॥ ৭ ॥
যদিও এই সমস্ত পক্ষপাতটাই এখনও পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্রের অবচেতনে ছিল। কারণ দুর্যোধন যে কাণ্ডটি করেছেন, সেটা তাঁর কর্ণগোচর হয়নি। ধৃতরাষ্ট্র আপাতত বরং কৌরব-পাণ্ডবদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে আছেন। ছেলেরা দিনরাত খেলে বেড়াচ্ছে দেখে তাঁর ভাল লাগছে না মোটেই—কুমারান্ ক্রীড়মানাংস্তান্ দৃষ্ট্বা রাজাতিদুর্মদান্। তিনি তাঁদের উপযুক্ত শিক্ষার জন্য ভর্তি করে দিলেন গৌতম-গোত্রীয় কৃপাচার্যের অস্ত্রপাঠশালায়। তবে কৃপাচার্যের কাছে কিছুদিন শিক্ষা হবার পরেই দ্রোণাচার্য হস্তিনায় এসে উপস্থিত হওয়ায় কৌরব-পাণ্ডদের আসল শিক্ষা আরম্ভ হল তখনই।
এই সম্পূর্ণ অস্ত্রশিক্ষার সময়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা নেই। এই সম্পূর্ণ সময়ের মধ্যে তিনি নিজ পুত্রদের শিক্ষা নিয়ে কোনও আত্মঘাতী ব্যবহার করেননি। এমনকী দ্রোণাচার্য যখন অস্ত্রপরীক্ষার আয়োজন করলেন সেই সময়েও তাঁর এই সমদর্শিতা ছিল যে, কৌরব এবং পাণ্ডবরা নিজেদের শক্তিবুদ্ধি অনুযায়ী যথাসম্ভব অস্ত্রশিক্ষা লাভ করুক। অস্ত্রপরীক্ষার দিনে তাঁর দুঃখ ছিল অফুরান। দ্রোণাচার্যের কাছে তিনি আপন দুর্ভাগ্যের কথা ব্যক্ত করে বলেছেন—যারা চোখে দেখতে পায়, তারা আজকে এই কুরুবাড়ির কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার সমস্ত কৌশল দেখতে পাবে। আমি অন্ধ বটে, কিন্তু আজকে আমার দৃষ্টি ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে, আচার্য—স্পৃহয়াম্যদ্য নির্বোদাৎ পুরুষাণাং সচক্ষুষাম্।
কুমারদের অস্ত্রপরীক্ষার সময় ভীম এবং দুর্যোধনের মতো প্রিয় পুত্রের তুল্যবল গদাযুদ্ধের বিবরণ তিনি শ্রবণ করেছেন, কিন্তু তবু পক্ষপাতের দৃষ্টিতে কোনও মন্তব্য করেননি। এমনকী অর্জুনের অপূর্ব অস্ত্রকৌশল যখন তাঁর কাছে অনুপুঙ্খভাবে বিবৃত হচ্ছিল, তখনও ধৃতরাষ্ট্র কোনও ঈর্ষাচিহ্ন প্রকট করেননি। অস্ত্রবিদ, ধনুর্বিদ হিসেবে দ্রোণশিষ্য অর্জুনের এতটাই সুনাম হয়েছিল যে, রঙ্গস্থলে অস্ত্রকৌশল দেখাবার জন্যে তিনি উঠে দাঁড়াতেই সর্বত্র শোরগোল উঠল। ধৃতরাষ্ট্র কোন অজানা আশঙ্কায় বলে উঠেছিলেন, কী হল, বিদুর। এমন আকাশ ফাটানো চিৎকার কীসের—ভিন্দন্নিব নভস্তলং…কিমেষ সুমহাস্বনঃ? বিদুর বললেন—পাণ্ডব অর্জুন বর্ম পরে রঙ্গস্থলে এসেছেন, তাই এই শব্দ। ধৃতরাষ্ট্র ভারী খুশি হলেন যেন। বললেন—কুন্তীর গর্ভজাত এই তিনটি পাণ্ডব-অগ্নির দ্বারা আমি আজকে ধন্য। আমি এদের জন্য পরম সম্মানিত এবং সুরক্ষিত বোধ করছি।
বৈদিক যজ্ঞে পবিত্র যজ্ঞকাষ্ঠ বা অরণি মন্থন করে তিন রকমের পবিত্র অগ্নি উৎপাদন করতেন ঋষিরা। এই অগ্নি তিনটির নাম গাৰ্হপত্য অগ্নি, দক্ষিণাগ্নি এবং আহবনীয় অগ্নি। এই তিন অগ্নির দ্বারাই সে কালের সমস্ত গৃহকর্ম এবং শ্রোতকর্ম সম্পন্ন হত। উপনিষদ এবং বিশেষত মহাভারতে বিবাহজ পুত্রকন্যার সঙ্গে অরণিকাষ্ঠজাত অগ্নির তুলনা বার বারই আমরা দেখতে পেয়েছি এবং সব সময়েই সেটা পুত্রকন্যার মাহাত্ম্য সূচনা করেছে। ধৃতরাষ্ট্র সেই বৈদিক মাহাত্ম্য জুড়ে দিলেন তিন পাণ্ডব ভাইদের নিজস্ব মাহাত্ম্যের সঙ্গে, যদিও আমরা জানি না—এটা সম্পূর্ণই তাঁর বিশ্বাস বা শ্রদ্ধাবৃত্তির অঙ্গ কি না।
রঙ্গস্থলে অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে কর্ণের উপস্থিতি কুরুকুলের সকলকেই বিব্রত করেছিল। দুর্যোধন তাঁকে সামনে দেখামাত্রই স্বাগত জানিয়েছিলেন, কিন্তু কর্ণকে নিয়ে যত কথা হয়েছে, কৌরব-ভাই এবং পাণ্ডব-ভাইদের মধ্যে যত বাদপ্রতিবাদ হয়েছে এবং শেষাশেষি দুর্যোধন যখন কর্ণকে অঙ্গরাজ্য দান করে তাঁর মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিলেন, তখন পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্রের মুখ দিয়ে একটি কথাও কিন্তু শোনা যায়নি। কোনও সন্দেহ নেই—কর্ণের প্রতি কৃপাচার্য বা পাণ্ডবদের অন্যায়, অযথা আক্ষেপগুলি মোটেই যুক্তিপূর্ণ ছিল না, কিন্তু অন্যদিকে কর্ণের প্রতি দুর্যোধনের সোচ্চার সমর্থন এবং রাজ্যদান নৈতিক দিক দিয়ে যতই গৌরবজনক হোক, এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার মধ্যে কর্ণের জন্য দুর্যোধনের মর্যাদাবোধ যত না ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল পাণ্ডবদের প্রতি বিরুদ্ধতা। আর ঠিক এই জায়গাটাতেই ধৃতরাষ্ট্রের নিশ্চল নিশ্চুপ ব্যবহার আমাদের মনে সংশয়ের সৃষ্টি করে। ছোট ভাইয়ের পুত্রগুলির জন্য তাঁর হৃদয়ে যদি কোনও মায়া বা মমত্ববোধ থাকত, তা হলে জ্ঞাতিভাইদের মধ্যে কর্ণকে নিয়ে যে উদগ্র বিরুদ্ধতার সৃষ্টি হল, সেটা তিনি সানন্দ নৈঃশব্দে মেনে নিতেন না।
কর্ণ অর্জুনকে যথেষ্ট অপমান করতে পেরেছেন বলেই দুর্যোধন কর্ণের মর্যাদা রক্ষায় ব্যস্ত হয়েছেন। অর্থাৎ পাণ্ডব-বিরোধিতা থেকেই তাঁর কর্ণের প্রতি ভালবাসা জন্মেছে। কিন্তু সেই ভালবাসায় এক বহিরাগত এবং অপরিচিত ব্যক্তিকে দুর্যোধন রাজ্যদান করে ফেললেন—এটা নিঃসন্দেহে বাড়াবাড়ি ছিল কি না জানি না, কিন্তু দুর্যোধনের এই স্বাধীনতায় কোনও হস্তক্ষেপ করেননি ধৃতরাষ্ট্র। মনে রাখতে হবে, তখনও পর্যন্ত পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরের এককণা জমিও পাননি, সেই অবস্থায় কর্ণের জন্য দুর্যোধনের ওই অতুলনীয় সমব্যথা যে রাজবাড়ির অর্ন্তদ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করবে, সে সম্বন্ধে ধৃতরাষ্ট্রের ধারণা যথেষ্ট ছিল, কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে মুখর হওয়ার চেয়ে স্বেচ্ছাকৃত নৈঃশব্দ্য বেশি পছন্দ করেছেন। হয়তো এই নৈঃশব্দ্যের মধ্যেও এক পক্ষপাতী মুখরতা আছে, যা কিছু দিন পরেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
রাজকুমারদের অস্ত্রপরীক্ষা হয়ে যাবার পর দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা চাইলেন। টাকা পয়সা নয়, ভূসম্পত্তি নয়, দ্রোণাচার্য পাঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবিত ধরে আনতে বললেন। কৌরব ভাইরা কর্ণের সহযোগিতা নিয়েও এ কাজ করতে পারলেন না। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ভীমের সহযোগিতায় দ্রুপদকে ধরে আনলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। অর্জুনের বীরত্ব প্রকাশিত হল পুরোমাত্রায়। এরপর কুরুবাড়ির বৃদ্ধদের চাপেই হোক অথবা স্বেচ্ছায়ই তোক মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করলেন। যুধিষ্ঠিরের নিজস্ব গুণ এত বেশি ছিল যে, তাঁর পক্ষে মানুষের মন পাওয়াটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের যৌবরাজ্যের সুযোগ নিয়ে পাণ্ডবরা নিজেদের শক্তিমত্তা আরও একটু বাড়িয়ে নিলেন। বিশেষত অর্জুন হস্তিনাপুরের রাজ্যসীমা বাড়ানোর জন্য যুদ্ধযাত্রায় বেরিয়ে বহু রাজ্য জয় করে রাশি রাশি ধন পৌঁছে দিলেন হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে। পাণ্ডু বেঁচে থাকতে যেসব রাজ্য জয় করতে পারেননি, সেগুলোও অর্জুন জয় করে আসার ফলে সমস্ত পাণ্ডব-ভাইয়েরই গুরুত্ব বেড়ে গেল হস্তিনানগরীতে—পররাষ্ট্ৰানি নির্জিত্য স্বরাষ্ট্রং ববৃধুঃ পুরা।
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের রাজা হয়ে আছেন, পাণ্ডবরা সেই রাষ্ট্রেরই সমৃদ্ধি ঘটিয়েছেন বলে ধৃতরাষ্ট্রের খুশি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পুর-জনপদবাসীরা যেহেতু অর্জুন-যুধিষ্ঠিরের গুণগানে মুখর হয়ে উঠছিল, এবং যেহেতু রাজবাড়ির ভিতরেই ভীষ্ম-বিদুরের মতো মানুষেরা পাণ্ডবদের সদা সর্বদা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাই ধৃতরাষ্ট্রের মানসিক জটিলতা বৃদ্ধি পেল। পাণ্ডবদের জনপ্রিয়তা তাঁকে এতটাই আকুল করে তুলল যে, এতদিন পাণ্ডবদের প্রতি কোনও সদাচরণ না করেও যে মৌখিকতার আড়ম্বরটুকু করে যাচ্ছিলেন তিনি, সেটাও আর তিনি ধরে রাখতে পারলেন না। হঠাৎ করেই যেন পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর চরম বিদ্বেষ জেগে উঠল মনে—দুষিতো সহসা ভাবো ধৃতরাষ্ট্রস্য পাণ্ডুষু। প্রাণপ্রিয় পুত্র দুর্যোধনকে কোনওমতেই যেহেতু জনপ্রিয়তার কোনও প্রকোষ্ঠেই স্থাপন করা যাচ্ছে না—এই দুর্বিপাক তাঁকে অস্থির করে তুলল। তিনি এখন রাত্রে আর ঘুমোতে পারেন না ভাল করে। রাজবাড়িতে কেউ বুঝবে না, পৌর-জনপদবাসীরা আন্দাজ করতে পারবে না, অথচ নিশ্চুপে পাণ্ডবদের মাহাত্ম্য খাটো করে দেওয়া যাবে—এই কৌশল ভাবতে ভাবতে এখন তাঁর সুপ্তিহীন রাত্রি প্রভাত হয়ে যায়—স চিন্তাপরমো রাজা ন নিদ্ৰামলভন্নিশি।
ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভায় অসাধারণ রাজনীতিজ্ঞ এক মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর নাম কণিক। পণ্ডিতেরা কেউ কেউ তাঁকে কণিক-ভরদ্বাজ বলেও ডাকেন। ধৃতরাষ্ট্র এই মন্ত্রিপ্রবরকে ডেকে পাঠালেন নিজের বাড়িতে। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন, ভীষ্মের সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন—এঁরাও কেউ কম রাজনীতিজ্ঞ ছিলেন না—কিন্তু কণিক ছিলেন নিরপেক্ষ রাজনীতিবিদ। রাজনীতির ‘থিয়োরি’ তাঁর খুব ভাল জানা আছে, রাজা যাকে পছন্দ করছেন না—সে বন্ধু হোক, শত্রু হোক—কীভাবে তাকে শায়েস্তা করতে হবে—সেটা তিনি খুব সুন্দর বাতলে দিতে পারেন। ধৃতরাষ্ট্র বুঝেছিলেন—এঁকে তিনি মনের ব্যথা জানিয়ে ব্যথার ওষুধ চাইতে পারবেন, ভীষ্ম-বিদুরের কাছে তিনি তা পারবেন না, অতএব নিজের জটিল বুদ্ধি সম্পূর্ণ সমর্থিত হবে বুঝেই তিনি কূটবুদ্ধি ভরদ্বাজ কণিককে ডেকে পাঠালেন আপন প্রকোষ্ঠে—তত আহূয় মন্ত্রজ্ঞং রাজশাস্ত্রার্থবিত্তমম্।
চিকিৎসকের কাছে যেমন রোগের কথা খুলে বলতে হয়, তেমনই কণিকের কাছেও ধৃতরাষ্ট্র প্রাণ খুলে বললেন—পাণ্ডবদের বাড়-বাড়ন্ত তো খুব হল। তাদের কীর্তিকাহিনী তো সবার মুখে মুখে। এদের অবস্থা দেখে আমি আর সহ্য করতে পারছি না, ঈর্ষায় আমার গা জ্বলে যাচ্ছে—উৎসিক্তাঃ পাণ্ডবা নিত্যং তেভ্যো’সূয়ে দ্বিজোত্তম। এদের সঙ্গে মানিয়ে গুনিয়ে থাকব, নাকি ঝগড়াবিবাদ করব—এ বিষয়ে কিছু ভাবতেই হবে। কণিক! তুমি বরং বলো, তোমার শাস্ত্র এবং বুদ্ধি কী বলে, আমি তোমার কথা শুনব—করিষ্যে বচনং তব।
ধৃতরাষ্ট্রের আগ্রহ দেখে কণিক যত উপদেশ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তা কণিকনীতি নামে বিখ্যাত হয়েছে। কণিকনীতির প্রধান বিশেষত্ব এই যে, দরকার হলে রাজা তাঁর আপন সমৃদ্ধির জন্য যে কোনও অসুদপায়ও অবলম্বন করতে পারেন। কণিক ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন—যে পর্যন্ত সুযোগ না আসে, দরকার হলে ততদিন শত্রুকে ঘাড়ে করে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে—বহেদমিত্রং স্কন্ধেন। কিন্তু সুযোগ এলে পাথরের ওপর আছাড় মেরে যেমন কলসি ভাঙে, তেমনি করে শত্রুর মাথা ফাটিয়ে দেবে—ভিন্দ্যাদ্ ঘটম্ ইবাশ্মনি। কণিকের কথা ধৃতরাষ্ট্রের বেশ পছন্দ হল। তিনি আরও জিজ্ঞাসা করলেন, যে, ঠান্ডা মাথায় কী করে শত্রু শাসন করা যায়। এর উত্তরে কণিক এমন সব কূটবুদ্ধির গল্প শোনালেন, যা অন্য কেউ হলে দ্বিতীয়বার অন্তত ভাবতেন। কণিক বলেছিলেন—‘তোমার কোনও ক্ষতি করব না।’ এইরকম প্রতিজ্ঞা করেই হোক, সাময়িকভাবে কিছু দান করেই হোক, অথবা দরকারে বিষ খাইয়েই হোক, সুকৌশলে শত্রুকে হত্যা করতে হবে। কণিকের মতে—হত্যার মতো সাংঘাতিক কাজ করতে হলে মুখে রাখতে হবে হাসি, কিন্তু মনটাকে রাখতে হবে ক্ষুরের মতো—বাচা ভৃশং বিনীতঃ স্যাদ্ হৃদয়েন তথা ক্ষুরঃ।
কণিকের শেষ কথা হল—আপনি যদি নিজের ছেলেদের চেয়ে পাণ্ডবদের বেশি বলশালী মনে করেন, তবে সেই ব্যবস্থা করুন, যাতে আপনার আর কোনও ভয় না থাকে—যথা ভয়ং ন পাণ্ডুভ্যস্তথা কুরু নরাধিপ। কণিক উপদেশ দিয়ে বাড়ি গেলেন, ধৃতরাষ্ট্রও চিন্তা করতে আরম্ভ করলেন—কীভাবে পাণ্ডবদের ঠেকানো যায়। এদিকে আরও একটি ঘটনা ঘটে গেল। হস্তিনাপুরের পুরবাসী এবং জনপদবাসীরা হাটেমাঠে, সভাসমিতিতে সর্বত্র যুধিষ্ঠিরের প্রশংসা করে বেড়াচ্ছিল। নানা জায়গায় তারা এই মতও ব্যক্ত করল যে, যুধিষ্ঠিরকেই হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে বসানো উচিত। মুশকিল হল—এই কথাগুলি দুর্যোধন দুঃশাসনদেরও কানে গেল। তাঁরা হিংসায় জ্বলতে লাগলেন, এসব কথা তাঁরা সহ্য করতে পারলেন না—ঈর্ষ্যয়া চাপি সন্তপ্তো তেষাং বাচো ন চক্ষমে।
সেদিন ধৃতরাষ্ট্র একা একাই বসেছিলেন নিজের ঘরে ব্যাকুল, চিন্তান্বিত। সেই সময়ে দুর্যোধন এসে উপস্থিত হলেন তাঁর কাছে। দুর্যোধন বললেন—পিতা! পুরবাসীরা আমাদের সম্বন্ধে যা-তা বলছে, সে সব আমি নিজের কানে শুনেছি—শ্রুতা মে জল্পতাং তাত পৌরাণামশিবা গিরঃ। তারা আপনাকে এবং পিতামহ ভীষ্মকে অগ্রাহ্য করে পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে রাজা বানাতে চাইছে।
দুর্যোধন দেখাতে চাইছেন যেন পিতার মর্যাদাহানিতে তিনি বিরক্ত। পিতার হৃদয়ের ক্ষত তিনি জানেন, অতএব সেই ক্ষতে ক্ষার নিক্ষেপ করে তিনি বললেন—আপনি তো জন্মান্ধ বলে নিজের প্রাপ্য রাজ্যই পাননি। এখন যদি পাণ্ডুর ছেলেই উত্তরাধিকার সূত্রে পাণ্ডুর রাজ্য পায়, তবে তারপরে তারই ছেলে আবার রাজ্য পাবে, তারপর তার ছেলে, তারপর আবার তার ছেলে—তস্য পুত্রো ধ্রুবং প্রাপ্তস্তস্য তস্যাপি চাপরঃ। এইভাবে যদি চলতে থাকে তা হলে এই রাজবংশে জন্মেও আমরা চিরকাল রাজ্য থেকে বঞ্চিত থাকব, আমাদের ছেলেপিলেরাও কোনওদিন আর রাজ্যসুখ পাবে না—তে বয়ং রাজবংশেন হীনাঃ সহ সুতৈরপি।
দুর্যোধন খুব করুণ ভাষায় নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনকে আরও করুণ করে তুলে বললেন—চিরকাল লোকে আমাদের অবজ্ঞা করবে, উপেক্ষা করবে। অতএব মহারাজ! যাতে আমাদের পরের ভাত খেয়ে জীবনধারণ করতে না হয়, আপনি তার ব্যবস্থা করুন—ন ভবেম রাজন্…পরপিণ্ডোপজীবিনঃ। দুর্যোধনের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের পিতৃহৃদয় একেবারে মথিত হয়ে উঠল। দুর্যোধন তাঁকে বুদ্ধি দিলেন—পাণ্ডবরা যাতে আমাদের কিচ্ছুটি করতে না পারে, সে জন্য তাদের নির্বাসিত করুন বারণাবতে—তান্ বিবাসয়তাং ভবান্।
পুত্রের কথা ধৃতরাষ্ট্রের ভাল লাগল বটে, কিন্তু পৌর-জানপদগণের ইচ্ছা এবং হস্তিনাপুরের পূর্বপুষ্ট মন্ত্রী অমাত্যদের নিয়ে তাঁর ভয় ছিল। তিনি অন্ধ হলেও রাজনীতি যথেষ্ট বোঝেন। সেই রাজনৈতিক সমস্যার কথা চিন্তা করেই তিনি বললেন—পাণ্ডু রাজা হিসেবে যথেষ্ট ভাল ছিলেন। সমস্ত জ্ঞাতিবর্গকে যেমন তিনি সন্তুষ্ট রেখেছিলেন, তেমনই আমার ব্যাপারে তাঁর ন্যায় বা কর্তব্যনিষ্ঠার কথা ভাবা যায় না। রাজ্যটাও তিনি আমার হাতেই সবসময় দিয়ে রাখতেন—নিবেদয়তি নিত্যং হি মম রাজ্যং ধৃতব্রতঃ।
আমরা আগে বলেছি—ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যাকাঙক্ষা এতটাই বেশি ছিল যে, পাণ্ডু সেটা খুব ভালই বুঝতে পারতেন। সেইজন্যই পাণ্ডু তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় রাজ্যের বাইরে বাইরে থাকার চেষ্টা করেছেন। শেষের দিকে তিনি বনবাসী হয়েছেন এবং আর রাজ্যে ফিরেও আসেননি। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর এই সৌজন্যটুকু স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন, কিন্তু এও তিনি মনে মনে জানেন যে, পাণ্ডুর এই সৌজন্য, অন্ধ বড় ভাইটির জন্য তাঁর এই মমতা এবং ত্যাগ পৌর-জানপদের মনে পাণ্ডুর সম্বন্ধে আরও গভীরতর শ্রদ্ধা তৈরি করেছে। অন্যদিকে পাণ্ডু রাজা থাকাকালীনই অপরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করায় যুবরাজ যুধিষ্ঠিরের পালে করুণা এবং সমব্যথার হাওয়া লেগেছিল। পুর-জনপদবাসীরা যুধিষ্ঠিরের অসাধারণ গুণে যেমন মুগ্ধ ছিলেন, তেমনই পাণ্ডুর মৃত্যুজনিত সমবেদনা যুধিষ্ঠিরকে আরও প্রিয় করে তুলেছিল তাদের কাছে। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ মন্ত্রী-অমাত্য, সেনাপতি এবং সৈন্যসামন্তরাও যুধিষ্ঠিরের সংস্পর্শে এসে তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েছেন।
ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনাপুরের অন্তঃরাষ্ট্রীয় রাজনীতির এই বৈশিষ্ট্যটুকু দুর্যোধনকে বুঝিয়ে দিয়ে বললেন—এই অবস্থায় কী করে পাণ্ডুপুত্রদের জোর করে তাদের পৈতৃক রাজ্য থেকে নির্বাসিত করি—স কথং শক্যতে’স্মাভি রপাকর্তুং বলাদিতঃ। বিশেষত মন্ত্রী, অমাত্য, জনপদবাসীরা যুধিষ্ঠিরের প্রতি এই অপকারের প্রতিশোধ নেবার জন্য আমাদের যে মেরেই ফেলবে না, তারই কী কারণ আছে—কথং যুধিষ্ঠিরস্যার্থে ন নো হন্যুঃ সবান্ধবান্?
বস্তুত ধৃতরাষ্ট্রের মনের মধ্যে যুক্তিবুদ্ধি, শুভশক্তি যে একেবারেই ক্রিয়া করে না, তা মোটেই নয়। করে, খুবই করে; কিন্তু সেই যুক্তি ততক্ষণই কাজ করে যতক্ষণ তাঁর প্রিয় পুত্রটি ক্লিষ্টবোধ না করছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে দুর্যোধন ক্লিষ্টবোধ করবেন অথবা কষ্ট পাবেন, তখনই এইসব যুক্তি তিনি দেন—এবং মনে রাখবেন—এইসব যুক্তি তিনি দুর্যোধনের প্রতিপক্ষতার জন্য দেন না। দেন পূর্বপক্ষতার জন্য। অর্থাৎ একটা কাজ করতে গেলে, বিশেষত সেটা যদি পাণ্ডবদের অপকার-সাধনের উপায় হয়, তবে সেই কাজের অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করার জন্যই তিনি এই পূর্বপক্ষগুলি সাজিয়ে দেন, যাতে দুর্যোধন কোনও বিপদে না পড়েন। তার মানে দুর্যোধন ক্রোধের বশে মাথা গরম করে যে কাজটা করতে চান, ধৃতরাষ্ট্র তার অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা করেন ঠান্ডা মাথায়।
পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসন দেবার ব্যাপারে মন্ত্রী-অমাত্য এবং পৌর-জনপদবাসীর সম্ভাব্য বিরুদ্ধতার যে প্রসঙ্গটি ধৃতরাষ্ট্র তুলেছিলেন, দুর্যোধন সেটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন—এসব সমস্যা আছে জেনেই আমি প্রচুর টাকাপয়সা ছড়িয়ে ধনেমানে প্রজাদের তুষ্ট করে ফেলেছি—প্রকৃতয়ঃ সর্বে অর্থমানেন পূজিতাঃ। মন্ত্রীদেরও আমি হাত করে নিয়েছি, রাজকোষও এখন আমারই অধীনে—অর্থবর্গঃ সহামাত্যো মৎসংস্থো’দ্য মহীপতে। অতএব আপনি ঠান্ডা মাথায় কোমল-হাস্য মুখে পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসিত করুন। এরপর সম্পূর্ণ রাজ্যে যখন আমার প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হবে, সেইদিন পাণ্ডবরা কুন্তীর সঙ্গে এখানে ফিরে আসুক, আমার আপত্তি নেই।
ধৃতরাষ্ট্র যেই বুঝলেন—সম্ভাব্য বাধা দূর হয়ে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের হৃদয় উন্মুক্ত করে দিয়ে বললেন—পাণ্ডবদের এখান থেকে তাড়িয়ে দিই, এটা আমারও মনের ভিতরকার ইচ্ছে। কিন্তু যেহেতু ব্যাপারটা বাইরে থেকে খুব খারাপ দেখায়, তাই বাইরে প্রকাশ করিনি—দুর্যোধন মমাপ্যেতদ্ হৃদি সম্পরিবর্ততে। ধৃতরাষ্ট্র নিজের দুষ্টবুদ্ধি একবারমাত্র প্রকাশ করেই আবার পুত্রের হিতসাধনে মন দিচ্ছেন। তিনি এবার রাজবাড়ির ভিতরকার বলাবল বিবেচনা করছেন। নির্বাসন কথাটা নিশ্চয়ই উচ্চারিত হবে না, কিন্তু হঠাৎ করে পাণ্ডবদের অন্যত্র সরিয়ে দিলে রাজবাড়ির ভিতরে কী প্রতিক্রিয়া হবে, ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপ—এঁরা ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখবেন, কে কোন পক্ষ নেবেন—সেসব কথাও প্রতিযুক্তি হিসেবে দুর্যোধনের সামনে পেশ করলেন ধৃতরাষ্ট্র। দুর্যোধন সে রাজনীতি সরল করে বুঝিয়ে দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। বুঝিয়ে দিলেন—ভীষ্মের কাছে পাণ্ডব এবং কৌরব-দু’পক্ষই সমান। পাণ্ডবরা বিপন্ন হলে তিনি অন্তত কৌরবদের ক্ষতি করবেন না। অন্যদিকে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা দুর্যোধনের পক্ষে থাকায় দ্রোণ তাঁরই পক্ষে আসবেন, আর দ্রোণ যে পক্ষে থাকবেন সেই পক্ষেই থাকবেন কৃপ, কারণ তিনি দ্রোণের শ্যালক। বাকি রইলেন শুধু বিদুর। দুর্যোধন বললেন—বিদুর একা আমাদের কোনও ক্ষতিই করতে পারবেন না, অতএব আপনি নিশ্চিন্তে আজকেই পাণ্ডবদের সমাতৃক বারণাবতে নির্বাসনের ব্যবস্থা করুন—বারণাবতম্ অদ্যৈব যথা যান্তি তথা কুরু। হৃদয়ে যে আগুন জ্বলছে, সে আগুন নিভিয়ে দিন একেবারে।
দুর্যোধনের কথায় সম্পূর্ণ আশ্বস্ত হলেন ধৃতরাষ্ট্র। অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও কী ঠান্ডা মাথায় কত নিপুণ কৌশলে তিনি পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসন দেবার ব্যবস্থা করেছেন, তা ভাবলে তাঁকে সর্বকালের অন্যতম কূটবুদ্ধিসম্পন্ন রাজা বলেই মানতে হয়। দুর্যোধন যেমনটি ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন, তেমনটিই করলেন। নিজে এবং ভাইয়েরা মিলে খুব করে টাকাপয়সা বিতরণ করলেন প্রজাদের মধ্যে। তারা এই অহেতুক বদান্যতায় দুর্যোধনকে ধন্য ধন্য করতে লাগল। এদিকে ধৃতরাষ্ট্র এক অদ্ভুত কৌশল করলেন। তাঁর মন্ত্রীমণ্ডলীর মধ্যে যাঁরা ভাল কথা বলতে পারেন, ভাল বর্ণনা করতে পারেন, তাঁদের দু-একজনকে তিনি নিযুক্ত করলেন একটি বিশেষ কাজে। তাঁদের কাজ হল—পাণ্ডবদের কাছে বারণাবতের রম্যতা বর্ণনা করা। জায়গাটা কত সুন্দর, কত উদার অরণ্যশোভায় পরিপূর্ণ, সেখানে থাকতে কত ভাল লাগে—এগুলি তাঁরা পাণ্ডবদের সামনে খুব করে বর্ণনা করলেন—কথায়াঞ্চক্রিরে রম্যং নগরং বারণাবতম্।
একটা সুন্দর জায়গার কথা শুনলে আমাদের মন যেমন যাই যাই হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনই পাণ্ডবরা বারণাবতে যাবার জন্য উন্মুখ হয়ে উঠলেন। তারমধ্যে একেকটা জায়গার প্রাকৃতিক শোভার সঙ্গে যদি আবার সেখানকার স্থানীয় উৎসব এবং পর্বের কথা শুনি, তা হলে যেমন জায়গার মাহাত্ম্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়, এখানেও তেমনই হল। বর্ণনা-নিপুণ মন্ত্রীরা বলল—বারণাবতে ঐশ্বর্যের কোনও অভাবই নেই এমনিতে, তারমধ্যে সেখানে আবার ভগবান মহাদেবের মহোৎসব উপলক্ষে বিরাট মেলা হবে। মানুষজনে ভরে উঠবে এই রমণীয় প্রদেশ—অয়ং সমাজঃ সুমহান্ রমণীয়তমো ভুবি।
ধৃতরাষ্ট্র যেমন যেমন বলে দিয়েছিলেন, ঠিক সেইভাবেই তাঁর মন্ত্রীরা বারণাবতের শোভা এবং সরসতা বর্ণনা করল—ইত্যেবং ধৃতরাষ্ট্রস্য বচনাচ্চক্রিরে কথাঃ। ছোটবেলায় শতশৃঙ্গ পর্বতের পাহাড়ি এলাকায় মানুষ হয়েছেন পাণ্ডবরা, নতুন জায়গার কথা শুনে একবার একটু মুক্তি পাবার সাধ জাগল তাঁদের মনে। বেশ ইচ্ছে হল একবার ঘুরে আসবেন বারণাবতে—গমনে পাণ্ডুপুত্ৰাণাং জজ্ঞে তত্র মতি-র্নৃপ। এদিক ওদিক পাণ্ডবদের কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র বুঝলেন—বারণাবতে যাবার জন্য পাণ্ডবদের বেশ ইচ্ছে হয়েছে মনে। নিজের কৌশল পরিপক্ক হয়েছে বুঝেই ধৃতরাষ্ট্র এবার পাণ্ডবদের ডেকে বললেন—এই লোকগুলো খালি খালি আমাকে বলে—বারণাবতের মতো সুন্দর জায়গা নাকি আর হয় না—মমৈতে পুরুষা নিত্যং কথয়ন্তি পুনঃ পুনঃ। আরে আমি অন্ধ মানুষ আমি গিয়েই বা কী করব, দেখব কী? তা ওরা এত ভাল বলছে, তোমাদের যদি তেমন ইচ্ছে হয় তো ঘুরে এস একবার। লোকজন যেমন দরকার নিয়ে যাও, দানধ্যান করার জন্য ধনরত্নও নিয়ে যাও যা লাগে—প্রযচ্ছধ্বং যথাকামং দেবা ইব সুবৰ্চসঃ। সেখানে কিছুদিন থেকে আমোদপ্রমোদ করে, তারপর না হয় ফিরে এস হস্তিনাপুরে—কঞ্চিৎ কালং বিহৃত্যৈবম্ অনুভয় পরাং সুখম্।
সমস্ত পাণ্ডব-ভাইদের উদ্দেশে এই কথাগুলি বলা হলেও সিদ্ধান্ত নেবার ভার থাকে যুধিষ্ঠিরের ওপরেই। তিনি খুব ভাল করে বুঝতে পারলেন না—ধৃতরাষ্ট্র ঠিক কী চাইছেন। যুধিষ্ঠির এটা বুঝলেন যে, তাঁদের বারণাবতে যাওয়াটা ধৃতরাষ্ট্র খুব চাইছেন, কিন্তু এই চাওয়ার মধ্যে যেন একটা ইচ্ছাকৃত জোর আছে। আর ঠিক এই জায়গাতেই তাঁর যেন কেমন সন্দেহ হল। তিনি খুব অসহায় বোধ করতে আরম্ভ করলেন, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের অতিরিক্ত সদিচ্ছা, যাকে কথ্য বাংলায় ‘ভাল্ভালাই’ বলে তাই দেখে যুধিষ্ঠির তাঁকে মুখের ওপর ‘না’ও বলতে পারলেন না—আত্মনশ্চাসহায়ত্বং তথেতি প্রত্যুবাচ তম্৷
বারণাবতে যাবার আগে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃপাচার্য ইত্যাদি মাননীয় ব্যক্তিদের কাছে অনুমতি চাইলেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু বিদায় নেবার সময় তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, নিজের ইচ্ছেতে তিনি বারণাবতে যাচ্ছেন না, যাচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ্ঞায়, তাঁরই ইচ্ছেকে সম্মান দেবার জন্য—সগণাস্তত্র গচ্ছামো ধৃতরাষ্ট্রস্য শাসনাৎ। যুধিষ্ঠির সবার কাছে বিদায় নিয়ে যখন মা-ভাইদের সঙ্গে করে বারণাবতের পথে পা বাড়ালেন, তখন তাঁদের পিছন পিছন প্রজারাও অনেকে চললেন বারণাবতের দিকে। আর তাঁদের সঙ্গে অনুগমন করে চললেন মহামতি বিদুর। হস্তিনাপুরের নির্ভীক ব্রাহ্মণ সমাজের অনেকেই চললেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে।