এ পাখির ইংরাজি নাম হর্নবিল্ (Hornbill) অর্থাৎ শৃঙ্গচঞ্চু কিন্তু তার আসল বাংলা নামটি যে কি, তা আর খুঁজে পেলাম না। লোকে তাকে ধনঞ্জয় বা ধনেশ পাখি বলে কিন্তু অভিধান খুঁজতে গিয়ে দেখি, ও নামে কোন পাখিই নেই। ওর কাছাকাছি একটা আছে, তার নাম ধনচ্চু— ‘হাড়গিলার আকার-বিশিষ্ট পক্ষীবিশেষ, করেটু পক্ষী’। ‘করেটু’ মানে ‘কর্করেটু পক্ষী’— ‘কর্করটু’ মানে ‘করটিয়া পক্ষী’। আর ‘করটিয়া’র মানে দেখতে গেলে আরও কত নাম বেরুতে পারে, সেই ভয়ে আর দেখা হল না। যা হোক, নাম দিয়ে যদি কেউ চিনতে না পারে, তবে চেহারাটা দেখলে তার পরিচয় পেতে বোধহয় দেরি হবে না— কারণ, এ চেহারা একবার দেখলে আর সহজে ভুলবার যো নেই।
আলিপুরের চিড়িয়াখানায় যত অদ্ভুত পাখি আছে, তার মধ্যে ‘ফার্স্ট প্রাইজ’ কাউকে দিতে হলে বোধ হয় একেই দেওয়া উচিত। আমরা ছেলেবেলায় যখন এই পাখিকে প্রথম দেখি তখন তার নাম দিয়েছিলাম ‘দুই-ঠোঁটওয়ালা পাখি’। বাস্তবিক কিন্তু এর একটা মাত্রই ঠোঁট। উপরেরটা শিং বলতে পার— সেটার সঙ্গে তার মুখ বা ঠোঁটের কোন সম্পর্কই নেই। অত বড় একটা জমকালো শিং দিয়ে কি যে কাজ হয়, তা দেখতে পাই না। অত্যন্ত নিরীহ পাখি, কারও সঙ্গে গুঁতাগুঁতি করবার সাহস তার আছে কিনা সন্দেহ। চেহারা দেখলে মনে হয়— ‘বাপরে! এই ঠোঁটের একটি ঠোকর খেলেই ত গেছি’। কিন্তু নিতান্ত ঠেকা না পড়লে গুঁতা মারার অভ্যাসটিও তার নেই বললেই হয়।
এত বড় ঠোঁট তার উপর এমনধারা শিং, এই বিষম বোঝা বয়ে বয়ে পাখিটার মাথাও কি ধরে না? চলতে ফিরতে উড়তে গিয়ে সে কি উলটেও পড়ে না? আসল কথা কি জান? তার ঠোঁটটি আর শিংটি আগাগোড়াই ফাঁপা, কাঁকাড়ার খোলার মতো হালকা। তাই তার ঠোঁট নিয়ে বড় বড় গাছের আগডালের উপর সে লাফিয়ে বেড়ায়— খাবার দেখলে ঝুপ করে উড়ে এসে পড়ে। কেবল তাই নয়, তার দিকে খাবারের টুক্রো ছুঁড়ে দেখ দেখি, সে কেমন চট্পট্ ঘাড় ফিরিয়ে তার বিশাল ঠোঁটের মধ্যে খাবার লুফে নেবে। এ বিষয়ে তার মতো ওস্তাদ আর বোধহয় দ্বিতীয় নেই; আর এমন খানেওয়ালা বোধহয় আর একটি পাওয়া দুষ্কর।
এক সাহেবের এক পোষা ধনঞ্জয় ছিল— সে আমাদের দেশে নয়, বোর্নিও দ্বীপে। সে দেশে এই পাখি অনেকেই পুষে থাকে। সাহেব বলেন, এমন সর্বনেশে পেটুক জীব আর কোথাও মেলে না। সেই এতটুকু বাচ্চা বয়স থেকেই তাকে খাইয়ে খাইয়েও মানুষে ঠাণ্ডা রাখতে পারত না। এইমাত্র খাইয়ে গেলে, আবার পাঁচ মিনিট পরেই দেখবে হতভাগা ল্যাজের উপর ভর দিয়ে পা মুড়ে বসে বসে প্রকাণ্ড হাঁ করে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে বিকট কান্না লাগিয়েছে। তারপর একটু বয়স হলে তখন তার অত্যাচারে বাড়িতে টেকা দায় হয়ে উঠল। খাবার সময় তার ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে তাকে আটকে রাখতে হত, তা নইলে সে পাতের খাবারে, ভাতের হাঁড়িতে, ব্যঞ্জনের বাটিতে, দুধের কড়ায় যেখানে সেখানে মুখ দিয়ে সকলকে অস্থির করে তুলত। মাছমাংস, ডালভাত, রুটিবিস্কুট, ময়দার ডেলা, যা দাও তাতেই সে খুশী, কিন্তু পেট ভরে দেওয়া চাই। পেটটি ভরলেই সে উড়ে গিয়ে গাছের আগায় বিশ্রাম করবে, রোদ পোহাবে আর প্রাণপণে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নতুন করে সাংঘাতিক খিদে ডেকে আনবে।
ধনঞ্জয় পাখির চালচলন স্বভাব যাঁরা লক্ষ করেছেন তাঁরা বলেন, এই পাখির বাসা বাঁধবার ধরনটি তার চেহারার চাইতে কম অদ্ভুত নয়। যখন ছানা হবার সময় হয় তখন মা-পাখিটা একটা গাছের কোটরের মধ্যে আশ্রয় নেয়, আর বাবা-পাখি সেই কোটরের মুখটাকে কাদামাটি শেওলা দিয়ে বেশ করে এঁটে বন্ধ করে দেয়— কেবল একটুখানি ফোকর রাখে, তা না হলে বাইরে থেকে খাবার দেবে কি করে? সেই কোটরের মধ্যে ডিম পেরে মা-পাখি দিনের পর দিন তার উপর বসে বসে তা দেয়। আর বাবা-পাখি বাইরে থেকে পাহারা দেয়, আর ফোকরের ভিতর দিয়ে সারাদিন খাবার চালান দেয়। এমন করে যখন ডিম ফুটে ছানা বেরোয়, আর সেই ছানাগুলো যখন একটু বড় হয়, তখন বাসা ভেঙে মা-পাখি বেরিয়ে আসে। এতদিন বদ্ধ জায়গায় বসে বসে তার পা এমন আড়ষ্ট হয়ে যায় যে কোটর থেকে বেরোবার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে উড়তে পারে না, ভাল করে চলতে ফিরতেও পারে না। এই বাসা গড়া ও ভাঙার সময় ধনঞ্জয়ের লম্বা ঠোঁট আর শিং দুটোই বোধহয় বেশ কাজে লাগে।
ধনঞ্জয় পাখি আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার নানা জায়গায় বাস করে এবং তার নানারকম চেহারা দেখা যায়। উড়িষ্যা দেশে এ পাখির নাম ‘কুচিলাখাই’। ‘কুচিলাখাই’য়ের গায়ের রং কালো, তার উপর ঠোঁট আর শিঙের রং চক্চকে লালচে হলুদ দেখতে বেশ মানায়। নেপালের লালা ধনঞ্জয়ের শিং নেই বললেই হয়, কিন্তু তার মুখে মাথায় খুব গম্ভীর গোছের কেশর আছে আর ঠোঁটদুটো করাতের মতো দাঁতাল। সুমাত্রা দ্বীপের ধনঞ্জয়ের শিং একেবারেই নেই, কিন্তু তার জমকালো কেশরটি অতি চমৎকার ধবধবে সাদা। আবার কেউ কেউ আছেন যাঁদের শিংও আছে, কেশরও আছে। শিঙের রকমারিও অনেক দেখা যায়— কারও শিং কড়্গের মতো বাঁকা, কারও কিরিচের মতো সোজা, আবার একজন আছেন তাঁর শিংটি শশার মতো গোল, তার উপর ঝুঁটি।
ধনঞ্জয়ের চেহারাটি যেমন বিকট তার গলার আওয়াজটিও তেমনি কট্কটে। বনের মধ্যে হঠাৎ তার গলা শুনলে পাখিরা ত ভয় পায়ই, বাঁদর বা বনবেড়াল পর্যন্ত ভয়ে পালায় এমনও দেখা যায়। তা ছাড়া তার মাংস নাকি এমন বিস্বাদ যে কুকুরেও খেতে চায় না।
ধনঞ্জয়ের কথা বলতে গেলে আর-এক পাখির কথা বলতে হয়— তার নাম টুকান (Toucan) এই পাখির বাসা আমেরিকায়। এদের গায়ে অনেক সময়ে খুব জমকালো রঙের বাহার দেখা যায়— কিন্তু আসল দেখবার জিনিস এদের লম্বা ঠোঁট দুখানি। দেখলে মনে হয় যত বড় পাখি প্রায় তত বড় ঠোঁট— যেন ‘বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি’। তাতে চেহারাটি কেমন খোলে, তার বর্ণনা করবার দরকার নেই। দেখতে অনেকটা ধনঞ্জয়ের মতো হলেও আসলে এরা ধনঞ্জয় নয়— আর ধনঞ্জয়ের মতো অত বড়ও হয় না।