নন্দীবাড়ির শাঁখ – ২

দুই

সকালে চিন্তিত মুখে সামনের বড় বারান্দায় পায়চারি করছিলেন মৃদঙ্গবাবু। গাছে-গাছে পাখির ডাকাডাকি। শিউলি ফুলের গন্ধ আসছে। আকাশে শরতের মেঘ আলস্যের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারদিকে তাপহীন কমজোরি রোদ। হাওয়ায় একটু চোরা ঠান্ডা। সকালবেলাটা মৃদঙ্গবাবুর বেশ ভালোই কাটবার কথা। কিন্তু তাঁর তেমন ভালো ঠেকছে না। মনের মধ্যে একটা অশান্তি খচখচ করছে সেই তখন থেকে।

ঠিক এই সময়ে তাঁদের পুরনো কাজের লোক রামু তাঁকে চা দিতে এলো। রামু নামেই কাজের লোক। আসলে সে গার্জিয়ানেরও অধিক। দরকার হলে ধমকধামকও দেয়।

হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে রামু গম্ভীর মুখে বলল, “কাল রাতে যে বাড়িতে চোর এসেছিল সেটা কি টের পেয়েছেন?”

ঘোরতর অন্যমনস্ক মৃদঙ্গবাবু বললেন, “টের পাব না কেন? চোরের সঙ্গে তো আমার অনেক কথা হয়েছে!”

“অ্যাঁ!” বলে খানিকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল রামু। তারপর বলল, “তার মানে?”

মৃদঙ্গবাবু ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “কেন, চোরের সঙ্গে কথা কওয়া কি বারণ নাকি? কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হয়েছে তাতে?”

রামু চোখ কপালে তুলে বলে, “বলেন কী বাবু! কোথায় চোরকে জাপটে ধরে ‘চোর! চোর!’ বলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করবেন, তা না করে চোরের সঙ্গে বসে কি গল্পগাছা করলেন নাকি?”

মৃদঙ্গবাবু একটু ফাঁপড়ে পড়ে বললেন, “আরে না, গল্পগাছা করব কেন? কাজের কথাই হচ্ছিল।”

“কাজের কথা! চোরের সঙ্গে আপনার কী কাজ?”

মৃদঙ্গবাবু খুব উদাস হয়ে গিয়ে বললেন, “সে আছে। সব কথা তুই বুঝবি না।”

কথাটা রটে যেতে দেরি হলো না। মৃদঙ্গবাবুর ভাগ্য ভালো যে কিছুদিন আগে তাঁর নাক ডাকা নিয়ে স্ত্রী কিছু কটুকাটব্য করায় দু’জনে মন কষাকষি হওয়ায় দু’জনের বাক্যালাপ বন্ধ। তাঁর স্ত্রী রাগ করে অন্য ঘরে থাকছেন এখন। তা মুখোমুখি কথা না হলেও আড়াল থেকেই তিনি বলতে লাগলেন, “আহা, চোর হবে কেন, ও তো মাসতুতো ভাই। তবু ভাগ্য ভালো যে মাঝরাতে উঠে আমাকে চোরের জন্য চা-জলখাবার করে দিতে হয়নি! এ বাড়িতে থাকলে আমার কপালে তাও লেখা আছে। জন্মে শুনিনি বাবা, বাড়িতে চোর এলে গেরস্ত তার সঙ্গে আড্ডা মারতে বসে যায়।”

মৃদঙ্গবাবুর বাবা ভুজঙ্গবাবু রাশভারী মানুষ। মৃদঙ্গবাবু তাঁকে যথেষ্ট ভয়ও খান। তিনি নিজের ঘরে মৃদঙ্গবাবুকে ডেকে পাঠিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললেন, “এসব কী শুনছি?”

মৃদঙ্গবাবু মাথা চুলকে মিনমিন করে বললেন, “আজ্ঞে চোর বলে ঠিক বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম স্বপ্ন দেখছি।”

“কিন্তু তুমি নাকি নিজের মুখেই কবুল করেছ যে, চোরের সঙ্গে তোমার কথাবার্তাও হয়েছে!”

“যে আজ্ঞে। কথা বলতে ঠিক চাইনি। চোরটাই গায়ে পড়ে কথা বলছিল।”

“এ তো তাজ্জব ব্যাপার হে। চোর গায়ে পড়ে গেরস্থর সঙ্গে কথা কয় এ তো কখনও শুনিনি। তা তোমার সঙ্গে তার কি কথা?”

“আজ্ঞে, বেশ ভালো-ভালো কথাই বলছিল।”

“ভালো-ভালো কথা! না হে বাপু, আমি আরও তাজ্জব হতে পারছি না। তাজ্জবেরও তো একটা শেষ আছে! চোরের মুখে কী শেষে হিতোপদেশও শুনতে হবে!”

“আজ্ঞে আমিও বড্ড কম অবাক হইনি।”

“তা সে তোমাকে বলছিল কী?”

“সেটা নিজের মুখে বলা কি ঠিক হবে?”

“তা এখন পরের মুখ পাবে কোথায়? নিজের মুখেই বলো।”

“সে আমার খুব প্রশংসা করছিল।”

“প্রশংসা! তোমার? না হে আমার পক্ষে আর অবাক হওয়া সম্ভব নয়। এক সকালের পক্ষে ইতিমধ্যেই আমি যথেষ্ট অবাক হয়েছি। তা তোমার মধ্যে প্রশংসা করার মতো কী খুঁজে পেল চোরটা?”

“এই আমার বুদ্ধি, বিবেচনা, কাণ্ডজ্ঞান, এই সব আর কী!”

ভুজঙ্গবাবু কিছুক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থেকে তারপর আঁতকে উঠে বললেন, “কী বললে! বুদ্ধি? বিবেচনা? কাণ্ডজ্ঞান?”

মৃদঙ্গবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “আজ্ঞে, সেরকমই তো মনে হলো।”

“তোমার মধ্যে?”

“যে আজ্ঞে।”

“সেগুলো যদি তোমার মধ্যে থেকেই থাকে তা হলে আমরা এতকাল খুঁজে পেলাম না কেন?”

মৃদঙ্গবাবু কুণ্ঠিত হয়ে বলেন, “আজ্ঞে কথাগুলো আমারও তেমন বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, বাড়িয়ে বলা। তবে চোরের চোখ তো অনেক কিছু দেখতে পায়, যা আমরা পাই না! অন্ধকারেও তারা ঠিক দামি-দামি জিনিস চিনতে পারে। তাই না বলুন!”

“আহাম্মকদের মুশকিল কী জানো? নিজের প্রশংসা শুনলে তারা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এই যেমন তুমি। চোরটা চুরি করার সময় সাড়াশব্দে তোমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। তখন চোরের দুটো উপায় ছিল। ডান্ডা মেরে তোমাকে ঠান্ডা করে দেওয়া, না হলে স্তোকবাক্যে তোমাকে ভুলিয়ে কাজ হাসিল করা। তোমাকে হাবাগোবা বলে বুঝতে পেরে চোরটা আর মেহনত না করে দ্বিতীয় পন্থাই নিয়েছে এবং তুমিও তার ফাঁদে পা দিয়েছ।”

“যে আজ্ঞে। তবে আমার ঘুম তো ভাঙেনি, চোরটাই তো খোঁচা মেরে আমাকে ঘুম থেকে তুলল!”

ভুজঙ্গবাবু ফের হাঁ হয়ে বাক্যহারা। বেশ কিছুক্ষণ বাদে মাথা নেড়ে বললেন, “না হে, আমার মাথা আর নিতে পারছে না। চোর ঘরে ঢুকে গেরস্থ মানুষকে খোঁচা মেরে ঘুম ভাঙিয়ে তার গুণগান করে যায়, এরকমটা কেউ কখনও শুনেছে কিনা সন্দেহ। যাকগে, তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে আর কিছুক্ষণ কথা বললে আমার মাথাটাই বিগড়ে যাবে। তোমার ঘরের আলমারিতে বউমার প্রায় পঞ্চাশ ভরির সোনার গয়না ছিল। তিনি এখন দেখছেন সেগুলোর কী গতি হলো। আমার বিশ্বাস, চোর সবই চেঁছেপুছে নিয়ে গিয়েছে। বাড়ি থেকে আর কী-কী চুরি গেল তাও দেখতে হবে। বিষ্টু দারোগাকে খবর পাঠাননা হয়েছে। তুমি এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ো না। বিষ্টু তোমাকে জেরা করবে।”

“যে আজ্ঞে।”

কী-কী চুরি হয়েছে তার নিকেশ নিতে সারা বাড়িতে তল্লাশি নেওয়া হলো। ঘণ্টা দু’য়েক বাদে মৃদঙ্গবাবুর স্ত্রী কাঁচুমাচু মুখে শ্বশুরমশাইয়ের কাছে এসে বললেন, “না, তেমন কিছু নেয়নি। শুধু রতনচূড় বালাটা…”

মৃদঙ্গবাবুর সাত বছরের মেয়ে লিপিকা বলল, “রতনচূড় বালাটা তো তুমি গোপাল স্যাঁকরাকে ভেঙে কী যেন গড়তে দিলে।”

মৃদঙ্গবাবুর স্ত্রী সুনয়নী চোখ পাকিয়ে মেয়েকে ধমক দিলেন, “তুই চুপ কর তো!”

ভুজঙ্গবাবু বললেন, “আর কিছু খোয়া যায়নি?”

“হ্যাঁ, ওই বক্স প্যাটার্নের হারটা…”

লিপিকা ফের বলল, “তোমার কিছু মনে থাকে না মা। ওই হারটা তো রুবিপিসি ধার নিয়ে গিয়েছে তার দেওরের বিয়েতে পরবে বলে!”

সুনয়নী ফের ধমক দিলেন, “বড়দের কথায় ছোটদের থাকতে নেই লিপি।”

রামু হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, “আজ্ঞে কর্তা, কোদাল আর হাত-দা উধাও হয়েছে। দোতলার বারান্দায় ছোটবাবুর পায়জামা শুকোচ্ছিল, সেটাও হাওয়া। গিন্নিমা তাঁর দামি চশমাজোড়া খুঁজে পাচ্ছেন না।”

ভুজঙ্গবাবু ভারী বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে দূর-দূর! চুরির কথায় আমার তো ঘেন্না এসে গেল। এসব অপদার্থ চোরকে ধরে আগাপাশতলা চাবকানো উচিত। লোকের কাছে মুখ দেখানোর উপায় রইল না।”

মৃদবাবু মিনমিন করে বললেন, “বাবামশাই, আমি তো চোরের তেমন কোনও দোষ দেখতে পাচ্ছি না! সে তো কিছুই নিয়ে যায়নি! চোর হলেও বেশ ভালো লোক।”

ভুজঙ্গবাবু ফুঁসে উঠে বললেন, “একে তুমি ভালো চোর বলতে চাও! আট ফুট উঁচু দেওয়াল টপকালি, দোতলার কার্নিশে উঠে গ্রিল কাটলি, ঘরে ঢুকে দেখলি একটা হাবাগোবা অপদার্থ লোক ছাড়া কেউ নেই। আলমারিতে পঞ্চাশ ভরি সোনার গয়না পড়ে রইল, টাকায় ঠাসা মানিব্যাগ, দামি হাতঘড়ি, বাসনকোসন, ভালো-ভালো দামি শাড়ি, মোবাইল ফোন, অষ্টধাতুর মূর্তি কোনওটাতে হাতই দিলি না। তা হলে কোন দেশি চোর তুই, অ্যাঁ! এ তো রীতিমতো এই বাড়ির অপমান! এখন পাড়ার লোকজনকে কী বলি বলো তো! পাঁচজন শুনে যে ছ্যা ছ্যা করবে। তার উপর বিষ্টু দারোগা এসে যখন চুরি-যাওয়া জিনিসের লিস্টি চাইবে তখন তার হাতে কী ফর্দ ধরাবে বাবা? বিস্তর চোর দেখেছি, কিন্তু এরকম বেয়াদপ চোর জন্মে দেখিনি! কুলাঙ্গার, কুলাঙ্গার।”

মৃদঙ্গবাবু ফের মিনমিন করে বললেন, “তা হলে কি বাবামশাই, চুরি হলেই ভালো ছিল!”

ভুজঙ্গবাবু রোষকষায়িত লোচনে নিজের বড় ছেলের দিকে চেয়ে বললেন, “না, তা বলছি না। চুরি যাওয়া মোটেই ভালো কথা নয়। কিন্তু সব জিনিসেরই তো একটা নিয়ম থাকবে, নাকি! আবহমানকালের নিয়ম হলো, চোর গেরস্থের ঘরে ঢুকে চুরি করে। ঠিক কিনা!”

“যে আজ্ঞে, তা তো বটেই।”

“তবে! এই চোরটা কৃতিত্বের সঙ্গে দেওয়াল টপকাল, সাফল্যের সঙ্গে দোতলায় উঠল, কুশলতার সঙ্গে গ্রিল কেটে ঘরে ঢুকল। ঠিক বলছি কি?”

“যে আজ্ঞে, ঠিক বলছেন বলেই মনে হচ্ছে।”

‘তা এত মেহনত করে সামনে আলিবাবার ভাণ্ডার পেয়েও সে কী করল! না, তোমার মতো একজন গবেটকে ঘুম থেকে তুলে খানিক গল্পগাছা করে খালি হাতে ফিরে গেল! সামনে পেলে আমি তার গলায় গামছা দিয়ে জবাবদিহি চাইতাম।”

মৃদঙ্গবাবু এ কথায় একটু চাঙ্গা হয়ে বললেন, “তার জন্য ভাববেন না বাবামশাই, চোরটা বলে গিয়েছে সে আবার আসবে।”

ভুজঙ্গবাবু অবাক হয়ে বলেন, “আসবে? তার মানে কী?”

“আজ্ঞে আসবে মানে তো আসবে বলেই মনে হচ্ছে।”

ভুজঙ্গবাবু একটু থমকে গিয়ে বলেন, “তা আসবে কেন হে! তোমাকেও লাইনে নামাতে চাইছে নাকি?”

মৃদঙ্গবাবু তটস্থ হয়ে বললেন, “আজ্ঞে না।”

ভুজঙ্গবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললেন, “শোনো, চোরটা যদি সত্যিই ওরকম কোনও প্রস্তাব নিয়ে আসে তা হলে বরং রাজি হয়ে যেয়ো। চোরের সঙ্গ করলে কর্মতৎপরতা বাড়বে, চোখ-কান সজাগ হবে, ঘ্রাণশক্তি বাড়বে, শরীরটা বেশ চনমনে হয়ে উঠবে। আর সেই সঙ্গে সাহস বাড়বে, সহ্যশক্তি বাড়বে, দূরদৃষ্টি প্রখর হবে। সব দিক বিবেচনা করে আমার তো মনে হচ্ছে তোমার মতো গোবরগণেশের পক্ষে এটা বিধাতার আশীর্বাদ।”

শুনে এমন অবাক হয়ে গেলেন যে মুখ দিয়ে “যে আজ্ঞে, ” কথাটা পর্যন্ত বেরল না। তদুপরি বিস্ময়ে হাঁ করে থাকায় একটা কাঁঠালের মাছি বোঁ করে ভিতরে ঢুকে একটা চক্কর দিয়ে বেরিয়ে এলো।

কে যেন কাছেপিঠেই খ্যাঁচ করে একটা শেয়ালের হাসি হেসে বলল, “কথাগুলোর ভিতরে কিন্তু দম আছে মশাই।”

আনমনা ছিলেন বলে লক্ষ করেননি, সামনেই একটা লোক দাঁড়িয়ে। রোগা পাকানো চেহারা, পরনে ধুতি আর হাফশার্ট, হাতে ছাতা আর মুখে বড়-বড় দাঁতের হাসি।

লোকটাকে বিশেষ পছন্দ করলেন না মৃদঙ্গবাবু। বললেন, “কোন কথাগুলো?”

“এই যে ভুজঙ্গবাবু বলছিলেন। বড় জুতসই কথা মশাই। এমন উচিত কথা বলার মতো বুকের পাটা ক’জনের আছে? বিচক্ষণ লোক।”

মৃদঙ্গ অত্যন্ত তিক্ত গলায় বললেন, “একটা কথা কী জানেন মশাই, সবাই হলো শক্তের ভক্ত আর নরমের যম। চিরকাল দেখে আসছি যার গায়ে জোর আছে তার কথায় সবাই সায় দেয়।”

“কথাটা বড় মন্দ বলেননি মৃদঙ্গবাবু। ভুজঙ্গবাবুর গায়ে যে জোর আছে এটা কে না জানে। আর হবে না-ই বা কেন? রোজ ডন-বৈঠক করছেন, ডাম্বেল-বারবেল তুলছেন, পাঁই-পাঁই করে পাঁচ-সাত মাইল হেঁটে আসছেন। পনেরো-বিশ কেজি বাজার রোজ দু’হাতে টেনে আসছেন। জোর বলে জোর! তবে কিনা ওঁর কথার জোরও বড় কম নয়। সে হাটে-বাজারেই বলুন, নন্দকিশোরের বৈঠকখানার আড্ডাতেই বলুন, ঝগড়া-কাজিয়ায় বলুন ভুজঙ্গবাবু যখন বলেন তখন সবাই চুপ করে যান।”

“তা বটে।”

“তাই বলছিলাম ওঁর কথায় খুব দম আছে। শুনলে শরীরে-মনে বেশ একটা ঝাঁকুনি লাগে।”

“হ্যাঁ, সেটা আমারও লাগে বটে।”

“তবেই বুঝুন।”

“বুঝলাম। কিন্তু আপনি কে বলুন তো? আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”

লোকটা ফের খ্যাঁচ করে হেসে বলে, “আমি কি চেনার মতো একটা লোক যে চিনবেন! পিতৃদত্ত একটা নাম আছে বটে, শীতল মান্না। এই কাছেই মনসাপোঁতা গাঁয়ে বাস। আর দেওয়ার মতো পরিচয় কিছু নেই মশাই!”

“তা আমার সঙ্গে কি আপনার কোনও প্রয়োজন আছে নাকি শীতলবাবু?”

“এই ধরে নিন কুশল প্রশ্ন করতেই আসা। তবে কিনা কানাঘুঁষো যে, আপনাদের বাড়িতে কাল চোর এসেছিল। কারও বাড়িতে চোর এসেছে শুনলে আমি ভারী খুশি হই। তাই প্রাতঃকালেই চলে এসেছি।”

মৃদঙ্গবাবু অবাক হয়ে বলেন, “কারও বাড়িতে চোর এলে আপনি খুশি হন?”

“আহা, বাড়িতে চোর আসা যে অতি সুলক্ষণ মৃদঙ্গবাবু। একটু তলিয়ে ভাবলেই বুঝতে পারবেন, চোরেরা যেমন তেমন বাড়িতে হানা দেয় না। যে বাড়িতে চোর আসে বুঝতে হবে সেই বাড়ির অবস্থা ভালো। বাড়িতে সোনাদানা, টাকাপয়সা আছে। বাড়ির লোকের বেশ খিদে হচ্ছে, ঘুম হচ্ছে, রোগ-বালাই নেই।”

“টাকাপয়সা, সোনাদানার ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু খিদে হচ্ছে, ঘুম হচ্ছে, রোগ-বালাই নেই কী করে বোঝা গেল?”

“ও তো সোজা হিসেব। হাতে টাকাপয়সা এলে লোকে একটু ভালোমন্দ খায়। আর ভালোমন্দ খেলে ঘুমটাও হয় ভারী ভালো। আর রোগ-বালাই যে নেই তাও বোঝা যায়। কারণ রোগ-বালাই থাকলে রোগী এপাশ-ওপাশ উঃ আঃ করবে, রোগীর বাড়ির লোকও উচাটন থাকবে, তাতে চোরের ভারী অসুবিধে।”

“মশাই শীতলবাবু, আপনি কি চোরের উপর রিসার্চ করেন নাকি?”

শীতল মান্না জিব কেটে বলে, “না-না, অত গুরুতর ব্যাপার নয়, এই একটু খোঁজখবর রাখি আর কী! চুরির ধরন দেখেই আন্দাজ করতে পারি চোর কে।”

“বটে। তা হলে আমার বাড়ির চুরির লক্ষণগুলো দেখুন তো!”

“ও আমার দেখা হয়ে গিয়েছে।”

“কিছু বুঝলেন?”

“যে আজ্ঞে। যত দূর আন্দাজ করতে পারি, লোকটা মাধব দাসের ভাই জগাই দাস।”

মৃদঙ্গ ভারী অবাক হয়ে বললেন, “আরে বাহ! আপনার আন্দাজ তো ঠিকঠাক মিলে গিয়েছে দেখছি। আপনার এলেম আছে শীতলবাবু।”

“ওইটেই তো ভুল করেন।”

“কী ভুল করলাম বলুন তো।”

“ওই যে টক করে প্রশংসা করে ফেললেন! শত হলেও আমি তো আপনার কাছে একজন অজ্ঞাতকুলশীল মানুষ! এমনও তো হতে পারে যে, আমি জগাই দাসের সঙ্গে সাঁট করেই আপনার কাছে এসেছি!”

“তা বটে! আমি অতটা ভেবে দেখিনি।”

“অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবে কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়, বুঝলেন।”

“হ্যাঁ, এখন বুঝতে পারছি।”

“আরও একটু কথা আছে মৃদঙ্গবাবু।”

“কী কথা?”

“আপনি চোরের নাম জানলেন কী করে? সে কি চুরি করে যাওয়ার সময় আপনাকে নিজের নাম বলে গিয়েছে?”

মৃদঙ্গ আমতা-আমতা করে বললেন, “ইয়ে, তার সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হয়েছে।”

শীতল মান্না বলে, “জগাইয়ের ওই স্বভাবটা আছে। মাঝে-মাঝে চুরি করতে ঢুকে গেরস্তর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়, তারপর চুরি না করেই পালিয়ে যায়। তবে দুঃখের কথা হলো, বৈরাগী দিঘির ধারে আজ সকালে তার লাশ পাওয়া গিয়েছে।”

মৃদঙ্গ আঁতকে উঠে বললেন, “লাশ! জগাই কি মারা গিয়েছে?”

শীতল মান্না বলল, “না মরলেও মর-মর অবস্থা।”