নন্দীবাড়ির শাঁখ – ৬

ছয়

তাঁর ঘুম হলো অনেকটা ব্যান্ডেজের মতো। পরতের পর-পরত, পরতের পর-পরত। তাই একবার ঘুম ভাঙার জন্য তাঁকে চারবার জাগতে হয়। আজও নিশুত রাতে ঘুম ভেঙে উঠে মৃদঙ্গবাবু বুঝতে পারছিলেন না, এটা কত নম্বর জাগা। এবং এর পর আর কয়েকটা জাগা জাগতে হবে। ভাবতে-ভাবতে একটু চিন্তিত মুখে যখন চোখ বুজতে যাবেন, ঠিক সেই সময় ফাঁকা অন্ধকার ঘরে একটা দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ হলো। মৃদঙ্গবাবু একটু চমকে উঠে বললেন, “কে? জগাই দাস নাকি?”

কেউ জবাব দিল না। বালিশের পাশ থেকে টর্চটা তুলে নিয়ে তিনি ঘরের চারদিকে আলো ফেললেন। কেউ নেই। মশারি তুলে খাট থেকে নেমে খাটের তলাও দেখলেন। পরিষ্কার, জনমনিষ্যি নেই। তবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল কে? স্পষ্ট শুনেছেন, কানের ভুল নয়। বিছানায় ঢুকতে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পিছনে ফের সেই দীর্ঘশ্বাস।

অশরীরী কাণ্ড নাকি? মৃদঙ্গবাবুর গায়ে কাঁটা দিল। কাঁপা গলায় বললেন, “দীর্ঘশ্বাসবাবু, আমার হার্টফেল হলে কি আপনার কিছু সুবিধে হয়? নাক ছাড়া দীর্ঘশ্বাস কি ভালো?”

কেউ কোনও জবাব দিল না। মশারি তুলে হামাগুড়ি দিয়ে বিছানায় ঢুকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লেন মৃদঙ্গবাবু। বুকটা বড় কাঁপছে। চোখ শক্ত করে বুজে ভাবতে লাগলেন, ‘এসব কিছু নয়। আমি স্বপ্ন দেখছি।’

হাহাকার ভরা আরও একটা দীর্ঘশ্বাস কানে এলো মৃদঙ্গবাবুর। হঠাৎ কেন যেন মনে হলো, শব্দটা আসছে কাঠের আলমারির মাথা থেকে। তবে কি আলমারির মাথায় উঠে কেউ লুকিয়ে রয়েছে? তা লুকিয়েই যদি থাকিস বাপু, তা হলে লুকনোর নিয়মকানুনগুলো মানবি তো! লুকিয়ে থেকে কেউ অত বড়-বড় করে মোষের মতো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে? তাতে কি লুকনোটাই ভন্ডুল হয়ে যায় না! লোকের ঘুম ভাঙিয়ে জানান দিয়ে এ আবার কোন ছিরির লুকনো। ভাবতে-ভাবতে মাথাটা উত্তেজিত হয়ে পড়ায় মৃদঙ্গবাবুর ভয়ডর ভেঙে গেল। তিনি উঠে বসে গলা একটু তুলে বললেন, “তুমি যেই হও বাপু, কাজটা কিন্তু বড় কাঁচা হয়ে যাচ্ছে। ঘাপটি মেরে থাকতে গেলে নিজেকে একটু কন্ট্রোল করতে হয়। যখন-তখন হাঁচি, কাশি, দীর্ঘশ্বাস দিয়ে ফেললে যে কেলেঙ্কারি হে! কেমনধারা আনাড়ি চোর হে তুমি?”

কেউ অবশ্য কোনও জবাব দিল না।

মৃদঙ্গবাবু ফের মশারি তুলে বেরিয়ে এলেন। মস্ত উঁচু বিশাল আলমারিটার মাথায় উঠে কেউ ঘাপটি মেরে থাকলে নিচে থেকে বুঝবার উপায় নেই। তাই মৃদঙ্গবাবু জল রাখার টুলটা টেনে এনে তার উপর উঠলেন। টর্চ মেরে দেখলেন, আলমারির মাথায় কেউ নেই, তবে হাবিজাবি জিনিস কিছু রয়েছে। তা হলে দীর্ঘশ্বাসটা ফেলছে কে? এ তো ভারী তাজ্জব কাণ্ড!

হঠাৎ মৃদঙ্গবাবুকে শিহরিত করে একেবারে তাঁর নাকের ডগাতেই এবার দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা হলো। বুক কাঁপানো, মর্মন্তুদ, করুণ, হাহকারে ভরা একটা প্রবল দীর্ঘশ্বাস। আর তখনই মৃদঙ্গবাবু খবরের কাগজে মোড়া মস্ত বড় শাঁখটাকে প্রথম দেখতে পেলেন। শাঁখটার কথা তাঁর মনেই ছিল না।

এত অবাক বহুকাল হননি তিনি। কিছুক্ষণ হাঁ করে শাঁখটার দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। আলগা মোড়কে ঢাকা বলে পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু যেটুকু ফাঁকফোকর দিয়ে দৃশ্যমান, তাতে বোঝা যাচ্ছে বেশ বাহারি শাঁখ। সচরাচর এমন সুন্দর শাঁখ দেখা যায় না। তিনি চেয়ে থাকতে থাকতেই ফের শাঁখের ভিতর থেকেই ফের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এলো।

মৃদঙ্গ চোখ বুজে ফেললেন। নাঃ, তিনি ফের স্বপ্নই দেখছেন। এই এক জ্বালা। স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন, তার মধ্যে আবার স্বপ্ন। একবার ঘুম ভাঙতেই তাঁকে চার-পাঁচবার জাগতে হয়।

হতাশ হয়ে নেমে পড়ছিলেন। তারপর কী ভেবে হাত বাড়িয়ে শাঁখটা তুলে নিলেন। ওজনে বেশ ভারী। সারা গায়ে নানা কারুকাজ, যেগুলো মানুষের করা নয়। প্রাকৃতিক। ঘরের আলো জ্বেলে ভালো করে শাঁখটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন তিনি। জগাই বলেছিল বটে, এই শাঁখটার জন্য নাকি তার প্রাণ যেতে বসেছিল। তা হলে কি শাঁখটার মধ্যে কোনও রহস্য আছে? থাকা বিচিত্র নয়। কারণ, দীর্ঘশ্বাসটা যে এই শাঁখের ভিতর থেকেই বেরিয়েছে তাতে তাঁর তেমন সন্দেহই নেই। তবে সেটা শাঁখের ভিতরকার ডিজাইনের জন্যও হতে পারে। হঠাৎ ঝটকা হাওয়া ঢুকে গেলে শাঁখে ওরকম শব্দ হওয়া হয়তো সম্ভব। কিন্তু সে হলো যুক্তির কথা। শাঁখটা যে যুক্তিসিদ্ধ উপায়েই দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে তার ঠিক কী?

মৃদঙ্গবাবু শাঁখটা হাতে নিয়ে চিন্তিতভাবে টুলের উপর বসে রইলেন। তিনি টের পাচ্ছিলেন হাতে-ধরা শাঁখটা যেন শান্ত নয়, অস্থির। খুব সূক্ষ্ম একটা কাঁপন কি টের পাচ্ছেন তিনি? মনের ভুলই হবে। তবু শাঁখটি তুলে কানের কাছে ধরলেন মৃদঙ্গ। শাঁখের গহ্বর থেকে খুব ক্ষীণ কিন্তু ভয়ঙ্কর শব্দটা শুনতে পেলেন তিনি। যেন এক কালান্তক ঘূর্ণিঝড় সমুদ্র মন্থন করতে করতে ধেয়ে আসছে। শুনতে পেলেন সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছাসের গুরুগম্ভীর গর্জন। শুনতে পেলেন যেন বিশাল বড় বড় বাড়িঘর ভেঙে পড়ছে ভয়ঙ্কর আর্তনাদের সঙ্গে। চমকে উঠে শাঁখটা কান থেকে সরিয়ে আনলেন। স্তম্ভিত হয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন শাঁখটার দিকে। এ তো সাংঘাতিক জিনিস! এমন হতেই পারে যে, তিনি স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু তা যদি না হয় তা হলে বলতে হবে, এটা কোনও এলেবেলে শাঁখ নয়।

শাঁখটা হাতে নিয়ে সেই যে ঝুম হয়ে বসে রইলেন মৃদঙ্গ, কখন যে ভোর হয়ে গিয়েছে তা টেরই পাননি।

শাঁখটা যথাস্থানে রেখে দিলেন মৃদঙ্গ। ঘোরে অন্যমনস্কভাবে প্রাতঃকৃত্যাদি সারলেন। জলখাবার খেলেন। তারপর পোশাক পরে বাড়িতে “একটু আসছি, ” বলে বেরিয়ে পড়লেন।

হাসপাতালটা নিতান্তই ছোটখাটো। হেলথ সেন্টার বললেই হয়। তবে রোগী রাখার ব্যবস্থা আছে। সামনের ঘরেই একজন গোমড়ামুখো ডাক্তারবাবু বসা, পাশে একজন বয়স্কা নার্স, সামনে অপেক্ষমান কয়েকজন রোগী।

মৃদঙ্গবাবু নার্সকেই জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে জগাই দাস নামে একজন সিরিয়াসলি উন্ডেড লোক ভর্তি আছে না?”

নার্স আঁশটে মুখে বললেন, “না।”

“একজন উন্ডেড লোক?”

“একজনই উন্ডেড লোক আছে। তার নাম জগাই নয়, নিতাই দাস।”

মৃদঙ্গবাবু ভাবলেন হতে পারে জগাই দাস তার আসল নাম গোপন করেছিল। তাই তিনি বললেন, “তার সঙ্গে একটু দেখা করতে পারি?”

“পারেন। ডরমিটরিতে বাঁ দিকের তিন নম্বর বেড। আপনার পেশেন্ট হলে তাড়াতাড়ি রিলিজ করে নিয়ে যাবেন। আমাদের বেডের এখন খুব ডিমান্ড।”

“ঠিক আছে, ” বলে মৃদঙ্গ ঢুকে পড়লেন।

তিন নম্বর বেডে মাথা আর বাঁ হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা একজন মাঝারি চেহারার লোক চোখ বুজে শুয়ে আছে। ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হবে।

মৃদঙ্গবাবু একটু গলাখাঁকারি দিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলেন, “জগাই!”

একডাকেই লোকটা চোখ মেলে তাঁর দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ খ্যাঁক করে উঠল, “কে জগাই? কাকে চাইছেন?”

মৃদঙ্গবাবু একটু থতমত খেয়ে বললেন, “কেন, তুমি জগাই নও?”

লোকটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, “কোন দুঃখে আমি জগাই হতে যাব? আমার তিন কুলে কেউ জগাই নেই। কেটে পড়ুন তো মশাই!”

মৃদঙ্গবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “বলছিলাম কী, তুমি কি আমাকে চেনো? আমি মৃদঙ্গ।”

নিতাই খুব অভদ্র গলায় বলে, “খুব চিনি মশাই। আপনি হাড়কেপ্পন ভুজঙ্গবাবুর বড় ছেলে। এই গঞ্জে সবাই সবাইকে চেনে।”

মৃদঙ্গবাবু বুঝতে পারছেন না তিনি ভুল করছেন কিনা। তবু মিনমিন করে বললেন, “তোমার কাছে একটা কথা জানতে এসেছিলাম।”

লোকটা তেমনি তিরিক্ষি মেজাজ দেখিয়ে বলল, “কী কথা?”

“তুমি কি একটা দক্ষিণাবর্ত শঙ্খের কথা কিছু জানো?”

নিতাই বিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠে বলল, “কিসের শঙ্খ? কোথাকার শঙ্খ? কার শঙ্খ? সকালবেলায় এসেই আগড়ম বাগড়ম বলতে লেগেছেন! আচ্ছা লোক তো আপনি!”

নিতাইয়ের চেঁচামেচিতে অন্য রোগীরাও অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। মৃদঙ্গ প্রমাদ গুনে বললেন, “তা হলে বোধ হয় আমার ভুলই হয়েছে।”

“হ্যাঁ, আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। এখন কেটে পড়ুন।”

“আচ্ছা, ” বলে মৃদঙ্গ পিছু ফিরতেই নিতাই বিষাক্ত গলায় বলল, “ইঃ, শাঁখ খুঁজতে এসেছেন! শাঁখ! শাঁখ যেন ছেলের হাতের মোয়া।”

মৃদঙ্গ দু’পা এগিয়েও একটু দাঁড়ালেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, নিতাই চোখ বন্ধ করে চাপা গলায় আপনমনেই বলছে, “ওই অলক্ষুণে শাঁখের জন্যই তো আমার এই অবস্থা। রোজগারপাতি বন্ধ। বাড়িতে হাঁড়ির হাল, তার উপর চোট। লোকেন ব্যাটাও একটা পয়সা উপুড়হস্ত করবে না।”

মৃদঙ্গবাবু পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে নিতাইয়ের কাছে গিয়ে বললেন, “এই টাকাটা রাখো। শাঁখ সম্পর্কে যদি তোমার কিছু জানা থাকে, তা হলে আমি একটু শুনতে চাই।”

নিতাই টাকাটা ফস করে নিয়ে মুখ বিকৃত করে বলে, “আপনি দেখছি আপনার বাবার চেয়ে বেশি কিপ্পুস!”

মৃদঙ্গবাবু অগত্যা আরও পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললেন, “এবার বলো।”

মাথাটা নেড়ে নিতাই বলে, “শাঁখ সম্পর্কে আমার কিছুই জানা নেই মশাই। শুধু জানি ওটা অলক্ষুণে শাঁখ।”

“শাঁখটা কার? কোথায় ছিল?”

“কেন, পুলিশের কাছে গিয়ে লাগাবেন নাকি মশাই?”

“আরে না না। আমার নিজেরই একটু কৌতূহল আছে।”

“আপনি মশাই হাসপাতালে এসেছিলেন তো জগাইকে খুঁজতে। কেন বলুন তো। জগাইয়ের সঙ্গে কি আপনার সাঁট আছে?”

“না হে নিতাই, জগাইকে আমি ভালো করে চিনিও না।”

“তা হলে খুঁজছিলেন কেন?”

“কে যেন বলছিল জগাই ওই শাঁখটা সম্পর্কে জানে।”

“জগাইকে যে হাসপাতালে পাওয়া যাবে একটা কে আপনাকে বলেছে?”

মৃদঙ্গবাবু দোনোমোনো করে বলে ফেললেন, “ভুল খবরই হবে বোধ হয় হে নিতাই। তবে খবরটা আমাকে দেয় শীতল মান্না। চেনো নাকি?”

“শীতলবাবু! সকালবেলাতেই নামটা শোনালেন! আজ নির্ঘাত আমার ভাগের মাছ বিড়ালে খেয়ে যাবে। ডালে মাছি পড়বে, ভাত পোড়া গন্ধ ছাড়বে। দুর্গা-দুর্গা! আজ নির্ঘাত ডাক্তারবাবু ইনজেকশন ঠকবে, নার্স দিদিমণি দাঁত খিঁচোবে আর জমাদার পয়সা চাইবে। হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন! শীতল মান্নাকে চিনি কিনা! কপালের ফেরে চিনি মশাই, কিন্তু না নিলেই ভালো হত। তা শীতল মান্না কী বলেছে আপনাকে?”

“বলেছে জগাই নাকি মরো-মরো। হাসপাতালে আছে।”

“আহা, তা হলে বড্ড ভালো হত মশাই। কিন্তু জগাই মরো-মরো হওয়ার পাত্রই নয়। সে বরং অন্যদের মরো-মরো করে ছাড়ে। তা আপনি শাঁখ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন কেন বলুন তো! শাঁখ সম্পর্কে আপনাকে কি কেউ কিছু বলেছে?”

“ওই শোনা কথা আর কী।”

“শাঁখের কথা ভুলে যান মশাই। আপনার ভালোর জন্যই বলছি। আপনারা কেপ্পন হলেও লোক খারাপ নন। শাঁখের পিছনে বড় বড় রাঘববোয়ালেরা লেগেছে। আমার দশা দেখছেন না?”

“তোমাকে এভাবে জখম করল কে? কেনই বা?”

নিতাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে কি আর আমাকে নাম-ঠিকানা দিয়ে মেরেছে মশাই? সন্ধেবেলা বাড়িতে ঢুকতে যাচ্ছি, এমন সময় পিছন থেকে মাথায় চোট হলো। মূর্ছা গিয়েছিলুম। তারপর এই হাসপাতালে। আমার মনে হয় শাঁখের ভিতর যে প্রেতাত্মা ঢুকে রয়েছে এ তারই কাজ।”

“তা হলে কি তোমার কাছেই শাঁখটা ছিল?”

নিতাই ফের একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, “ছিল মশাই, এখন আর নেই। কিন্তু মশাই, একশো টাকার মাপে অনেক বেশি কথা কয়ে ফেলেছি। আর নয়, এই বাজারে একশো টাকায় কী হয় বলুন।”

“আমার কাছে আর নেই।”

“থাকলেই কি দিতেন?”

“ঠিক আছে, যাচ্ছি। শুধু একটা কথা, জগাই দাস আসলে কে?”

“তার আমি কী জানি। জগাই নামে কত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, সবাইকে কি চেনা সম্ভব?”

“এই নাও বাপু, দশটা টাকা দিচ্ছি।”

“আপনার নজর ছোট, যাকগে জগাই দাস মস্ত পালোয়ান। গজুবাবুর কুস্তির আখড়া চেনেন তো, ওখানেই কুস্তি শিখেছিল। গজুবাবুর চেলা।”

“সে কি চোর?”

“তা জানি না মশাই। চোর না হলেও ভালো লোক নয়। লোক রোগী দেখতে এলে হাতে ফল-টল নিয়ে আসে। আজকাল কি রেওয়াজটা উঠে গিয়েছে নাকি মশাই?”

“আমি তো রোগী দেখতে আসিনি বাপু। তবু আরও দশটা টাকা দিচ্ছি, একটা কমলালেবু বোধ হয় ওতে হয়ে যাবে।”

মৃদঙ্গবাবু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন।

জীবনে কখনও একটাও ডন বা বৈঠক দেননি মৃদঙ্গবাবু। ব্যায়াম বা আসন করার ইচ্ছেও জীবনে কখনও হয়নি। তাই গজু পালোয়নের আখড়ায় ঢুকে তাঁর একটু ভয়-ভয়ই করছিল। যেন এক দঙ্গল গোরিলার মধ্যে ঢুকে পড়েছেন। একজন প্যারালাল বার-এ উঠে উলটোপালটা খাচ্ছে, জনাদুই বারবেল তুলছে হাপুসহুপুস করে, জনাতিনেক বিশাল-বিশাল কাঠের গদা ঘোরাচ্ছে সাঁই-সাঁই করে। বাদবাকিরা হুমহাম শব্দ করে ডন বা বৈঠক মারছে। চারদিকে যেন মাংসপেশির ঢেউ খেলে যাচ্ছে। ফটকের ভিতরে ঢুকেই তিনি সামনের বীরত্বব্যঞ্জক দৃশ্যটা দেখে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এদের কারও হাতের একটা কোঁৎকা খেলেই বোধ হয় তাঁর পাঁজর ভেঙে যাবে। এরা যদি রাগী মানুষ হয়, তা হলে তো আরও চিত্তির।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একটি ল্যাঙটপরা, পাহাড়প্রমাণ ছেলে এসে খুবই ভদ্র গলায় বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, “ভর্তি হতে এসেছেন নাকি?”

আঁতকে উঠে মৃদঙ্গ বললেন, “না-না। আসলে আমি একজনকে খুঁজতে এসেছি।”

“কাকে বলুন তো!”

“ইয়ে, ওই জগাই দাস নামে একজন।”

“ও, জগাইদা! ওই যে গজুদা, টুলের উপর বসে আছেন, উনি জানেন।”

পেশির অরণ্যে সাবধানে গা বাঁচিয়ে মৃদঙ্গ যখন গজু পালোয়ানের সামনে হাজির হলেন, তখন তাঁর মনে হলো একটা টিলার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

ভাগ্য ভালো যে, এরা সব বিনয়ী এবং ভদ্রলোক। কটমট করে তাকায় না। দাঁত কটমট করে কথা বলে না। দিব্যি হাসি হাসি মুখ। গজু তাঁর দিকে চেয়ে হাসিমুখেই বলল, “ভয় পাবেন না। কুস্তি শেখা খুব সহজ। ইচ্ছে করলেই হয়। প্রথম-প্রথম গায়ে-হাত-পায়ে একটু ব্যথা হয় বটে, কিন্তু দু’দিনেই ব্যথা মরে যায়। তখন খুব ফুরফুরে লাগে।”

মৃধবার ভিতরে কী হলো কে জানে, তার মনে হলো বুকে ভিতরে কে যেন ডিগবাজির পর-ডিগবাজি খাচ্ছে। তিনি একটু কাঁপা গলায় বললেন, “চোট-টোট লাগলে? আমি আবার ব্যথা একদম সহ্য করতে পারি না কিনা।”

“আরে না-না। আমাদের ট্রেনাররা খুব পাকা, যত্ন করে শেখায়। শুরু করতেই যা গড়িমসি হয়। কিন্তু একবার শুরু করে দিলে দেখবেন নেশার মতো পেয়ে বসবে।”

“ভরসা দিচ্ছেন তো!”

“খুব-খুব। দু’মাস বাদে নিজেকেই নিজে চিনতে পারবেন না।”

বুকে কেমন একটু জোর পেলেন মৃদঙ্গবাবু। তিনি রোগাভোগা দুবলা বলে কেউই তেমন তাঁকে পাত্তা দেয় না। এরকম একখানা শরীর বাগালে কেউ চোখে চোখ রেখে কথা কওয়ার সাহস পাবে? তিনি মরিয়া হয়ে বলেই ফেললেন, “আমি রাজি। কী করতে হবে?”

গজু পালোয়ান সহর্ষে বলে উঠল, “সাবাস! যান, ওই ঘরে নন্দগোপালের কাছে খাতায় নাম লিখিয়ে আসুন।”

মৃদঙ্গবাবু বেশ উত্তেজিত বোধ করছেন। কেমন যেন একটা আনন্দও হচ্ছে। ম্যান্তামারা জীবন কাটানোর উপর ঘেন্না এসে যাচ্ছে। তিনি গটগট করে গিয়ে নন্দগোপালের খাতায় নিজের নামধাম লিখে ফেললেন। নন্দগোপালও একজন পালোয়ান। খুশিয়াল গলায় বলল, “শক্তিমানদের জগতে স্বাগত!”

আনন্দের চোটে কী কাজে এসেছিলেন, সেটাই ভুলে মেরে দিয়েছিলেন মৃদঙ্গবাবু। আখড়া থেকে বেরিয়েই মনে পড়ায় আবার ফিরে গেলেন।

গজু পালোয়ান বলল, “কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ। ইয়ে আমি একজনকে খুঁজছিলাম। তার নাম জগাই দাস।”

গজুর মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বলল, “জগাইয়ের সঙ্গে কি আপনার কোনও দরকার আছে?”

“হ্যাঁ, জরুরি দরকার।”

“গত তিনদিন ধরে জগাইয়ের কোনও খোঁজ নেই। তার বাড়ির লোক ভাবছে, আমরাও টেনশনে আছি।”

“জগাইয়ের কি কিছু হয়েছে?”

“সেটা বোঝা যাচ্ছে না। কেউ-কেউ গুজব ছড়াচ্ছে জগাই নাকি খুন হয়ে গিয়েছে।”

“সর্বনাশ।”