নন্দীবাড়ির শাঁখ – ৩

তিন

“আখড়া থেকে সন্ধের মুখে তোর চেলারা যখন বেরোয়, তখন মনে হয় হাতির পাল বেরিয়েছে। দেখে মনে হয় তোর গজপতি নামটা সার্থক। এই যে হোঁতকা-কোঁতকা সব চেহারা বানিয়ে দিচ্ছিস এতে কি দেশের লাভ হবে? শরীরে বাড়াবাড়ি হলে মাথায় কমা হয় তা জানিস? সেদিনই কোন সায়েন্স জার্নালে পড়ছিলাম, বেশি ডন-বৈঠক করলে মানুষ মাথামোটা হয়ে যায়।”

“তোর মুন্ডু। শাস্ত্রে আছে যাদের শরীর দুর্বল তাদের মনও দুর্বল। আমার ছেলেরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় তখন দেখিস কত লোক হাঁ করে চেয়ে থাকে।”

“আহা, সে তো সং দেখলেও চেয়ে থাকে। লোকে চেয়ে থাকার কি কোনও মানে হয়!”

“আমার ছেলেরা কি সং বলে তোর মনে হয়?”

“তা বাপু, হয়। সারা গায়ে শিঙি-মাগুরের মতো মাংস কিলবিল করতে দেখলে সং ছাড়া আর কী মনে হবে?”

“তুই স্বাস্থ্যের মর্মই বুঝলি না। রোগা-ভোগারা তো এই জন্যই হিংসুটে, পরশ্রীকাতর, কুচুটে হয়।”

“শোন, আরও কথা আছে।”

“কী কথা?”

“এই যে সব হাতির মতো চেলা তৈরি করলি এদের খোরাকের বহর জানিস? এক-একজন চেলা চার-পাঁচটা লোকের খোরাক খায়। তাতে এই গরিব দেশের কি ভালো হচ্ছে? চেলার সংখ্যা বাড়লে যে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।”

“চারদিকে যে স্বাস্থ্যের দুর্ভিক্ষ চলছে তা দেখেছিস? এই তোর নিজের কথাই ধর। জামাটা পরে আছিস, মনে হচ্ছে হ্যাঙারে জামা ঝুলে আছে। বারো মাস আমাশায় ভুগিস। বাজার বয়ে আনতে মুটে ভাড়া করতে হয়।”

“সে তুই যাই বলিস, সবাই জানে গায়ের জোরের চেয়ে বুদ্ধির জোরের দাম অনেক বেশি। আর গায়ের জোরওয়ালারা গবেট হয়।”

“দি ভিঞ্চির নাম শুনেছিস?”

“কেন শুনব না! আমি কি মুখ্যু নাকি?”

“হেমিংওয়ের নাম জানা আছে? পিকাসোর? দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর কথা শুনেছিস কখনও?”

“কেন শুনব না?”

“এঁরা কি গবেট? দি ভিঞ্চির যা স্বাস্থ্য ছিল হেলায় বিশ্বশ্রী হতে পারতেন। হেমিংওয়ের রিস্টের মাপ শুনলে মূৰ্ছা যাবি। পিকাসোকে বুল ফাইটার বলে মনে হত। আর দেবীপ্রসাদ তো রীতিমতো নামকরা কুস্তিগির।”

বেলা শেষ হয়ে গিয়েছে। খোলা, ফাঁকা আখরায় কোণের দিকে একটা বেঞ্চে দুই বন্ধু বসে আছে। হাতে কাচের গেলাসে বাদামের শরবত। শরবতে একটা চুমুক দিয়ে হেমেন নিমীলিত চোখে চেয়ে বলল, “আরে ওসব দু’-চারটে একসেপশন থাকেই। ওটা ধরতে নেই।”

গজু মিচকি হেসে বলে, “এই আখড়ার ছেলে হিমাংশু গতবার মাধ্যমিকে সেভেনথ হয়েছিল, মনে আছে? আর নয়নচাঁদ এই বয়সেই কালোয়াতি গানে জেলায় ফার্স্ট হয়েছে। যিশু মেডিক্যাল পড়ছে। সায়ন্তন আই আই টি-র পাশ করা ইঞ্জিনিয়ার। এখন বেঙ্গালুরুতে মোটা বেতনের চাকরি হাঁকিয়েছে।”

হেমেন নির্বিকার গলায় বলে, “সে তো তুই এখন স্বাস্থ্যের গুণকীর্তন করতে কত কী খুঁজে বের করবি। আমি বাপু দিনরাত্তির হাপুস হুপুস ডন-বৈঠক মেরে সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করার কোনও কারণ খুঁজে পাই না। ভগবান যে শরীরখানা দিয়েছেন তা নিয়ে খুশি থাকলেই তো হয় রে বাপু। খোদার উপর খোদাকরি কি ভালো?”

“ভগবানের ভরসায় তোর মতো সবাই যদি শুয়ে-শুয়ে ঠ্যাং নাচাত তা হলে মানুষ এখনও জঙ্গলের রাজত্বে বাস করত।”

“এই যে এত কসরত করে শরীর বাগালি, তাতে লাভটা কী হলো বল তো! এই তো মাসখানেক আগে লোকেনের দলবল এসে তোর আখড়ার জমি মুক্ত করতে তোকে বেধড়ক পিটিয়ে গেল। তোর চেলারাও বাদ যায়নি। পারলি কিছু করতে? মুখ বুজে ষন্ডা-গুন্ডাদের হাতে মারই যদি খেতে হয় তা হলে এত ব্যায়াম, এত প্যাঁচপয়জার শিখে লাভ কী?”

গজপতি একটু রাগল না। তার শরীরে অবশ্য রাগ বস্তুটাই নেই। ঠান্ডা গলাতেই বলল, “প্রথমেই বলে রাখি, গুন্ডামি করার জন্য আমি কুস্তি শিখিনি। আমার কাছে যারা শিখতে আসে তাদেরও বলি, যদি গুন্ডামি-ষন্ডামি করার জন্য গায়ের জোর করতে এসে থাকো তা হলে কেটে পড়ো। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, সেলফ ডিফেন্সে নিশ্চয়ই আমরা ওদের উপর পালটা হামলা করতাম। কিন্তু ওদের হাতে পিস্তল, পাইপগান আর ভোজালি ছিল। আমরা কিছু করলে গুলিগোলা, ভোজালি চলত এবং দু’-চারজন মারাও যেতে পারত। তাই আমরা চুপচাপ মার হজম করেছি। আর এটা জেনে রাখিস মার হজম করাটাও শক্তিরই পরিচয়।”

“সে কী কথা! তা বলে এক তরফা মার খেয়ে যাবি? প্রতিশোধ নিবি না?”

“প্রতিশোধ জিনিসটার তো শেষ নেই। আমি প্রতিশোধ নিলে ওরা আবার পালটা প্রতিশোধ নিতে আসত। আবার আমাকে সেটার প্রতিশোধ নিতে হত। এইভাবেই ব্যাপারটা আর শেষ হতে চায় না।”

“সেদিন গিরিজাখুড়ো কী বলে গিয়েছিল মনে আছে? ওই আখড়ার ওধারে দাঁড়িয়ে হাতের ছাতাটা নাচাতে-নাচাতে টং হয়ে চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘ছিঃ ছিঃ, তোমরা তো কুস্তিগিরকুলের কুলাঙ্গার হে! এরকম পাহাড় পর্বতের মতো চেহারা নিয়ে ক’টা পাতি মস্তানের হাতে মার খেলে। ধরে ধরে ক’টাকে তো আখড়ার মাটিতে পুঁতেও ফেলতে পারতে। আসলে চেহারাই যা বাগিয়েছ, কলজের জোরে নেংটি ইঁদুরেরও অধম।’”

গজপতি মিটিমিটি হেসে বলে, “মনে থাকবে না কেন? খুব মনে আছে। উনি যা বলেছিলেন তা করলে আমরা খুনের দায়ে পড়তাম। উনি ভেবেচিন্তে বলেননি। রাগের বশে বলেছিলেন।”

হেমেন কিছুক্ষণ তেরছা চোখে গজপতির দিকে চেয়ে শেষে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “ব্যায়াম বা কুস্তির একটা ভালো দিক কি জানিস?”

“অনেক ভালো দিক আছে।”

“না, একটাই উপকার আমি খুঁজে পেয়েছি। যারা ব্যায়াম বা কুস্তি-টুস্তি করে তাদের মাথা খুব ঠান্ডা থাকে, মেজাজ গরম হয় না। আর সেটা বোধ হয় তারা ভিতু বলেই।”

“তোর মতে তা হলে বীর কে? ষন্ডাগুন্ডা মস্তানরা?”

কথায় বাধা পড়ল। নেপু এসে বলল, “গোপালবাবুর পায়রা এসেছে। তার পায়ে বাঁধা এই চিঠি, ” বলে গজপতির হাতে একটা চিরকুট এগিয়ে দিল।

পায়রাবাহিত চিঠি অবশ্য নতুন কিছু নয়। তাদের দু’জনেরই ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু গোপাল একটু বিটকেল প্রকৃতির মানুষ। এখান থেকে অন্তত কুড়ি-পঁচিশ মাইল দূরে এক গ্রামে তার বাড়ি। বাড়ি গ্রামের মধ্যেও নয়, একটু তফাতে একটা জঙ্গলের মধ্যে। চারপাশে প্রায় দশ একরের মতো ঘন জঙ্গল। ঠিক মাঝখানে গোপালদের বহু পুরনো জমিদারবাড়ি। বাড়ির এখন প্রায় ভগ্নদশা। গোপাল অবশ্য সেই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার পাত্র নয়। বলতে গেলে সে একাই থাকে। আর-এক বুড়ো কাজের লোক মহাদেব। তা মহাদেবের অনেক বয়স। চোখে ভালো দেখে না, কানেও শোনে না। তবু সে-ই যা হোক দেখভাল করে গোপালের। গোপাল হচ্ছে গ্যাজেট-বিরোধী লোক। সে আধুনিক কোনও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না। এমনকি সময় দেখার জন্য সে বালুঘড়ি আর সান ডায়াল ব্যবহার করে। তার ক্যালকুলেটার হলো অ্যাবাকাস। তার হোয়াটসঅ্যাপ নেই। দরকার মতো সে পায়রা দিয়ে বার্তা পাঠায়। সে দু’শো বা তিনশো বছরের পুরনো সময়ে বাস করে। ওটাই তার নেশা। জিজ্ঞেস করলে বলে, “মানুষ তো এক সময়ে এসব যন্ত্রপাতি ছাড়াও দিব্যি বেঁচে ছিল। আমি সেই বাঁচাটা বাঁচবার চেষ্টা করছি।”

অন্ধকার হয়ে এসেছে বলে মোবাইলের আলো জ্বেলে চিরকুটটা পড়ল গজপতি। তারপর উদ্বেগের গলায় বলে উঠল, “গোপালের সেই দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ চুরি হয়ে গিয়েছে।”

হেমেনও সোজা হয়ে বসে বলে, “বলিস কী?”

“হ্যাঁ। আরও লিখেছে, ‘আমার চারদিকে অমঙ্গল ঘনিয়ে আসছে। প্রেতাত্মার শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পাচ্ছি। আমি বোধ হয় আর বেশিদিন নেই। উকিলবাবুকে খবর পাঠিয়েছি।’”

হেমেন অবাক হয়ে বলে, “কিন্তু গোপাল তো সহজে ভড়কানোর ছেলে নয়। এ চিঠি নিশ্চয়ই গোপালের লেখা হতে পারে না। ভালো করে দেখ তো।”

গজপতি ভ্রু কুঁচকে চিঠিটা খুঁটিয়ে দেখে বলে, “কিন্তু এ তো গোপালেরই লেখা বলে মনে হচ্ছে।”

এ বাড়িতে মাঝে-মাঝে ফাঁকা ঘরে হঠাৎ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ হয়। কখনও বা একটা পায়ের শব্দ আস্তে-আস্তে সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায়। হঠাৎ তালাবন্ধ কোনও ঘর থেকে খুক খুক কাশির শব্দ আসে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ানো বা দাড়ি কামানোর সময় হঠাৎ কানের পাশ দিয়ে একটা অচেনা মুখ দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়। নিশুত রাতে কে যেন উঠোনের কুয়ো থেকে জল তুলে হাপুর হুপুর চান করে। তা এসব গোপালের গা সওয়া। বাড়াবাড়ি না হলে মাথা ঘামানোর কিছুই নেই। ছেলেবেলা থেকেই হয়ে আসছে।

কাছের গাঁয়ে অবশ্য গোপালকে নিয়ে নানা রটনা আছে। গণেশ হালদার বলে, “গোপালবাবুর টাইমগাড়ি আছে। পাস্ট টেল আর ফিউচার টেলে নিত্যি যাতায়াত। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও গোপাল নন্দীর কাঁচকলা। উনি টপ করে টাইমগাড়িতে চেপে দেড়শো-দু’শো বছর পিছনে গিয়ে তখনকার দরে সর্ষের তেল, ইলিশ মাছ, কাঁচালঙ্কা কিনে আনবেন। তা ছাড়া নিজের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে আসছেন, যাঁরা সব গত হয়েছেন তাঁদের সঙ্গে নিত্যি দেখাসাক্ষাৎ। দুর্গাবাড়ির ঠাকুর দালানের জমায়েতে দেবেন সরখেল হলফ করে বলেছে, “নাতির আমাশা হওয়াতে একটু গ্যাঁদাল পাতার সন্ধানে নন্দীবাড়ির পাশের জঙ্গলটায় গিয়েছিলাম মশাই। তখন নন্দীবাড়ির উত্তরের উঠোনের কুয়োতলায় কে যেন কাপড় কাচছিল। প্রথমটায় খেয়াল করিনি। হঠাৎ ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখি, কাপড় কাচা হচ্ছে ঠিকই তবে ধারেকাছে কেউ নেই। কাপড় আপনা থেকেই শুন্যে উঠে আছাড় খাচ্ছে, কুয়ো থেকে জল আপনিই বালতি করে উঠছে, আপনিই কাপড় ধোয়া হয়ে যাচ্ছে। না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আমি তো মিনিটপাঁচেকের জন্য মূৰ্ছা গিয়েছিলাম।”

একটা লোক, ছোকরা বয়স, এ যুগে বসেও প্রাচীনকালের মতো বাস করে জেনে গাঁয়ের স্কুলের নবাগত বিজ্ঞান শিক্ষক নরেশ পাল ভারী সংকোচের সঙ্গে একদিন দেখা করতে এলেন। হাত কচলে বললেন, “শুনলাম আপনি কোনও আধুনিক গ্যাজেটসকে প্রশ্রয় দেন না। উনিশ শতকের লাইফস্টাইল অ্যাডপ্ট করেছেন।”

গোপাল উদাস গলায় বলে, “অত ভেবে কিছু করিনি। শুধু ভাবলাম, এসব জিনিস ছাড়াও তো মানুষ এক সময়ে বেঁচে ছিল। তা হলে আমিই বা পারব না কেন?”

নরেশ পাল খুবই বিনয়ী লোক। হাত কচলে বললেন, “সে তো ঠিকই, সেই তো ঠিকই। কিন্তু আর কোনও উদ্দেশ্য নেই? ধরুন, এটাকে কি টাইম মেশিনের অভাবে আর-এক ধরনের টাইম ট্র্যাভেলের চেষ্টা?”

“না মশাই, আমার কোনও মহৎ উদ্দেশ্য-ফুদ্দেশ্য নেই।”

“সে তো ঠিকই, সে তো ঠিকই, ” বলে চারদিকটা বড়-বড় চোখে দেখে নরেশ বললেন, “আপনার বাড়িটা তো বিশাল। এত বড় বাড়িতে একা থাকেন?”

“না, একা কেন? মহাদেবদাদা আছে।”

“তিনি তো শুনেছি বুড়োমানুষ।”

“বুড়ো হলেও মানুষ তো বটে।”

“সে তো ঠিকই, সে তো ঠিকই। আপনি খুব সাহসী মানুষ।”

তো এইভাবে নরেশের সঙ্গে একটু ভাব হলো। তা নরেশবাবু প্রায়ই এসে বাড়ির আনাচ কানাচ ঘুরে বেড়ান, গোপালের লাইফস্টাইল নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেন। একদিন বললেন, “বালুঘড়ি বা আওয়ার গ্লাসে অ্যাকিউরেট টাইম বোঝা যায় কি?”

গোপাল একটু চিন্তা করে বলে, “তা আমার তো তেমন অ্যাকিউরেট সময়ের দরকার হয় না। কিন্তু প্রাচীনকালে ওই আওয়ার প্লাস দেখেই তখনকার বিজ্ঞানী বা জ্যোতির্বিদরা নির্ভুল সময় পেয়ে যেত। তার জন্য যন্ত্রের চেয়েও বেশি দরকার হয় তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আর ডিডাকশন। তখনকার মানুষের সেই গুণ ছিল। এখন ঘড়ি দেখলেই সময় বোঝা যায় বলে মানুষ তার সেই গুণ হারিয়ে ফেলেছে।”

“সে তো ঠিকই, সে তো ঠিকই। কিন্তু ধরুন সেকেন্ডের ভগ্নাংশ কি ওই যন্ত্রে বোঝা যাবে?”

গোপাল একটু ভেবে বলে, “দেখুন, অ্যাটম ভাঙতে গেলে যেমন বিস্ফোরণ হয়, সময়কে ভাঙতে-ভাঙতে সময়ের সূক্ষ্ম দানায় পৌঁছে মানুষ যদি সেটারও বিভাজন করতে চায় তা হলেও একটা বিস্ফোরণ হতে পারে কিন্তু।”

“হলে কী হবে?”

গোপাল মাথা নেড়ে বলে, “জানি না। হয়তো সেই বিস্ফোরণের ফলে মানুষ টাইম মেশিন আবিষ্কার করে ফেলবে। কিংবা দুম করে সভ্যতা উবে গিয়ে মানুষ প্রস্তরযুগে ফিরে যাবে। কিংবা পৃথিবী এবং সময় এগিয়ে গিয়ে মহাপ্রলয় নিয়ে আসবে।”

“সে তো ঠিকই, সে তো ঠিকই, ” বলতে-বলতে খুব চিন্তিত মুখে নরেশ পাল উঠে গেলেন। আর সেদিনই কে যেন বাগানের ফটকের কাছে তাঁকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল।

পরদিন নরেশ পাল একটু থমথমে মুখে এসে বললেন, “দেখুন, আমি ঠিক নালিশ করছি না। কিন্তু কাল যাওয়ার সময় ফটকের কাছে কেউ আমাকে পিছন থেকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিল।”

গোপাল ভ্রু তুলে বলে, “সে কী? কে সেই বেয়াদব?”

“উঠে চারদিক খুঁজে দেখেছি। ভেবেছিলাম কোনও দুষ্টু ছেলে-টেলে হবে। কিন্তু ধারেকাছে কাউকে দেখতে পাইনি।”

“সে যে-ই হোক আমি তার হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।”

“ব্যাপারটা ক্ষমার বিষয় নয় গোপালবাবু।”

“তা হলে কিসের ব্যাপার?”

খুব শুকনো মুখে অন্যমনস্ক নরেশ পাল বলেন, “বিজ্ঞানের সীমানার বাইরে অনেক ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে কিনা। তাই বলা খুব মুশকিল।”

এর কয়েকদিন পর সকালে গোপাল বাগানের গোলাপ গাছে ঝারি দিয়ে জল দিচ্ছিল, এমন সময় হতদন্ত হয়ে নরেশ পাল হাজির। চোখ বড়-বড়, চুল উসকোখুসকো, উদভ্রান্ত চেহারা।

গোপাল অবাক হয়ে বলে, “কী হয়েছে নরেশবাবু?”

“আপনাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই। প্লিজ আমার সঙ্গে আসুন।”

“কোথায় যেতে হবে?”

“বেশি দূরে নয়। আপনাদের ঠাকুরদালানে।”

ঠাকুরদালানটা বাড়ি থেকে একটু তফাতে, উত্তর দিকের ঘের দেওয়ালের কাছ বরাবর। মূল মন্দিরের সামনে লম্বাটে নাটমণ্ডপ। তার হাত ধরে প্রায় টানতে-টানতে নাটমণ্ডপের সামনে নিয়ে এলেন নরেশ পাল। বললেন, “দেখুন।”

ঠাকুরদালানে নিত্যপুজো করতে আসেন পুরুতমশাই হলধর চক্রবর্তী। জ্বর হওয়ায় কয়েকদিন তিনি আসেননি। নাটমণ্ডপে তাই পুরু ধুলো জমেছে। সেই দিকে আঙুল দেখিয়ে নরেশ পাল বললেন, “দেখতে পাচ্ছেন?”

গোপাল বুঝতে না পেরে বলে, “কী দেখব?”

“দেখছেন না! ওই যে পায়ের ছাপ?”

এবার গোপাল দেখল, নাটমণ্ডপের ধুলোয় বেশ স্পষ্টই এক জোড়া পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে বটে। সে হেসে বলল, “পায়ের ছাপ তো! ও আর দেখার কী আছে! মহাদেবদাদা হয়তো এসেছিল।”

“আপনার মহাদেবদাদার বাঁ পা কি ডান পায়ের জায়গায়, আর ডান পা বাঁয়ে? ভালো করে দেখুন!”

এবার গোপাল সত্যিই লক্ষ করে দেখল, কথাটা মিথ্যে নয়। ধুলোর উপর বাঁ পায়ের জায়গায় ডান পায়ের ছাপ পড়েছে আর ডান পায়ের জায়গায় বাঁ পায়ের। এই অশৈলী কাণ্ড দেখেও সে অবশ্য খুব একটা অবাক হলো না। শুধু বলল, “হুঁ।”

“আপনি অবাক হচ্ছেন না?”

গোপাল মিনমিন করে বলল, “হচ্ছি তো।”

নরেশ পাল মাথা নেড়ে বললেন, “না হচ্ছেন না। অর্থাৎ এর রহস্যটা আপনি জানেন।”

“আরে না, তা নয়। আমি ভাবছিলাম কেউ দুষ্টুমি করে এটা করেছে কিনা। পা ক্রস করে তো ডান পায়ের জায়গায় বাঁ পা ফেলা যায়।”

নরেশ পাল হাঁ করে তার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলেন, “আপনার সত্যিই তা মনে হচ্ছে? আমার তো হচ্ছে না!”

গোপাল কী বলবে ভেবে পেল না।

“তবু আপনি একা এ বাড়িতে বাস করেন?”

“আমার তো যাওয়ার জায়গা নেই।”

একদিন বিকেলের দিকে ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল গোপাল। নরেশ পাল এসে তাঁর মার্কামারা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “আপনাদের ঠাকুরদালানে যে বিষ্ণুমূর্তিটা আছে সেটা ভালো করে দেখেছেন?”

“দেখব না কেন?”

“আচ্ছা বিষ্ণুর হাতে চক্র, গদা আর পদ্ম তিনটেই তো পিতলের, তা হলে শঙ্খটা আসল শঙ্খ কেন? সেটাও তো পিতলের হলেই মানানসই হত! তাই না?”

গোপাল বলল, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। শঙ্খটা একটু বেমানানই বটে।”

“কারণটা কী?”

“তা তো আমি বলতে পারব না। ওই বিষ্ণুমূর্তি দেড়-দু’শো বছরের পুরনো। বংশানুক্রমে পুজো হয়ে আসছে।”

“গাঁয়ের লোকেরা কী বলে জানেন?”

“গাঁয়ের লোকেরা তো গুজব ছড়াতে পারলে কিছু চায় না।”

“সেটা গুজব কিনা তা জানার জন্যই তো আপনার কাছে আসা।”

“কী বলে তারা?”

“তারা বলে ওই শঙ্খটা নাকি মাঝে-মাঝে নিজে থেকে বেজে ওঠে।”

গোপাল সুতো গুটিয়ে ঘুড়ি নামিয়ে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।

নরেশ পাল বলেন, “গাঁয়ের লোক কি মিথ্যে কথা বলে?”

গোপাল বলে, “না, তবে বাড়িয়ে বলেছে।”

“তার মানে?”

“শঙ্খটা মাঝে-মাঝে আপনার থেকে বেজে ওঠে না। তবে একবার বেজেছিল বলে আমার মনে আছে।”

চোখ কপালে নরেশ পাল বলেন, “সে কী মশাই! সত্যিই বেজেছিল নাকি?”

“তখন আমি খুব ছোট। চার-পাঁচ বছর বয়স হবে। একদিন ভোররাতে হঠাৎ ঠাকুরদালান থেকে শঙ্খের জোরালো আওয়াজ আসে। এতই জোরালো যে তাতে বাড়িসুদ্ধ লোক জেগে যায়। প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল মূল মন্দিরে কেউ ঢুকে শাঁখ বাজাচ্ছে। কিন্তু গিয়ে দেখা গেল মূল মন্দিরের কোলাপসিবল গেটের তালা অক্ষতই আছে। শাঁখও বিষ্ণুর হাতেই ধরা।”

“কিন্তু শাঁখটা তা হলে বাজল কীভাবে?”

“তা জানি না।”

“বাই চান্স অন্য কোনও শাঁখের আওয়াজও তো হতে পারে।”

“নিশ্চয়ই। তাও হতে পারে। তবে সেই দিন রাতে আমাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। আমার দাদু বন্দুক নিয়ে ডাকাতদের ঠেকাতে বেরিয়েছিলেন। ডাকাতদের গুলিতে উনি মারা যান। আগেই বলে রাখছি, ব্যাপারটা কাকতালীয়ই হতে পারে।”

“আপনি কখনও শাঁখটা বাজানোর চেষ্টা করেননি?”

“পাগল। বিষ্ণুর শাঁখ কি উচ্ছিষ্ট করতে হয়?”

সেদিন একটু বেলার দিকে বাড়ির সামনের চত্বরে পায়রাদের দানা খাওয়াচ্ছিল গোপাল। চেয়ারের পায়ের কছে ঘুরঘুর করছিল বাড়ির পোষা বেজিটা। পায়রারা দানা খেতে-খেতে উড়ে-উড়ে তার কাঁধে মাথায় চেপে বসছিল। এই দানা খাওয়ানোর সময়টা বড় ভালো লাগে গোপালের।

ঠিক এই সময়ে নরেশ পাল এসে চত্বরের পাথরে বাঁধানো বেদিটায় বসে ব্যাপারটা খুব মন দিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, “পায়রার ডাক অর্থাৎ পায়রাকে দিয়ে চিঠি পাঠানো ব্যাপারটা কি আপনার সায়েন্টিফিক বলে মনে হয়? আপনার পায়রারা তো আর সব ঠিকানায় চিঠি নিয়ে যেতে পারবে না।”

গোপাল মাথা নেড়ে বলে, “না, তা পারবে না। শুধু চেনা জায়গায় পৌঁছে দেবে। ঠিকই বলেছেন, ব্যাপারটা তেমন সায়েন্টিফিক নয়। তবে আমার কাজ চলে যায়।”

“আচ্ছা আপনার পোষ্য কতজন আছে একটু বলবেন?”

গোপাল মাথা নেড়ে বলল, “বেশি নেই। এই তো দেখছেন পাঁচটা পায়রা, একটা বেজি আর গোটাচারেক বিড়াল।”

“আশ্চর্য। আপনার কুকুর নেই?”

গোপাল মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“তাই ভাবছি, গত তিন মাস ধরে এতবার আপনার বাড়ি এসেছি, কখনও কুকুর দেখিনি। কিন্তু আজ দেখলাম।”

গোপাল কিছু বলল না, শুধু চেয়ে রইল।

নরেশ পাল বললেন, “আজ ফটক দিয়ে ঢুকবার পর কয়েক পা এগিয়েছি, দেখি ডান দিককার কামিনী ঝোপের আড়াল থেকে একটা কুকুর আমার দিকে জ্বলজ্বল করে চেয়ে আছে। মিশমিশে কালো কুকুর। পেটটা খুব মরা। ল্যাকপ্যাকে চেহারার বড়সড় কুকুর। এক সময়ে আমার খুব কুকুরের শখ ছিল, তাই কুকুর আমি খুব চিনি। এটা হাউন্ড জাতের কুকুর। শিকারী। কিন্তু অবাক কাণ্ড, কুকুরটা আমাকে দেখে তেড়েও এলো না, কোনও শব্দও করল না। শুধু খুব মন দিয়ে লক্ষ্য করল আমাকে। কুকুরটাকে কি আপনি চেনেন গোপালবাবু?”

“না।”

“কুকুররা খুব প্রভুভক্ত হয়। তাই না? আর ওই প্রভুভক্তির জোরে তারা মানুষের অন্য সব পোষ্যকে টেক্কা দিয়েছে। কী বলেন?”

“তা সত্যি। কুকুর খুব প্রভুভক্ত হয়।”

“আপনি তো একটা পুষলেও পারতেন।”

“আমার একটা ছিল। কিন্তু কুকুররা তো বেশিদিন বাঁচে না। চোদ্দ-পনেরো বছর। মরে গেলে বড্ড কষ্ট হয়।”

“আপনার কী রকম কুকুর ছিল?”

“হাউন্ড।”

“কী রকম রং?”

“কালো।”

“এ কুকুরটাও কালো হাউন্ড।”

“এরকম মিল তো হতেই পারে।”

“আমি কিন্তু কালো হাউন্ড আর কখনও দেখিনি। খুব রেয়ার জিনিস।”

গোপাল অস্বস্তি বোধ করে বলে, “দেখেননি বলে কি হয় না? তা হলে এ কুকুরটা হলো কী করে?”

“তা হলে আপনি বলতে চান এ কুকুরটা আপনার নয়?”

“কী করে আমার হবে! আমার ভোলা কুকুরটা তো দু’ বছর আগে মারা গিয়েছে।”

“কে জানে মশাই, প্রভুভক্ত কুকুর কত কী করতে পারে!”

গোপাল চুপ করে রইল।

খুব চিন্তিত মুখে নরেশ পাল বলে, “কিছু মনে করবেন না, আপনাদের বিষ্ণুমূর্তির হাতে যে শঙ্খটা আছে তা দক্ষিণাবর্ত শখ। বিষ্ণুর হাতে কিন্তু স্বাভাবিক উত্তরাবর্ত শঙ্খ থাকে। দক্ষিণাবর্ত শাঁখ হলো গিয়ে শিবের শাঁখ।”

একটা সংক্ষিপ্ত শিস দিয়ে পায়রাদের ছাদের ঘরে ফেরত পাঠাল গোপাল। তারপর বলল, “হ্যাঁ, আমি তা জানি। শঙ্খের গঠনের মধ্যে যে মোচড় রয়েছে তা আসলে অনন্ত বা অসীমের ছায়া, যা ক্রমশ প্রসারিত হয়ে চলেছে। উলটো দিকে মোচড় হলে তা মহাবিশ্বের ওই নিয়মকে উলটে দেবে। আপনাকে তো বলেছি, ওই বিষ্ণুমূর্তি অনেক পুরনো। আমরা যেমন আছে তেমন রেখে দিয়েছি। কিন্তু আপনি এ নিয়ে এত ভাবছেন কেন?”

“আপনার বাড়িতে যতবার আসছি ততই ভাবিত হয়ে পড়ছি মশাই। নিত্যনতুন প্রশ্ন মনের মধ্যে বুদবুদের মতো উঠে আসছে। আপনার নির্বিকার ভাবটাও আমাকে ভারী অবাক করে দেয়।”

গোপাল কী বলবে ভেবে পেল না। কারণ চারদিকে সে যা সব দেখতে পায় তাতে তার অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। সে এটাও জানে যে, নরেশ পাল কালুকেই দেখেছেন। কারণ মাঝে-মাঝে কালুর উপস্থিতি গোপাল নিজেও টের পায়। তবে অবাক হয় না, এই যা।

নরেশ পাল বললেন, “আপনার বাড়ির যে দিকেই তাকাই কেমন যেন খটকা লাগে। আপনাকে দেখলেও লাগে। মনে হয় যা দেখছি বা শুনছি তার সবটাই যেন সত্যি নয়, গোলমেলে। যেন খানিকটা রূপকথা ঢুকে পড়েছে, খানিকটা অতীত এসে উঁকিঝুঁকি মারছে। খানিকটা যেন কল্পনারও রচনা রয়েছে।”

গোপাল খুব নিরাসক্ত গলায় বলে, “পুরনো বাড়ি তো, তাই ওরকম সব মনে হয় আপনার। গাঁয়ের লোক তো এ বাড়িতে ঢুকতে একটু ভয়ই পায়। শুধু গয়লা রামপদ, ঠিকে কাজের মেয়ে সুখলতা, আর ঠাকুরমশাই।”

“একটা সত্যি কথা বলুন তো। আপনি আপনার কুকুরটাকে কি মাঝে-মাঝে দেখতে পান?”

“আপনার বাবা-মা কি বেঁচে আছেন?”

“মা আছেন। বাবা নেই।”

“যখন বাবার কথা খুব মনে পড়ে তখন কি বাবাকে দেখতে পান?”

“পাই। তবে সেটা মনশ্চক্ষে। চর্মচক্ষে নয়। ছেলেভুলনো কথা বলে কি লাভ গোপালবাবু?”

সুখলতার মাজায় ব্যথা। দিনতিনেক শয্যাশায়ী থাকার পর আজ এসে সে ঠাম্মালান ঝাঁটপাট দিয়েছে। মূল মন্দির ধোয়ামোছা করেছে। তারপর নাটমণ্ডপের একধারে বসে জিরোচ্ছে। ঠাকুরমশাই হলধর চক্রবর্তী পুজোর জোগাড়যন্তর করছেন।

সুখলতা হঠাৎ বলল, “ও ঠাকুরমশাই, বলি মাস্টারটা এবাড়িতে রোজ হানা দিচ্ছে কেন বলো তো।”

“তার আমি কী জানি। তুই জিজ্ঞেস করলেই তো পারিস।”

‘জিজ্ঞেস করেছিলাম গো। তা বলে এ বাড়িতে সে নাকি নানা অদ্ভুত জিনিস দেখতে আসে। ভূতপ্রেত আরও কী-কী যেন। শুনে তো আমার মাথায় হাত। গত চল্লিশ বছর টানা কাজ করছি, কখনও কিছু দেখলাম না, আর ও ছোঁড়া তিনদিন এসেই দেখে ফেলল? বলি, তুমি কখনও কিছু অশৈলী দেখেছ এ বাড়িতে?”

“কম্মিনকালেও না।”

“তবেই বোঝো! জলজ্যান্ত যা দেখা যায় তাকে কি ভূত দেখা বলে কেউ? এই তো সে দিন পানুবাবু এসে বললেন, ‘ও সুখলতা, বলি বেনারসী পাতির একটা পান খাওয়াতে পারবি?’ শুনে কপাল চাপড়ে বললাম, ‘সেদিন কী আর আছে পানুবাবু? এ মুলুকে কি পাওয়া যায় ও বস্তু? সেই বুড়ো কর্তা শহর থেকে বান্ডিল-বান্ডিল আনাতেন।’ তা পানুবাবু মুখ শুকনো করে বলল, ‘ঘেসো পান খেতে পারি না রে, মুখের ছাল উঠে যায়।’”

“পানুবাবু কে বল তো!”

“ওই যে গো, খুব বাবু মানুষ। বুড়ো কর্তার সঙ্গে পাশা খেলতে আসত। ফরসা মতে, মোটাসোটা, গলায় সোনার মোটা চেন।”

“হ্যাঁ, মনে পড়েছে।”

“তারপর ধরো ছোটগিন্নি। তাকে মনে আছে? ওই যে, গলায় দড়ি দিয়েছিল দোতলার দক্ষিণের ঘরটায়।”

“তা মনে থাকবে না কেন? মাঝে-মাঝে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি।”

“দেহ মোচন হওয়ার পর এখন বেশ আছে। দিনরাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গয়না পরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে নিজেকে। সেদিন ঘর গোছাতে গিয়ে দেখা। আমাকে বলল, ‘দেখ তো সুখী, এই সীতাহারটায় আমায় কেমন মানিয়েছে!’ তাই তো বলি, এ বাড়িতে আবার ভূত এলো কোত্থেকে! তুমি কি কিছু দেখো?”

“না রে বাপু। পুজোআর্চ্চা নিয়ে থাকি। কোথায় ভূত! তরঙ্গিণী এসে ফুল তুলে চন্দন বেটে দিয়ে যায়।”

“তরঙ্গিণী মানে নন্দবাবুর মেয়ে তো! ওই যে আট বছর বয়সে পদ্মপুকুরে জলে ডুবে গিয়েছিল।”

“সে-ই। সন্ধেবেলা যখন শয়ান দিতে আসি তখন আরতির সময় কাঁসিও বাজায়। না বাপু, ভূত-প্রেত দেখিনি কখনও।”

“গাঁয়ের লোকগুলোর তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তাই বসে-বসে নন্দীবাড়ি নিয়ে যত গাঁজাখুরি গল্প বানায়। সেইসব শুনেই মাস্টারটার মাথা বিগড়েছে। এই তো সেদিন বাগানে একটা কালো কুকুরকে দেখে নাকি মুচ্ছো যাচ্ছিল। শুনি আমি বলি, ‘ও মাগো, মুচ্ছো যাওয়ার কী হলো? ও তো আমাদের ছোটবাবুর আদরের কালু, দিনরাত সারা বাড়ি ঘুরে পাহারা দিয়ে বেড়ায়।’”

ঠাকুরমশাই পুজোয় বসেছেন, তাই কথা বললেন না।

সুখলতা আপনমনে গজগজ করতে-করতে উঠল। তার মাজায় মাঝে-মাঝে বড্ড ব্যথা হয়। বেশিদিন এই ধোয়ামোছার কাজ করতে পারবে না। কিন্তু এবাড়ির উপর তার বড় মায়া। একটা নাতনি থাকলে এ কাজে বহাল করে দিয়ে জিরোনো যেত। কিন্তু এমনই পোড়া কপাল যে, তার কোনও কূলেই কেউ নেই।

সুখলতার চোখে ছানি এসেছে। একটু ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখে আজকাল। বাগানের শুঁড়িপথ দিয়ে যেতে গিয়ে পাম গাছের তলায় ঢ্যাঙা একজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। চেনা-চেনাই মনে হলো। তাই গলা উঁচু করে বলল, “কে গো, বিপিনবাবু নাকি? তা তুমি তো কাশী গিয়েছিলে গো বিপিনবাবু। ফিরলে কবে?”

মনের ভুলই হবে। একটু এগিয়ে ঠাহর করে দেখতে গিয়ে সুখলতা দেখে, গাছতলা ভোঁ ভাঁ। কেউ নেই তো! ভুলই দেখেছে তবে।

“এই যে সুখলতা, বলি কার সঙ্গে কথা বলতে-বলতে যাচ্ছ?”

গলাটা চিনতে পেরে সুখলতা একগাল হেসে বলে, “মাস্টার নাকি? আর কার সঙ্গে কথা বলব বাছা, এই আকাশ, বাতাসের সতেই কথা কই। তবে কাকে যেন দেখলাম, ঢ্যাঙামতো, ওই পাম গাছের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভুলই দেখেছি বোধ হয়, ছানিপড়া চোখ তো।”

‘না সুখলতা, ভুল দেখোনি। একটা লোক, বেশ লম্বা, ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল বটে, সাড়াশব্দ পেয়ে ওপাশের ভাঙা দেওয়ালের ফাটল গলে পালিয়ে গেল।”

“কিন্তু বাছা, তুমি তো আবার এ বাড়িতে দিনেদুপরে ভূত-প্রেতও দেখতে পাও।”

“তা পাই। তবে এই লম্বা সোকটি ভূত নয়। রক্তমাংসের মানুষই বটে।”

সুখলতা দুটো হাত উলটে বলে, “কে জানে বাছা। তবে এ বাড়িতে তো চোরছ্যাঁচড়দের আসার কথা নয়। সোনাদানা নেই, আসবাবপত্র নেই। বাসনকোসন নেই।”

“বনেদি বাড়ি বলে কথা। নেই-নেই করেও যা আছে তা কুড়িয়ে বাড়িয়ে মন্দ হবে না।”

“দেখো মাস্টার, এ বাড়ির কড়ি বরগার হিসেবও আমি জানি। আনাচ-কানাচ সব আমার মুখস্থ। এ বাড়ি হলো চোরের অরুচি। আহাম্মক না হলে এখানে এসে সময় নষ্ট করবে না।”

“আমার তা মনে হয় না সুখলতা। লোকটাকে আমি স্পষ্ট দেখলাম, ঘুরে-ঘুরে চারদিক দেখছে। হাবভাব সন্দেহজনক।”