৪
দ্রৌপদী সুদেষ্ণার কাছে ফিরে গেলেন, চুল খোলা, চোখ লাল, রাজরানি দ্রৌপদীর মুখে সব শুনে দ্রৌপদীকে কথা দিলেন যে, তিনি কীচকের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। দ্রৌপদী বললেন—তার আর দরকার হবে না, যাঁদের ব্যবস্থা নেবার কথা, তাঁরাই নেবেন। রাজসভায় দ্রৌপদীকে পদাঘাতে ভুলুণ্ঠিতা দেখেছেন ভীম, অন্য কেউ নন। এ-কথা দ্রৌপদীর মনে ছিল, অতএব সুদেষ্ণাকে উত্তর দিতে দেরি হয়নি দ্রৌপদীর।
অপমানে মানুষের যা হয়, মনে মনে শালা, রাজার শালাকে মেরেই ফেলতে চাইলেন দ্রৌপদী—বধং কৃষ্ণা পরীস্পন্তী। মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য শীতল জলে গা ধুলেন, উত্তমাঙ্গ এবং অধমাঙ্গের বসন দুটিতে কীচকের পায়ের ধুলো, মাটির ধুলো লেগেছে, সেগুলি ধুয়ে নিলেন। বাইরে রাত নেমে আসছে। সুদেষ্ণাকে এই একটু আগেই দ্রৌপদী বলেছেন—আজকের রাত্রিই তোমার ভাইয়ের কালরাত্রি না হয়—মন্যে চাদ্যৈব সুব্যক্তং পরলোকং গমিষ্যতি।
ধুর! গা ধুলে আর কাপড় ধুয়ে ফেললেই কি আর রাগ যায়? দ্রৌপদীর কিছুতেই আর স্বস্তি হচ্ছে না। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ওপর তাঁর কোনও বিশ্বাস নেই। তিনি বলেছেন এখনও তোমার গন্ধর্ব স্বামীদের ক্রোধ করার সময় আসেনি। দ্রৌপদীর মনের ভাব—তোমার কোনওদিনই সময় আসবে না। এখন কী করি, কোথায় যাই, আমার ভবিষ্যতের পথটাই বা কী হওয়া উচিত—কিং করোমি, ক্ব গচ্ছামি, কথং কার্যং ভবেন্মম। রাতের আঁধার গভীরতর হয়ে আসছে। দ্রৌপদী মনের মধ্যে বিদ্যুৎশিখার মতো ঝলক দিয়ে উঠল একটি নাম—ভীমসেন—ভীমং বৈ মনসাগমৎ। দ্রৌপদী জানেন ভীমের ব্যাপারে তাঁর ভালবাসায় ফাঁকি আছে। কিন্তু তিনি এও জানেন যে, ভীমের ভালবাসায় কোনও ফাঁকি নেই। অন্তত দ্রৌপদী যা চান এবং যেমন করে চান তা একমাত্র সাধন করতে পারেন ভীম। যুধিষ্ঠিরের মনোভাব তিনি পূর্বাহ্নেই জানেন, আর অর্জুনকে বললে তিনি ধর্মরাজের সঙ্গে কোনও কথা না বলে দ্রৌপদীর কথায় কাজ করবেন বলে মনে হয় না। কাজেই একমাত্র ভরসা ভীম। তিনি নির্বিচারে কারও কোনও অপেক্ষা না রেখেই দ্রৌপদীর যা ভাল লাগে তাই করবেন—নান্যং কশ্চিদ্ ঋতে ভীমান্মমাদ্য মনসঃ প্রিয়ম—অতএব সেই সময়ে ভীমই তাঁর একমাত্র প্রিয় হয়ে উঠলেন (ব্যাসের এই পংক্তিটির মধ্যেই দ্রৌপদীর ভালবাসার ফাঁকিটুকু ধরা পড়ে গেল)।
রাতের সুখশয়ন ছেড়ে স্তিমিতপ্রদীপ অন্দর-মহলের বাইরে চলে এলেন দ্রৌপদী। সূপকার-কুলপতি ভীমের আবাস হবে রন্ধনশালার কাছেই, যেখানে বল্লব নামের ছদ্মবেশে নিজেকে মধ্যম-পাণ্ডবের গৌরব থেকে আড়াল করে রেখেছেন তিনি। দ্রৌপদী এক লহমায় ভীমের ঘরের সামনে পৌঁছলেন। ভেজানো দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই দ্রৌপদী বিড়বিড় করে বললেন—আমার মর্মশত্রু কীচক বেঁচে আছে, তবু তুমি ঘুমোচ্ছ কী করে—কথং নিদ্রাং নিষেবসে। দ্রৌপদী দেখলেন, তাঁর বিড়বিড়ানিতে ভীমের ঘুম ভাঙল না, বলবান সিংহ যেমন নির্ভয়ে নিদ্রা যায়, তেমনি ভীম ঘুমিয়েই আছেন। ব্যাস লিখেছেন দ্রৌপদীর অলোকসামান্য রূপে আর ভীমের প্রদীপ্ত তেজে সেই রন্ধনশালা যেন জ্বলে উঠল। আমি বলি, ভীমের আগুন-তেজে দ্রৌপদীর রূপের ঘি পড়ল। পাঁচ স্বামীর সহবাসিনী দ্রৌপদী দীর্ঘ দশ-এগার মাস পরে মধ্যম-পাণ্ডবের সাহচর্য পেয়েছেন। মনে আছে অপমানের জ্বালা। ভীমকে কীভাবে কাবু করতে হবে তা তিনি জানেন।
দ্রৌপদী ভীমকে জাগায়। কিন্তু যেভাবে জাগালেন তার মধ্যে মহাভারতকার দ্রৌপদীর প্রেমের ফাঁকিটুকু দেখিয়েছিল। কালীপ্রসন্ন সিংহমশায় বিপদ ভেবে এই ফাঁকির শ্লোকের আনুবাদ করেননি, কিন্তু এই শ্লোক না হলে দ্রৌপদীর প্রেম-বিশ্লেষণ অসমাপ্ত থেকে যাবে। দ্রৌপদীর প্রেমের ফাঁকিটুকু আর পরিষ্কার করে দেখিয়েছেন টীকাকার নীলকণ্ঠ। অতএব তাঁর সাহায্যও আমরা নেব। ব্যাস লিখেছেন—দ্রৌপদী প্রথমেই ভীমের কাছটিতে গা ঘেঁসে বসলেন, পাঞ্চালী দ্রৌপদী সর্বাংশে বরণীয় পতির কাছটিতে বসলেন—উপাতিষ্ঠত পাঞ্চালী। কেমন করে বসলেন? ব্যাস্ উপমা দিয়াছেন—পুষ্পবতী কামাতুর রমণীর মতো—বাসিতেব—কামাতুরা রমণীর মতো। প্রকিতপক্ষে তিনি কামাতুর নন, নীলকণ্ঠ আরও ভেঙে বললেন—বস্তুতঃ ন কামাতুরা কিন্তু দ্বেষাতুরা এব। অর্থাৎ কিনা আন্তর্দাহ প্রতিশোধ ইত্যাদি কারণেই ভীমকে পটাবার জন্য কামাতুরা রমণীর মতো দ্রৌপদী ভীমের গা ঘেঁসে বসলেন। ঠিক যেমনটি বন্য বকস্ত্রী প্রকৃস্তই কামাতুরা হয়ে বকের গা ঘেঁসে বসে থাকে, ঠিক যেমনটি তন বছর বয়সের বকনা গরু গরম হয়ে ষাঁড়ের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে ঠিক তেমনই এক কামাতুরার ভাব নিয়ে দ্রৌপদী ভীমের কাছটি ঘেঁসে বসলেন—সর্বশ্বেতেব মাহেয়ী বনে জাতা ত্রিহায়ণী। উপাতিষ্ঠত পাঞ্চালী বাসিতেব বরর্ষভম্ ॥
শ্লোকটিতে ‘বাসিতা’ মানে পুষ্পিণী কামাতুরা নারী। ‘ইব’ শব্দটা উপমার্থক, যার মানে ‘মতো’—কামাতুরা রমণীর মতো। এই ‘মতো’ শব্দটা ‘সর্বশ্বেতা অর্থাৎ বকীর সঙ্গেও লাগবে আবার গরুর সঙ্গে লাগবে। কাক যেমন দুদিকে চোখ ঘুরাতে পারে, সেই মতো ‘মতো’ শব্দটা একবার বকীর সঙ্গে লাগবে, আবার গরুর সঙ্গেও লাগবে। নীলকণ্ঠ লিখেছেন আভিধানিক অর্থে শ্বেতা মানে রাজহংসী। কিন্তু ‘সর্ব’ শব্দটা তো আর বোকার মতো ব্যবহার করেননি ব্যাস। কাজেই ‘সর্বশ্বেতা’ মানে বকী। আর সে যেহেতু বনে জাত, তাই কামাতুর হতে তার সময় লাগে না। আবার ‘মাহেয়ী’ মানেও গরু, ত্রিহায়ণী মানেও গরু। ব্যাস নিশ্চয়ই একই অর্থে দুটো শব্দ প্রয়োগ করেননি। ব্যাস বলতে চেয়েছেন—তিন বচ্ছর বয়সের গরু—ত্রিহায়ণী। আমরা বলি—তাতে এমনকী হল? নীলকণ্ঠ উত্তর দিয়েছেন—ওই ‘তিন বচ্ছরে’র বিশেষণটার মধ্যেই কামাতুরত্ব লুকিয়ে আছে, নইলে ওটি দ্রৌপদীর উপমা হবে কেন? নীলকণ্ঠ লিখেছেন—তিন বচ্ছর বয়েসের গরু নাকি যৌবনবতী কামাতুরা হয়—ত্রিবর্ষা হি গৌঃ যৌবনারূঢ়া কামাতুরা চ ভবতি। তা আমাদের দ্রৌপদী যৌবনবতী গাভীর মতো, বন্য বকীর মতো কামাতুরা ভাব দেখিয়ে ভীমের কাছে বসলেন।
এই শ্লোকে দ্রৌপদীর প্রেমের ফাঁকিটুকু সাধারণে যাতে সহজে না বোঝে, তাই ব্যাস পর পর কয়েকটি উপমা সাজিয়ে দিয়েছেন। গোমতী নদীর তীরে মহাপ্রাংশু শালগাছগুলিকে লতা যেমন জড়িয়ে ধরে তেমনি করে পাঞ্চালী ভীমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলেন। মনের মধ্যে দ্বেষভাব নিয়ে আর বাইরে যেমন কামাতুর ভাবে তিনি ভীমের কাছে বসে ছিলেন, মনের মধ্যে সেই ভাব নিয়েই তিনি নিশ্চয়ই ভীমকে জড়িয়ে ধরলেন। প্রসুপ্ত মৃগরাজ সিংহকে সিংহবধু যেমন জড়িয়ে ধরে, হাতিকে যেমন জড়িয়ে ধরে হাতির বউ, তেমনি দ্রৌপদী জড়িয়ে ধরলেন ভীমকে। দ্রৌপদীর প্রেমশীতল বক্ষে বাহুর ঘেরে জেগে উঠলেন ভীম—বাহুভ্যাং পরিরভ্যৈনং প্রাবোয়দনিন্দিতা। গলার স্বরে বীণার গান্ধার তুলে দ্রৌপদী বললেন—ওঠো ওঠো, কেমন মরার মতো ঘুমোচ্ছ তুমি—ভীম উত্তিষ্ঠোতিষ্ঠ কিং শেষে ভীমসেন যথা মৃতঃ। এমন মরার মতো না হলে কি আর জীবন্ত কোনও লোকের বউকে অপমান করে অন্যে বেঁচে থাকে?
গা-ঘেঁষা, আলিঙ্গন, বাহুর ঘের—এত সবের পর বীণার গান্ধারে যে সপ্তমের আমদানি হল তাতে ভীমের দিকে আর প্রত্যালিঙ্গন সম্ভব ছিল না। ভীম উঠে বসলেন এবং সোজাসুজি প্রশ্ন করলেন—তোমার গায়ের রঙ যে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে! কী ব্যাপারটা হয়েছে, খোলসা করে বল তো? খারাপ, ভাল, যাই ঘটুক, পরিষ্কার বল। তুমি তো জান কৃষ্ণা, সমস্ত ব্যাপারেই আমি তোমার বিশ্বাস রেখেছি, অনেক বিপদে আমি মাকে কতবার বাঁচিয়েছি—অহমেব হি তে কৃষ্ণে বিশ্বাস্যঃ সর্বকর্মসু। অহম্ আপৎসু চাপি ত্বাং মোয়ামি পুনঃ পুনঃ ॥
ভীমের মতো মানুষও বুঝে গেছেন দ্রৌপদী তাঁকে বিশ্বাস করেন। বিশেষ করে বিপদে পড়লে অন্য সবার থেকে ভীমই যে দ্রৌপদীর কাছে বেশি আদরণীয় হয়ে ওঠেন, সে কথা ভীমও বুঝে গেছেন। ঠিক সেই কারণেই ভীম বললেন—তোমার যা বলার বল এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে তুমি যা চাও অর্থাৎ যা হলে তোমার ভাল লাগবে, সেটা তাড়াতাড়ি বল—শ্রীঘ্রমুক্ত্বা যথাকামং যত্তে কার্যং ব্যবস্থিতম্। সবাই জেগে উঠলে তোমায় আমায় চিনে ফেলতে পারে, কাজেই তার আগেই যা বলার বলে শুতে যাও।
আমি আগেই বলেছি যুধিষ্ঠিরের স্বামি-ব্যবহারে দ্রৌপদী কোনওকালেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই বিরাটের রাজসভায় তিনি কথা দিলেও তাঁর ওপরে তিনি নির্ভর করেননি। তিনি ভীমের কাছে এসেছেন তড়িঘড়ি অপমানের শোধ নিতে। দ্রৌপদী ভীমের মনস্তত্ত্ব জানতেন অথবা কোন বুদ্ধিমতী স্ত্রীই বা স্বামীর মনস্তত্ত্ব না জানেন? দ্রৌপদী এও জানতেন যে, যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার নীতি ভীম পছন্দ করেন না অথবা অপমানের সময়েও যুধিষ্ঠিরের স্থিরভাব ভীম দু’চক্ষে দেখতে পারেন না।
দ্রৌপদী তাই ভীমের কাছে প্রথমেই যুধিষ্ঠিরের ওপর ঝাল ঝেড়ে নিলেন। দ্রৌপদী বললেন—যার স্বামী যুধিষ্ঠির, তার জীবনে আর সুখ কী—অশোচত্বং কুতস্তস্যা যস্যা ভর্ত্তা যুধিষ্ঠিরঃ? আমার সব দুঃখ জেনেও, আবার তুমি ভালভালাই করে জিজ্ঞাসা করছ—কী আমার হয়েছে? দ্রৌপদী পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তুললেন, কারণ তিনি জানেন কোন কোন ঘটনায় ভীমের আক্রোশ জমা আছে। তিনি বললেন—একে তো সেই কৌরবসভার মধ্যে আমাকে টেনে আনা হয়েছিল, সে দুঃখ তো আমার রয়েইছে, এক দ্রৌপদী ছাড়া আর কোন রাজার ঝি এত অপমান সইবে? তার মধ্যে বনের মাঝে জয়দ্রথ এসে আমাকে আরেকবার নাকাল করে গেল, সেই অপমানও আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন মেয়ে সইবে—বোঢ়মুৎসহতে নু কা? এখন আবার…কেন, তুমি তো চোখের সামনেই দেখলে, এখন আবার ধূর্ত বিরাটরাজার শালা কীচক রাজার সামনেই আমায় লাথি কষাল—সে আঘাত সহ্য করার জন্যও তো আমিই বেঁচে আছি —কা নু জীবেত মাদৃশী। আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী? এই রাজার শালা রানির ঘরে আমার দাসীত্বের সুযোগ নিয়ে দিন-রাত—‘আমার বউ হও, আমার বউ হও’—বলে ঘ্যানর ঘ্যানর করছে—নিত্যমেবাহ দুষ্টাত্মা ভার্যা মম ভবেতি বৈ।
কীচকের সম্বন্ধে এইটুকু বলেই দ্রৌপদী কিন্তু আবার যুধিষ্ঠিরের ওপর আক্রোশে ফেটে পড়লেন বললেন, তোমার দাদাভাইকে ঝাড়তে পারছ না, যার জুয়া খেলার ফল ভোগ করছি আমি—ভ্রাতরং তে বিগর্হস্ব জ্যেষ্ঠং দূর্দ্যূতদেবিনম্। যস্যাস্মি কর্মর্ণা প্রাপ্তা দুঃখখেতদনন্তকম্। সত্যি করে বল তো, এক জুয়াড়ি ছাড়া আর কে আছে, যে নাকি রাজ্য-সম্পত্তি সব ছেড়ে দিয়ে বনবাসের জন্য পাশা খেলে? দ্রৌপদী বললেন—খেলবি, খেল না, ধন-রত্ন কি হাজার খানেক মোহর নিয়ে সম্বচ্ছর ধার—সকাল-সন্ধে পাশা খেললেও তো এত সম্পত্তি উজাড় হয়ে যেত না—সায়ং প্রাতরদেবিষ্যদ্ অপি সংবৎসরান্ বহুন্। কিন্তু বিবাদ আর উৎপাতের পাশা খেলে এখন মাথামোটার মতো চিৎপাত হয়ে পড়ে, চুপটি করে পুরনো কাজের হিসেব করছে—তৃষ্ণীম্ আস্তে যথা মূঢ় স্বানি কর্মাণি চিন্তয়ন্। এই হল তোমার দাদা।
দ্রৌপদী দেখলেন, একটু বেশি হয়ে গেছে। ভীম যদি আবার ‘জুয়াড়ি’ মাথামোটা’—এসব কথায় ক্ষেপে যান। তাই তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের পূর্ব সম্মানের এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে, “এখন তাঁর কী অবস্থা হয়েছে, এও কি আমি সইতে পারি!”—এইভাবে একটা প্রলেপ লাগিয়ে দিলেন পূর্ব গঞ্জনার ওপর। দ্রৌপদী দেখাতে চাইলেন—তিনি এই অনুক্রমেই কথা বলছিলেন, যার জন্য ভীমের সম্বন্ধেও তাঁকে বলতে হল—এই যে তুমি পাকঘরে রসুই করার কাজ নিয়ে বিরাটরাজার খিদমতগারি করছ, এও কি আমি সইতে পারি—তদা সীদতি মে মনঃ। বিরাটরাজা বলল—তোমার গায়ে শক্তি আছে, এই মত্ত হাতিগুলোর সঙ্গে লড়, আর তুমি হাতির সঙ্গে লড়াই করছ। হাতির সঙ্গে তোমার লড়াই দেখে এদিকে বিরাটরানি সুদেষ্ণা আর তাঁর পরিজনেরা যে দাঁত বার করে হাসে, তাতে আমার কীরকম লাগে, তা তুমি জান কি—হসন্ত্যন্তঃপুরে নার্যো মম তুদ্বিজতে মনঃ। জান তো, তোমার ওই হাতির সঙ্গে লড়াই দেখে একদিন আমার ভীষণ খারাপ লাগছিল, আমি চক্কর খেয়ে পড়েই গেছিলাম। তাই না দেখে বিরাটরানি অন্য মেয়েদের সামনে দাঁত বার করে কি হাসিই না হাসছিল! আর তারা কী বলল, জান? বলল—রাঁধুনে ছেলেটিকে হাতির সঙ্গে যুদ্ধ করতে দেখে এই সুন্দরীর এমন সোহাগ উথলে উঠেছে, যেন ও ব্যাটা ওর কতকালের সোয়ামী–স্নেহাৎ সংবাসজাদ্ ধর্মাদ্…ইয়ং সমনুশোচতি। তা আমাদের সৈরস্ত্রীকেও দেখতে ভাল, রাঁধুনে ছোকরাটাও চমৎকার, মেয়েদের মনের কথাও কিছু বলা যায় না, তার ওপরে দুটিতেই এই রাজবাড়িতে কাজ নিয়েছে প্রায়ই একই সময়ে, সৈরন্ধ্রীও তো দেখি মাঝে মাঝেই স্বামীর সঙ্গে মিলতে পারছে না বলে দুঃখ করে, কে জানে কী ব্যাপার! দ্রৌপদী বললেন—জান ভীম। সুদেষ্ণারা বারবার আমাকে এই সব কথা বলে, আবার তাতে যদি আমি রেগে যাই, তাহলে আবার তোমায় নিয়ে আমাকে ঠাট্টা করে—ক্রুধ্যন্তীং মাং চ সংপ্রেক্ষ্য সমশঙ্কত মাং ত্বয়ি। আমার আর এসব ভাল লাগছে না। আবার আর একজনকে দেখ, ওইরকম ধনুর্ধর পুরুষ! সে কিনা খুকি-বিনুনি বেঁধে-বেণীবিকৃতকেশান্তঃ—কানে দুল পরে, মেয়ে সেজে মেয়েদেরই মধ্যে নাচ শেখাচ্ছে, গান শেখাচ্ছে—কন্যানাং নৰ্ত্তকো যুবা। সো’দ্য কন্যাপরিবৃতো গায়ন্নাস্তে ধনঞ্জয়ঃ। আর দুটির কথা তো ছেড়েই দিলাম—একজন লাল খেটো পরে—সংরদ্ধং রক্ত নেপথ্যং—রাখালি করে বেড়াচ্ছে, আর একজন বিরাটরাজাকে ঘোড়ার কেরামতি দেখাচ্ছে—বিরাটম্ উপতিষ্ঠন্তং দর্শয়ন্তঞ্চ বাজিনঃ।
বস্তুত দ্রৌপদীর এই বক্তব্যের মধ্যে বীরভ্রাতা ভীম আর অর্জুনের জন্যই তাঁর মানসিক নিপীড়ন বেশি। আমি আগেই বলেছি নকুল এবং সহদেবের ব্যাপারে দ্রৌপদীর পত্নীপ্রেম যতটুকু ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল বাৎসল্য। এইখানে ভীমের কাছে যে তিনি দুঃখ করছেন, তাতেও সেই ভাবটি পরিষ্কার ফুট উঠেছে।
ভীম আর অর্জনের জন্যই দ্রৌপদীর মনে বীরপত্নীর মর্মপীড়া ছিল। স্ত্রীবেশী অর্জুনের ব্যবহার তাঁর আর সহ্য হচ্ছিল না। আর ভীমের মতো মানুষ রাজবাড়ির মাইনে-করা কুস্তিগির আর হাতিদের সঙ্গে লড়ে মেয়েদের তামাশার খোরাক জোগাচ্ছেন, দ্রৌপদীর কাছে এর থেকে কষ্টকর আর কী হতে পারে। আবার এই ঘটনা নিয়ে রাজবাড়ির মেয়েদের সামনে তাঁর মমতা দেখানোর উপায়টুকু পর্যন্ত নেই। একে তো জানাজানি হবার ভয়, তার ওপরে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক, যা নাকি দ্রৌপদী এবং ভীমের ক্ষেত্রে ঘটনাই, সেটাকেও অন্তত সবার সামনে উড়িয়ে দিতে হচ্ছে, সুদেষ্ণা আর অন্য মেয়েদের মস্করাও শুনতে হচ্ছে—আমাদের সৈরন্ধ্রীও রূপে-গুণে লক্ষ্মীমতী আর এই রাঁধুনে ছোকরাটাও চমৎকার দেখতে-কল্যাণরূপা সৈরন্ধ্রী বল্লবশ্যাপি সুন্দরঃ। অর্জুন আর ভীমের জন্য মর্মপীড়া বাদ দিলে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর কিন্তু সেই একই ভাব। বিশেষত কৌরবের রাজসভায় যে পাশাখেলা হয়েছিল, তাতে হাজার নাকানি-চুবানি খেয়েও যুধিষ্ঠির যে বিরাটের রাজসভায় আবার পাশা খেলারই কাজ নিয়েছেন, এটা দ্রৌপদীর কাছে অন্য অর্থ বহন করে এনেছে। তাঁর কাছে নকুল সহদেব ছোট্ট ‘নাজুক’, নরম মানুষ—গরু চরানো ঘোড়া-দাবড়ানো এসব পরিশ্রমবহুল কাজ তাদের যেন সয় না। উল্টোদিক থেকে ভীম আর অর্জুন হলেন বীর। বিশাল গদা আর গাণ্ডীব নিয়ে যাঁদের কারবার, তাঁদের পক্ষে রান্না করা আর গান শেখানো যেন নিতান্ত বীরত্বহানির ব্যাপার, অন্তত দ্রৌপদীর কাছে তাই। কিন্তু সেদিক থেকে দেখতে গেলে যুধিষ্ঠিরকে কোনও পরিশ্রমের কাজও করতে হচ্ছিল না, আবার তাঁর সম্মান হানি হয়, এমন কিছুও তাঁকে করতে হচ্ছিল না। এতে তো দ্রৌপদীর বরং সুখী হবার কথা ছিল, কিন্তু তা তিনি হননি।
যুধিষ্ঠিরের হাত থেকে পাশার দান পড়ছে—এ তাঁর দু’চক্ষের বিষ। ভীমের কাছে তিনি কথা আরম্ভ করেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে ধিক্কার দিয়ে। বলেছিলেন—যুধিষ্ঠির যার স্বামী, তার আবার সুখ? এখন ভীমের কাছে সব স্বামীর প্রতি মমত্ব জানিয়ে কথা শেষ করলেন যুধিষ্ঠিরকে দিয়েই। বললেন—এই যে শতেক দুঃখ আমার দেখছ, সেও যুধিষ্ঠিরের জন্যেই—এবং দুঃখশতাবিষ্টা যুধিষ্ঠির-নিমিত্ততঃ। আজকে যে আমাকে চাকরানির মতো রাজবাড়িতে ফরমাস খাটতে হচ্ছে, রানি সুদেষ্ণার পায়খানা পেচ্ছাপের জল জোগান দিতে হচ্ছে, সেও ওই পাকা জুয়াড়িটার জন্য—শৌচদাস্মি সুদেষ্ণায়া অক্ষধূৰ্ত্তস্য কারণাৎ! দ্রৌপদী এতক্ষণ অন্য স্বামীদের কষ্টভোগের কথা শুনিয়াছেন, এবারে নিজের দুভোর্গের কাহিনী শোনাতে লাগলেন ভীমকে।
দ্রৌপদী বললেন—পঞ্চপাণ্ডবের মহিষী আর দ্রুপদ রাজার মেয়ে হয়েও এই অবস্থায় পড়ে আমি ছাড়া আর কে বেঁচে থাকতে পারে? এককালে ইন্দ্রের মতো স্বামীরা আমার মুখ চেয়ে বসে থাকত, এখন আমিই এই অন্তঃপুরের ছোটলোক মেয়েগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার সুখ কী ছিল—তা তুমি তো অন্তত বুঝবে ভীম! এককালে আমি হাঁটলে পরে আমার সামনে পেছনে শতখানেক বাঁদী যেত, এখন আমিই সেই কাজটা করি, আর হাঁটেন রানি সুদেষ্ণা—সাহমদা। সুদেষ্ণায়াঃ পুরঃ পশ্চাচ্চ গামিনী। আর একটা দুঃখ আমার মনের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধছে, ভীম। আমি আগে কোনও দিন কারও জন্যে চন্দনও ঘসিনি, আমার শাশুড়িমাতা ছাড়া আর কারও গা-হাত-পাও টিপে দিইনি, এখন সেই চন্দন পিষতে পিষতে আমার হাতে কড়া পড়ে গেল। দেখ, ভীম! দেখ এই আঙুলগুলো, এ কি আর সেই রকম নরম তুলতুলে আছে, যেমনটি তুমি আগে দেখেছ—পশ্য কৌন্তেয় পাণী মে নৈবং যৌ ভবতঃ পুরা।
পাঠক! লক্ষ করবেন, সুদেষ্ণার বাড়িতে এই পরিচারিকার কাজ দ্রৌপদী নিজেই সেধে নিয়েছিলেন, নইলে যুধিষ্ঠির ঠিকই সন্দেহ করেছিলেন যে, সুকুমারী কৃষ্ণার পক্ষে কোনও নীচ কাজ করা সম্ভব নয় হয়তো। কিন্তু রাজার শালা কীচকের জ্বালায় আজ পরিস্থিতি পালটে গেছে। আজ তিনি যুধিষ্ঠিরকেই দুষছেন যে, কেন তাকে চন্দন পিষতে হচ্ছে? দ্রৌপদী বলেছেন যে, আমি কোনওদিন শাশুড়ি কি স্বামীদের ভয় করে চলিনি—বিভেমি কুন্ত্যা যা নাহং যুস্মাকং বা কদাচন—সেই আমাকে কিনা এখন বিরাটরাজার ভয়ে সিটিয়ে থাকতে হয়। চন্দন পেষা ভাল হল, না মন্দ হল—বর্ণকঃ সুকৃতো ন বা—মহারাজ কী বলবেন—কিং নু বক্ষ্যতি সম্রাড্ মাং—এ সব প্রশ্নে সব সময় এখন আমি বিচলিত। হায় হায়! কী পাপ করেছি, যার ফলে আমাকে এত দুঃখও সইতে হল।
দ্রৌপদীর চোখ দিয়ে জল পড়তে থাকল, ভীমের দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে কান্নার নিঃশ্বাসে মিশিয়ে দিলেন অশ্রুবারি। ভীম দ্রৌপদীর হাত দুখানি নিজের হাতে তুলে নিলেন, অসীম মমতায় সে দুটি হাত ক্ষণকাল রাখলেন নিজের মুখে, তারপর কেঁদে ফেললেন দ্রৌপদীর হাতের মধ্যেই—মুখমানীয় দ্রৌপদ্যা রুরোদ পরবীরহা। নিঝুম রাত্রে যখন বৃষ্টির মতো অন্ধকারের কাজল ঝরে পড়ছিল তখন বিরাটের রন্ধনশালার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ প্রেমের ছবি দেখতে পেলাম আমরা। বর্তমান লেখক কিন্তু ভীম আর দ্রৌপদীর এই আভিসারিক প্রেম সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বাস্তববাদী। ভীম যে দ্রৌপদীর হাত দুখানি নিজের গালের ওপরে রাখলেন তার কারণ হয়তো এই—সুবিশাল গদা চালাতে চালাতে ভীমের নিজের হাতেই কড়া পড়ে গেছে ; সেই গদা-ঘোরানো কড়ার মধ্যে চন্দন-পেষা মেয়েলি কড়া ঠিক ঠাহর করা যায় না বলেই ভীম নিজের মসৃণ গালে (পাঠক! ভীমের দাড়ি গোঁফও খুব বেশি ছিল না) দ্রৌপদীর হাত রেখে তাঁর দুভোর্গ পরিমাপ করতে চেয়েছেন এবং যখন বুঝেছেন দ্রৌপদীর কথা সত্যি, সরলপ্রাণ ভীম তখন কেঁদে উঠেছেন সমব্যথায়। আমার কথা যে ঠিক, তার প্রমাণ—দ্রৌপদীর হাত দুখানি মুখে মেজেই ভীম বলে উঠেছেন—ধিক আমার বাহুবল ধিক সেই গাণ্ডীবধন্বার গাণ্ডীবকে, যাঁরা থাকতেও তোমার হাতের রক্ত-লাল নরম তালুতে কড়া পড়েছে—যত্তে রক্তৌ পুরা ভূত্বা পাণী কৃতক্বিণাবিমৌ।
এতক্ষণ ভীমের সামনে দ্রৌপদী যে যুধিষ্ঠিরের নিন্দা করেছেন, তাতে অন্য সময়ে হলে ভীমের দিক থেকে যে প্রতিক্রিয়াটা হত, তা হয়তো দ্রৌপদীর অনুকুলেই যেত এবং অন্যত্র তা গেছেও। কিন্তু এই সময়ে অজ্ঞাতবাসের কারণেই হোক কিংবা যা হোক কোনও কারণে, ভীম কিন্তু দ্রৌপদীকে বুঝিয়ে বলতে চাইলেন যে বেচারা যুধিষ্ঠিরের ওপরে তিনি যেন রাগ না করেন। ভীম বললেন—যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাসের শেষের দিন গুণছেন, নইলে তো একটি লাথিতে ওই বদমাস কীচকটার মাথা গুঁড়িয়ে ফেলতাম আমি—পোথয়ামি পদা শিরঃ। এই বিরাট-রাজ্যেও লাগিয়ে দিতাম ধুন্ধুমার। নেহাত বড় ভাই যুধিষ্ঠির সব জানাজানি হবার ভয়ে চোখের ঠারে আমাকে সরে যেতে বললেন, তাই। কী জানি কেন, সরলপ্রাণ ভীমও বুঝেছেন যে যুধিষ্ঠির ঠিক কাজই করেছেন এবং এটা মাথায় ঢুকেছে বলেই তার মাথাও ঠাণ্ডা হয়েছে—স্থিত এবাস্মি ভামিনি। এই প্রথমবার বুঝি ভীম বললেন—মাথা ঠাণ্ডা কর, সুন্দরী! মাথা ঠাণু কর। তুমি যুধিষ্ঠিরের নামে যেভাবে বললে, এ যদি তিনি শোনেন, তিনি নির্ঘাত ‘সুইসাইড’ করবেনে—শৃণুয়াদ্ যদি কল্যাণি নূনং জহ্যাৎ স জীবিতম্।
ভীমের কী সরল যুক্তি, হাজার হোক বড় ভাই, সুখে দুঃখে এতকাল একসঙ্গে আছেন। ভীম খুব চেষ্টা করলেন—যাতে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদী কিঞ্চিৎ সুদক্ষিণা হন। তিনি যুক্তি দিয়ে বললেন—তোমার এই নিন্দে-মন্দ শুনলে যুধিষ্ঠির নির্ঘাত ‘সুইসাইড’ করবেন। আর যুধিষ্ঠির ‘সুইসাইড’, করলে অর্জুন, নকুল এবং সহদেবও ‘সুইসাইড্’ করবে। অপিচ এরা সবাই আত্মহত্যা করলে আমিই বা আর বেঁচে থেকে কী করব—নাহং শক্লোমি জীবিতুম্। অকাট্য যুক্তি, অর্থাৎ কিনা যুধিষ্ঠিরের হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আত্মহত্যা করতে পারছেন না, কারণ বোধহয় দ্রৌপদীই, কিন্তু চার ভাই পর-পর মারা গেলে তিনি একা দ্রৌপদীর একচ্ছত্র অধিকার নিতেও সাহসী নন—কারণ বোধহয় অনভ্যাস। দ্রৌপদীকে ভাগে পাওয়াই ভীমের অভ্যাস অথবা তাঁর ভাতৃপ্রীতিও ছোট করে দেখা উচিত নয়। যুধিষ্ঠিরকে আংশিক অবমাননা তিনি বহুবারই করেছেন কিন্তু পুরোটা কখনও নয়।
ভীমের কাছে দ্রৌপদীর ভাষণ শুনে একথা পরিষ্কার বোঝা যায়, মাঝে মাঝে দ্রৌপদীর অন্যায় মাথা গরম করার অভ্যাস ছিল, নইলে ভীমের মতো হঠাৎ-ক্রোধী মানুষও এই মুহূর্তে চ্যবনপত্নী সুকন্যা সীতাদেবী, লোপামুদ্রা এবং সাবিত্রীর উদাহরণ তুলে দ্রৌপদীকে পতিপরায়ণতার উপদেশ দিয়েছেন।
পাঠক মহাশয়! আমরা বোধহয় আবার প্রসঙ্গ থেকে সরে এসেছি। আমাদের দোষও নেই খুব একটা—দ্রৌপদী এতক্ষণ পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছিলেন, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে আমরাও ঘাঁটছিলাম। এখন তিনি ভীমের মনোভাব বুঝে যুধিষ্ঠির ইত্যাদির প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন, আমরাও তাই সুযোগ বুঝে সেই রাজার শালা কীচকের প্রসঙ্গে এসেছি। দ্রৌপদী বললেন—আমার দুঃখ সমস্ত সহ্য-সীমার বাইরে চলে গেছে, নইলে যুধিষ্ঠিরকে গালমন্দ করে আর কী হবে—ন রাজানমুপালভে? পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটেই বা কী হবে—কিমুক্তেন ব্যতীতেন? দ্রৌপদী এবার সোজাসুজি কীচকের প্রসঙ্গে এলেন। তার ভাব, ভাবনা, তার পেছনে রাজবাড়ির মদত—এ-সব কিছুই ভীমকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন। দ্রৌপদীর বক্তব্য অনুযায়ী—এক বাঘের মুখ থেকে বাঁচতে গিয়ে দ্রৌপদী আরেক বাঘের মুখে পড়েছেন। দ্রৌপদী সুদেষ্ণার পরিচারিকা। সুদেষ্ণার ধারণা—দ্রৌপদীকে দেখলে রাজা-বিরাটকে ঠেকানো খুবই কঠিন হবে। দ্রৌপদীর রূপে তিনি এতই উদ্বিগ্ন যে, রাজা-বিরাট অন্তঃপুরের দিকে এলেই সুদেষ্ণা এটা ওটা ফরমাস দিয়ে দ্রৌপদীকে এদিক-ওদিক পাঠিয়ে দেন। এই সুযোগটাই কীচক নিয়েছে। সুদেষ্ণার মনোভাব বুঝেই এবং ইতস্তত দ্রৌপদীকে চলাফেরা করতে দেখেই কীচক দ্রৌপদীকে প্রম নিবেদন করা শুরু করে। তার পরের ঘটনা ভীমের জানা। গতদিন কীচক দ্রৌপদীকে সবার সামনে পদাঘাত করেছে। রাজা-বিরাটের এতে কিছুই করবার নেই, কেননা সুদেষ্ণার কারণেই হোক কিংবা অন্য কোনও কারণে, রাজা তাকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলেছেন এবং দ্রৌপদীর পক্ষে তা কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে—কীচকো রাজবাল্লভ্যাচ্ছোককৃন্ মম ভারত।
শুধু এইটুকুই নয়, দ্রৌপদীর কাছে এইমাত্র যে সংবাদ পাওয়া গেল, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, কীচক শুধু সুন্দরী নারীর রতিলিস্পু নয়, সে নৃশংসও বটে। গরিব প্রজাদের টাকা-পয়সা আত্মসাৎ করা থেকে হত্যা—এসব কিছুতেই তার হাত পাকা। দ্রৌপদীর আশঙ্কা হয় (পাঠক হিসেবে আমরাও বুঝি—এ আশঙ্কা অমূলক নয়) যে, বাবার রাস্তায় তিনি যেভাবে কামান্ধ কীচকের রতি-প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করেছেন, তাতে এরপর তার চোখের সামনে পড়লেই যথেষ্ট চড়-লাথি খেতে হবে দ্রৌপদীকে। পরে মহাভারতের গীতাপর্বে আমরা দেখেছি কামিজনের কামনা প্রতিহত হলেই তা ক্রোধের আকার ধারণ করে। ‘কামাৎ ক্রোধো’ভিজায়তে’ এই শ্লোকের ওপর টীকায় শংকরাচার্য তাই লিখেছেন—কাম এব প্রতিহতঃ ক্রোধরূপে পরিণামতে। ট্রোপদী কীচকের ব্যাপারে এই সন্দেহই করছেন। তিনি এখন আপন সতীত্বের থেকে বারবার মার খাবার কথা ভাবছেন এবং সেই মার খেতে খেতে তাঁর জীবন থাকবে কিনা—এই স্থূল শারীরিক চিন্তাই আপাতত তাঁর আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে—দর্শনে দর্শনে হন্যাদ্ যথা জহ্যাঞ্চ জীবিতম্। দ্রৌপদী বললেন—ভীম! এতে তোমাদের ধর্মও থাকবে না, শৌর্য-বীর্যও ব্যর্থ, কেননা যে স্বামী বউকেই রক্ষা করতে পারে না, তার আবার ধর্ম কীসের—মহান ধর্মো ন শিষ্যতি। আবার তোমরা যে লোক জানাজানি হবার ভয়ে অজ্ঞাতবাসের ব্রত নিয়েছ, সেই প্রতিজ্ঞা রাখতে গেলে তোমরা পাঁচভাই আর স্ত্রীর আশা কোরো না—সময়ং রক্ষমাণানাং ভার্যা বো ন ভবিষ্যতি।
কীচকের কামনার জ্বরে দগ্ধা দ্রৌপদী মহিলা হিসেবে আকুল প্রার্থনা জানালেন ভীমের কাছে, কারণ, অজ্ঞাতবাসের কড়াক্কড়ির মধ্যে এই কাজ ভীম ছাড়া আর কারও পক্ষেই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। দ্রৌপদী বললেন-“তুমি আমাকে একসময়ে জটাসুরের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে, ভীম! (এ ঘটনা বনপর্বের। জটাসুর হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব এবং দ্ৰৌপদীকে। ভীম তাকে মারেন।) তুমিই রক্ষা করেছিলে দুষ্ট জয়দ্রথের হাত থেকে, এখন এই লম্পট কীচকটাকেও উপযুক্ত শিক্ষা দাও। পাথরের ওপর মাটির কলসি ফাটালে যেমনটি হয়, তেমনি করে ওই কীচকের মাথাটা ফাটাও দেখি—ভিন্ধি কুম্ভমিবাশ্মনি।
জনান্তিকে বলে রাখি দ্রৌপদীর সামনে ‘মাসল্’ ফুলিয়ে বাহুর কসরত দেখাতে একটু পছন্দ করতেন ভীম। স্ত্রীলোক সামনে থাকলে কোন বীরপুরুষই বা এটি না-পছন্দ করে। আমরা বনপর্বে কীর্মির রাক্ষস বধের সময়ে দেখেছি সুন্দরী কৃষ্ণা ভীমের যুদ্ধ-কসরত দেখছিলেন বলে, শুধুমাত্র দেখছিলেন বলেই, ভীমের শক্তি যেন আরও ক’গুণ বেড়ে গেল—কৃষ্ণানয়ন দৃষ্টশ্চ ব্যবর্ধত বৃকোদরঃ। রুক্ষ শুষ্ক বামুন নীলকণ্ঠ এই শ্লোকের টীকায় বলেছেন কৌরবনিবাসে দ্রৌপদীর বস্ত্রকর্ষণের কথা স্মরণ করেই, নাকি কৃষ্ণার চোখের চাহনিতে (নিশ্চয় করুণ চোখ বোঝাচ্ছেন নীলকণ্ঠ) অধিক কুপিত হয়েছেন ভীম। আরে এই শ্লোকের পূবার্ধে তো দুর্যোধনের অত্যাচারের কথাই আছে, কাজেই ‘কৃষ্ণানয়নদৃষ্টশ্চ’ এই সুন্দর শ্লোকাংশে আবার ওসব কথা কেন! নীলকণ্ঠ জানেন না, সুন্দরী স্ত্রীর তারিফ-করা চোখের চাহনিতে যে কোনও প্রতিযোগিতার শক্তি বেড়ে যায়, যুদ্ধশক্তি তো বটেই! আমি বাপু এখানে ভূয়োদর্শী ব্যাসের কথার সোজা অর্থ বুঝি—কৃষ্ণানয়নদৃষ্টশ্চ ব্যবর্ধত বৃকোদরঃ। তার ওপরে করুণ চোখে তাকানোটা কৃষ্ণার স্বভাববিরুদ্ধ। হয় তিনি বিদগ্ধা নারীর কটাক্ষে তাকান, নয়তো বাহবা দেওয়ার চোখে। ভীমের শক্তি তাতেই চেতিয়ে দেয়। দ্রৌপদী জানেন—কীচকের কথা যতটুকু বলেছেন, তাতেই ভীম তেতে গেছেন, এখন শুধু ঠোঁট ফুলিয়ে একবার বললেন—কীচক জীবিত আছে—এই অবস্থায় যদি কালকের রাত্রিও কাটে তবে আমি ‘গ্লাসে’র মধ্যে বিষ গুলিয়ে খাব—–বিষমালোড্য পাস্যামি—তবু কীচকের হাতে আমি ধরা দেব না। তার চেয়ে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে মরব, তাও ভাল।
আবার প্রেমের ‘সিন’। ভীম দ্রৌপদীর কথার মর্ম বুঝলেন। বুঝলেন কীচকের বিরুদ্ধে আশু ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। সুন্দরী কৃষ্ণা তখনও ভীমের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছেন। ভীম জড়িয়ে ধরলেন দুঃখের ঝড়ে আপতিতা অভিসারিকাকে। হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে রাজনন্দিনী দ্রৌপদীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন—তুমি যা চাও তাই হবে—তথা ভদ্রে করিষ্যামি যথা ত্বং ভীরু ভাষসে। তবে একটু নাটক করতে হবে তোমায়। বিরাটের নতুন নৃত্যশালাটি চেন তো? ওখানে দিনের বেলা মেয়েরা নাচে, কিন্তু রাত্রে কেউ সেখানে থাকে না। তুমি কীচককে জানাবে নৃত্যশালাতেই তোমার সঙ্গে মিলন হবে তার। দেখো কেউ যেন তোমাদের কথালাপ শুনতে না পায়। আজ সন্ধেবেলাতেই এই কাজ করতে হবে, তারপর সেখানেই আমি কীচককে তার মৃত বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব—তএাস্য দর্শয়িষ্যামি পূর্বপ্ৰেতান্ পিতামহান্।
রাত্রি আর বাকি নেই। দুঁহু কোলে দুঁহু কাঁদে, যতক্ষণ থাকা যায় ততক্ষণ থেকে দ্রৌপদী ফিরলেন নিজের ঘরে। ভোর হতেই কীচককে আবার দেখা গেল দ্রৌপদীর কাছে কাছে ঘুর-ঘুর করতে। তার আর লজ্জা-ভয় কিছুই নেই। সে বলল—বিরাটরাজার সামনেই তো তোমাকে আমি লাথি মেরেছি। আরে! রাজা কিছু করতে পারল আমাকে? ও রাজা, নামেই রাজা-প্রবাদেনেহ মৎস্যানাং রাজা—রাজা আমিই এবং সেনাপতি তো বটেই—অহমেব হি মৎস্যানাং রাজা বৈ বাহিনীপতিঃ। আমাকে তুমি একটু সুখ দাও সুন্দরী, আমি তোমার গোলাম হয়ে যাব—দাসো ভীরু ভবামি তে। প্রতিদিন তোমায় দেব হাজার মোহরের তোড়া আর দাস-দাসী যা চাও! পরিবর্তে আমি চাই তোমার সঙ্গে মিলতে—অস্তু নো ভীরু সঙ্গমঃ।
দ্রৌপদী বিদগ্ধা নারী। নাটক করা তাঁর ভালই আসে। দ্রৌপদী বললেন—আমি আজ মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি—তোমার বাঁধনে ধরা দেব। কিন্তু একটা কথা, তোমার বন্ধু-বান্ধব ভাইয়েরা সব কেউ যেন এ-কথাটা জানতে না পারে। তুমি জান তো, আমার সেই মুখপোড়া গন্ধর্ব স্বামীগুলো আছে, তারা জানতে পারলে আমায় আর আস্ত রাখবে না। কীচক বললেন—দূর বোকা, কেউ জানতে পারবে না, আমি একাই যাব—একো ভদ্রে গমিষ্যামি। ‘মিট্ করার জায়গা ঠিক হয়ে গেল—সেই নৃত্যশালা।
সেই সকাল বেলার কথা। দুপুর বারোটা পর্যন্ত কীচকের মনে হল সে যেন ছ’মাস বসে আছে। দুপুর গড়িয়ে পড়তেই আরম্ভ হল তার সাজ। মনে কেবল দ্রৌপদীর রূপ-চিন্তা, আর সমাগমের প্রতীক্ষা। দ্রোপদী আবার ভীমের কাছে জানিয়ে এসেছেন—সব ব্যবস্থা পাকা। রাত এসে গেল। সিংহ যেমন প্রচ্ছন্ন ভাবে শিকারের অপেক্ষা করে, ভীমও অন্ধকার নর্তনাগারে তেমনটি ঘাপটি মেরে রইলেন। রাত্রির আমেজে অনেক সাজগোজ করে কীচক উপস্থিত হল অন্ধকার নৃত্যশালায়। প্রথমে যেন কিছু ঠাহর করাই যায় না কথায় সেই দ্রোপদী। কীচকের মনে হল—সে যে বলেছিল, নৃত্যশালায় রীতিমতো শয্যা বিছানো আছে একটা। কোথায় শয্যা! আরে এই তো, এইখানেই শুয়ে আছে, কীচক অল্প একটু হাত ছোঁয়াল। দ্রোপদী যে এতটা উন্মুখ হয়ে আছেন, তা যেন তার কল্পনাতেও আসে না। কীচক বলল—তোমায় কত টাকা পাঠিয়েছি, কত দাসী পাঠিয়েছি, তোমার সেবার জন্য। (এবার কাজের কথায়—) জান তো আমার অন্তপুরের মেয়েরা বলে—আমার মতো সুন্দর পুরুষ নাকি তারা কোনওদিন দেখেনি।
উত্তর এল, তবে সে কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত, বড় কঠিন, শুষ্ক স্বাধীন সে উত্তর। উত্তর এল—বড় সৌভাগ্য আমার, তুমি এত সুন্দর। মেয়েদের ভাল লাগবার মতোই বটে। তবে এখন আমি তোমায় যে স্পর্শসুখ দেব, তুমি কামকলাকোবিদ হওয়া সত্বেও এমন স্পর্শসুখ তুমি কোথাও পাওনি—ঈদৃশস্তু ত্বয়া স্পর্শঃ স্পৃষ্টপর্বো ন কৰ্হিচিৎ। আর নিশ্চয়ই বলতে হবে না। কীচক আর ভীমের ধস্তাধস্তিতে নৃত্যশালা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল! অবশেষে কীচককে মাংসপিণ্ডে পরিণত করে একটুখানি আগুন জ্বালিয়ে ভীম এবার ডাকলেন দ্রৌপদীকে। দ্রৌপদী এবং ভীম—দুজনেরই ক্রোধ শান্ত হল। ভীম বললেন—তোমায় যারা অন্যায়ভাবে চাইবে, তাদের অবস্থা হবে ঠিক এই কীচকের মতো। দ্রৌপদীব প্রিয়কার্য করে ভীম রন্ধনশালায় ফিরে গেলেন। কিন্তু দ্রৌপদী গেলেন না। তাঁর সাহসটা দেখুন। এই নির্জন রাত্রে তিনি ঘুমন্ত সভাসদদের ডেকে ডেকে বললেন—দেখুন আমার গন্ধর্ব-স্বামীরা লম্পট কীচককে তার লাম্পট্যের শাস্তিটি কেমন দিয়েছেন, দেখুন। সভাপালেরা এলেন, মশাল জ্বালিয়ে এলেন অন্যেরাও। কীচকের বন্ধুবান্ধব এবং তার ভাইয়েরাও। কীচকের ভাইয়েরা হল সব উপকীচক। তারা ভাবল এই দ্রৌপদীটাই যত নষ্টের গোড়া। তারা দ্রৌপদীকে বেঁধে নিয়ে চলল মরা কীচকের সঙ্গে—তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে কীচকের আত্মার শান্তি ঘটাতে। দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর ছদ্মনামগুলি ধরে চেঁচাতে লাগলেন এবং আবার তাঁর রক্ষায় এগিয়ে এলেন ভীম। গুপ্ত দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে শ্মশান চত্বরে ঢুকে দ্রৌপদীকে বন্ধন-মুক্ত করলেন ভীম এবং সেই সঙ্গে কীচকের একশো পাঁচটি ভাইকেও হত্যা করলেন।
খবরটা রটে গেল। প্রত্যক্ষদর্শীরা এসে রাজা-বিরাটকে ভয় দেখাল। ভয়ের কারণ তিনটে—সৈরন্ধ্রী অত্যন্ত রূপবতী, গন্ধর্ব বলে যার কথা শোনা যাচ্ছে সে প্রবল পরাক্রান্ত ; তৃতীয়, কোনও পুরুষ যদি আবার দ্রৌপদীর পেছনে ছোঁক ছোঁক করে—তাহলেই বিরাট রাজ্য উচ্ছন্নে যাবে। রাজাকে তারা বলল—মুক্ত হয়ে সৈরন্ধ্রী আবার আপনার ঘরে ফিরে আসছে—পুনরায়াতি তে গৃহম্। মানে এটাও যেন একটা ভয়ের কথা। দ্রৌপদীকে রাস্তায় ফিরে আসতে দেখে বিরাটরাজ্যের পুরুষমানুষেরা পর্যন্ত পালিয়ে গিয়ে ঘরের দরজা দিল। শশ্মান-ফেরা দ্রৌপদী স্নান করে নতুন কাপড় পরে জনহীন পথ বেয়ে বিরাটের রন্ধনশালার দ্বারে এলেন ভীমকে কৃতজ্ঞতা জানাতে। একটু ইশারা করে আস্তে ভীমকে বললেন—নমো গন্ধর্বরাজায়, তুমি আমার রক্ষাকর্তা। ভীম বললেন, আমরা যার হুকুমের গোলাম, তার এইটুকু কথাতেই আমি অঋণী হলাম।
আমরা বলেছিলাম—পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে ভীম একমাত্র মানুষ যিনি দ্রৌপদীকে ভালবাসতেন মনে গভীর থেকে। দ্রৌপদীর প্রত্যেকটি কথা যিনি বিনা দ্বিধায় নির্বিচারে পালন করতেন, তিনি ভীম। কৌরবসভায় দ্রৌপদীয় অপমানে তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—দুঃশাসনের বুক চিরে রক্ত খাব। খেয়েছেন। দুর্যোধনকে বলেছিলেন—গদার বাড়িতে তোমার উরু দুটি ভাঙব। ভেঙেছেন। ক্ষত্রিয়ের নীতি উলঙ্ঘন করার কলঙ্ক মাথায় নিয়েও দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করেছিলেন ভীম। কিন্তু যে দ্রৌপদীর জন্য এত আত্মদান, সেই দ্রৌপদী! তাঁর মনে মনে মাতাল হওয়ার জায়গা তে ভীম নয়। ভীমকে তিনি বললেন—নমো গন্ধর্বরাজায়—আর এইটুকু চাটুতেই ভীম একেবারে বাধিত বোধ করেন দ্রৌপদীর কাছে। কিন্তু বিদগ্ধা রসবতীর এতে তৃপ্তি হবে কেন? তিনি কেবলই ধাওয়া করে বেড়ান সেই ব্যক্তিত্বের পেছনে, যাকে কেবলই মনে হয় এই বুঝি আধেক ধরা পড়েছেন। কিন্তু আর বাকি অর্ধেকের নাগাল পেয়েছি পেয়েছি করেও পাওয়া যায় না যেন। তার জন্য খোঁজ চলে, কিন্তু উত্তর মেলে কি?
দ্রৌপদী কিন্তু ভীমের কাছ থেকে মধুর বিদায় নিয়ে সুদেষ্ণার ঘরে ফিরে গেলেন না। মহাভারতের লেখক লক্ষ করেছেন যে, তিনি বিনা কারণে বিরাটরাজার নর্তনালয়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, সেই যেখানে বিরাটের মেয়েরা নাচগান শেখে। আর নর্তনাগারের কাছে গেলে যে বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে দেখা যাবে, তাতে সন্দেহ কী? হ্যাঁ, তিনি স্বভাবতই রাজবাড়ির মেয়েদের কাছে নাচের বোল আউড়ে যাচ্ছিলেন। মেয়েরাও দেখল দ্রৌপদীকে। সেই মুহূর্তে দ্রৌপদী নিজেই যেহেতু জব্বর খবর, তাই নাচিয়ে মেয়েরা সব অর্জুনকে নিয়েই বেরিয়ে এসে দ্রৌপদীকে সম্ভাষণ জানাল—ভাগ্যিস আপনি কীচকদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছেন, ভাগ্যি মানি আপনি ফিরে এসেছেন। আবার—দিষ্ট্যা সৈরন্ধ্রী মুক্তাসি, দিষ্ট্যাসি পুনরাগতা। মেয়েদের দেখাদেখি অর্জুনও জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি কেমন করে ছাড়া পেলে সৈরন্ধ্রী! কেমন করেই বা সেই দুষ্টু লোকগুলো শাস্তি পেল—আমরা আদ্যন্ত সব কিছু শুনতে চাই তোমার মুখে—ইচ্ছামি বৈ তব শ্রোতুং সর্বমেতদ যথাযথম্।
দ্রৌপদীকে এমনিতেই ক্লিষ্টা দেখাচ্ছিল, কিন্তু যিনি সারারাত্রির ধকল সহ্য করে, সকালবেলায় গা ধুয়ে, কাপড় কেচে—গাত্রাণি বাসসী চৈব প্রক্ষাল্য সলিলেন সা—আবার ভীমের কাছে দরবার করতে যেতে পারেন, তিনি নিশ্চয়ই এত ক্লান্ত ছিলেন না যে, গল্প বলতে পারবেন না। কিন্তু কই, তিনি তো গল্পের ধারে কাছে গেলেন না, উল্টে দ্রৌপদী বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে বললেন—তুমি অন্তপুরের মেয়েদের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছ, সুখেই থাক, আবার সৈরন্ধ্রীর কী হল না হল, তা দিয়ে তোমার আজ কী দরকার—কিন্নু তব সৈরন্ধ্র্যা কার্যমদ্য বৈ। রাজবাড়ির কিঙ্করী সৈরন্ধ্রী যে কষ্ট পাচ্ছে, সে কষ্ট তো আর তোমাকে পেতে হচ্ছে না এবং ঠিক সেইজন্যই মধুর হাসিটি হেসে দুখিনীকে এমনতর প্রশ্ন করতে পারছ—তেন মাং দুঃখিতামেবং পৃচ্ছসে প্রহসন্নিব—‘হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান?’
অন্তরের ব্যথায় দ্রৌপদী ভুলেই গেছিলেন অর্জুন এখন স্ত্রীবেশে বৃহন্নলা, আপন পূর্ব-সংস্কারবশে তাই অর্জুনের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন পুংলিঙ্গবোধক ক্রিয়াপদ—প্রহসন্নিব। অর্জুন শুধরে দিয়ে বললেন—বৃহন্নলাও তোমার জন্যে যথোচিত দুঃখ পাচ্ছে, কল্যাণী! তাকে তুমি অন্তত পশু-পক্ষী ভেব না। এতকাল তুমি আমাদের মধ্যে আছ, আমিও তোমাদের মধ্যে একসঙ্গে আছি। সহবাসিনী একজনের কষ্ট মানে যে আমাদের সবারই কষ্ট। এবারে অর্জুন মোক্ষম কথাটি বললেন। বললেন—যে কেউ আরেক জনের মনের কথা ভাল করে বুঝতে পারে না—ন তু কেনচিদ্ অত্যন্তং কস্যচিদ্ হৃদয়ং ক্বচিৎ। বেদিতুং শক্যতে ভদ্রে যেন মাং নাববুধ্যসে ॥
দ্রৌপদীকে অর্জুন কতটা ভালবাসতেন সেটার পরিমাণ বিচারে অর্জুনের এই কথাটা অত্যন্ত জরুরি। যে বিদগ্ধা সুন্দরীকে তিনি নিজেই লক্ষ্যভেদ করে আপন বীর্যশুল্কে বিবাহ করে এনেছিলেন, বিবাহের এত বচ্ছর পরেও তাঁকে বলতে হচ্ছে—তুমি আমার মনের কথাটা বুঝতে পারছ না—যেন মাং নাববুধ্যসে। অন্যদিকে দ্রৌপদী তার মনের কথাটাই বুঝতে চান, অথচ পারেন না। এমনকী আজকেও তিনি এক লহমার তরে অর্জুনের কাছে না এসে পারেননি, অন্তত এই বিপন্ন মুহূর্তে অর্জুন তাঁর কথা কী ভাবছেন, কতটা ভাবছেন—এই জানা তাঁর নিতান্ত প্রয়োজন। এসেই খোঁটা দিয়েছেন, অথচ অর্জুন কতটা নিরুপায় তা তিনি বোঝবার চেষ্টা করেননি।
বস্তুত দ্রৌপদীর ব্যাপারে অর্জুন যে শুধু এখনই নিরুপায় তা নয়। স্ত্রীবেশী বৃহন্নলা অজ্ঞাতবাসের ব্যবহারে—এখনই নিরুপায়, তা মোটেই নয়। এই উপায়হীনতার বন্ধন তাঁর জীবনে সেইদিন থেকে তৈরি হয়েছে, যেদিন তাঁর মা কুমোরশালার মধ্যে থেকে দ্রৌপদীকে না দেখেই বলেছিলেন—পাঁচ ভাই ভাগ করে নাও! ব্যাপারটা আরও একটু বুঝিয়ে বলি। প্রথম কথা, অর্জুন হলেন মহাভারতের উদাত্ত নায়ক। যুদ্ধবীর হিসেবে তিনি যতখানি বড়, ঠিক ততখানি বড় সংযমী হিসেবে। সংযমী কথাটা আমি খুব প্রসারিত অর্থে ব্যবহার করছি। মহাভারতের কথায় অর্জুনের যতগুলি পদক্ষেপ আছে, প্রত্যেকটি সংযমের মাহাত্ম্যে ভরা। যুদ্ধ কিংবা অন্যান্য জায়গাগুলো আপাতত বাদই দিলাম, কারণ সেখানে সমস্ত বড় কাজগুলিই তাঁর নীরব এবং আস্ফোটহীন সহায়তায় ঘটেছে। শুধু যদি দ্রৌপদীর ক্ষেত্রটাই ধরি, তাহলেও দেখব—প্রতি পদক্ষেপে তাঁকে নিজেকে বাঁধবার জন্যই কতবার রাশ টেনে ধরতে হয়েছে এবং এইভাবেই তিনি অন্য ভাইদের ভুল বুঝবার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পেতে চেয়েছেন। অন্যদিকে সুন্দরী কৃষ্ণাকে দেখুন। পাঁচ ভাইকে আপন একক প্রেম ভাগ করে দেওয়ার জন্য বৈবাহিকভাবে তিনি দায়বদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে তা করতে গিয়ে কারও প্রতি বাৎসল্য, কাউকে রসমধুর স্তোকবাক্য, আবার কারও প্রতি শুধুই কর্তব্য করে গেছেন। কিন্তু অর্জুনের ব্যাপারটা বুঝি আলাদা। বিবাহ-লগ্নেই যে লক্ষ্যভেদী বীরপুরুষকে তিনি আশ্চর্য বিস্ময়ে হৃদয় নিবেদন করেছিলেন, সেই মানুষকে কি ভাগের প্রেম দিলে চলে? কারণে অকারণে, জ্ঞানে অজ্ঞানে দ্রৌপদীর দিক থেকে তাই কখনও সামান্য আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, যে আকুলতা অতি স্বাভাবিক এবং তা এতই সূক্ষ্ম যে ঝোই যায় না, এতই গভীর যে একমাত্র ভাগ-বসানো সতর্ক স্বামী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে তা ধরাই মুশকিল।
বস্তুত আমাদের দেশের সামাজিক পরিস্থিতিতে একজনের পাঁচটা বউ থাকতে পারত, কিন্তু এক বউয়ের পাঁচটা স্বামী থাকতে পারত না। কিন্তু এক স্বামীর পাঁচটা কেন, যদি দুটি বউও থাকে তাদের একজন ঠিক বুঝতে পারে যে অন্যতরের প্রতি কতটা রস বিতরণ হচ্ছে, তেমনি এক বউয়ের যদি পাঁচটা স্বামী থাকে তাহলে অন্য স্বামীরাও ঠিক বুঝতে পারেন যে, নিকষে কার কতটা রসলাভ হল। এঁদের মধ্যে তাঁর পক্ষেই বরং খানিকটা নির্লিপ্ত থাকা সম্ভব, যাঁর ভাগ্যে সত্যিই সেই রস-বিনোদন ঘটছে এবং এই ঘটনাই ঘটেছে অর্জুনের ক্ষেত্রে। দ্রৌপদীর প্রেম নিশ্চিত জেনেই তিনি সে প্রেমে অধিকতর নির্লিপ্ত ; কিন্তু সমস্ত বাস্তবতার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে, ঔচিত্যের গণ্ডি পেরিয়ে অর্জুনের জন্য দ্রৌপদীর যে আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে, সে আকুলতা সামান্য হলেও তা ঠিক ধরা পড়েছে অন্য স্বামীদের কাছে। হ্যাঁ, এ-কথা ঠিক, দ্রৌপদীর বিবাহ থেকে আরম্ভ করে মহাভারতের প্রায় শেষাংশ পর্যন্ত এ-তথ্য কেউ প্রকাশ করেননি, পঞ্চপাণ্ডবের কেউ না। মনের কথা বুঝি মনেই ছিল, হয়তো দ্রৌপদীর সামনে এ-কথা প্রকাশ করার ভয়ও ছিল। কিন্তু মহাপ্রস্থানপর্বে যে মুহূর্তে দ্রৌপদীর দেহান্ত হয়েছে সেই মুহূর্তে—আমাদের ধারণামতো—বউ ভাল মরলে আর চাকর ভাল পালালে—এই সুযুক্তি সহানুভূতি যুধিষ্ঠিরের ছিল না, সেই মুহূর্তে তিনি যেন ভাইদের প্রতিনিধি হয়ে বললেন—আমাদের সবার মধ্যে দ্রৌপদী সবচেয়ে ভালবাসত অর্জুনকে, তার ওপরেই ছিল দ্রৌপদীর গহন প্রেমের পক্ষপাত—পক্ষপাতো মহানস্যা বিশেষেণ ধনঞ্জয়ে। যুধিষ্ঠির একটুও ভণিতা না করে দ্বিধাহীনভাবে বললেন—এই পক্ষপাতেরই ফল আজ পাচ্ছে দ্রৌপদী তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে—তস্যৈতৎ ফলমদ্যৈষা ভুঙ্ক্তে পুরুষসত্তম।
অর্জুনকে বেশি ভালবাসত এবং তার ফল পেয়েছে, মরেছে—মৃত্যুর মুহূর্তে হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা যুধিষ্ঠিরের এই সত্যবচন তাঁকে যতই সত্যবাক ঋষির মতো করে তুলুক, মানুষের হৃদয়লোকে এ যেন নৃশংসতা। তা ছাড়া এই পক্ষপাত কতটুকু? নববধূর কুসুম-কল্পনা বারবার দলিত করে ভাবে ভঙ্গিতে আর বক্রোক্তিতে এই পক্ষপাত কতটুকু দেখাতে পেরেছেন দ্রৌপদী? আবার তিনি, যদি বা নিজের অভিমান-মঞ্চ থেকে নেমে এসে যতটুকু পক্ষপাত দেখাতে পেরেছেন, অর্জুনের দিক থেকে তারও সাড়া মেলেনি। একেবারে বিরাটপর্বে এসে অর্জুনকে তাই বলতে হয়েছে—কেউ কারও মন বোঝে না, আমাকেও তুমি বোঝ না—যেন মাং নাববুধ্যসে।
ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে। অর্জুনের দিক থেকে একটা পরিকল্পিত ব্যবহার সৃষ্টি করে নিলেই তাঁর নির্লিপ্ততা এবং দ্রৌপদী আকর্ষণের তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন ধরুন, আমি সেদিনটার কথা ধরছি না, যেদিন লক্ষ্যভেদের পর খুশির হাসিতে উছলে-পড়া দ্রৌপদীর বরমাল্যখানি অর্জুনের গলায় দুলিয়ে দিয়েছিলেন। ধরছি না এই জন্যে যে, নববধূর সদ্য-ফোটা একাধার হৃদয়কল্পনার মধ্যে ঠাসাঠাসি করে বসিয়ে দেওয়া হল আরও চারজনকে। বেশ এ-পর্যন্তও না হয় বোঝা গেল, কিন্তু দ্রৌপদীর সঙ্গে প্রথম সহবাসের সুযোগ পেলেন যুধিষ্ঠির, অর্জুন নয়। অন্তত লক্ষ্যভেদ করার পুরস্কার হিসেবে প্রথম সহবাসের অধিকার তো অৰ্জুনকে দেওয়া যেত। না, যুধিষ্ঠিরও এ-সুযোগ ছাড়েননি, যদিচ ছাড়লেও আমি নিশ্চিত জানি অর্জন এ সুযোগ নিতেন না। তারপরেই তো সেই ব্রাহ্মণের গরু-হারানোর ঘটনা। আচ্ছা, সামান্য একটা গরু চোর ধরার জন্য, আর গরু খোঁজার জন্যও কি অর্জুনকে যেতে হবে? ভীম, নকুল, সহদেব—এঁরা কী করছিলেন? যিনি দূর থেকে কতবার দ্রৌপদীর গলা শুনতে পেয়ে বিপদ উদ্ধার করেছেন, সেই তিনি ভীম ব্রাহ্মণের গরু-হারানো গলা শুনতে পেলেন না? নাকি, কেউই ওই অস্ত্রাগারে ঢুকে দ্রৌপদীর সহবাস খোয়াতে চাননি। তা যাক, না হয় অর্জনই গরু-চোর ধরতে গেলেন এবং নারদের নিয়মে তাঁর বনবাস হল। কিন্তু যুধিষ্ঠির তো ছোট ভাইকে ছাড় দিয়ে বাড়িতেই থাকতে বলেছিলেন, তিনিই তো পাকামি করে থাকলেন না।
ঠিক এইখানটাতেই কথা। ধরে নিই যুধিষ্ঠিরের পীড়াপীড়িতে অর্জুন থেকেই গেলেন। ফলটা কী হত? প্রথমেই এটা পরিস্কার হয়ে যেত যে, অর্জুন কোনও মূল্যেই সহবাস-সুখ ত্যাগ করতে চান না। দ্বিতীয়ত, ভীম কিংবা নকুল-সহদেব হলেও বুঝি ঘরেই থেকে যেতে পারতেন, কিন্তু এটা যেহেতু সেই অর্জুন, যিনি দ্রৌপদীর বরমাল্য জিতেছিলেন, তাই তিনিই প্রথম নিয়ম ভাঙলে অন্য স্বামীদের মনে, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের মনে তো এক ধরনের মিশ্রক্রিয়া হতই। ভীম, নকুল-সহদেবের মনে হত—অর্জুনই যেহেতু লক্ষ্যভেদী এবং দ্ৰৌপদীর আসল নায়ক, তাই যুধিষ্ঠিরের তাকে অত করে থাকতে বলছেন। আর যুধিষ্ঠির মনে মনে ভাবতেন—অর্জুন থেকে গেল, বীর ক্ষত্রিয় হওয়া সত্ত্বেও অন্তত দ্রৌপদীর ওপরে নিজের হক এবং প্রাপ্য পাওনা ছেড়ে দিতে চায় না অর্জুন। কাজেই যুধিষ্ঠির যখন বলেছিলেন—তুমি ছোটভাই, বড়দের ঘরে ঢুকেছ, কী হয়েছে—এটা যুধিষ্ঠিরের ভালমানুষি, না পরীক্ষা, সেটা বুঝতে হবে। অন্তত অর্জুন এটাকে পরীক্ষা হিসেবেই নিয়েছিলেন। তাই যে কথাগুলি যুধিষ্ঠিরই সাধারণত বলেন, অর্জুন সেই ধর্মেরই দোহাই দিয়ে বললেন—ধর্মের ব্যাপারে চালাকি চলে না, একথা আপনার কাছেই শুনেছি। অতএব সত্যধর্ম থেকে বিচলিত হতে চাই না, দাদা? অর্জুন ধীর নির্লিপ্ততায় বনবাসী হলেন।
না, দ্রৌপদী কাঁদেননি, হৃদয়ের গভীরে পাক খাওয়া আসন্ন বিরহের বেদনা হৃদয়ের মধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। তা ছাড়া সেটা কোনও সময়ও ছিল না কাঁদবার। তিনি জ্যেষ্ঠ-স্বামীর সঙ্গসুখ ভোগ করছেন, এই সময়ে তৃতীয় পাণ্ডবের জন্য কাঁদবার মানে হবে একটাই। পক্ষপাত। তিনি শারীরিক সঙ্গ পাবার আগেই অর্জুনকে ভালবেসেছেন। অন্তত নববধূর প্রথম মিলন মুহূর্তেও এই কথাটা তিনি কান্নায় প্রকাশ করতে চাননি। কিন্তু অর্জুন তো চলে গেলেন এবং দ্ৰৌপদীকে না পাবার নৈরাশ্যেই কিছুটা বা বাউল স্বভাব হয়ে গেল তাঁর! নৈরাশ্যের জবাবে উলূপী, চিত্রাঙ্গদা—একটার পর একটা বিয়েই করে ফেললেন। তারপর বুঝি দ্রৌপদীকে হারানোর দুঃখ কিছুটা বা ঘুচল প্রথমবারের মতো সুভদ্রাকে দেখে। রৈবতক পর্বতের বনভোজন মহোৎসবে সুভদ্রাকে দেখেই তাঁর মনে হল—কৃষ্ণ-বলরামের বোনকে দেখে কেই বা না মোহিত হবে-কমিবৈষা ন মো মোহয়েৎ। তিনি সুভদ্রার মধ্যে দ্রৌপদীর রূপ এবং বৈদগ্ধ্য, দুয়েরই ছায়া পেলেন, মনে ভাবলেন—এই মহিলা যদি আমার বউ হত—যদি স্যান্ মম বাষ্ণেয়ী মহিষীয়ম্। শেষে কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় সুভদ্রা-হরণ করে, অনেক যুদ্ধের প্রস্তুতি শেষে বীরের মতো অর্জুন পেলেন সুভদ্রাকে।
পেলেন তো, কিন্তু এক বছরের একটু বেশি সময় দ্বারকায় থেকে সুভদ্রার উষ্ণ-সঙ্গ ভোগ করতে করতেই যে বনবাসের বারো বচ্ছর কেটে গেল। এবার তো ঘরে ফেরার পালা, খাণ্ডবপ্রস্থে, দ্রৌপদীর ঘরে। উলূপী, চিত্রাঙ্গদাকে না হয় দ্রৌপদী নিজের সমমর্যাদায় দেখতেন না, কিন্তু সুভদ্রাকে নিয়ে দ্রৌপদীর মুখোমুখি হওয়া! অর্জুন যে জানেন দ্রৌপদী তাঁকে ভালবাসেন। মাটিতে পড়ে গেলেও স্বলিতপাদ মনুষ্যের অবলম্বন তো সেই ভূমিই, কাজেই যার কাছে অর্জুন অপরাধী, অর্জুন তাকেই আশ্রয় করলেন। খাণ্ডবপ্রস্থে এসে রাজা-ব্রাহ্মণের অভিবাদন সেরেই তিনি ঢুকলেন দ্রৌপদীর ঘরে—দ্রৌপদীম্ অভিজগ্নিবান্। আগেই খবর হয়ে গেছে। বারো বচ্ছর পরে অভিমানে বিধূর দ্রৌপদী প্রথম স্বামি-সম্ভাষণ করলেন কঠিন বক্রোক্তিতে। বললেন—তুমি আবার এখানে কেন? যাও সেইখানে, যেখানে আছে সেই সাত্বত-বৃষ্ণি-কুলের সোহাগী মেয়ে—তত্রৈব গচ্ছ কৌন্তেয় যত্র সা সাত্বতাত্মজা। দ্রৌপদী সুভদ্রার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করলেন না, তাঁর বংশের নামে কথা চালালেন। অর্জুনকে খোঁটা দিয়ে বললেন—তোমার আর দোষ কী? ভারী জিনিস কঠিন বাঁধনে বেঁধে রাখলেও সময়কালে সে বাঁধন খানিকটা আলগা হয়েই যায়—সুবদ্ধস্যাপি ভারস্য পূর্ববন্ধঃ শ্লথায়তে।