॥ ১২ ॥
সর্বত্র যুদ্ধের বাজনা বেজে উঠল। যুদ্ধ হবেই। দু’পক্ষের হানাহানি আরম্ভ হওয়ার ঠিক আগে ব্যাস এলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। ধৃতরাষ্ট্র চিন্তায় আকুল দেখে ব্যাস বললেন—দুঃখ কোরো না বৎস! কাল পরিপক্ক হয়েছে, ছেলেদের পারস্পরিক হানাহানি অনেক দেখতে হবে। অতএব দুঃখ কোরো না। যদি তুমি এই সংগ্রাম দেখতে চাও তো আমি তোমাকে দিব্য চক্ষু দিতে পারি। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—আমি আর চক্ষু দিয়ে এই জ্ঞাতি-বধ দেখতে চাই না—ন রোচয়ে জ্ঞাতিবধং দ্রষ্টুং রাজর্ষিসত্তমঃ। আপনি এমন ব্যবস্থা করুন, যাতে আমি সব শুনতে পাই ঠিক ঠিক। ব্যাস সঞ্জয়কে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন যুদ্ধের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেবার জন্য। সঞ্জয় দিব্য চক্ষু লাভ করলেন ব্যাসের প্রসাদে এবং ধৃতরাষ্ট্রের কারণেই সঞ্জয়কে আমরা প্রাচীন ভারতবর্ষের প্রথম সার্থক ধারাভাষ্যকার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।
মহামতি ভীষ্মের সেনাপতিত্বে কুরুক্ষেত্রের বিরাট যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ যতই এগোতে থাকল, কৌরবপক্ষের যতই ক্ষতি হতে থাকল, ধৃতরাষ্ট্রের ততই মনে হতে লাগল যে, পুরুষকারের বোধ হয় মূল্য নেই কিছু, সবটাই মানুষের অদৃষ্ট—দিষ্টমেব পরং মন্যে পৌরুষাদিতি মে মতিঃ। ভীষ্ম, দ্রোণের মতো মহাবীর থাকতেও স্বপক্ষের অনুকূল ফল পেতে কেন দেরি হচ্ছে, এটা খুব ভাল করে মেনে নিতে পারছেন না ধৃতরাষ্ট্র। সঞ্জয়ের কাছে তিনি আপন পক্ষের সৈন্যদের ক্ষমতা বর্ণনা করেছেন। কত বেশি টাকা দিয়ে কত অস্ত্রকুশল সৈন্য সংগ্রহ করা হয়েছে, সেসব বিবরণ দিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন—এইরকম বিরাট এক সৈন্যবাহিনী, যা সংখ্যায় এবং গুণে সব চাইতে ভাল, সেই সৈন্যও পাণ্ডবদের হাতে যেভাবে হতাহত হচ্ছে, তাকে অদৃষ্ট ছাড়া আর কী বলব সঞ্জয়! সবকিছুই আমার কাছে একেবারে বিপরীত লাগছে—বিপরীতম্ ইদং সর্বং প্রতিভাতি হি সঞ্জয়।
সঞ্জয় বললেন—দৈবের দোষ নয়, মহারাজ! এ আপনারই দোষ। নিজের দোষেই আপনি এই বিপদ ডেকে এনেছেন—আত্মদোষাস্ত্বায়া রাজন্ প্রাপ্তং ব্যসনমীদৃশম্। আপনার দোষেই পাশাখেলার মতো সাংঘাতিক ব্যাপারটা ঘটেছিল এবং এই যে যুদ্ধ হচ্ছে, সেও আপনার দোষেই। আপনি নিজে যে পাপ করেছেন, তার ফল ভোগ করবেন আপনি নিজে—ত্বমেবাদ্য ফলং ভুঙ্ক্ষ্ব কৃত্বা কিল্বিষমাত্মনা। ধৃতরাষ্ট্র এখন আর সঞ্জয়ের কথাও তেমন করে বুঝতে পারেন না। তাঁর হাত থেকে এখন সব কিছু বেরিয়ে গেছে। একের পর এক সেনাপতি মারা যাচ্ছেন, একের পর এক ছেলেরা মারা যাচ্ছে, আর তিনি শুধু বিলাপ করে যাচ্ছেন, আর দুর্যোধনকে বৃথা দোষ দিয়ে যাচ্ছেন। সঞ্জয় তাঁকে বলেওছেন—দেখুন মহারাজ! বন্যা হয়ে গেলে সেতুর যে অবস্থা হয়, আপনার অবস্থাও ঠিক সেইরকম। শুধুমুধু কেঁদে কী হবে—বিলাপো নিষ্ফলং রাজন্। এত সুযোগ গেছে যুদ্ধ থামাবার, তার একটাও আপনি কাজে লাগাননি, এখন যুদ্ধ আরম্ভ হবার পর আপনি পুত্রদের নানারকম দোষ দিয়ে যাচ্ছেন—যৎ পুনর্যুদ্ধকালে তু পুত্রান্ গর্হয়সে নৃপ। এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।
কী করুণ অবস্থা ধৃতরাষ্ট্রের। শকুনি যখন পাশাখেলার একটি একটি বাজি জিতছিলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্রের মনে কত জয়ের আনন্দ ছিল। প্রত্যেকবার বাচ্চাছেলের মতো জিজ্ঞাসা করছিলেন—এ বাজিটা জিতেছি কি? আর এখন কী বিপরীত অবস্থা। একে একে সব যাচ্ছে, স্বজন, আত্মীয়, প্রিয় পুত্রেরা একে একে। অথচ ধৃতরাষ্ট্র এখন প্রাণ খুলে বিলাপ করে কাঁদারও সুযোগ পাচ্ছেন না। বিলাপ করে কাঁদলেই সঞ্জয় বলেন—সব দোষই তো আপনার, কাঁদবেন না, স্থির হয়ে শুনুন এই যুদ্ধ-কথা—শুশ্রূষস্ব স্থিরো ভূত্বা তব হ্যপনয়ো মহান্।
এইভাবে ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মের মৃত্যুসংবাদ শ্রবণ করলেন। দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বকালেও যখন একের পর এক তাঁর ক্ষতি হচ্ছে, তখন তিনি অনেকটা স্থির হয়েছেন। বুঝতে পারছেন পাশার দান এবার উলটো দিকে পড়ছে। সঞ্জয়কে বলছেন—বলো, সঞ্জয়! বলো। এসব বিশেষ করে আমারই অন্যায়ের ফল ফলছে। তুমি বলো, সঞ্জয়! আমি স্থির হয়ে শুনছি—স্থিরীভূতো’স্মি সঞ্জয়। এরপরে দ্রোণাচার্যও মারা গেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের তবু কিছু স্থিরতা ছিল। কিন্তু কর্ণ যখন মারা গেলেন, ধৃতরাষ্ট্র তখন আর নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। তিনি জানতেন—ভীষ্ম-দ্রোণ নয়, প্রধানত কর্ণের ভরসাতেই যুদ্ধে নেমেছেন দুর্যোধন—যমাশ্ৰিত্য মহাবাহুং…দুর্যোধনো’ করোদ্ বৈরং পাণ্ডুপুত্রৈৰ্মহারথৈঃ।
কর্ণের মৃত্যুতে ধৃতরাষ্ট্র একেবারে ভেঙে পড়লেন। তবু যাও বা তাঁর ক্ষীণ আশা ছিল যে, ভীষ্ম-দ্রোণ যা পারেননি কর্ণ তা করে দেখাবেন। বিশেষত দুর্যোধন তো বটেই, এমনকী কর্ণও মাঝে মাঝে স্বাত্মারোপিত গর্বে ধৃতরাষ্ট্রকে এইরকম বুঝিয়েছিলেন যে, পাণ্ডবদের জয় করা কঠিন হবে না তাঁর পক্ষে। দুর্যোধনের হয়ে কর্ণ পূর্বে যত যুদ্ধ করেছেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্রেরও আশা ছিল যে, শেষ পর্যন্ত জয়টা কর্ণের হাতেই আসবে। কর্ণ মারা গেলে তাই ধৃতরাষ্ট্রের শোক উদ্বেলিত হয়ে উঠল। লক্ষণীয় বিষয় হল, দুর্যোধন ছাড়া ধৃতরাষ্ট্রের অন্যান্য পুত্রেরা এমনকী দুঃশাসনও মারা যান কর্ণেরই সেনাপতিত্বকালে। তবু ধৃতরাষ্ট্র এই আশায় বুক বেঁধে বসেছিলেন যে, কর্ণ শেষ পর্যন্ত কৌরবদের বিজয়কেতন উড্ডীন করে তাঁকে এসে প্রণাম করবেন। কিন্তু হল না, কর্ণও মারা গেলেন। প্রথমে তো অজ্ঞানই হয়ে গিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্র—পপাত জগতীপতিঃ। কিন্তু সংজ্ঞা হওয়ামাত্রই তাঁর বুক চিরে বেরিয়ে এসেছে অনন্ত বিলাপরাশি। শেষে এমনও বলেছেন—জ্ঞাতি-বন্ধু স্বজনদের এমন পরাভব দেখেও আমি ছাড়া আর কোন মানুষ বেঁচে থাকে, সঞ্জয়! বালকরা খেলা করবার বয়সে পাখি ধরে তার ডানাটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়, তারপর পাখিটাকে ছেড়ে দেয়। পাখিটার আর চলবার শক্তি থাকে না। আমারও সেই দশা হয়েছে সঞ্জয়—বিসর্জয়ন্তি সংহৃষ্টা স্তাড্যমানাঃ কুমারকাঃ—আমাকে আমার জ্ঞাতিমিত্রের ডানা ছেঁটে ছেড়ে দিয়েছে ছেলেরা। আমি এখন কী করি, কোন দিকে যাই! এর থেকে আমার বিষ খাওয়াও ভাল ছিল সঞ্জয়, ভাল ছিল আগুনে পুড়ে মরা, জলে ডুবে মরা, অথবা পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া—বিষমগ্নি প্রপাতং বা পর্বতাগ্রাদহং বৃণে। আমি আর এ দুঃখ সইতে পারছি না।
শেষ পর্যন্ত দুর্যোধন, ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয়তম পুত্র দুর্যোধনও ভীমের গদাঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তখন সূর্য অস্ত গেছে, কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরের পথে রওনা দিলেন। প্রিয় পুত্রের ঊরুভঙ্গের সংবাদ জানাতে কৃষ্ণই প্রথম এলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তিনি নিজেও কাঁদলেন অনেক। কৃষ্ণ অনেক বোঝালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। পুত্রশোকে তিনি যেন পাথর হয়ে গেছেন তখন। ধৃতরাষ্ট্র যে কৃষ্ণের সান্ত্বনাবাক্য অনুধাবন করলেন না তা নয়, কিন্তু দুর্যোধন যেহেতু সারা জীবনই তাঁকে পাণ্ডব-বিদ্বেষে মদত জুগিয়ে গেছেন, তাই তাঁর মৃত্যুর পরেও সে বিদ্বেষ তাঁর যায়নি। কৃষ্ণ অনেক করে তাঁকে বুঝিয়েছেন যে, এই যুদ্ধের ঘটনায় বা মৃত্যুর ব্যাপারে পাণ্ডবরা কিন্তু মোটেই দায়ী নন, কিন্তু তবু পাণ্ডবরাই যে তাঁর শতপুত্র-হন্তা, সে কথা তিনি ভোলেননি এবং এটাই যেন তাঁর বিশ্বাস।
এর পরে যখন কৌরববধূরা স্বামীদের বা মৃত আত্মীয়দের তর্পণ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, তখন ধৃতরাষ্ট্র আবারও শোকসন্তপ্ত হয়েছেন। সঞ্জয় এবং বিদুর তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সঞ্জয়ের ভাষণে ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি দোষারোপ প্রকট হওয়ায় সেটা ক্ষতে ক্ষারের কাজ করেছে। বিদুর কিন্তু হতপুত্র বৃদ্ধকে আর পূর্বকথা স্মরণ করিয়ে দেননি। প্রকৃষ্ট তত্ত্বকথা উপদেশ করে আধ্যাত্মিক উপায়ে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের মনের কষ্ট দূর করার চেষ্টা করেছেন। বিদুর যেসব কথা বলেছেন, তাকে ভগবদ্গীতার সারাৎসার বলা যায়। ধৃতরাষ্ট্র, সেসব কথা শুনে খানিকটা শান্তি পেয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁর প্রিয়তম পুত্রটিকে যে ব্যক্তি গদাঘাতে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে, তার প্রতি এখনও ধৃতরাষ্ট্রের ক্রোধ প্রশমিত হয়নি।
প্রেতকার্য হয়ে যাবার পর গঙ্গাস্নান সেরে পাণ্ডব-ভাইরা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করার পরেই ধৃতরাষ্ট্র ভীমকে খুঁজতে লাগলেন। এই খোঁজাটাকে সহজভাবে নেননি কৃষ্ণ। পাণ্ডবরা যেখানে পর পর এসে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে আনত হবেন, সেখানে আলাদা করে ভীমকে খোঁজার মানে ছিল না বলেই এর মধ্যে তাঁর গূঢ় কোনও অভিসন্ধি কাজ করছে বলে কৃষ্ণ মনে করেছেন—দুষ্টাত্মা ভীমমন্বীপ্সন্ দিধক্ষুরিব পাবকঃ।
ধৃতরাষ্ট্রের ভাবেভঙ্গিতেই তাঁর ক্রোধের ইঙ্গিত মিলেছিল। সেটা বুঝেই কৃষ্ণ শেষ মুহূর্তে এক ঝটকায় হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন ভীমকে। বদলে দুর্যোধন যে লৌহভীমের অঙ্গে গদাপ্রহার করতেন, সেই ভীমটিকে এক মুহূর্তের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের আলিঙ্গনের পরিসরে এনে দিলেন কৃষ্ণ। ভীমের ওপর কত রাগ ছিল বৃদ্ধের যে, লৌহভীমও তাঁর চাপ সহ্য করতে না পেরে বিদীর্ণ হয়ে গেল। আমরা আগেই বলেছি ধৃতরাষ্ট্রের শারীরিক শক্তি ছিল অসম্ভব এবং সেই শক্তি কাজে লাগিয়েই ধৃতরাষ্ট্র ভীমকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেললেন। এদিকে লৌহভীম চূর্ণ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র ‘হা ভীম কোথা ভীম’ বলে কেঁদে আকুল হয়েছেন—হা হা ভীমেতি চুক্রোশ নৃপঃ শোকসমন্বিতঃ। আসলে ভীমের ওপরে তাঁর যে রাগ ছিল, তা তথাকথিত ভীম-হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই চলে গেছে, এখন তিনি নিজ কর্মের জন্যই অনুতাপগ্রস্ত।
আসলে ধৃতরাষ্ট্র চরিত্রের এই হল প্রধান বৈশিষ্ট্য। তিনি যে কাজটি করেন, তার ফলাফল নিয়ে সাময়িককালে তিনি একটুও ভাবেন না, পরে তার জন্য অনুতাপ করে মরেন। কৃষ্ণ যখনই বুঝলেন যে, লৌহভীম চূর্ণ করেই ধৃতরাষ্ট্রের ক্রোধ চলে গেছে,—তং বিদিত্বা গতক্রোধং—তখনই তিনি সান্ত্বনা দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে—ভীম মারা যায়নি, মহারাজ। আমি জানতাম যে, আপনার ক্রোধযুক্ত বাহুযুগলের মধ্যগত হলে রক্ষা নেই ভীমের। আমি তাই বুদ্ধি করে দুর্যোধনের তৈরি করা লোহার ভীমটি এগিয়ে দিয়েছি। আমি জানলাম— পুত্রশোকে আপনার ধর্মাধর্ম জ্ঞান লুপ্ত হয়েছে আপাতত এবং সেই জন্যই আপনি ভীমকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন—তব রাজেন্দ্র তেন ত্বং ভীমসেনং জিঘাংসসি।
কৃষ্ণ এবার সুযোগ পেলেন ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে বলার। ধৃতরাষ্ট্রের মানসিক কুটিলতা এই মুহূর্তে এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ে গেছে যে, তাঁকে প্রায় হাতেনাতে ধরে ফেলেছেন কৃষ্ণ। অতএব এই সুযোগ। কৃষ্ণ বললেন—মহারাজ! আপনি বেদ বেদাঙ্গ, ইতিহাস, পুরাণ অনেক শুনেছেন। রাজধর্মও আপনার অজানা নয়। কিন্তু সবকিছু জেনেবুঝেও যেখানে আপনার নিজেরই এত দোষ রয়েছে, সেখানে ভীমকে হত্যা করার মতো একটা ক্রোধ প্রদর্শন করলেন আপনি। এটা কি ঠিক হল—আত্মাপরাধাৎ কস্মাৎ ত্বং কুরুষে কোপমীদৃশম্। আপনার ছেলেকে আমরা অনেক বারণ করেছি, সে শোনেনি। যুদ্ধের ক্ষেত্রেও আপনাদের চেয়ে পাণ্ডবদের সামরিক ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল, তাও আপনি অনুভব করেননি। যিনি রাজা হবেন, তাঁর নিজের ছিদ্রটা আগে দেখা উচিত, মহারাজ। আপনি নিজের দিকে তাকান। আপনি নিজেই কোনওদিন নিজের স্বেচ্ছানিঃসারিত সাময়িক বৃত্তিগুলিকে রোধ করতে পারেননি এবং চিরকাল তাই করে গেছেন যা আপনার ছেলে বলেছে—রাজংস্ত্বম্ অবিধেয়াত্মা দুর্যোধনবশে স্থিতঃ। দুর্যোধন পাঞ্চালী কৃষ্ণাকে সভাস্থলে নিয়ে এসে যে অন্যায় করেছিল, তারই ফল পেয়েছে ভীমের হাতে। আপনি কি সেসময় একটুও বারণ করেছিলেন তাকে? করেননি। তা হলে আপনার দোষ থাকা সত্ত্বেও কেন আপনি ভীমকে মারার চেষ্টা করছিলেন—আত্মপরাধাদাপন্নস্তৎ কিং ভীমং জিঘাংসসি।
ধৃতরাষ্ট্র নিজের দোষ স্বীকার করলেন—একেবারেই ঠিক কথাটি তুমি বলেছ, কৃষ্ণ! পুত্রস্নেহের কারণেই আমি সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার ভাগ্য যে, তুমি বুদ্ধি করে ভীমকে আমার শক্তিশালী হাতদুটোর মধ্যে আসতে দাওনি—ত্বদ্গুপ্তো নাগমৎ কৃষ্ণো ভীমো বাহ্বন্তরং মম। ধৃতরাষ্ট্র একটু লজ্জা পেয়েই বললেন—যা হবার হয়ে গেছে, আমার আর কোনও রাগ নেই জেনো। আমি মন থেকে বলছি—ভীমকে আমি স্পর্শ করতে চাই। কত কত বড় বড় রাজারা এই যুদ্ধের কারণে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, আমার পুত্রেরাও কেউ বেঁচে রইল না। এখন পাণ্ডবদের ওপরেই আমার সব কিছু, সব শান্তি, সব ভালবাসা—পাণ্ডুপুত্ৰেষু বৈ শৰ্ম প্রীতিশ্চাপ্যবতিষ্ঠতে।
জ্যাঠামশাই আর ভাইপোদের মান-অভিমানের পালা মিটলে যুদ্ধভূমিতে এলেন সবাই। সেখানে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের প্রেতকার্য করার জন্য চিন্তা আছে ধৃতরাষ্ট্রের। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের মত নিয়ে মৃত ব্যক্তিদের সম্মান এবং পূজ্যতা অনুসারে দাহকার্য সম্পন্ন করলেন। তারপর গঙ্গায় মৃত ব্যক্তিদের জন্য তর্পণ করতে যাবার সময় যুধিষ্ঠির সবার সামনে রাখলেন ধৃতরাষ্ট্রকে, যাতে বৃদ্ধ মনে না করেন—আজ তাঁর ছেলেরা নেই বলে তাঁকে কেউ মানছে না—ধৃতরাষ্ট্রং পুরস্কৃত্য গঙ্গামভিমুখো’ভবৎ।
যুধিষ্ঠির তাঁর পিতৃতুল্য ধৃতরাষ্ট্রকে সামনে নিয়ে সমস্ত কাজ করছেন বটে, কিন্তু তাঁর মনে কোনও শান্তি নেই। স্বজন-আত্মীয়-বন্ধুদের বিয়োগে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের চেয়ে কম সন্তপ্ত নন। এইরকম একটি শোক-কর্ষিত রাজ্যে তাঁকে রাজা হতে হবে—এই কথা ভেবে যুধিষ্ঠির মোটেই শান্তি পাচ্ছেন না। যাই হোক গঙ্গার জলে প্রেত ব্যক্তিদের জন্য স্নান-তর্পণ শেষ হলে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি হাতে ধরে গঙ্গার জল থেকে তুলে আনলেন—ধৃতরাষ্ট্রং-মহাবাহু রুত্ততারাকুলেন্দ্রিয়ঃ। কিন্তু বৃদ্ধকে গঙ্গার তীরভূমিতে তুলে এনে যুধিষ্ঠির নিজেই প্রায় অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় শক্তিহীন হয়ে গেছে। এতদিন ধরে যুদ্ধবিগ্রহের আকুলতার পর গঙ্গাতে আত্মীয়স্বজনের জন্য ‘গয়া-গঙ্গা-গদাধরো হরিঃ’ করতে গিয়ে তিনি প্রথম শুনেছেন—কর্ণ তাঁর ভাই। এতেও তাঁর অতিসংবেদনশীল হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করেছে। নিদারুণ বৈরাগ্যে এখন তিনি রাজ্যপাট, সিংহাসন থেকে মুক্তি চাইছেন।
যুধিষ্ঠিরের বিপরীতে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের অবস্থা নিশ্চয়ই আরও শোচনীয়। কেন শোচনীয়, তাও সহজেই অনুমেয়। তাঁর এতগুলি সুযোগ্য পুত্র মারা গেছে, বিশেষত প্রিয়তম দুর্যোধন। আত্মীয়স্বজন কেউ বেঁচে নেই। যুদ্ধেও তাঁর পক্ষে জুটেছে শোচনীয় পরাজয়। তবু কিন্তু এই বৃদ্ধের ‘স্ট্যামিনা’ দেখার মতো। যুধিষ্ঠিরের হাত ধরে গঙ্গাতীরে উঠে তিনি যখন দেখলেন যে, যুধিষ্ঠিরই আর টাল রাখতে পারছেন না, তখন তিনিই শক্তি জোগালেন তাঁকে। যুধিষ্ঠির পড়ে গেছেন, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ছেন, ইন্দ্রিয়-মন সমস্ত ব্যাকুল। সমস্ত রাজন্যবর্গ এবং পাণ্ডব-ভাইরা তাঁর দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হচ্ছেন, আর ঠিক সেই সময়ে নিজে পুত্রশোকে ক্লিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বলে উঠলেন—ওঠো যুধিষ্ঠির! ওঠো। তুমি না মহান ক্ষত্রিয়ধর্মের গৌরবে এই পৃথিবী জয় করেছ। এখন তোমার কাজ হল ভাইদের নিয়ে, মনোমতো বন্ধুদের নিয়ে এই পৃথিবী ভোগ করা। তুমি বাছা এমন শোক করছ কেন? তোমার তো শোক করার মতো কিছু ঘটেনি—শোচিতব্যং ন পশ্যামি ত্বয়া ধর্মভৃতাং বরঃ।
ধৃতরাষ্ট্র, শতপুত্রের মরণক্লিষ্ট ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে সোৎসাহে জানিয়েছেন—কারও যদি শোকগ্রস্ত হওয়ার দায় থাকে, সে শুধু আমার এবং এই গান্ধারীর—শোচিতব্যং ময়া চৈব গান্ধাৰ্য্যা চ বিশেষতঃ। আমাদের একশত পুত্র মারা গেছে। স্বপ্নলব্ধ সম্পত্তি যেমন নষ্ট হয়ে যায়, তেমনই করেই যেন আমার ছেলেরা স্বপ্নে দেখা দিয়ে আমার কাছ থেকে চলে গেল। বিদুর আমাকে কত বুঝিয়েছিলেন, কিন্তু সেসব কথায় আমি একটুও কান দিইনি। কতবার সে বলেছে—এই দুর্যোধনের জন্য এ বংশের সর্বনাশ হবে, এ ছেলেকে আপনার মেরে ফেলাও ভাল। কর্ণ, শকুনি, দুঃশাসন—এদের সম্বন্ধেও বিদুর আমাকে অনেক সাবধান করেছে। এমনকী সে এও বলেছে যে, আপনি এদের সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে কুমার যুধিষ্ঠিরকে রাজা করুন। কিন্তু যুধিষ্ঠির! বিদুর এত কিছু বললেও কুপুত্রের স্নেহে অন্ধ আমি দুর্যোধনেরই পিছন পিছন চলেছি—দুর্যোধনমিমং পাপমন্ববর্তং বৃথামতিঃ—এবং তার ফলও পাচ্ছি। কত শোক-তাপ আমি পেয়েছি, সে তো তুমি দেখতেই পাচ্ছ, যুধিষ্ঠির! কাজেই বাছা! তুমি আর কোনও কষ্ট পেয়ো না। আমরা দুই বুড়ো-বুড়ি তোমার পিতা-মাতার মতো। আমরা এমনিতেই অনেক কষ্ট পাচ্ছি—বৃদ্ধৌ হি তে’দ্য পিতরৌ পশ্য তৌ দুঃখিতৌ নৃপ। এরমধ্যে আবার তুমি কষ্ট পেলে আমরা কোথায় যাই বলো।
যুধিষ্ঠিরের মানসিক বৈকল্য যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন শোকস্তব্ধ এই বৃদ্ধের মুখে এমন সযৌক্তিক কথা আমাদের শুধু অবাকই করে না, একইসঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের মানসিক শক্তির কথাও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ধৃতরাষ্ট্র, ব্যাস, এবং কৃষ্ণের কথায় শেষপর্যন্ত যুধিষ্ঠির রাজ্য গ্রহণ করলেন। সেকালের ধর্মীয় সংস্কারে রাজারা ভাবতেন যে, অশ্বমেধ যজ্ঞ করলে যুদ্ধের পাপ চলে যায়, যুধিষ্ঠির তাই সকলের পরামর্শ নিয়ে অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। কিন্তু পুরো সময়টা জুড়ে কেমন ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র—এ প্রশ্নটা আমাদের মনে যেমন জাগছে, তেমনই জাগছে পাণ্ডব-বংশধর জনমেজয়ের মনেও। তিনি মহাভারত শুনছেন রাজসভায় বসে, যুধিষ্ঠিরের পরম্পরাপ্রাপ্ত সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের মতোই তিনি প্রশ্ন করছেন—আমার পাণ্ডব-পিতামহরা রাজ্য পাবার পর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতেন—কথমাসন্ মহারাজ্ঞি ধৃতরাষ্ট্রে মহাত্মনি।
জনমেজয়ের এই প্রশ্ন তুলবার কারণ আছে। আমরা এই প্রবন্ধের আরম্ভে পূর্ববঙ্গবাসী এক বড় দাদার কীর্তি বর্ণনা করেছিলাম। সব জায়গায় বঞ্চিত হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত ছোট ভাইয়ের আশ্রয়ে এসে সুখে ছিলেন। এখানেও জনমেজয় প্রশ্ন করছেন—মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয় বলতে তো আর কিছুই ছিল না। তাঁর পুত্রেরা মারা গেছেন, মন্ত্রী অমাত্যেরা কেউ বেঁচে নেই, ধনৈশ্চর্যও সব গেছে। তিনি তো একেবারেই নিরাশ্রয়—স তু রাজা হতামাত্যো হতপুত্রো নিরাশ্রয়ঃ। তা তিনি আমার পিতামহদের আশ্রয়ে কেমন ছিলেন, কতদিনই বা ছিলেন।
মহাভারতের কথকঠাকুর উত্তর দিচ্ছেন—ভালই ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। অন্তত তাঁর সম্মান নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। মহারাজ যুধিষ্ঠির আগে যেমন সর্বকর্তৃত্বময় রাজার সম্মান দিতেন তাঁকে, এখনও তাই দেন। যে কাজই পাণ্ডবরা করতেন, তা ধৃতরাষ্ট্রের মত নিয়েই করতেন—ধৃতরাষ্ট্রং পুরস্কৃত্য পৃথিবীং পর্যপালয়ন্। যেন তাঁর এমন মনে না হয় যে, আজ তাঁর ক্ষমতা নেই বলে কেউ তাঁকে গ্রাহ্য করছে না। ধৃতরাষ্ট্রের সুখ দুঃখের কথা শোনার জন্য, তাঁকে সর্বক্ষণ দেখাশোনা করার জন্য তিনটি মানুষ সদাই তটস্থ থাকতেন। একজন মহামতি বিদুর, একজন প্রাজ্ঞ সারথি সঞ্জয়, আর তৃতীয়জন ধৃতরাষ্ট্রের একটি পুত্র। ভাবতে অবাক লাগে এখনও একটি পুত্র জীবিত আছেন ধৃতরাষ্ট্রের। এই পুত্রটি গান্ধারীর গর্ভজাত নন, ইনি সেই বৈশ্যার গর্ভে জন্ম নেওয়া ধৃতরাষ্ট্রের ঔরস-সন্তান যুযুৎসু। দুর্যোধন-দুঃশাসনের কূটবুদ্ধি এবং অসভ্যতা তাঁর ছিল না। যুযুৎসু অতীব সজ্জন মানুষ এবং দুর্যোধনের অন্যায়-অবিচার সহ্য করতে না পেরে মহাযুদ্ধের পূর্বেই তিনি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেই জন্যই এখনও বেঁচে আছেন। তিনি সদাসর্বদা নজর রাখতেন ধৃতরাষ্ট্রের ওপর।
পাণ্ডবরা প্রত্যেকে—শুধু ভীমসেন ছাড়া—প্রত্যেক কাজে ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিতেন এবং অনুমতি পেলেই তবে সে কাজ করতেন—পাণ্ডবাঃ সর্বকার্যাণি সংপৃচ্ছন্তি স্ম তং নৃপম্। সকালবেলা উঠেই প্রত্যেক পাণ্ডবের কাজ ছিল ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম করে আসা এবং এটাই ছিল ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নির্দেশ। পুরুষমহলে যেমন বিদুর-সঞ্জয়-যুযুৎসুরা ধৃতরাষ্ট্রের সদা-সহায় ছিলেন, মেয়েমহলে তেমনই কুন্তী-দ্রৌপদী-সুভদ্রারা দেখে রাখতেন গান্ধারীকে। ধৃতরাষ্ট্রের রাজোচিত বিলাস-ব্যসনেরও কোনও অভাব রাখেননি যুধিষ্ঠির। দুগ্ধফেননিভ কোমল শয্যা, সুচিক্কণ বস্ত্র, স্বর্ণময় আভরণ এবং রাজোচিত ভক্ষ্য-ভোজের সুব্যবস্থায় ধৃতরাষ্ট্রের কখনও মনে হয়নি যে, তিনি রাজা নন। ভাল রান্না করতে পারে এমন সূপকার তো ছিলই, কিন্তু বুড়ো বয়সে গুরুভোজন সহ্য হয় না, ভালও লাগে না, অতএব এমন একজন ‘স্পেশালিস্ট’ সবজি-রাধুনে ছিলেন, যিনি বিভিন্ন প্রকার সবজি রান্না করে দিতেন ধৃতরাষ্ট্রকে। একজন ছিলেন, যিনি পিপুল-শুঠের সঙ্গে কিঞ্চিৎ চিনির সহযোগে মুগডালের ‘যূষ’ রান্না করে দিতেন ধৃতরাষ্ট্রকে। মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্রের এই তিন প্রকার রাধুনের পারিভাষিক নাম হল—আরালিকাঃ সুপকারা রাগখাণ্ডবিকাস্তথা। বৃদ্ধ বয়সে স্বল্প পরিমাণ মদ্যপান করলে শরীর চনমনে থাকে, সেই জন্যই হোক, অথবা এতকালের রাজার অভ্যাস—সেই জন্যই হোক, কিঞ্চিৎ মৈরেয়মার্কা মদ্যের সঙ্গে ভর্জিত মৎস্য অথবা মাংসের অনুপান—মৈরেয়-মৎস্য-মাংসানি পানকানি মধূনি চ—সেগুলিও ঠিক একইভাবে যোগানো হত, যেমনটি আগে ছিল।
এ সব কিছুই যুধিষ্ঠিরের নির্দেশ। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে এমনভাবেই রেখেছিলেন, যাতে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর মনে না হয় যে, আগে আমি রাজা বলে যে সুযোগ পেয়েছি, এখন তা নেই। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান যেভাবে দেওয়া যায়—যেমন গণতান্ত্রিক ভারতে রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা, ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষমতাটা ছিল অনেকটা ওই পর্যায়ের। কোনও সামন্ত রাষ্ট্র বা প্রতিবেশী রাষ্ট্র যদি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সুযোগ সুবিধা প্রার্থনা করত, তা হলে ধৃতরাষ্ট্রের উচ্চারণমাত্রেই সেইসব সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করা হত। অন্যায় আচরণ করার জন্য যাকে কারাবন্দি করা হয়েছে, তার আত্মীয়স্বজনরা যদি এসে ধৃতরাষ্ট্রকে ধরত—হুজুর আপনি ব্যবস্থা করুন, এবং ধৃতরাষ্ট্র যদি কৃপাপরবশ হতেন, তা হলে তার বন্দিদশার মুক্তি ঘটত। যার ফাঁসির হুকুম হয়েছে, যে যদি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহারের আবেদন করত, তা হলে ধৃতরাষ্ট্র মনে করলে তার ফাঁসির হুকুম রদ করা হত—অকরোদ্ বন্ধ-মোক্ষঞ্চ বধ্যানাং মোক্ষণং তথা।
ধৃতরাষ্ট্রকে এমন রাষ্ট্রপতির মর্যাদা দিয়ে রেখেছিলেন যুধিষ্ঠির স্বয়ং। যে বন্দির মুক্তি হওয়ার কথা নয় অথবা যে আসামির মৃত্যু থেকে বাঁচবার কথা নয়, তাকেও যখন করুণাপরবশ হয়ে মুক্তির আদেশ দিতেন ধৃতরাষ্ট্র, তখন রাষ্ট্রগতভাবে কিছু অসুবিধা হওয়ারই কথা। কিন্তু যেহেতু বৃদ্ধ পিতা ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন, অতএব যুধিষ্ঠির সেখানে একটি কথাও বলতেন না—ন চ ধর্মসুতো রাজা কদাচিৎ কিঞ্চিদ্ অব্রবীৎ। বুড়ো হয়েছেন অতএব ঘরে বসে থাকুন—এমন কথাও কখনও আসেনি যুধিষ্ঠিরের তরফ থেকে। সময়কালে হাতে ভালরকম টাকাপয়সা নিয়ে এদিক ওদিক ভ্রমণ করে আসাটাও ধৃতরাষ্ট্র ইচ্ছেমতো করতে পেরেছেন যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে—বিহারযাত্ৰাসু পুনঃ…সর্বান্ কামান্ মহাতেজাঃ প্রদদাবম্বিকাসুতে।
বেশ বোঝা যাচ্ছে—ভালই ছিলেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। নিজের পুত্রের আমলেও তিনি বোধ হয় এত স্বাধীনতা পাননি, যা এখন পাচ্ছেন অথবা বলা যায়—নিজে রাজা থাকার সময় তিনি যে সুখ, যে বিলাস-ব্যসন ভোগ করেছেন—যাবদ্ধি কুরুবীরস্য জীবৎপুত্রস্য বৈ সুখম্। বভূব তদাপ্নোতি—তিনি সে সবই ভোগ করছেন এখনও। মহারাজ যুধিষ্ঠির—ভাইদের ডেকে, মন্ত্রী অমাত্যদের ডেকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন—মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে আমি যেমন মান্যি করে চলি, তোমরাও তাই করবে। ধৃতরাষ্ট্র যেমনটি বলবেন, তেমনটি যদি কর, তবে জানবে সে আমার বন্ধু, আর এর বিপরীত হলে আমি তাকে শত্রু বলে গণ্য করব। ধৃতরাষ্ট্র ব্রাহ্মণদের দানধ্যান করবেন, আর্থিক নির্দেশ দেওয়াই আছে, তিনি যজ্ঞযাগ করবেন তার ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক দায়দায়িত্ব মেটানোর সমস্ত নির্দেশ আগে থেকেই দিয়ে রেখেছেন যুধিষ্ঠির।
ধৃতরাষ্ট্রও বুঝতেন যে, যুধিষ্ঠির কতটা অনুভব করেন তাঁর জন্য। তাঁর অন্য কোনও কষ্ট ছিল না। পাণ্ডবদের ব্যবহারে তিনিও অত্যন্ত প্রীত ছিলেন। কিন্তু এত সুখ এবং সম্মানের মধ্যেও মাত্র একটি ব্যবহার ক্ষুদ্র কণ্টকের মতো তাঁকে বিদ্ধ করত। এই ব্যবহার মধ্যম পাণ্ডব ভীমের। যুধিষ্ঠির বা অন্য ভাইদের সামনে ভীম কোনও খারাপ ব্যবহার করতেন না ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে। এমনকী সকালবেলায় তাঁকে প্রণাম করতে যাবার সময় অথবা ধৃতরাষ্ট্র কোনও নির্দেশ দিচ্ছেন, সেটা মেনে নেবার ব্যাপারে ভীম সবার সঙ্গে একই ব্যবহার করছেন। কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের আড়াল হলেই ভীম কিন্তু অন্যরকম ব্যবহার করছেন ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে। আসলে ভীম পূর্বের কষ্ট ভুলতে পারেননি। বনবাসে যাবার সময়ে পর্যন্ত দুর্যোধন-কৰ্ণরা তাঁকে ‘গোরু’ ‘গোরু’ বলে ডেকেছিলেন, তার ওপরে দ্যূতসভার সেই অসভ্য ব্যবহার—এগুলি ভীম ভুলতে পারেননি—নহি তত্তস্য বীরস্য হৃদয়ান্নাপসৰ্পতি। আরও ভুলতে পারেননি, কারণ দুর্যোধনের এই সমস্ত অপকর্মই ঘটেছিল ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে। ধৃতরাষ্ট্র একবারের তরেও দুর্যোধনকে বারণ করেননি যে—ভীমকে এমনভাবে অপমান কোরো না। ভীম তাই আড়ালে আবডালে ধৃতরাষ্ট্রকে কথা শোনাতে ছাড়তেন না।
মহারাজ যুধিষ্ঠির বা অন্যান্য পাণ্ডব-ভাইদের বিনীত ব্যবহারে অত্যন্ত প্রীত ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। কোনও ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের প্রতি অপ্রসন্ন ছিলেন না—ন দদর্শ তদা কিঞ্চিদ্ অপ্রিয়ং পাণ্ডুনন্দনে। এতদিনে বৃদ্ধের অনুতাপ হয়—দুর্যোধনকে প্রশ্রয় না দিলেই তিনি ভাল করতেন। পাণ্ডবদের আচারে ব্যবহারে তিনি এতই সন্তুষ্ট হয়েছেন যে, সকালবেলায় উঠে স্নান ধ্যান সেরে এখন প্রতিদিন তিনি পণ্ডবদের মঙ্গলকামনা করেন, দেবতার কাছে সর্বদা প্রার্থনা করেন যাতে পাণ্ডবরা যুদ্ধে কখনও কোনও শত্রুর কাছে পরাজিত না হন—আশাস্তে পাণ্ডুপুত্ৰাণাং সমরেষ্বপরাজয়ম্। ধৃতরাষ্ট্রের জীবন এখন শান্তিতে ভরে গেছে। তিনি মনেপ্রাণে অনুভব করেন যে, তাঁর ছেলেরাও বেঁচে থাকতে এত সুখ ধৃতরাষ্ট্রকে দেয়নি, যা তাঁকে এই পাণ্ডুপুত্রেরা দিয়েছে—যাং প্রীতিং পাণ্ডুপুত্রেভ্যঃ সদাবাপ নরাধিপঃ।
যুধিষ্ঠিরের জ্বালায় কারও কিছু বলার উপায় ছিল না ধৃতরাষ্ট্রকে। কারও এমন সাহসও ছিল না যে, কোনওভাবে ধৃতরাষ্ট্রের সম্বন্ধে কটু কথা বলে পার পাবে। ধৃতরাষ্ট্র কেন, ধৃতরাষ্ট্র যেহেতু দুর্যোধনের নিন্দা শুনলে দুঃখ পাবেন, তাই দুর্যোধনেরও নিন্দা করা চলত না ধৃতরাষ্ট্রের সামনে—ন রাজ্ঞো ধৃতরাষ্ট্রস্য ন চ দুর্যোধনস্য বৈ। যদি কেউ এই ভাবে না চলতেন, তবে যুধিষ্ঠিরের শত্রুই হয়ে যেতেন তিনি। কিন্তু একমাত্র মুশকিল হয়েছে ভীমকে নিয়ে। বড় দাদা তথা রাজা যুধিষ্ঠিরের কথামতো ভীম ধৃতরাষ্ট্রের অনুবর্তন করতেন বটে, কিন্তু দাদার এই নির্দেশ মানতে তাঁর মন চাইত না—অন্ববর্তন্ত কৌরব্যো হৃদয়েন পরাঙ্মুখঃ। ভীমের কেবলই মনে হত—এই লোকটা তাদের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, এই লোকটা পাশাখেলার কপটতায় প্রশ্রয় দিয়ে দ্রৌপদীর অপমান ঘটিয়েছিল এবং এই লোকটাই তাদের বনবাসে পাঠাতে চেয়েছিল। অন্যদিকে ভীমের এই মানসিকতা যখন কাজ করছে, তখন ধৃতরাষ্ট্রও কিন্তু ভীমকে কখনও মন থেকে ক্ষমা করতে পারেননি। দুর্যোধনের কথা যখনই তাঁর মনে হয়, তখনই ধৃতরাষ্ট্র ভাবেন—এই লোকটাই তাঁর পুত্রকে বধ করেছে ঊরুভঙ্গ করে—তদা ভীমং হৃদা রাজন্ অপধ্যাতি চ পার্থিবঃ।
আমাদের আধুনিক কথ্য ভাষায় যাকে বলে ‘চাপা মার’, ভীম সেই ব্যবহারটাই করতেন ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সামনাসামনি তিনি নেহাতই ভদ্রলোক, কিন্তু আড়ালে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রিয় কাজ করে নিজের পূর্ব-প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করতেন—অপ্রকাশন্যপ্রিয়ানি চকারাস্য বৃকোদরঃ। ধৃতরাষ্ট্রের সেবাদাস ছিলেন যাঁরা, তাঁরা হয়তো ধৃতরাষ্ট্রের কথামতো কিছু করতে যাচ্ছেন বা কিছু আনতে যাচ্ছেন, ভীম তাঁদের কাজ থেকে নিবৃত্ত করে মজা দেখতেন—আজ্ঞাং প্রত্যাহরচ্চাপি কৃতকৈঃ পুরুষৈঃ সদা।
ভীমের আরও একটা বদভ্যাস ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই বেশি প্রকটিত হত। মাঝে মাঝেই তিনি ধৃতরাষ্ট্রের সামনে নিজের পেশিবহুল হাতের গুলি দেখাতেন, মাঝে মাঝেই তাঁর সামনে বন্ধুবান্ধবকে দেখিয়ে দেখিয়ে বগল বাজিয়ে নিজের শক্তি প্রদর্শন করতেন—অথ ভীমঃ সুহৃন্মধ্যে বাহুশব্দং তথাকরোৎ। ধৃতরাষ্ট্রের সামনেই ভীম দুর্যোধনের নাম করে নানা অপকথা বলতেন। দুর্যোধনের চরিত্রেও যেহেতু ভীমের প্রতি বিদ্বেষ ছিল চরম, তাই তাঁর অপকর্মগুলি, বিশেষত তিনি জীবনে যেসব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেগুলি সবিস্তারে বলতে বলতে হাততালি দিয়ে উঠতেন ভীম। ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর সামনে যখন অন্যান্য লোকেরা রয়েছে—সে কর্মকরই হোক অথবা বাইরের লোক—ভীম তাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন—আমার এই হাতদুটো দেখেছিস তো শক্ত কাঠের খুঁটি ছাড়া আর কিছু নয়, অন্ধ রাজার ছেলেরা সব এই হাতদুটোর মাঝখানে এসে পড়েই যত গোলমাল করল। ওপারে চলে যেতে হল জীবনের মতো—যাবাসাদ্য রণে মূঢ়া ধার্তরাষ্ট্রাঃ ক্ষয়ং গতাঃ।
ভীম তাঁর চন্দন-কুঙ্কুমে অঙ্কিত হাতদুটি দেখিয়ে চিৎকার করে বলতেন—আরে এই হল সেই চন্দনমাখা হাতদুটো, সত্যিই তো চন্দনটন্দন দিয়ে পুজো করা উচিত এই হাতদুটোকে—চন্দনার্হৌ চ মে ভুজৌ—কেননা এই হাতদুটোই দুর্যোধনকে আত্মীয়বন্ধু সহযোগে যমের মুখ দেখিয়েছে—যাভ্যাং দুর্যোধনো নীতঃ ক্ষয়ং সসুতবান্ধবঃ। এইরকম একটা দুটো কথা নয়, আরও পাঁচরকম কথা ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলতেন ভীম। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এসব কটুকথার বিন্দুবিসর্গ জানতেন না—নাম্ববুধ্যত তদ্ৰাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ—জানতেন না অর্জুন, দ্রৌপদী, কুন্তী কিংবা অন্যান্য ভাইয়েরা। অন্যদিকে বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষেও এমন ছেলেমানুষি করা সম্ভব ছিল না যে, তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে নালিশ করবেন ভীমের সম্বন্ধে।
দুর্যোধনের মৃত্যু বা যুধিষ্ঠিরের রাজা হবার পর পনেরো বছর কেটে গেছে। যুধিষ্ঠিরের দেওয়া অনন্ত সুখের মধ্যে ভীমের এই কটুকথার কাঁটাগুলি ধৃতরাষ্ট্রকে আস্তে আস্তে সংসার-বিরাগী তুলল—রাজা নির্বেদমাপেদে ভীমবাগ্বাণপীড়িতঃ। একদিন তিনি স্বজন-সুহৃৎদের ডেকে এবং অবশ্যই যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করে বললেন—আপনারা সব জানেন কীভাবে এই কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমার অপরাধ কিছু কম নয়। আমি তাদের প্রশ্রয় দিয়েছি এবং সেই প্রশ্রয় পেয়েই দুর্যোধন এক সময় কৌরবদের আধিপত্য লাভ করেছিল। আমি ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, কৃষ্ণ এমনকী পিতা ব্যাসের কথাও কান দিয়ে শুনিনি। তাঁরা পদে পদে আমাকে অন্যায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—পদে পদে ভগবতা ব্যাসেন চ মহাত্মনা।
ধৃতরাষ্ট্র আজকে সত্যিই অনুতাপগ্রস্ত। সকলের সামনে তিনি আজ অপরাধ স্বীকার করে ভারমুক্ত হতে চাইছেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—আমার সুহৃৎ-সজ্জনেরা অনেক বলা সত্ত্বেও আমি এই গুণবান পাণ্ডবদের হাতে তাঁদের পিতৃ-পিতামহের পরম্পরাপ্রাপ্ত রাজ্যখণ্ড তুলে দিইনি—ন দত্তবান্ শ্রিয়ং দীপ্তাং পিতৃপৈতামহীম্ ইমাম্। অনেক অন্যায়, অনেক পাপ, অনেক দুঃখ আমার এই হৃদয়ে জমা হয়ে আছে। সেইসব পাপের শুদ্ধির জন্য আমার এই শেষ বয়সে আমি কিছু নিয়ম-ব্রত পালন করতে চাই। আজ পনেরোটা বছর হয়ে গেল—মহারাজ যুধিষ্ঠির আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। তাঁর পরিজন আজ্ঞাকারীরা সব সময় আমার দেখাশোনা করেছে। কিন্তু আমার এখন উচিত বৈরাগ্য অবলম্বন করা, জাগতিক তৃষ্ণার নিবৃত্তি ঘটানো—তৃষ্ণা-বিনয়নং ভুঞ্জে। আমার যা বয়স হয়েছে, তাতে বৈরাগ্যের বিধানে আমার উচিত ভূমিতে শয়ন করা, অজিন পরিধান করে কুশাসনের ওপর বসে জপযজ্ঞে দিন কাটাতে চাই আমি—ভূমৌ শয়ে জপ্যপরো দুর্ভেষ্বজিনসংবৃতে।
ধৃতরাষ্ট্রের বৈরাগ্য এসেছে। আমাদের ধারণা—আসত না, তবু এসেছে। সাধুসন্তদের মুখে ছোটবেলায় শুনেছি—সংসার-বৈরাগ্য নানাভাবে আসে। কেউ আজন্ম বৈরাগী, তাঁর জন্য পৃথিবী আপনিই সেজে বসে থাকেন। বনের ফল আর নদীর জল দিয়ে জননী বসুন্ধরা তাঁর সেবা করেন। কারও ভগবৎকৃপায় বৈরাগ্য আসে, কারও বা সাধুমহান্তের কৃপায়। আর বৈরাগ্য আসে ঠেলায় পড়ে, যাকে ঠেলার নাম বাবাজি বলি। সংসারে স্ত্রী-পুত্রের গঞ্জনা সইতে না পেরে বৈরাগ্য আসে। এক মহান ব্যক্তির কথা শুনেছি, তিনি সংসারে স্ত্রী-পুত্রের কাছে লাথিঝাঁটা খেলেই বলতেন—তোমরা আমার ভগবত-ভজনের পরম সহায়, পরম উপকারী। তোমরা এমন করে গঞ্জনা দাও বলেই ভগবানের কথা আমার এত মনে পড়ে, তাঁর করুণার জন্য এত আর্তি হয়।
যুধিষ্ঠিরের লালনে পালনে পরিষেবায় ধৃতরাষ্ট্র যেমন সুখে ছিলেন, তাতে এই পনেরো বছরে তাঁর তৃষ্ণার নিবৃত্তি হত বলে মনে হয় না। কিন্তু মহাভারতের কবি লিখেছেন—ভীমের বাক্যবাণেই তাঁর বৈরাগ্য উদয় হল। অর্থাৎ এক অর্থে ভীমের দিক থেকে ব্যাপারটা যতই খারাপ হোক, ওই ভীমই কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের সাধন-সহায়। ধৃতরাষ্ট্র নিজের মতো করেই একটা সান্ত্বনা খুঁজে নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—আমার ছেলেরা সব মারা গেছে। তা যাক, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সম্মুখসমরে মৃতুই তো পরম গতি, তার জন্য আর আমার অনুশোচনা নেই—নানুতপ্যামি তাচ্চাহং ক্ষত্রধর্মং হি তে বিদুঃ। ধৃতরাষ্ট্র এবার হৃদয়ের গভীর থেকে কৃতজ্ঞতা জানালেন যুধিষ্ঠিরকে। বললেন—তোমার কাছে তোমার তত্ত্বাবধানে এতকাল বড়ই সুখে ছিলাম, বাছা—সুখমস্মি-ঊষিতঃ পুত্র ত্বয়া সুপরিপালিতঃ। তোমার জন্য আমার দানধ্যান যজ্ঞাদি ক্রিয়া সম্পন্ন করার কোনও অসুবিধে ঘটেনি। তুমি রাজা, তুমি সকলের গুরুস্বরূপ, এখন তুমি যদি অনুমতি কর তবে এই পুত্রশোকাতুরা গান্ধারীকে নিয়ে আমি বানপ্রস্থ অবলম্বন করতে পারি—অনুজ্ঞাতস্ত্বয়া বীর সংশ্রয়েয়ং বনান্যহম্।
যুধিষ্ঠির মোটেই সুখী হলেন না। ধৃতরাষ্ট্র বনে যেতে চাইলে তিনি একেবারে বালকের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললেন—এই রাজ্যপাট আমার একটুও ভাল লাগে না। আপনি আমাদের পিতা-মাতা, আপনিই আমাদের প্রথম গুরু। আপনাকে ছাড়া এ রাজ্যে আমি বাস করতে পারব না। আপনি ছাড়া কার কাছেই বা আমরা সমস্ত বিষয়ে সৎপরামর্শ পাব—ভবতা বিপ্রহীণা বৈ কং তু তিষ্ঠামহে বয়ম্। যুধিষ্ঠির বললেন—আপনি বরং আপনার ঔরস পুত্র যুযুৎসুকে রাজ্য দিয়ে আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলুন। কারণ এ রাজ্যের রাজা মোটেই আমি নই, আপনিই এই কুরুরাষ্ট্রের আসল রাজা, আমরা সকলেই আপনার অধীন—নাহং রাজা ভবান্ রাজা ভবতঃ পরবানহম্। দুর্যোধন যা করেছে, তার জন্য আমার মনে একটুও রাগ নেই, পিতা। কিন্তু যেমন দুর্যোধন আপনার পুত্র, আমরাও তেমনই আপনার পুত্র। আমার জননী কুন্তী এবং গান্ধারীকে আমি কোনও দিন আলাদা করে ভাবিনি। অতএব আপনি পিতা হয়ে যদি আমাকে ছেড়ে চলে যান, তবে জানবেন—আমিও আপনার পিছন পিছন বনে চলে যাব—পৃষ্ঠতস্তু অনুযাস্যামি সতjমাত্মানমালভে।
যুধিষ্ঠিরের আন্তরিকতায় কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু শোকতাপ-দগ্ধ বৃদ্ধের তখন সত্যিই সংসারে নির্বিণ্ণতা এসেছে। ধৃতরাষ্ট্রও আন্তরিকভাবে বুঝিয়ে বললেন—মনটা আমার সত্যিই তপস্যা-বৈরাগ্যের দিকে চলে গেছে, বাছা! তা ছাড়া এই কি আমাদের কুলধর্মও নয়? যৌবনোচিত বিষয়-এষণা ত্যাগ করে এই বুড়ো বয়সে বানপ্রস্থই তো আমাদের কুলাচার, বাবা। তা ছাড়া তোমার ঘরে তো অনেককাল সুখে রইলাম, বাবা। তুমি আমার অনেক সেবা করেছ, এবার এই বুড়োকে ছেড়ে দাও—বৃদ্ধং মামপ্যনুজ্ঞাতুম্ অর্হসি ত্বং নরাধিপ।
এতকালের সুখবাস ছেড়ে চলে যাবেন! ধৃতরাষ্ট্রেরও কষ্ট কিছু কম হচ্ছিল না। মায়া তো কম বাড়েনি। সেই পাণ্ডুর বনে যাবার সময় থেকে তিনি রাজ্য ভোগ করছেন। তার ওপরে দুষ্ট অবুঝ ছেলের ওপর মায়া থাকে বেশি। তাকে সর্বাধিপত্য দিয়ে তাঁর নিজের দুর্বলতা চরিতার্থ করেছেন অত্যন্ত সবলভাবে। তারপর একে একে সব পুত্র চলে যাবার পর এখন এই অজাতশত্রু যুধিষ্ঠিরের ওপরেও তাঁর কম মমতা তৈরি হয়নি। এই সমস্ত মায়ামমতার বন্ধন হঠাৎ এক ঝটকায় সরিয়ে দেবার সময় ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয়-বিকার শরীরের মধ্যেও ধরা পড়ল।
যুধিষ্ঠিরের আর্তিমাখা মুখের দিকে আর তিনি তাকাতে পারলেন না। তাঁর শরীরটা কাঁপছিল। যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র তাঁর অনেককালের সাথী সঞ্জয়কে বললেন—আমাকে অনুমতি দাও ভাই। আমার মনটাও ভাল নেই, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, কথাও বলতে পারছি না। বুড়ো বয়সে বেশি কথা বললেও কষ্ট হয়—বয়সা চ প্রকৃষ্টেন বাগ্-ব্যায়ামেন চৈব হ। ধৃতরাষ্ট্র আর দাঁড়াতে পারলেন না, গান্ধারীর পিঠে হাত রেখে তিনি একটা অবলম্বন খুঁজলেন। কিন্তু তাতেও কিছু হল না। সংজ্ঞাহীন মানুষের মতো গান্ধারীর পিঠে হাত রেখে তিনি বসে পড়লেন আবার।
যুধিষ্ঠির তাঁকে দেখে খুব কষ্ট পেলেন। ভাবলেন—যাঁর গায়ে একশো হাতির বল, তিনি এমন করে ভেঙে পড়েন কী করে। ধৃতরাষ্ট্রের অবস্থা দেখে চিন্তাকুল ধর্মরাজ সঙ্গে সঙ্গে একটি জলপাত্রের মধ্যে হাত ডুবিয়ে সেই জলস্নিগ্ধ হাতখানি দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের মুখে বুকে শীতল স্পর্শ দিলেন—উরো সুখং চ শনকৈ… জলশীতেন পাণ্ডবঃ। সামান্য সংজ্ঞা ফিরে আসতেই ধৃতরাষ্ট্র আস্তে আস্তে যুধিষ্ঠিরের হাতখানি ধরলেন আলতো করে। স্নিগ্ধ মধুর আর্তিতে বললেন—তোমার এই হাতখানি দিয়ে আমায় স্পর্শ করো বাবা! আমাকে আলিঙ্গন করো—স্পৃশ মাং পাণিনা ভূয়ঃ পরিষ্বজ চ পাণ্ডব। তোমার এই স্নিগ্ধ করস্পর্শেই আমি যেন বেঁচে আছি, বাছা! একবার তোমার মস্তক আঘ্রাণ করতে চাই, তুমি আমার কাছে এসো।
আগেই বলেছি—সমগ্র মহাভারত খুঁজলে ধৃতরাষ্ট্রের মতো এমন স্নেহপ্রবণ ব্যক্তি দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে না। এমন স্নেহময় পিতা আমি বাস্তব জীবনেও দেখেছি। এমন পিতা, যিনি পুত্রের কষ্ট হবে বলে ধুঁকতে ধুঁকতে বাজার যান। এমন পিতা, যিনি পুত্রের কষ্ট হবে বলে তাকে পরিশ্রমের চাকরি করতে দেন না। এমন পিতা, যিনি পক্ষীর অধিক ভালবাসায় এক সময় পুত্রকে ঠুকরে বার করে দেন না কর্মময় পন্থায়। আমরা জানি—এমন স্নেহও এক রিপুর মতো, কিন্তু যিনি এই স্নেহধারার আধার, সেই স্নিগ্ধ প্রস্রবণটিকে আমরা কেমন করে দোষ দিই। অন্তত দুর্যোধনের দিক থেকে দেখলে এমন স্নেহান্ধ পিতাকে কি মায়া না করে পারা যায়?
এখনও দেখুন, এই অরণ্য-গমনের প্রাকমুহূর্তে যুধিষ্ঠিরকে কী অসীম মায়ায় বেঁধে ফেলেছেন তিনি। জ্যেষ্ঠ পিতার কথামতো যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রের গায়ে হাত বুলোলেন, তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন সর্বাঙ্গে। আর জ্যেষ্ঠ পিতা! ছোট্ট শিশুর মতো তিনি যুধিষ্ঠিরের মস্তক আঘ্রাণ করে জড়িয়ে ধরলেন যুধিষ্ঠিরকে—বাহুভ্যাং সম্পরিষ্বজ্য মূধ্ন্যজিঘ্রত পাণ্ডবম্। ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয়ে চিরন্তনী স্বত-উৎসারিত স্নেহের ধারায় সিক্ত হয়ে গেলেন যুধিষ্ঠির! সেই কবে তাঁর পিতা স্বর্গত হয়েছেন। তদবধি এমন শিশুর মতো কেউ তাঁকে জড়িয়ে ধরেনি। ধৃতরাষ্ট্র বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃশ, বিবর্ণ হয়ে গেছেন। তার মধ্যে বানপ্রস্থের প্রথম প্রস্থে আজ সকাল থেকে উপবাস করে আছেন তিনি। দেহটি অস্থিচর্মসার অনুজ্জ্বল হয়ে গেছে—উপবাস-পরিশ্রান্তং ত্বগস্থিপরিবারণম্।
যুধিষ্ঠির কেঁদে বললেন—আপনি যা চাইছেন, তাই না হয় হবে। আপনার অপ্রিয় কাজ করে এই পৃথিবীও ভোগ করতে চাই না আমি। আপনি বনে যেতে চাইছেন, আমি আর কী করে মানা করব। কিন্তু আপনি এবেলার মতো স্নান-ভোজন করে যান অন্তত, সেটাই আমার কাছে এখন অনেক কিছু—ক্রিয়তাং তাবদাহারস্ততো বেৎস্যাম্যহং পরম। যুধিষ্ঠির অনুরোধ উপরোধ করছেন ধৃতরাষ্ট্রকে—এই অবস্থায় দ্বৈপায়ন ব্যাস এসে উপস্থিত হলেন সেইখানে। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর আত্মজ পুত্র, এত স্নেহান্ধ হয়ে থেকে অনেক কষ্ট পেয়েছেন তাঁর এই পুত্রটি। আজ তিনি তাঁকে মুমুক্ষুত্ব এবং বৈরাগ্যের পথে নিয়ে যেতে এসেছেন। বহুকাল আগে এইভাবে তিনি জননী সত্যবতী এবং তাঁর সন্তানধারিণী দুই পুত্রবধূ অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে এইভাবেই অরণ্যের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ আবার তিনি এসেছেন মায়াচ্ছন্ন পুত্রটিকে মোক্ষের পথ দেখাতে।
ব্যাসই যুধিষ্ঠিরকে বোঝালেন ধৃতরাষ্ট্রকে ছেড়ে দেবার জন্য। এতকাল এই সংসারে বসে কুরুবাড়ির নানান কুটিল রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে জড়িয়ে ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। ব্যাস তা মনে মনে পছন্দ করেননি। মায়ার এই সুদৃঢ় বন্ধন ধৃতরাষ্ট্র এতকাল কাটাতে পারেননি। আজ যখন এই সুমতি হয়েছে, ব্যাস তখন যুধিষ্ঠিরকে অনুরোধ করেছেন—এবার এঁকে ছেড়ে দাও যুধিষ্ঠির, এই রাজধানীতে বসে এক রাজর্ষির মরণ শোভা পায় না—অনুজ্ঞাং লভতাং রাজা মা বৃথেহ মরিষ্যতি। যুধিষ্ঠির বুঝেছেন। কিন্তু শত বুঝেও আবারও সেই বলেছেন—তবু আপনাকে আজ খেয়ে যেতে হবে, তারপর আপনি গমন করুন আপনার অরণ্য-আশ্রয়ে—ক্রিয়তাং তাবদাহারস্ততো গচ্ছাশ্রয়ং প্রতি।
ধৃতরাষ্ট্র আর না করতে পারলেন না। আপন ভুবনে গিয়ে সন্ধ্যাআহ্নিক সেরে খেতে বসলেন। বধূরা তাঁকে পরিতৃপ্ত করে খাওয়ালেন এবং একই সঙ্গে বিদুর-সঞ্জয়-যুধিষ্ঠিররাও সেদিন শেষ আহার করলেন ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে। বনে যাবার আগে ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যের মঙ্গলের জন্য অনেক সদুপদেশ দিলেন যুধিষ্ঠিরকে এবং সেই উপদেশগুলি রাজনীতিশাস্ত্রের পরিসর। রাষ্ট্রের সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতা বিবৃত করে ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে নিয়ে অন্তঃপুর থেকে রাজপথে এসে পড়লেন।
ধৃতরাষ্ট্র বনগমন করছেন—এ কথা আগেই চাউর হয়ে গিয়েছিল। রাজপথ তখন জনপথে পরিণত হয়েছে। চতুবর্ণের সমস্ত মানুষ আজ একত্র হয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে শেষ অভিবাদন জানাবার জন্য। ধৃতরাষ্ট্র পৌর-জনপদবাসী সবার কাছে হাত জোড় করে অনুমতি চাইলেন যাবার জন্য। দুর্গপ্রতিম হস্তিনাপুরীর অন্যতম প্রধান দ্বার বর্ধমান। সেই বর্ধমান পুরদ্বার দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র রওনা হলেন বনের পথে। পথ লোকে লোকারণ্য। ধৃতরাষ্ট্রের বনযাত্রার সঙ্গী হয়েছেন বিদুর এবং সঞ্জয়। গান্ধারীর সঙ্গে চলেছেন কুন্তী। যুধিষ্ঠির যা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, সেই ঘটনাও ঘটল যখন কুন্তী বললেন—তিনিও বনে যেতে চান ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সেবা করার জন্য। যুধিষ্ঠিররা পাঁচ ভাই জননীর কাছে করুণ আবেদন করেছেন ফিরে আসার জন্য। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রও গান্ধারীর মাধ্যমে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু কুন্তী শোনেননি। অতএব ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও চারটি প্রাণী হস্তিনাপুর ছেড়ে বনের পথে পা বাড়ালেন।
এই দিনটি ছিল কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথি। ধৃতরাষ্ট্র বনে যাবার আগে পিতৃপুরুষ এবং পুত্রদের শ্রাদ্ধক্রিয়া করে নিজের এবং গান্ধারীরও শ্রাদ্ধক্রিয়া সমাপন করেছিলেন। সেকালে এমন অনেকেই করতেন। বনের পথে যাবার সময় কুন্তী, গান্ধারী এবং ধৃতরাষ্ট্রের যাত্রাদৃশ্যটি চিত্রপটে আঁকা যায়। যূথবদ্ধ হাতিরা যেমন একজন আরেকজনের পিঠে শুঁড় রেখে চলতে থাকে তেমনই কুন্তী পথ দেখিয়ে চলেছেন সবার আগে, তাঁর পিঠে হাত রেখেছেন কাপড় দিয়ে চোখ বাঁধা গান্ধারী আর তাঁর পিঠে হাত রেখে যাচ্ছেন অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র। বনবাসের প্রথম রাত্রিটি কেটে গেল ভাগীরথীর তীরে কুশশয্যার শয়নে। মহামতি বিদুরই বলেছিলেন—সেদিনটা ওইখানেই কাটাতে। পরের দিন গঙ্গা পার হয়ে বানপ্রস্থী ধৃতরাষ্ট্র এসে পৌঁছোলেন মহর্ষি শতযূপের আশ্রমে। তারপর সেখান থেকে বনে বনান্তরে।
এখনও ধৃতরাষ্ট্রের হদিস পাওয়া যায়। যুধিষ্ঠির একদিন সবাইকে নিয়ে এসে দেখে গেছেন ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্যদের। এই বৃদ্ধ বয়সেও ধৃতরাষ্ট্রের তপশ্চর্যার শক্তি দেখে তাঁরা অবাক হয়ে গেছেন। যুধিষ্ঠির তখনও সপরিবারে বনেই রয়েছেন, এইরকমই একটা সময়ে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এলেন পুত্রের সঙ্গে দেখা করতে। এরইমধ্যে বিদুর যোগবলে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন—সে কথা ব্যাসের কানে পৌঁছেছে এবং যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে সেই মহান দৃশ্য দেখেওছেন।
ব্যাস এসেছেন তাঁর পুত্রের খবর নিতে। বনবাসে ধৃতরাষ্ট্রের মন লেগেছে কি না অথবা এখনও কি মৃত পুত্রদের জন্য তাঁর মন হাহাকার করে ওঠে—কচ্চিদ্ হৃদি ন তে শোকো রাজন্ পুত্ৰবিনাশজঃ? ব্যাস কিন্তু বুঝেছেন—ধৃতরাষ্ট্র তাঁর অন্য ছেলেগুলির মতো নয়। ধৃতরাষ্ট্র স্নেহে পাগল। বনবাসে এলেও তিনি তাঁর পূর্বকথা ভুলতে পারছেন না। ব্যাস অনুগ্রহ করে বলেছেন—যদি তোমার কোনও দুঃখ থাকে, কোনও কামনা থাকে তবে তোমার দুঃখের নিরসন ঘটিয়ে সে কামনা পূরণ করব আমি—প্রবণো’স্মি বরং দাতুং পশ্য সে তপস্যঃ ফলম্।
ধৃতরাষ্ট্র লুকোননি। এত যে তিনি তপস্যা করছেন, এত যে কৃচ্ছ্রসাধন করছেন এবং এত কিছু উপায়ে এত যে ভুলে থাকার চেষ্টা করছেন, তবু কেমন নিজের অলস অন্তরালে সেই দুষ্ট পুত্রটির কথা তাঁর মনে পড়ে। ব্যাসকে তিনি কথাটা বলেছেন বেশ ঘুরিয়ে। বলেছেন—পরলোকে আমার গতি কী হবে, তা নিয়ে আমার আর ভয় নেই, পিতা! তবে আমার সেই দুষ্টচেতা মন্দবুদ্ধি পুত্রটি, যার জন্য পাণ্ডব-ভাইরা প্রত্যেকে কষ্ট পেয়েছে, যার জন্য নানা রাজ্যের রাজারা যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই পাপবুদ্ধি ছেলেটির জন্য মনে আমার এখনও কষ্ট আছে, পিতা—দূয়তে মে মনো নিত্যং স্মরতঃ পুত্ৰগৃদ্ধিনঃ। ধৃতরাষ্ট্র ঘুরিয়ে বলেছেন—ভীষ্ম, দ্রোণ এবং আরও অন্যান্য রাজারা আমারই পুত্রের কারণে আজ স্বৰ্গত হয়েছেন। আমি এঁদের সবাইকে দেখতে চাই, পিতা।
ধৃতরাষ্ট্র ইচ্ছাটা প্রকাশ করলেন সবাইকে জড়িয়ে নিয়ে। কিন্তু গান্ধারী এই পুত্রবৎসল পিতাটিকে চেনেন। তিনি একেবারে পরিষ্কার করে বললেন—আজকে ষোলো বচ্ছর কেটে গেছে, মুনিবর। দুর্যোধনের মৃত্যুর পর ষোলো বচ্ছর কেটে গেছে—ষোড়শেমানি বর্ষাণি গতানি মুনিপুঙ্গব। কিন্তু আজও ইনি পুত্রশোক ভুলতে পারেননি। সারাটা দিন হা-হুতাশ করে তাঁর কেটে যায়, আর রাত্রেও ইনি ঘুমোতে পারেন না পুত্রশোকের জ্বালায়—ন শেতে বসতীঃ সর্বাঃ ধৃতরাষ্ট্ৰো মহামুনে।
ব্যাস বুঝেছিলেন, যে, ধৃতরাষ্ট্র এই অরণ্যবাসে এসেও পুত্রের জন্য কষ্ট পান। তিনি বড়ই কৃপাময়, আপন যোগবলে তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশয়ান ব্যক্তিদের ভাসিয়ে তুললেন জীবিত ধৃতরাষ্ট্রের সামনে। তাঁরা এলেন, সকলেই এলেন। দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পুত্রেরা, দ্রুপদ—সকলেই এলেন সবার চোখের সামনে। ধৃতরাষ্ট্র দিব্যচক্ষুতে সকলকে দেখতে পেলেন। নশ্বর পৃথিবীতে এঁদের পরস্পরের মধ্যে কত ক্রোধ ছিল, কত দ্বন্দ্ব ছিল। এখন এঁরা প্রত্যেকে পরস্পরের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। ধৃতরাষ্ট্র দেখতে পেলেন সবাইকে যেন পটে আঁকা ছবি—আশ্চর্যভূতং দদৃশে চিত্রং পটগতং যথা। ধৃতরাষ্ট্রের মন ভরে গেল আনন্দে। তাঁর আর কোনও কষ্ট নেই। এখন তিনি স্বচ্ছন্দে তপস্যায় মনোনিবেশ করতে পারবেন।
এই ঘটনার পর আরও দুটি বৎসর বেঁচেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। এরপরে যুধিষ্ঠিরও ধৃতরাষ্ট্রের খবর পাননি ভাল করে। হয়তো এ বন সে বন ঘুরতে ঘুরতে ধৃতরাষ্ট্র একদিন পাণ্ডবদের দৃষ্টি এবং সংবাদের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। দু’বছর পর—দ্বিবর্ষোপনিবৃত্তেযু—নারদ এসে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে শেষ সংবাদ জানালেন ধৃতরাষ্ট্রের। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী এবং সঞ্জয় তখন কুরুক্ষেত্রের অরণ্যভূমি হরদ্বার বা হরিদ্বারে (গঙ্গাদ্বার) চলে গেছেন কঠোর তপস্যা করতে। সেখানে একদিন গঙ্গায় স্নান করে উঠে ধৃতরাষ্ট্র আশ্রমের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই সময়ই টের পাওয়া গেল বনে আগুন লেগেছে। দাবানল। ভয়ংকর সে আগুন এগিয়ে আসছে ধৃতরাষ্ট্রের দিকে। আগুনের অবস্থিতি অনুভব করে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন—তুমি এক্ষুনি চলে যাও। ধৃতরাষ্ট্র বৃদ্ধ, উপরন্তু তপস্যার কাঠিন্যে একেবারে কৃশ হয়ে গেছেন—ত্বগস্থিসার। গান্ধারী-কুন্তীও তাই। তাঁদের কারোরই এমন শক্তি নেই যে, দৌড়ে পালিয়ে যাবেন বাঁচবার জন্য—অসমর্থো’পসরণে…মন্দপ্রাণ বিচেষ্টিতঃ।
ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে বললেন পালিয়ে যেতে, যেখানে আগুন নেই সেখানে—গচ্ছ সঞ্জয় যত্রাগ্নি র্ন ত্বাং দহতি কর্হিচিৎ। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে ফেলে যেতে চাননি, কিন্তু কী করবেন! সঞ্জয়কে এই দাবানলের বিপাক থেকে বাঁচাতেই হবে। ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন—যেভাবে হোক তুমি পালাও। এই অগ্নিতে মরণ আমাদের কাছে হীন নয়, কিছু অসহ্যও নয়। ধৃতরাষ্ট্র যোগবলে নিজের শরীরটিকে কাঠের মতো শক্ত করে ফেললেন—সন্নিরুধ্যেন্দ্রিয়গ্রামম্ আসীৎ কাষ্ঠোপমস্তদা। সঞ্জয় কোনওমতে পালান এবং দুরন্ত দাবানল গ্রাস করল ধৃতরাষ্ট্রের ‘কাষ্ঠোপম’ শরীর। তিনি স্বর্গত হলেন এবং তাঁরই সঙ্গে মারা গেলেন গান্ধারী এবং কুন্তী। ধৃতরাষ্ট্রের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কুরুরাজ্য থেকে এক মহান স্নেহশীল পিতার ইতিহাস লুপ্ত হয়ে গেল।
এই ইতিহাস শৌর্য বীর্যের ইতিহাস নয়, এই ইতিহাস সমাজসংস্কারের বা রাজনৈতিক সূক্ষ্মতার ইতিহাসও নয়। মহাকাব্যের একেকটি চরিত্রে যে নায়কোচিত উদাত্ত গুণ থাকে, তাও এই ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে নেই, এমনকী খলতা, ধূর্ততা, শঠতা—ইত্যাদি মন্দ গুণের কলুষ দিয়ে যদি বা কখনও ধৃতরাষ্ট্রের অন্তর খণ্ডিত করা যায়, তবু সেগুলি তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য রচনা করে না। ধৃতরাষ্ট্র-চরিত্রের আত্মা রচিত হয়েছে পুত্রস্নেহ দিয়ে। অখণ্ড, বাঁধভাঙা, অবুঝ স্নেহ, যেটাকে মহাকাব্যিক বৈশিষ্ট্যের বৈপরীত্যে ‘রিপু’ই বলতে হবে। কিন্তু তর্ক, যুক্তি বা বিচারের পরিসর ছেড়ে দিয়ে আমরা যদি এক পুত্রের মতো পিতা ধৃতরাষ্ট্রের দিকে তাকাই, তা হলে দেখবেন—তাঁর সমস্ত আপাতখলতা, শঠতা ধুয়েমুছে গেছে। তখন আপনার ইচ্ছে করবে—যুধিষ্ঠিরের মতো জলসিক্ত শীতল হাতখানি বৃদ্ধ পিতার কপালে রাখি, তাঁর শোকদিগ্ধ মায়াময় শরীর একবার অন্তত জড়িয়ে ধরি অথবা একবার কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মতো তাঁর মন্দবুদ্ধি মৃত পুত্রকে তাঁর সামনে এনে দিয়ে বলি—দেখো ধৃতরাষ্ট্র! তোমার ছেলে স্বর্গসুখে ভালই আছে। তুমি নিশ্চিন্তে মৃত্যু বরণ করো।