দ্রৌপদী – ৫

ব্যাস লিখেছেন—প্রথমটা দ্রৌপদী যেভাবে বলছিলেন তাঁর প্রণয়কোপের ভাগটাই ছিল বেশি—প্রণয়াৎ কুরুনন্দনম্‌। কিন্তু দ্রৌপদী যে বাঁধনের কথা বললেন, সে বাঁধন তো তাঁর অন্য স্বামীদের। যুধিষ্ঠির, ভীম—এঁদের বাঁধন যত বেড়েছে, অর্জুনের বাঁধন তত আলগা হয়েছে—পরে তার প্রমাণও দেব। কিন্তু এই মুহূর্তে, বারো বচ্ছর পরে যে দ্রৌপদী প্রথমে প্রণয়রসে রাগ দেখিয়ে কথা আরম্ভ করেছিলেন সে রাগ তার কোথায় গেল! তিনি তো পরমুহূর্তেই কেঁদে ফেললেন ঝরঝর করে। ব্যাস শব্দটা লিখছেন—বিলপন্তীং, যার মানে বিলাপ করাও হয়, আবার কালীপ্রসন্ন সিংহ মশায়ের মতে ‘নানাবিধ পরিহাস করিতে থাকিলে’—তাও হয়। সিংহীমশায় ভেবেছেন, আগে যখন প্রণয় কোপের কথা আছে, তাহলে এ শব্দটা পরিহাসই বোঝাবে। কিন্তু সাতবাহন হাল থেকে সমস্ত রসবেত্তা বোদ্ধারা বলেছেন—বিদগ্ধা মহিলারা রাগ দেখায় কেঁদে, আমি তাই এখানে ‘বিলপন্তীং বলতে কাঁদতে-থাকা দ্রৌপদীকেই বুঝি। বিশেষ করে অর্জুন যেহেতু দ্রৌপদীকে নানাভাবে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, বহুভাবে দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, তাতে বুঝি মানিনী দ্রৌপদী কাঁদছিলেন।

দ্রৌপদী কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন। ধর্মপুত্র থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেক পাণ্ডবেরই দ্রৌপদী ছাড়া অন্য স্ত্রী আছেন। তাদের কারও জন্যে দ্রৌপদীর কোনও দুঃখ কোথাও ধরা পড়েনি। কারণ তাদের কাউকে দ্রৌপদী আপনার সমকক্ষ মনে করেননি। কিন্তু অর্জুন তাঁর নির্লিপ্ততার বাহানায় দ্রৌপদীর মতো সপ্রতিভ ব্যক্তিত্বের দিক থেকে পেছন ফিরতে গিয়ে তাঁরই সমকক্ষ আরেক ব্যক্তিত্বকে বিবাহ করে এনেছেন। এ অপমান দ্রৌপদীর সইবে কী করে? যার জন্য বারো বচ্ছর ধরে হৃদয়ের মধ্যে গোপন আসন সাজিয়ে বসে আছেন, তিনি একেবারে বিয়ে করে ফিরেছেন। দ্রৌপদী লজ্জায় অপমানে কেঁদে ফেললেন। প্রথমবারের মতো তিনি ধরা পড়ে গেলেন—তিনি অর্জুনকে বেশি ভালবাসেন।

সমকক্ষ ব্যক্তিত্বকে দিয়ে সমকক্ষের মোকাবিলা করা মুশকিল, বিশেষত আগুনপানা দ্রৌপদীকে। অর্জুন প্রথমেই সুভদ্রাকে দ্রৌপদীর ঘরে এনে তোলার সাহস পাননি। এখন দ্রৌপদীর ভাব বুঝে, ক্ষমা চেয়ে ফিরে গেলেন সুভদ্রার ঘরে। নববধূর নতুন অনুরাগের মতো লাল কৌশেয় বাসখানি তাড়াতাড়ি খুলে ফেলতে বললেন সুভদ্রাকে, খুলে ফেলতে বললেন ভূষণ-অলংকার। সুভদ্রাকে সাজিয়ে দিলেন দীন-হীন গোয়ালিনীর বেশে-কৃত্বা গোপালিকাবপুঃ। এবারে তাকে দ্রৌপদীর ঘরে পাঠিয়ে দিলেন একা। অনুক্রম অনুসারে সুভদ্রা কুন্তীকে প্রণাম করেই দ্রৌপদীর ঘরে এলেন। তাঁকেও প্রণাম করে সুভদ্রা বললেন—আজ থেকে আমি তোমার দাসী হলাম দিদি—প্ৰেষ্যাহম্‌ ইতি চাব্রবীৎ। ‘দাসী!’ দ্রৌপদীর অভিমান বুঝি কিঞ্চিৎ তৃপ্ত হল। সুভদ্রার কুল মান সব বুঝেও তাঁর আপাত ব্যবহারে, দীন বেশ খুশি হলেন দ্রৌপদী। ভবিষ্যতের ধারণাহীন নতমুখী একা একা বালিকাকে দেখে দ্রৌপদীর বুঝি মায়া হল। উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন সুভদ্রাকে, আশীর্বাদ করলেন—তোমার স্বামী নিঃসপত্ন হন। সপত্ন—মানে শত্রু, কাজেই নিঃসপত্ন হন মানে—স্বামী নিঃশত্রুক হন—এই তো বীরাঙ্গনার আশীর্বাদ। কিন্তু পাঠক! শব্দের মধ্যেও ব্যঞ্জনা আছে। স্ত্রীলিঙ্গে ‘সপত্নী’ মানে যদি সতীন হয় তাহলে পুংলিঙ্গে সুপত্ন মানেও একটা পুরুষ-সতীনের ব্যাপার থেকেই যায়, বিশেষত দ্রৌপদীর যিনি আসল স্বামী অর্জুন, তাঁর সপত্ন পুরুষের জ্বালাতেই বারো বছর পরে অর্জুনকে দেখতে পেলেন তিনি। কাজেই দ্রৌপদীর এই আশীবাদের অর্থ এই যে, আমার মতো যেন তোমার অবস্থা না হয়—তোমার স্বামী নিঃসপত্ন হোন।

ভাব দেখে মনে হল বুঝি দ্রৌপদী অর্জুনকে দিয়েই দিলেন সুভদ্রাকে। কিন্তু মন থেকে কি দেওয়া যায়? দেওয়া কি অতই সহজ? বরঞ্চ অর্জুনের প্রতি অক্ষমায় এবং সুভদ্রার প্রতি অতি ক্ষমায় দ্রৌপদীই যেন ধরা পড়ে গেলেন। সুভদ্রার স্বামীকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে নিজেরই মনের মধ্যে সতীন-কাঁটা বিঁধে রইল। অর্জুনের নির্লিপ্ততা দিনে দিনে বাড়িয়ে তুলল দ্রৌপদীর অক্ষমা। ইতিমধ্যে দ্রৌপদী ভীমকে অবলম্বন করতে আরম্ভ করেছেন—ভালবাসার জন্যে যতখানি, অর্জুনের ঈর্ষা জাগানোর জন্যে তার চেয়ে বেশি। কৌরব সভায় সেই অপমানের দিন এসে গেল। দ্রৌপদীর মনে হল অর্জুন যেন নির্বিকার। অর্জুন যেন তাঁর হয়ে একটুও কথা বলছেন না। যেখানে ভীম দ্রৌপদীর অপমা একের পর এক প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছেন, তার প্রতিতুলনায় গাণ্ডীবধন্বকে তাঁর নিতান্ত অপ্রতিভ মনে হল। ভীম রাগের চোটে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের হাত পুড়িয়ে দিতে চাইছিলেন, অর্জুনই তাঁকে বারণ করেছেন। এ-সব ব্যবহার দ্রৌপদীর কাছে প্রীতিপদ হয়নি।

দ্রৌপদী বুঝতে পারেননি, যিনি মহাযুদ্ধের নায়ক হবেন, তাঁর মাথাটি ভীমের মতো হলে চলে। অর্জুনের যুক্তি ছিল—যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায় পাশা খেলতে আসেননি। ক্ষত্রিয় ধর্মের নিয়ম অনুসারে পাশা খেলায় আহুত হলে তাকে খেলতেই হবে। সেখানে যুধিষ্ঠিরের দোষ কী? অর্জুন ভীমকে বলেছেন—নিজেদের মধ্যে বাদ-বিসংবাদে শত্রুরই আখেরে লাভ হবে। সেই সুযোগ আপনি করে দেবেন না দাদা–ন সকামাঃ পরে কার্যাঃ। ভীম যুক্তি বুঝেছেন। তবু অর্জুনের এই স্থিরতা, ধৈর্যের চেয়ে ভীমের হঠাৎ-ক্রোধই দ্রৌপদীর কাছে বেশি ভাল লেগেছে। অর্জুনের ওপর অক্ষমা তাই বেড়েই যাচ্ছিল। কিন্তু মুখের এই ক্ষমাহীতার সঙ্গে দ্রোপদীর হৃদয়ের মিল নেই। সেখানে বারবার অর্জুনের প্রেমিকা হিসেবেই তিনি ধরা পড়ে যান। বনবাস-পর্বে পাণ্ডবেরা যখন দ্বৈতবন ছাড়ার মুখে, তখন ব্যাস এসে প্রতিস্মৃতি বিদ্যা দিয়ে গেলেন যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে সেই বিদ্যা শিখিয়ে তপস্যায় যেতে বললেন, যে তপস্যায় তুষ্ট হবেন ইন্দ্র এবং মহাদেব। অর্জুন জ্যেষ্ঠের আদেশ নিয়ে চললেন। ব্রাহ্মণেরা আশীর্বাদ করলেন—ধ্রুবো’স্তু বিজয়স্তব। হতভাগিনী দ্রৌপদী আবার ধরা পড়ে গেলেন।

অর্জুনের আসন্ন প্রবাস বেদনায় দ্রৌপদীর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। সব ভাইয়ের সামনেই তিনি অর্জুনের জন্য জমে থাকা ভালবাসা উজাড় করে দিলেন। বুঝি বিদগ্ধা রমণীর ভালবাসার এই রীতি। মুখে তাঁর প্রতি প্রসন্ন নন, অথচ বাড়ি থেকে তিনি যে চলে যাবেন, তারও উপায় নেই—চলে যেতে চাইলেই অভিমানে ভরা একরাশ দুঃখ হাঁড়ি-মুখ থেকে গলগল করে বেরিয়ে পড়ে। দ্রৌপদী বললেন—মহাবাহু! তুমি জন্মানোর পরে আর্যা কুন্তী তোমার কাছে যা চেয়েছিলেন এবং যেমনটি তুমিও চাও, ঠিক তেমনটিই যেন তোমার হয়, অর্জুন! ঠিক এই শুভাকাঙ্ক্ষার পরেই দ্রৌপদীর গলা থেকে বেরিয়ে এল আক্ষেপের সুর—প্রার্থনা করি, কারও যেন আর ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম না হয়—মাস্মাকং ক্ষত্রিয়কুলে জন্ম কশ্চিদবাপ্নুয়াৎ। ভিক্ষা করে যাঁরা জীবিকা নির্বাহ করেন, সেই ব্রাহ্মণেরা আমাদের চেয়ে অনেক ভাল আছেন, তাঁদের আমি নমস্কার করি—ব্রাহ্মণেভ্যো নমো নিত্যং যেষাং ভৈক্ষ্যেণ জীবিকা।

ক্ষত্রিয় রমণীর মুখে এ কী কথা? না, আমরা বুঝি, আমরা দ্রৌপদীর দুঃখ বুঝি। সেই যে নববধূর আবেশ না ঘুচতেই ব্রাহ্মণের গরু উদ্ধার করতে অর্জুনকে ছুটে যেতে হল, আর বনবাস জুটল কপালে, সে ক্ষত্রিয় বলেই তো ; রাজসভায় পাশাখেলার আসরে অপমান হতে হল দ্রৌপদীকে তাও—তো ক্ষত্রিয়নীতির বালাই নিয়ে। আবার এখন যে অর্জুনকে প্রবাসে তপস্যায় যেতে হচ্ছে, তাও তো ক্ষাত্রযুদ্ধে চরম জয়লাভের জন্য। এর থেকে বামুন হয়ে জন্মালে, দুবেলা দুমুঠো ভিক্ষার অন্ন মুখে দিয়ে, বামুন ঠাকুরের ত্রিসন্ধ্যা-তপস্যার ব্যবস্থা করে দিলেই তো ল্যাঠা চুকত। অন্তত তিনি তো কাছেই থাকতেন, কোনওদিন কর্মহীন অবকাশে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিন কাটাতে হত না দ্রৌপদীকে। কিন্তু দ্রৌপদীর মুশকিল হল—কৌরবসভায় যে অপমান তাঁকে সইতে হয়েছিল তার চরম প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য অর্জুনকে ছেড়ে দিতেই হবে, আবার অন্যদিকে তাঁকে ছেড়ে থাকতে তাঁর বনবাসের জীবন হয়ে উঠবে বিরহে বিধুর। চার স্বামী কাছে থাকতেও শুধু অর্জুন না থাকার মানে যে আলাদা। দ্রৌপদী বললেন—কুরুসভায় দুর্যোধন আমাকে বলেছিল ‘গরু’। আমি ‘গরু’, কিন্তু সেই অপমান আর দুঃখ থেকে, তুমি অর্জুন—আমার কাছে থাকবে না—এ দুঃখ আমার কাছে আরও অনেক বড়—তস্মাদ্‌ দুঃখাদ্‌ ইদং দুখং গরীয় ইতি মে মতিঃ। তুমি চলে গেলে তোমার ভাইয়েরা হয়তো বীরত্বের কথা কয়েই দিন কাটাবে ; কিন্তু আমার কী থাকল—তুমি প্রবাসে কষ্ট করবে, সেই আবস্থায় কোনও সুখ, কোনও ভোগ এমনকী জীবনও আমার কাছে অসহ্য লাগবে। আমাদের সুখ, দুঃখ, জীবন, মরণ, রাজ্য, ঐশ্বর্য—সব, সব তোমাতেই নির্ভর। কাজেই তোমাকে বিদায় দিতেই হবে, হে বন্ধু বিদায়। নমো ধাত্রে বিধাত্রে চ—প্রার্থনা করি তোমার প্রবাসের দিন সুখের হোক, তুমি নীরোগ থাক—স্বস্তি গচ্ছ হ্যনাময়ম্‌।

ব্যাস লিখেছেন—দ্রৌপদী অর্জুনকে এই ‘আশীর্বাদ করে থামলেন—এবমুক্‌ত্বাশিষঃ কৃষ্ণা বিররাম যশস্বিনী। দ্রৌপদী কি তখন যুধিষ্ঠির কিংবা ভীমের বউ হয়ে ছিলেন যে, এই শব্দটি—আশীর্বাদ? হয়তো তাই, নয়তো নয়—ব্যাস স্বকণ্ঠে কিছু বলেননি। কিন্তু অভিজ্ঞতায় দেখেছি অর্জুনের বনবাস, প্রবাস—সবকিছুই ঘটে, যখন তিনি অন্য পাণ্ডবের ঘরণী—হয়তো এখানেও তাই হবে, হয়তো দুঃখ তাই বেশি। কৃষ্ণার এত কথা, এত শুভাশংসার উত্তরে অর্জুন কিন্তু একটি কথাও বলেননি। যদি বলতেন, তাহলে ভাইদের সতীন-হৃদয়ে তার ছায়া পড়ত এবং মৃত্যুর পরও তাঁকে শুনতে হত—অর্জুন কৃষ্ণার প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিল। কিন্তু অর্জুন না হয় ধীরোদাত্ত নায়ক পুরুষ, কিছু বললেন না, কিন্তু দ্রৌপদীর স্ত্রীহৃদয় কি বশে আনা যায়! একবার, যেমন এখন, তিনি অর্জুনের ওপর তাঁর পক্ষপাত প্রকাশ করে ফেললেন, তেমনি অর্জুনের প্রবাস-পর্বে তিনি নিজেকে একেবারেই ধরে রাখতে পারেননি।

অর্জুন যখন তপস্যার জন্য চলে গেলেন তখনও পাণ্ডবেরা কাম্যকবনে। তাঁরা কিছুদিন ব্রাহ্মণদের মুখে নল-দময়ন্তীর কাহিনী শুনে দিন কাটালেন, কিন্তু অর্জুন ছাড়া কারও ভাল লাগছিল না, এমনকী মহরতের্গ শ্রোতা যে তরুণ ছেলেটি—জন্মেঞ্জয়, অর্জুন যার সাক্ষাৎ প্রপিতামহ, সে পর্যন্ত বৈশম্পায়নকে বলল—অর্জুনকে বাদ দিয়ে আমার আর আর পিতামহেরা কী করছিলেন? সুভদ্রার গর্ভ-পরম্পরায় যার জন্ম সেই জন্মেঞ্জয়ও কি দ্রৌপদীর ধরা পড়ার আন্দাজ পেয়েছিলেন কোনও? মহর্ষি বৈশম্পায়ন একটু বললেন অন্য পাণ্ডবদের কথা। তাঁরা সুতোছেঁড়া মণিমালার মতো ছন্নছাড়া আর ডানাকাটা পাখির মতো ছন্দোহীন হয়ে পড়েছেন। সবাই শোঁকার্ত, অহৃষ্টমনসঃ, কিন্তু পাঞ্চালী-দ্রৌপদীর অবস্থা যেন আরও খারাপ, অর্জুনকে স্মরণ করলেই জীবনের সবগুলো ফাগুন যেন একসঙ্গে তাঁর বুকের মধ্যে হা হা করে—অর্জুনকে যে তার ভাল করে পাওয়াই হয়নি। ব্যাস তাই লিখলেন—বিশেষতস্তু পাঞ্চালী স্মরন্তী মধ্যমং পতিম্। পাঞ্চালী দুঃখ জানানোর লোক পেলেন না, বেছে বেছে যুধিষ্ঠিরকেই তিনি মনের ব্যথা বোঝাতে আরম্ভ করলেন। জ্যেষ্ঠ-স্বামীর মানসিক জটিলতা সম্পূর্ণ হল—দ্রৌপদী অর্জুনেরই।

দ্রৌপদী বললেন—মাত্র দুটি হাতেই অর্জুন আমার সহস্রবাহু কার্তবীর্যর্জুনের মতো শক্তিশালী। তাকে ছাড়া এই বনভূমি যে আমার কাছে শূন্য হয়ে গেছে, এই ফল-ফুল, নদী লতা সব শূন্য। সেই মেঘের মতো কালোপানা পেটা চেহারা, হাঁটলে মনে হবে হ্যাঁ হাঁটছে বটে, হাতি হাঁটছে। আর মনে পড়ছে তার নীল পদ্মের পাপড়ি হেন চোখ দুটি। সে ছাড়া এই কাম্যক বন আমার অন্ধকার। যার ধনুকের টঙ্কার শুনলে মনে হবে বাজ পড়ছে যেন—সেই পরবাসী অর্জুনের কথা ভেবে ভেবে একটু যে শান্তি পাচ্ছি না আমি—ন লভে শর্ম বৈ রাজন্ স্মরন্তী সব্যসাচিনম্‌।

অর্জুনের বীরত্ব, অর্জুনের চেহারা আর অর্জুন ছাড়া সুন্দরী অরণ্যভূমি—শুন্যামিব প্রপশ্যামি—দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের কাছে সম্পূর্ণ ধরা পড়ে গেলেন। কৃষ্ণার অর্জুন-বিলাপ শেষ হলে ভীম, নকুল এবং সহদেব তাঁরই সঙ্গে সুর মেলালেন বটে, কিন্তু সেই অধ্যায়ে ধর্মরাজের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরল না। পরের অধ্যায়ে দেখতে পাচ্ছি কৃষ্ণা এবং ভাইদের সম্মিলিত হাহাকার শুনে যুধিষ্ঠিরও কিঞ্চিৎ বিমনা হলেন—শ্রুত্বা বাক্যানি বিমনা ধর্মরাজো’প্যজায়ত। যুধিষ্ঠিরও অর্জনের জন্যে বিলাপ করেছেন, তবে সে পরে, ভাইদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে নয়। আমি বিশ্বাস করি প্রধানত দ্রৌপদীর উদ্‌ভ্রান্ত অবস্থা দেখেই পরবর্তী সময়ে যুধিষ্ঠির এবং তাঁর ভাইয়েরা অর্জুনকে কৈলাস পর্বতের দুর্গম পথে খুঁজতে বেরলেন। যুধিষ্ঠির পথ-পরিশ্রমের কারণে কৃষ্ণাকে রেখেই যেতে চেয়েছিলেন, সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন শুধু নকুলকে। কিন্তু ভীম দ্রৌপদীর মন বুঝেই জবাব দিলেন—সে হয় না, দ্রৌপদী সত্যিই ক্লান্ত। কিন্তু অর্জুনকে দেখতে না পেয়ে তিনি তো দুঃখও পাচ্ছেন বটে এবং প্রিয়দর্শন লালসা যেহেতু শ্রমক্লান্ত শরীরকেও টেনে নিয়ে চলে, তাই দ্রৌপদী অর্জুনকে দেখার ইচ্ছে সামলাতে পারবেন না, তিনি যাবেনই—ব্রজত্যেব হি কল্যাণী শ্বেতবাহদিদৃক্ষয়া।

সার্থক প্রেমিক ছাড়া প্রিয়ার মনের কথা এমন করে কে বুঝবে? ভীম দ্রৌপদীকে ভালবাসেন বলেই তাঁর ভালবাসার পাত্রকে এমন করেই জুগিয়ে দিতে পারেন। ভীম বললেন—দুর্গম স্থানে আমি কাঁধে করে নিয়ে যাব দ্রৌপদীকে—অহং বহিস্যে পাঞ্চালীং যত্র যত্ৰ ন শক্ষ্যতি। এইবার এতক্ষণে দ্রৌপদীর মুখে হাসি ফুটল—প্রহসন্তী মনোরমা। যুধিষ্ঠিরকে সলজ্জে বললেন—আমার জন্য আপনি ব্যাকুল হবেন না, মহারাজ! আমি ঠিক পারব—গমিষ্যামি ন সন্তাপঃ কার্যো মাং প্রতি ভারত। ঠিক এই অর্জুনকে খুঁজবার পথেই দ্রৌপদীর সেই সুর-সৌগন্ধিকের বায়না। বায়না ভীমের কাছে। পাঠক এটি উৎকট কিছু ভাববেন না। অর্জুনের প্রতি এতক্ষণ যে অতিরিক্ত পক্ষপাত দেখিয়েছেন পাঞ্চালী তাতে যদি একান্ত অনুরক্ত ভীমের প্রতি অবিচার হয়, তাই তিনি নতুন কোনও কর্ম দিয়ে ধন্য করলেন অনুরগীকে। কিন্তু লক্ষ করুন অর্জুনকে। পাঁচ বচ্ছর পরে অর্জুনের সঙ্গে দেখা হল পাণ্ডবদের এবং পাঞ্চালীর। অর্জুন চারভাইকে অভিবাদন জানালেন, অগ্রজদের প্রণাম করলেন, অনুজদের আশীর্বাদ। কিন্তু এতদিনের পথ-চাওয়া কৃষ্ণার সঙ্গে মিলিত হলেন যখন, অবিচারী ব্যাস সেই মুহূর্তটিকে তপ্ত আলিঙ্গনে ধরে রাখতে পারেননি। রাখবেন কী করে? অর্জুনই যে সেরকম নন। দ্রৌপদী নিশ্চয়ই কাঁদছিলেন, হয়ত অনেক আশা ছিল। কিন্তু অর্জুন কী করেন, তিনি আপন প্রণয়িনীকে কোনওমতে সান্ত্বনা দিলেন—সমেত্য কৃষ্ণাং পরিসাণত্ব্য চৈনাম্‌-এর বেশি কিছুই তাঁর পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আর যদি করতেন তা হলে মৃত্যুর পরে যুধিষ্ঠিরের মুখে সেই বাণী শুনতে হত—দ্রৌপদীর প্রতি অর্জুনের বেশি পক্ষপাত ছিল।

আমরা বিরাটরাজার নৃত্যশালায় দ্রৌপদী আর অর্জুনের সংলাপ থেকেই অর্জুনের প্রসঙ্গে এসেছিলাম। অৰ্জুন বলেছিলেন—আমার মন তুমি বুঝলে না, ধনি। আমরা বলি, বুঝবার উপায় রাখলে কি? কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অনুকুলে তুমি একটি কথাও বললে না। বনের মধ্যে জয়দ্রথ এলেন, তোমার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভীম, বিরাটের ঘরে কীচকেরা জ্বালাল, রক্ষা করলেন ভীম, তুমি তখনও উত্তরাকে নাচ শিখিয়ে চলেছ। অর্জুন! তুমি বলবে—দ্রৌপদীর বিপদে তুমি এগিয়ে আসার আগেই ভীম এত বেশি প্রাগ্রসর যে, তারপরেও তোমার এগিয়ে আসাটা বেমানান হত। আমরা বলি, হলেই কি, প্রেম দেখানোর রাস্তা তো ওইটাই। আসলে বল, তুমি যুধিষ্ঠিরের কাছে ধরা পড়ে যেতে—তুমি নির্লিপ্ত বীর সাজতে চেয়েছ এবং তা পেরেওছ। তোমার বিরুদ্ধে যুধিষ্ঠিরের কোনও অভিযোগ নেই বটে, কিন্তু দ্রৌপদীর আছে, আমাদেরও আছে। দ্রৌপদীর মতো আমরাও তাই তোমাকে আশীর্বাদ করি—তুমি জন্মানোর সময় আর্যা কুন্তী যা চেয়েছিলেন এবং তুমিও যেমনটি চাও, তুমি যেন তাই পাও, অর্জুন—তৎ তেস্তু সর্বং কৌন্তেয় যথা চ স্বয়মিচ্‌ছসি। তোমাকে আর তোমার মন বুঝতে হবে না অর্জুন। দ্রৌপদীর ভালবাসার উত্তরে, তুমি যদি কোথাও ধরা পড়ে যেতে, সেই হত তোমার সত্য পুরস্কার। তা তুমি পারনি, কিন্তু ধরা-পড়া তুমি জান না তা তো নয়। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রার কাছে তুমি বেশ বাঁধা। দ্রৌপদীর আগেই তার গর্ভে তোমার পুত্র হয়েছে এবং সেই পুত্রের শিক্ষা-দীক্ষা হয়েছে সযত্নে। দ্রৌপদীর গর্ভে তোমার পুত্র অবহেলিত, তার নামও শোনা যায় না। বিরাটরাজা যখন উত্তরার বিবাহ সম্বন্ধ করলেন তখন তাকে তোমার দ্রৌপদী-গর্ভজাত পুত্র শ্রুতকর্মার জন্য গ্রহণ করলেই পারতে, অভিমন্যুর জন্য কেন? পট্টমহিষী দ্রৌপদীর সমস্ত পুত্রগুলির মৃত্যুও হয়েছে এমনভাবে, যা একটু বীরোচিত নয়। সবই দ্রৌপদীর ভাগ্য। অথচ সুভদ্রার ধারায় অভিমনু মারা গেলেও তাঁরই বংশ পরীক্ষিৎ, জন্মেজয় পাণ্ডবকুলের রাজ্যশাসন করেছেন। স্বামী এবং পুত্র—কোনওটাতেই চরম সুখ হয়নি দ্রৌপদীর। প্রায় সারা জীবনই রাজ্যহীন অথচ—শুধু পট্টমহিষীর উপাধিটা বয়ে বেড়ানো ছাড়া দ্রৌপদী আর কিছুই পাননি।

আসলে বিদগ্ধা এক রমণীর অধিকার স্বামীর পক্ষে অতি গৌরবের কথা। কিন্তু সে যদি অতি বিদগ্ধা হয় তাহলে স্বামী তাঁকে যতখানি ভালবাসেন তার চেয়ে বেশি ভয় পান। দ্রৌপদীকে অনেকেই ভয় পেতেন, স্বামীরাও। ব্যাতিরেক একমাত্র অর্জুন, কারণ তিনি নির্লিপ্ত। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত তার পুত্রদের সাবধান করে দিয়েছেন দ্রৌপদীর তেজস্বিতা সম্পর্কে। ঘোষযাত্রা পর্বে তিনি বলেছেন—দ্রৌপদী শুধু তেজেরই প্রতিমূর্তি—যজ্ঞসেনস্য দুহিতা তেজ এব তু কেবলম্। রাজমাতা কুন্তী, যিনি নিজেও প্রায় কোনওদিন রাজ্যসুখ ভোগ করেননি, তিনি অসীম প্রশ্রয়ে তাঁর এই পুত্রবধূটিকে তেজস্বিনী দেখতেই ভালবাসতেন। অন্তত একজন স্ত্রীলোক হিসেবে পুত্রবধুর মর্যাদা সর্বক্ষণ তাঁর অন্তরাশায়িনী ছিল। বনবাসে যাবার সময় দ্রৌপদীকে তিনি বলেছেন—আমি নিশ্চিন্ত, কারণ পতিব্রতার খামায় শেখাতে হবে না। সত্যি কুন্তী নিশ্চিন্ত ছিলেন, কিন্তু বনবাসের চোদ্দো বছরের মাথায় কৃষ্ণ যখন দূতীয়ালি করার জন্য কৌরব-সভায় এসেছেন, তখন কৃষ্ণের দেখা পাওয়ামাত্র তিনি যেমন তাঁর প্রিয় পুত্রদের জন্য বিলাপ করেছেন, তেমনি করেছেন পুত্রবধু দ্রৌপদীর জন্য। কুন্তী বলেছেন—প্রিয় পুত্রদের থেকেও দ্রৌপদী আমার কাছে প্রিয়তরা—সর্বৈঃ পুত্রৈঃ প্রিয়তরা দ্রৌপদী মে জনার্দন! সে নিজের পুত্রস্নেহ জলাঞ্জলি দিয়ে স্বামীদের সঙ্গে কষ্ট করা বেশি ভাল মনে করেছে। কুন্তী তাঁর উপাধি দিয়েছেন—ঈশ্বরী সর্বকল্যাণী। স্ত্রীলোক হিসেবে কুন্তীর কাছে দ্রৌপদীর মর্যাদা যে কতখানি, সেটা বোঝা যায় কুন্তী যখন কৃষ্ণকে বলেন—যেদিন কৌরবসভায় কেস শ্রমি দ্রৌপদীর অপমান দেখেছি, সেদিন থেকে কি যুধিষ্ঠির, কি ভীম, কি অর্জুন, কুল, সহদেব—কাউকে আমি তার প্রিয় বলে ভাবতে পারি না। কুন্তী দ্রৌপদীর অপমানে এতখানি অপমানিত বোধ করেন য়ে, পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরের হার, রাজ্য-হারানো এমনকী পুত্রদের নির্বাসন পর্যন্ত তাঁর সইতে পারে, কিন্তু রাজসভায় দ্রৌপদীকে খারাপ কথা বলা—এ তাঁর সয় না—ন দুঃখং রাজ্যহরণং ন চ দ্যূতে পরাজয়ঃ। …যত্‌তুসা বৃহতী শ্যামা একবস্ত্রা সভাং গতা। অশৃণোৎ পরুষা বাচঃ কিংনু দুঃখতরং ততঃ।

কুন্তীর এই অভিমানী মর্যাদাবোধ দ্রৌপদীর অন্তরে সর্বক্ষণ অনুস্যূত ছিল। তিনি মুখে যতই বলুন কেন—ক্ষত্রিয়কুলে যেন আর কারও জন্ম না হয়, দ্রৌপদী ছিলেন সেই মানের ক্ষত্রিয়রমণী যিনি কোনও কিছুর মূল্যেই মান খোয়াতে রাজি নন। বাস্তব জীবনে তিনি যতখানি প্রেমিক বা কুলবধু, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষাত্র তেজে তেজস্বিনী। সে তেজ এমনই যে তা প্রায় তাঁর পুরুষস্বামীদের সমান্তরাল। যেদিন থেকে তাঁর অপমান হয়েছে সেদিন থেকে প্রতিশোধ-স্পৃহাই তাঁর ধ্যান এবং জ্ঞান। মহাভারতের শল্যপর্বে এসে দেখেছি—যখন একে একে ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের মতো প্রধান সেনাপতিরা মারা গেছেন, মারা গেছেন দুর্যোধনের ভাইয়েরা, কুলগুরু কৃপাচার্য তখন সন্ধি করতে বললেন দুর্যোধনকে। দুর্যোধন বললেন—আমি এখন সন্ধি করলেও পাণ্ডবেরা সন্ধি করবেন না। তাঁর অনেক যুক্তির মধ্যে একটি হল দ্রৌপদী। এতদিনে দুর্যোধনের বোধ হয়েছে যে, রাজসভায় দ্রৌপদীর যে অপমান তাঁরা করেছিলেন, সে অপমানের শোধ না হওয়া পর্যন্ত পাণ্ডবেরা কেন, স্বয়ং দ্রৌপদীই ছাড়বেন না। দুর্যোধনের কাছেই আমরা শুনেছি যে অপমানের পরের দিন থেকেই দ্রৌপদী নাকি প্রতিশোধ-স্পৃহায় আপন স্বামীদের জয়লাভের জন্য তপশ্চরণ করছেন এবং সেই তপস্যার অঙ্গ হিসেবে সেদিন থেকেই তিনি নাকি মাটিতে শোন। দ্রৌপদী মাটিতে শোবেন ততদিনই, যতদিন না মূলশত্ৰু দুর্যোধনের অন্ত হচ্ছে—স্থণ্ডিলে নিত্যদা শেতে যাবদ্‌ বৈরস্য যাতনম্।

এই হচ্ছেন দ্রৌপদী। শুধু ‘প্রাজ্ঞা’ ‘পণ্ডিতা’ কিংবা ‘মনস্বিনী’ নন, আগুনের মতো তেজস্বিনী। অজ্ঞাতবাসের শেষে যেখানে কোরবদের সঙ্গে কথাবার্তার ‘স্ট্র্যাটিজি’ ঠিক করা হচ্ছে, সেদিন পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে একমাত্র সহদেব ছাড়া চারজনই, এমনকী ভীমও সন্ধির সুরে কথা বলেছিলেন। অন্তত ভীমের আচরণ দেখে দ্রৌপদী তো কিঞ্চিৎ হতাশই হয়ে পড়লেন—ভীমসেনঞ্চ সংশান্তং দৃষ্ট্বা পরমদুর্মনাঃ। সেদিন এই কনিষ্ঠ স্বামীকেই সহায় করে—সম্পূজ্য সহদেবঞ্চ—দ্রৌপদী কৃষ্ণের কাছে তাঁর প্রতিশোধের বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন। দুঃশাসনের হাত-ছোঁয়ানো দ্রৌপদীর চুল—অসিয়তায়তমূর্ধজা—সর্বজনের অভিজ্ঞানের জন্য সেদিন ভোলাই ছিল। দ্রৌপদী আজকে আবার রাজনীতির পাকা আলোচনায় সামিল। অনেক কথার মধ্যে দ্রৌপদী বললেন—যুধিষ্ঠির মাত্র পাঁচখানি গ্রাম চেয়ে দুর্যোধনের সঙ্গে সন্ধি চাচ্ছেন, তাও যেন লজ্জার সঙ্গে হ্রীমতঃ সন্ধিমিচ্ছতঃ। মনে রেখ কৃষ্ণ! দুর্যোধন যদি ঈপ্সিত রাজ্য না দেন, তাহলে যেন খবরদার সন্ধি করতে যেয়ো না, দুর্যোধন করতে চাইলেও না—সন্ধিমিচ্ছেন্ন কৰ্ত্তব্যস্তত্র গত্বা কথঞ্চন। তাদের ওপরে তোমার দয়া দেখানোর দরকার নেই। যেখানে মিষ্টি কথায় কাজ হয় না, সেখানে দণ্ড দিতে হয় এবং এই পাপিষ্ঠদের দরকার মহাদণ্ড—তস্মাত্তেষু মহাদণ্ডঃ ক্ষেপ্তব্যঃ ক্ষিপ্রমত্যুত।

পরপর খানিকটা ওজস্বিনী বক্তৃতা দিয়ে দ্রৌপদী এবার করুণরসের ছোঁয়া লাগালেন রমণীর অস্ত্র হিসেবে। বললেন, কৃষ্ণ! তোমাকে ভাল করেই বলছি, হয়তো বা পুনরুক্তিও হচ্ছে, কিন্তু সীমন্তিনী কুলবধূর দুর্দশা আমার মতো আর কার হয়েছে বলতে পার! যজ্ঞের আগুন থেকে আমার জন্ম, মহারাজ দ্রুপদের মেয়ে আমি। ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন আর তোমার না আমি বন্ধু—তব কৃষ্ণ প্রিয়া সখী। আজকে মহারাজ পাণ্ডুর কুলবধূ হয়ে, পাঁচটা বীর স্বামী থাকতে এবং পাঁচটা ছেলে থাকতেও কৌরবসভায় আমাকে সেই অপমান সইতে হল? এই পাণ্ডবদের শরীরে যেন তখন রাগ বলে কিছু ছিল না, তাঁরা কোনও চেষ্টাও করেননি আমাকে বাঁচাবার। তাঁরা শুধু স্থানু সাক্ষীর মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার অপমান দেখছিলেন—নিরমর্ষেষু অচেষ্টেষু প্রেক্ষমাণেষু পাণ্ডুষু। ধিক্ এই অর্জুন আর ভীমকে যদি এঁরা থাকতেও দুর্যোধন আর এক মুহূর্তও বেঁচে থাকে—যত্র দুর্যোধনঃ কৃষ্ণ মুহূৰ্ত্তমপি জীবতি।

লক্ষণীয়, দ্রৌপদী যেখানে নিজেকে করুণার যোগ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন, সেখানে তাঁর করুণ-রসাত্মক বাক্যগুলির মধ্যেও ওজস্বিতার ছোঁয়া লাগে। প্রত্যেক কথায়, প্রত্যেক শব্দে প্রতিহিংসার ফুলকি ছড়িয়ে দ্রৌপদী মাথা ঝাঁকিয়ে তাঁর বাম বাহুতে নিয়ে এলেন আপন কুঞ্চিত কেশদাম। বেণী করা থাকলেও সে চুলের কোকড়ানো ভাব, ঘনত্ব অথবা সুবাস—কোনওটাই চাপা দেওয়া যাচ্ছে না। সেই বিশাল বেণী-ভূজঙ্গিনীকে কৃষ্ণা তুলে নিলেন তাঁর বাম হাতে—মহাভুজগর্বচ্চস। কেশপক্ষং বরারোহা গৃহ্য বামেন পাণিনা। সেই কুটিল কেশদামের মধ্যে বিষধর সর্পের অভিসন্ধি আরোপ করে দ্রৌপদী আকুল, জলভরা চোখে আস্তে আস্তে কৃষ্ণের কাছে এলেন। প্রস্ফুটিত পদ্মের পাপড়ির মতো আয়ত চোখে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে পাণ্ডব-ঘরণী কৃষ্ণা বললেন—এই সেই চুল, কৃষ্ণ! যে চুলে হাত লাগিয়েছিল দুঃশাসন। তোমার সন্ধি করার ইচ্ছে প্রবল হলে তুমি শুধু এই আমার চুলের কথা মনে রেখ-স্মৰ্ত্তব্যঃ সর্বকার্যেষু পরেষাং সন্ধিমিচ্ছতা।

বক্তৃতায় এই অলংকার-পর্বের পর এবারে ‘আলটিমেটাম্‌’। দ্রৌপদী বললেন ভীম আর অর্জুনকে তো দেখছি যুদ্ধের ব্যাপারে একেবারে যেন মিইয়ে গেছে, তারা যেন এখন সন্ধির জন্যই সজ্জিত। আমি বলছি—তাঁরা যদি যুদ্ধ করতে না চান, তাহলে জানবে—যুদ্ধ করবেন আমার বৃদ্ধ পিতা, যুদ্ধ করবেন আমার ভাইয়েরা—পিতা মে যোৎস্যতে বৃদ্ধঃ সহ পুত্রৈ-র্মহারথৈঃ। যুদ্ধ করার লোক আছে আরও। আমার পাঁচটি ছেলে তাদের মায়ের সম্মান রক্ষা করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে, আর তাদের নেতৃত্ব দেবে কুমার অভিমন্যু— অভিমন্যুং পুরস্কৃত্য যোৎস্যন্তে কুরুভিঃ সহ।

দ্রৌপদী যাঁদের নাম করলেন, তাঁদের ওপর তাঁর অধিকার একান্ত। এমনকী অর্জুন যতই সুভদ্রা-সোহাগী হন না কেন, সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যুর ক্ষমতা ছিল না তার বড়-মায়ের আদেশ অমান্য করার। আর দ্রৌপদীও সুভদ্রার এই ছেলেটিকে নিজের ছেলের থেকে কম স্নেহ করতেন না। সুভদ্রা নিজেও তাঁর বড় জা দ্রৌপদীকে কোনওদিনও কোনও ব্যবহারেই অতিক্রম করেননি। এই অনতিক্রমণই হয়তো ওজস্বিনী দ্রৌপদীকে সুভদ্রার ওপর সপত্নীর ঈর্ষা অতিক্রমের যুক্তি জুগিয়েছে। সেই যে বিবাহলগ্নেই সুভদ্রা এসে দ্রৌপদীকে বলেছিলেন—আমি তোমার দাসী, দিদি!—সে-ভাব তাঁর শেষ পর্যন্ত ছিল। শল্য পর্বে দুর্যোধনের মতো শত্রুপক্ষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, তাঁরা শত-চেষ্টাতেও সুভদ্রা এবং দ্রৌপদীর মধ্যে বিরোধ ঘটাতে সক্ষম হননি। তিনি বলেছেন—কৃষ্ণের বোন সুভদ্রা সমস্ত মান, অহঙ্কার ত্যাগ করে এখনও পর্যন্ত দ্রৌপদীর মতে চলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর সেবা শুশ্রূষা করেন দাসীর মতো—

নিক্ষিপ্য মানং দর্পঞ্চ বাসুদেব-সহোদরা।

কৃষ্ণায়াঃ প্রেষ্যবদ্‌ ভূত্বা শুশ্রুষাং কুরুতে সদা॥

কাজেই দ্রৌপদী স্বামীদের কাছে তাঁর প্রেমের যথাযথ মূল্য না পেলেও তাঁর ওজস্বিতার সম্মান, ব্যক্তিত্বের সম্মান সব সময় পেয়েছেন। নিজের ছেলেদের নেতৃত্বে কুমার অভিমন্যুকে স্থাপন করার মধ্যে ওই ওজস্বিতার সঙ্গে স্নেহধারা মিশেছে। হয়তো এই স্নেহধারা কৃষ্ণা পাঞ্চালীর অন্তরতম অর্জুনের প্রিয়তম পুত্র বলেই। তবু এই স্নেহ যে কতটা ছিল—তা স্বয়ং যুধিষ্ঠিরও ইয়ত্তা করতে পারেননি, যতখানি করেছেন সেই অর্জুন এবং তাও হয়তো বিদগ্ধা রমণীর অন্তর বিদগ্ধজনে বোঝে বলেই। প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেও বলতে বাধ্য হচ্ছি—ওজস্বিতার মতো কঠিন গুণের প্রতিতুলনায় স্নেহ বড় বিরুদ্ধ বস্তু হলেও ব্যাঘিনীর পুত্রের জন্য ব্যাঘ্রিনীর মমতা মোটেই অকল্পনীয় নয়। অভিমন্যু যখন সপ্তরথীর চক্রান্তে প্রাণ দিলেন, তখন যুধিষ্ঠির প্রচুর বিলাপ করেছিলেন। সেই সখেদ বিলাপোক্তির মধ্যে যুধিষ্ঠির বারবার এই কথা বলেছেন যে, তিনি অর্জুনের সামনে মুখ দেখাবেন কী করে! কী করেই বা তিনি অভিমন্যু-জননী সুভদ্রার মুখের দিকে চাইবেন—সুভদ্রাং বা মহাভাগাং প্রিয়ং পুত্রমপশ্যতীম্‌!

কিন্তু অর্জুনকে বলতে হয়নি। প্রিয় পুত্রটি যখন সামনে এসে দাঁড়াল না, যুদ্ধ শিবির থমথম করছে, তখনই অর্জুন বুঝেছিলেন—অভিমন্যু যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। কেমন করে সেই পুত্রের মৃত্যু ঘনিয়ে এল—সেটা সবিশেষ জিজ্ঞাসা করার প্রথম মুহূর্তেই অভিমন্যুর প্রিয়ত্বের সম্বন্ধগুলি স্মরণ করলেন অর্জুন। বললেন—কেমন করে মারা গেল সেই বালকটি, যে শুধু সুভদ্রাই নয়, দ্রৌপদী এবং কৃষ্ণের প্রিয় পুত্র—সুভদ্রায়াঃ প্রিয়ং পুত্রং দ্রৌপদ্যাঃ কেশবস্য চ। এরপর আবার যখন অর্জুনের বিলাপোক্তির মধ্যে নিজের প্রতি ধিক্কার আসছে—প্রিয় পুত্রকে বাঁচাতে পারেননি বলে, তখনও সবার কথা বাদ দিয়ে শুধু দুটি শোকার্তা রমণীর মুখ তাঁকে পীড়ন করছে। কিন্তু শোক-ক্লিষ্ট অবস্থার মধ্যেও এই দুই রমণীর মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য অর্জুনের পর এড়ায় না। অভিমন্যুর প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে অর্জুন এই দুই নারীর নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারন করেন, কিন্তু তবুও তার মধ্যে বলতে ভোলেন না—অভিমন্যুকে না দেখে সুভদ্রা আমায় কী বলবে? আর শোকার্তা দ্রৌপদীকে আমিই বা কী বলব?-সুভদ্রা বক্ষ্যতে কিং মাম্‌ অভিমন্যুম্ অপশ্যতা। দ্রৌপদী চৈব দুঃখার্তে তে চ বক্ষ্যামি কিং ম্বহম্ ॥

‘একজন আমায় কী বলবে, অন্যজনকে আমি কী বলব?’ অর্থাৎ প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে এই দুই নারীই একইভাবে শোক সন্তপ্ত হন হন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁদের মধ্যে প্রথমা সুভদ্রার শোকের আচ্ছাদন এতটাই যে, তিনি প্রিয় পুত্রের মুত্যুর জন্য বারবার অর্জুনের কাছে নিরাশ্রয়তার আর শুন্যতার হাহাকার শোনাবেন। তাই অর্জুন বলছেন—সুভদ্রা আমায় কী বলবে? কিন্তু ওই পুত্রহীনার শত শূন্যতার মধ্যেও অন্যতরা রমণী তাঁকে প্রশ্ন করবে—তোমার এই শিব-স্পর্ধী ধনুষ্মত্তা নিয়ে বাসববিজয়ী বীরত্ব নিয়ে তুমি কী করছিলে, অর্জুন? তাই অর্জুনকে ভাবতে হয়—আমি দ্রৌপদীকে কী-ই বা বলব—তে চ বক্ষ্যামি কিং ম্বহম্। দ্রোপদী এইখানেই দ্রোপদী। বস্তুত অর্জুন এই অসম্ভব মৃত্যু-সংবাদ বহন করে এই দুই নারীর মুখোমুখি হতে পারেননি। আমার বক্তব্য ছিল—অসামান্য প্রেম, বা অকৃত্রিম স্নেহধারার মধ্যেও দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্ব এমনই যে, অন্যায় এবং ক্ষত্রিয়ের শিথিলতায় তিনি প্রশ্ন না করে থাকবেন না। কাজ বিলা করবেন গালাগালিও দেবেন, কিন্তু দ্রৌপদী প্রতিশোধ চাইবেন, জীবনের বদলে জীবন—আমি সুখে নেই, তুমিও সুখে থাকবে না।

আমি আমার পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে যাই। দ্রৌপদী, তাঁর স্বামীদের কাছে সার্থক প্রেমের মূল্য যতখানি পেয়েছেন, ব্যক্তিত্বের মূল্য পেয়েছে তার চেয়ে বেশি। তার স্বামী ছাড়াও অন্য যাঁরা আছেন, তাঁরাও দ্রৌপদীর সাভিমান ব্যক্তিত্বকে অতিক্রম করতে পারেননি। ফলে কৃষ্ণের মতো অসাধারণ পুরুষকেও দ্রৌপদীর স্বাধিকার-বক্তৃতা সমস্ত গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়েছে। সন্ধির আশয় নিয়ে যে মহান দূত কৌরব-সভায় যাচ্ছিলেন, তিনি পূর্বাহ্নেই দ্রৌপদীকে নিজের নামের মাহাত্ম্যটুকু ধার দিয়ে কবুল করে বসলেন—আজ তুমি যেমন করে কাঁদছ, কৃষ্ণা! ঠিক এমনই কাঁদবে (কৌরবপক্ষের কুলবধূরা। স্বামী, পুত্র, ভাই, বন্ধু—সব হারিয়ে কাঁদবে এবং তা কাঁদবে শুধু তুমি তাদের ওপর রাগ করেছ বলে—যেষাং ক্রুদ্ধাসি ভামিনি। কত অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারী এই কৃষ্ণ। তাঁর ধারণা—ভীম, অর্জুনের মতো মহাবীরদের সন্ধিকামুকতার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যাই থাকুক, দ্রৌপদীর তাতে মন ভরবার কথা নয়, কারণ কুরুসভায় যে অপমান হয়েছিল তার বলি একমাত্র দ্রৌপদীই। পাছে ভীম, অর্জুনের মতো স্বামীকে তিনি ভুল বোঝেন, তাই কৃষ্ণ বললেন—আমি যা বললাম, তা আমি এই ভীম অর্জুন কি নকুল-সহদেবকে সঙ্গে নিয়েই করব, স্বয়ং ধর্মরাজও সেই নির্দেশ দেবেন। কৃষ্ণ বললেন—আমার অনুরোধ যদি কৌরবরা না শোনে, তাহলে শেয়াল-কুকুরের খাদ্য হয়ে রণভূমিতে মরে পড়ে থাকতে হবে তাদের। আজকে যদি হিমালয় পাহাড়ও চলতে আরম্ভ করে, পৃথিবীও যদি ফেটে যায় শতধা, আকাশও যদি তার নক্ষত্রবাহিনী নিয়ে ভেঙে পড়ে ভুঁয়ে, তবুও আমার কথা অন্যথা হবে না, কৃষ্ণা! তুমি আর কেঁদো না কৃষ্ণে বাষ্পে নিগৃহ্যতাম্।

আবারও সেই সম্বোধন—কৃষ্ণা। নিজের নামের সমস্ত ব্যাপ্তি দ্রৌপদীর ডাক-নামে লিপ্ত করে কৃষ্ণের এই সম্বোধন—কৃষ্ণা। যুধিষ্ঠির যা পারেননি, অর্জুন-ভীম যা পারেননি, কৃষ্ণ তাই পারলেন। কেন পারলেন—সে কথায় শর আসছি।

আমি আগেই বলেছি—দ্রৌপদী আগুনের মতো। কৌরবরা কৃষ্ণের প্রস্তাব মেনে নেননি। অতএব একদিন যে কুরুকুল ভীষ্ম, বিদুর এবং রাজমাতা সত্যবতীর বিচক্ষণতায় সংবর্ধিত হয়েছিল, সেই কুরুকুল দ্রৌপদীর ক্রোধের আগুনে আপনাকে আহুতি দিল। সংস্কৃতের নীতিশাস্ত্রে একটা লোকপ্রসিদ্ধ কথা চালু আছে। কথাটার মোদ্দা অর্থটা হল—সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি—এই চর্তুযুগের এক একটিতে একেকজন অসামান্যা নারী জন্মেছেন, যাঁদের কারণে প্রচুর লোকক্ষয়, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং অশান্তি হয়েছে। নীতিশাস্ত্রকার এই নারীর নাম দিয়েছেন ‘কৃত্যা’। ‘কৃত্যা’ শব্দটির অর্থের মধ্যে একটু হীনতা আছে, কারণ কৃত্যা মানে হল এক ধরণের অপদেবতা। কখনও বা যজ্ঞীয় অভিচার প্রক্রিয়ায় সেই অপদেবী নারীর উৎপত্তি হয় অপরের ধ্বংস সাধনের জন্য। এই শ্লোকটিতে অবশ্য কৃত্যা শব্দটি আরও একটু বিশদর্থে ব্যবহৃত। এখানে বলা হচ্ছে—সত্যযুগের কৃত্যা হলেন রেণুকা।

রেণুকা মহর্ষি জমদগ্নির স্ত্রী, পরশুরামের মা। ছেলে হয়েও পরশুরাম মাকে মেরেছিলেন, এইটাই তাঁর সম্বন্ধে বিখ্যাত কথা। বাবার কাছে বর লাভ করে পরশুরাম অবশ্য মাকে পরে বাঁচিয়ে ছিলেন।

এক সময় ক্ষত্রিয়কুলের বিশাল পুরুষ কার্তবীর্য-অর্জুন পাত্রমিত্র নিয়ে জমদগ্নির আশ্রমে আসেন। জমদগ্নি তাঁর কামধেনু সুশীলার সাহায্যে অতিথি-সংস্কার করেন বটে, কিন্তু ওই কামধেনুর ওপর কার্তবীর্যের লোভ হয়। মুনিও তাঁর হোমধেনু দেবেন না, রাজাও সেটা নেবেন। ফল হল এই যে, ব্রাহ্মণের সঙ্গে ক্ষত্রিয়কুলের যুদ্ধবিগ্রহ বেধে গেল। চলল আক্রমণ, পালটা আক্রমণ। জমদগ্নির দিক থেকে যুদ্ধ চালাতে লাগলেন কিংশুরাম। তিনি কার্তবীর্যের হাজার হাত কেটে মেরে ফেললেন তাঁকে। ওদিকে পরশুরাম ইন বাড়ি নেই তখন কার্তবীর্যের ছেলে এসে জমদগ্নি মুনিকেই মেরে রেখে গেল। এই সময়ে জমদগ্নির স্ত্রী রেণুকা নাকি স্বামীর মৃত্যু যন্ত্রণায় একশোবার বুক চাপড়ে কেঁদেছিলেন। পুত্র পরশুরাম তখন বাধা দিয়ে মায়ের হাত ধরেন এবং প্রতিজ্ঞা করেন একুশবার তিনি ক্ষত্রিয় নিধন করবেন। এই শুরু হল। পরশুরাম ক্ষত্রিয় মেরে মেরে রুধির হ্রদ তৈরি করে গেলেন। জমদগ্নির স্ত্রী রেণুকা এই একুশবার ক্ষত্রিয় নিধনের কারণ বলে সত্য যুগের কৃত্যা হলেন তিনি।

ত্রেতাযুগের কৃত্যা হলেন জনকনন্দিনী সীতা। সীতার কারণেই রামচন্দ্রের সাগর পার হয়ে লঙ্কায় যাওয়া এবং রাবণ বধ। কবির মতে দ্বাপরের কৃত্যা হলেন দ্রৌপদী। কারণ তাঁকে অপমান করার ফলেই কুরুকুল উৎসাদিত হয়েছিল। সবার শেষে কবির মজাদার মন্তব্য—কলিকালে ঘরে ঘরে এই কৃত্যাদেবীরা আছেন, যাঁরা ঘর ভাঙেন—দ্বাপরে দ্রৌপদী কৃত্যা কলৌ কৃত্যা গৃহে গৃহে।

শ্লোকটা আমি উদ্ধার করলাম বটে, তবে এই শ্লোকের ভাবার্থের সঙ্গে আমার মতের মিল হয় না। প্রথমত দেখুন, কলিযুগের ‘ঘর-পোড়ানি, পরভুলানি’ সামান্যা নারীগুলির সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে দ্রৌপদীর নাম উচ্চারণ করায় আমার আপত্তি আছে। দ্বিতীয়ত জনকনন্দিনী সীতা রাবণ-বধের যত বড় নিমিত্তই হন না কেন, তাঁর সঙ্গেও দ্রৌপদীর কোনও তুলনা হয় না। আর ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের কুলক্ষয়ী যুদ্ধে রেণুকার একুশবার বুক চাপড়ানোটা এতই অকিঞ্চিৎকর যে, রেণুকাকে একটি গোটা যুগের’ ধ্বংস-প্রতীক বলে মেনে নিতে আমার যৌক্তিকতায় বাধে। আমার তো মনে হয় দ্বাপর -কলির সন্ধিলগ্নে এই যে বিরাট ভারত যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধের নিমিত্ত হিসেবে দ্রৌপদী অত্যন্ত ব্যতিক্রমীভাবে উজ্জ্বল বলেই তাঁকে একটি যুগ-ধ্বংসের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করা অনেক বেশি সযৌক্তিক। অপিচ সেইটেই একমাত্র বেশি সযৌক্তিক বলে অন্যান্য যুগেও আরও এক একটি নারীকে শুধু খাড়া করে দেওয়া হল চতুর্যুগের শূন্যতা পূরণের জন্যই। নইলে দেখুন, সত্যযুগের রেণুকা বা কলিকালের ফাঁপা-চুলের রোম-দোলানো বিনোদিনীর কথা না হয় বাদই দিলাম, ত্রেতা যুগের সীতা লঙ্কার রাক্ষস ধ্বংসের যতখানি কারণ, রামচন্দ্র নিজেই তাঁর চেয়ে তাকে বেশি কাম। রাবণ-বধের অন্তে সীলা উল্পে পর রামচন্দ্র নিজেই প্রায় সে কথা স্বীকার ক্ষুরে বলেছেন—সমুদ্র লঙঘন করে এসে অশেষ রনপরিশ্রমে রাক্ষস রাবণকে আমি যে শাস্তি দিয়েছি—তা তোমার জন্য নয় সীতা। তা সবটাই প্রখ্যাত রঘুবংশের কলঙ্ক-মোচনের জন্য, নিজের মান রক্ষার জন্য—ময়েদং মানকাঙিক্ষণা। তবু অসামান্য রূপবতী সীতাকে আমরা ত্রেতাযুগের কৃত্যা হিসেবে মেনে নিতে পারি, কারণ সীতাহরণ না হলে সেই বিরাট লঙ্কাকাণ্ড ঘটত না।

কিন্তু রান সীতাক হরণ করেছেন, তাতে সীতার দিক থেকে অক্ষম বিলাপোক্তি ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। “তিনি অত্যন্ত পতিনির্ভর এবং সেই ভরসাই তাঁর কাজে লেগেছে। কিন্তু অনুরূপ পরিস্থিতিতে দ্রৌপদী পড়লে কী হত, তা সভাপর্বে বস্ত্র হরণের সময়েই টের পাওয়া গেছে। পাঁচটি স্বামীর কাশের সেখানে সঙ্গত কারণেই কথা বলার উপায় ছিল না। কিন্তু দ্রৌপদী নিজেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না! বস্ত্রাকর্ষণের হতচকিত মুহূর্তগুলির মধ্যেও তিনি কৌরবসভায় ধুন্ধুমার লাগিয়ে দিয়েছিলেন এবং সভা শেষ হয়েছে তাঁরই অনুকূলে। কাজেই সীতাহরণের বদলে দ্রৌপদী-হরণ হলে দ্রৌপদী যে নিষ্ক্রিয় থাকতেন না—তা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। অন্তত হনুমান পৌঁছনোর আগেই অশোকবনে যে ধুন্ধুমার লেগে যেত—তা বেশ অনুমান করা যায়।

তবু বলি, এই সব তাৎক্ষণিক প্রত্যাশা তো দ্রৌপদীর কাছে করাই যায়, কিন্তু এমনটাই দ্রৌপদী নয়। দ্রৌপদী আরও অনেক বড়। অন্তত সমস্ত, কুরুকুল-ধ্বংসের প্রতীক হিসেবে দ্রৌপদীকে চিহ্নিত করতে গেলে কুরুসভার মধ্যে তাঁর সর্বাঙ্গীন অপমানই একমাত্র কারণ—এমন একটা কথাও বড়ই অকিঞ্চিৎকর শোনাবে। মনে রাখা দরকার, মহাভারতের কবি যাঁকে ‘মনস্বিনী’ অথবা ‘পণ্ডিতা’ শব্দের উপাধিতে ভূষিত করেছেন, তিনি শুধু নারীর অপমানে ক্লিষ্ট হন না। পঞ্চস্বামীকেও তিনি শুধুমাত্র তাঁর একান্ত অপমানের দ্বারাই চালিত করেছেন—তাও আমি মনে করি না। মহাকাব্যের বিরাট পরিমণ্ডলে কুরুসৃভায় দ্রৌপদীর অপমান একটা খণ্ডচিত্র মাত্র। সেই অপমান থেকে উৎক্ৰমণ করার জন্য তাঁর বীরস্বামীদের সহায়তার প্রয়োজন হয়নি, তিনি একাই ছিলেন তার জন্য যথেষ্ট।

কুরুসভায় আসবার আগে যুধিষ্ঠির তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ‘একবস্ত্র অধোনীবী’ অবস্থায় শ্বশুর ধৃতরাষ্ট্রের সামনে এসে কেঁদে কেঁদে তিনি যেন তাঁর করুণা উদ্রেক করেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির তাঁকে চেনেননি। কুরুসভায় এসে তিনি যে নিজের জ্যেষ্ঠ-স্বামীকেই আইনের ফাঁদে ফেলে আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন অথবা আপন মনস্বিতায় শ্বশুরকে সন্তুষ্ট করে সেই ফাঁদে-পড়া জ্যেষ্ঠ-স্বামীকেই প্রথম মুক্ত করবেন কৌরবদের হাত থেকে—এসব কথা যুধিষ্ঠির ভাবতেই পারেন না। বিদগ্ধা রমণীর বিচিত্র হৃদয় বুঝতে পারেন না বলেই যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর কথায় কখনও থতমত খান, কখনও পুলকিত হন, কখনও সাতিশয় ক্রুদ্ধ হন, কখনও বা গালাগালিও দেন। কিন্তু এই যে ‘কনফিউশন’, এই দ্বিধাগ্রস্ততা—এর কারণও দ্রৌপদীর বৈদগ্ধ্যই। নারীত্বের সঙ্গে ব্যক্তিত্ব, পড়াশুনো এবং রাজনীতির জ্ঞান যদি একত্তর হয়ে যায়, তাহলে যে বিশালতা জন্মায়, সেই বিশালতা ধারণ করার ক্ষমতা যুধিষ্ঠিরের ছিল না। যাঁর ছিল, তিনি সে-পথে হাঁটেননি একান্ত ব্যক্তিগত কারণে—তিনি অর্জুন। আরও যাঁর ছিল—তিনি তাঁকে অবধারণ করেছেন বটে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি একটু ঘরের বাইরের লোক—তিনি কৃষ্ণ। তবু সে-কথা পরে।

দ্যূতক্রীড়ার উত্তর পর্বে যে দিন কৃষ্ণা পাঞ্চালী কুরুকুলের দাসপঙ্ক থেকে তাঁর পঞ্চ স্বামীকে উদ্ধার করে আনলেন—সেদিন দুর্যোধন-কৰ্ণরা বাঁকা হাসি হেলে প্রলেছিলেন—যারা জলে ডুবে মরছিল, আঁকড়ে ধরবার মতো কিছু ছিল না, সেই নিমজ্জমান পাণ্ডবদের দ্রৌপদী যেন নৌকার মতো এসে পার করে নিয়ে গেলেন—পাঞ্চালী পাণ্ডুপুত্ৰাণং নৌরেষা পারগাভবৎ। কথাটা সেই মুহূর্তে যতই বাঁকা শোনাক, কথাটার মধ্যে গভীর সত্য আছে, এবং সে-সত্য স্বয়ং যুধিষ্ঠিরই পরে স্বীকার করেছেন। কর্ণের ওই কথা শুনে ভীম তো সেই মুহূর্তে রেগেমেগে অস্থির হয়েছিলেন, কিন্তু ওই একই কথা পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ স্বীকার করে নিয়েছিলেন পরে। যখন বনপর্বে স্বয়ং দ্রৌপদী এবং ভীমের কাছে তিনি তাঁর প্রশান্তি আর ক্ষমাগুণের জন্য গালাগালি খাচ্ছেন, তখন তিনি বলেছেন—তোমরা যে দুজনে মিলে আমায় গালাগালি করছ, সেটা যত খারাপই শোনাক, তবু বেঠিক নয়। আমি যে অসম্ভব একটা অন্যায় করেছিলাম, তার কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে তোমাদের—মমানয়াদ্ধি ব্যসনং ব আগাৎ। আমার যথেষ্ট মনে পড়ে—যেদিন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা কপট পাশায় জিতে আমাদের রাজ্য নিয়ে নিল, আমাদের মাথায় চাপিয়ে দিল দাস-দাসীর অপমান-পঙ্ক, সেদিন এই দ্রৌপদী—আমাদেরই এই দ্রোপদীই, সবার প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছিলেন—যত্রাভবচ্ছরণং দ্রৌপদী নঃ।

এত নির্ভরতার সুরে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের এই যে স্তুতিবাদ-আপনারা কি মনে করেন—এই স্তুতিবাদে দ্রৌপদী একটুও সম্মানিত বোধ করেছেন? আমি যতদূর এই মহাকাব্যের নায়িকাকে চিনেছি, তাতে আমার বোধ হয় না যে, কোনও অসাধারণ বিপৎকালে স্বামীদের তিনি রক্ষা করেছেন—এই গৌরববোধ তাঁকে মোটেই স্বস্তি দেয় না। বরঞ্চ বিপৎকালে স্বামীরা কেন তাঁকে রক্ষা করতে পারেননি, কেন স্বামীরা বেঁচে থাকতেও—জীবৎসু পাণ্ডুপুত্রেষু—তাঁকে অন্য পুরুষের হাতে চুলের মুঠি-ধরা সইতে হল—এই কৈফিয়ত তিনি বার বার চেয়েছেন। তিনি তো স্বামীদের শরণ বা আশ্রয় হতে চান না, কিন্তু স্বামীরা তাঁর অপমান চোখে দেখছেন—এই অবস্থাতেও—পঞ্চানাং পাণ্ডুপুত্ৰাণাং প্রেক্ষতাং—কেন তাঁর আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারেননি—এই অনাস্থা বিদগ্ধা রমণীর বুকে পীড়ার সঞ্চার করে। কর্ণের বাঁকা কথা শুনে ভীম যে রেগে গিয়েছিলেন, বরং তাও তাঁর ভাল লাগে। তিনি তবু তাতে সনাথ বোধ করেন ; এই বোধ আছে বলেই কৌরবসভায় পঞ্চস্বামীর দাসত্ব-মুক্তির পর ধৃতরাষ্ট্র যখন আবারও বর দিতে চাইলেন, তখন তিনি বলেছিলেন—আমি আর কোনও বর চাই না। আমার স্বামীরা পাপকর্ম করে ফেলেছিলেন, কিন্তু এখন তাঁরা বিপদ থেকে উত্তীর্ণ—পাপীয়াংস ইমে ভূত্বা সন্তীর্ণা পতয়ো মম। এঁদের মঙ্গল এখন এঁরা নিজেরাই বুঝবেন।

এক্ষুনি যে শ্লোকটা বললাম—আমার স্বামীরা নীচকর্ম পাপকর্ম করে ফেলেছিলেন, এখন তাঁরা বিপদ থেকে উত্তীর্ণ—এই শ্লোকে ‘পাপীয়াংসঃ’ শব্দের অর্থ টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন—কৌরবদের দাস্যে তাঁরা নীচভাবে অবনমিত হয়েছিলেন। কিন্তু পাপীয়াংসঃ মানে কি দ্রৌপদী শুধু তাঁদের দাসত্বে কষ্ট পেয়েছিলেন? আমার তো মনে হয়—পাণ্ডবদের দাসত্ব-শৃঙ্খল থেকেও, তাঁর স্বামীরা যে উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে তাঁকে রক্ষা করতে পারলেন না, কুলবধূর লজ্জা নিবারণ করতে পারলেন না—এই অসহায়তার ঐই তিনি বলেছেন—আমার স্বামীরা নীচকর্ম করে ফেলেছিলেন। যেভাবেই হোক এখন তাঁরা মুক্ত, কী করতে হবে—সেই মঙ্গল কর্ম তাঁদের আপন পুণ্যবলেই তাঁরা সাধিত করবেন—বেৎস্যন্তি চৈর ভদ্রাণি রাজন্ পুণ্যেন কর্মণা।

কী সেই পুণ্য কর্ম, যার দ্বারা নিজেদের মঙ্গল সাধন করবেন তাঁর স্বামীরা? এই পুণ্য নিশ্চয়ই যজ্ঞে আহুতি দেওয়া অথবা ব্রাহ্মণের যজ্ঞ-তপস্যা নয়, ক্ষত্রিয়ের কাছে এই পুণ্য হল তার শক্তি, যে শক্তির দ্বারা সে অন্যায়কে দমন করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করে। দ্রৌপদী যে স্ত্রী-রক্ষায় অক্ষম স্বামীদের পাপী হয়ে পড়াটা দেখেছিলেন, তাতেও তিনি ততটা আহত হননি, যতটা হয়েছেন পরবর্তী সময়ে নিজের ক্ষমতায় তাঁরা প্রতিশোধ-বৃত্তি গ্রহণ না করায়। ‘পাপ’ বা ‘পাপী’ বলতে দ্রৌপদীর বোধে যে স্বামীদের অক্ষমতাই ছিল এবং ‘পুণ্য’ বলতে তাঁর মনে যে ক্ষত্রিয়বধূর প্রতিশোধ-স্পৃহাই ছিল আরও একভাবে বোঝা যায়।

দ্যূতক্রীড়ার দ্বিতীয় পর্বে যুধিষ্ঠির যখন পাশাখেলায় হেরে গেলেন, তখন অরণ্যবাসের শস্তি নেমে এল সমস্ত পাণ্ডবভাই এবং দ্ৰৌপদীর ওপর। যুধিষ্ঠির এবং অন্য বীর ভাইয়েরাও জানতেন এই পাশাখেলার জন্ম হয়েছে কৌরবদের লোভ এবং অন্যায় থেকেই। কিন্তু পাণ্ডবভাইয়েরা কেউই দুর্যোধনের বাজি ধরার প্রতিবাদ করেননি, যুধিষ্ঠিরকেও অতিক্রম করেননি। পাঞ্চালী-কৃষ্ণার পতির পুণ্যে সতীর প্রতিশোধ-স্পৃহা তৃপ্ত হয়নি কিছুই। এরই মধ্যে কৃষ্ণ এসে পৌঁছলেন কাম্যক বনে, পাণ্ডবদের কাছে। আগেও আমি একবার বলেছি—এই সময়ে কীভাবে দ্রৌপদী তাঁর অভিমান প্রকাশ করেছিলেন কৃষ্ণের ওপর। কিন্তু এই মুহূর্তে যে কথাটা ভীষণ জরুরি, তা হল ‘পাপ’ আর ‘পুণ্য’ বলতে দ্রৌপদী কী বুঝেছিলেন? দ্রৌপদী বলেছিলেন—ওঁদের দিক দেখে না হয় অন্যায়টা বুঝলাম। বুঝলাম যে, ভীষ্ম কিংবা ধৃতরাষ্ট্র তাঁদের ধর্মানুসারে বিবাহিতা কুলবধূর অপমানে প্রশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু আমি আমার স্বামীদের দোষই বেশি দিই, কেননা তাঁরা ভারতবিখ্যাত বীর অথচ তাঁরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁদের ‘ধর্মপত্নীর ধর্ষণা দেখেছেন—যৎ ক্লিশ্যমানাং প্রেক্ষন্তে ধর্মপত্নীং যশস্বিনীম্‌।

আপনাদের কি মনে হয় না—এখানে ‘ধর্মপত্নী’ কথাটার ওপর একটা আলাদা জোর আছে। মনে রাখা দরকার—এর পরেই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদী এবং ভীমের ঝগড়া, লাগবে; তখন ক্ষমা আর ধর্মের কথা কতবারই না বলেছেন যুধিষ্ঠির। দ্রৌপদী আগে ভাগেই তাই ধর্মের কথাই বলছেন। বললেন—চিরন্তন যে ধর্মপথ অথবা যে ধর্ম সজ্জন ব্যক্তিরা আচরণ করে এসেছেন এতকাল—সেই ধর্মে দৈহিক শক্তিহীন স্বামীরাও তাঁদের স্ত্রীদের সর্বতোভাবে রক্ষা করেন। সেখানে আমার কী হল? দ্রৌপদী এবার নিশ্চয়ই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের দিকে ইঙ্গিত করেছেন অর্থাৎ, ধরমপুত্র যুধিষ্ঠির থাকতেও, আমার এই দশা হল কেন। দ্রৌপদী এবার ভীমের কথার জবাব দিচ্ছেন, যদিও সে-কথা ভোলেভালা ভীমও বোঝেননি। দ্রৌপদীর ‘অনারে’ পাণ্ডবদের দাসত্ব মুক্তির পর কর্ণ তির্যকভাবে পাণ্ডবদের যা বলেছিলেন তার অর্থ—অগতির গতি তোদের এই বউটি। আমি আগেই বলেছি কথাটা শুনে ভীম খুব ক্ষেপে গিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষ্যাপার কথাগুলির ভাষা যা ছিল, তাতে কর্ণ যথেষ্ট বিদ্ধ হলেও দ্রৌপদীর গায়ে তার আঁচ লাগে। ভীম সে-কথা না বুঝলেও, দ্রৌপদীর সে কষ্ট আছে বলেই আমি মনে করি।

ভীম রেগে অর্জুনকে উদ্দেশ করে কর্ণের কথার জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন—হায়! শেষে স্ত্রীই কিনা পাণ্ডবদের গতি হল—স্ত্রী গতিঃ পাণ্ডুপুত্ৰাণাম্‌! শাস্ত্রে বলে যে, পুরুষ মানুষ যদি মারা যায়, যদি অপবিত্র হয়, জ্ঞাতিবন্ধু যদি তাকে ত্যাগ করে, তাহলে পুত্র, মঙ্গল কর্ম এবং বিদ্যা—এই তিন জ্যোতি তাকে সাহায্য করে। কিন্তু আজ আমাদের ধর্মপত্নীকে দুঃশাসন যেভাবে সবলে লঙঘন করল, তাতে তাঁর গর্ভের সন্তান কীভাবে আমাদের জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে!

কথাগুলি যতই ধর্মগন্ধী হোক না কেন, কথাগুলি ভাল নয়। এই কথায় যে স্বয়ং দ্রৌপদী জড়িয়ে পড়েন—সেটা সেই মুহূর্তে কর্ণ-দুঃশাসনের বিগর্হণার আতিশয্যে ভীম বুঝতে পারেননি। কিন্তু যাঁকে সম্বোধন করে ভীম কথাগুলি বলেছিলেন, সেই অর্জুন কিন্তু বুঝেছিলেন যে, এই ধর্ম-প্রবচন বেশি দূর এগোতে দেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেছিলেন—ফালতু লোকে কী বলল, না বলল—তাই নিয়ে কি ভদ্রলোক মাথা ঘামায়? ভীমের নিন্দাবাদ কর্ণ-দুঃশাসনের অসভ্যতা প্রকট করার জন্য যতটা, দ্রৌপদীর অসহায়তার জন্যও যে ততটাই—সেটা দ্রৌপদী বোঝেন, কিন্তু কথাটা তো ভাল নয়। তাই এ-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য কী হতে পারে—সেটা ভীমের নাম না করেও তিনি কৃষ্ণকে একভাবে বলেছেন। তিনি বলেছেন—দুর্বল লোকেরাও নিজের বউকে সব সময় বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে—যদ্‌ ভার্যাং পরিরক্ষন্তি ভর্ত্তারো’ল্পবলা অপি। স্ত্রীকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার অর্থ হল আত্মজ সন্তানকে রক্ষা করা। স্ত্রী এবং সন্তানের সুরক্ষার মধ্য দিয়ে পুরুষ নিজেও রক্ষিত হয়, কেননা পুরুষ স্ত্রীর গর্ভে নিজেই জন্মায় বলে স্ত্রীকে লোকে ‘জায়া’ বলে।

এতটা শাস্ত্র-প্রসিদ্ধ কথা বলে এইবার ভীমকে এক হাত নিচ্ছেন দ্রৌপদী অথাৎ ভাবটা এই—তুমি না বলেছিলে—দুঃশাসন যেভাবে আমাদের ধর্মপত্নীকে লঙঘন করল, তাতে তাঁর গর্ভের সন্তান পিতার কাছে জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে না। তাতে আমি বলি কি স্ত্রীকেই যেখানে স্বামীর সুরক্ষায় উদ্‌যুক্ত হতে হয়, যে স্বামী স্ত্রী-রক্ষায় নিরুদ্যম হয়ে নিজেই যেখানে স্ত্রীর আশ্রয়ে মুক্ত হন, সে আমার পেটে ধর্মজ সন্তানের জন্ম দিয়ে নিজে জন্মাবে কীভাবে—ভর্ত্তা চ ভার্যয়া রক্ষ্যঃ কথং জায়ান্ মমোদরে? এতকাল শুনে এসেছি—শরণাগত জনকে পাণ্ডবরা কখনও ত্যাগ করেন না, আমি যে ধর্মপত্নীর অধিকারে তাঁদের শরণাগত হয়েই আছি, কই আমার প্রতি তো তাঁরা সেই শরণাগত-পরিত্রাণের অনুগ্রহ দেখাননি—তে মাং শরণমাপন্নাং নান্বপদ্যন্ত পাণ্ডবাঃ। এত যে শুনি—এই ধনুর্যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয় করবেন, এমন শত্রু পৃথিবীতে নেই, কেন সেই পাণ্ডবরা দুর্বলতর কৌরবদের অপমান সহ্য করছেন—কিমর্থং ধার্তরাষ্ট্ৰাণাং সহন্তে দুর্বলীয়সাম্।

হয়তো শেষ বাক্যটি তাঁর অর্জুনের উদ্দেশে। কিন্তু অর্জুন-ভীমের উদ্দেশে যে কটুবাক্যই তিনি বলুন না কেন, দ্রৌপদীর মূল লক্ষ্য ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামী—ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, যাঁর ধর্ম এবং ক্ষমার অনুবৃত্তিতে ভীমার্জুনের মত শক্তিধরকেও দমিত হয়ে থাকতে হয়েছে। আসল কথা, কৌরব সভায় আত্মশক্তিতে স্বামীদের দাসত্ব-বন্ধন মোচন করেও দ্রৌপদী কোনও সাধুবাদে আগ্রহী নন, স্বামীরা কেন আপন যুক্তিতে স্ত্রীর সম্মান বাঁচাতে পারেননি বা এখনও কেন তাঁরা শত্রুর মাথায় পা দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না—এই প্রতিশোধ-ভাবনাতেই তিনি আকুল। কারণ স্বামীরা যদি স্বরাজ্যে সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হন, তা হলে আপনিই যে দ্রৌপদীর সম্মান ফিরে আসবে—সেটা দ্রৌপদী জানতেন। এই স্বরাজ্য এবং রাজ-সম্মানের মতো বিরাট একটা ব্যাপারের জন্য দ্রৌপদী নিজের অপমানকে শুধু নিমিত্তের মতো ব্যবহার করেছেন। বস্তুত পাণ্ডব-কৌরবদের জ্ঞাতিস্বার্থ এবং রাজনীতির মধ্যে তিনি এতটাই সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে, যখনই তিনি স্বামীদের, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের দুর্বলতা লক্ষ করেছেন, তখনই সবার ওপরে যে যুক্তিটা তিনি অস্ত্রের মতো ব্যবহার করেছেন—সেটা সেই কৌরব-সভায় অপমানের কথা।

তাই বলেছিলাম—দ্রৌপদী ঠিক সীতা বা রেণুকার মতো নন! তাঁর ধর্ষণ অপমান তিনি সব সময়ই মনে রেখেছেন বটে, কিন্তু সেইটাই সব নয়। তিনি চেয়েছেন, তাঁর স্বামীরা স্বাধিকারে প্রতিষ্ঠিত হন, এবং এই প্রতিষ্ঠায় যত বিলম্ব ঘটছিল, ততই পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের ওপর তাঁর ক্রোধ ঘনীভূত হচ্ছিল। কারণ, দ্রৌপদী জানেন—যুধিষ্ঠিরের একান্ত ধর্মবোধ এবং সহিষ্ণুতা ক্ষত্রিয়ের ধর্মের সঙ্গে মেলে না, ক্ষত্রিয় বন্ধুর আশা-আকাঙ্ক্ষাও তাতে তৃপ্তিলাভ করে না। তৃপ্তিলাভ করে না বলেই তিনি নিজের অপমান সমস্ত রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। আমাদের এই সিদ্ধান্ত যে মিথ্যা নয় তারও একটা প্রমাণ আমরা হাজির করার চেষ্টা করছি।