নন্দীবাড়ির শাঁখ – ৪

চার

“নিতাই, এ বাড়িতে কি কুকুর আছে?”

“না।”

“তবে আমি কুকুরের গন্ধ পাচ্ছি কেন?”

“দূর আহাম্মক! কুকুরের গন্ধ আবার কী? কুকুর থাকলে তো ঘেউ-ঘেউ করত।”

“তা করছে না। কিন্তু আশপাশে ঘুরঘুর করছে। হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছে। আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।”

“তুই আসলে ঘাবড়ে গিয়েছিস। ঘাবড়ে গেলে মানুষ ভুল-ভাল শোনে। এ বাড়িতে কুকুর নেই, পাহারাদার নেই, দরোয়ান নেই। থাকার মধ্যে আছে একটা বুড়ো কাজের লোক আর-একটা মাথা পাগলা ছোঁড়া। আমাদের কাজটা জলবৎ তরলং। বুঝলি?”

“বুঝলাম। কিন্তু আমার আশপাশে কুকুরটা যে ঘুরছে তা কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি কর। আমার গায়ের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু!”

“কুকুরই যদি হয় তা হলেই বা ভয়ের কী আছে। নেড়ি কুকুর-টুকুর হবে। তাড়া দিলেই পালাবে।”

“দু’বার টর্চ জ্বেলে দেখলাম। কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে না।”

“দাঁড়া, এ তালাটা ঝামেলা করছে, খুলছে না। তুই একটু চুপ মেরে থাক তো, আমাকে কাজ করতে দে।”

“কাজ কর না। শুধু একটু তাড়াতাড়ি কর। জায়গাটা আমার সুবিধের মনে হচ্ছে না। ভূতের বাড়ি নয় তো রে!”

“তাই বল, তোর তা হলে ভূতের ভয় মাথায় চেপেছে। গাঁয়ের লোকেদের তো কাজকম্ম নেই, বসে-বসে ওসব গাঁজাখুরি গল্প বানিয়ে রটায়। এসব বিশ্বাস করতে আছে?”

“তালাটা খুলতে পারলি?”

“মনে হচ্ছে এবার খুলে যাবে।”

ধড়াস করে তালাটা এক সময়ে খুলে ঝুলে পড়ল। নিতাই একটা শ্বাস ফেলে বলে, “যাক বাবা। শেষ পর্যন্ত খুলেছে! এমন বিচ্ছিরি তালা জন্মে দেখিনি। লোকে বলে, যে-কোনও তালা খুলতে আমার এক মিনিটের বেশি লাগে না। আর এতালা আমাকে আধঘণ্টা ভুগিয়েছে।”

মূল মন্দিরের কোলাপসিবল গেটটা নিঃশব্দে একটুখানি সরালো নিতাই, তারপর বলল, “আয় রে রতন।”

“ঢুকব তো, কিন্তু আমার যেন একটু গা ছমছম করছে। বুঝলি!”

“কলজে এত দুবলা হলে কি এমন লাইনে সুবিধে করতে পারবি? লোকেনবাবুর কানে গেলে তোকে কাজ থেকেই তাড়িয়ে দেবে।”

ভিতরে ঢুকে নিতাই টর্চ জেলে বিষ্ণুমূর্তিটা দেখল। পিতলের তৈরি দু’-আড়াই হাত লম্বা মূর্তি টর্চের আলোয় ঝলমল করে উঠল। নিতাই একটা শ্বাস ফেলে বলে, “মূর্তিটা শুনেছি ভীষণ ভারী। দু’-আড়াই মন ওজন। নইলে আজই মূর্তি হাপিস করতাম। বেচলে হয়তো লাখখানেক টাকা পাওয়া যেত। এসব পুরনো মূর্তির বেশ দাম।”

রতন বিষ্ণুকে একটা পেন্নাম করে বলল, “হুঁ।”

“এমন হেলাফেলায় ফেলে রেখেছে, যে-কোনওদিন চুরি হয়ে যাবে। তাই ভাবছি, শিগগিরই একদিন একটা গাড়ি ভাড়া করে এনে মূর্তিটা তুলে নিয়ে যাব।”

“সময় নষ্ট করছিস কেন নিতাই? এটা কি শলাপরামর্শের সময়? শাঁখ সরানোর কথা, সেটাই করে চটপট সরে পড়ি চল।”

নিতাই বিষ্ণুর উপরের ডান হাতে শাঁখটার উপর টর্চ মেরে বলল, “দেবদেবীর এত হাত থাকে কেন বল তো। পা কিন্তু সেই দুটোই।”

“ওরে হাতের হিসেব পরেও করতে পারবি।”

“আহা, কথাটা মাথায় এলো, তাই বললাম। শুনেছি মা দুর্গার নাকি আগে আঠারোটা হাত ছিল। ভেবে দেখেছিস আঠারোটা হাত সামলে ওঠা কি চাট্টিখানি কথা?”

শাঁখটা নাগালের একটু বাইরে, উঁচুতে। নামাতে গেলে মূর্তির শ্বেতপাথরের বেদির উপর পা রেখে উঠতে হয়। নিতাই একটু দোনোমনো করে বিষ্ণুকে একটা পেন্নাম করে বলল, “হেই ঠাকুর, পাপ নিয়ো না, ” বলেই উঠে ডিং মেরে শাঁখটা ডান হাতে ছুঁয়েই চমকে নেমে এলো।

“কী হলো রে নিতাই?”

“শুনলি! শাঁখটা থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।”

“ওরে বাবা! কাজটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না রে নিতাই। চল, কেটে পড়ি।”

নিতাই একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে ঠিকই। কারণ, সে স্পষ্ট শুনেছে, শাঁখটা ছোঁয়ামাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। তবে সামলে নিয়ে বলল, “মনের ভুলও হতে পারে।” বলে সে এবার বেদির উপর উঠেই দেরি না করে টপ করে শাঁখটা নামিয়ে আনল। আর তার পরেই অদ্ভুত ঘটনাটা ঘটল। হঠাৎ করুণ, গভীর, দীর্ঘ একটা আর্তনাদের মতো শাঁখটা বেজে উঠল।

সেই শব্দে হতবুদ্ধি নিতাইয়ের হাত থেকে শাঁখটা ছিটকে পড়ল বেদির উপর। আর দু’জনেই কেমন যেন মাথা ঘুরে বসে পড়ল মেঝেতে।

কিছুক্ষণ তাদের কথা কওয়ার মতো শক্তি রইল না। মাথা যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল।

খুব বেশিক্ষণ নয়। বেশিক্ষণ নয়, দশ গুনতে যতটা সময় লাগে ততটা সময় বেজে শাঁখটা থেমে গেল।

“নিতাই, পালা। ও শাঁখ আর ছুঁসনে।”

নিতাই নিজের মাথা দু’ হাতে চেপে বসেছিল। হঠাৎ একটা ঝাঁকি মেরে বলল, “পাগল নাকি? ফেলে যাব কীরে? এই শাঁখের দাম জানিস? এমন হেলাফেলার জায়গায় এ জিনিস ফেলে যেতে হয়? যা হয় হবে, শাঁখ ফেলে যাচ্ছি না বাবা, ” বলে সে প্রকাণ্ড শাঁখটা কুড়িয়ে নিল। শাঁখ আর বাজল না। নিতাই সেটা তার ঝোলায় পুরে বলল, “এবার পা চালিয়ে চল। শাঁখের শব্দে লোকে সজাগ হয়েছে।”

“কাজটা কি ঠিক করছিস নিতাই?”

“ঠিকই করছি। আমরা না নিলেও অন্য কেউ ঠিক নিত।”

“আমার বড্ড ভয় হচ্ছে।”

“সে আমারও এখন একটু-একটু হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো পাপ বেচেই খাই।”

ঘড়ি নেই বলে গোপালের সময়ের আন্দাজ অতিশয় প্রখর। এমনকি, রাতে কোনও কারণে হঠাৎ ঘুম ভাঙলেও সে নির্ভুল সময় টের পায়।

আজ শেষ রাতে তার ঘুম ভাঙল শাঁখের আওয়াজে। ঠিক চারটে বেজে পাঁচ মিনিটে। বাইশ-তেইশ বছর আগে, যখন সে অবোধ এক বালকমাত্র, তখন একবার শুনেছিল এই অলৌকিক শঙ্খধ্বনি। তখন শঙ্খধ্বনি শুনে শুধু অবাক হয়েছিল আর-একটু ভয়ও পেয়েছিল। বড় গভীর, বিষণ্ণ, কান্নার মতো একটি টানা আওয়াজ। এতদিন পরে শব্দটা শুনে ঘুম ভেঙে যখন উঠে বসল সে, তখনও তার হাত-পা কেমন ঠান্ডা আর অবশ হয়ে গেল। ও কি বিষ্ণুর শাঁখ?

রাতে ঘরে একটা প্রদীপ জ্বালানোই থাকে। টর্চ নেই বলে রাতবিরেতে আপদ বিপদের জন্য সে একটা মশাল তৈরি করে রেখেছে। সে উঠল, প্রদীপের আলো থেকে মশালটা জ্বালিয়ে নিল। তারপর একতলায় নেমে সদর খুলে বাগানের জমি পেরিয়ে ঠাকুরদালানে পৌঁছল। অবাক হয়ে দেখল মন্দিরের তালা ভাঙা, কোলাপসিবল গেট ফাঁক হয়ে আছে এবং বিষ্ণুর হাতে শঙ্খটা নেই। মন্দিরের প্রদীপ জ্বালিয়ে মশালটা নিভিয়ে দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল সে।

অনেকদিন আগে, যখন সে খুব ছোট, তখন তার দাদু নরেন নন্দী একদিন বিষ্ণুর শঙ্খটা তার কানের কাছে ধরে জিজ্ঞেস করেছিল, “কিছু শুনতে পাচ্ছ দাদুভাই?”

অভিজ্ঞতাটা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো। গোপাল সত্যিই শুনেছিল। শঙ্খের ভিতরে যেন অনেক দূর থেকে এক অশান্ত সমুদ্রের প্রচণ্ড জলোচ্ছ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে, ভেসে আসছে ভয়ঙ্কর ঝোড়ো হাওয়ার হুঙ্কার আর মর্মরধ্বনি। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্ৰপাত। দাদু তার কান থেকে শঙ্খটা সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বুঝতে পারলে কিছু?”

সে অবাক হয়ে বলেছিল, “ভয়ের শব্দ হচ্ছে তো!”

দাদু অন্যমনস্কভাবে বলেছিল, “ওই শঙ্খের মধ্যে সৃষ্টির আদি রহস্য লুকিয়ে আছে। একে রক্ষা কোরো। এও তোমাকে রক্ষা করবে।”

শঙ্খটা সে রক্ষা করতে পারেনি বলে গভীর এক শোক অনুভব করছিল। তার আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। কিন্তু তাকে ঘিরে তার চারদিকে যে সব বস্তুগুলো রয়েছে সেগুলোর সঙ্গে তার বাক্যহীন নিবিড় আত্মীয়তা রয়েছে। এই বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে যা কিছু আছে, ওই গাছপালা, মন্দির, ওই পুরনো বাড়ি তার যাবতীয় আসবাব, তার পোষা পায়রা, বিড়াল বা বেজি, তার পোষ্য ওই বুড়ো মহাদেব এসব নিয়েই তার জগৎ, তার অস্তিত্ব।

মহাদেব এক সময়ে মস্ত পালোয়ান ছিল। ছিল লেঠেল। বন্দুকেও ছিল অব্যর্থ টিপ। এখন বুড়ো বয়সে তার লম্বা শরীরটা ঝুঁকে গিয়েছে, হাঁটতে-চলতে কষ্ট হয়। চোখে ছানি আছে, কানেও কম শোনে। নিঃশব্দে কখন উঠে এসে তার পাশে বসেছে।

গোপাল ভাঙা গলায় বলল, “মহাদেবদাদা, কী হবে বলো তো!”

মহাদেব একটা বুকভাঙা শ্বাস ফেলে বলল, “রক্ষা হলো না। এবার কী হবে ভাবতে ভয় করে। আমার না হয় বয়স হয়েছে। কিন্তু তোমার তো এখনও কচি বয়স।”

“কী হবে তা নিয়ে ভাবছি না মহাদেবদাদা, যা হওয়ার তা তো হবেই। কিন্তু শাঁখটার জন্য আমার বড় শোক হচ্ছে। যেন বড্ড আপনজন কেউ হারিয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম, একটা সামান্য শাঁখ চুরি করতে তো কেউ আসবে না। সেটাই বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। আজ মনে হচ্ছে, আমার আর-একটু বিষয়বুদ্ধি থাকার দরকার ছিল। যে জিনিস নিয়ে যত রটনা হয় ততই তার দাম বাড়ে। হাড়ে-হাড়ে সেটা টের পাচ্ছি।”

“তুমি পুলিশের কাছে যাও খোকাবাবু।”

“তুমি পাগল হয়েছ মহাদেবদাদা? শাঁখ চুরির নালিশ করতে গেলে যে তারা হেসে খুন হবে। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। তারা ও শাঁখের মর্ম কী বুঝবে বলো!”

“তা হলে লাঠিগাছটা নিয়ে আমি একটি বেরোই। এ তল্লাটের চোরছ্যাঁচড়াদের তো আমি এক সময় ভালোই চিনতাম। কানাই বৈরাগী ছিল তাদের সর্দার। তার কাছে গেলেই খবর পাওয়া যাবে।”

“তুমি সব ভুলে গিয়েছ মহাদেবদাদা। কানাই বৈরাগী কবেই বুড়ো হয়ে মরে গিয়েছে। আর আগের চোর-বদমায়েশরাও কেউ নেই। তোমার তো দশ পা হাঁটলে আজকাল হাঁফ ধরে যায়।”

“কিন্তু চুপ করে বসেই বা থাকি কী করে? আমার হাত-পা যে নিশপিশ করছে।”

“বরং ঘরে গিয়ে বসে মাথা খাটাও। ভাবো।”

“কী যে বলো তার ঠিক নেই। আমি কি মাথা খাটানোর মানুষ? মাথাই নেই। সম্বল ছিল শরীরখানা, তা সেও বয়সের পাল্লায় পড়ে নড়বড়ে।”

বলে মহাদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ মেরে গেল।

আলো ফুটতে না-ফুটতেই আপনমনে বকবক করতে করতে সুখলতা এসে হাজির। গয়লা রামপদর মুখে সে প্রাতঃকালেই শাঁখচুরির খবর পেয়েছে। সেই থেকে তার আর শান্তি নেই। আকাশ-বাতাসকে শুনিয়ে বলে যাচ্ছে, “এবার মড়ক লাগবে। বান এসে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। কলেরা সান্নিপাতিক হবে ঘরে-ঘরে। দুর্ভিক্ষ লাগবে, গাঁয়ে শকুন পড়বে। চারদিকে অলক্ষণ আর অলক্ষণ!”

বাগানে জবা গাছটার আবডালে কে একটা শুয়ে আছে না ঘাসের উপর? সুখলতা খুব ঠাহর করে দেখে চিনতে পারল। এ যে মাস্টার। সুখলতা ডুকরে উঠল, “কী আক্কেল বলো তো তোমার মাস্টার! এই আশ্বিনের সকালে বড় যে মাঠের মাঝমধ্যিখানে শুয়ে আছ! শুতে হলো তো বাপু, নিজের ঘরে বিছানাই রয়েছে। মরতে এই হিমের মধ্যে খোলা জায়গায় শুয়ে থাকে কেউ। বলি ও মাস্টার! কী ঘুম রে বাবা!”

সাড়াশব্দে গোপাল বেরিয়ে এসে বলল, “কী হয়েছে মাসি?”

“এই যে তোমার পেয়ারের মাস্টারের কাণ্ড দেখো। বাগানের ভেজা ঘাসে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে।”

গোপাল এসে দেখল, নরেশ পাল ঘাসে শুয়ে আছেন বটে, কিন্তু ঘুমোচ্ছন না। উনি অজ্ঞান হয়ে আছেন। মাথায় একটা চোট রয়েছে, তা থেকে এখনও রক্ত বেরচ্ছে একটু-একটু। আর মাথার পিছন দিকটায় চাপ বেঁধে জমে আছে রক্ত।

চোখে-মুখে জলের ছিটে পড়তেই অবশ্য নরেশ পাল চোখ চাইলেন। একটু ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি।

গোপাল জিজ্ঞেস করলেন, “কেমন বোধ করছেন নরেশবাবু?”

“মাথায় বড্ড ব্যথা।”

“মাথায় চোট পেলেন কী করে?”

“জীবনে কখনও চোরের হাতে মার খাইনি মশাই। এই প্রথম। তবে দোষটা আমারই। চোরকে তাড়া করারও কিছু নিয়মকানুন আছে নিশ্চয়ই। অগ্রপশ্চাৎ একটু প্রস্তুতিরও প্রয়োজন। আনাড়ির মতো কাজ করলে কর্মফল তো ভুগতেই হবে।”

“আপনি কি চোরকে দেখতে পেয়েছেন?”

“একজন নয়, এক জোড়া। আগেভাগেই স্বীকার করে নিই যে, আমিও অপরাধী বড় কম নই। প্রায়দিনই আমি আপনার বিনা অনুমতিতে গভীর রাতে আপনার বাড়িতে হানা দিই।”

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “সে কী। রাতে হানা দেন কেন? এ বাড়িতে যে অনেক সাপখোপ আছে।”

“শুধু সাপ নয়, আপনি স্বীকার করুন বা না করুন, সাপ ছাড়াও অনেক কিছু আছে।”

গোপাল একটু মিইয়ে গিয়ে বলল, “তাই নাকি?”

“আমি বিজ্ঞানের লোক হয়েও বলছি, আপনার বাড়ি আমার অনেক ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছে। গত অমাবস্যায় নিশুতি রাতে এসে দেখি, নাটমণ্ডপে জমাটি কথকতার আসর বসেছে। একজন নেড়ামাথা গেরুয়াধারী মানুষ কথকতা করছে, বিস্তর মানুষ বসে শুনছে। ভারী অবাক হয়ে কাছাকাছি যেতে গেলেই হঠাৎ সব ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল। দিনপনেরো আগে রাত দুটোর সময়ে এসে আমি অবাক। একতলার বারান্দায় শতরঞ্চি পেতে বসে একজন মোটাসোটা ফরসা মানুষ, গলায় সোনার চেন আর একজন বুড়ো মানুষের সঙ্গে পাশা খেলছে। যেই না কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি অমনি ধাঁ করে বাতাসে হাওয়া হয়ে গেল। আর-একদিন দূর থেকেই দেখলাম নাটমণ্ডপের চাতালে যাত্রার আসর বসেছে। দুর থেকে মনে হলো বেহুলা-লখিন্দরের পালা। আমার যাত্রা দেখার ভারী নেশা মশাই। তাই ধেয়ে পেয়ে আসছি, দুম করে সব অন্ধকার আর ফাঁকা হয়ে গেল। সেই থেকে নেশা হয়ে গিয়েছে মশাই, তাই বাড়িতে ঢুকে দূর থেকেই নানা তামাশা দেখি, কাছে ঘেঁষবার চেষ্টা করি না। ওঁরা মাখামাখি পছন্দ করেন না।”

গোপাল মিনমিন করে বলে, “অনেক সময় চোখের ভুলও তো হয়।”

নরেশ মাথা নেড়ে বলেন, “না মশাই, এসব যে চোখের ভুল নয় তা আপনি ভালোই জানেন! ঠিক কিনা?”

প্রসঙ্গটা এড়ানোর জন্য গোপাল বলল, “চোরের কথা কী যেন বলছিলেন?”

“আজ্ঞে, ঘুরেফিরে সেই কথাতেই আসছি। রোজ রাতে আমি নিশি পাওয়ার মতো এ বাড়িতে হানা দিই। ভূতনাথ বলেছিল, আজ নাকি কর্ণার্জুন পালা হবে।”

“ভূতনাথ! ভূতনাথ কে?”

“সেটা তো আপনারই জানার কথা। সে এ বাড়িতেই থাকে। শুনলাম সে নাকি বুড়োকর্তার তামাক সাজে আর ধুতি চুনট করে। আমি তো তাকে আমদানি করিনি গোপালবাবু। সে আপনার বাড়িতেই থাকে।”

গোপাল অসহায় একটা ঢোক গিলে বলে, “ও! তা হবে!”

“আমি কর্ণার্জুন দেখতে এসে দেখি বাড়ি অন্ধকার। খানিকক্ষণ হতাশ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। নিত্যি রাতে এবাড়িতে কিছু না-কিছু হয়ই। যাত্রা হোক, কেত্তন হোক, পাশাখেলা হোক। কিন্তু আজ কিছু নেই। অথচ ভূতনাথ আমাকে পই-পই করে বলেছে, ‘আজ কর্ণার্জুন পালা।’ তা ওই জাম গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে ইতিউতি চাইছি, হঠাৎ নজরে পড়ল ঠাকুরদালানে একঝলক টর্চের আলো। তখনই বুঝে গেলাম, গতিক খারাপ। বাড়িতে বাইরের লোকের সমাগম হয়েছে। আর সেইজন্যই রোজকার মতো কোনও তামাশা হচ্ছে না আজ। আপনার বাড়ির বর্তমান আর অতীতরা বড্ডই লাজুক কিনা। কিন্তু বাইরের লোক কারা? কী চায়? চুরি করতে ঢোকেনি তো? এইসব সাত-পাঁচ ভেবে আমি পা টিপে-টিপে এগিয়ে গেলাম। আর তখনই হঠাৎ ওই প্রাণঘাতী আওয়াজ। হঠাৎ বেমক্কা একটা গুরুগম্ভীর শাঁখ ভোঁ করে এমন বেজে উঠল যে, আমি বুকে ধড়পড়ানিতে বসে পড়লাম। শব্দে মাথা ঝিমঝিম করছিল। আপনি বলেছিলেন বটে যে, শাঁখটা নাকি মাঝে-মাঝে নিজে থেকেই বেজে ওঠে। তখন কথাটা তেমন বিশ্বাস হয়নি। আজ ভোর রাতে হলো।”

গোপাল বলে, “শাঁখটা আপনিই বেজেছে কী করে বুঝলেন? চোরেরাও তো কেউ বাজিয়ে থাকতে পারে!”

“পারেই তো! খুব পারে। তবে আমার একটা সন্দেহ কী জানেন? গেরস্তবাড়িতে চুরি করতে এসে শাঁখ বাজিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেবে, এমন আহম্মক চোর কি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে? আরও একটা ব্যাপার হলো, শাঁখের আওয়াজে শুধু আমিই ভিরমি খাইনি, চোরেরাও খেয়েছিল। আমি তাদের একজনকে স্পষ্ট বলতে শুনেছি, ‘নিতাই পালা। ও শাঁখ আর ছুঁসনে।’”

“তার মানে একজন চোরের নাম নিতাই।”

“যে আজ্ঞে।”

“তারপর কী হলো?”

“নিতাইয়ের বিষয়বুদ্ধি অনেক বেশি। সে বুঝে গিয়েছিল এই অলৌকিক শাঁখের অনেক দাম। তাই শাঁখের ওই ভূতুড়ে আওয়াজ শুনেও সে শাঁখটা ঝোলায় পুরেছে।”

“তারপর কী হলো?”

“আপনাদের সিংহদরজার তো কোনও আগলবাগল নেই! হাঁ-হাঁ করে খোলা। তারা অনায়াসে বেরিয়ে যেত।”

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “তার মানে কি আপনি বলতে চান, তারা বেরিয়ে যেতে পারেনি?”

“পেরেছে, তবে অনায়াসে নয়।”

“তার মানে?”

“বেরনোর মুখে আমি গিয়ে তার উপর হামলে পড়ি। হঠাৎ এই হামলায় তারা ভড়কে গিয়ে প্রথমটায় পিছু হটে যায়। তারপর টর্চ মেরে আমাকে চিনতে পেরে বলে, ‘আহা মাস্টারমশাই, আপনি আবার এসব ঝামেলা-ঝঞ্ঝাটে কেন? এসব কি আপনাকে মানায়?’ আমি তখন অবাক হয়ে বললুম, ‘কেন বেমানান কী দেখলে হে?’ একজন ফস করে বলল, ‘আমরা না হয় পেটের দায়ে চুরি-ছ্যাঁচড়ামি করতে অন্যের বাড়িতে হানা দিই। কিন্তু আপনি তো ছাত্রদের অঙ্ক শিখিয়ে মাসমাইনে পাচ্ছেন। তবে আমাদের অন্ন মারতে লাইনে নেমে পড়েছেন কেন? যান মশাই বাড়ি গিয়ে ঘুমোন।’”

“এ তো রীতিমতো অপমান।”

“তবেই বুঝুন। রাগের চোটে আমি সামনের লোকটাকে একখানা মোক্ষম ঘুসি মারলুম। কিন্তু আমার ঘুসির জোর যে এত কম সেটা আমার জানা ছিল না। ঘুসি খেয়ে লোকটা হাঁ হাঁ করে উঠল, ‘করেন কী মাস্টারমশাই! আপনার এসব অভ্যেস নেই, শেষে ব্যথাট্যাথা পেয়ে বসবেন যে!’ আমি মরিয়া হয়ে দ্বিতীয় ঘুসিটা তুলতেই লোকটা বলল, ‘আচ্ছা মশাই, আচ্ছা। আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছি। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।’ এরকম বিদ্রূপ শুনলে কারই বা মাথা ঠিক থাকে বলুন! আমারও ছিল না। আমি ‘তবে রে’ বলে ওদের উপর বাঘের মতো লাফিয়ে পড়লাম। তখন একজন বলল, ‘ওরে রতন, মাস্টারমশাইকে খুব যত্ন করে একটু ইয়ে দে, ’ আর তখনই মাথার পিছন দিকটায় ওই রতন নামে লোকটা কী দিয়ে যেন মারল। তারপর আর কিছু মনে নেই।”

“তা হলে দ্বিতীয় চোরের নাম রতন।”

“যে আজ্ঞে।”

ভোরের আলো ফুটে যখন রোদ একটু তপ্ত হয়েছে তখন দু’জন মোহনপুরের বিখ্যাত বটতলা পেরিয়ে অনাথ দামের মিষ্টির দোকানে পৌঁছে গেল। অনাথ বোষ্টম মানুষ, গলায় কণ্ঠি, চেহারা রোগাভোগা, মাথায় চুল উঠে গিয়েছে, মুখে বিরক্তির ভাব। বিরক্তির কারণও আছে। তার দোকানের খদ্দেররা প্রায় কেউই ভদ্রলোক নয়। বেশির ভাগই চোরচোট্টা, বদমাশ, খুনে এবং গুন্ডা। আস্ত ডাকাতের দলও এসে মাঝে-মাঝে বসে যায়। ফলে তার দোকানের খুব বদনাম। এই তো দিনতিনেক আগে মদনবাবু তাঁর নতুন জামাইকে নিয়ে গাঁ-গঞ্জ দেখাতে বেরিয়েছিলেন। তা নতুন জামাই অনাধের দোকানের সামনে এসে বলল, “এখানে বসে একটু চা খেয়ে নিলে হয় না?”

মদন আঁতকে উঠে বললেন, “সর্বনাশ। না বাবা, এসব নোংরা দোকানে বসে তোমাকে চা খেতে হবে না। চলো ওদিকে ভালো দোকান আছে।”

সেই থেকে মনটা খিঁচিয়ে আছে।

সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত যদি কেবল পাপীতাপিদের মুখই দেখতে হয় তা হলে পরকাল তো ঝরঝরে। আর বলতে নেই, ইদানীং পাপীর সংখ্যাও বড্ড বেড়েছে বাপু। সকালবেলায় দোকানে ধূপধুনো দিয়ে ভালো করে হরিনামটাও নেওয়া হয়নি, অমনি দুটি ছ্যাঁচড়া এসে হাজির। মনটা খিঁচিয়েই ছিল। এই দু’জনকে দেখে মাথাটা বেমক্কা গরম হয়ে গেল। তেড়ে উঠে সরু গলার ধমক দিয়ে বলে উঠল, “কী চাই? ভালো করে রাত পোয়ানোর আগেই বড় যে এসে হাজির হয়েছ? মরার আর জায়গা পাও না?”

দু’জনেই একটু ভড়কে গেল। নিতাই মোলায়েম গলায় বলে, “আহা, অমন চটে গেলে কেন বলল তো অনাথদা? বলি কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়নি নাকি? আর আমাদের কাজের কোনও সময়-অসময় নেই রে বাপ।”

অনাথ আপনমনেই গজগজ করতে থাকে, “পাপের বোঝা বেড়ে পাহাড় হতে চলল, এখনও বসে দু’-দণ্ড হরিনাম করে উঠতে পারি না।”

রতন খুশির গলায় বলে, “আরে, তোমার আবার পাপ কী? পাপ তো আমাদের।”

অনাথ একটা বড় শ্বাস ঝেড়ে বলে, “এই যে চোরের পয়সায় খাচ্ছি, এ কী আর ভগবানের খাতায় লেখা থাকছে না নাকি?”

“তা চিন্তা কী? চোরের পয়সায় একটু গঙ্গাজল ছিটিয়ে নিলেই তো হয়। ধর্মে সবরকম ব্যবস্থা দেওয়া আছে, বুঝলে? অত ভেবো না তো। বরং গরম-গরম শিঙাড়া দাও গোটাকতক।”

তারপর গলা নামিয়ে রন জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে নিতাই, লোকেনবাবুর সঙ্গে তো তোর পাঁচশো টাকার কড়ার।”

“হুঁ।”

“শাঁখের যা কেরানি দেখলাম, এত কমে দিয়ে দিবি?”

“পাগল হয়েছিস? লাখ টাকার কমে এ জিনিস হাতছাড়া করে কেউ?”

“লোকেনবাবু দেবে লাখ টাকা?”

“না দিলে অন্য খদ্দের পেয়ে যাব।”

“তা হলে কি লোকেন তোকে ছেড়ে কথা কইবে?”

“শাঁখের কথাটা চেপে গেলেই হবে। বলব ওই সময়ে একটা লোক এসে চড়াও হওয়ায় কাজ ভেস্তে গিয়েছে। কথাটা মিথ্যেও খুব একটা হবে না।”

“বিশ্বাস করবে ভেবেছিস? লোকেন ঘোড়েল লোক, ” বলে একটু চুপ করে রইল রতন। তারপর একটু উদাস গলায় বলল, “একটা কথা ভাবছি জানিস?”

“কী কথা?”

“ভাবছি মাস্টারটার মাথায় বাটখারা দিয়ে মারাটা ঠিক হয়নি, মরেটরে গেল কিনা।”

“বাটখারা। বাটখারা তুই পেলি কোথায়?”

“একটা আড়াইশো গ্রামের বাটখারা সর্বদা আমার সঙ্গে থাকে। সেটা অস্ত্র বলে বোঝা যায় না, কিন্তু ভারী ভালো অস্ত্র। বিপদে আপদে খুব কাজে লাগে।”

“বাটখারা দিয়ে! এমন কথা জন্মেও শুনিনি।”

“শুনেছি ডটপেন দিয়েও খুন করা যায়।”

“তা হয়তো যায়, কে জানে। তবে মাস্টার খুন হয়নি। অজ্ঞান হওয়ার পর আমি নাড়ি দেখেছি। আর নাড়ি আমি খুব চিনি।”

অনাথ জানে তার চোখের দোষ আছে। মানুষ দেখলেই সে চিনতে পারে কোনটা পাপী আর কোনটা পাপী নয়। আর কার কোন মতলব। এখন সবে শরৎকাল। শীত পড়েনি এখনও। ও মাথা-মুখ কম্ফর্টারে ঢেকে যে লোকটা কোণের দিকে ঘাপটি মেরে বসে সুড়ুক সুড়ুক করে কাচের ছোট গেলাস থেকে চা খাচ্ছে, ও যে মোটেই শুধু লেড়ো বিস্কুট দিয়ে চা খেতে আসেনি তা অনাথ খুব ভালোই বুঝতে পারে। অনেকেই অনেক কিছু দেখতে পায় না, দেখার কথাও নয়। কিন্তু অনাথের জোড়া চোখে সেইসব জিনিসই যে কেন ধরা পড়ে কে জানে বাবা! এইসব দেখতে পাওয়াকেও অনাথ তার চোখের দোষ বসেই ধরে নিয়েছে। কম্ফর্টার জড়ানো লোকটার কানে একটা যন্ত্র লাগানো আছে। মাফলারে ঢাকা বলে দেখার উপায় নেই। শুধু অনাথই কেন যে এসব দেখতে পায় তা হরিই জানেন। লোকটা কোনও দিকে তাকাচ্ছে না বটে, খুব মন দিয়ে লেড়ো বিস্কুট আর চা খাচ্ছে, কিন্তু অনাথের মন বলছে যে, লোকটা নিতাই আর রতনের উপর নজর রাখছে। অনাথ একজন খদ্দেরের কাছ থেকে পয়সা গুনে নিয়ে ক্যাশবাক্সে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার না দেখলেও চলে তবু কেন যে তারই চোখে পড়ে যে, নিতাই যে ঝোলাখানা বাঁ ধারে তার কাঁকালের কাছে চেপে ধরে রেখেছে সেটির ভিতরে চোরাই মাল আছে।

অনাথ আর একজন খদ্দেরকে বিদায় করে গরম তেলে জিলিপি ছাড়তে ছাড়তে ফের দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এই যে পাপীতাপিদের খাওয়াচ্ছে সে, তাদের পয়সায় সংসার প্রতিপালন করছে। তাতে কি তার ভালো হবে?

নাহ, ব্যবসা কিছুদিন বন্ধ রেখে এবার তার তীর্থে গিয়ে পাপতাপ কিছু ধুয়েমুছে আসা বড্ড দরকার।

ভরপেট শিঙাড়া, জিলিপি আর চা খেয়ে রতন আর নিতাই উঠে পড়ল। পয়সা মিটিয়ে দিয়ে রাস্তায় এসে রতন বলে, “তা শাঁখটা তা হলে লোকেনবাবুর কপালে নেই। কিন্তু বেচবি কাকে?”

“সেটাই ভাবছি।”

“খদ্দের পাওয়া কিন্তু মুশকিল হবে।”

“বলিস কী? এ শাঁখের খদ্দের পাব না?”

“তুই আহাম্মক আছিস, শাঁখের মহিমা খদ্দেরকে বোঝাবি কী করে? শাঁখ তো আর তোর হুকুমে আপনা থেকেই বাজবে না।”

“ভাবছিস কেন? এই শাঁখের খদ্দেরের অভাব হবে না।”

“বলছিস। কিন্তু আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছে।”

“ঘাবড়াস না। এই নিতাই তলাপাত্র কখনও কাঁচা কাজ করে না। খদ্দের ঠিক করেই কাজে নেমেছি।”

“বলিস কী?”

“তুই কি ভাবলি লোকেনের পাঁচশো টাকার টোপ গিলে হাত গন্ধ করি?”

“কে রে? কত টাকার বন্দোবস্ত?”

“সেসব কথা বারণ। সময় এলে জানতে পারবি।”

পাপীদের মুখের দিকে তাকানো একরকম ছেড়েই দিয়েছে অনাথ। যাতে তাকাতে না হয় তার জন্য ঘাড় হেঁট করে ক্যাশবাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্যাশবাক্সের ডালায় নিতাই-গৌরের ছবি সাঁটা। তাও কি রক্ষে হয়? কম্ফর্টার জড়ানো লোকটা যখন চা আর লেড়ো বিস্কুটের দাম মেটাতে এলো তখন স্পষ্টই দেখা গেল তার বাঁ হাতের কবজির উপরের দিকে একটা কেউটে সাপের উল্কি, তার উপরে একটা রুইতন। বড় চেনা উল্কি, বছরকয়েক আগে দেখা, কিন্তু অনাথের মুশকিল হলো, সে ভুলতে চাইলেও কিছুতেই কিছুই ভুলতে পারে না। মুখের দিকে না তাকালেও লোকটার নাড়িনক্ষত্র সে জানে। তবে কী, তার মুখ খোলা বারণ। কারবার চালাতে গেলে মুখ বুজে না থাকলে উপায় নেই। কেউটে সাপের হাতে খুচরো পয়সা ফেরত দিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বৃন্দাবন অনেক দূর। ফুরসত মতো এবার নবদ্বীপে গিয়ে গঙ্গায় দুটো ডুব দিয়ে এলেও হত। পাপের ঘরে মেলাই জমা হয়ে যাচ্ছে।

কাম্ফর্টারওয়ালা লোকটা খুচরো পয়সা পকেটে পুরতে-পুরতে বলল, “ওই যে ছোঁড়াদুটো বেরিয়ে গেল, নাম কী বলো তো।”

অনাথ ঠোঁট উলটে বলে, “কে জানে বাপু। কত লোক আসছে যাচ্ছে। এ হলো খোলা হাট।”

“এ তল্লাটে এমন কেউ আছে নাকি যে তুমি তাকে চেনো না?”

“না হে বাপু, আজকাল আমার কিছু মনে থাকে না। ওইটেই আমার রোগ কিনা।”

“মনে পড়ানোর অনেক ওষুধ আমার জানা আছে। নাম দুটো আমার দরকার।”

অনাথ বুঝে গেল কেউটে সাপকে আর বেশি চটানো ঠিক হবে। সে মুখটুখ কুঁচকে একটু ভাবনার ভাব করে বলল, “কী জানি কাকে দেখলুম, তবে নিতাই আর রতন বলেই মনে হলো যেন। ভুলও হতে পারে।”

“তোমার যেদিন ভুল হবে সেদিন সুয্যি পুব দিকে অস্ত যাবে।”

লোকটা বেরিয়ে গেলে ভারী মনস্তাপ হলো অনাথের। কাজটা ঠিক করল সে? এখন যদি লাশ-টাশ পড়ে তবে যেন পাপ না হয়, দেখো ঠাকুর। জয় নিতাই।