চুপিচুপি বলে রাখছি মশাই, যত তাড়াতাড়ি পারেন নাম কাটিয়ে দিয়ে চলে আসুন। আর ওই যে জগাই দাস, ওটিও ওই গজু গুন্ডার চেলা কিনা। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি কিছু বাকি নেই। আবার চোরাই মাল এর ওর তার বাড়িতে লুকিয়ে রেখে যায়।”

“তাই নাকি? কিন্তু আপনি যে সেদিন বলছিলেন চোরের মতো ঢুকলেও জগাই নাকি চুরি করে না।”

“আপনি ভুল বুঝেছেন মৃদঙ্গবাবু, আমি বলেছি যে, সে সব বাড়িতে চুরি করতে ঢোকে না। কোনও-কোনও বাড়িতে ঢুকে অন্য বাড়ির চোরাই মাল রেখেও যায়, যাতে তার বাড়িতে সার্চ হলে ধরা না পড়ে। সুযোগমতো আবার সেই চোরাই মাল সরিয়ে নিয়ে যায়। ধুরন্ধর চোর মশাই।”

“আমাদের বাড়িতে সে কিন্তু কিছু চুরি করেনি।”

“সেইটেই তো ভয়ের কথা। এমন হতেই পারে, সে হয়তো কোনও চোরাই মাল রাখতে এসেছিল। চিন্তা করে দেখুন, আপনারা বিশিষ্ট মানুষ, শহরের মান্যগণ্য লোক, আপনাদের একটা প্রেস্টিজও তো আছে। এখন ফস করে যদি আপনাদের বাড়ি থেকে চোরাই মাল বেরোয়, তা হলে কি আপনাদের সম্মান থাকবে?”

মনে-মনে একটু ভয় খেয়ে মৃদঙ্গবাবু বললেন, “তা হলে কী করা উচিত বলুন তো?”

“আমি বলি কী, ভালো করে সারা বাড়ি খুঁজে দেখুন, জগাই কোনও জিনিস রেখে গিয়েছে কিনা। আপনার ঘরেই রাখার সম্ভাবনা বেশি।”

“কী রকম জিনিস হতে পারে বলুন তো। সোনাদানা, হিরে-জহরত বা আর কিছু?”

“আলপটকা বলি কী করে বলুন। তবে শুনতে পাচ্ছি নন্দীবাড়ির পুরনো শাঁখটা চুরি হয়েছে। সেটাই কিনা ভাবছি।”

“ঠিক আছে। কিছু খুঁজে পেলে আমি বরং দারোগা বিষ্ণুবাবুকে পৌঁছে দেব।”

টপ করে এক হাত জিব কেটে শীতল মান্না বলল, “খবরদার। ও কাজও করতে যাবেন না। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা তো পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ। কাজ কী পুলিশের ঝামেলায় জড়িয়ে? নন্দীবাড়িতে আমার নিত্যি যাতায়াত, আমার হাতে দেবেন, পৌঁছে দিয়ে আসব। বেশ বড়সড় দক্ষিণাবর্ত শাঁখ মশাই। গায়ে নকশা আছে।”

একথায় ভারী দোটানায় পড়ে গেলেন মৃদঙ্গবাবু। শাঁখটার প্রতি তাঁর একটা রহস্যময় দুর্বলতা আছে বটে, কিন্তু জিনিসটা যে তাঁর নয়, এটাও তো স্বীকার করতে হবে। আর বাস্তবিকই তো, চোরাই জিনিস বাড়িতে রাখা বিপজ্জনক। থানা-পুলিশ হতেই পারে।

তার এই দোনোমনো ভাবটা লক্ষ করেই শীতল মান্না বলল, “মনে হচ্ছে আপনি নিজেও কিছু একটা সন্দেহ করছেন। তা গিয়ে দেখে আসুন না, ওরকম কিছু আপনার ঘরে জগাই ফেলে গিয়েছে কিনা।”

মৃদঙ্গবাবু ভালোমানুষ। বেশিক্ষণ পেটে কথা চেপে রাখার অভ্যাস তাঁর নেই। একটা বড় শ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ, একটা শাঁখ জগাই রেখে গিয়েছে বটে।”

চোখ গোল করে চিন্তিত শীতল মান্না বলে, “গিয়েছে? তা হলে ও জিনিস যত তাড়াতাড়ি পারেন বিদেয় করুন। শুধু পুলিশের হুজ্জতই নয়, শুনেছি ওই শাঁখ অভিশপ্ত, নানা অশৈলী কাণ্ড হয় শাঁখ বাড়িতে রাখলে।”

এবার একটু বুদ্ধি খাটিয়ে মৃদঙ্গবাবু বললেন, “ঠিক আছে। শাঁখ আমি নিয়ে আসছি। তবে মাপ করবেন, আপনার হাতে ওটা দিতে পারব না। কারণ, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র দু’দিনের। আমি নিজে ওই শখ গিয়ে নন্দীবাড়িতে পৌঁছে দেব।”

চোখ বড় করে হাঁ হয়ে খানিকক্ষণ মৃদঙ্গর দিকে চেয়ে থেকে শীতল মান্না গদগদ গলায় বলে, “আপনার উপর শ্রদ্ধা বহুগুণ বেড়ে গেল মশাই। আপনি সত্যিই একজন কাণ্ডজ্ঞানওয়ালা মানুষ। সত্যিই তো, উটকো একটা লোকের হাতে ও জিনিস এক কথায় তুলে দেওয়া কি উচিত?”

“কিন্তু মুশকিল হলো, আমি নন্দীবাড়ি চিনি না। কোনওদিন নামও শুনিনি।”

“তাতে কী! আপনি চিনবেনই বা কী করে। আমিই আপনাকে নিয়ে যাব। বেশি দূরও নয়, শহর ছাড়িয়ে মাইলখানেক। আমার তো সারাদিনের জন্য রিকশা ভাড়া করাই থাকে। ওই যে ফটকের বাইরে আমার রিকশা। আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে, ফের পৌঁছেও দিয়ে যাব। কোনও চিন্তা করবেন না। রোদ আরও চড়বার আগেই চলুন বেরিয়ে পড়ি।”

শীতল মান্নার তাড়াহুড়োটা একটু সন্দেহজনক না? মৃদঙ্গ আবার ভাবলেন, কথাগুলো তো আর অযৌক্তিক বলছে না। তিনি দোতলায় উঠে শাঁখটা আলমারির মাথা থেকে নামিয়ে একটু দেখলেন শাঁখটাকে। তাঁর শরীরে একটা শিহরণ হচ্ছে। শাঁখটা সামান্য জিনিস নয়। ফেরত দিতে তাঁর বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু অন্যের জিনিস তো দখলও করা উচিত নয়।

শাঁখটা একটা নাইলনের ব্যাগে ভরে নিলেন। সিঁড়ি বেয়ে নামবার সময় তিনি দেখতে পেলেন শীতল মান্না বারান্দা থেকে নেমে বাগানে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে যেন ফোনে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। দৃশ্যটা খুব একটা ভালো লাগল না তাঁর। মনটা টিক টিক করছে।

রিকশায় উঠে হুডটা তুলে দিল শীতল মান্না। বলল, “ওহ, আপনি খুব সাচ্চা মানুষ মশাই, এই কলিযুগে আপনার মতো মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়াও ভাগ্যের কথা।”

শহর ছাড়িয়ে রিকশাটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। আশপাশে জনমনিষ্যি দেখা যাচ্ছে না।

একটু উদ্বেগের সঙ্গে মৃদঙ্গবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কত দূর বললেন?”

“আর মাইলটাক। রাস্তা ভালো নয় তো, তাই সময় লাগছে।”

আচমকা যে কাণ্ডটা ঘটল তার জন্য মোটেই তৈরি ছিলেন না মৃদঙ্গ। একটা বাঁশঝাড় পেরিয়ে যাচ্ছে রিকশাটা, গোটাচারেক ছোকরা বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রিকশাটা দাঁড় করাল। পট করে একজন শীতল মান্নাকে বুকের জামা খিমচে ধরে টেনে নামাল, অন্যজন মৃদঙ্গকে।

শীতল মান্না প্রাণপণে চেঁচাচ্ছিল, “বাঁচাও, বাঁচাও, ডাকাত!”

পরপর দুটো ঘুসি খেয়ে শীতল মায়া কাটা কলা গাছের মতো রাস্তায় পড়ে গেল। ছেলেগুলো বিনা বাক্যে মৃদঙ্গবাবুর ব্যাগটা টেনে হিঁচড়ে কেড়ে নিল। মৃদঙ্গবাবু সদ্য ব্যায়ামাগারের কসরত করা শিখছেন, ফলে ভিতরে একটা সুপ্ত বীরত্বের আচমকা জাগরণ ঘটায় তিনি জীবনে প্রথম একটা ঘুসি মারলেন। কিন্তু যাকে মারলেন সে ঘুসিটাকে পাত্তাই দিল না। উলটে একটা হালকা ঘুসি বসিয়ে দিল মৃদঙ্গের নাকে। মৃদঙ্গ ঘুরে পড়ে গেলেন রাস্তায়। মাথা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল।

অবশেষে কেঁদে কঁকিয়ে শীতল মান্নাই এসে ধরে তুলল তাঁকে। উদ্বেগের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “এহে, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে নাকি? এ তো রক্তারক্তি কাণ্ড!”

নিজেকে ভারী বোকা-বোকা লাগছিল মৃদঙ্গবাবুর। একটা বাচ্চা ছেলেকে কেউ যেন জুজুর ভয় দেখিয়ে হাত থেকে রসগোল্লাটা কেড়ে নিয়ে গিয়েছে। এত সহজে শাঁখটা হাতছাড়া হয়ে যাবে এটা ভাবতেই পারেননি মৃদঙ্গবাবু। চক্রান্তটা তিনি বুঝতেও পারছেন খানিকটা। কিন্তু কিছু করারও নেই। ছিনতাইবাজরা মোটরবাইকে উঠে হাওয়া হয়ে গিয়েছে।

শীতল মান্না ফাঁকা রাস্তায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিল, “আমিও ছাড়ব না। দেখে রাখিস, সব ক’টাকে চিনে রেখেছি। বিষ্ণুদারোগাকে বলে সব ক’টাকে পিছমোড়া করে বেঁধে আনাব। সব জানি, তোরা জগাই দাসের চেলা। মোটরবাইকের নম্বরও আমার মুখস্থ। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই তোদের ব্যবস্থা হচ্ছে।”

হাঙ্গামা দেখে রিকশাওয়ালা পালিয়ে গিয়েছিল। এবার ফিরে এলে তাকেও খুব ধমকাল শীতল মান্না, “এ তোর কেমনধারা ব্যবহার ফেলু? আমাদের বিপদে ফেলে পালিয়ে গেলি যে বড়! এখন শিগগির চল, মৃদঙ্গবাবুর নাক থেকে রক্ত পড়ছে দেখছিস না, শিগগির ডাক্তারখানায় নিয়ে যেতে হবে।”

ডাক্তারখানায় নিয়ে গিয়ে নাকে বরফ ঘষে, রক্ত বন্ধ করার পর ওষুধ-টষুধ দিয়ে যত্ন করে মৃদঙ্গবাবুকে বাড়িতে পৌঁছে দিল। বলল, “একদম চিন্তা করবেন না। এ শাঁখ আমি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার করে আপনার হাতে পৌঁছে দেব। আপনি নিজে গিয়ে গোপাল নন্দীকে দিয়ে আসবেন। আমি এখনই থানায় গিয়ে ডায়েরি করাই।”

মৃদঙ্গবাবুর নাকের অবস্থা দেখে বাড়িতে প্রবল চেঁচামেচি শুরু হলো। মৃদঙ্গ গুন্ডাদের হাতে ঘুসি খেয়েছে শুনে তার মা অনন্তবালা দা নিয়ে বেরতে চাইছিলেন। স্ত্রী হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলেন। মেয়ে ছলছল চোখে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল আর ভুজঙ্গবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, “কাঁইচি মেরে ফেলে দিতে পারলি না? ধোবিপাটে আছাড় মারতে পারলি না? একটা কুংফু কিকও তো মারতে পারতিস!”

মৃদঙ্গবাবু সারাদিন খুব অন্যমনস্ক রইলেন। শাঁখটাখ নিয়ে তিনি ভাবিত নন। তিনি গভীরভাবে শুধু ভাবছেন, আমি যে ছেলেটাকে একটা ঘুসি মারলুম ছেলেটা সেটা টেরই পেল না কেন?

নিশুতরাতে মৃদঙ্গবাবু আজও স্বপ্ন দেখছিলেন। এমন সময়ে পায়ে নাড়া খেয়ে চোখ চাইতেই অন্ধকার থেকে কে যেন বলে উঠল, “টর্চ জ্বালাবেন না কর্তা। আমি জগাই।”

“জগাই! কিন্তু শুনলাম তুমি মারা গিয়েছ!”

“ভুল শোনেননি। একরকম তাই। ষোলাআনা বেঁচে আছি বলা যায় না।”

“তোমার কাছে আমার বড্ড অপরাধ হয়ে আছে।”

“বলেন কী? অপরাধ কীসের?”

“শাঁখটা রেখে গিয়েছিলে, আমি তা আগলে রাখতে পারিনি।”

“সর্বনাশ? কী হয়েছিল বলুন তো।”

খুব অনুতাপের সঙ্গে মৃদঙ্গ ঘটনাটা বললেন।

জগাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনি খুব সোজা মানুষ। ঘটনাটা যে সাজানো তা ধরতে পারেননি।”

“একটা কথা বলবে জগাই? আমি একটা ব্যাপারের মাথামুন্ডু বুঝে উঠতে পারছি না।”

“কী ব্যাপার বলুন তো।”

“যারা ছিনতাই করছিল আমি তাদের মধ্যে একটা ছেলের মুখে একটা ঘুসি মেরেছিলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য, ছেলেটা ঘুসিটা যে তার মুখে লাগল তা যেন টেরই পেল না। তোমার কী মনে হয় আমার ঘুসিতে কোনও জোর নেই?”

“কী যে বলেন মৃদঙ্গবাবু। ওসব ভাবছেন কেন? আসলে ঘুসোঘুসি তো আপনার লাইন নয়। ছেলেটার লাগুক আর না-লাগুক, টের পাক বা না-পাক, আপনি যে মেরেছিলেন সেটাই তো সাহসের কাজ।”

“না হে জগাই, তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ। ওতে ভবি ভুলবার নয়। আমি ভাবছি, আমার গায়ে আর-একটু জোর থাকলে শাঁখটা এত সহজে কেড়ে নিতে পারত না। কী বলো?”

“তা বলে সবাই কী আর রুস্তম হবে নাকি মৃদঙ্গবাবু? আপনার মতো ভাবুক লোককেও তো পৃথিবীতে দরকার। সবাই ঘুসোবাজ হয়ে গেলে দুনিয়াটা কি বাসযোগ্য থাকবে?”

“আহা, তা বলে তো গায়ের জোরটা কোনও খারাপ জিনিস নয়। আর সেইজন্যই আমি এই চারদিন হলো গজু পালোয়ানের আখড়ায় নাম লিখিয়েছি।”

জগাই বিস্ময়ের সঙ্গে বলে, “বলেন কী মশাই? শেষে হাত-পা মটকে পড়ে থাকলে কী হবে?”

“আমাকে ভড়কে দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। আজ নিজের কেরামতি দেখে নিজের উপর ঘেন্না এসে গিয়েছে।”

“দেখবেন কর্তা, কসরত করে চেহারা বাগানোর পর আবার রদ্দাটদ্দা মেরে বসবেন না।”

“চালাকি কোরো না জগাই, তুমিও যে একজন পালোয়ান তা আমি জানি।”

জগাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

জগাইয়ের দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাসটা পড়ল ভোররাতে, লোকেনবাবুর শোয়ার ঘরে, যখন লোকেনবাবু বিছানায় উঠে বসে জগাইয়ের দিকে পিস্তল তাক করে বললেন, “তিন গুনতে-শুনতে পাতলা হয়ে যা। এক…”

তীরে এসে তরী ডুবলে দীর্ঘশ্বাস পড়ারই কথা। লোকেনের বাড়িতে দু’-দু’জন পাহারাওয়ালা দুটো অ্যালসেশিয়ান কুকুর এবং বন্দুক-পিস্তল আছে। এ বাড়িতে ঢোকার কথা কোনও চোর বা ডাকাতেও স্বপ্নে ভাবে না। কারণ, লোকেন নিজেই তাদের ধর্মবাপ। কিন্তু জগাইয়ের জেদ হলো যে বাড়িতে ঢোকা যত কঠিন সেই বাড়িতেই সে ঢুকবে।

ঢুকলও। দু’জন পাহারাদারের একজন বাগানে রাউন্ড মারছিল। অন্যজন ফটক আগলে বসেছিল। সাধারণত, চোরেরা সদর দিয়ে ঢোকে না। তাই সদরের পাহারা একটু ঢিলে হয়। তাই জগাই সদরটাই বেছে নিয়েছিল। পাহারাদারটাকে ঘায়েল করতে লেগেছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

লোকে বিশ্বাসঘাতক আর ঘুষখোরদের নিন্দে-মন্দ করে বটে, কিন্তু জায়গামতো দু’-চারটে ঘুষখোর আর বিশ্বাসঘাতক থাকলে কিন্তু অনেক কাজের ভারী সুবিধে হয়ে যায়। সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না। বেশি গা-ও ঘামাতে হয় না, কার্যসিদ্ধি হয়ে যায়।

আর তাই সকালের দিকটাতেই নীলমণিকে হাটখোলার কাছে ধরেছিল জগাই। নীলমণি বলল, “না বাপু, নিমকহারামি করতে পারব না। শত হলেও লোকেনবাবু আমার অন্নদাতা, তা ছাড়া তোমাকে বিশ্বাস কী বলো। এই তো সেদিন হাজার টাকার চুক্তি করে টাকাটা ফের ধার বলে ফেরত নিলে। তোমার ফাঁদে আর পা দেয় কোন আহম্মক?”

জগাইয়ের হাতদুটো নিশপিশ করছিল। কিন্তু মাথা গরম করে তো লাভ নেই। এরকম একজনকেই তো তার এখন দরকার। সুতরাং সে আগের হাজার টাকার সঙ্গে আরও হাজার টাকা হাতে দিতেই নীলমণির মুখে স্বর্গীয় হাসি ফুটল। বলল, “বাজারে সবকিছুরই একটা দাম আছে, বুঝলে জগাইদাদা! সবকিছু কী আর গা জোয়ারিতে হয়!”

বন্দোবস্ত না করে উপায় ছিল না জগাইয়ের। লোকেনের পাজি অ্যালসেশিয়ানগুলো খ্যাঁকালে মুশকিল আছে। আর ছাদের সিঁড়িঘরের দরজাটার খিল খোলা থাকলে তার একটু সময় বাঁচে।

ঘুষের টাকা খেলে নীলমণি কারও সঙ্গে বেইমানি করে না। সদর টপকে বাগানটা অনায়াসে পেরিয়ে দেওয়ালের কার্নিশ বেয়ে ছাদে উঠতে জগাইয়ের বিশেষ গা ঘামাতে হলো না। কুকুরেরাও চুপচাপ। সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলার সামনের দিকে লোকেনের ঘরে ঢুকতেও কোনও বাধা নেই। লোকেনের ঘরের ভিতরকার দৃশ্যও চমৎকার। ঘরে একটা মৃদু সবুজ আলোর ডুম জ্বলছে। খাটের উপর লোকেন গভীর ঘুমে। তার শিয়রেই জলজ্যান্ত শাঁখটা। মনে হচ্ছে, ঘুমনোর আগে শাঁখটা নিরখপরখ করছিল।

দুনিয়াতে যে-কোনও লাইনেই যারা খুব উন্নতি করে তাদের কোনও না-কোনও গুণ থাকেই। বড় পাজি হতে গেলেও মেধা আর বুদ্ধি কিন্তু কম দরকার হয় না। এলেবেলে লোকের মধ্যেও পাজি লোক মেলা আছে বটে তবে গুণের অভাবে তারা এলেবেলেই থেকে যায়।

লোকেন যে কত বড় পাজি তা একটু বাদেই বুঝতে পারল জগাই। পা টিপে-টিপে খাটের কাছটায় গিয়ে সবে শাঁখের দিকে হাত বাড়িয়েছে, কী করে যেন গভীর ঘুমের মধ্যেও তা টের পেল লোকেন। হয়তো শ্বাসের শব্দ পেয়েছে বা শরীরের তাপ। কোনও মানুষ যে শোয়া অবস্থা থেকে ওরকম ছিপটির মতো উঠে বসতে পারে তা যেন দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না জগাইয়ের। শোয়া থেকে এত তাড়াতাড়ি মাথা তোলা দিতে পারে একমাত্র কেউটে বা গোখরো।

সে হাঁ হয়ে গেল। ভালো জিনিসের প্রশংসা না করাটাও অন্যায়। ওটা ছোট মনের পরিচয়। সে বলে উঠল, “বাহ, আপনার বডি তো খুব ফিট মশাই!”

লোকেন স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বলল, “তুই কে? কী চাস?”

কথাটা গায়েই মাখল না জগাই, সপ্রশংস গলায় বলল, “ইচ্ছে করলে ভালো জিমন্যাস্ট হতে পারতেন মশাই।”

ঠিক এই সময়ে ভোজবাজির মতো কোথা থেকে যেন একটা পিস্তল উঠে এলো লোকেনের হাতে। দেখে হাঁ হয়ে গেল জগাই। অবাক গলায় বলল, “গ্যাঁড়াপোতার মেলায় জাদুকর গজপতিকে দেখেছিলাম মশাই। দুটো খালি হাত, কিচ্ছু ছিল না, হঠাৎ ফস করে ইস্কাপনের টেক্কা উঠে এলো হাতে। কোথা থেকে পিস্তলটা বের করলেন বলুন তো, ঠাহরই করতে পারলুম না।”

লোকেন দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “ঘরের মধ্যে খুনটা করতে চাইছি না। তিন গুনতে গুনতে পাতলা হয়ে যা। এক…”

জগাই জানে এই অবস্থায় সে খুন হয়ে গেলে লোকেনের ফাঁসি বা যাবজ্জীবন হবে না। কারণ, ঘরে মাঝরাতে অনাহূত লোককে মারলে সেটা খুনের মধ্যে ধরা হয় না। ইস, শাঁখটা হাতে প্রায় এসে গিয়েও কেঁচে গেল। তাই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

লোকেন বলল, “দুই…”

তিন বলার আর সময় হলো না লোকেনের, তার আগেই কাণ্ডটা ঘটল। হঠাৎ তার শিয়রে রাখা শাঁখটা থেকে একটা গভীর, বায়ুমন্থন করা শব্দ উঠে এলো। তীব্র, গভীর, ভয়ঙ্কর, ঝোড়ো শব্দ যেন কানকে বধির করে দিচ্ছিল। শাঁখের শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠছে ঘরবাড়ি, জিনিসপত্র। কাঁপছে শরীর, কাঁপছে বাতাস, কেঁপে উঠছে মাটি। সেই আশ্চর্য শব্দে জগাইয়ের মাথাটা যেন ভোঁ হয়ে গেল।

মাথা ঝিমঝিম করছিল জগাইয়ের। তবু তার মধ্যেই সে দেখতে পেল, হাতের পিস্তল ফেলে দিয়ে দু’হাতে কান চেপে ধরেছে লোকেন। তারপরই হঠাৎ তার চোখ উলটে গেল। সে গোঁ গোঁ করে চিতপটাং হয়ে পড়ে গেল বিছানার উপর।

যেমন হঠাৎ করে বেজে উঠেছিল, তেমনি হঠাৎ করে থেমে গেল শাঁখের আওয়াজ।

চারদিকটা ভীষণ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে শাঁখটার দিকে চেয়ে রইল জগাই। তারপর সংবিত ফিরে পেয়ে চারদিক চেয়ে দেখল যে, এরচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ আর কী-ই বা হতে পারে! শাঁখটা তুলে নিয়ে সে চটপট সরে পড়ল।