॥ ৮ ॥
বারণাবতের নির্বাসন-যন্ত্রণা পাণ্ডবরা লুকিয়ে রাখেননি। তাঁদের মুখেও সে যন্ত্রণার প্রকাশ ঘটেছিল। হস্তিনাপুরের ব্রাহ্মণরা এই যন্ত্রণা দেখতে পাচ্ছিলেন পাণ্ডবদের চোখেমুখে। তাঁরা কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে ছাড়লেন না। পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠানোটা যে সম্পূর্ণই ধৃতরাষ্ট্রের চাল, সে সম্বন্ধে তদানীন্তন সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণরা মন্তব্য করতে ছাড়লেন না। তাঁরা বললেন—এই বদমাশ ধৃতরাষ্ট্রটা তার নিজের ছেলেদের সঙ্গে একরকম দৃষ্টিতে পাণ্ডবদের দেখে না—বিষমং পশ্যতে রাজা সর্বথা স সুমন্ধধীঃ। এই যুধিষ্ঠিরের মধ্যে পাপ বলে কোনও জিনিস নেই। কিন্তু পাপী ধৃতরাষ্ট্র ধর্ম বোঝে না। যুধিষ্ঠিরকে সে পছন্দ করে না, ভীম অর্জুনকেও না। আর মাদ্রীর ছেলেদুটিকে তো খেয়ালই করে না। পাণ্ডবরা নিজের উত্তরাধিকারেই পিতৃরাজ্যের অধিকারী, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র সেটা সহ্য করতে পারছে না—তান্ রাজ্যং পিতৃতঃ প্রাপ্তান্ ধৃতরাষ্ট্রো ন মৃষ্যতে।
ব্রাহ্মণরা অবাক হলেন—কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের এই আচরণ সহ্য করছেন কী করে? তাঁরা দুঃখ করে বললেন—এই সেদিন এই ছেলেগুলোর বাপ মারা গেল! আর এই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেগুলিকে ধৃতরাষ্ট্র এখনই সহ্য করতে পারছে না? যাক, ঠিক আছে। এই ছেলেদের সঙ্গে আজ আমরাও হস্তিনাপুর ছেড়ে বারণাবতে চলে যাব। যেখানে যুধিষ্ঠির থাকবে, আমরাও সেখানেই থাকব—গৃহান্ বিহায় গচ্ছামো যত্র গন্তা যুধিষ্ঠিরঃ।
বোঝা যাচ্ছে—যুধিষ্ঠির রওনা হবার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের মধ্যে, সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণ এবং প্রজা-সাধারণের মধ্যে একটা সাধারণ কোপের সঞ্চার হয়েছিল। কুরুবৃদ্ধরা ধৃতরাষ্ট্রের কূটবুদ্ধি টের পাননি, আর যিনি টের পেয়েছিলেন, সেই বিদুর যুধিষ্ঠিরের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ম্লেচ্ছভাষায় প্রকাশ করে দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে হস্তিনাপুরের জনপদবাসীদের রাজধানীতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন এবং আমরা জানি—বিদুরের বুদ্ধিতে পাণ্ডবরাও জতুগৃহের আগুন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন।
পাণ্ডবদের এই মুক্তির কথা অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রের জানা ছিল না। জতুগৃহ দগ্ধ হবার পর বারণাবতের নগরবাসীজনেরা ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশে যথেষ্ট গালাগালি দিয়েছে। এমন কথাও বলেছে যে, ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমেই তাঁর গুণধর ছেলেটি ওই জঘন্য কাজ করেছে এবং তিনি দুর্যোধনকে বারণও করেননি—বিদিতে ধৃতরাষ্ট্রস্য…ন হ্যেনং প্রতিষিধ্যবান্। নগরবাসীরা যখন ধৃতরাষ্ট্রকে পাণ্ডবদের তথাকথিত মৃত্যুসংবাদ জানাল, তখন ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে খুশি হয়েছিলেন কি না জানি না, কিন্তু বাহ্যত তিনি খুব কান্নাকাটি করেছিলেন—বিললাপ সুদঃখিতঃ। বলেছিলেন—আজকেই আসলে আমার ভাই পাণ্ডুর মৃত্যু হল। মায়ের সঙ্গে তাঁর সব ছেলেগুলি মারা গেল, পাণ্ডুর উত্তরাধিকারী হিসেবে একটি পুত্রও বেঁচে রইল না—অদ্য পাণ্ডুর্মৃতো রাজা মম ভ্রাতা মহাযশাঃ। ধৃতরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে নিজের লোকজনকে পাঠালেন বারণাবতে, যাতে মহারানি কুন্তী এবং তাঁর পুত্রদের অন্তিম সংস্কার করার ব্যাপারে কোনও অসুবিধে না হয়।
ঠিক এইসব জায়গায় ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝতে আমাদের একটু অসুবিধে হয়। যদি এই বিলাপ, এই শ্রাদ্ধক্রিয়া এবং এই অনুভূতির সবটাই লোক দেখানো মৌখিকতা হত, তা হলে ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্র ব্যাখা কঠিন হত না আমাদের পক্ষে। তা ছাড়া ভবিষ্যতে ধৃতরাষ্ট্রের আরও অনেক ব্যবহারে আমরা আবারও ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিধাভিন্ন বিপ্রতীপ আচরণ লক্ষ করব। ছোট ভাই পাণ্ডুকে তিনি যথেষ্টই ভালবাসতেন, কিন্তু অন্ধত্ববশত তিনি নিজে রাজা হতে পারেননি—এই ভাবনাটুকুকে অতিক্রম করে নয়। পাণ্ডুপুত্রদেরও তিনি পছন্দ করতেন না, তা নয়। কিন্তু সে পছন্দটা ততক্ষণই, যতক্ষণ না সেটা নিজপুত্র দুর্যোধনের স্বার্থ অতিক্রম করছে। পাণ্ডবদের বারণবাতে নির্বাসন দেওয়া বা তাঁদের পুড়িয়ে মারাটা দুর্যোধন কোনও অন্যায়ের মধ্যেই গণ্য করেন না, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র মনে মনে অন্তত এটাকে পাপ বলে মনে করতেন—অভিপ্রায়স্য পাপত্বাৎ নৈবং তু বিবৃণোম্যহম্। কিন্তু দুর্যোধনের স্বার্থ দেখে এই গুরুতর অন্যায় কাজটি তিনি করে গেলেন।
কোনও সন্দেহ নেই—দুর্যোধনের স্বার্থের বিরুদ্ধেই তো তিনি যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ নির্বাচিত করেছিলেন। হয়তো এর পিছনে কুরুবৃদ্ধ এবং হস্তিনাপুরের পৌর-জনপদবাসীদের কিছু চাপ ছিল, কিন্তু তবু সেটা দুর্যোধনকে অতিক্রম করেই করেছিলেন। কিন্তু যে মুহূর্ত থেকে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি বেড়ে চলল, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি আপন পুত্রের স্নেহে ক্লিষ্ট বোধ করতে আরম্ভ করলেন। বিশেষত দুর্যোধনের মনোবেদনায় অভিভূত হয়ে পাণ্ডবদের নির্বাসনে পাঠালেন। নিজের ‘অভিপ্রায়’ পাপমূলক জেনেও তিনি তাঁর স্নেহান্ধ হৃদয়বৃত্তি রোধ করতে পারলেন না। অথচ বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের দগ্ধ হওয়ার কাহিনী শুনে এখন তিনি বিলাপ করছেন।
ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে এই দ্বৈতসত্তা সব সময় কাজ করতে থাকবে। কিন্তু বিলাপ প্রলাপের অন্তে গিয়ে আমরা ধৃতরাষ্ট্রকে বেশ শক্ত হয়েই দুর্যোধনের পিছনে দাঁড়াতে দেখছি। আসলে ধৃতরাষ্ট্র জানেন—পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুনে অনেকদিন আগেই দগ্ধ হয়ে গেছেন। প্রাথমিকভাবে পাণ্ডুপুত্রদের জন্য তাঁর হৃদয়ে কিছু আঘাত লাগলেও প্রিয় পুত্র দুর্যোধন একেবারে জ্ঞাতিশত্রুহীন হয়ে যাওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র পরম আনন্দ লাভ করেছিলেন। দুর্যোধনের সিংহাসন লাভের অধিকারে আর কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, অতএব হস্তিনাপুরের রাজ-পরম্পরা চলবে তাঁরই অনুক্রমে—এই সুখ-ভাবনা তাঁর অন্তর আপ্লুত করে রেখেছিল।
অন্ধ, স্নেহাতুর রাজা ধৃতরাষ্ট্র আন্দাজও করতে পারেননি যে, বাস্তব জগৎ কত কঠিন। এদিকে পাঞ্চাল রাজ্যে দ্রৌপদী পাঞ্চালীর স্বয়ংবরসভার খবর এসে পৌঁছেছে। দুর্যোধন ভাইদের সঙ্গে নিয়ে, বন্ধু কর্ণকে নিয়ে পাঞ্চালসভায় গেলেন—দ্রৌপদীকে পাবার আশায়। দ্রৌপদীর রূপ গুণ এবং ব্যক্তিত্বের কথা তখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বোধ করি ধৃতরাষ্ট্রের কানেও তা এসে থাকবে। দুর্যোধনের পাঞ্চাল-প্রয়াণে তিনি নিশ্চয় মনে মনে খুশিই হয়েছিলেন। কারণ তখনও দুর্যোধনের বিয়ে হয়নি এবং পাঞ্চালীর সঙ্গে বিবাহ ঘটে গেলে সেটা যে একটা দারুণ আনন্দের ব্যাপার হবে তাঁর কাছে, সেটা আন্দাজ করা যায় ধৃতরাষ্ট্রের পরবর্তী ব্যবহার থেকে।
অনেককাল পাণ্ডবদের নামই কেউ করে না ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। তাঁদের কথা তিনি প্রায় ভুলেই ছিলেন। এরইমধ্যে হস্তিনাপুরের গুপ্তচরেরা এসে খবর দিল—যিনি সেদিন লক্ষ্য ভেদ করে দ্রৌপদীকে স্বয়ংবরে জিতেছেন তিনি অর্জুন। যিনি যুদ্ধে অসাধারণ বিক্রম প্রকাশ করেছিলেন তিনি ভীম। খবর এল—পাণ্ডবরা ব্রাহ্মণের রূপ ধরে বসেছিলেন। যাঁরা জতুগৃহের আগুনে পুড়ে গিয়েছিলেন বলে শোনা গিয়েছিল তাঁদের যেন পুনর্জন্ম হয়েছে। পাণ্ডবদের পরিচয় জানার পর অন্যান্য সকলেই যে ধৃতরাষ্ট্রের নিন্দেমন্দ করছেন, সে কথাও গুপ্তচরেরা লুকোল না। কথাটা অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রের কানে সোজাসুজি পৌঁছোল না। কৌরব-ভাইরা গুপ্তচরদের মুখেই প্রথম এই খবর শুনলেন। তাঁদের দুঃখ-কষ্ট এবং ঈর্ষা ক্রোধের অন্ত রইল না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে খবরটা দিতে এলেন বিদুর, যিনি পূর্বাহ্নেই জানতেন যে জতুগৃহের আগুন থেকে পাণ্ডবরা রক্ষা পাবেনই।
পাণ্ডবদের বিবাহের সংবাদ অবশ্য তিনি জানতেন না। গুপ্তচরদের মুখে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ এবং দ্রৌপদী-লাভের কথা শুনে তিনি পরম আনন্দে সে কথা জানাতে এলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। কৌরব-পাণ্ডবদের প্রতি সমবুদ্ধিতে বিদুর কথা আরম্ভ করলেন নিতান্তই সাধারণভাবে। বললেন—কী সৌভাগ্য। কী সৌভাগ্য কুরুদের আজ বড়ই বাড়বাড়ন্ত হল—দিষ্ট্যা কুরুবো বর্দ্ধন্তে। ধৃতরাষ্ট্র কানাঘুষোয় শুনেছিলেন যে, দ্রৌপদীর সঙ্গে হস্তিনাপুরের একটা সম্বন্ধ ঘটেছে, অতএব বিদুরের মুখে সাধারণ একটা মন্তব্য শোনামাত্রই তিনি ভাবলেন—দুর্যোধনকেই স্বয়ংবরে বরণ করেছেন পাঞ্চাল রাজনন্দিনী—মন্যতে স বৃতং পুত্রং জ্যেষ্ঠং দ্রুপদকন্যায়া।
বিদুরের কথা শোনামাত্রই ধৃতরাষ্ট্র আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে পুত্রবধূ দ্রৌপদীর জন্য প্রচুর গয়না বানানোর আদেশ দিলেন, আর বিদুরকে বললেন—সত্যিই আজ বড় সৌভাগ্য আমাদের, বড় সৌভাগ্য! ওরে কে আছিস, যা এক্ষুনি—এ কথা বলার আগেই তিনি পুত্র দুর্যোধনকেই আদেশ দিলেন—যাও এক্ষুনি, আমার পুত্রবধূ পাঞ্চালী কৃষ্ণাকে নিয়ে এসো আমার সামনে—আনীয়তাং বৈ কৃষ্ণেতি পুত্রং দুর্যোধনং তদা (আজ্ঞাপয়ামাস)।
জীবন-নাটকের চরম ‘আয়রনি’ ঘটিয়ে বিদুর গম্ভীর স্বরে জানালেন—দুর্যোধনকে নয়, পাঞ্চালী কৃষ্ণা পাণ্ডবদেরই বরণ করেছেন বিবাহসভায়। মহারাজ দ্রুপদ তাঁদের অনেক সম্মান করে দ্রৌপদীকে তুলে দিয়েছেন পাণ্ডবদের হাতে। পাঞ্চালদের পক্ষপাতী অন্যান্য অনেক রাজাই সেই স্বয়ংবরসভায় পাণ্ডবদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ধৃতরাষ্ট্র অন্ধত্ববশে রাজা হননি বটে, তবে কী অসাধারণ তাঁর ক্ষমতা। বিদুরের কথা শুনে তিনি একটুও চমকিত হলেন না। এতকাল পরে পাণ্ডবদের কথা শুনে তিনি এতটুকুও আন্দোলিত হলেন না। তাঁর আকার ইঙ্গিত এবং হস্তপদের বিক্ষেপ দেখে এতটুকুও বোঝবার উপায় নেই যে, মনে মনে আবারও তাঁর ঈর্ষাবহ্নি জ্বলে উঠছে। সুনিপুণ অভিনয়ে এক মূহুর্তের মধ্যে তাঁর ব্যক্তি এবং অভিব্যক্তি দুইই পালটে গেল। মুখেচোখে নতুন অভিব্যক্তি যোগ করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন—তাই নাকি, তাই নাকি, সে তো খুব ভাল কথা। আমার কাছে আমার নিজের ছেলেরা যেমন, তার চেয়ে পাণ্ডুর ছেলেরা অনেক বেশি—যথৈব পাণ্ডোঃ পুত্ৰাস্তু তথৈবাভ্যধিকা মম। অনেক বেশি কেন জান—তারা যে ভাল আছে, তারা যে ভাল আত্মীয় এবং বন্ধু পেয়েছে—সেটা জেনে আমার কত ভাল লাগছে জান? তা ছাড়া দ্রুপদ রাজাকে আত্মীয়-কুটুম্ব হিসেবে লাভ করে সকলেই সম্মানিত বোধ করবে, আমিও করছি।
বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয়বৃত্তি জানতেন, অতএব একটু অবাক ব্যঙ্গোক্তি মিশিয়ে বললেন—পাণ্ডবদের প্রতি আপনার এই বুদ্ধিই যেন চিরকাল থাকে, মহারাজ! বিদুর চলে গেলেন। কিন্তু দুর্যোধন-কৰ্ণরা এতক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই দাঁড়িয়েছিলেন। বিদুরের কাছে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের সম্বন্ধে যত প্রশংসা বর্ষণ করছিলেন, তাতে তাঁরা মোটেই খুশি হননি। অতএব বিদুর চলে যেতেই তাঁরা ধৃতরাষ্ট্রের সামনে এসে বললেন—উনি সামনে ছিলেন, তাই কিছু বলতে পারিনি, কিন্তু এখন বলছি—এ আপনার কী ব্যবহার? আপনি সত্যিই কী করতে চাইছেন বলুন তো—কিং তবেদং চিকীর্ষিতম্? আপনি এতক্ষণ ধরে আমাদের শত্রুপক্ষের প্রশংসা করে গেলেন বিদুরের কাছে। শত্রুরা যাতে আমাদের সপরিবারে গ্রাস না করে, আমাদের এখন সেই ভাবনা করা দরকার। কিন্তু কী করা উচিত, আর কী আপনি এতক্ষণ করে গেলেন—অন্যস্মিন্ নৃপ কর্তব্যে ত্বমন্যং কুরুষে’নঘ।
ধৃতরাষ্ট্র ঠান্ডা মাথায় দুর্যোধনকে বললেন—তোমরা যা করতে চাইছ, আমিও তাই করতে চাইছি। কিন্তু আমি কি সেটা বিদুরের সামনে প্রস্ফুটভাবে প্রকাশ করব নাকি? আমি যে এতক্ষণ বিদুরের সামনে পাণ্ডবদের প্রশংসা করে গেলাম, তাতে লাভ হল এই যে, বিদুর আমার অভিপ্রায় বা মনের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। এখন তোমরা বলো, কী করতে চাও? দুর্যোধন অনেক কথা বললেন। কিন্তু তার মধ্যে কূটবুদ্ধি আর প্রবঞ্চনার কথাই বেশি। কীভাবে পাণ্ডবদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করা যায়, সে ভেদ ভাইতে ভাইতে হোক, পাণ্ডব এবং দ্রৌপদীর সম্বন্ধেই সে ভেদ হোক, অথবা দ্রুপদরাজার সঙ্গে পাণ্ডবদের যাতে ভেদ সৃষ্টি করা যায়—এই সব কূট পরামর্শেই তাঁর মন্তব্য শেষ হল। কর্ণ দুর্যোধনের কথা মানলেন না। তিনি বললেন—যুদ্ধ। এখনই যুদ্ধযাত্রা করা উচিত পাঞ্চালদের বিরুদ্ধে, যাতে তারা আর বাড়তে না পারে। খলতা এবং তঞ্চকতায় কর্ণের কোনও বিশ্বাস নেই, যা দুর্যোধনের আছে।
ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু কর্ণের কথাই শুনলেন এবং বললেন—রাধেয় কর্ণই ঠিক বলছে। তবে যুদ্ধের কথা ভাবলে তো আমরা এই ক’জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলে হবে না। সেখানে ভীষ্ম আছেন, দ্রোণ আছেন, বিদুর আছেন এবং তোমরাও আছ। সবাই মিলেই একটা কিছু ঠিক করতে হবে যাতে ভবিষ্যৎটা আমাদের পক্ষে সুখের হয়—যুবাঞ্চ কুরুতং বুদ্ধিং ভবেদ্ যা নঃ সুখোদয়া।
শুনেছি যাঁর অঙ্গহানি ঘটে, তাঁর অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বেশি সক্রিয় হয়। তবে ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চেয়ে বুদ্ধিটাই বেশি সক্রিয় হয়েছে। কী ধুরন্ধর মানুষ তিনি। পুত্র দুর্যোধন তাঁর যতই প্রিয় হোক, তাঁর কূট তঞ্চকতার মধ্যে তিনি আপাতত যেতে চাইলেন না। কারণ পাণ্ডবদের জতুগৃহে পাঠিয়ে পূর্বাহ্নেই তিনি অনেক দুর্নাম কুড়িয়েছেন। কিন্তু সে কথা তিনি দুর্যোধনকে বললেন না। কর্ণ দুর্যোধনের প্রাণের বন্ধু। তাঁর কথায় সায় দিলে দুর্যোধন রাগ করতে পারবেন না। আবার কর্ণ যেহেতু যুদ্ধের কথা বলেছেন এবং যুদ্ধ করতে গেলে যেহেতু সকলের মত চাই, তাই সেই সুযোগে মন্ত্রীসভার অধিবেশন ডাকা যাবে। আর ধৃতরাষ্ট্র খুব ভালই জানতেন যে, ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর—এঁরা কেউই এইসময়ে যুদ্ধের ব্যাপারে সায় দেবেন না। অতএব সমস্ত ব্যাপারটার ওপরেই এখন ধামাচাপা পড়ে যাবে। অন্তত এই মুহূর্তে তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে আর বিবাদ চাইছেন না। বারণাবতে পাণ্ডবদের নির্বাসন দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কোনও মানসিক চাপ তৈরি হয়নি, তা মোটেই নয়। নির্বাসিত পাণ্ডবদের বিপদ যা হবার হয়ে গেলে তা একরকম ছিল। কিন্তু তাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের উপযুক্ত ঘরে বিয়ে হয়েছে—অন্তত এইসময়ে যুদ্ধবিগ্রহ করে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর মনের শান্তি নষ্ট করতে চাননি। তিনি আরও বুঝেছিলেন—এইসময়ে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে গেলে—কুরুবৃদ্ধ এবং মন্ত্রী-অমাত্যরাই শুধু নয়, তাঁর রাজ্যবাসী প্রজারাও তাঁকে ছাড়বে না।
অতএব তিনি মন্ত্রীসভার অধিবেশন ডাকলেন। ঠিক যা হবার তাই হল। ভীষ্ম দ্রোণ মোটেই যুদ্ধবিগ্রহ সমর্থন করলেন না, বরং দুর্যোধনের ওপর ধৃতরাষ্ট্রের অতি স্নেহের নিরিখে তাঁরা প্রস্তাব করলেন—যদি নিজের মঙ্গল চাও, তো কুরুরাজ্যের অর্ধেক অন্তত পাণ্ডবদের দিয়ে দাও—ক্ষেমং যদি কর্তব্যং তেষামর্ধঃ প্রদীয়তাম্। বিদুর তো ভীষ্ম-দ্রোণকে সমর্থন করলেনই, উপরন্তু পাঞ্চাল দ্রুপদের সঙ্গে পাণ্ডবদের বৈবাহিক সম্বন্ধ ঘটায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও যে তাঁদের এক মিত্রবলয় তৈরি হয়েছে, সেটা বেশ বুঝিয়ে দিলেন। শেষে বললেন—পৌর জনপদবাসীরা যখন শুনবে যে, পাণ্ডবরা বেঁচে আছেন, তখন তারাও এঁদের দেখার জন্য উৎসাহিত হবে। তা ছাড়া বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য যেভাবে পুরোচনকে লাগানো হয়েছিল, সেই দুঃখক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার অনুগ্রহের বুদ্ধিটাই এখন ঠিক হবে। আপনি দুর্যোধনের বুদ্ধিতে চলার চেষ্টা করবেন না, তাতে রাজ্য ছারখার হয়ে যাবে।
ধৃতরাষ্ট্র সভা ডেকে একদিকে দুর্যোধন-কর্ণকে অন্যের মুখ দিয়ে নিজের বক্তব্য শুনিয়ে দেবার সুযোগ পেলেন। তাতে দুর্যোধন-কৰ্ণরা আপাতত স্তিমিত হলেন। অন্যদিকে ভীষ্ম দ্রোণের মত নিয়ে নিজেকে খানিকটা সমদর্শী রাজার ভূমিকায় নিয়ে এলেন। ভীষ্ম দ্রোণ বিদুরের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র রায় দিলেন—তুমি পাণ্ডবদের এবং তাঁদের জায়া জননীকে পরম সমাদরে হস্তিনাপুরে নিয়ে এসো। ভাগ্যিস তাঁরা বেঁচে আছেন, ভাগ্যিস বেঁচে আছেন তাঁদের জননী পৃথা। পুরোচনের চেষ্টা যে সফল হয়নি, এও আমার ভাগ্য। দ্রুপদের সঙ্গে তাঁদের সম্বন্ধ ঘটেছে, কৃষ্ণা পাঞ্চালীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তাঁদের—এ আমার পরম সৌভাগ্য। আমার সমস্ত দুঃখ থেকে আজ আমি মুক্ত হয়েছি। যাও সবাইকে নিয়ে এসো, বিদুর! পরম আদরে হস্তিনাপুরে নিয়ে এসো—ক্ষওরানয় গচ্ছৈতান্ সহ মাত্রা সুসৎকৃতান্।
বিদুর পাঞ্চালে গিয়ে পাণ্ডবদের নিয়ে এলেন হস্তিনানগরে। সঙ্গে দ্রৌপদী এবং জননী কুন্তী। রাজপুরীর বাইরে থেকে তাঁদের সাভিনন্দন নগরপ্রবেশ করানোর জন্য ধৃতরাষ্ট্র চারটি মানুষকে পাঠালেন—দ্রোণাচার্য কৃপাচার্যের মতো দুই গুরুকে, আর কৌরবকুলের বিকর্ণ এবং চিত্রসেনকে। প্রজাদের প্রবল উচ্ছ্বাসের মধ্যে যুধিষ্ঠির সপরিবারে নগরে প্রবেশ করে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করলেন। তারপরেই ধৃতরাষ্ট্রের ডাক পেয়ে ভাইদের নিয়ে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে এলেন।
যদি দুর্যোধনের স্বার্থরক্ষার নিরিখে কথাটা ভাবা যায়, তা হলে এই মুহূর্তে অসাধারণ কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় দিলেন ধৃতরাষ্ট্র। ভীষ্ম-দ্রোণের মতো বৃদ্ধ হিতৈষীরা ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্য ভাগ করে দিতে বলেছিলেন; সেই অনুজ্ঞা মেনে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের একটি জায়গা দিলেন রাজত্ব করার জন্য। জায়গার নাম খাণ্ডবপ্রস্থ। জায়গাটা ঘন জঙ্গলে ভরা, কোনও ভদ্র মানুষ থাকে না সেখানে। শস্য ভাল হয় না। একেবারে পাথুরে বনাঞ্চল। এমন জায়গায় রাজত্ব করে ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধি ঘটানো অত্যন্ত কঠিন বলেই ধৃতরাষ্ট্র এই জায়গাটাই ঠিক করলেন পাণ্ডবদের বসবাস এবং রাজত্বের জন্য। এতে ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুররা মনে মনে যত ক্ষুব্ধই হোন না কেন, মুখে তাঁদের কিছু বলার মতো থাকবে না। কারণ ধৃতরাষ্ট্র তো একটি রাজ্যের রাজত্ব করার সুযোগ দিচ্ছেনই পাণ্ডবদের।
ধৃতরাষ্ট্র বললেন যুধিষ্ঠিরকে। বললেন—ভাইদের সঙ্গে আমার কথা শোনো, যুধিষ্ঠির! তোমরা সবাই খাণ্ডবপ্রস্থে যাও এবং রাজত্ব করো সেখানে। সেখানে তোমাদের কেউ বিরক্ত করবে না, আর তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তোমাদের সকলকে সুরক্ষিত রাখবে। খাণ্ডবপ্রস্থের রাজত্ব স্বীকার করলে তোমাদের সঙ্গে আমাদের আর কখনও কোনও বিবাদ বিসংবাদ হওয়ার সুযোগ থাকবে না—পুনর্নো বিগ্রহো মাভূৎ খাণ্ডবপ্রস্থমাবিশ।
ভীষ্ম কিংবা বিদুর যেমন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, তাঁদের অর্ধরাজ্য দেবার প্রস্তাব ধৃতরাষ্ট্র এইভাবে কার্যে পরিণত করবেন, তেমনই ধৃতরাষ্ট্রও কল্পনা করতে পারেননি যে, আপন উদ্যমে পাণ্ডবদের মতো মানুষেরাই খাণ্ডবপ্রস্থের বিপরীত পরিবেশকে স্বর্গে পরিণত করতে পারেন। ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চয়ই খুব ভালবেসে পাণ্ডবদের রাজত্ব করার জন্য জমি দেননি। কিন্তু পাণ্ডবরা যখন কৃষ্ণ এবং ময়দানবের সাহায্যে খাণ্ডবপ্রস্থে ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করলেন, তখন সেই রাজধানীই তাঁদের কাল হয়ে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে অবশ্য পাণ্ডবদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেক বেড়ে গেল। তখনকার দিনের একছত্র সম্রাট বলে পরিচিত জরাসন্ধ ভীমের হাতে মারা গেলেন। এদিকে রাজসূয় যজ্ঞ করে যুধিষ্ঠির তখনকার রাজ-সমাজের চূড়ায় অধিষ্ঠিত হলেন। পাণ্ডব ভাইদের দিগবিজয়ের মাধ্যমে যেমন সামন্ত রাজারা আনত হলেন, তেমনই রাজকর এবং উপঢৌকনের মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি ঘটল বহু গুণ।
রাজসূয় যজ্ঞের আনুষ্ঠানিক পর্বে যুধিষ্ঠির নকুলকে পাঠালেন হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে নিমন্ত্রণ করার জন্য। নকুল গিয়ে ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র সবাইকে নিমন্ত্রণ করলেন। কিন্তু কুরুবাড়ির সকলেই এক উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এলেন না। এঁদের মধ্যে ভীষ্ম যদি আর-এক ঘরের নাতিদের বাড়বাড়ন্ত দেখতে এসে থাকেন, তবে ধৃতরাষ্ট্র এসেছিলেন যুধিষ্ঠিরের ক্ষমতা-ঐশ্বর্য পরিমাপ করার জন্য। দুর্যোধন শকুনিরা এসেছিলেন ঈর্ষায়, বিদুর এসেছিলেন অসীম মমত্ববোধে। আরও অনেকেই এসেছিলেন, কিন্তু তাঁদের মন বোঝার দরকার নেই আমাদের। হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের যতটুকু অনুভব করে গেলেন, সেই অংশটুকুই আমাদের প্রয়োজন।
বস্তুত ধৃতরাষ্ট্র যা অনুভব করে গেলেন, সে কথা খুব বড় করে বলেননি মহাভারতের কবি। কিন্তু দুর্যোধন যা অনুভব করে গেলেন, তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা আছে মহাভারতে এবং তা আছে পিতাপুত্রের কথোপকথনে। ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে ফিরে এসে দুর্যোধন ঈর্ষা অসূয়া আর পরশ্রীকাতরতায় জ্বলতে লাগলেন সব সময়। অবস্থা দেখে শকুনিমামা একদিন ধৃতরাষ্ট্রকে বলেই ফেললেন—ভাগনে দুর্যোধনের দুঃখের কথা। শকুনি বললেন—আপনার বড় ছেলেটির দিকে একটু খেয়াল করেন না, মহারাজ! তার দুঃখটা কোথায়—একবারও ভেবে দেখেছেন—জ্যেষ্ঠপুত্রস্য হৃচ্ছোকং কিমর্থং নাববুধ্যসে? কী রোগা আর শুকনো হয়ে গেছে চেহারাটা—বিবর্ণো হরিণঃ কৃশঃ। ধৃতরাষ্ট্র, অন্ধ স্নেহে আত্মহারা হয়ে দুর্যোধনকে ডেকে বললেন—কী হয়েছে, বাছা আমার! এত দুঃখের কারণ কী? এই যে শকুনি বলে গেল—তোমার চেহারা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। গায়ের রং হয়ে যাচ্ছে কালো—আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা! হঠাৎ করে এত শোকের কী কারণ ঘটল—তা তো কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না—চিন্তয়ংশ্চ ন পশ্যামি শোকস্য তব সম্ভবম্।
জীবনে এটা প্রথমবার নয় অবশ্য। ধৃতরাষ্ট্র যে একজন যুক্তিবাদী মানুষের মতো কথা বলছেন, তা এই প্রথম নয়। তাঁর মধ্যে এখন সেই শুভসত্তা কাজ করছে। তিনি নিশ্চয় ভেবেছিলেন যে, শত হোক, পাণ্ডবদের পৃথক রাজ্য দেওয়া হয়েছে এক অতি র্নিকৃষ্ট জায়গায়, দুর্যোধন হস্তিনাপুরে বাপ ঠাকুরদার সাজানো রাজ্য পাবেন, অতএব তাঁর ঈর্ষা থাকার কারণ নেই কোনও। কিন্তু তবু কেন এই ঈর্ষা, তা তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। দুর্যোধনকে বলেও ফেললেন সে কথা। বললেন—রাজঐশ্বর্য! সেও তো তোমার কিছু কম নেই বাবা। তোমার ভাইরা—সে তোমার নিজের ভাইই হোক অথবা পাণ্ডবরা—কেউ তো তোমার কোনও ক্ষতি করছে না। তা ছাড়া খাচ্ছ ভাল, পরছ ভাল—আচ্ছাদয়সি প্রাবারান্ অশ্নাসি পিশিতৌদনম্—তাও, আশ্চর্য কথা, তুমি নাকি রোগা হয়ে যাচ্ছ? ধৃতরাষ্ট্র আরও বললেন—ভাল বাড়ি, ভাল গাড়ি—অজানেয়া বহন্তশ্বাঃ—সে সব তো কিছুর অভাব নেই তোমার। এমনকী মহার্ঘ শয্যায় স্ত্রীলোকের রতিকল্প, সেও তোমার করায়ত্ত—শয়নানি মহার্হানি যোষিতশ্চ মনোরমাঃ। অতএব তোমার আবার দুঃখ কীসের? তোমার এই দুঃখ শুধু দুঃখ নয় মোটেই, এ হল মৌখিক দুঃখবিলাস—বাচি বদ্ধং ন সংশয়?
ধৃতরাষ্ট্রের এই কথার উত্তরেই দুর্যোধনের ভাষা কবিতায় রূপান্তরিত হতে পারে—সুখ চাহি নাই মহারাজ। দুর্যোধন বললেন—ভাল খাবার আর ভাল পরিধানেই যারা খুশি, তাদের মতো সাধারণ পুরুষ কি আমি—অশ্নাম্যাচ্ছাদয়ে চাহং যথা কুপুরুষ স্তথা। হৃদয়ে চিরকালের এক রাগ পুষে রেখে আমি কাল কাটাতে চাই। আমার কোনও সন্তুষ্টি নেই জীবনে, কারণ সন্তুষ্টিই তো সবসময় সমৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সন্তুষ্টি বড় হওয়ার অহংকার নষ্ট করে দেয়। দুর্যোধন এবার সোজাসুজি ধৃতরাষ্ট্রের যুক্তিতে এসে বললেন—আপনি আমার মহার্ঘ ভোজন পরিধানের কথা বললেন তো? তার উত্তরে বলি—যুধিষ্ঠিরের সমৃদ্ধি দেখবার পর থেকে আমার ভাত হজম হয় না—ন মাং প্রীণাতি মদ্ভুক্তং শিয়ং দৃষ্টা যুধিষ্ঠিরে। যুধিষ্ঠিরের ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্যের চোখ ধাঁধানো রঙই আমাকে একেবারে বিবর্ণ করে দিয়েছে।
দুর্যোধন পিতার কাছে পাণ্ডবদের ঋদ্ধি এবং প্রতাপের বর্ণনা দিলেন যথাসম্ভব। কথার মাঝখানে শকুনি তাঁর সেই ভয়ংকর প্রস্তাব করলেন। পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে তিনি পাশায় হারিয়ে দিতে চান। দুর্যোধন তাঁকে অনুমোদন করে ধৃতরাষ্ট্রের মত চাইলেন পাশাখেলার ব্যাপারে। ধৃতরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে মত দিতে পারলেন না। তাঁর ভিতরে এখন শুভসত্তা এবং অশুভসত্তার দ্বন্দ্ব চলছে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—মহামতি বিদুরকে একবার জিজ্ঞাসা করতেই হবে, দুর্যোধন। তিনি আমাদের মন্ত্রী তথা প্রাজ্ঞ পণ্ডিত। তিনি নিরপেক্ষভাবে তাঁর মত জানাবেন এবং তাতে পাণ্ডব-কৌরব উভয়পক্ষের ভবিষ্যৎই ভাল হবে।
দুর্যোধন বললেন—আপনি বিদুরকে জিজ্ঞাসা করবেন? তা হলেই হয়েছে। তিনি জীবনেও এ ব্যাপারে মত দেবেন না। আর মত না দিলে আপনিও যদি সেইসঙ্গে পিছিয়ে আসেন, তবে মৃত্যু ছাড়া আর কোনও গতি থাকবে না আমার। আমি মরলে তখন বিদুরকে নিয়ে রাজ্যসুখ ভোগ করুন আপনি। আমার কী প্রয়োজন আছে বেঁচে থেকে—স ত্বং ময়ি মৃতে রাজন্ বিদুরেণ সুখী ভব।
বীরমানী দুর্যোধনের মুখে এমন আর্ত কণ্ঠস্বর শুনে ধৃতরাষ্ট্রের অন্তরশায়ী মায়াধার উদ্বেলিত হয়ে উঠল। তিনি প্রথমত একটু সরল করেই ব্যাপারটা ভাবলেন। ভাবলেন—যুধিষ্ঠিরের নবনির্মিত অসাধারণ রাজসভাটির নির্মাণ-নৈপুণ্য দেখেই বোধহয় দুর্যোধনের মাথাটা খারাপ হয়েছে। তিনি হস্তিনাপুরের সভাটাকে নতুন স্থাপত্যরীতিতে গড়ে তোলার আদেশ দিলেন—মনোরমাং দর্শনীয়াম্ আশু কুর্বন্তু শিল্পিনঃ। কিন্তু এসব কাজে যে দুর্যোধন শান্ত হবেন না, সেটা ধৃতরাষ্ট্র জানতেন। এদিকে পাশাখেলার মাধ্যমে নিরীহ পাণ্ডবদের রাজ্য জিতে নেওয়ার ব্যাপারটাও ধৃতরাষ্ট্রের ভাল লাগছিল না। পণ ফেলে পাশার বাজি জেতার মধ্যে যে ভয়ংকর এক অভিশাপ আছে, তা তিনি জানতেন। দুর্যোধন সেই সর্বনেশে ব্যাপারে তাঁকে রাজি করাতে চাইছেন—এটা বুঝেও প্রিয় পুত্রকে তিনি সরাসরি ‘না’ বললেন না। রাজবাড়ির ভিতরে মন্ত্রী অমাত্য এবং কুরুবৃদ্ধদের মধ্যে এর কী প্রতিক্রিয়া হবে, সেটাও তিনি বুঝে নিতে চান বিদুরের সঙ্গে কথা বলে। অতএব পাশাখেলার কুফলের জন্য নয়, দুর্যোধনের প্রতি মায়াবশতই তিনি পাশাখেলার ব্যাপারে মাথা ঘামাতে আরম্ভ করলেন—দ্যূতে দোষাশ্চ জানন্ স পুত্রস্নেহাদ্ অকৃষ্যত।
বিদুর এলেন এবং সোচ্চারে জানালেন যে, কলহ সৃষ্টির এই প্রকৃষ্টতম আদর্শে তাঁর কোনও শ্রদ্ধা নেই। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের মায়ায় বিদুরকে বোঝালেন—আরে না না, ঝগড়া হবে কেন? ছেলেতে ছেলেতে এ ঝগড়া সম্ভব নাকি? তা ছাড়া ভীষ্ম, দ্রোণ, আমি, তুমি—সবাই তো রয়েছি। আমরা থাকতে কোনও অন্যায়ই আমরা হতে দেব না। তবে হ্যাঁ, একটা ব্যাপার সত্যি যে, তোমাকেই গিয়ে ডেকে আনতে হবে যুধিষ্ঠিরকে এবং ভাল হোক মন্দ হোক, মঙ্গল কিংবা অমঙ্গল—পাশা খেলানোর ব্যবস্থা একটা করতেই হবে। তুমি গিয়ে বলবে—এই পাশাখেলা হবে বন্ধুর মতো, অর্থাৎ জয়-পরাজয়ে কোনও সুখদুঃখের বালাই নেই এতে—কিন্তু খেলাটা হবেই—প্রবর্ততাং সুহৃদ্দ্যূতং দিষ্টমেতন্ন সংশয়।
বিদুরকে ঝোঁকের মাথায় একটা আদেশ দিয়ে দিলেও ধৃতরাষ্ট্র বুঝতে পারছিলেন যে, ঘটনাটা ভয়ংকর হতে চলেছে। দুর্যোধনকে তিনি একান্তে ডেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। বিদুরের উপদেশ স্মরণ করিয়ে দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র জানালেন যে, বিদুরের মতো হিতবক্তা প্রাজ্ঞ ব্যক্তি দ্বিতীয় নেই। তিনি দুর্যোধনের হিতের কথাই বলেছেন। ধৃতরাষ্ট্র জোর দিয়ে বললেন—পাশাখেলা মানেই ভাইতে ভাইতে বিরোধ সৃষ্টি হবে আর বিরোধ মানেই রাজ্যনাশ। অতএব এই কাজ করতে যেয়ো না—ভেদে বিনাশো রাজ্যস্য তৎ পুত্রং পরিবর্জয়। তা ছাড়া তুমি তো বাছা পিতৃপিতামহের রাজ্য পেয়েইছ। সেখানে শয়ন ভোজন আচ্ছাদন যা তুমি পাচ্ছ, তা তো কেউ কেড়ে নিচ্ছে না তোমার কাছ থেকে—পৃথগ্জনৈরলভ্যং তৎ ভোজনাচ্ছাদনং পরম্। সেখানে তোমাদের সকলের বড় ভাই তার নিজের রাজ্যে রাজা হয়েছে—সেটাকে তুমি খারাপ ভাবে দেখছ কেন—মন্যসে কিং ন শোভনম্।
দুর্যোধন এবার তাঁর অপমানের কথা শোনালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভায় স্ফটিক-স্বচ্ছ ভূমিতলে কীভাবে তাঁর জলভ্রম হয়েছিল এবং অস্থানে স্থানচ্যুত হওয়ায় পাণ্ডব-ভাইরা, এমনকী দ্রৌপদীও কীভাবে হেসে উঠেছিলেন, সে সব বর্ণনা দিলেন। রাজসভায় সামন্তরাজারা কে কত উপঢৌকন দিয়েছিলেন এবং সেই অতুল ধনৈশ্বর্য হাতে ধরে রাখতে রাখতেই তিনি কত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাও অনেক ঘটা করে শোনালেন দুর্যোধন। সম্পূর্ণ তিন-চার অধ্যায় জুড়ে দুর্যোধনের এই সন্তাপপর্ব বর্ণিত হয়েছে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু তাতেও খুব একটা বিগলিত হননি। দুর্যোধনকে তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, পাণ্ডব যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের সমান শক্তিসম্পন্ন এক রাজামাত্র তার বেশি নয়। তা ছাড়া যুধিষ্ঠির যেখানে তাঁর প্রতি লেশমাত্র বিদ্বেষ পোষণ করেন না, সেখানে তাঁকে বিদ্বেষ করা কি দুর্যোধনকে মানায়—অদ্বিষন্তং কথং দ্বিষ্যাৎ ত্বদৃশো ভরতৰ্ষভ।
ধৃতরাষ্ট্র আরও একটা প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন যে, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের ঐশ্বর্য দেখে যদি দুর্যোধনের মনে কোনও যজ্ঞ করার বাসনা জেগে থাকে! ধৃতরাষ্ট্র বললেন—যদি বড় একটা যজ্ঞ করে কীর্তি অর্জন করতে চাও, তো ঋত্বিক ব্রাহ্মণরা কোনও যজ্ঞকর্মে দীক্ষিত করুন তোমাকে। তাতেও নানা দেশের রাজারা এসে তোমার হাতে উপহার তুলে দেবেন। কিন্তু শুধু শুধু ভাইদের প্রতি বিদ্বেষ করো না। এইভাবে পাণ্ডবদের রাজ্য ছিনিয়ে নেওয়াটা মিত্র-দ্রোহের পর্যায়ে পড়বে। পাণ্ডুপুত্রেরা তোমারই অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো। তাঁদের ছেঁটে দেওয়া মানে তো নিজের হাতদুখানি কেটে ফেলার মতো। মনে রেখো—পাণ্ডবের কৌরবের এক পিতামহ—পিতামহা যে তব তে’পি তেষাম্।
এতক্ষণ দুর্যোধন তবু শুনছিলেন, এবার তিনি গালাগালি দিতে আরম্ভ করলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। বললেন—আপনি আমাদের স্বার্থের দিকে তাকাচ্ছেন না, আমাকেই গালাগালি দিচ্ছেন—স্বার্থে কিং নাবধানং তে উতাহো দ্বেষ্টি মাং ভবান্। আরে পাণ্ডবদের যা বাড়বৃদ্ধি হয়েছে, তাতে আপনার ছেলেরা, যাঁদের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে শাসন করছেন আপনি, তারাই ভবিষ্যতে কেউ থাকবে না, সেখানে আপনি ভবিষ্যতের মঙ্গল শোনাচ্ছেন—ন সন্তীমে ধার্তারাষ্ট্রা যেষাং ত্বমনুশাসিতা। দুর্যোধন অনেক আশঙ্কার কথা শোনালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। যেভাবে হোক শত্রুকে, অন্তত দুর্যোধন পাণ্ডবদের পরম শত্রু মনে করেন বলেই, যেভাবে হোক তাঁদের রাজ্য কেড়ে নেওয়াটাই প্রয়োজন বলে মনে করেন দুর্যোধন। মাতুল শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই দুর্যোধনের মহতী পরিকল্পনা সত্যে পরিণত করার উপযোগিতা প্রকট করলেন।
পুত্রস্নেহের স্বাভাবিক বৃত্তি এবং অন্ধতার বিরুদ্ধে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্র এতক্ষণ অনেক যুক্তি দেখিয়েছেন। এইভাবে বিনা কারণে পাণ্ডবদের সঙ্গে বঞ্চনা করলে যে, ঘরেবাইরে সর্বত্র অসহায় এবং বিপন্ন হয়ে পড়বেন দুর্যোধন—এটাও ধৃতরাষ্ট্র তাঁর স্নেহ-প্রবৃত্তির মাধ্যমেই বুঝতে পারছিলেন। কিন্তু আর তিনি পারছেন না। ঈর্ষা অসূয়ায় পীড়িত দুর্যোধন এমনভাবে ধৃতরাষ্ট্রকে আক্রমণ করছেন, এমনভাবেই মর্যাদাহানি করছেন, যাতে উত্তরোত্তর তাঁর শক্তি কমে আসছে, তিনি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। পুত্রকে আর তিনি রোধ করতে পারছেন না। স্নেহবৃত্তির প্রতিরোধও আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে। দুর্যোধন শকুনির যৌথ পরামর্শে শেষ পর্যন্ত তিনি আকুল হয়ে বলে উঠলেন—আমার কথা যখন শুনলে না, তখন যা তোমাদের ভাল লাগে, তাই করো—যত্ তে প্রিয়ং তৎ ক্রিয়তাং নরেন্দ্র। এই পাশাখেলার সীমাহীন বিপদ সম্বন্ধে বিদুর যা বলেছিলেন, আমি তাই মনে করি। কিন্তু তোমরা যখন শুনবে না, তখন ভবিষ্যতে অনুতাপ করতে হবে এই কথা ভেবেই এগিয়ে যাও।
আমরা জানি—তবু একমাত্র ধৃতরাষ্ট্রই এই পাশাখেলার তঞ্চকতা বন্ধ করতে পারতেন। দুর্যোধনের সমস্ত দুঃখ শোক এবং ক্রোধের কারণ বুঝেও তিনি যদি এই ব্যাপারে উদাসীন থাকতেন বা পাশাখেলার অনুমতি না দিতেন, তা হলেই পাণ্ডব কৌরবের অন্তর্ভেদ অত শীঘ্র জটিল হয়ে উঠত না। কিন্তু না, দুর্যোধনকে যখন তিনি কিছুতেই মানাতে পারলেন না, তখন তিনি ভাবলেন—এটাই দৈব এবং দৈবের বিধান দুরতিক্রম্য—দৈবং মত্বা পরমং দুস্তরঞ্চ। কিন্তু মহাভারতের কবি লক্ষ করেছেন যে, এই দুস্তর দৈবকে তিনি প্রতিরোধ করতে পারতেন কারণ দুর্যোধনের ঈর্ষা অসূয়ায় নির্মাণ করা হয়েছে এই দৈবের শরীর। কবি তাই ছোট্ট মন্তব্য করেছেন—ধৃতরাষ্ট্র এটাকে দুস্তর দৈবের বিধান মনে করে আসলে পুত্রের বাক্যেই স্থিত হলেন, অর্থাৎ পুত্র যা বলছেন, তাই মেনে নিলেন—পুত্ৰবাক্যে স্থিতো রাজা দৈব-সংমূঢ়চেতা। ধৃতরাষ্ট্র এবার নিজের রাশ ছেড়ে দিলেন দৈবরূপী পুত্রের হাতে।
পাশক প্রতিযোগিতার জন্য ধৃতরাষ্ট্রের সভা নতুন করে গড়া হল। বড় বড় দরজা, দামি দামি আসন, আর রত্ন বৈদুর্যখচিত সভাস্তম্ভে ধৃতরাষ্ট্রের সভার চেহারা হল অভিনব। রাজ্যের ছোট বড় সমস্ত পাশাড়েকে খবর দেওয়া হল দ্যূতসভায় যোগদান করার জন্য। ধৃতরাষ্ট্র এখন আর কারও কথা শুনছেন না। শুভাশুভের সমস্ত দ্বন্দ্ব উত্তীর্ণ হয়ে এখন তিনি তাই করে যাচ্ছেন, যা তাঁর ছেলে দুর্যোধন বলছেন—মতমাজ্ঞায় পুত্রস্য ধৃতরাষ্ট্ৰো নরাধিপঃ। বিদুরকে তিনি আগেই আদেশ করেছিলেন—যুধিষ্ঠিরকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু কী ভেবে বিদুর তক্ষুনি যাননি। তিনি ভীষ্মকেও কথাটা বলেছিলেন। এখন দুর্যোধনের মতে স্থিত হবার পর ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে আবারও ডাক পড়ল বিদুরের।
বিদুর আগের মতো করেই আবারও বোঝাবার চেষ্টা করলেন অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রকে। বার বার বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, ওই পাশাখেলা থেকেই চিরন্তন কলহ তৈরি হবে পাণ্ডব-কৌরবের মধ্যে। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন—দেখো বিদুর! দৈব যদি অন্যরকম না হয়, তা হলে এসব কলহটলহ নিয়ে আমি একটুও ভাবছি না—নৈবং ক্ষত্তঃ কলহস্তপ্স্যতে মাং/ন চেদ্দৈবং প্রতিলোমং ভবিষ্যৎ। আমরা সকলেই বিধাতার বিধানে দৈবের হাতে ক্রীড়নকমাত্র, স্বতন্ত্রভাবে আমি কীই বা করতে পারি? যাই হোক, এত কথার দরকার নেই, তুমি আমার আদেশ অনুসারে এখনই কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরকে এখানে নিয়ে এসো—ক্ষিপ্রমানয় দুর্ধর্ষং কুন্তীপুত্রং যুধিষ্ঠিরম্।
ধৃতরাষ্ট্র এখন কথায় কথায় দৈবের অজুহাত দিচ্ছেন এবং সেইজন্যই সামান্য একটু দার্শনিক কথা এখানে বলে নেওয়া দরকার। কথাটা আরম্ভ করতে হবে অন্য একটা প্রসঙ্গ দিয়েই। আমাদের মতো সাধারণ গৃহস্থের ঘরে বার বার আমি একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। দেখেছি—গৃহস্থের ঘরে কোনও বিপদ ঘটলেই—সে কঠিন অসুখবিসুখ, মৃত্যু থেকে মেয়ে পালানো পর্যন্ত—এমনি কোনও বিপদ ঘটলেই মানুষ কপাল চাপড়ে বলে—ভগবান! এই আমার কপালে ছিল! আমরা তো জ্ঞানত কোনও অন্যায় করিনি, তবে তুমি কেন আমাকে এই দুঃখ দিলে? মানুষ প্রচণ্ড সুখের মধ্যে ভগবানকে একইভাবে যে দায়ী করে, তা তো নয়, তবে দুঃখের মধ্যে অন্তত দায়ী করার জন্যই ভগবানকে মনে করে—সেটা বেশ দেখেছি।
যাই হোক, দার্শনিকভাবে যদি উপরিউক্ত কথার উত্তর দিতে হয়, তবে বলতে হবে যে, ঈশ্বর কারও পাপ পুণ্যের জন্য দায়ী নন। জন্মের মুহূর্ত থেকেই মানুষের স্বাধীনতা আছে পাপ কর্ম করার বা পুণ্য কর্ম করার। ভারতীয় দর্শন মতে—মানুষের সদসৎ কর্মের পরিণামেই তার সুখ এবং দুঃখ নিয়ন্ত্রিত হয়। অপরিণত মৃত্যু বা আপাতিক বিপদ সম্বন্ধে পূর্বজন্মকৃত পাপের কথা স্মরণ করা হয়। কিন্তু কোনওভাবেই কোনও বিপদ বা মৃত্যু বা সম্পদ বা অতি-সুখের নিয়ন্তা হিসেবে ভগবান চিহ্নিত নন। খুব সোজা কথায় এটা বলা হয়েছে ভগবদ্গীতায়—নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভো। কাজেই যিনি গাড়ি বাড়ি, সম্পদ বা আয়ু ভোগ করছেন, তিনি সেটা তাঁর ইদানীন্তন পুরুষকার অথবা প্রাক্তন পুণ্যবশেই করছেন, আবার যিনি দারিদ্র, দুঃখ বা মৃত্যুর যাতনা ভোগ করছেন, তিনিও তাঁর ইদানীন্তন আলস্য, অচেষ্টা অপচেষ্টা অথবা প্রাক্তন পাপকর্মবশেই তা ভোগ করছেন। পরম ঈশ্বর মানুষকে এই সাধু অসাধু কর্ম করার অধিকার দিয়েছেন এবং কোনও অবস্থায় তিনি এইসব কর্মের রাশ ধরে নেই। তাঁর জন্য জগৎ-সংসারে আরও অনেক বড় বড় কাজ নির্দিষ্ট আছে।
সত্যি কথা বলতে কী এখানে ব্রহ্মসূত্র থেকে শঙ্করাচার্য অনেক কিছুই আলোচনা করা যেত, কিন্তু একে জায়গা কম, তাতে আবার ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্রের অনেকখানি বাকি পড়ে আছে। অতএব সেসব বড় বড় কথায় না গিয়ে, যে প্রসঙ্গে পাপ পুণ্যের কথায় এলাম, সেটা শেষ করে নিই। দার্শনিক দিক থেকে মানুষের পাপ পুণ্যের ব্যাপারে যদি ঈশ্বরের হাত কিছুই না থাকে, তা হলে মানুষকেও তো এক স্বাধীন স্বতন্ত্র ঈশ্বরে পরিণত করা যায়। ঠিক এইখানে সার্বত্রিকভাবে ঈশ্বরের কাছে মানুষ জীবের কিছু অধীনতা আছে বলে বেদান্ত দর্শনে একটি সূত্র আছে। সেখানে শঙ্করাচার্য তাঁর টীকায় একটি শ্রুতিবাক্য উদ্ধার করেছেন, যা মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠও উচ্চারণ করেছেন ধৃতরাষ্ট্রের দৈবের অজুহাত খোঁজার প্রসঙ্গে।
শ্রুতি বলেছে—যে ভাল কাজ করে ঈশ্বর তাকে আরও উন্নততর লোকে স্থাপন করেন, আর যে খারাপ কাজ করে ঈশ্বর তাকে আরও অধমভূমিতে স্থাপন করেন। জীবের স্বতন্ত্র কর্তৃত্ব আছে কি না অথবা জীবের কর্তৃত্ব ঈশ্বরের অধীন কি না এই নিয়ে বিরাট বিচার আছে বেদান্ত দর্শনে। কিন্তু নীলকণ্ঠ এখানে বলতে চাইছেন—পূবকর্মবশেই ধৃতরাষ্ট্রকে ঈশ্বর আরও খারাপ দিকে প্রযোজিত করছেন। অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র পাপ কর্ম করে করে নিজেকে পূর্বাহ্নেই অধমভূমিতে স্থাপন করেছেন, এখন দৈব বা ঈশ্বর তাঁকে আরও অধম গতি দান করছেন। অর্থাৎ ঈশ্বর এখানে প্রযোজক কর্তামাত্র, মূল কর্তৃত্ব ধৃতরাষ্ট্রেরই—পূর্বকর্মাপেক্ষ ঈশ এব সত্যসতি বা সর্গে প্রবর্তয়তীতি শ্রুতেঃ।
ধৃতরাষ্ট্রের শাসন মেনে বিদুর শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রপ্রস্থে গেলেন যুধিষ্ঠিরকে নিমন্ত্রণ করার জন্য। বিদুর অত্যন্ত অনিচ্ছুকভাবেই ইন্দ্রপ্রস্থে গেলেন—বলান্নিযুক্তো ধৃতরাষ্ট্রেণ রাজ্ঞা—এবং পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা বললেনও। যুধিষ্ঠির নিজে পাশাখেলার দোষ যথেষ্টই জানতেন এবং বিদুরের মাধ্যমে তিনি খবরও পেলেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের সভায় কারা কারা পাশা খেলতে এসেছেন। কিন্তু সব শুনেও তিনি পাশাখেলার লোভ সংবরণ করতে পারলেন না এবং তিনিও দৈবেরই অজুহাত দিতে লাগলেন। টীকাকার নীলকণ্ঠ এ স্থলে কোনও মন্তব্য করেননি, কারণ পাশাখেলার লোভটা যুধিষ্ঠিরের অশেষ সদ্গুণের মধ্যে একটা মাত্র বদগুণ। তাও তিনি কারও ক্ষতি করবেন বলে পাশা খেলেন না। পাশাখেলাটা তাঁর বড় ভাল লাগে, কিন্তু খেলতেও ভাল পারেন না—দ্যূতপ্রিয়শ্চ কৌন্তেয়ো ন স জানাতি দেবিতুম্।
পৃথিবীতে এমন মানুষ অনেক পাওয়া যাবে। যে খেলতে জানে না, অথচ খেলাটা ভীষণ ভালবাসে, তার খেলার রোখ সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এই খেলার মধ্যে দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রের দুরভিসন্ধি নেই বলেই টীকাকার নীলকণ্ঠকে এখানে শ্রুতিবাক্য উচ্চারণ করতে হয়নি। অর্থাৎ পাশাখেলার জন্য যুধিষ্ঠিরের বলা দৈবের দোহাই একেবারেই দোহাই মাত্র। তিনি প্রতিযোগিতা জিততে চান। আর তাতে খুব ভয় থাকারও কথা নয়, কারণ, ধৃতরাষ্ট্র ‘সুহৃদদ্দ্যূত’ বা বন্ধুভাবে খেলার জন্য যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান করছেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু সরলপ্রাণ যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে খানিকটা চিনলেও ধৃতরাষ্ট্রকে মোটেই চেনেননি। খেলার দিন যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের সভায় প্রবেশ করে রীতিমতো ভয় পেয়েছেন। বার বার তিনি বলেছেন—এই খেলায় শঠতা করো না, শকুনি! অন্যায় করো না। কিন্তু শকুনির কথার চালে হেরে গিয়ে যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন।