ধর্ষণের সাথে পোশাকের সম্পর্ক
ধর্ষণের সাথে পোশাকের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা আলোচনা করার আগে, ধর্ষণ কী, তা একটু বুঝা জরুরি। ‘ধর্ষণ’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে যে-ছবিটি আসে, তা একটি অসহায় নারী ও একজন শক্তিমান পুরুষের। পরিস্থিতিভেদে পুরুষের সংখ্যা এক বা একাধিক হতে পারে। এ পুরুষেরা ধর্ষণ করার সময় নারীর শরীরকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপূর্বক দখলে নিয়ে থাকে। এ সময় নারীদেহটি আর নারীর থাকে না। সেটি হয়ে ওঠে ধর্ষকের সম্পত্তি। ধর্ষক পুরুষ তখন নারীটির শারীরিক সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে চরিতার্থ করতে থাকে নিজের সুখ।
তবে ধর্ষণ শুধু নারী-পুরুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। একজন দুর্বল পুরুষও একজন শক্তিমান পুরুষ দ্বারা ধর্ষণের শিকার হতে পারেন। সম্প্রতি আমরা জেনেছি যে, বাংলাদেশের কিছু মাদ্রাসায়, শক্তিমান পুরুষ শিক্ষকদের হাতে দুর্বল পুরুষ ছাত্ররা, অর্থাৎ শিশুরা, প্রায়ই ধর্ষণ বা বলাৎকারের শিকার হচ্ছে। শুধু মাদ্রাসা নয়, সমাজের অন্যান্য অংশেও এ ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। পার্থক্য হলো, ধর্ষণের পুরুষ ভিক্টিমরা অধিকাংশই শিশু, এবং এ শিশুরা কখনো ধর্ষণের ঘটনা কাউকে জানাতে চায় না। বাংলাদেশের আদালতগুলোতে কোনো ধর্ষিত পুরুষ মামলা দায়ের করেছে, এমন খবর সচরাচর শোনা যায় না। ফলে সমাজের একটি বড়ো অংশ ধরে নিয়েছে যে, ধর্ষণ শুধু নারীদের বেলায়ই ঘটে থাকে; পুরুষদের বেলায় নয়।
কিন্তু ‘ধর্ষণের পেছনে পোশাক দায়ী’– এ তর্কটি কেবল নারীদের বেলায়ই উঠে থাকে। ধর্ষণের পুরুষ ভিক্টিমদের বেলায় এ তর্কটি কখনো ওঠে না। মাদ্রাসার কোনো ছাত্রের পোশাক তার শিক্ষককে আকৃষ্ট করেছে, এমন দাবি কখনো শুনিনি। কেউ যদি বলতো, এই এই পোশাক পরলে শিশুরা আর বলাৎকারের শিকার হবে না, তাহলে কিছু বিষয় বুঝতে আমার খুব সুবিধা হতো। যেহেতু সমাজ কেবল নারীর পোশাকের সাথেই ধর্ষণের সম্পর্ক খুঁজছে, পুরুষ বা শিশুর পোশাকের সাথে তা খুঁজছে না, তাই আমি এ আলোচনাকে কেবল নারীর পোশাকের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ রাখবো।
কিছুদিন আগে এ বিষয়ে আমি পাঠকদের কাছে মতামত জানতে চেয়েছিলাম। তাদেরকে প্রশ্ন করেছিলাম, ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাক দায়ী, এমনটি কারা কারা মনে করেন, এবং কেন মনে করেন?
প্রায় ২৫০ জন নারী-পুরুষ ফেসবুক কমেন্ট ও মেসেজে আমাকে তাদের মতামত জানিয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন পোশাক দায়ী, কেউ কেউ বলেছেন পোশাক দায়ী নয়। অনেকে বলেছেন— ধর্ষণের বহু কারণের মধ্যে পোশাকও একটি কারণ। কয়েকজন মেসেজে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও বর্ণনা করেছেন। একজন নারী তার নিজের ধর্ষণের ঘটনা বিশদভাবে খুলে বলেছেন।
প্রশ্ন হলো, ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী বা পোশাকও একটি কারণ, এ দাবিটি কারা করে থাকে? কোনো ধর্ষক কখনো এমন দাবি করেছে কি না?
বাংলাদেশের আদালতে ফৌজদারি অপরাধের বিচার কাজ পরিচালনা করেন, এমন কয়েকজন বিচারক জানালেন— ‘আমরা অনেক ধর্ষণ মামলার আসামির জবানবন্দি নিয়েছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো আসামিকে বলতে শুনিনি, নারীর পোশাক দেখে সে ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।’
এখানে আমার নিজের অভিজ্ঞতাও একটু বলতে চাই। আমি ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বহু ধর্ষণ মামলার রায় পড়েছি। কোনো মামলাতেই এমন কিছু পাইনি যে, ধর্ষক কোনো নারীর পোশাক দেখে তার ওপর হামলে পড়েছেন। এমনকি প্রিভি কাউন্সিলের কোনো রায়েও এমনটি পাইনি।
সুতরাং বলা যায়, ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাক দায়ী, এ দাবিটি মূলত তাদের, যারা নিজেরা কখনো কোনো নারীকে ধর্ষণ করেননি। অর্থাৎ, যারা কখনো ডাকাতি করেননি, তারা অনুমান করছেন ডাকাতির কারণ। এ অনুমানে তারা বের করেছেন— গৃহস্থের ঘরের দেয়াল দুর্বল ছিলো বলেই ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গভীরভাবে কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, পৃথিবীর কোনো ঘরের দেয়ালই অভেদ্য নয়। হোয়াইট হাউস এবং ক্রেমলিনের দেয়ালও দুর্বল। কোনো দেয়াল শক্ত কি না, এটি মূলত নির্ভর করে ডাকাতদের হাতে থাকা দেয়াল ভাঙার প্রযুক্তির ওপর।
শুধু সাধারণ মানুষই যে ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাককে দায়ী করেন, ব্যাপারটি এমন নয়। সমাজে যাদের ‘অসাধারণ’ মানুষ ধরা হয়, তাদেরও একটি বড়ো অংশ এমন মনে করে থাকেন।
১৯৯৬ সালে ভারতীয় বিচারকদের ভেতর একটি জরিপ চালানো হয়েছিলো, যেখানে ৬৮ শতাংশ বিচারক মতামত দিয়েছিলেন যে, নারীদের পোশাক পুরুষদেরকে ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ করে থাকে।
এখানে একটি বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। ১৯৯৬ সালে ভারতের বিচার বিভাগে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ছিলো না বললেই চলে। ফলে, এ ৬৮ শতাংশ বিচারকের মতামত মূলত পুরুষ বিচারকদের মতামত। জরিপে অংশগ্রহণকারী বিচারকদের ৫০ শতাংশ যদি নারী হতেন, তাহলে জরিপের ফলাফল একই রকম হতো বলে মনে করি না।
তবে একটি ব্যাপার এখানেও সত্য, জরিপে অংশগ্রহণকারী বিচারকদের কারোরই ধর্ষণের অভিজ্ঞতা নেই। আমি বলছি না যে ধর্ষণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য ধর্ষণের অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন, কিন্তু এ বিষয়টি খেয়াল না রাখলে আমার পরবর্তী আলোচনা বুঝতে অসুবিধা হবে।
প্রশ্ন হলো, পোশাক কীভাবে একজন নারীকে ধর্ষকের কাছে আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপন করে? বা আদৌ করে কি না? এখানে লক্ষ রাখা দরকার, ধর্ষণ করেন এমন পুরুষের সংখ্যা সমাজের মোট পুরুষ-সংখ্যার এক শতাংশেরও কম হবে। অর্থাৎ, সব পুরুষই ধর্ষণ করেন না, কেউ কেউ করেন। যদি নারীদের পোশাক ধর্ষণের পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতো, তাহলে সমাজে ধর্ষকের সংখ্যাটি অনেক বেশি হতো।
ধরা যাক কোনো নারী ‘অসামাজিক’ পোশাক পরে বাইরে বের হয়েছেন। ‘অসামাজিক’ বলতে আমি বুঝাচ্ছি এমন পোশাক, যা সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাছে ‘গ্রহণযোগ্য’ নয়, এবং যা কোনো পুরুষের মনে কাম আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে পারে। ‘সমাজ’ একটি সীমাবদ্ধ ধারণা, কারণ এটি ভৌগোলিকভাবে সার্বজনীন নয়। চীনে যা সামাজিক পোশাক, বাংলাদেশে তা অসামাজিক। আবার বাংলাদেশে যা সামাজিক পোশাক, চীনে তা অসামাজিক। অর্থাৎ, পোশাকের একটি সামাজিক সীমা আছে, যা নির্ধারিত হয় ওই সমাজের সংস্কৃতি ও বাসিন্দাদের আবেগ দ্বারা।
আবার কোনো কোনো সমাজে এটি নির্ধারিত হয় ধর্ম দ্বারা। কিন্তু ধর্ষণের ধরনের কোনো ভৌগোলিক সীমা নেই। পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলে ধর্ষণের ধরন মোটামুটি একই। ধর্ষণের সময় একজন ভারতীয় ধর্ষক যা করেন, একজন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্ষকও তাই করেন। যদিও তাদের দুজনের সমাজ এক নয়।
ফলে বলা যায়, ধর্ষিত নারীর পোশাক সমাজভেদে ভিন্ন হলেও ধর্ষণের মূল রূপ সব সমাজে একই। ধর্ষণের সংজ্ঞার দিকে তাকালেও এটি টের পাওয়া যায়। যুক্তরাজ্যের ‘সেক্সুয়াল অফেন্স অ্যাক্ট ২০০৩’ অনুযায়ী, কোনো মানুষ (ধরা যাক তার নাম A) ধর্ষণের অপরাধে দোষী হবেন যদি তিনি:
(ক) অন্য কোনো মানুষের (ধরা যাক তার নাম B) ভ্যাজাইনা, এনাস, অথবা মুখের ভেতর তার পেনিস প্রবেশ করান; এবং
(খ) এ কাজে B-এর সম্মতি ছিলো না; এবং
(গ) B সম্মতি দিয়েছে, এমন মনে করার কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ A- এর ছিলো না।
পৃথিবীর সব ভৌগোলিক অঞ্চলেই ধর্ষণের মূল সংজ্ঞা (এক্টাস রয়স ও মেনস রিয়া) যুক্তরাজ্যের সংজ্ঞার অনুরূপ, অথবা কাছাকাছি। শুধু আমেরিকার চেয়ে উন্নত একটি দেশে, এ সংজ্ঞায় ‘প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করিয়া’ নামক একটি বাক্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ নামক একটি উদ্ভট প্রথা চালু করেছে। এ ব্যতিক্রমটি, আর কিছু আরব ও আফ্রিকান দেশ বাদ দিলে, সব গণতান্ত্রিক দেশেই ধর্ষণের সংজ্ঞা মোটামুটি এক।
কোনো দেশই ধর্ষণের সংজ্ঞায় উল্লেখ করেনি যে- ‘অসামাজিক’ পোশাক পরা নারীর ক্ষেত্রে ‘বলপূর্বক সঙ্গম’-এ নারীটির সম্মতি রয়েছে, এমনটি ধরে নেওয়া যাবে। লক্ষ করুন, কানসেন্ট বা সম্মতি প্রতিষ্ঠার ‘ল অব এভিডেন্স’ আমি এখানে আলোচনা করছি না।
অর্থাৎ, আইনপ্রণেতারাও, ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাক দায়ী — এরকম কোনো মনোভাব দেখাননি। একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত বিজেপির উগ্র হিন্দুবাদী এমপি বানওয়ারি লাল সিংহল। দিল্লিতে গণধর্ষণের ঘটনার পর তিনি রাজস্থানে ইশকুলের মেয়েদের স্কার্ট পরা নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন। যদিও তার এ দাবি ধর্ষণ প্রসঙ্গে ছিলো না, ছিলো যৌন হয়রানি প্রসঙ্গে, তবুও গুরুত্ব বিবেচনায় উল্লেখ করলাম।
এবার আমি ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাক দায়ী— এ দাবির পেছনের কারণগুলো একটু খতিয়ে দেখতে চাই। প্রথমত, এ দাবিটি সাধারণত তুলে থাকে পুরুষরা। আবার কিছু দেশের আইনই এমন যে, রাষ্ট্র নিজেই ধর্ষণের জন্য নারীর পোশাককে দায়ী করে থাকে। রাষ্ট্র এ কাজ সরাসরি করে না, কিন্তু পরোক্ষভাবে করে। যেমন সৌদি আরব। ধর্ষিতা ভিক্টিমকে সেখানে পর্দাপ্রথা লঙ্ঘনের দায়ে শাস্তি দেওয়ার বিধান আছে। সৌদি গেজেট ২০০৯ সালে খবর প্রকাশ করেছিলো যে, গণধর্ষণের শিকার হওয়া এক নারীকে ১০০ ঘা চাবুক ও ১ বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। বহুল আলোচিত কাতিফ প্রদেশের ঘটনাটিতেও ধর্ষিতা ভিক্টিমকে ৯০ ঘা চাবুক এবং ৬ মাসের জেল দেওয়া হয়েছিলো (এ সাজা পরে দ্বিগুণ করা হয়েছিলো, যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সৌদি বাদশাহ তা বাতিল করেছিলেন)। ওই মেয়েটিকে ৬ জন সৌদি পুরুষ অপহরণপূর্বক ধর্ষণ করেছিলো। মেয়েটি ছিলো শিয়া সম্প্রদায়ের।
এ কারণে সৌদি আরবে, কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলেও তিনি মুখ খুলেন না। কারণ বিচার চাইতে গেলে দেখা যাবে, পর্দাপ্রথার ফাঁক-ফোকরে ফেলে উল্টো তাকেই চাবুক মারা হয়েছে, এবং ঢুকানো হয়েছে জেলে। ফলে, ঘোলা চোখে দেখলে মনে হবে— কঠোর আইনের কারণে সৌদিতে ধর্ষণ কম। কিন্তু তা সঠিক নয়। সৌদিতে বছরে পাঁচ হাজার ধর্ষণ হলেও কাগজপত্রে মনে হবে কয়েকটি।
সৌদি আরবের এমন মনোভাব সমগ্র মুসলিম বিশ্বেই কমবেশি ছড়িয়ে আছে। এ জন্য মুসলিম দেশগুলোতে ধর্ষণের জন্য ভিক্টিমকে দায়ী করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মুসলিমদের ধারণা, হিজাব বা বোরকা পরা থাকলে নারীরা ধর্ষিত হবেন না। কিন্তু কোনো হিজাব পরা নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন, তখন তারা পোশাককে দায়ী করতে চান না।
পোশাকের কারণে ধর্ষণ ঘটে বা ধর্ষণের পেছনে পোশাক একটি কারণ— এ তর্কের মূল উদ্ঘাটন করতে আমি এবার নারীদের শরীর থেকে পোশাক ফেলে দিতে চাই।
ধরা যাক, পৃথিবীতে কোনো পোশাকই নেই। এ অবস্থায় কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হবেন কি না? তর্কের দাবি অনুযায়ী, পোশাকহীন পৃথিবীতে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নাইজেরিয়ার কোমা সম্প্রদায়ের দিকে যদি আমি তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো কোমা সমাজে ধর্ষণ নেই বললেই চলে। সেখানে নারী-পুরুষ কেউই ‘পোশাক’ পরেন না। তাদের স্তন ও নিতম্ব অনাবৃত থাকে।
আপনি বলতে পারেন, কোমা সমাজে নারীদের ‘আকর্ষণীয় দেখায় না। তারা দেখতে কালো। এ জন্য তারা পোশাক না পরলেও ধর্ষিত হন না। হ্যাঁ, আপনার কাছে মনে হতে পারে তারা আকর্ষণীয় নন, কিন্তু তাদের সমাজে তারা একে অপরের কাছে আকর্ষণীয়। না হলে তারা বিলুপ্ত হয়ে যেতো। আর বাংলাদেশ ও ভারতের বহু নারীর চেয়ে কোমা নারীদের শারীরিক গঠন নান্দনিক। কিন্তু কোমা পুরুষেরা তাদের ধর্ষণ করছে না।
পোশাকহীন নারীদের এবার ধীরে ধীরে পোশাক পরানো যাক। প্ৰথমে শর্ট প্যান্ট, ব্রা, টাইট ব্লাউজ, প্যান্টি ইত্যাদি; যেরকমটি আমরা পশ্চিমা সমাজের কোনো সমুদ্র সৈকতে গেলে দেখে থাকি। কোনো সমাজে এর চেয়ে খোলামেলা পোশাক আর হতে পারে না। তবে শুধু পশ্চিমা সমাজ নয়, দুবাইয়ের সৈকতেও আমি এমন পোশাক পরা নারী দেখেছি। এ নারীরা দেখতে আকর্ষণীয়। তাদের শরীর সুগঠিত। চেহারা ফর্সা। অর্থাৎ যা যা দেখলে একজন পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে, তার সবই এ নারীদের মধ্যে উপস্থিত। বহু পুরুষ গোপনে তাদের ছবি তুলে থাকে। তারা যখন সাগরে সাঁতার কাটেন, তখন অনেক পুরুষ তাদের দেখার জন্য এমনি এমনি পানির নিচে ডুব দিয়ে থাকে। কিন্তু সৈকতে, এমন পোশাক পরা নারীদের কেউ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন— এমনটি সচরাচর শোনা যায় না। যদিও গত সপ্তাহে (জুলাই, ২০২১), এরকম একটি ঘটনা যুক্তরাজ্যের বনমাথ বিচে ঘটেছে। এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত যুবক, পানিতে খেলতে থাকা একটি মেয়েকে কথা বলতে বলতে হঠাৎ টান মেরে সাগরের একটু গভীরে নিয়ে যায়, এবং পানিতেই তাকে ধর্ষণ করে। ভিক্টিমের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ ছেলেটিকে এখন খুঁজছে।
আমি চীন ও তাইওয়ানের রাস্তায় খুব খোলামেলা পোশাক পরা মেয়ে দেখেছি। এরা পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়েও খোলামেলা পোশাক পরে থাকে। শুধু উরু নয়, অনেকের নিতম্বের তলদেশ পর্যন্ত অনাবৃত থাকে। কিন্তু এমন অবস্থায় রাস্তাঘাটে এরা কেউ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এরকমটি কখনো শুনিনি।
কয়েকটি দেশে আমি মেয়েদের সাথে ‘মিক্সড ডরমেটোরি’-তে থেকেছি। এমনও হয়েছে— আমি দোতলা খাটের নিচতলায় ঘুমিয়েছি, আর উপরতলায় ঘুমিয়েছে কোনো আমেরিকান বা জার্মান তরুণী। দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। পোশাকও খোলামেলা। বাংলাদেশের সিনেমা-নাটকের কেউ এ সৌন্দর্যের ধারে-কাছে আসতে পারবে না। হাত বাড়ালেই তার শরীর নাগাল পাওয়া যায়। কিন্তু হাত বাড়ানোর কথা কখনো ভাবতেও পারিনি। কারণ আমি জানি যে, মেয়েটির সম্মতি ব্যতীত কিছু করে আমি পার পাবো না। আমার পাঠকদের মধ্যে এমন অনেকেই হয়তো আছেন, যাদের এরকম অভিজ্ঞতা রয়েছে।
প্রশ্ন হলো, তাহলে ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাক দায়ী বা পোশাক একটি কারণ— এমন দাবি সমাজে উঠছে কেন? এর উত্তরে আমি বলবো, সাধারণ যৌন আকাঙ্ক্ষাকে ধর্ষণের সাথে গুলিয়ে ফেলার ফলেই এমন দাবি উঠছে। এটি একটি সামাজিক ভুল। সমাজভেদে কিছু পোশাক নারীদেরকে পুরুষদের সামনে আকর্ষণীয় হিশেবে উপস্থাপন করতে পারে। তবে এ ক্ষমতা যতোটা না পোশাকের, তার চেয়েও বেশি শরীরের। নোংরা শরীরের, কঙ্কালসার, দরিদ্র কোনো নারী, যতোই আকর্ষণীয় পোশাক পরুক না কেন, তাকে দেখে কোনো পুরুষের কাম জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু একই পোশাক, স্বাস্থ্যবান, সুগঠিত শরীরের কোনো নারী পরলে, তাকে দেখে কাম জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। হাজার হাজার বছর ধরে নারী- পুরুষেরা সমাজে, পরস্পরের প্রতি এ আকর্ষণ বজায় রেখেছে বলেই মানুষ টিকে আছে। এটুকু না থাকলে মানুষ পরিবার গঠন করতে আগ্রহ পেতো না।
সাধারণ পুরুষরা ভাবছে, ‘কারও শরীর দেখা গেলে বা শরীরের গড়ন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেলে আমাদের যেহেতু কাম জাগে’, সেহেতু ধর্ষকদেরও নিশ্চয়ই একই প্রক্রিয়ায় কাম জাগে!
ভুলটা এখানেই, এবং এ ভুল শুধু ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজেই সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমা সমাজেও এ ধারণা কমবেশি চালু আছে। ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের পুরুষদের মাঝে ‘দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ পত্রিকা এ বিষয়ে একটি জরিপ করেছিলো। ৫৫ শতাংশ পুরুষ দাবি করেছিলো, নারীরা যতো বেশি শরীর উদোম করা পোশাক পরবে, ততো বেশি তারা যৌন হয়রানির শিকার হবে।
তবে এ ক্ষেত্রেও জরিপে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের যদি জিগ্যেস করা হতো শরীর উদোম করা পোশাক দেখে আপনি কোনো নারীকে কখনো যৌন হয়রানি বা ধর্ষণ করেছেন কি না? তাহলে অধিকাংশই উত্তর দিতেন- না, আমি করিনি। অর্থাৎ, সমাজের বাসিন্দাদের সাধারণ যৌন আকর্ষণবোধকে ধর্ষকের যৌন আকর্ষণবোধের সাথে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। ফলে ধর্ষণের পেছনে নারীর পোশাক দায়ী, বা পোশাক একটি কারণ, এ তর্ক সমাজে জীবিত থাকছে।
আবার অনেকের ধারণা, কোনো নারী শরীর-উদোম করা পোশাক পরছেন, এর অর্থ হলো, তিনি কোনো পুরুষের সাথে মিলিত হতে চাচ্ছেন। অবশ্যই কোনো পুরুষের সাথে তার মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, কিন্তু সে-পুরুষটি তো যেকোনো পুরুষ নন। তিনি মিলিত হতে চান তার পছন্দের পুরুষের সঙ্গে।
তাকে দেখে যদি মনে হয় যে, তার পছন্দের পুরুষ হওয়ার সক্ষমতা আপনারও আছে, বা তাকে আপনি একান্ত সান্নিধ্যে পেতে ইচ্ছুক, তাহলে আপনার ভালো লাগার কথা তাকে জানান। পুরুষরা শতো শতো বছর ধরে এ প্রক্রিয়াতেই নারীদেরকে প্রেম নিবেদন করে আসছে। কিন্তু প্রেমের কোনো চেষ্টা না করে জোর করে নারীটির শরীর দখলে নিতে হবে, এমন চিন্তাই ধর্ষণের মূল কারণ (রক্ষণশীল ধর্মীয় সমাজের ক্ষেত্রে ‘প্রেম’ শব্দটির জায়গায় ‘বিয়ে’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে)।
প্রশ্ন আসতে পারে, কোনো নারী শরীর-উদোম করা পোশাক না পরেও পুরুষদের মনে যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে পারে কি না? এখানে আমার উত্তর হলো, পারে। যৌন আকাঙ্ক্ষা একেক সমাজে একেকভাবে তৈরি হয়। ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজে ‘শালীন’ বা ‘ধর্মীয়’ পোশাক পরেও একজন নারী পুরুষদের মনে যৌন আকাঙ্ক্ষা তৈরি করতে পারেন। এখানেও একটি ব্যাপারে আমরা ভুল করে থাকি। আমরা ধরেই নিই যে, কেবল কোনো নারীর দিকে তাকালেই আমাদের যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগে। আসলে তা নয়। কোনো নারীকে না দেখেও একজন পুরুষের মনে যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগতে পারে। কল্পনা ও পূর্ব অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে বড়ো ভূমিকা রাখে। এটি একটি সাবজেক্টিভ মেন্টাল কনস্ট্রাক্ট। একেক ব্যক্তির মনে এটি একেকভাবে ঘটে।
ফলে, বোরকা বা শালীন পোশাক পরেও একজন নারী ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির শিকার হতে পারেন। যেমন মিসরে ধর্ষণের শিকার অধিকাংশ নারীর পরনেই বোরকা পাওয়া যায়। নাইজেরিয়ান মিলিটারির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে বুকো হারামের কবল থেকে উদ্ধার হওয়া নারীদের ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছিলো। এ নারীদের সবাই বোরকা পরা ছিলেন। আমি তাদের কয়েকজনের জবানবন্দি পড়েছিলাম, যা খুবই বিভীষিকাময়। মূলত তাদেরকে খাবার দেয়ার কথা বলে ধর্ষণ করা হতো। যারা ধর্ষিত হতেন, কেবল তারাই খাবার পেতেন।
ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী- এমন দাবির কয়েকটি দিক আমি উপরে দেখিয়েছি। তবে আরেকটি দিকও আপনাদের দেখাতে চাই। দিকটি হলো— ধর্মীয় পোশাকের প্রতি ধর্মপ্রচারকদের পক্ষপাতিত্ব। সমাজে ধর্মীয় পোশাককে প্রতিষ্ঠিত করার একটি উপায় হিশেবেও এমন দাবি ওঠানো হয়ে থাকে। ধর্মীয় পোশাক না পরলে নারীরা ধর্ষণের শিকার হবেন— এ বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারলে সমাজে ধর্মীয় পোশাককে সহজে প্রতিষ্ঠিত করা যায়। মুসলিম দেশসমূহে এরকম বার্তা খুবই কার্যকরী। এটি একসাথে পাঁচটি কাজ করে। এক— ধর্মীয় পোশাক না পরার কারণে নারীদেরকে লজ্জা দেওয়া; দুই— কেউ ধর্মীয় পোশাক না পরা অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হলে তাকে উদাহরণ হিশেবে ব্যবহার করা; তিন— ধর্ষকের অপরাধকে হালকা করে দেওয়া; চার— সমাজে ধর্মীয় পোশাক পরার উপকারিতা প্রচার করা; পাঁচ— ভবিষ্যৎ ধর্ষকদের জন্য একটি অজুহাত সৃষ্টি করা।
এ জন্য কেউ ‘ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী’ বা ‘পোশাক একটি কারণ’— এমনটি দাবি করলে, দাবিটি স্রেফ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে করা হচ্ছে কি না, এটিও আপনাদের মাথায় রাখা দরকার।
আমার মনে হয় এবার আমি আমার নিজস্ব ব্যাখ্যায় যেতে পারি। আমি মনে করি, ধর্ষণের মূল কারণ ক্ষমতার বৈষম্য। সমাজে দুই ধরনের ধর্ষক আছে। এক. যারা ধর্ষণ কী তা জানে না, দুই. যারা ধর্ষণ কী, তার শাস্তি কী, তার সবই জানে, কিন্তু তারপরও ধর্ষণ করে।
আমার পাশের গ্রামে একটি অমুসলিম পাড়া আছে। ওই পাড়ায় ধর্মীয় উৎসবের সময় আমাদের গ্রাম থেকে প্রতি বছর কয়েকজন যুবক যেতো, যাদের কাজ ছিলো– রাত গভীর হলে উপাসনালয়ের কাছ থেকে কোনো অমুসলিম মেয়েকে মুখ চেপে ধরে কোলে করে মাঠে নিয়ে আসা (এটি আমার শৈশবের ঘটনা, এখন এরকম হয় না)। লক্ষ করুন, উপাসনালয়ের আশেপাশে তখন মুসলিম পরিবারের মেয়েরাও থাকতো। কিন্তু কখনো কোনো মুসলিম পরিবারের মেয়েকে তারা তুলে আনতো না। এখানেই লুকিয়ে আছে ক্ষমতার ব্যাপারটি।
ওই গ্রামে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ফলে তাদের কোনো মেয়েকে তুলে আনলে তোলপাড় হয়ে যাবে— এ বোধ যুবকদের ছিলো। এ জন্য তারা সবসময় অমুসলিম মেয়েদের তুলে আনতো, এবং কয়েক ঘণ্টা পর ফেরত দিয়ে আসতো। সাধারণত কোনো মেয়ে প্রস্রাব করার জন্য উপাসনালয় বা ঘরের পেছনে গেলে এটি ঘটতো।
আমি এ যুবকদের কয়েকটি দলের সাথে কথা বলেছি, এবং কথা বলে বুঝেছি যে, ধর্ষণ কী, তা তারা জানে না। ধর্ষণের শাস্তি কী, এ ব্যাপারেও তাদের কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই। তারা শুধু জানে, যে-কাজের জন্য তারা মেয়েদেরকে উঠিয়ে আনে, সে-কাজটি গোপনে করতে হয়। কেউ দেখে ফেললে বিচার-শালিস বসতে পারে। অর্থাৎ অপরাধ-নিরোধক হিশেবে ‘ক্রিমিনাল ল’ বা ‘ফৌজদারি আইন’ এখানে কোনো ভূমিকা পালন করছে না।
তারা আরো একটি বিষয় আমাকে জানিয়েছে। মাঠে আনার পর মেয়েটি কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি করতো না। কারণ চিৎকার-চেঁচামেচি করলে মানুষ ঘটনাটি জেনে যাবে, এবং মানুষ জেনে গেলে মেয়েটির বিয়ে হবে না। মেয়েদের মাথায় এটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ধর্ষিতা মেয়ের বিয়ে এ সমাজে হয় না। ফলে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয়েও বছরের পর বছর চুপ করে থাকছে। এ জন্য যুবকেরা এটিকে স্বাভাবিক কাজ বলে ধরে নিয়েছে। তাদের ভেতর এ নিয়ে কোনো অপরাধবোধও নেই। তারা জানেই না যে এটি একটি অপরাধ। তারা শুধু জানে, এটি একটি বড়ো গুনাহ!
তারা আরো দাবি করেছে, অমুসলিম মেয়েরা নাকি মনে মনে চায় যে তাদের তুলে আনা হোক! আমি বললাম, তাহলে মুসলিম মেয়েরাও তো মনে মনে এরকম চায়, তাদের তোমরা তুলে আনো না কেন? এ ব্যাপারে তাদের উত্তর হলো, আমাদের জাতের কাউকে তুলে আনলে অসুবিধা আছে, কিন্তু ওই মেয়েদের কাউকে তুলে আনলে বিপদ নেই। কেউ দেখে ফেললেও সমস্যা নেই। ওরা আমাদের কিছু করতে পারবে না।
অর্থাৎ, বিপদে না পড়ার সম্ভাবনাটি এখানে বড়ো কারণ। ধর্ষণ তখনই ঘটে, যখন ধর্ষক বুঝতে পারে যে ধর্ষণ করার পরও সে নিরাপদে থাকবে। এ জন্য সে প্রথমেই, যাকে ধর্ষণ করবে তার ক্ষমতা মেপে নেয়। ক্ষমতা মাপার এ পদ্ধতিটি একটু জটিল। টার্গেটকৃত নারীর পারিবারিক সুনাম, রাজনীতিক প্রভাব, আর্থিক সচ্ছলতা, সাম্প্রদায়িক পরিচয়, ঘটনার সময় আশেপাশে কেউ থাকবে কি না, নারীটির কাছে কোনো অস্ত্র আছে কি না, ধর্ষণ করার জন্য পরিবেশ উপযুক্ত কি না, ধর্ষণের সময় ভিক্টিম নীরব থাকবে কি না, ধর্ষণের পর মামলা হবে কি না, ইত্যাদি বিষয় ধর্ষক আমলে নিয়ে থাকে। যদি সে দেখে, পরিস্থিতি তার অনুকূলে, ধর্ষণ করে সে পার পেয়ে যাবে, ঘটনাটি জানাজানি হবে না, তার পরিচয় প্রকাশ পাবে না, বা প্রকাশ পেলেও ভয়ে তাকে কেউ কিছু বলবে না, তাহলে সে ধর্ষণ করার ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রে ভিক্টিম কী পোশাক পরলো-না-পরলো, তাতে তার কিছু আসে-যায় না। কারণ ভিক্টিমের পোশাক ভিক্টিমের ক্ষমতা কাঠামোর কোনো অংশই নয়। একটি নির্জন রাস্তায়, একজন ব্রা পরা অস্ত্রধারী নারীর চেয়ে একজন নিরস্ত্র বোরকা পরা নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এ জন্য পর্যাপ্ত জনসমাগম আছে, এমন স্থানে সাধারণত ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না।
বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে. ডাকাতেরা ডাকাতির সময় ধর্ষণ করে থাকে। এর কারণও ক্ষমতা। নিরস্ত্র গৃহকর্তার ক্ষমতা তখন শূন্য থাকে। অস্ত্রধারী ডাকাতদের মুখে তিনি তার পরিবারকে সুরক্ষা দিতে পারেন না। কিন্তু তিনি যদি কোনোভাবে ভারী অস্ত্র দিয়ে ডাকাতদের ঘায়েল করে ফেলতে পারেন, তাহলে কিন্তু ধর্ষণ ঘটবে না। এ কথা যুদ্ধাবস্থার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আক্রান্ত দেশের জনগণ যদি উপযুক্ত মারণাস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে, তাহলে আগ্রাসী দেশের সেনারা কাউকে ধর্ষণ করার সুযোগ পাবে না।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যে-ক্ষমতা কাঠামো আছে, তাতে একজন মন্ত্রীর মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা, একজন কৃষকের মেয়ের ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কম।
এখানে আমি আরেকটি বিষয় বলতে চাই। কিছু কিছু সমাজে, কোনো নারী ধর্মীয় পোশাক পরলে বা সাধারণ মানের ‘শালীন’ পোশাক পরলে, মানুষজন ধরে নেয় যে নারীটির ক্ষমতা কম। বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ধর্ষকেরা প্রায়ই নারীর পোশাক দেখে তার পারিবারিক ক্ষমতা নির্ণয়ের চেষ্টা করে থাকে। মেয়েটি শিক্ষিত কি না, এ তথ্যও তারা পোশাক দেখে অনুমান করার চেষ্টা করে। ধর্মীয় ও দরিদ্র পোশাক পরা নারীদের সামাজিক লজ্জা বেশি। এ জন্য যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে, তাদের চুপ থাকার সম্ভাবনাও বেশি। ফলে ঘটনাটি পুলিশের নজরে না যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এটি ধর্ষকদের আশ্বস্ত করে। ধর্মীয় ও দরিদ্র পোশাক পরা নারীরা একটু সহজ-সরল হয়, এমন ধারণাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত আছে। ফলে কোনো উপযুক্ত স্থানে, এ নারীদের ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা অন্য নারীদের চেয়ে অনেক বেশি।
যৌন হয়রানির ক্ষেত্রেও আমার এ বক্তব্য সত্য। কিছুদিন আগে বুয়েটে যে ঘটনাটি ঘটলো (ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে একটি মেয়েকে নগ্ন ছবি পাঠানো), সেখানে ছেলেগুলো যদি জানতো যে মেয়েটি কোনো ক্ষমতাধর পরিবারের সন্তান, তাহলে ওরা এমনটি করতো বলে মনে হয় না। করলেও পরিচয় লুকিয়ে করতো। আমি গ্রামাঞ্চলে দেখেছি, ইশকুল ছুটি হলে ইউপি চেয়ারম্যানের মেয়ের দিকে কেউ শিস ছুড়ে দেয় না, কিন্তু দরিদ্র-ক্ষমতাহীন পরিবারের মেয়েদের দেখলে শিস দেওয়া হয়।
তবে সাধারণ প্রেম নিবেদনের উপায়সমূহকে, যেমন কোনো মেয়েকে দেখে গান গাওয়া, হেসে ওঠা, কবিতা আবৃত্তি করা, তাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে মেসেজ পাঠানো, চিঠি লেখা, ইত্যাদিকে একটি সীমা পর্যন্ত আমি যৌন হয়রানি বলতে রাজি নই। বরং এগুলোর সুস্থ চর্চা না থাকলে, সমাজে যৌন হয়রানি বেড়ে যেতে পারে। মেয়েরা ছেলেদেরকে, ছেলেরা মেয়েদেরকে, তাদের ভালোলাগার কথা যেন নির্ভয়ে জানাতে পারে, এ নিশ্চয়তা সমাজে থাকতে হবে।
আমি আমার বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শুধু অবদমিত কামের বিষয়টি একটু আলোচনা করতে চাই।
সাধারণত ধর্মীয় রক্ষণশীল সমাজে নারী-পুরুষের কাম বেশি অবদমিত থাকে। এ অবদমন, দরিদ্র সমাজে বিয়ের পরও বজায় থাকতে পারে। কারণ দরিদ্র সমাজে, একটি বাচ্চা হওয়ার পর নারীদের শরীর প্রায়ই ভেঙে যায়। অপুষ্টি এখানে বড়ো ভূমিকা রাখে। কেউ কেউ বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে যে-মানের খাবার পেতেন, বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে সে- মানের খাবার পান না। ফলে স্বামীর কাছে তার শারীরিক আকর্ষণ কমে যায়। এ স্বামীদের কেউ কেউ ধর্ষক হয়ে উঠতে পারেন। আমি ছোটোবেলায় এরকম কয়েকটি ঘটনার শালিস প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
তবে বিবাহিত পুরুষদের চেয়ে অবিবাহিত পুরুষরাই ধর্ষণে বেশি অংশ নিয়ে থাকে (সব সমাজে এটি সত্য নাও হতে পারে)। কারণ তাদের কামই বেশি অবদমিত থাকে। এখানেও একটি ব্যাপারে আমরা ভুল করে থাকি। অনেকের ধারণা, অবদমিত কাম কেবল রক্ষণশীল ধর্মীয় সমাজেই থাকে। কিন্তু এটিকে আমার সঠিক মনে হয় না। পশ্চিমের মুক্ত সমাজেও অবদমিত কামের অস্তিত্ব আছে। বহু আমেরিকান পুরুষ, পছন্দের সঙ্গিনীর অভাবে একা একা জীবনযাপন করেন। অনেক পেশাদার অপরাধী আছেন, যাদের স্বাভাবিক নারী সংসর্গে যাওয়ার সুযোগ হয় না। এ পুরুষদের কেউ কেউ নানা সুযোগে ধর্ষক হয়ে উঠতে পারেন।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি। অনেকে অবদমিত কামকে ধর্ষণের বড়ো কারণ মনে করে থাকেন, যা আমার কাছে ভুল মনে হয়। কারণ সমাজে, সব পুরুষেরই কমবেশি অবদমিত কাম থাকে। কিন্তু তা ধর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। এগুলো বড়োজোর কাউকে বিকল্প সঙ্গিনী বা প্রেমিকা খুঁজতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। যে নারীরা আকর্ষণীয় পোশাক পরেন, তাদের সাথে হয়তো এ পুরুষদের প্রেম বা বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কিন্তু পোশাক দেখে তারা ধর্ষণে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এমন কল্পনা উদ্ভট।
প্রশ্ন উঠতে পারে, নারীদের পোশাক পুরুষদের অবদমিত কামকে জাগিয়ে তুলতে পারে কি না? আমি আগেই বলেছি, শুধু পোশাকের এ ক্ষমতা নেই। শরীরের গঠন এবং সৌন্দর্য এখানে মুখ্য। পোশাক যদি নারীর শরীরের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারে, তাহলে তা পুরুষদের মনে নারী সংসর্গ পাওয়ার একটি আবেগ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু এ আবেগ মূলত প্রেমের আবেগ। কোনো নারীকে একান্তে পাওয়ার আবেগ। এ আবেগ ধর্ষণের আবেগ নয়।
এ আবেগ তৈরির পেছনে প্রধান কারণ— নারীদের পোশাক পুরুষদের মনে, নারীদেহ নিয়ে একটি কৌতূহল তৈরি করতে পারে। সমাজভেদে এ কৌতূহলের মাত্রা কমবেশি হয়। তবে ‘শালীন’ পোশাক এ কৌতূহল কমিয়ে দেয় আর ‘অশালীন’ পোশাক এ কৌতূহল বাড়িয়ে দেয়— এমন দাবির কোনো ভালো প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং উল্টোটা অনেক সময় ঘটে থাকে। বোরকা পরা অনেক নারী, যারা হয়তো বাস্তবে দেখতে অতোটা আকর্ষণীয় নন, তারাও একজন আকর্ষণীয় নারীর সমান কৌতূহল তৈরি করতে পারেন। যেমন বাংলাদেশের পুরুষেরা মিসরের বোরকা পরা কোনো নারীকে দেখলে প্রচণ্ড কৌতূহল অনুভব করবে। কারণ মিসরের নারীদের শারীরিক আকার বাংলাদেশের নারীদের চেয়ে বড়ো। ফলে, ওই বোরকার ভেতর কী আছে, তা দেখার জন্য বাংলাদেশের পুরুষেরা ভেতরে ভেতরে কৌতূহলী হয়ে উঠতে পারে।
আমি দুবাইতে একটি সবজি মার্কেটে এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। ওই মার্কেটে কিছু মিসরীয় নারী টম্যাটো কিনতে আসতেন, যাদের পরনে থাকতো বোরকা। মার্কেটের বাংলাদেশি ও ভারতীয় শ্রমিকরা, ওই নারীদের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকতো। তাদের কিন্তু মুখ বা শরীর দেখা যেতো না। বোরকার ভেতর নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর শরীর লুকিয়ে আছে— এমন কল্পনা থেকেই তারা হাঁ করে থাকতো। তাদের নানা মন্তব্য শুনে আমি নিশ্চিত হতাম, তাদের অবদমিত কাম জাগ্রত হয়ে গেছে।
সুতরাং, বোরকা পরলে বা ‘শালীন’ পোশাক পরলে কোনো পুরুষ আকৃষ্ট হবে না, আর বোরকা না পরলে বা ‘অশালীন’ পোশাক পরলে পুরুষেরা আকৃষ্ট হবে – এমন দাবি ভিত্তিহীন। সামাজিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকের কাছে এমনটি মনে হতে পারে, কিন্তু এটি সার্বজনীন নয়। যেকোনো পোশাকের নারীই পুরুষদের আকৃষ্ট করতে পারে, যদি ওই নারীর শরীরের প্রতি পুরুষদের কৌতূহল জাগ্রত হয়। পুরুষরা নিশ্চিত হতে চায়, ওই নারীর সঙ্গ পেতে তাদের ভালো লাগবে কি না।
অনেকে দাবি করেন, ইন্টারনেটে ‘অশ্লীল’ ছবি ও ভিডিও দেখে দেখে, বা রাস্তাঘাটে ‘অশালীন’ পোশাকের নারী দেখে দেখে, ধীরে ধীরে একজন পুরুষের মনে ধর্ষণের ইচ্ছা তৈরি হতে পারে। এটিও ভ্রান্ত ধারণা। কাম জাগ্রত হওয়া আর ধর্ষণের ইচ্ছা তৈরি হওয়া এক জিনিস নয়। কোনো পুরুষ তার জাগ্রত কামকে নানা উপায়ে চরিতার্থ করতে পারেন (যেমন— বিয়ে, লিভ টুগেদার, ইত্যাদি)। তবে আরো উপায় আছে, যা আমি এখানে খুলে বলার প্রয়োজন অনুভব করছি না। কাম চরিতার্থ করার একমাত্র উপায় ধর্ষণ, এমন দাবি উন্মাদ ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। কিন্তু সঙ্গমের বাসনাকে ধর্ষণের বাসনার সাথে গুলিয়ে ফেলে অনেকেই এ ভ্রান্তি সমাজে ছড়াচ্ছেন।
আর ‘অশ্লীল’ ভিডিও বা ‘অশালীন পোশাক’ আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই সমাজে ধর্ষণ আছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়েও ধর্ষণ ছিলো। ধর্ষণ তখনই ঘটে, যখন অবদমিত কাম বা শখ বা প্রতিহিংসার সাথে, ক্ষমতার হিসেবটি ধর্ষকের অনুকূলে থাকে।