॥ ৫ ॥
অন্ধ হয়ে জন্মেছিলেন বলেই ধৃতরাষ্ট্রকে রাজপুত্রের শিক্ষা দীক্ষা থেকে মোটেই বঞ্চিত করা হয়নি। ব্রহ্মচারী হয়ে বেদ পাঠ করা থেকে আরম্ভ করে যা যা ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব—মল্লযুদ্ধ, ব্যায়াম, দ্রুত দৌড়োনো—এগুলো তাঁকে শেখানো হল যথেষ্ট করে। ধৃতরাষ্ট্রের শারীরিক বল পাণ্ডুর চেয়েও বেশি অন্যেভ্যো বলবানাসীদ্ ধৃতরাষ্ট্রো মহামতিঃ কিন্তু চক্ষুহীনতার জন্য ধনুর্বেদ বা অন্যান্য চক্ষুঃসাধ্য অস্ত্রবিদ্যা তাঁকে শেখানো গেল না।
ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুর—এই তিন রাজকুমারকেই ভীষ্ম অসীম মমতায় মানুষ করেছিলেন। কিন্তু এবারে সেই সময় এল, যখন এমনই এক সংকট উপস্থিত, যাতে ভীষ্মের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে এক সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। হস্তিনাপুরের সিংহাসনে উপস্থিত কোনও রাজা নেই এবং প্রসিদ্ধ ভরতবংশের উত্তরাধিকারীর জন্যই জননী সত্যবতী অন্য উপায়ে এই তিনটি কুমারকে লাভ করেছেন। কিন্তু উত্তরাধিকারী এবং একটি উপযুক্ত রাজা পাবার জন্য সত্যবতীর তাড়না কতটা ছিল, তা বোঝা যাবে মহামতি ব্যাসের সেই ভবিষ্যৎবাণীর সময়। অম্বিকার সঙ্গে ব্যাসের মিলন সম্পূর্ণ হবার পরেই সত্যবতী তাঁকে বলেছিলেন—কেমন হবে এই পুত্র। ব্যাস বলেছিলেন—এই পুত্র বলবান, ভাগ্যবান সবই হবে কিন্তু এ পুত্র অন্ধ হয়েই জন্মাবে।
সত্যবতী হাহাকার করে ব্যাসকে বলেছিলেন—একটি অন্ধ ছেলে কী করে কুরুবংশের রাজা হবে, বাছা—নান্ধঃ করূণাং নৃপতিরনুরূপস্তপোধন। তুমি দ্বিতীয় একটি পুত্রের জন্ম দাও, যে রাজা হবে এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশের—রাজানং দাতুমর্হসি। ধৃতরাষ্ট্র সেদিন এ কথা শুনতে পাননি অথবা শুনলেও বোঝেননি, কিন্তু ব্রহ্মচর্য বেদবিদ্যা, এবং শারীর শিক্ষার পালা যখন শেষ হল, সেদিন হঠাৎ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের জীবনে আরও এক অদ্ভুত অন্ধকার নেমে এল। চিরকাল তিনি শুনে এসেছেন—বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্ৰই রাজা হন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ পুত্র হওয়া সত্ত্বেও কেউ তাঁকে রাজা হবার কথা বলল না। কোনও প্রতিহারী আকালিক মুহূর্তে এসে তাঁকে জানাল না—রাজপুত্র! রাজসভায় আপনার ডাক পড়েছে। ধৃতরাষ্ট্র যে কিছুই জানতেন না, তা নয়। তিনি বেদ বেদাঙ্গ রাজধর্মের গ্রন্থ অনেক পড়েছেন। রাজধর্মের নীতিনিয়মে বলা আছে—বামন, ক্লীব, পতিত, জন্মান্ধ এবং জন্মবধির ব্যক্তিরা রাজ্যলাভের অধিকারী নন—অনংশৌ ক্লীব-পতিতৌ জাত্যন্ধবধিরৌ তথা।
কেন যে তাঁরা রাজত্বের অধিকারী নন সে সম্বন্ধে শাস্ত্রকারদের নিরপেক্ষ যুক্তি আছে। সত্যিই তো একটি রাজ্যের শাসন সুষ্ঠুভাবে চালাতে হলে যে পরিমাণ সজাগ থাকতে হয়, তাতে সাধারণ অঙ্গবৈকল্যও বাধা সৃষ্টি করে। সেখানে চক্ষুহীনতা একজন রাজার কাছে এতটাই বাস্তব অসুবিধে তৈরি করে, যে পদে পদে তাঁকে মন্ত্রী সেনাপতিদের কাছে পরোক্ষভাবে নিগৃহীত হতে হবে। ধৃতরাষ্ট্র এসব জানেন না, তা নয়। কিন্তু তবু জ্যেষ্ঠপুত্র বলে, অথবা অন্ধ হওয়া সত্ত্বেও বেশ কিছু শারীর শিক্ষা তাঁর হয়েছিল বলে, হয়তো অন্তরের অন্তঃস্থলে এতটুকু আশা ছিল—যদি তিনি রাজা হন! কিন্তু তা হল না। সমাজ এবং রাষ্ট্রের শৃঙ্খলিত নিয়মে কোনও এক পুণ্যপ্রভাতে পাণ্ডু হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে বসলেন। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ বলে সিংহাসনের অধিকার পেলেন না—ধৃতরাষ্ট্রস্ত্বচক্ষুস্ত্বাদ্, রাজ্যং ন প্রত্যপদ্যত।
রাজ্যের জ্যেষ্ঠ পুত্রটি সিংহাসনে বসতে পারলেন না বলে পাণ্ডুরও কোনও সাড়ম্বর অভিষেক সম্পন্ন হল না। দিন চলতে লাগল অন্য দিনগুলির মতোই। অন্ধের জীবনেও তার কোনও ব্যতিক্রম হল না। শুধু অন্তরে এক কূট দীর্ঘশ্বাস তৈরি হল—যে জন্মান্ধ তার অধিকার কী শুধু অন্যের করুণায়?
পাণ্ডুর অভিষেকে তেমন কোনও উৎসব হয়নি বলেই এবং জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের মনে কিছু দুঃখ আছে জেনেই ভীষ্ম নতুন এক উত্তেজনা সৃষ্টি করলেন, যাতে বেশ ভালরকম একটা উৎসবও করা যায় এবং অন্ধ পৌত্রটির মনও যাতে অন্যদিকে চালিত হয়। ভীষ্ম একদিন বিদুরকে ডেকে পরামর্শ আরম্ভ করলেন। রাজপুত্রদের বিয়ের পরামর্শ। বিদুরকে তিনি বললেন—আমাদের এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশ যাতে ফুলে ফেঁপে সাগরের মতো হয়ে ওঠে—তস্যৈতদ্ বর্ধতে ভূয়ঃ কুলং সাগরবদ্ যথা—সেই চিন্তাই এখন করতে হবে। মনে রেখো—আমি, জননী সত্যবর্তী এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এই তিনজন মিলে এই বংশের সুস্থিতি রাখবার যে চেষ্টা করেছি, সে ভার এখন তোমাদের ওপর—সমবস্থাপিতং ভূয়ো যুস্মাসু কুলতন্তুষু।
ভীষ্ম বিদুরকে কয়েকটি কন্যারত্নের খবর দিলেন, যাঁদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্বন্ধ ঘটলে ভরতবংশের পক্ষে অনকূল হবে বলে তিনি মনে করেছেন। আসলে ভরতবংশের পরম্পরা নিয়ে ভীষ্মের মনে এক অদ্ভুত ভয় আছে। মহারাজ শান্তনুর সঙ্গে সত্যবতীর সেই বিবাহের সময় থেকে এই সমস্যা আরম্ভ হয়েছে। তিনি নিজে বিবাহ করতে পারলেন না, চিত্রাঙ্গদ মারা গেলেন, বিচিত্রবীর্য মারা গেলেন। তার বহু সাধ্যসাধনা করে ভরতবংশে যে পুত্রগুলি জন্মাল, তাঁদের মধ্যে একজন অন্ধ, একজন শূদ্রার সন্তান। বাকি রইলেন শুধু পাণ্ডু। তিনিই রাজা হয়েছেন বটে, কিন্তু ভীষ্ম চান তাঁদের বংশধারায় অনেকগুলি পুত্র সন্তান জন্মাক, যাতে ভরতবংশে উত্তরাধিকারের কোনও সমস্যা না হয়।