॥ ১ ॥
আজ থেকে ষাট-সত্তর বছর আগে পূর্ববঙ্গের এক গ্রামের বাড়িতে ঠাকুরদাদা মারা গেছেন। বসতবাড়ি ছাড়াও ঠাকুরদাদার ভূসম্পত্তি অনেক এবং সবই তাঁর দুই ছেলের মধ্যে ভাগ হবে। বড় ভাই এতকাল বাইরে বাইরে কাজ করতেন। কিন্তু বড় গিন্নি থাকতেন বাড়িতে। তাঁর ছেলেমেয়েও সেই বাড়িতে মানুষ হচ্ছে। ছোট ভাই বিবাহিত। তাঁরও ছেলেমেয়ে আছে। ছোট ভাইয়ের কর্মস্থল গ্রামের কাছাকাছি বলে তিনি বাড়িতেই থাকেন এবং সংসারের যত ঝুটঝামেলা—সে দাদার সংসারেই হোক, অথবা নিজের সংসারে—সবই তিনি পোয়ান। বড় গিন্নি মাটির মানুষ। অসামান্য তাঁর হৃদয়। ছোট দেবরটির ওপর তাঁর স্নেহ পুত্রস্নেহের চেয়েও বেশি এবং এই একান্নবর্তী পরিবারের সমস্ত সুখ দুঃখ, আশা আকাঙ্ক্ষা সবই তিনি ভাগ করে নেন ছোট দেবরটির সঙ্গে। বড় কথা হল—এই সংসারের সুখ এবং বোঝাপড়া অন্য অনেক পরিবারেরই ঈর্ষার কারণ।
এরই মধ্যে ঠাকুরদাদা মারা গেলেন এবং বড় ভাই বাড়ি ফিরলেন। প্রথম কদিন ভালই কাটল। তারপর এক এক করে নানারকমের ছোটখাটো স্বার্থ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হীনতা আঘাত হানতে আরম্ভ করল একান্নবর্তী পরিবারের গায়ে। বড় ভাই অনেক টাকা উপায় করেছেন, অতএব তাঁর বক্তব্য হল—আমার ছেলেপিলেরা এমন অনাদরে মানুষ হবে কেন? তারা দামি জামাকাপড় পরবে, ভাল খাবার খাবে এবং আরও ভালভাবে থাকবে। বড় গিন্নি খুব আপত্তি করেছিলেন। বলেছিলেন—ছোটর ছেলেপিলেরা এসব দেখলে কী ভাববে? ভাল জামাকাপড় পরাতে চাও তো ছোটর ছেলেপিলের জন্যও কিনে আনো, কে না করেছে? কর্তা বললেন—আমার অত টাকা নেই যে, দানছত্র করব। গিন্নি বললেন—তাই যদি হয়, তো নিজের ছেলেদের পিছনেও দানছত্রটি বন্ধ করো, তাতে তোমার আরও টাকা বাঁচবে, সংসারে সুখও থাকবে।
বড় ভাইয়ের রাগ আস্তে আস্তে চড়তে আরম্ভ করল। তারমধ্যে বড় গিন্নি যখন আবার ছোট দেবরটিকে ডেকে আলাদা করে ক্ষীর ননি খাওয়ান, কর্তার কেনা জামাকাপড় থেকে নতুন ধুতিটি কি চাদরটি দেবরকে দিয়ে দেন, তখন কর্তার রাগ আরও বাড়ে। বলেন—যত সব আদিখ্যেতা। ওকে অত মাথায় তোলার কী আছে। গিন্নি বলেন—ওগো তুমি যখন ছিলে না, তখন কে আমার সব কিছু করেছে, তুমি, না ছোট? সেই যেবার তোমার ছেলের ধুম জ্বর এল, তখন ডাক্তার-কবিরাজ, রাত জেগে বসে থাকা, কত্তামশায়ের সেবা করা—এ সব কে করেছে, তুমি, না ছোট? বড় ভাই রেগে বললেন—বেশি বাড়াবাড়ি কথা বলো না। আমি থাকলে আমি করতাম, আর ছোট না থাকলে পাড়ার লোকে করত। অসুখ, ডাক্তারবদ্যির জন্য পাড়ার লোকও দৌড়ায়, তার জন্য ওই অপকম্মাটিকে মাথায় তোলার নেই অত কিছু।
গিন্নি বললেন—মাথায় কেউ কাউকে তোলে না। সে নিজের কাজে, ত্যাগে, সহিষ্ণুতায় এই পরিবারের মাথায় উঠেছে, আমি তাকে মাথায় তুলিনি। আর এই যে তুমি! তোমাকে তো আমি মাথায় তুলিনি, তুমি আপন অহংকারে চেঁচিয়ে মেচিয়ে নিজেই আমাদের মাথায় চেপে বসছ। তবে তোমার মাথায় চাপা আর ছোটর মাথায় ওঠার তফাত আছে বিলক্ষণ।
এই পরিবারে সুখ শান্তি বেশিদিন টেকেনি। বড় ভাই হাঁড়িকুড়ি আলাদা করে নিয়েছিলেন। যে সংসারে ডাল রান্না করতে আগে একটি মাত্র শুকনো লঙ্কা লাগত, এখন সেখানে দুটি শুকনো লঙ্কা লাগে। কিন্তু এও খুব বড় কথা নয়। এখন বড় ভাইয়ের ছেলেরা তাদের খুড়তুতো ভাইদের দেখিয়ে দেখিয়ে নতুন জামাকাপড় পরে, দেখিয়ে দেখিয়ে ক্ষীর রাবড়ি খায়। পিতার করুণায় ছেলেদের মনে এবং মজ্জায় প্রবেশ করল হিংসা, লোভ অহংকার। ছোটভাই একদিন বাড়ি ঘরদোর দাদার কাছে বিক্রি করে দিয়ে ভিটেমাটি ছেড়ে চলে গেলেন অন্যত্র। যেদিন তিনি গেলেন, সেদিন বড় গিন্নি বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অশ্রুমোক্ষণ করলেন বারংবার। আশীর্বাদ করে বললেন—ছোট! যদি ভগবান থাকেন, যদি ধর্ম বলে কিছু থাকে, তবে কর্তা একদিন তোকে ডেকে এই বাড়িতে আনবেন। কিন্তু সেদিন যেন তুই আসিসনে, ভাই! আমার মাথা খা, সেদিন যেন তুই আসিসনে।
পরবর্তীকালে বড় গিন্নির কথা সত্যি করে দিয়ে বড় করুণ ঘটনা ঘটেছিল। বড় ভাইয়ের দুই ছেলে দিব্যি আড়ম্বরে মানুষ হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে শহুরে মেয়ে বিয়ে করে শহরের চালে চলে আর কখনও গ্রামের বাড়িতে আসেননি। বাবামা শহরে ছেলের বাড়িতে গিয়ে কিন্তু কিন্তু করে গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন আবার। শেষ বয়সে বড় ভাইয়ের কঠিন অসুখ করল। ডাক্তারবদ্যি, সেবাপথ্যি?—বুড়ো বড় গিন্নিই বা কত পারেন! শেষে বড় ভাই কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠি লিখলেন ছোট ভাইকে। ছোট ভাই খবর পাওয়ামাত্র ছেলেকে নিয়ে হাজির হলেন দাদার বাড়ি। বড় গিন্নি আবারও খুব কাঁদলেন। অনেক সেবাযত্নের পর বড় ভাই বেঁচে উঠলেন বটে, তবে কাজকর্ম করা, জমিজমা দেখা এ সবের ক্ষমতা রইল না আর।
ছোট ভাই বললেন—দাদা! আর কেন। আমারও তো ঘরসংসার রয়েছে। আর কতদিনই বা এখানে থাকব? তার চাইতে চলো আমার বাড়ি, সেখানে দাদাভাইয়ে মিলে শেষজীবন কাটিয়ে দেব। বড় ভাই বললেন—সে কেমন করে হয়? তোমার সংসারে অসুবিধে হবে না? তোমার ছেলেরা? ছোট ভাই বললেন—আমার বাড়ি যে তোমারই বাড়ি, দাদা! আর আমার ছেলেরা কি ওদের বড়মার ছেলে নয়।
বড় ভাই আর কথা বাড়াননি। কত্তাগিন্নি ছোট ভাইয়ের বাড়িতে এসে উঠলেন। ছোট গিন্নি বললেন—এতকাল রান্নাবাড়ি করেও তোমার দেওরটিকে সুখী করতে পারলাম না। খালি বলে—বউদিদি যা শুকতো রান্না করতেন! বউদিদি যা পায়েস রান্না করতেন! এবার তুমি এসেছ সব সামলাও।
মহাভারতের অন্যতম এক প্রধান চরিত্র ধৃতরাষ্ট্রের প্রসঙ্গে যাবার আগেই পূর্ববঙ্গের এই গ্রাম্য পরিবারের কাহিনী কেন বললাম, তার উত্তর মিলবে পরে।