নতুন বছরের ছন্দ
তখন ওরা সবাই এক আনন্দের ঘরে বসত করছিলো। আলো ঝলমলে স্টেজে উঠে কেউ আবৃত্তি করছিলো। কেউ গান গাইছিলো। সবাই তালি দিচ্ছিলো। হাসি হাসি মুখে চুইংগাম আর চকোলেট চিবোচ্ছিলো। টেবিলে ফুলের ভেতর অনেক বই, লাল কাগজের মোড়কে লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা। ওদের প্রাইজ দেয়া হবে।
ছন্দ তখন এক কোণে দাঁড়িয়েছিলো। যেখানে ওদের আলো ওর গায়ে এসে লুটিয়ে হেসে ওঠেনি। আনন্দ সেখানে নরম কান্নার সানাইয়ের মতো বাজছিলো। ছন্দের বুকের ভেতর সেই কান্নাগুলো থরে থরে জমছিলো।
ইশকুলে নতুন বছরের উৎসব হচ্ছে। হোস্টেলের ছেলেরা সুপারের অনুমতি নিয়ে। রাত জাগা উৎসবের আয়োজন করেছে। রাত বারোটার পর ওরা আতশ জ্বালিয়ে নতুন বছরকে বরণ করবে। সারা রাত উৎসব করবে। সূর্য ওঠার পর প্রার্থনা সেরে ঘরে ফিরবে।
ছন্দ চেয়েছিলো সেই আনন্দের রাজ্যে ওকে নিয়ে যাক। কেউ ওকে ডাকেনি।
ছন্দের বাবা নেই। মা নেই। ওদের মিশনারি ইশকুলের ফাদার মার্টিন অনেক দিন আগে ওকে কোনো এক গ্রাম থেকে এনেছিলেন। সেই থেকে ছন্দ ইশকুলের হোস্টেলে থাকে। হোস্টেলের অন্য ছেলেদের মতো ওর কাছে কোনো ভিজিটর আসে না। ছন্দের সঙ্গে অন্য ছেলেরা মেশে না। উৎসবের দুই দিন আগে ভয়ে ভয়ে মনিটরকে বলেছিলো-”আমিও কবিতা আবৃত্তি করবো।
মনিটর তাকে ধমকে দিয়েছে–কী বললি আবৃত্তি? তুই কবিতা আবৃত্তি করবি? মুখ ফুটে কথা বেরোয় না, তুই আবৃত্তি করবি কবিতা? হেসে আর বাঁচিনে।
এরপর মনিটর সবাইকে ডেকে বললো, তোদের আর প্রাইজ পেতে হবে না। আমাদের ছন্দ এবার আবৃত্তি করবে।
তাহলেই হয়েছে! বলে সবার সে কি হাসি। ছন্দের মনে হলো যেদিন আশুতোষ স্যার ওকে বেত দিয়ে মেরেছিলেন, সেদিনও বুঝি সে এতো কষ্ট পায়নি। সে ছুটে গেলো। মনিটরকে গিয়ে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারলো–কেন তোমরা আমাকে নিয়ে এভাবে হাসবে। আমার বুঝি কষ্ট হয় না? আমি তোমাদের কী করেছি?
ছেলেরা কেউ ওর কথা শুনলো না। সবাই ওকে খুব মারলো। ভীষণ নির্দয়ের মতো মারলো। শেষে ক্লান্ত হয়ে বললো, সুপারকে যদি কিছু বলেছিস তাহলে তক্তা বানিয়ে দেবো।
ছন্দ সুপারকে কিছু বলেনি। ওর জ্বর এসেছিলো। ও জানে হোস্টেল সুপার ভৌমিক স্যার খুব শান্ত মানুষ। ওদের ভয় পান। কিছু বললে তিনি কেমন যেন কুঁকড়ে যান–তোরা একটু মিলেমিশে থাকতে পারিসনে? নালিশ কেন করিস? যা বাপু মিটিয়ে ফেলগে।
ছন্দের সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় ওকে কেউ বুঝতে চায় না। ঘন্টাবুড়োকে বলে, আমি তো কাউকে খারাপ ভাবি না, ওকে কক্ষণো আমি মারতে চাইনি। কেন ওরা এমন করে?
বুড়ো জানে এমন অনেক প্রশ্নের যন্ত্রণা ছন্দের বুকটাকে কুঁরে কুঁরে ঝাঁঝরা করে দেয়।
তখন হু হু করে বাতাস বইছিলো। চাঁদটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। দুটো কাক ডানা ঝাঁপটে ডাকে। ভোর হতে বেশি দেরি নেই।
স্টেজের ওপর ওদের আনন্দ দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ওঠে ছন্দ।
এক সময়ে ছন্দের মনে হলো কে যেন তাকে ডাকলো। শান্ত নরম গলায় ডাকলো, ছন্দ এসো।
বাগানে একরাশ ছুঁই ফুল ফুটে আছে। ওখানে ওকে ডাকলো, ছন্দ এসো।
ছন্দ অবাক হলো। ওরা বললো, আনন্দ এখানে। আমাদের ভেতরে। আনন্দ ভালবাসার ভেতরে। আনন্দ সুন্দরের ভেতরে। তুমি ওখানে কেন আনন্দকে খুঁজছো?
ছন্দ বললে, ভালোবাসা কোথায় পাবো? কেউ আমাকে ভালোবাসে না।
মিষ্টি হেসে জুই বললো সুন্দরের ভিতর ভালোবাসা।
সুন্দর কোথায়?
ভালোবাসার ভেতরে।
ছন্দ আবার বললো–ভালোবাসা কোথায়?
ওরা আবার বললো–সুন্দরের ভেতর।
বুঝিয়ে বলো।
জুঁই হাসলো–তোমার মনই হচ্ছে সব কিছু। বুঝলে ছন্দ, সুন্দর বলো, ভালোবাসা বলো সব কিছু রয়েছে তোমার মনে। ইশকুলের কুৎসিত চেহারার ঘন্টাবুড়োকেও তোমার ভালো লাগে। রামদয়াল মালির লোমওঠা থকথকে পোকাভরা কুকুরটাকেও তুমি ভালোবাসো, এই ভালোবাসাটাই সুন্দর। এই সুন্দরই ভালোবাসা। আর সব কিছু মিলিয়ে হলো ছন্দ। তুমি আমাদের ছন্দ। তুমি সকলের ছন্দ। তুমি সময়ের ছন্দ। তুমি এই নতুন বছরের ছন্দ।
ছন্দ তখন এক আনন্দের জগতে পৌঁছে গেলো।
ভোরের সূর্য ছন্দের কপালে চুমু খেলো। স্কুলে সবাই হৈ চৈ জুড়ে দিলো। ভৌমিক স্যার কাঁপতে কাঁপতে বললেন–ও বাগানে কখন এলো? ওর যে একশ চার ডিগ্রি জ্বর ছিলো! রাতে আমি ওকে শুইয়ে দিয়েছিলাম।
রামদয়ালের ঘেয়ো কুকুরটা কুঁই কুঁই করে কেবলই ঘুরতে লাগলো। ওরা ওকে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিলো।
ঘন্টাবুড়ো বিড় বিড় করে বললো–বাজে কথা বলছো সবাই! ছন্দ কখনো মরে না। ওদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
তবু ঘন্টাবুড়োকে ওদের কথায় গির্জার ঘন্টা বাজাতে হলো। ঢং ঢং করে ঘন্টাটা বাজছিলো। ওর কান্না পেলো। ঘন্টার শব্দ শুনতে ওর একেবারেই ভালো লাগছিলো না। বারবার বিড় বিড় করে বলছিলো–প্রভু, দেখলো তো। নতুন বছরে ওরা ছন্দকে বাঁচতে দিতে চায় না। তুমি শুধু দেখে রাখো প্রভু, আমাদের ছন্দকে সবাই মিলে কী ভাবে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। ও না থাকলে যে কোনো কিছুরই অর্থ থাকবে না!