॥ ৪ ॥
সন্ধ্যার সময় জননী সত্যবতী অম্বিকাকে স্নান করে আসতে বললেন। শুদ্ধ নির্মল বাসখানি পরে অম্বিকা যখন শাশুড়ির কাছে উপস্থিত হলেন, তখন সত্যবতী তাঁকে বললেন—তোমার এক দেবর মিলিত হবেন তোমার সঙ্গে। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে তার জন্য অপেক্ষা কোরো। রাত্রে তিনি তোমার ঘরে আসবেন। অম্বিকা অপেক্ষা করতে লাগলেন। মনে মনে চলতে লাগল নানা জল্পনাকল্পনা। কে হবেন এই দেবরটি? বিচিত্রবীর্যের ছোট ভাই তো কেউ নেই। তবে দেবর শব্দটা হয়তো সংজ্ঞামাত্র। এই মানুষটি ভীষ্মও হতে পারেন। হতে পারেন কুরুবংশের লতাপাতায় জড়ানো বিচিত্রবীর্যের অন্য কোনও ভাই—সাচিন্তয়ৎ তদা ভীষ্মমন্যাংশ্চ কুরুপুঙ্গবান্।
অম্বিকার ঘরে তৈলপূর প্রদীপ জ্বলছিল অনেকগুলি। আর তাঁর ভাবনায় যন্ত্রণার আগুন লাগছিল একটু একটু করে। আকাশপাতাল ভাবনা শেষ হতে-না-হতেই আপন প্রকোষ্ঠের আলোকপ্রভায় মহামতি ব্যাসকে দেখা গেল—তিনি অম্বিকার ঘরে প্রবেশ করছেন। মসীর মতো কালো তাঁর গায়ের রং, মাথায় জটাভার, দীপ্ত চক্ষু জ্বলছে আগুনের ভাটার মতো—তস্য কৃষ্ণস্য কপিলাং জটাং দীপ্তে চ লোচনে। মুখভর্তি পাঁশুটে দাড়ি এক অদৃষ্টপূর্ব বিকট মানুষ দেখে অম্বিকা ভয়ে ত্রাসে চোখ বন্ধ করলেন। নিমীলিত চোখে শয়ানা রাজবধূর সঙ্গে ব্যাসের মিলন সম্পূর্ণ হল সুন্দর রাজপুরুষ বিচিত্রবীর্যের প্রতিস্মৃতিতে।
ব্যাস যতক্ষণ অম্বিকার ঘরে ছিলেন, ততক্ষণ তিনি চক্ষু মুদে রইলেন। মিলন সম্পূর্ণ করে ব্যাস ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ব্যগ্র সত্যবতী ছেলেকে শুধোলেন—সব ঠিক আছে তো? আমরা ভরতবংশের অনুরূপ পুত্র লাভ করব তো, বাবা! ব্যাস যোগেশ্বরের দৃষ্টিতে জননীকে জানালেন—শত সহস্র হাতির শক্তি নিয়ে জন্মাবে এই ছেলে। বিদ্বান হবে, রাজর্ষি হবে। অনেক বুদ্ধি, অনেক শক্তি, সবই থাকবে, মা! কিন্তু ছেলেটি অন্ধ হয়েই জন্মাবে। কী করব? বধূ তোমার সারাক্ষণ চক্ষু মুদেই রইল—কিন্তু মাতুঃ স বৈগুণ্যাদন্ধ এব ভবিষ্যতি।
জননী সত্যবতী প্রমাদ গণলেন। বললেন—কী করে, একটি অন্ধ রাজপুত্র এই প্রসিদ্ধ কুরুবংশের রাজ্যপাট সামলাবে, কী করেই বা এই বিশাল রাজ্য রক্ষা করবে সে? তুমি বাপু দ্বিতীয় একটি পুত্র জন্মের প্রযত্ন গ্রহণ করো, যাতে একটি উপযুক্ত রাজা পাই আমরা।
বাস! ভবিষ্যতে যিনি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে জন্মাবেন, জন্মলগ্নেই তাঁর কপাল থেকে রাজা হবার লিখনটি মুছে গেল অম্বিকার গর্ভের আর্দ্র জলরাশিতে। আমরা বলি—যোগমূর্তি ব্যাসের অলৌকিক ভবিষ্যৎবাণীতে বিশ্বাস নাই করলেন আপনারা। ধরেই নিতে পারেন—শুধুমাত্র চক্ষু নিমীলনের কারণে একটি অন্ধ পুত্রের জন্ম হতে পারে না। একটু আধুনিক দৃষ্টিতে যদি দেখি, তবে ব্যাসের সঙ্গে অম্বিকার মিলনের ঘটনাকে রীতিমতো এক ধর্ষণের ঘটনা বলেই মেনে নেওয়া যেতে পারে। এমন এক ধর্ষণের ঘটনা, যাতে কুরুরাজবধূর শারীরিক মানসিক কোনও সম্মতি ছিল না। আর কে না জানে যে, ধর্ষণের ফলে অনেক সময়েই বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হয়। বস্তুত বিকটরূপী ব্যাসের সেই মিলন-আয়াস সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত এক রমণীর কাছে এতটাই ‘শকিং’ ছিল যে, অম্বিকার গর্ভধারণ সার্থকভাবে সুশ্রী মিলনের পরিণতি লাভ করেনি। আমরা এই ঘটনাকে ধর্ষণ বলছি না, কিন্তু যদি একে অম্বিকার দিক থেকে মানসিক প্রস্তুতিহীন আতঙ্ক-মুহূর্ত বলে মেনে নিই, তবে তারই ফল অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। অম্বিকার গর্ভকাল সম্পূর্ণ হলে অন্ধ হয়ে তিনি জন্মালেন—সাপি কালেন কৌশল্যা সুষুবে’ন্ধং তমাত্মাজম্।
বস্তুত ধৃতরাষ্ট্র নামটা যে তাঁর কেমন করে হল, তাও আমাদের ভাল জানা নেই। নামের সঙ্গে কাজের মিল ঘটে না তাই মানুষের নাম সব সময়েই প্রায় অসার্থক হয়। কিন্তু যিনি যা কাজ করেন, সেই কর্মানুসারে মানুষের নতুন নামকরণও হয়। এই যেমন নেতাজি, দেশবন্ধু ইত্যাদি। ধৃতরাষ্ট্রও সেইরকম কোনও নাম নাকি কে জানে। তিনি কোনও রাজ্যই পেলেন না অথচ তাঁর নাম ধৃতরাষ্ট্র—রাষ্ট্রকে যিনি ধারণ করেছেন। আমাদের ধারণা যদি ভুল না হয়, তা হলে এইভাবে ভাবা যেতে পারে যে, আমরা জানি—ভবিষ্যতে পাণ্ডু যখন রাজ্য ছেড়ে বনে চলে যাবেন, তখন থেকে তাঁর এই অন্ধ দাদাটিই কিন্তু পাণ্ডুর প্রতিভূ হিসেবে রাজ্যশাসন করবেন এবং তা করবেন সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত। তা হলে বোঝা যাচ্ছে হস্তিনার স্বীকৃত রাজা পাণ্ডু যতদিন রাজত্ব করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি রাজ্যশাসন করেছেন তাঁর বড় দাদা। তবুও তিনি রাজা নন, সব সময়েই তাকে অন্যের প্রতিনিধিত্ব করে রাজ্যভার সামলাতে হয়েছে, রাজ্যটাকে কোনওমতে ধারণ করতে হয়েছে। হয়তো এই জন্যই তাঁর নাম ধৃতরাষ্ট্র।