॥ ৭ ॥
পাণ্ডৰ কৌরবদের শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে দ্রোণাচার্য তাঁর নগরপ্রান্তিক আবাসস্থল ছেড়ে রাজবাড়িতে এলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। দ্রোণাচার্যের অনুরোধে জরুরি সভা তলব করা হল। স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্র ছাড়াও সেখানে উপস্থিত হলেন দ্রোণের নিয়োগকর্তা ভীষ্ম, বিদুর, ব্যাস, বাহ্লীক এবং কৃপাচার্য। দ্রোণাচার্য সবার সামনে রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন—আপনাদের ঘরের রাজপুত্রেরা অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ করেছে। আপনাদের অনুমতি হলে তারা সে বিদ্যা আপনাদের সামনে প্রদর্শন করবে। ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত খুশি হলেন। খুশি হলেন এই কারণে যে, একসময় তাঁর বড় দুশ্চিন্তা হয়েছিল। খেলাধুলো আর হইহল্লা করে রাজকুমারেরা একসময় বড় বেশি সময় নষ্ট করেছেন, অস্ত্র শিক্ষার কোনও ভাবনাই রাজপুত্রদের ছিল না—কুমারান্ ক্রীড়মানাংস্তান্ দৃষ্ট্বা রাজাতিদুর্মদান্। ধৃতরাষ্ট্রের দুর্ভাবনা ছিল—কুরুবাড়ির বালকেরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের ক্ষত্রিয়োচিত শিক্ষা সম্পূর্ণই করতে পারবে না। কাজেই দ্রোণাচার্য যখন এসে রাজকুমারদের বিদ্যার কুশল নিবেদন করলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্র সোল্লাসে বলে উঠলেন—ঠাকুর! আপনি তো অসম্ভব সম্ভব করে ফেলেছেন—ভারদ্বাজ মহৎ কর্ম কৃতং তে দ্বিজসত্তম।
পুত্রেরা উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করেছে, সেই আনন্দে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র অস্ত্র প্রদর্শনীর সমস্ত ভারই আচার্য দ্রোণের ওপর ছেড়ে দিলেন। সেই প্রাচীনকালে রাজবাড়ির অন্নভোক্তা হওয়া সত্ত্বেও আচার্য এবং গুরুদেবের এই স্বাধীনতা আজও আমাদের কাছে দৃষ্টান্তের মতো। এখনকার দিনে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমস্ত কর্ণধারদের যেভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মেনে চলতে হয়, দ্রোণাচার্যের উদাহরণ তাঁদের আপন স্বাধীনতা সম্বন্ধে মনে মনে পীড়িত করবে। কথাটা কালিদাসের পূর্বজন্মা কবি ভাসের নাটকে আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। সেখানে ভীষ্ম দ্রোণাচার্যকে সম্মান জানিয়ে বলেছেন—যেদিন থেকে কুমারদের ভার উপযুক্ত গুরুর হাতে দেওয়া হয়, সেদিন থেকে মাতাপিতারও সন্তানের ওপর অধিকার থাকে না। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তো দূরের কথা।
ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণাচার্যকে বলেছেন—আপনি যে সময়, যে জায়গায়, যেভাবে, যা করা ভাল মনে করেন, সেই অনুসারেই আমাকে আদেশ করুন—যদানুমন্যসে কালং যস্মিন্ দেশে যথা যথা। আমি অন্ধ, কিন্তু আমাদের ছেলেদের এই পরাক্রম যারা চোখে দেখবে, তাদের মতো চোখ ফিরে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে আদেশ দিলেন দ্রোণাচার্যের মতানুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থা করার জন্য। অর্থাৎ দ্রোণাচার্যের ইচ্ছানুযায়ী অর্থব্যয়ের অনুমতি হয়ে গেল। দ্রোণাচার্য বিদুরের সঙ্গে অস্ত্র প্রদর্শনীর জায়গা দেখলেন আগে। গাছপালা নেই, উঁচু নিচু নয় এমন সমতল ভূমি পরীক্ষা করে জায়গা মাপ করে দিলেন দ্রোণাচার্য এবং সেখানে রাজা এবং রাজবাড়ির মেয়েদের বসবার জন্য দর্শনগৃহ তৈরি করলেন দ্রোণাচার্যের নিযুক্ত শিল্পীরা—প্রেক্ষাগারং সুবিহিতং চক্রুস্তে তস্য শিল্পিনঃ।
দ্রোণাচার্য শুভতিথি দেখে রঙ্গভূমিতে বাস্তুপূজা করলেন এবং ডিণ্ডিম বাজিয়ে ঘোষণা করালেন রাজকুমারদের অস্ত্র প্রদর্শনীর দিনক্ষণ। এমন একটা সংবাদ পেয়ে হস্তিনাপুরের ধনী জনপদবাসীরা নিজেদের খরচায় রঙ্গভূমির পাশে উঁচু উঁচু মঞ্চ তৈরি করলেন—মঞ্চাংশ্চ কারয়ামাসুস্ত্রত্র জানপদা জনাঃ। এখনকার রাজকুমার ভবিষ্যতের রাজা। জনপদবাসীরা তাই রাজপুত্রদের অস্ত্ৰক্ষমতা দেখার ব্যাপারে কর্তব্য বোধ করে। অভিজাত ধনী ব্যক্তিরা পালকি করে ঘরের বউ-ঝিদেরও নিয়ে আসবার ব্যবস্থা করেছেন। এমন রঙ্গ তো আর সব দিন হবে না।
রাজকুমারদের অস্ত্র প্রদর্শনীর নির্দিষ্ট দিন উপস্থিত হল। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রী অমাত্যদের সঙ্গে নিয়ে উপবিষ্ট হলেন দর্শনগৃহের মঞ্চে। তাঁদের সামনে সামনে হাঁটতে হাঁটতে আগেই উপস্থিত হয়েছিলেন পিতামহ ভীষ্ম এবং প্রথম গুরু কৃপাচার্য। এলেন কুরুকুলের রাজমাতারা গান্ধারী, কুন্তী এবং অন্যান্য রমণীরা। আচার্য দ্রোণ তাঁর অস্ত্র-শিষ্যদের শেষ উপদেশ দিয়ে পুত্র অশ্বত্থামার সঙ্গে একটু পরে এসে উপস্থিত হলেন রঙ্গভূমিতে। তাঁর সাদা চুল, সাদা দাড়ির সঙ্গে সাদা কাপড় আর শুভ্র যজ্ঞোপবীতখানি অন্য এক গুরুতর মাত্রা এনে দিয়েছে উপস্থিত দর্শকদের চোখে। রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হয়েই দ্রোণাচার্য ইষ্ট দেবতার পূজা করলেন। ব্রাহ্মণরা স্বস্তিবাচন করলেন—স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ স্বস্তি নস্তার্ক্ষ্যো’রিষ্টনেমিঃ। রাজা ধৃতরাষ্ট্র দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্যকে অস্ত্র-প্রশিক্ষণের দক্ষিণা হিসেবে সোনা মণিমুক্তো এবং অনেক বস্ত্র দান করলেন। এরপর পূণ্যাহ শব্দ উচ্চারণ শেষ হয়ে গেলে রাজকুমারেরা যুদ্ধের উপযোগে সজ্জিত হয়ে রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হলেন।
রাজপুত্রদের অস্ত্র প্রদর্শনীর বিস্তারিত বিবরণ এখানে দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। শুধু এইটুকু না বললে নয় যে, কুমারদের শক্তি এবং কৌশলের ক্ষেত্র যেখানে মাত্রা অতিক্রম করছিল, শুধু সেখানেই দ্রোণাচার্য এবং অশ্বত্থামা প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করছিলেন নিজেদের ব্যক্তিত্ব এবং বোধ অনুযায়ী। এই কারণেই ভীম এবং দুর্যোধনের শক্তি প্রদর্শনের তুঙ্গ মুহূর্তে দ্রোণের নির্দেশ অনুযায়ী অশ্বত্থামা তাঁদের থামিয়ে দিয়েছিলেন। রঙ্গভূমিতে সম্পূর্ণ সময়টাই বেশ ভালভাবে কেটে যাবার কথা ছিল, এমনকী বেশ সকৌতুকেও। কেননা অস্ত্র প্রদর্শনীর শেষ চমৎকার হিসেবে দ্রোণাচার্য অর্জুনকে পেশ করেছিলেন সকলের সামনে। তিনি বলেছিলেন—আমার পুত্রের থেকেও যে আমার প্রিয়তর, ভগবান বিষ্ণুর মতো যে পরাক্রমী, সমস্ত অস্ত্রে নিপুণ—যো মে পুত্ৰাৎ প্রিয়তরঃ সর্বশস্ত্রবিশারদঃ—সেই অর্জুনের শিক্ষা আপনারা দেখুন—স পার্থো দৃশ্যতামিতি।
দ্রোণাচার্যের এই সদৃপ্ত ঘোষণাই শেষপর্যন্ত নতুন এক বিপদ ডেকে এনেছিল রঙ্গভূমিতে। অর্জুন অনেক অস্ত্রকৌশল দেখালেন বটে কিন্তু তাঁর সমস্ত শিক্ষাটাকেই ‘চ্যালেঞ্জ’ জানালেন কর্ণ—যে কর্ণ দ্রোণাচার্যের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র লাভের ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। কর্ণের মনোভাব ছিল অত্যন্ত আপত্তিজনক। রঙ্গভূমিতে দ্রোণাচার্যের মর্যাদা ছিল সবার ওপরে। সেখানে দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্যকে এমন অস্পৃশ্যের মতো একটা সেলাম ঠুকে কর্ণ তাঁর কর্কশ কথাবার্তাগুলি আরম্ভ করলেন, যা সেকালের দিনের সভ্যতার রীতি অতিক্রম করে—প্রণামং দ্রোণকৃপয়ো-র্নাত্যাদৃতমিবাকরোৎ।
অর্জুনের হেনস্থাও কিছু কম হল না। তিনি অত্যন্ত ধীরভাবে এবং অবশ্যই বীরোচিত মর্যাদায় কর্ণকৃত অপমানের মৌখিক জবাব দিলেন বটে, কিন্তু রঙ্গভূমিতে সমস্ত জনপদবাসীদের সামনে তিনি যে মর্যাদায় স্থাপিত হয়েছিলেন, তা অনেকটাই ক্ষুন্ন হল কর্ণের বাগাড়ম্বরে। অর্জুন কর্ণের সম্ভাবিত দ্বৈরথ নিবারিত হল কৃপাচার্যের হস্তক্ষেপে। তিনি কোনও উপায় না দেখে কর্ণকে সূতপুত্রের কলঙ্কে কলুষিত করে রঙ্গভূমির মর্যাদা রক্ষা করলেন বটে, কিন্তু এইখানেই অর্জুন-কর্ণের হৃদয়ে সারা জীবনের শত্রুতার বীজ উপ্ত হয়ে গেল। এই শত্রুতার সঙ্গে দ্রোণাচার্যও একভাবে জড়িয়ে রইলেন এবং ভবিষ্যতে হস্তিনাপুরে যে ধরনের রাজনীতি চলবে, তাতে এই উদ্ধতস্বভাব কর্ণের নানা অমর্যাদা দ্রোণকে সহ্য করতে হবে—কখনও চোখ বুজে, কখনও বা সপ্রতিবাদে।
হস্তিনাপুরের রাজারাজড়া, মন্ত্রী-অমাত্যদের সামনে দ্রোণ যে মর্যাদায় তাঁর প্রশিক্ষণ প্রদর্শনী চালিয়ে গেলেন, তাতে রাজবাড়িতে তাঁর গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল। রাজকুমারদের গুরুকে বয়োজ্যেষ্ঠতার কারণে এবং অবশ্যই ব্রাহ্মণ বলেও সকলে সার্বত্রিকভাবে গুরু বলেই মেনে নিয়েছিলেন। সকলের এই মান্যতা এবং গৌরব-ভাবনার মধ্যেই দ্রোণাচার্য প্রথমেই তাঁর নিজের কাজটি সেরে নেবার কথা ভাবলেন। অর্থাৎ পাঞ্চাল দ্রুপদকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে।
রাজকুমারদের অস্ত্রশিক্ষাদানের প্রতিদান হিসেবে একটা বড়সড় গুরুদক্ষিণা দ্রোণাচার্যের প্রাপ্যই ছিল। আর গুরুদক্ষিণা এমনই এক জিনিস যাতে শিষ্যদের ‘না’ বলার উপায় থাকত না কোনও। ‘না’ বলাটা রীতিসম্মতও ছিল না। দ্রোণ তাঁর সমস্ত অস্ত্র-শিষ্যদের একসঙ্গে ডাকলেন এবং বললেন—তোমাদের পক্ষে শ্রেষ্ঠ গুরুদক্ষিণা হল—পঞ্চালরাজ দ্রুপদকে জীবন্ত ধরে আনতে হবে আমার কাছে—পাঞ্চালরাজং দ্রুপদং গৃহীত্বা রণমূর্ধনি। পৰ্য্যানয়ত ভদ্রং বঃ সা স্যাৎ পরমদক্ষিণা।
গুরুর কথা শুনে যৌবনোদ্ধত রাজকুমারেরা একেবারে হুড়মুড় করে রণসজ্জায় সজ্জিত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন দ্রুপদকে ধরে আনবার জন্য। কেউ একবারও ভাবলেন না—এ কাজের গুরুত্ব কী, রাজনৈতিক তাৎপর্য কী, অথবা যাঁকে তাঁরা ধরতে যাচ্ছেন, তাঁর শক্তিই বা কতটা? দ্রোণাচার্যের দিক থেকেও ঘটনাটা ভেবে দেখুন। তিনি একবারও কুরুবাড়ির প্রধান পুরুষদের একজনকেও জিজ্ঞাসা করলেন না যে, তিনি পাঞ্চাল দ্রুপদকে ধরে আনবার জন্য কুরুবাড়ির রাজকুমারদের পঞ্চালে পাঠাচ্ছেন। তাঁর দিকে অবশ্য যুক্তির অভাব নেই। কেননা, অস্ত্র প্রশিক্ষণের কাজ নেবার আগেই তিনি তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা পিতামহ ভীষ্মের কাছে ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে শিষ্যদের কাছে দক্ষিণা চাওয়ার ব্যাপারেও তাঁর চিরাচরিত স্বাধীনতা আছে; এখানে পিতা বলে ধৃতরাষ্ট্রের, কাকা বলে বিদুরের, অথবা পিতামহ বলে ভীষ্মেরও কোনও হস্তক্ষেপের প্রশ্ন আসে না।
তবে এত যুক্তি থাকলেও প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়। পঞ্চাল আক্রমণ করে দ্রুপদকে ধরে আনার রাজনৈতিক তাৎপর্য যে কতখানি, তা দ্রোণাচার্যও যেমন জানতেন, ভীষ্ম, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্ররাও তেমনই জানতেন। পুনশ্চ এই যুদ্ধযাত্রা সম্বন্ধে তাঁরা অবহিত ছিলেন না মোটেই, এটা ভাবারও কোনও কারণ নেই। অতএব সব জানা সত্ত্বেও যে কুরুবাড়ির প্রধান পুরুষেরা দ্রোণাচার্যের অভিলাষ পূরণে বাধা দিলেন না, তার দুটো কারণ আছে। এক তো সেই পাঞ্চাল-কুরুদের পরস্পরাগত দ্বন্দ্ব, যাতে কোনও না কোনও ভাবে, বিশেষত এখানে দ্রোণের মতো এক পরস্মৈপদী আক্রমণেও যদি পাঞ্চালরা একবার পর্যুদস্ত হয়, তবে তা কুরুমুখ্যদের অনীপ্সিত ছিল না। দ্বিতীয় কারণ, দ্রোণাচার্যের প্রভাব বৃদ্ধি। হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে দ্রোণাচার্যের প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তিনি নিজে থেকে যে কাজটা করছেন, সেটায় কুরুমুখ্যেরা কেউ বাধা দিতে চাননি। বিশেষত দ্রোণের মতো এক পাঞ্চাল-বিরোধী মহাবীরকে বাধা দিয়ে তাঁকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিকূল করে তুলতে চাননি তাঁরা।
দ্রুপদের বিরুদ্ধে দ্রোণশিষ্যদের প্রাথমিক অভিযান সফল হয়নি। দুর্যোধন ইত্যাদি একশো ভাই কৌরব এবং যাঁদের বন্ধু হিসেবে কর্ণও ছিলেন, তাঁদের আক্রমণ দ্রুপদ বিফল করে দিয়েছিলেন। এঁদের প্রায় পলায়মান অবস্থায় অর্জুন এবং ভীম যুদ্ধযাত্রা করেন এবং ভীমের সহায়তায় পঞ্চাল-সৈন্য নাশ করে অর্জুন শেষপর্যন্ত জীবন্ত ধরে ফেলেন দ্রুপদকে। দ্রুপদের এই হীন অবস্থাতেও অর্জুন কিন্তু তাঁকে অপমান করেননি। অপিচ তিনি এই অভিযানের রাজনৈতিক তাৎপর্যও যথেষ্ট অনুধাবন করেছিলেন বলেই দ্রুপদকে ধরে ফেলার পরেও তিনি তাঁর ভাবে ভাষায় দ্রুপদকে এটা বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন যে, তিনি গুরু দ্রোণাচার্যের অভীষ্ট গুরুদক্ষিণা দিতে চেষ্টা করছেন মাত্র, দ্রুপদকে ধরার পিছনে তাঁর ব্যক্তিগত কোনও আক্রোশ নেই। উপরন্তু দ্রুপদকে ধরবার সময় তাঁকে কুরুবীরদের আত্মীয় বলে সম্বোধন করে তিনি দ্রুপদের প্রতি যে সম্মান দেখিয়েছেন তাতে এই হঠাৎ-আক্রমণে কুরুদের রাজনৈতিক দায়ও অনেকটা লঘু হয়ে গেছে। অর্জুন ভীমকে বলেছিলেন—শুধু শুধু দ্রুপদের সৈন্য বধ কোরো না। রাজশ্রেষ্ঠ দ্রুপদ কুরুবীরদের আত্মীয়। তিনি ধরা পড়েছেন অতএব তুমি শুধু গুরুদক্ষিণার কথাটা চিন্তা করো, আর কিছু নয়—সম্বন্ধী কুরুবীরাণাং দ্রুপদো রাজসত্তমঃ। মা বধীস্তদ্বলং ভীম গুরুদানং প্রদীয়তাম। মহাভারতের পরবর্তী অংশ দেখলে বোঝা যাবে—অর্জুনের এই সংযমের ফলে পাঞ্চাল দ্রুপদের সমস্ত রাগটাই দ্রোণের ওপর গিয়ে পড়েছিল, যদিও দ্রোণের আশ্রয়দাতা হিসেবে কুরুমুখ্যরা পাঞ্চাল দ্রুপদের রোষ থেকে কোনওভাবেই মুক্ত হতে পারেননি।
থাক এ কথা, অর্জুন যখন দ্রুপদকে যুদ্ধে পরাজিত করে জীবন্ত অবস্থায় গুরু দ্রোণাচার্যের সামনে নিয়ে এলেন, তখন দ্রোণ একটি একটি করে দ্রুপদের কথাগুলি ফিরিয়ে দিলেন। বললেন—তোমার কথা ছিল,—রাজা নয় এমন মানুষ নাকি রাজার সখা হতে পারে না। তা আজ আমি নিজের জোরে তোমার রাজ্যও বিধ্বস্ত করেছি, তোমার রাজধানীও আমারই অধিকারে। এমনকী তোমার মরণ বাঁচনও এখন তোমার শত্রুর অধীন। এখন বলো, তোমার সঙ্গে পুরনো বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে তুমি কী চাও—সখিপূর্বং কিমিষ্যতে?
বক্রোক্তির জাল বোনা ছেড়ে দিয়ে দ্রোণ এবার সরল কথায় এসে বললেন—আরে আমরা বামুন মানুষ। ক্ষমাই আমাদের ধর্ম—ক্ষমিণো ব্রাহ্মণা বয়ম্। কাজেই তোমার প্রাণের ভয় নেই। ভুলে যেয়ো না ছোটবেলায় তুমি আমার সঙ্গে খেলেছ, আমাদের দুজনের ভাব-ভালবাসা-বন্ধুত্বও কিছু কম ছিল না। সে বন্ধুত্ব আমি এখনও চাই। তবে হ্যাঁ, তুমি যে বলেছিলে—অরাজা কখনও রাজার সখা হতে পারে না, তাই গঙ্গার দক্ষিণ তীরের পঞ্চাল রাজ্যটুকু তোমার, আর উত্তর দিকের রাজ্যভাগটুকু আমার—রাজাসি দক্ষিণে কূলে ভাগীরথ্যাহমুত্তরে। এখন দেখো, তুমি আমাকে বন্ধু বলে মেনে নিতে পার কি না?
না মেনে আর উপায় কী! শত্রুর দাপট সহ্য করে শত্রুর বশীভূত হয়ে তাঁর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। দ্রোণাচার্যের শর্ত দ্রুপদ মেনে নিতে বাধ্য হলেন। তাঁর পিতৃপরস্পরালব্ধ পঞ্চাল রাজ্য ভাগ হয়ে গেল। গঙ্গার দক্ষিণভাগে কাম্পিল্য, মাকন্দী ইত্যাদি নগরীর সমাবেশে একেবারে চর্মণ্বতীর জলধোয়া চম্বল পর্যন্ত দ্রুপদের রাজ্যসীমা ঠিক হল। ওদিকে দ্রোণ গঙ্গার উত্তরে যে রাজ্য পেলেন তার রাজধানী হল অহিচ্ছত্র। শিষ্য অর্জুনের কল্যাণে দ্রোণ এতদিনে রাজা হলেন। ঋষিবংশের স্বাহাকার বষট্কার ছেড়ে শুধু ধনুষ্টংকারের জোরে দ্রোণের আশৈশব লালিত দারিদ্র্য এতদিনে একেবারেই ঘুচে গেল। এখন তিনি রাজা, অহিচ্ছত্র তাঁর রাজধানী—অহিচ্ছত্রঞ্চ বিষয়ং দ্রোণঃ সমভিপদ্যত। দ্রুপদ দ্রোণের কাছে এইভাবে হেরে গিয়ে মনে মনে সান্ত্বনা লাভ করলেন—ক্ষাত্রশক্তিতে তিনি যুদ্ধ হারেননি, তিনি হেরেছেন ব্রাহ্মণ দ্রোণের ব্রাহ্মণ্যের কাছে—হীনং বিদিত্বা চাত্মানং ব্রাহ্মেণ স বলেন তু।
দ্রুপদের ধারণায় ভুল ছিল। যে প্রক্রিয়ায় দ্রোণাচার্য তাঁর রাজ্যলাভের চিরন্তনী বাসনা চরিতার্থ করেছেন, তাতে ব্রাহ্মণের আদর্শ তাঁর কাজে কতটুকু সমুজ্জ্বল, তাতে সন্দেহ থেকেই যায়। তবে হ্যাঁ, একেবারে আধুনিকের দৃষ্টিতে যদি দেখি, তবে দ্রোণাচার্যের মতো এমন ‘ইলাস্টিক’ চরিত্র আধুনিক দৃষ্টিতে এক পরম আদর্শ। যাকে আমরা ‘স্ক্র্যাচ্’ থেকে ওঠা বলি, দ্রোণাচার্য হলেন, সেই চরিত্র। জীবনের যন্ত্রণা তাঁকে কম ভোগ করতে হয়নি। স্ত্রী-পুত্রকে তিনি একসময় উপযুক্ত অন্নপানও দিতে পারেননি। কিন্তু শুধু চেষ্টা এবং লেগে থাকার জোরে যিনি হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে সামান্য জায়গাটুকু করে নিয়েছিলেন, সেই পথে আজ তিনি কিন্তু রাজা। তাঁর শৈশবের স্বপ্ন আজ পূর্ণ হয়ে গেছে।
ঠিক এই মুহূর্তেই কিন্তু সেই সাংঘাতিক প্রশ্নটি আসবে। অহিচ্ছত্রের রাজা হবার পর অথবা তাঁর চিরকালের স্বপ্ন সত্যে পরিণত হবার পরও কি তাঁর উচ্চাশার নিবৃত্তি ঘটেছিল? কই রাজা হবার পর আমরা দ্রোণকে তো সপুত্র-পরিবারে অহিচ্ছত্রের দিকে পা বাড়াতে দেখছি না। একবারও তো পিতামহ ভীষ্মকে তিনি ডেকে বললেন না—আপনাদের উপকার স্মরণে রাখব। অহিচ্ছত্রে আপনাদের আতিথ্য কামনা করি। না, এসব কিছুই নয়। দ্রোণ হস্তিনাতেই রয়ে গেলেন। নিশ্চয় এই অনুপমা নগরী তাঁর ভাল লেগেছে। এখানকার রাজনীতির আস্বাদ নিশ্চয় অহিচ্ছত্রে মিলবে না এবং সেই আস্বাদ তিনি ভোগ করতে চান।
অবশ্য এই মুহূর্তে হস্তিনাপুরে থাকতে তাঁর সম্মানেও লাগছে না। এখন তাঁর সম্পূর্ণ সান্ত্বনা আছে যে, তিনি এক নগরীর রাজা, তিনি আর পরাশ্রিত নন। আমি এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়বাড়ির জনৈকা ঠাকুরমাকে চিনতাম। দেশের বাড়িতে তাঁর কিছু জমিজায়গা ছিল। কিন্তু তিনি শহরে পুত্রের বাড়িতে থাকতেই ভালবাসতেন। কারণে অকারণে পুত্র বা পুত্রবধূর সঙ্গে ঝগড়া লাগলেই তিনি বলতেন—আমাকে ভয় দেখাস না। আমি ইচ্ছে করলে এখনই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারি। নেহাত ওই ‘নিমে’টার জন্য যেতে পারি না। নিমে হলেন ঠাকুরমার নাতি।
দ্রোণের ব্যাপারটা হয়তো একই রকম নিশ্চয়ই। কিন্তু রাজ্য থাকা সত্ত্বেও যে কারণে তিনি সে রাজ্যে জীবনেও পৌঁছোতে পারলেন না, সে হল আর এক ‘নিমে’—হস্তিনাপুরের রাজনীতি। ভেবে দেখবেন, এই হস্তিনাপুরের রাজনীতির আস্বাদ এতই মধুর যে, অধিরথসূতপুত্র কর্ণ অঙ্গরাজ্যের অধীশ্বর হিসেবে স্বীকৃত এবং অভিষিক্ত হবার পরেও তাঁকে কখনও আমরা অঙ্গরাজ্যের শাসন সামলাতে দেখিনি এবং একইভাবে দ্রোণাচার্যও অহিচ্ছত্রে রাজার স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও সেখানে আর ফিরে গেলেন না। সত্যি কথা বলতে কী, হস্তিনাপুরে রাজনীতির বৈচিত্র্য এতই বেশি যে, দ্রোণাচার্যের মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তি, যিনি মনুষ্য রাজনীতি বুঝে বুঝেই এতটা চুল পাকিয়ে ফেলেছেন, তিনি আর অন্যত্র গিয়ে অবশিষ্ট জীবনকে বৈচিত্র্যহীন কুপোদকে পরিণত করতে চাননি। অতএব দ্রোণাচার্য কৌরব-পাণ্ডবদের আচার্যের মহিমায় হস্তিনাপুরেই থেকে গেলেন।
বস্তুত যেদিন দ্রুপদ পাঞ্চালকে অর্জুনের মাধ্যমে হস্তিনায় একান্তে ধরে এনেছিলেন দ্রোণাচার্য এবং তাঁকে তাঁর পূর্বকৃত অপমানরাশি ফিরিয়ে দিয়ে তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলেন, সেইদিন থেকেই চরম রাজনীতি শুরু হয়ে গেল। দ্রোণের প্রতি মরণান্তক প্রতিশোধস্পৃহায় দ্রুপদ এক দ্রোণহন্তা পুত্র কামনা করলেন। যজ্ঞের বেদি থেকে অলৌকিকভাবে সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত পুত্রের জন্ম হল—রাজ্ঞঃ শোকাপহো জাত এষ দ্রোণবধায় বৈ—এবং তাঁর সঙ্গে জন্মালেন দ্রৌপদী, যাঁর জন্মলগ্নেই আকাশবাণী হল—এই কন্যার কারণে ভবিষ্যতে কৌরবদের মহাভয় সৃষ্টি হবে—অস্যা হেতোঃ কৌরবাণাং মহদুৎপৎস্যতে ভয়ম্। লক্ষণীয়, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর আবির্ভাবের সময় থেকেই দ্রোণহন্তা বলে চিহ্নিত, অন্যদিকে দ্রৌপদী চিহ্নিত হলেন কৌরবকুলের ত্রাস হিসেবে। তা হলে দ্রোণ এবং দ্রোণের আশ্রয়দাতা কৌরবরা সকলেই পাঞ্চাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন এবং তা পড়লেন দ্রোণের জন্য।
যে অলৌকিক উপায়ে যুবক এবং যুবতী অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং দ্ৰৌপদীকে পেলেন দ্রুপদ, তাতে আধুনিক মনে কিছু সন্দেহ থেকেই যাবে। তাঁদের সন্দেহ অনুযায়ী এঁরা দ্রুপদের পালিতা পুত্র-কন্যাই হোন, অথবা হোন দ্রোণবধের কারণেই অন্য দেশ থেকে আমদানি করা, তাতে মহাকাব্যের অন্তর বোঝা পাঠকের কোনও অসুবিধে নেই, দ্রুপদের পুত্রকন্যা লাভের সঙ্গে সঙ্গেই মহাভারতের পাঠক বুঝে যান যে, এবার মহাকাব্যের অন্তরবাহিনী নাটকীয়তা অন্য খাতে বইতে আরম্ভ করেছে। কী অসাধারণ এই মহাকাব্যের কাহিনীর গতি। একদিকে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরা নিজেদের জ্ঞাতিশত্রুতার কারণে পাণ্ডবদের বারণাবতে পুড়িয়ে মারার চক্রান্ত করেছেন, অন্যদিকে পাঞ্চাল দ্রুপদ পাণ্ডব অর্জুনকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাঁর সঙ্গে নিজ কন্যা কৃষ্ণা দ্রৌপদীর বিবাহ দেবার জন্য। অর্জুনের কথা ভেবেই তিনি এমন এক ধনুক বানিয়েছেন, যা দিয়ে একমাত্র তিনিই লক্ষ্যভেদ করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়—সো’ন্বেষয়ানঃ কৌন্তেয়ং…দৃঢ়ং ধনুরনানম্যং কারায়ামাস ভারত।
কুরুকুলের জ্ঞাতিশত্রুতার খবর দ্রুপদ জানেন এবং সেই শত্রুতার সুযোগ নিয়ে তিনি সেই কুলেরই মুখ্যতম ধানুষ্কের সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেবার কথা ভেবেছেন। শুধু তাই নয়, যে অর্জুনের মাধ্যমে দ্রোণাচার্য দ্রুপদকে চরম অপমান করেছেন, সেই অর্জুনকে, সেই দ্রোণের প্রিয়তম শিষ্যকে দ্রুপদ নিজের পক্ষে টেনে আনছেন একেবারে রাজনৈতিকভাবে। দ্রৌপদীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দেওয়ার কথা ভাবাটা এখানে দ্রুপদের রাজনৈতিক ভাবনার অনুষঙ্গমাত্র। কুরুকুলের রাজবাড়িতে পরদেশি দ্রোণাচার্যকে পরোক্ষভাবে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটল, এর ভবিষ্যৎ ফল স্থায়ী হবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত।
দ্রুপদের পঞ্চাল রাজ্য অর্ধেক কেড়ে নিয়ে দ্রোণাচার্যও যে খুব শান্তিতে ছিলেন, তা নয়। তাঁর ভয় কিছু ছিল না, তবে অনুশোচনা কিছু ছিল। পাঞ্চালরা যাঁর কাছে অপমানিত হয়েছিলেন, তাঁর হত্যাকারী দ্রুপদের ছেলে হয়ে জন্মেছেন, এ কথা শুনে পাঞ্চালরা আক্রোশে সিংহনাদ করেছিল—ততঃ প্রণেদুঃ পাঞ্চালাঃ প্রহৃষ্টা সাধু সাধ্বিতি। ফলে এ খবর দ্রোণাচার্যের কাছে আসতে দেরি হয়নি। তিনি যে খুব বিচলিত হয়েছিলেন, তা অবশ্য নয়। বরঞ্চ, দৈবের গতি তো খন্ডাবার নয়, এমন একটা বুদ্ধিতে তিনি নিজের মহানুভবতা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে। কুমার ধৃষ্টদ্যুম্নকে তিনি নিজে থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন অস্ত্রশিক্ষা দেবার জন্য—ধৃষ্টদ্যুম্নং তু পাঞ্চাল্যম্ আনীয় স্বং নিবেশনম্। দ্রুপদের রাজ্য কেড়ে নেবার প্রতিদান দিতে চেয়েছিলেন দ্রোণ। সেকালের দিনে এটা অস্বাভাবিক ছিল না। শত্রুর ছেলে বলে বিদ্যাশিক্ষা দেব না—গুরুমশায়রা এমন কুচুটে ছিলেন না। নৈতিক শত্রু বৃহস্পতির ছেলে কচকে যেমন শুক্রাচার্য শিক্ষা দিয়েছিলেন, দ্রোণাচার্যও তেমনই দ্রুপদের ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্নকে ডেকে এনে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন। এতে আর কিছু না হোক, দ্রোণ এক কালজয়ী যশস্বিতার অধিকারী হয়েছিলেন। জগতের কাছে তিনি প্রচার করতে পেরেছিলেন যে, না, লোভ নয়, শুধু দ্রুপদ তাঁর প্রতিজ্ঞাত সত্য লঙ্ঘন করেছিলেন বলেই দ্রোণ তাঁকে শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু মনে মনে তাঁর কোনও রাগ নেই। থাকলে কি শত্রুর পুত্রকে নিজের ভবিষ্যৎ-হন্তা জেনেও কেউ তাঁকে অস্ত্রশিক্ষা দেয়? দ্রোণ তাই দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর এই মহানুভবতা গুরু হিসেবে তাঁর নিরপেক্ষতা প্রমাণ করবার জন্য যতখানি, তার থেকে অনেক বেশি নিরপেক্ষ এবং মহানুভব হিসেবে নিজেকে প্রচার করার জন্য। এই যশটুকু তিনি ধরে রাখতে চান—তথা তং কৃতবান্ দ্রোণ আত্মকীর্ত্যনুরক্ষণাৎ।
কিন্তু দ্রোণের যশোভাবনা, মহানুভবতা, সবকিছু নিশ্চয়ই একেবারে গণ্ডগোল হয়ে গেল, যখন তিনি শুনলেন যে, তাঁর পুত্রাধিক প্রিয়তম শিষ্য অর্জুন পাঞ্চাল রাজকুমারীকে বিবাহ করেছেন এবং এই সূত্রে পঞ্চ পাণ্ডবই কৃষ্ণা দ্রৌপদীর স্বামিত্ব লাভ করেছেন। ঠিক এইসময় থেকেই কিন্তু দ্রোণাচার্যের ভাবনা চিন্তা পালটে যেতে থাকে। কৌরব-পাণ্ডবের পারিবারিক তথা পারস্পরিক বিরোধের সঙ্গে তাঁর দ্রুপদ-বিরোধিতা মিশে গেলেও পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রুপদকন্যার বিবাহসংবাদ যখন কৌরব রাজসভায় আলোচনার বস্তু হয়ে উঠল, তখন কিন্তু দ্রোণাচার্যকে একেবারে উলটো গাইতে শুনছি। তাঁর সেই তীব্র দ্রুপদ-বিরোধিতা আগেই কিছু প্রশমিত হয়েছিল বটে, এখন কিন্তু তিনি পাঞ্চাল দ্রুপদের বিরোধ মিটিয়ে নেবার পক্ষে। হয়তো এর প্রধান কারণ অর্জুন, যাঁর বীরত্ব সম্পর্কে দ্রোণাচার্যই সবচেয়ে অবহিত ব্যক্তি।
কৌরব-রাজসভায় আলোচ্য বস্তু ছিল—পাণ্ডবদের রাজ্যভাগ দেওয়া হবে কি না। সভায় ভীষ্ম সমস্ত আন্তরিকতায় পাণ্ডবদের পৈতৃক রাজ্যভাগ ফিরিয়ে দেবার কথা বলেন এবং তাঁকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেন দ্রোণ। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন—আপনি মন্ত্রিসভায় মন্ত্রণা দিতে ডেকেছেন বলেই যেটা আপনার পক্ষে ন্যায় হবে এবং আপনার সুনাম হবে, সেই মন্ত্রণাই আপনাকে দেব। পাণ্ডবদের রাজ্যভাগ ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে ভীষ্মের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। অপিচ আমার পরামর্শ হল—আপনি দ্রুপদের কাছে এখনই এমন একজন লোক পাঠান যে ভাল কথা বলে—প্রেষ্যতাং দ্রুপদায়াশু নরঃ কশ্চিৎ প্রিয়ম্বদঃ। সে গিয়ে যেমন পাণ্ডবদেরও কুশল এবং বৃদ্ধি কামনা করবে, তেমনই মহারাজ দ্রুপদ এবং তাঁর পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নেরও বৃদ্ধি কামনা করবে এবং তা বার বার করবে—অসকৃৎ দ্রুপদে চৈব ধৃষ্টদ্যুম্নে চ ভারতে। দ্রুপদের সঙ্গে এই বৈবাহিক সম্বন্ধ ঘটায় কৌরবদের যে কত আনন্দ এবং কত লাভ হয়েছে, সেটাও যেন আপনার দূত পরিষ্কার করে বলে—উচিতত্বং প্রিয়ত্বঞ্চ যোগস্যাপি চ বর্ণয়েৎ।
বিবাহ উপলক্ষে পাণ্ডবদের কাছে যেসব ধনরত্ন বস্ত্রালংকার ইত্যাদি উপহার পাঠানোর প্রস্তাব করলেন দ্রোণ, তার সঙ্গে দ্রুপদ এবং দ্রুপদের ছেলেদের কাছেও প্রচুর উপহার সামগ্রী পাঠাতে বললেন তিনি—তথা দ্রুপদপুত্ৰাণং সর্বেষাং ভরতৰ্ষভ। দ্রোণাচার্যের এমনতর পরামর্শের জন্য তাঁকে সামান্য করে হলেও কথা শুনতে হল দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণের কাছে। আসলে কুরুমুখ্যদের মন্ত্রণাসভায় একটা পরিবর্তন চোখে পড়ছে দ্রোণের। তিনি দেখতে পাচ্ছেন—ভীষ্ম, বিদুর ইত্যাদি কুরুপ্রধানদের বক্তব্য আজকাল যেন তেমন গুরুত্ব পায় না মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। পুত্রের স্বার্থে ধৃতরাষ্ট্র আজকাল দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ এবং শকুনিকে এতটাই প্রশ্রয় দিচ্ছেন, যাতে ভীষ্ম বিদুর এমনকী তিনি নিজেও যেন কেমন সংকুচিত বোধ করেন। দ্রোণ দেখলেন—ভীষ্মের কথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি আপন সুচিন্তিত পরামর্শ কুরুসভায় নিবেদন করা সত্ত্বেও দুর্যোধনের প্রশ্রয়ে কর্ণ এমন একটু বাড়াবাড়ি কথা বলে ফেললেন যাতে মনে হয়—তিনি ভীষ্মের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং তাঁদের দুজনের মনেই যেন পাপ আছে—সর্বকার্যেষ্বনন্তরৌ…প্রচ্ছনেনান্তরাত্মনা। কর্ণ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দ্রোণাচার্যকে গালাগালি দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন—আপনাকে এখন বুঝে নিতে হবে যে, আপনার দুষ্ট মন্ত্রীরা কী বলছেন এবং আপনার হিতকামী অদুষ্ট পরামর্শদাতারাই বা কী বলছেন—ধৃষ্টানাঞ্চৈব বোদ্ধব্যম্ অধৃষ্টানাঞ্চ ভাষিতম্।
দ্রোণ বুঝতে পারেন—কেন তাঁর ওপর এত রাগ কর্ণের। অর্জুনকে মারবার জন্য ব্রহ্মাস্ত্রের সন্ধি জানতে চেয়েও পাননি দ্রোণের কাছে, অতএব রাগ তো থাকবেই। কিন্তু তাই বলে রাজসভায় দাঁড়িয়ে এইভাবে ঘুরিয়ে অপমান করবে। তা ছাড়া দ্রোণের মর্যাদা কি কুরুবাড়িতে কিছু কম? আজও কি তিনি কুরুসভার মন্ত্রী নন? সেই বালকদের অস্ত্র পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকে তিনি কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রকে পরিচ্ছন্ন উপদেশই দিয়ে আসছেন। এ কথা অবশ্যই সত্যি যে, দ্রুপদ পাঞ্চালের ওপর ব্যক্তিগত ক্রোধ থাকা সত্ত্বেও দ্রোণাচার্য কিন্তু সমস্ত ব্যক্তি-স্বার্থ ভুলেই এখন সদুপদেশ দিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। রাজনীতির বোধ তাঁর কিছু কম নয় এবং সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পালটানোটাই যদি রাজনীতির সিদ্ধি বলে চিহ্নিত হয়, তা হলে নিঃসন্দেহে দ্রোণাচার্য একজন বড় রাজনীতিবিদ।
ব্যক্তিগত সমস্ত ক্রোধ ভুলে তিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি পালটেছেন। পাণ্ডবদের মতো মহাবীর দ্রুপদের মতো সহায় পেলে যে কুরু রাজ্যের সামূহিক ক্ষতি করতে পারেন—এ কথা বুঝতে দ্রোণাচার্যের দেরি হয়নি। কাজেই কর্ণ কটু কথা বললেও দ্রোণ তাঁকে ছেড়ে দিলেন না। বললেন—ওরে বদমাশ। পাণ্ডবদের ওপর তোর চিরকালের রাগ আর, সেই জন্যই এ সব অন্যায় কথা তুই বলছিস—দুষ্ট! পাণ্ডবহেতো-স্ত্বং দোষমাখ্যাপয়স্যুত। তা বেশ তো, আমার কথাটা যদি এতই খারাপ, তত ভালটা তুই বল দেখি—ব্ৰূহি যৎ পরমং হিতম্। দ্রোণ এবার চরম কথাটা শুনিয়ে দিলেন। বললেন—ভাল কথা বললাম বাপু। যদি না শোনা হয়, তবে এই কুরুদের সর্বনাশ হবে বলে দিলাম—কুরবো বৈ বিনঙ্ক্ষ্যন্তি ন চিরেণৈব মে মতিঃ।
কর্ণ দ্বিতীয়বার দ্রোণের প্রতিবাদ করার আগেই বিদুর বলতে উঠেছেন। ভীষ্ম এবং দ্ৰোণ দুজনকেই পরম মর্যাদা দিয়ে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন—বয়স, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতা—এই সবগুলিই এঁদের এত বেশি যে, ভীষ্ম-দ্রোণের কথা একেবারেই ফেলে দেওয়া যায় না। কুরুবাড়িতে এই দুই ব্যক্তির অবস্থিতি পরম মর্যাদার আসনে। এঁরা আগেও কোনওদিন কুরুদের অহিতের কথা বলেননি, কোনও দিন কোনও অপকারও করেননি এবং এঁরা আপনার প্রতি কপট আচরণ করবেন না—তন্নিমিত্তমতো নেমৌ কিঞ্চিদ্ জিহ্মং বদিষ্যতঃ। বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে বললেন—রাজনীতির কূট পরামর্শ বলে কথা। সবকিছু এঁরা তাই স্পষ্ট করে বলেনওনি—নোচতু-র্বিবৃতং কিঞ্চিৎ। বিদুর দ্রোণের কথারই ইঙ্গিত দিলেন। বোঝাতে চাইলেন—পাঞ্চাল দ্রুপদের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে পাণ্ডবদের সামরিক শক্তি যুক্ত হয়ে যাওয়ায় রাজনীতির ক্ষেত্রে নতুন এক মেরুকরণ ঘটেছে।
বিদুর একে একে অর্জুন-ভীমের সামরিক পরাক্রমের কথাই শুধু বললেন না, কীভাবে পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্ণি-অন্ধক জাতিগোষ্ঠীর প্রধান প্রতিভূ কৃষ্ণ এসে গেছেন পাণ্ডবদের সহায়তায় এবং পাণ্ডবদের শ্বশুর হিসেবে দ্রুপদ যে কৌরবদের কতটা প্রতিপক্ষতা করবেন—সেটা বুঝিয়ে দিলেন বিদুর। দ্রোণাচার্য বার বার পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রুপদের কথাটাও কেন উচ্চারণ করেছেন, সেটা আরও স্পষ্ট করে দিয়ে বিদুর বললেন—দ্রুপদ একজন বড় রাজা এবং আমরা কুরুরা তাঁর সঙ্গে কিছু শত্রুতা করেছি—দ্রুপদো’পি মহান্ রাজা কৃতবৈরশ্চ নঃ পুরা। এই বৈরিতার মধ্যে দ্রোণের দায়িত্বের কথা বিদুর এড়িয়ে গেলেন এবং বললেন—যাঁর সঙ্গে এই শত্রুতা আমরা করে রেখেছি, তাঁকে যদি আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা যায়, তবে আমাদেরই বাড়বাড়ন্ত হবে—তস্য সংগ্ৰহণং রাজন্ অস্মৎকুল-বিবর্ধনম্।
বস্তুত দ্রোণ এই কথাটাই বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দ্রুপদের সঙ্গে শত্রুতা সৃষ্টি করার মধ্যে তাঁর নিজের যে সাময়িক ব্যক্তিস্বার্থ ছিল, সে কথা আর রাজসভায় বলে নিজের অসম্মান ডেকে আনেন কী করে! একেতেই তো কর্ণ মুখিয়েই আছে। রাজসভায় দাঁড়িয়ে দ্রুপদকে খুব বড় রাজা বলাও দ্রোণাচার্যের পক্ষে সম্ভব নয়, কেননা, তাতেও এই শত্রুতার ব্যাপারে তাঁর দায়িত্ব উচ্চারিত হতে পারে। বিদুর তাই খুব কায়দা করে পাণ্ডবদের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুপদকেও যে কেন তুষ্ট করতে বলেছেন দ্রোণ, সেটা ঘুরিয়ে বলে দিলেন। বললেন—যাঁদের শ্বশুর হলেন দ্রুপদ, যাঁদের শ্যালক সম্বন্ধীরা হলেন ধৃষ্টদ্যুম্ন ইত্যাদি ভাইয়েরা, তাঁদের প্রাপ্য রাজ্য দিয়ে দিন তাঁদের। মনে রাখবেন—দ্রুপদ খুব কম বড় রাজা নয় এবং মিত্রপক্ষ হিসেবে কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর অনুগত দাশার্হ, বৃষ্ণি, অন্ধক ইত্যাদি গোষ্ঠীপতিরাও পাণ্ডবদের বিজয় ত্বরান্বিত করবেন।
দ্রোণাচার্য-কথিত রাজনৈতিক সমীকরণ বিদুরের মুখে স্পষ্টভাবে যখন উচ্চারিত হল, প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র তখন পাণ্ডবদের বিবাহোত্তর রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিকঠাক বুঝতে পারলেন। দ্রোণ এবং ভীষ্মের প্রতি মৌখিক সম্মান তো তিনি দেখালেনই, উপরন্তু বিদুরকে পঞ্চালে পাঠিয়ে দিলেন দ্রুপদকে যথোচিত সম্মান জানানোর জন্য। কুন্তী এবং দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদেরও তিনি ফিরিয়ে আনলেন রাজধানীতে। পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরের কাছাকাছি পৌঁছোলে রাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী পাণ্ডবদের প্রত্যুদ্গমন করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসার জন্য ধৃতরাষ্ট্র যাঁদের পাঠালেন, তাঁদের মধ্যে দুর্যোধন, দুঃশাসনের মতো পাণ্ডববিদ্বেষী লোক মোটেই স্থান পেলেন না। স্থান পেলেন বিকর্ণ, যিনি কৌরবদের এক ভাই হওয়া সত্ত্বেও পাণ্ডবদের অনুকূল পুরুষ। আর স্থান পেলেন কৃপাচার্য এবং দ্রোণাচার্য—দ্রোণঞ্চ পরমেষ্বাসং গৌতমং কৃপমেব চ। দ্রুপদের বাড়ি-ফেরত বলে দ্রোণ কিন্তু পাণ্ডবদের প্রতি এই সময় বিমুখ হয়ে থাকেননি।
পাণ্ডবরা হস্তিনায় এলেন এবং রাজধানীর মন্ত্রীঅমাত্য তথা কুরুমুখ্যদের চাপে—এর মধ্যে দ্রোণাচার্যও অবশ্যই ছিলেন—ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের রাজ্য ভাগ করে দিতে বাধ্য হলেন। পাণ্ডবরা খাণ্ডবপ্রস্থে চলে গেলে কুরুবাড়ির রাজসভায় নতুন রাজনীতি শুরু হল। পাণ্ডবরা ময়দানবের সাহায্যে ধৃতরাষ্ট্রের দেওয়া নির্গুণ ভূমিতে ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করলেন। তাঁদের বাড়বাড়ন্তও কিছু কম হল না। জরাসন্ধবধ এবং রাজসূয় যজ্ঞের শেষ কল্পে যুধিষ্ঠিরের মর্যাদা তুঙ্গে উঠল। মহামতি দ্রোণাচার্যকে এইসময় আমরা প্রায় অন্তরালবর্তী অবস্থায় দেখছি। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়তে তিনি অন্যান্য কৌরবদের সঙ্গে নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন সাদরে। চতুর্থ পাণ্ডব নকুল পৃথকভাবে দ্রোণকে নিমন্ত্রণ করেন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ে যোগ দেবার জন্য এবং তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে উপস্থিত হলে যুধিষ্ঠির তাঁকে যে কাজ দিয়েছিলেন, মর্যাদায় তা ভীষ্মের সমান। যুধিষ্ঠির দ্রোণ এবং ভীষ্মকে বলেছিলেন—এই বিশাল যজ্ঞকার্যে যে কাজ করা হয়ে গেছে এবং যেসব কাজ করা হয়নি—সে বিষয়ে উপদেশ দেবেন আপনারা দুজন—কৃতাকৃত-পরিজ্ঞানে ভীষ্মদ্রোণৌ মহামতী।
রাজসূয় যজ্ঞের পর যুধিষ্ঠিরের মর্যাদা এবং ধনসম্পদ যত বাড়ল দুর্যোধনের ঈর্ষা এবং অসূয়া বাড়ল ঠিক ততখানি। এই ঈর্ষা অসূয়া দুর্যোধনের মাধ্যমে অনুসৃত হল ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয়ে। এর ফলে হস্তিনাপুরের রাজসভার বৃদ্ধ এবং অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের প্রভাব প্রতিপত্তি যেন একটু কমে এল। দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ এবং শকুনিকে নিয়ে যে ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ তৈরি হয়েছিল, স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র প্রায় প্রত্যক্ষভাবেই তাঁদের কথায় সায় দিচ্ছিলেন। এরই ফলে পাশাখেলার আসর বসল এবং কৃষ্ণা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো চরম অসভ্যতা চোখের সামনে দেখতে হল কুরুকুলের প্রধানদের এবং অবশ্যই চিরবিশ্বস্ত মন্ত্রী অমাত্যদেরও।
রাজবাড়ির ভিতরে এবং বাইরে সর্বত্রই দুর্যোধন দুঃশাসনেরা যে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে চরম বিদ্বেষ পোষণ করছেন, দ্রোণাচার্য তা জানেন। কিন্তু সে বিদ্বেষ যে এই পর্যায় পৌঁছেছে, তা তিনি বোঝেননি। পাশায় হারতে হারতে যুধিষ্ঠিরের পণ রাখার মতো আর যখন কিছু রইল না এবং শকুনি যখন তাঁকে কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে পণ রাখার ইঙ্গিত দিলেন, দ্রোণ-ভীষ্মরা তখনও ভাবতে পারেননি যে, যুধিষ্ঠির এই ফাঁদে পা দেবেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যখন শেষপর্যন্ত পঞ্চস্বামী-গর্বিতা দ্রৌপদীকে দ্যূতক্রীড়ার তাড়নায় পণ রেখে বসলেন, সেই মুহূর্তে লজ্জায়, অপমানে দ্রোণাচার্যের সারা শরীর দিয়ে ঘাম বেরোতে লাগল। ভীষ্ম এবং কৃপের অবস্থাও একই রকম। কুরুবাড়িতে এঁরা তিনজনই প্রায় সমবয়স্ক মানুষ। কেউ বা একটু ছোট বড়, এই আর কী। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই আকস্মিকতার পরে যে কত কিছু ঘটবে, এটা তাঁরা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁদের সকলেরই সমান প্রতিক্রিয়া হল—ভীষ্মদ্রোণ কৃপাদীনাং স্বেদশ্চ সমজায়ত। কুরুসভার বৃদ্ধ উপদেষ্টা হিসেবে সভার মর্যাদাহানিকর সমস্ত ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধেই তাঁরা সোদ্বিগ্ন ধিক্কার জানালেন—ধিগ্ধিগিত্যেব বৃদ্ধানাং সভ্যানাং নিঃসৃতা গিরঃ।
কিন্তু রাজসভার মন্ত্রী হলে শুধু ধিক্শব্দ উচ্চারণ করে পার পাওয়া যায় না। সভার মর্যাদাহানি ঘটলে বিপন্ন ব্যক্তির প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। অতএব দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর বস্ত্র আকর্ষণ করেছেন, তখন দ্রৌপদীর কাছে শেষ ভরসা ছিলেন কুরুসভার সভ্যরাই, যার মধ্যে দ্রোণও আছেন। দ্রৌপদী কুরুবৃদ্ধদের ধিক্কার শব্দ ফিরিয়ে দিয়েছেন প্রতিধিক্কারে। তিনি বলেছেন—কুরুসভার মধ্যে এই পাপিষ্ঠ আমার বস্ত্র আকর্ষণ করছে এবং কেউ তার প্রতিবাদ করছেন না। এতে মনে হয় বৃদ্ধদের এতে মত আছে, সায় আছে। ধিক্ এই ভরতবংশীয় পুরুষদের, তাঁদের ধর্ম নষ্ট হয়ে গেছে—ধিগস্তু নষ্টঃ খলু ভারতানাং ধর্মঃ—তাঁরা বসে বসে এই দুষ্কর্ম দেখছেন! দ্রৌপদী নাম করে বললেন—কৌরব পাণ্ডবদের গুরু দ্রোণাচার্য, পিতামহ ভীষ্ম এবং বিদুর—এঁদের শরীরে প্রাণ বলে কোনও বস্তু আছে বলে মনে হচ্ছে না—দ্রোণস্য ভীষ্মস্য চ নাস্তি সত্ত্বং—সবচেয়ে বড় কথা, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যে এই অমানুষিক কর্ম করছেন, কুরুবৃদ্ধ এবং রাজসভার বৃদ্ধরা তা চোখে দেখতে পাচ্ছেন না—ন লক্ষয়ন্তে কুরুবৃদ্ধমুখ্যাঃ।
দ্রৌপদী অনেক কঠিন শব্দে রাজসভার মুখ্য পুরুষদের উদ্দেশে বক্রোক্তি করলেও দ্রোণাচার্য কোনও কথা বলতে পারলেন না। বলা উচিত ছিল, কিন্তু বললেন না বোধ হয় এই কারণে যে, তিনি স্পষ্টতই কুরুবাড়ির আত্মীয়-সম্বন্ধী কেউ নন। এ বাবদে প্রথম কথা বলা উচিত আত্মীয়দেরই এবং তাঁর এই ভাবনা সত্য করে ভীষ্মই প্রথমে কথা বলেছিলেন, যদিও সে কথা ছিল অনেকটাই নৈতিকতায় ভরা। তাতে দ্রৌপদীর কোনও কাজ হয়নি। সভায় কৌরবদের অসভ্যতার বিরুদ্ধে ধর্মনিষ্ঠ বিকর্ণও কঠিন কথা বলেছেন এবং সেখানেও দ্রোণাচার্যকে কথা শুনতে হয়েছে। কৌরব পাণ্ডবদের আচার্য হিসেবে তাঁর যে কিছু মন্তব্য করা উচিত ছিল—বিকর্ণ সে কথা উল্লেখ করতে ভোলেননি—ভারদ্বাজো হি সর্বেষামাচার্যঃ কৃপ এব চ। বিকর্ণের মতো আরও একজন ওই ঘটনার প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বিদুর। তিনি এমনও বলেছিলেন যে, কুরুসভার সভ্যরা যদি দ্রৌপদীর প্রশ্নের জবাব না দেন, তবে সেটা ধর্মের অবমাননা এবং সেও এক ধরনের মিথ্যাচারিতা—ন চ বিব্রত তং প্রশ্নং সভ্যা ধর্মো’ত্র পীড্যতে।
দ্রোণাচার্য তবু কোনও কথা বলেননি। আসলে দ্রোণের বাস্তববোধ অতি প্রখর। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র্য এবং বঞ্চনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে সংসারকে তিনি বড় বেশি চিনে গেছেন। তিনি বেশ বুঝে গেছেন—দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণরা যে পরিমাণ প্রশ্রয় পেয়েছেন স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, তাতে বৃদ্ধদের কথার কোনও মূল্য হবে না। উলটে তাঁকে অপমানিত হতে হবে ওই যুবক সদস্যদের কাছেই। অবশ্য এই অপমান ধরে নিয়েও তাঁর কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলেননি যে, তার কারণ খানিকটা স্বার্থবোধ আর খানিকটা বাস্তববোধ। যে অবস্থা থেকে তিনি কুরুসভার মন্ত্রীপদে উন্নীত হয়েছেন, তাতে কুরুকুলের প্রধানতম পুরুষ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তাঁর ঋণ আছে। এখন এই বয়সে তাঁর প্রশ্রিত জনের প্রতিপক্ষতা করে নিজের স্বার্থহানি ঘটানোর প্রয়োজন বোধ করেননি দ্রোণাচার্য।
তবে এই স্বার্থচেতনার চেয়েও বড় তাঁর বাস্তববোধ। সেটা আরও বেশি করে প্রমাণ হয় যখন কর্ণ কটু ভাষায় সভামুখ্যদের নিন্দা করতে থাকেন। দ্রোণাচার্য কোনও কথা বলেননি, তবু কর্ণের কাছে তাঁকে কী না শুনতে হল। কর্ণ বললেন—এ সভায় তিনটি মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে ন্যায় এবং ধর্মের কোনও বালাই নেই। এঁরা হলেন ওই ভীষ্ম, বিদুর এবং ওই কৌরবদের গুরুটা—ভীষ্মঃ ক্ষত্তা কৌরবাণাং গুরুশ্চ। এঁরা কী করেন জানেন? এঁরা যে প্রভুর আশ্রয়ে থাকেন, সেই প্রভুকেই এঁরা বদমাশ বলে গালাগাল দেন, সেই প্রভুরই মূলোচ্ছেদ কামনা করেন এবং এই পাপ করতে এঁদের কোনও লজ্জাও হয় না—যে স্বামিনং দুষ্টতমং বদন্তি, বাঞ্ছন্তি বৃদ্ধিং ন চ বিক্ষিপন্তি।
দ্রোণ কিছু বলেননি, কোনও প্রতিবাদও করেননি। অথচ তাঁকে এই অপমান সইতে হল এই কারণে যে, ভীম যখন উত্তাল সভার মাঝে দুর্যোধন দুঃশাসনদের মারণ-প্রতিজ্ঞা করছিলেন, তখন ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুরেরা তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। দ্রৌপদী এবং পাণ্ডবদের প্রতি এই পরোক্ষ সমর্থনেই এতখানি কঠিন কথা শুনতে হল কর্ণের কাছে। অবশ্য এই অপমানের পিছনে দ্রোণের প্রতি কর্ণের যে ব্যক্তিগত আক্রোশও ছিল এবং সে আক্রোশ যে সেই অস্ত্রশিক্ষার সময় থেকেই মনে মনে পুষে আসছেন কর্ণ, সে কথা দ্রোণ যথেষ্ট বোঝেন। এর পরেও দ্রোণ অবশ্য কিছু বলেননি, কিন্তু পক্ক কূটনীতিবিদের মতো কর্ণের অপমান তিনি মনে রেখে দিলেন।
দ্বিতীয়বার দ্যূতক্রীড়া হল এবং পাণ্ডবদের বনবাসে যেতেই হল। বনে যাবার আগে পাণ্ডবরা কুরুবংশ ধ্বংশের প্রতিজ্ঞা করে গেলেন। কর্ণ-শকুনিও এই বধ-প্রতিজ্ঞার বাইরে রইলেন না মোটেই। ভীম-অর্জুনের কঠিন প্রতিজ্ঞায় এই ভয় এবং আশঙ্কা সকলের মনে সজীব থাকল যে, পাণ্ডবরা প্রতিশোধ নেবেন অবশ্যই। ঠিক এইসব সময় আমরা দ্রোণাচার্যের মর্যাদা বেড়ে উঠতে দেখছি। দুর্যোধনের প্রশ্রয়ে যে কর্ণ দ্রোণাচার্যকে চরম অপমান করেছিলেন, সেই কর্ণকে এখন অন্যরকম দেখছি। পাণ্ডবরা বনবাসে যাবার পর দেবর্ষি নারদ এসে আধুনিক কৌরব কর্তাদের সাবধানবাণী শুনিয়ে গেছেন। তিনি বলে গেছেন—এখন থেকে চোদ্দো বছরের মাথায় দুর্যোধনের অন্যায়ের চরম ফল ফলবে। ভীম অর্জুনের শক্তিতে কৌরবকুল ধ্বংস হবে—ইতশ্চর্তুদশে বর্ষে বিনঙ্ক্ষ্যন্তীহ কৌরবাঃ।
নারদের এই সাবধানবাণী শুনে—দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি—যাঁরা প্রধানত পাণ্ডবদের রাজ্যহরণের চক্রান্ত করেছিলেন—তাঁরা সবাই এসে হঠাৎ দ্রোণাচার্যের পায়ে পড়ে গেলেন। তাঁরা বিদুর কিংবা ভীষ্মের পায়ে পড়লেন না, কারণ, তাঁরা কৌরবদের এবং পাণ্ডবদের সমান আত্মীয়। কিন্তু দ্রোণ যেহেতু ভীষ্মের মতোই শক্তিশালী অথচ তিনি কৌরবদের ভরণপোষণ গ্রহণ করেন, অতএব বিপন্ন সময়ে তাঁর শরণাপন্ন হলে কৌরবদের প্রতি তিনি শেষপর্যন্ত অকরুণ হতে পারবেন না—এই ভেবেই কৌরবরা আচার্যের শরণাপন্ন হলেন—দ্রোণং দ্বীপমন্যন্ত রাজ্যং চাস্মৈ ন্যবেদয়ন্—শুধু তাই নয়, কৌরবরা সাময়িকভাবে সমস্ত কৌরব রাজ্যের ভালমন্দও ন্যস্ত করলেন দ্রোণের ওপর।
এই আপাতিক শরণাগতির ভাবুকতার মধ্যে দুর্যোধনের সঙ্গে যেহেতু কর্ণ-শকুনিরাও ছিলেন, এবং যেহেতু কুরু রাজ্যের শাসককুলের অন্নঋণ মনে রাখেন দ্রোণ, অতএব এই বিপত্তারণের ভার তিনি অস্বীকার করলেন না। কিন্তু আচার্যের স্মৃতিশক্তি যেহেতু একটুও দুর্বল নয়, তাই মুক্ত সভার মধ্যে কর্ণের কটূক্তিগুলি অবশ্যই তাঁর মনে আছে। দুর্যোধন কৰ্ণরা যতই এখন ভাল্ভালাই করুন, দ্রোণ অত্যন্ত বিনীতভাবে তাঁদের দুটো কথা শোনাতে ছাড়লেন না। দ্রোণ বললেন—সোজা কথা জেনে রাখো—পাণ্ডবদের মেরে ফেলা মোটেই সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, তোমরা বিপন্ন হয়ে আমার শরণাগত হয়েছ, আমি আমার শক্তি অনুসারে তোমাদের রক্ষা করার চেষ্টা করব। অন্তত এই সময় তোমাদের ত্যাগ করে যেতে পারি না আমি। তবে কপালে যা আছে, তা ঘটবে—নোৎসহেয়ং পরিত্যক্তং দৈবং হি বলবত্তরম্।
দ্রোণাচার্য কর্ণের কথাটা একভাবে ফিরিয়েই দিলেন। কর্ণ বলেছিলেন যে, দ্রোণের মতো মন্ত্রীরা শত্রুর হিত চিন্তা করেন এবং তাতে লজ্জাও পান না। দ্রোণ বললেন—বাস্তব সেটাই। পাণ্ডবরা যেভাবে পাশায় হেরে বনে গেছেন তাতে তাঁদের ন্যায়বুদ্ধিতে বারো বছর বনে কাটালেও ফিরে এসে তাঁরা প্রতিশোধ নেবেনই—বৈরং নির্যাতয়িষ্যন্তি মহদ্দুঃখায় পাণ্ডবাঃ। দ্রোণ এবার আরও একটি কঠোর বাস্তব স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন কৌরবদের। তিনি বুঝেছেন—যতই কৌরবরা তাঁদের রাজ্যের ভালমন্দ তাঁর ওপরে ন্যস্ত করুন, রাজনৈতিকভাবে তাঁর সমস্যা রয়েই গেছে। দ্রোণ বলেছেন—আমিও তো মহারাজ দ্রুপদকে একসময় রাজ্যচ্যুত করেছি—ময়া চ ভ্ৰংশিতো রাজ্যাদ্ দ্রুপদঃ সখিবিগ্রহে। সেই অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য সে ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং দ্রৌপদীকে লাভ করেছে। মনে রেখো—ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবদের শ্যালক এবং পাণ্ডবদের সঙ্গে তার প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ আছে। ঠিক এইখানেই আমার ভয়—পাণ্ডবানাং প্রিয়তরস্তস্মান্মে ভয়মাবিশৎ। দ্রোণ বলতে চাইলেন যেন—দুটি একাকার ঘটনা ঘটেছে। এক, কৃষ্ণা দ্রৌপদীর অপমান। তিনি পাণ্ডবদের প্রিয়া পত্নী। তাঁরই কারণে পাণ্ডবরাও রাজ্যভ্রষ্ট এবং বনবাসী। দুই, দ্রুপদকে অপমান করেছেন স্বয়ং দ্রোণ এবং সেই কারণে তিনিও রাজ্যভ্রষ্ট। দুটি রাজ্যচ্যুতির কারণ এখানে একাকার হয়ে গেছে এবং তাতে কৌরবদেরও রেহাই নেই, দ্রোণেরও রেহাই নেই। দ্রোণ বলেছেন—পার্ষত দ্রুপদ সর্বান্তঃকরণে পাণ্ডবদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন—গতো হি পক্ষতাং তেষাং পার্ষতঃ পরবীরহা—ওদিকে পাণ্ডব অর্জুনও যুবক পুরুষ। যুদ্ধে অনেক রথী মহারথী তার কাছে হার মানবে। যুদ্ধে প্রাণের বিনিময়েও যদি তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, তবে তার চাইতে দুঃখের আর কিছু নেই—কিমন্যদ্ দুঃখমধিকং পরমং ভুবি কৌরবাঃ।
পাণ্ডবদের বনবাস এবং অজ্ঞাতবাস শেষ হলে পাণ্ডবরা যেমন রুদ্রমূর্তি ধারণ করে যুদ্ধের জন্য ফিরে আসবেন—এই ভয়ের কথা শোনানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মিত্রশক্তি পাঞ্চাল এবং কৃষ্ণপক্ষীয় বৃষ্ণিবীরদের যৌথ আক্রমণের কথাও ঘোষণা করেছেন দ্রোণ। এঁদের সকলের মিলিত আক্রমণ কৌরবরা সহ্য করতে পারবেন না—এই ব্যক্তিগত বিশ্বাস পরিষ্কার জানিয়ে একই সঙ্গে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতিটুকুও স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমাদের এই যুদ্ধবিগ্রহ আমার মোটেই পছন্দ নয় এবং কৌরবদের থেকে পাণ্ডবদের আমি অনেক বেশি শক্তিমান মনে করি—কুরুভ্যো হি সদা মন্যে পাণ্ডবান্ বলবত্তরান্। তা ছাড়া দুর্যোধন! এখনও সময় আছে। আমার কথা শুনে যেটা উপযুক্ত মনে হয়, করো। এমনকী পাণ্ডবদের সঙ্গে দুটো মৃদুমধুর কথা বলে এখনও তাদের ফিরিয়ে আনা যায়—সাম বা পাণ্ডবেয়েষু প্রযুঙ্ক্ষ্ব যদি মনসে।
দ্রোণাচার্য যেভাবে সমস্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা বর্ণনা করেছেন, তাতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু ভয় পেয়েছেন। একবার তিনি বিদুরকে বলেছেন যে, গুরু দ্রোণ ঠিকই বলেছেন। বিদুর তুমি পাণ্ডবদের ফিরিয়েই নিয়ে এসো—সম্যগাহ গুরুঃ ক্ষত্তরুপাবর্তয় পাণ্ডবান্। ধৃতরাষ্ট্রের এই মানসিকতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ দুর্যোধন কৰ্ণরা সাময়িকভাবে যতই দ্রোণাচার্যের পায়ে পড়ুন, পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনার মতো মহৎপ্রাণ তাঁরা ছিলেন না। অন্যদিকে পাণ্ডবদের বারো বচ্ছরের দীর্ঘ বনবাসকাল যত বৈচিত্র্যেই কাটুক, এই সময়টাতেই কিন্তু পাণ্ডব কৌরব দু পক্ষেই ভবিষ্যৎ যুদ্ধভাবনা সম্বন্ধে নীতি স্থির করছিলেন। দ্রোণাচার্য যেভাবে পাণ্ডবদের প্রশংসা করেও দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধবিগ্রহ করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন,—সেই ভাবটা পাণ্ডবরা নিশ্চয় আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। হয়তো রাজসভায় দ্রৌপদীর অপমানের সময় ভীষ্ম দ্রোণের নিস্তরঙ্গ আচরণ দেখেও তাঁদের ভাবটা অনেকটা বোঝা গিয়েছিল। বোঝা গিয়েছিল যে, এঁরা পাণ্ডবদের হিতকামী হলেও শুধুমাত্র কর্তব্যের তাড়নায় এঁরা কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করবেন। কিন্তু দ্রোণের মতো অস্ত্রগুরু শুধু কর্তব্যের বুদ্ধিতে কৌরবদের হয়ে যুদ্ধ করলেও সে ভার যে পাণ্ডবদের ওপর যথেষ্ট গুরুতর হয়ে দাঁড়াবে, সেটা আর কেউ না বুঝলেও পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির যথেষ্টই বুঝেছিলেন।
এই কারণেই দ্রৌপদী এবং ভীম যখন পর পর যুধিষ্ঠিরকে তাঁর কোমল স্বভাব এবং অপ্রতিহিংস স্বভাবের জন্য ভৎসনা করেছিলেন, তখন যুধিষ্ঠিরের মতো শান্ত স্বভাবের মানুষও বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। দ্রৌপদী এবং ভীমের বক্তব্য ছিল—কৌরবরা যখন শঠতা আচরণ করেছেন, তখন সেখানে বনবাসের সত্যরক্ষার কোনও প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ শঠে শাঠ্যং এই নীতিতে অবিলম্বে কৌরব রাজ্য আক্রমণ করা উচিত বলে তাঁরা রায় দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির এইখানে কৌরবদের রাজনৈতিক শক্তির রহস্যটুকু সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন ভীম এবং দ্রৌপদীকে। যুধিষ্ঠির কৌরব-পক্ষপাতী অন্যান্য রাজা এবং বীরদের অস্ত্ৰক্ষমতা বর্ণনা করার পর বলেছিলেন—ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপ—এঁরা যদিও আমাদের প্রতি এবং কৌরবদের প্রতি সম-ভাব পোষণ করেন, তবু এঁরা যেহেতু কৌরবকুলের প্রতি অন্নঋণে ঋণী, তাই ঋণ-পরিশোধের জন্যই তাঁরা কৌরবদের হয়ে যুদ্ধ করবেন—অবশ্যং রাজপিণ্ডৈস্তৈ র্নিবেশ্য ইতি মে মতিঃ। প্রাণ গেলেও এঁরা কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করবেন এবং এঁরা এতটাই যুদ্ধনিপুণ যে, দেবতারাও এঁদের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে ওঠেন না—অজেয়াশ্চেতি মে বুদ্ধিরপি দেবৈঃ সবাসবৈঃ।
দ্রোণাচার্যের কর্তব্যবোধ অথবা তাঁর নৈতিকতার নিরিখে যুধিষ্ঠির তাঁর মতো করে যা ভেবেছিলেন, তা হয়তো ভুল নয়। কিন্তু ভীষ্মের মতো দ্রোণাচার্যেরও এতটাই মমতা ছিল পাণ্ডবদের ওপর, বিশেষত অর্জুনের ওপর যে, ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনরা দ্রোণের সেই ভাবটাই বেশি বিশ্বাস করতেন। তাঁরা বলতেন—বুড়ো বলেই হোক অথব আচার্য স্থানে আছেন বলেই হোক, যুদ্ধের ব্যাপারে দ্রোণাচার্যের যেন তেমন মনোযোগ নেই—প্রমাদী চ আচাৰ্যঃ স্থবিরো গুরুঃ। কী করেই বা থাকবে? এককালে আচার্যের দিন কেটেছে কৃচ্ছ্রতার মধ্য দিয়ে। তাঁর প্রিয়তম শিষ্য আজ বনবাসের কৃচ্ছ্রতায় দিনাতিপাত করছে—আচার্য কীভাবে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে মন দেবেন। তা ছাড়া আচার্য এতদিনে কৌরবদের সম্পূর্ণ চক্রান্ত বুঝে গেছেন। পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে সব সময় ওঠা-বসা করে বৃদ্ধ আচার্য পাণ্ডবদের স্নেহ করেন একই মমতায়। কী করে তিনি দুর্যোধন অথবা কর্ণ শকুনির পক্ষে কথা বলবেন?
পাণ্ডবদের বনবাসের সময় কেটে গেছে। শেষ হয়ে আসছে অজ্ঞাতবাসের কালও। কৌরব-শাসকদের চরেরা শত চেষ্টা করেও পাণ্ডবদের অজ্ঞাত অবস্থান নির্ণয় করতে পারেনি। কর্ণ দুর্যোধনকে আরও দক্ষতর চর পাঠাতে বললেন যারা সমস্ত জায়গা একেবারে চষে ফেলবে। দুঃশাসন কর্ণের কথা সমর্থন করেও খুব সন্দেহ প্রকাশ করলেন যে, পাণ্ডবরা মারা গেছেন। হয় তাঁরা বাঘের পেটে গেছেন, নয়তো বিপন্ন হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। কুরুসভার বৃদ্ধ সভাসদেরা এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন। কিন্তু দুর্যোধন কর্ণ দুঃশাসনদের বহুতর যুক্তি-প্রতিযুক্তি শুনে দ্রোণাচার্য আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। দ্রোণ বললেন—অত সহজে ভেবো না, বাপু! পাণ্ডবরা যেমন প্রকৃতির মানুষ তাতে হঠাৎ করে মরে যাবার পাত্রও তাঁরা নন, আর সত্যভ্রষ্ট হয়ে জীবনযুদ্ধে হেরে যাবার পাত্রও তাঁরা নন—ন তাদৃশা বিনশ্যন্তি নাপি যান্তি পরাভবম্।
দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের শৌর্যবীর্য এবং বিদ্যাবুদ্ধির প্রশংসাই শুধু করলেন না, বিশেষ করে যুধিষ্ঠির এবং অন্যন্য পাণ্ডবদের জিতেন্দ্রিয়তা এবং সত্যনিষ্ঠার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বললেন—পাণ্ডবরা তাঁদের ভাল সময়ের অপেক্ষা করছেন—তস্মাদ্ যত্নাৎ প্রতীক্ষন্তে কালস্যোদয়মাগতম্। দ্রোণাচার্য নিজের দৃঢ় বিশ্বাসে দুর্যোধন এবং তাঁর অনুগামীদের সাধু পরামর্শ দিয়ে বললেন—তোমাদের যা করা উচিত, তা হল—যথেষ্ট দেরি হয়ে গেলেও ভাবনাচিন্তা করে তাঁদের প্রাপ্য রাজ্য ছেড়ে দাও—বাসশ্চৈষাং প্রচিন্ত্যতাম। দ্রোণাচার্য কর্ণ দুঃশাসনের সোৎসাহ যুক্তিতে জল ঢেলে দিয়ে বললেন—চরই যখন পাঠাচ্ছ, তখন ব্রাহ্মণদের পাঠাও, নয়তো পাণ্ডবদের যারা প্রাণে-মনে চেনে তাদের পাঠাও। দ্রোণাচার্যের ভাব বুঝতে অসুবিধে হয় না। ব্রাহ্মণদের দূত করে পাঠানোর অর্থই হল শান্তির ভাবনা, সসম্মানে পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনার ভাবনা। দ্রোণাচার্য বার বার তাই বলছেন এবং তাঁর বক্তব্য শেষ হবার পর তাঁকে সোচ্চারে সাধুবাদ দিয়ে ভীষ্ম সর্বাত্মক সমর্থন জানালেন দ্রোণাচার্যকে—যথৈষ ব্রাহ্মণঃ প্রাহ…ন মে’স্ত্যত্র বিচারণা।
কুরুসভার হাওয়াটা হঠাৎই ঘুরে গেল। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসে বিরাট রাজ্যের সেনাপতি কীচক মারা গেলে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মার বুদ্ধিতে কৌরব বিরাটরাজার গোধন হরণ করার জন্য যুদ্ধযাত্রা করলেন। এই যুদ্ধে অন্যান্য কুরুবৃদ্ধদের সঙ্গে দ্রোণাচার্যও শামিল হয়েছিলেন। খুব যে উৎসাহ নিয়ে দ্রোণাচার্য এখানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, তা নয়। কিন্তু কৌরবরা যেখানে যাচ্ছেন, সেখানে যাওয়াটা ওই অন্নঋণ শোধের মতোই কোনও যুক্তিতে ভীষ্ম কৃপের সঙ্গে দ্রোণাচার্যও সপুত্ৰক গেছেন। বিরাট রাজ্যে যুদ্ধযাত্রার ব্যাপারটা যথেষ্টই সহজ ব্যাপার ছিল, কিন্তু বিরাটরাজার গোধন হরণের পর সম্পূর্ণ ঘটনাটাই বেশ জটিল হয়ে উঠল।
কৌরবরা প্রায় বিনা বাধায় বিরাটের গোশালা থেকে শত শত গোরু ধরে নিয়ে চললেন। অনেকগুলি গোরু রথের বেড় দিয়ে ঘিরে নিয়ে তাঁরা নগরপ্রান্তের বিশাল প্রান্তরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগলেন। ভাবটা এই—আসুক না কেউ। একেবারে তার যুদ্ধভিলাষ জীবনের মতো শান্ত করে দেব। আপনারা জানেন—পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের কাল তখন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এবং সে হিসেবটা অর্জুনের বেশ ভালই জানা ছিল। অতএব তিনি নির্দ্বিধায় কুমার উত্তরকে রথের সারথি করে যুদ্ধে এসেছেন বৃহন্নলার বেশেই। বিশাল যুদ্ধপ্রান্তরের প্রান্তিক ভূমি থেকে বৃহন্নলাবেশী অর্জুন গাণ্ডীবে টঙ্কার দিলেন, যুদ্ধের ঘোষণা করলেন জলদগম্ভীর শঙ্খধ্বনি করে। গাণ্ডীবের টংকার এবং শঙ্খনিনাদ একত্রে মিশ্রিত হয়ে কুরুবীরদের কর্ণ বিদারিত করল।
প্রথম কথা বললেন দ্রোণাচার্য। সাপের হাসি বেদেয় চেনে—এই নিয়মেই যেন পুত্ৰাধিক প্রিয়তম শিষ্যের উপস্থিতি অনুমান করলেন। প্রতিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া দূরে থাক, দ্ৰোণ হেঁকেডেকে সবাইকে বলতে লাগলেন—দেখো বাপু! রথের আওয়াজ যেমনটি শুনছি, যেমন মেঘ ডাকছে আকাশে, পৃথিবী যেমন কম্পিত হচ্ছে, তাতে এ সব্যসাচী অর্জুন ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না—নৈষো’ন্যঃ সব্যসাচিনঃ। অর্জুনের উপস্থিতি দ্রোণাচার্য প্রকাশ করলেন হাজারো দুর্লক্ষণ আর দুনির্মিত্তের মাধ্যমে। দ্রোণ যা বললেন তার অর্থ দাঁড়ায়—শত্রুর রথনির্ঘোষ শুনে কোথায় ঝনঝন্ ঝলসে উঠবে অস্ত্রশস্ত্র, টগবগ করে ছুটে যাবে অশ্বকুল। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র যেন ভোঁতা হয়ে গেছে, মিইয়ে গেছে ঘোড়াগুলি—শস্ত্রাণি ন প্রকাশন্তে ন প্রহৃষ্যন্তি বাজিনঃ।
রথের ধ্বজায় কাক, শকুনের গতায়াত, উল্কা পতন—আরও সব পৌরাণিক দুর্লক্ষণের কথা উচ্চারণ করে দ্রোণাচার্য বললেন—আমার ভাল ঠেকছে না বাপু—তন্ন শোভনম্—সব কিছুই যেন কেমন ভয়ের জানান দিচ্ছে—বেদয়ন্তি মহদ্ভয়ম্। আসলে অর্জুনের রথশব্দ এবং ধনুষ্টংকার শুনে কৌরবপক্ষের সেনারাও প্রমাদ গণছিল। তারা যেন যুদ্ধে হেরেই বসে আছে—পরাভূতা চ নঃ সেনা ন কশ্চিদ্ যোদ্ধুমিচ্ছতি—এমন ভাব দেখেই দ্রোণ এত দুর্লক্ষণের কথা বলেছেন, এবং আরও বলেছেন অর্জুন এসে গেছেন ভেবে। দ্রোণাচার্য ভেবেছিলেন—দুর্যোধন-কর্ণদের সুমতি হবে। তারা অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ না করে সন্ধির পথ ধরবে। কিন্তু অহংকারী মানুষের হৃদয় বোঝেন না বৃদ্ধ, ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে কুরুদের রাজবাড়িতে যে অন্তঃসভার সৃষ্টি হয়েছিল দুর্যোধন দুঃশাসন, কর্ণ আর শকুনিকে নিয়ে, তাঁদের ওপর বৃদ্ধদের মতামত চলে না। দুর্যোধন এতটাই দুর্বিনীত যে, তিনি নিজে অপমান না করে অন্য প্রশ্রিত জনকে দিয়ে দ্রোণ-ভীষ্মের অপমান ঘটান। এখানেও তাই হল।
দ্রোণাচার্যের মুখে অর্জুনের কথা শুনেই দুর্যোধন পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের তিথি-নক্ষত্র হিসেব করতে আরম্ভ করলেন। বার বার বলতে লাগলেন—আবার বনবাসে যেতে হবে পাণ্ডবদের। অন্যদিকে যুদ্ধের ভয়টাও তো কম নয়। অতএব অর্জুন যদি এসেই থাকেন তা হলে যুদ্ধ জেতার জন্য দুর্যোধন ‘রেড অ্যালার্ট’ দিলেন ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা এবং বিকর্ণের প্রতি। লক্ষণীয়, এঁরা কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করতে এলেও মনে মনে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী। বিশেষত দ্রোণাচার্য যেভাবে, যে মর্যাদায় অর্জুনের আগমন ঘোষণা করেছেন, তাতে অর্জুনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী কর্ণের গা জ্বলে গেল। তিনি প্রধানত দ্রোণাচার্যকে উদ্দেশ করে দুর্যোধনকে বললেন—যা করবে করো, কিন্তু এই আচার্য দ্রোণকে সেনাপতির মুখ্য কর্ম থেকে মুক্ত করে পিছনে ঠেলে দাও আগে—আচার্য্যং পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা তথা নীতি বিধীয়তাম্। তুমি তো এঁদের ভাবনাচিন্তা জান। শত্রুদের সম্বন্ধে এঁরা মর্যাদা পোষণ করেন বলেই আমাদের ভয় দেখাচ্ছেন এইভাবে।
কর্ণ একেবারে গোড়া থেকে আরম্ভ করে বললেন—অর্জুনের ওপর এই দ্রোণাচার্যের সরসতা অত্যন্ত বেশি আর সেই জন্যই অর্জুনের কথা ভেবেই ইনি তাঁর প্রশংসা করে যাচ্ছেন। অর্জুনের ঘোড়ার ডাক শুনেই যেখানে দ্রোণাচার্যের সব গুলিয়ে যাচ্ছে—হ্ৰেষিতং হ্যুপশৃম্বানে দ্রোণে সর্বং বিঘট্টিতম্—সেখানে আমাদের সৈন্যরা যুদ্ধ করবে কী? তারা তো সেনাপতির অবস্থা দেখেই ভয়ে পালাবে। এই আচার্যের কাছে পাণ্ডবদের মতো ভাল কেউ নেই—ইষ্টা হি পাণ্ডবা নিত্যমাচাৰ্য্যস্য বিশেষতঃ—সেই জন্য এত তাঁদের প্রশংসা। আর আমরা সবাই এঁর কাছে খারাপ, নইলে ঘোড়ার ডাক শুনতে পেলেই কি কেউ এমন প্রশংসা আরম্ভ করতে পারে—অশ্বানাং হ্ৰেষিতং শ্রুত্বা কঃ প্রশংসাপরো ভবেৎ।
কর্ণের জিহ্বা আরও শাণিত হল। যুদ্ধের মুখে হঠাৎই দ্রোণাচার্য অর্জুনের প্রশংসা করে ফেলায় কর্ণ বিরাট সুযোগ পেয়েছেন দ্রোণকে অপমান করার। কর্ণ বললেন—এসব বামুন-পণ্ডিত আচার্যরা বড় দয়ালু, বড় প্রাজ্ঞ হতে পারেন, তবে যুদ্ধের মতো ভয়ের সময় এঁদের কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। রাজসভায় বক্তৃতা দিতে দাও, বাগানবাড়িতে গুষ্টিসুখের সময় বড় বড় কথা বলতে দাও, দেখবে এই বামুন-পণ্ডিতদের কেমন মানায়—কথা বিচিত্রা কুর্বাণাঃ পণ্ডিতস্তত্র শোভনাঃ। এঁদের মানানসই জায়গা আরও আছে। যজ্ঞের সময় কোনটায় জলের ছিটে মারতে হবে, কোনটা ধুয়ে নিতে হবে, কোন যাজ্ঞিক কোথায় ভুল করল—এসব ব্যাপারে এই দ্রোণাচার্যের মতো লোকেরা হলেন সবচেয়ে ওস্তাদ—পরেষাং বিবরজ্ঞানে মনুষ্যচরিতেষু চ। পুরাতন পুষে রাখা রাগ অনেকটা গালাগালিতে মিটিয়ে নিয়ে কর্ণ শেষ প্রস্তাব দিলেন—এইসব পরগুণগর্বিত বামুন-পণ্ডিতদের পিছনের দিকে রেখে, যাতে আমরা ঠিকঠাক যুদ্ধ করতে পারি, বিরাটরাজার গোরুগুলিকে ধরে রাখতে পারি, সেই কথা ভাবো, দুর্যোধন।
শুধুমাত্র বক্তব্য নিবেদন এবং পরামর্শের মধ্যেও কর্ণ দ্রোণাচার্যের যত নিন্দা করলেন, ততটাও বুঝি সওয়া যেত, কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হল কর্ণের আত্মশ্লাঘা। এমনভাবে তিনি নিজের ক্ষমতা এবং অস্ত্রবিদ্যার কথা সাহংকারে ঘোষণা করতে আরম্ভ করলেন যাতে মনে হল—ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য—এইসব অস্ত্রবীরদের কোনও প্রয়োজনই নেই এবং তিনি একাই অর্জুনকে মেরে এক্ষুনি বন্ধু দুর্যোধনকে নিরঙ্কুশ যুদ্ধ জয়ের স্বাদ বিতরণ করবেন। দ্রোণের প্রতি যথেচ্ছ গালাগালির সঙ্গে এই আত্মশ্লাঘার ফল ভাল হল না। বৃদ্ধ দ্রোণাচার্য একটাও কথা বললেন না বটে, কিন্তু তাঁর শ্যালক কৃপাচার্য এবার দ্রোণের হয়ে মুখ খুললেন। অর্জুনের একক ক্ষমতা প্রদর্শনের বিভিন্ন উদাহরণ স্মরণ করিয়ে দিয়ে কর্ণকে বললেন—তুমি একটা অন্তত দৃষ্টান্ত দাও যেখানে একা কোনও ক্ষমতা দেখিয়েছ। কৃপাচার্যের দেখাদেখি দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাও কর্ণকে একহাত নিলেন। কৃপ তবু বলেছিলেন—অর্জুনের সঙ্গে সবাই মিলেই যুদ্ধ করব আমরা, কিন্তু কর্ণের মুখে পিতার নিন্দা শুনে অশ্বত্থামা কর্ণকে বললেন—অর্জুনের গাণ্ডীব থেকে পাশাখেলার গুটি বেরোয় না, কর্ণ! বেরোয় প্রাণান্তক শররাশি। ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় মাতুল শকুনির বুদ্ধিতে যেমন যুদ্ধ করেছিলে তুমি, সেইরকম যুদ্ধ করতে চাইলে, বেশ তো তুমি শকুনিকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করো, আমি যুদ্ধ করব না—নাহং যোৎস্যে ধনঞ্জয়ম্।
ভীষ্ম দেখলেন—অর্জুনের রথ আগতপ্রায়। তিনি কৌরবদের রাজমর্যাদার কথা ভাবলেন। এই যুদ্ধ হারা মানে বিরাটরাজার মতো ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে যাওয়া। তিনি দ্রোণাচার্য অশ্বত্থামা এবং কৃপাচার্যকে যথোচিত মর্যাদা দিয়ে ক্ষমা করতে বললেন। বিশেষত যুদ্ধ এবং অস্ত্ৰক্ষমতার ক্ষেত্রে জামদগ্ন্য পরশুরামের পরে দ্রোণাচার্যের মতো ব্যক্তিত্ব যে আর নেই—সে কথা খুব জোর দিয়েই প্রতিষ্ঠা করলেন ভীষ্ম—জামদগ্ন্যাদৃতে রাজন্ কো দ্রোণাদধিকো ভবেৎ। ভীষ্মের ইঙ্গিত পেয়ে দুর্যোধনও ক্ষমা চাইলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। তিনি বুঝেছিলেন যে, আসন্ন যুদ্ধের সময় তাঁর সেনাপক্ষের একটি প্রধান গোষ্ঠী যদি নিরুদ্যম হয়ে থাকে তবে বিপদ বাড়বে। বিশেষত এমন ঘটনা আছেই, যেখানে দ্রোণ ভীষ্ম কৃপ ছিলেন না, অথচ কর্ণ ছিলেন, কিন্তু তিনি একা যুদ্ধজয় করে দুর্যোধনের গৌরব বাড়াতে পারেননি। দুর্যোধন অতএব খুব করে ক্ষমা চাইলেন দ্রোণের কাছে। এমনকী শেষ পর্যন্ত কর্ণও ক্ষমা চাইলেন তাঁর কাছে। হাজার হলেও দ্রোণ ব্রাহ্মণ এবং এতদিনের অভিজ্ঞতায় তিনি ‘সময়’ ব্যাপারটাও যথেষ্ট বোঝেন। কিন্তু ক্ষমার কথা স্পষ্ট উচ্চারণ করেও তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিলেন যে, দুর্যোধন বা কর্ণের কথায় তিনি এই ক্ষমা করছেন না। করছেন ভীষ্মের কথায়। ভীষ্ম বলেছিলেন যে, এখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার সময় নয়—নায়ং কালঃ স্বভেদনে—সেই প্রথম কথাটা মনে রেখেই আমি সমস্ত ক্ষমা করে দিয়েছি—যদেতৎ প্রথমং বাক্যং ভীষ্মঃ শান্তনবো’ব্রবীৎ।
ক্ষমা হল, শান্তি হল, ভীষ্ম সমস্ত কৌরবসেনা ভাগে ভাগে রেখে মাঝখানে রাখলেন দ্রোণাচার্যকে এবং সামনে রাখলেন কর্ণকে। কর্ণ অনেক দর্প করেছিলেন বলেই তাঁর এই অগ্রস্থিতি নির্দিষ্ট হল হয়তো। ওদিকে শঙ্খ বাজিয়ে, গাণ্ডীবের শব্দ তুলে অর্জুন এসে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কতকাল পরে গুরুশিষ্যের দেখা হল সংগ্রামের মুখে। যে কোনও যুদ্ধ লাগলেই অর্জুনের মনে পড়ে দ্রোণাচার্যের কথা। কত যত্নে, কত পরিশ্রমে তিনি এই শিষ্যটিকে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন। অর্জুন এই কৃতজ্ঞতা কখনও ভোলেন না। অন্যদিকে দ্রোণও ভাবছেন—এই সেই অর্জুন। সেই বালক বয়স থেকে কী অসাধারণ অভ্যাস এবং প্রতিভায় আজ সে পাশুপত অস্ত্রের অধিকারী। অর্জুনের প্রতি স্নেহে আচার্যের সব অন্যথা স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়। এতক্ষণ যে কথার জন্য তিনি কর্ণের কাছে এত গালাগালি খেলেন, অর্জুনের রথ স্পষ্ট দেখতে পেয়ে আত্মবিস্মৃত আচার্য আবার সেই একই কথা বলে উঠলেন—আরে এই তো, দূর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই তো অর্জুনের রথ। সেই গাণ্ডীবের টংকার, সেই পুরাতন রথঘর্ঘর, সেই পুরাতন রথচিহ্ন, কপিধ্বজ রথ—এষ ঘোষঃ স রথজো রোরবীতি বানরঃ।
দ্রোণাচার্যের মুখে সেই পুরাতন কথা সপ্রশংসায় উচ্চারিত হতে হতেই দুটি তীক্ষ্ণ বাণ দ্রোণের চরণের কাছে এসে ভূমিচ্ছেদ করল। আরও দুটি বাণ আচার্যের কানের পাশ দিয়ে শন্ শন্ করে বেরিয়ে গেল। দ্রোণ সোচ্ছ্বাসে চেঁচিয়ে উঠলেন—আমার পায়ের কাছে যে শর দুখানি, এ হল অর্জুনের গুরুপ্রণাম—অভিবাদয়তে পার্থঃ। আর ওই যে দুটি কর্ণস্পর্শী বাণ শন্ শন্ করে চলে গেল, ওইদুটির মাধ্যমে অর্জুন আমার কুশলসংবাদ জিজ্ঞাসা করল—শোত্রে চ পরিপৃচ্ছতি। অর্জুন আরও বলতে চাইছে—বনবাসে তারা অনেক কষ্ট করেছে এবং সেই বনবাসের কাল তাদের শেষ হয়েছে। দ্রোণাচার্য বড় খুশি হলেন। তাঁর চোখেমুখে, সমস্ত শরীরে সেই খুশির উদ্ভাস দেখা গেল। বার বার বললেন—বহুকাল পরে আমরা এই অর্জুনকে দেখলাম। বড় ভালবাসে আমাদের সবাইকে—চিরদৃষ্টো’য়মস্মাভিঃ প্রজ্ঞাবান্ বান্ধবপ্রিয়ঃ।
দ্রোণের মুখে সেই চিরায়ত প্রশংসার কোনও প্রতিক্রিয়া আপাতত হয়নি। কারণ যুদ্ধ একেবারেই আসন্ন ছিল। তা ছাড়া অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে এসেই প্রথমে দুর্যোধন এবং কর্ণকে তাড়া করেছিলেন এবং তাঁরা কোনওরকমে পালিয়ে বেঁচেছেন। অর্জুন এবার কৌরব পক্ষের মূল বাহিনীর সামনে এসে পড়েছেন। অবশ্য এতক্ষণে দুর্যোধন কৰ্ণরা আবারও এসে যোগ দিয়েছেন মূল বাহিনীর সঙ্গে। অর্জুনের ব্যাপারে আচার্য দ্রোণের যেমন উচ্ছাস দেখেছি, আচার্য সম্বন্ধেও ঠিক তেমনই উচ্ছ্বাস আছে অর্জুনের মনেও। বিরাটতনয় উত্তরকে কৌরবদের বীর-পরিচয় করিয়ে দেবার সময় সসম্ভ্রমে দ্রোণের কথা উচ্চারণ করে অর্জুন বলেছেন—ওই যে রথটি দেখছ, যাঁর রথের ধ্বজায় সোনার কমণ্ডলু বসানো, ইনিই হলেন আচার্য দ্রোণ—ধ্বজে কমণ্ডলুর্যস্য শাতকৌম্ভময়ঃ শুভঃ। কুমার উত্তর! তুমি এই রথকে প্রদক্ষিণ করো। সমস্ত অস্ত্রবীরদের মধ্যে ইনি আমার সবচেয়ে মান্য।
সেকালের দিনে এমনটিই রীতি ছিল। মান্য ব্যক্তিকে শত্রুপক্ষে দেখলাম, আর আঘাত হানলাম, এমন অসভ্যতা সেকালে চলত না। এ ছাড়া প্রিয়ত্বের সম্বন্ধযুক্ত এই গুরুশিষ্যের মধ্যে যুদ্ধে একটি পূর্বঘোষিত শর্তও ছিল। শর্ত ছিল—অর্জুন কোনওভাবেই দ্রোণের প্রতি প্রথম অস্ত্র নিক্ষেপ করবেন না—এখনকার ভাষায় ‘নো ফার্স্ট স্ট্রাইক’ আর কী। টীকাকার নীলকণ্ঠ বলেছেন অর্জুনের দিক থেকে প্রথম এই অপ্রহারের মানে হল গুরুর প্রতি সম্মান প্রদর্শন। অর্জুন নিজের মুখে বলেছেন—যদি দ্রোণ প্রথম আমার শরীরে অস্ত্রাঘাত করেন এবং তার পরে যদি আমি তাঁকে অস্ত্রাঘাত করি, তা হলে আর দ্রোণাচার্যের রাগ হবে না—ততো’স্য প্রহরিষ্যামি নাস্য কোপো ভবেদিতি।
প্রাথমিকভাবে আচার্যের সঙ্গে বাণের মাধ্যমেই অভিবাদন সম্ভাষণের পর কৌরব বাহিনীর একেক সেনাপতির সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। প্রথমেই অবশ্য দ্রোণ নন, তার আগে অর্জুনের সঙ্গে কৃপাচার্যের যুদ্ধ হয়ে গেছে। দুর্যোধন, কর্ণ এবং কৃপাচার্যের অক্ষমতা প্রকট হয়ে যাবার পর সেনাবাহিনীর মধ্যভাগের রক্ষক দ্রোণের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হল। এই প্রথম যুদ্ধ! গুরুশিষ্য কোনও দিন মুখোমুখি যুদ্ধ করেননি এর আগে। এই তাঁদের প্রথম ‘এনকাউন্টার’। অর্জুন দ্বিতীয়বার উচ্ছ্বসিত হয়ে কুমার উত্তরের কাছে দ্রোণের কথা বলেছেন এবং এই আলাপচারিতার মধ্যেই আমরা প্রথম দ্রোণের চেহারা, তাঁর ছোট ছোট পছন্দ অপছন্দ, তাঁর আপাতকঠিন বীর স্বভাবের পিছনে তাঁর স্নেহ—সবকিছুই যেন একটু একটু করে চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
মহাভারতের কবি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রচনা লিখতে বসেননি। মহাকবি বলেই তিনি দ্রোণের আকৃতি-প্রকৃতি বা পছন্দ-অপছন্দের কথা প্রথম দিকে উচ্চারণই করেননি। তিনি এগুলো অতি সংক্ষেপে অর্জুনের মুখ দিয়ে প্রকাশ করছেন। তাও কখন? যুদ্ধক্ষেত্রে যখন গুরুশিষ্য মুখোমুখি। পঞ্চাল রাজ্যের অর্ধভাগী রাজার পরিচয় দ্রোণের পরিচয় নয়। ঋষি ভরদ্বাজের ক্ষণিক অস্থিরতায় জাত এক ব্রাহ্মণের পরিচয়ও দ্রোণের পরিচয় নয়। তাঁর আসল পরিচয় তিনি গুরু, আচার্য এবং সব থেকে বড় পরিচয় তিনি অর্জুনের মতো সর্বজয়ী শিষ্যের গুরু। তাই যে মর্যাদা এবং যে প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে এক জননী তাঁর পুত্রের আকৃতি-প্রকৃতি, পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে মাথা ঘামান, ঠিক সেই মর্যাদায়, সেই প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে এবং সেই ব্যাপ্তিতে অর্জুন দ্রোণের কথা বলেছেন।
অর্জুন বলেছেন—রথের ওপরে তাঁর সোনার যজ্ঞবেদি বাঁধানো, তাতে সোনার কমণ্ডলু। অর্থাৎ ক্ষত্রিয়োচিত কর্ম করলেও দ্রোণ নিজেকে ব্রাহ্মণ ভাবতেই ভালবাসেন। দ্রোণ বোঝাতে চান—তাঁর দারিদ্র্য, তাঁর অস্ত্রনিপুণতা এবং অবশ্যই তাঁর উচ্চাশাই যে শুধু তাঁকে ব্রাহ্মণ থাকতে দেয়নি, তা নয়। এগুলি নিয়েই তিনি ব্রাহ্মণ থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমাজ তাঁর প্রতি অনুকূল হয়নি। ধ্বজ মানে চিহ্ন। দ্রোণ তাই ব্রাহ্মণের চিহ্নটুকু রেখে দিয়েছেন মাথার ওপর, রথের গায়ে চিহ্ন এঁকে। ধ্বজের নীচেই ক্ষত্রিয় মূর্তি ক্ষত্রিয়ের কর্মকারী দ্রোণাচার্য, ব্রাহ্মণত্বের চিহ্নমাত্র বহনকারী আপাদমস্তক এক প্রতিবাদী বীরপুরুষ দ্রোণাচার্য।
দ্রোণের রথে যে ঘোড়াগুলি যোতা আছে তাদের রং কোমল লাল, চকচক করছে তেজে বিশাল ঘোড়াগুলির গা—অশ্বাঃ শোনা প্রকাশন্তে বৃহন্তশ্চারুবাহিনঃ। ক্ষুদ্র স্নিগ্ধ বট অশ্বত্থ নিমের কচি পাতাটি যেমন স্নিগ্ধ লাল দ্রোণের ঘোড়াগুলির রঙও সেইরকম লাল। তাদের মুখগুলি আবার তামাটে—স্নিগ্ধ বিদ্রুমসঙ্কাশা-স্তাম্ৰাস্যাঃ প্রিয়দর্শনাঃ। এত যে ঘোড়ার বর্ণনা, তার কারণ আছে। ক্ষত্রিয়ের গুণ হল রজোগুণ। লাল রং রজোগুণের প্রতীক। এই রজোগুণই দ্রোণের জীবন বহন করে নিয়ে চলেছে, রজোগুণই তাঁকে চালায়। দ্রোণ নিজে কেমন? দীর্ঘবাহুর্মহাতেজাঃ বলরূপসমন্বিতঃ। এই একটি বাক্যই যথেষ্ট। তাঁর চেহারার মধ্যে শক্তিমত্তার ছাপ যতটুকু আছে ততটুকুই তাঁর রূপ, তার সঙ্গে আছে দীর্ঘ বাহুর সুলক্ষণ, অর্থাৎ রীতিমতো পুরুষালি চেহারা। রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিতে তিনি শুক্রাচার্য এবং বৃহস্পতির সমান। অর্থাৎ ‘ডিপ্লোমেসি’র প্রশ্নে দ্রোণ ‘রিজিড’ নন। রামায়ণে দেখব—অসুর রাবণ অসুরগুরু শুক্রাচার্যের নীতিতে সেনাব্যূহ সাজাচ্ছেন আর দেবত্বের প্রতীক রামচন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির মতানুযায়ী সেনাব্যূহ নির্মাণ করছেন। এঁরা নিজের নিজের জায়গায় ‘রিজিড’। মহাভারতের কবি সেনাব্যূহের মতো সাধারণ কথা বলছেন না। বলছেন—বুদ্ধিতে অর্থাৎ ‘ডিপ্লোমেসি’র ক্ষেত্রে তিনি শুক্রাচার্যের মতো—বুদ্ধ্যা হি উশনসা তুল্যঃ। আর রাজনৈতিক জ্ঞানগরিমার ক্ষেত্রে দ্রোণ বৃহস্পতির মতো প্রাজ্ঞ—বৃহস্পতিসমো নয়ে।
সত্যি কথা বলতে কী, ‘ডিপ্লোমেসি’ এবং রাজনীতি—এ দুটোই ভাল না জানলে কৌরব রাজ্যে বাস করে তাঁদের চিরায়ত শত্রুতার সুযোগ নিয়ে দ্রুপদের ওপর নিজের প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করা এবং শত্রু তৈরি করার পরও সেই রাজ্যেই সসম্মানে মন্ত্রী হিসেবে বাস করা দ্রোণের পক্ষে সম্ভব হত না। অর্জুন বলছেন—দ্রোণ বেদবিদ্যা এবং ব্রহ্মবিদ্যার রহস্য যেমন জানেন, তেমনই জানেন অস্ত্রবিদ্যা, দৈবমানুষ—সব রকমের অস্ত্রবিদ্যা। জীবনচর্যার মধ্যে গুণ এবং কর্মের এই দ্বৈরথ-সাধনের মধ্যেও দ্রোণের মূল চরিত্রের মধ্যে যে তাঁর জন্মমূল ব্রাহ্মণ্যের গুণটুকুই বেশি প্রকট, সেটি আর কারও চোখে না পড়ুক, কিন্তু অর্জুনের চোখে ঠিক পড়েছে। অর্জুন দ্রোণের শেষ পরিচয়-সারাংশে যা ব্যক্ত করেছেন, তা হল—ক্ষমা, নিজের উদ্ধত অজিতেন্দ্রিয়তা দমন করবার ক্ষমতা, সত্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা, অনৃশংসতা, ঋজুসরল স্বভাব—এইরকম যত গুণ একটি আদর্শ ব্রাহ্মণের মধ্যে থাকা উচিত, তা সবই দ্রোণের মধ্যে আছে—এতে চান্যে চ বহবো যস্মিন্ নিত্যং দ্বিজে গুণাঃ।
এই গুণের পরীক্ষা আমরা পেয়েছি। কর্ণ যেভাবে তাঁকে অপমান করেছিলেন, তার উত্তরে দ্রোণ একটা কথাও বলেননি। পরেও এরকম অপমানের সময় আরও আসবে এবং দ্ৰোণকে আমরা ক্ষমা করে দিতে দেখব। নিজে অমন ক্রূর ক্ষত্রিয় কর্ম করেন বলেই দ্রোণকে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় সম্বোধন করলে বড় খুশি হতেন তিনি। মহামতি ভীষ্ম বোধ হয় তাঁর এই দুর্বলতাটুকু জানতেন আর জানতেন বলেই যখন তখন দ্রোণকে সমর্থন করার সময় তিনি বলতেন—যথৈতৎ ব্রাহ্মণঃ প্রাহ—এই ব্রাহ্মণ যেমন বলেছেন। আর দ্রোণ সবচেয়ে নিন্দিত বোধ করতেন তখনই, যখন কেউ তাঁকে বলত—যেমন কর্ণই তাঁকে বহুবার বলেছেন—বামুন হয়েও যাঁদের ক্ষত্রিয়কর্ম করতে লজ্জা হয় না—তখন অপমানে, রাগে, লজ্জায় দ্রোণের মুখ লাল হয়ে উঠত। এটাও নেতিবাচকতায় তাঁর দুর্বলতারই জায়গা। হায়! কর্ণের সুতপুত্রতার গালাগালিতে যাঁরা দুঃখিত, বিগলিত হন, তাঁরা কর্ণের এই গালাগালিকে কেমন উপভোগ করেন!
ক্ষত্রিয়কর্মা পুরুষের ব্রাহ্মণ্যের প্রতি এই দুর্বলতার কথা অর্জুন বড় সহৃদয়তার সঙ্গে বুঝেছেন বলেই দ্রোণের স্থান অর্জুনের কাছে অনেক উঁচুতে। অর্জুন তাঁর ব্রাহ্মণের গুণটুকুও বোঝেন এবং অগত্যা ক্ষত্রিয়কর্মটুকুও বোঝেন বলেই তিনি দ্রোণাচার্যের পুত্ৰাধিক প্রিয় শিষ্য। যাই হোক, সেই গুরুর সঙ্গে সেই শিষ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা হল এই প্রথম। রক্তাশ্ববাহন দ্রোণের রথের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল শ্বেতাশ্ববাহন অর্জুনের রথ। অর্জুন সানুনয়ে দ্রোণকে বললেন—অনেককাল বনবাসের কষ্ট সয়েছি, গুরুদেব। এবার আমাদের প্রতিশোধ নেবার সুযোগ দিন। আপনি রাগ করবেন না আমার ওপর—উষিতাঃ স্ম বনে বাসং প্রতিকর্মচিকীর্ষবঃ। তবে হ্যাঁ আচার্য! আপনি প্রথম প্রহার করবেন, তবে আমি। সেইরকমই কথা আছে—ইতি মে বৰ্ততে বুদ্ধিস্তদ্ ভবান্ কর্তুমর্হসি।
অর্জুনের কথা শোনার পরেই দ্রোণাচার্য বাণবর্ষণ করলেন অর্জুনের ওপর। এক মুহূর্তে সে সমস্ত বাণ কেটে ফেললেন অর্জুন। গুরুশিষ্যের মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হল, তা যেমন ভয়ানক, তেমনই বিচিত্র। মহাভারতের কবি তাঁর অমানুষী ভাষা এবং ছন্দে এই যুদ্ধের যে বর্ণনা করেছেন, আমার ভাষায় তার নাগাল পাওয়া ভার। শুধু এইটুকু জানাই—অর্জুনের বয়স কম এবং অস্ত্রমোক্ষণের শীঘ্রতাও তাঁর অনেক বেশি। তার ওপরে ব্যক্তিগত অপমানে এবং তেরো বচ্ছরের কৃচ্ছ্রসাধনে তিনি আতপ্ত হয়ে আছেন। কর্ণ-কৃপরা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করে ভঙ্গ দিয়েছেন। এইরকম অর্জুনের সঙ্গে বহুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর যুদ্ধপ্রেক্ষকেরা শুধু বলেছিলেন যে, প্রশংসা যদি করতে হয় তো দ্রোণেরই করো—দ্রোণস্তত্র প্রশংসতাম্। কেননা অর্জুনের সঙ্গে তিনি এতক্ষণ লড়াই চালিয়েছেন—দুষ্করং কৃতবান্ দ্রোণো যদর্জুনমযোধয়ৎ।
যে কোনও ক্ষেত্রেই ন্যায়সঙ্গতভাবে পুত্রের কাছে হেরে গেলে পিতার আনন্দ হয়, শিষ্যের কাছে হেরে গেলে গুরুর আনন্দ। কৃতী ছাত্র-শিষ্যকে অন্যেরা প্রশংসা করলে গুরু সগর্বে বলেন—আমার ছাত্র বটে। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের বহু বিচিত্র রণকৌশল দেখে দ্রোণ কেবলই বিস্ময়ে আকুলিত হচ্ছিলেন—পার্থস্য সমরে দৃষ্ট্বা দ্রোণস্যাভূচ্চ বিস্ময়ঃ। কেবলই ভাবছিলেন—এই সেই বালক, যাকে অস্ত্রশিক্ষা দেবার সময়েই তিনি মহান সম্ভাবনা দেখেছিলেন। কিন্তু আজ! অভ্যাস এবং পরিশ্রমে তাঁর এই শিষ্যটি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে একটি বাণ ছাড়ার পর সেই বাণের পশ্চাদ্গত দ্বিতীয় বাণের মধ্যে হাওয়াটুকুও ঢুকতে পারছে না যেন—ন চ বাণান্তরেপস্য বায়ুঃ শক্লোতি সর্পিতুম্।
অর্জুনের শররাশি একসময় দ্রোণের কমণ্ডলুবাহী রথের চারপাশ ঘিরে ফেলল। দ্রোণ তাঁর শিষ্যের অবিরাম বাণবৃষ্টি আর রোধ করতে পারছেন না। দ্রোণের অবস্থা দেখে সমস্ত সাধারণ সৈন্যেরা হাহাকার করে উঠল—হাহাকারো মহানাসীৎ সৈন্যানাং ভরতৰ্ষভ। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা দূর থেকে পিতার করুণ অবস্থা দেখতে পেয়েছেন। অর্জুনের অস্ত্রমোক্ষণের ক্ষমতা দেখে একদিকে তিনি তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য হলেন মনে মনে। অন্যদিকে দ্রোণের অবস্থা দেখে তাঁর রাগও হল। অশ্বত্থামা দ্রোণের সামনে এসে দাঁড়ালেন অর্জুনকে নতুনভাবে প্রতিরোধ করার জন্য। দ্রোণ এবার একটু সম্মান নিয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ পেলেন। তাঁর শরীরের বর্ম ছিন্ন হয়ে পড়ে গেছে। রথোপরি যজ্ঞবেদী-কমণ্ডলুর ব্রাহ্ম ধ্বজখানি কর্তিত হয়ে পড়েছে মাটিতে। কোনওরকমে শীঘ্রগামী অশ্বের সহায়তায় দ্রোণ পালিয়ে যাবার সুযোগ পেলেন—ছিন্নবর্মধ্বজঃ শূরো… ব্যপায়াজ্জবনৈ র্হয়ৈঃ। শিষ্যের কাছে হেরে দ্ৰোণ পালিয়ে গেলেন বটে, কিন্তু তাঁর হৃদয় ভরে গেল প্রিয়তম শিষ্যের নিপুণ অস্ত্রশক্তি দর্শন করে। সমস্ত কৌরববাহিনীর মধ্যে অর্জুনের মাহাত্ম্য কীর্তন করে তিনি যে কোনও ভুল করেননি, সে ব্যাপারে একটা দৃঢ়তাও কাজ করল তাঁর মনে।
বিরাটরাজার গোধন হরণ করে কৌরববাহিনীর সঙ্গে পাণ্ডব অর্জুনের যে মহাযুদ্ধ হয়ে গেল, সেটা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে একটা মহড়ামাত্র ছিল না, এই যুদ্ধের একটা ইঙ্গিত ছিল, একটা ‘মেসেজ’ ছিল। কৌরব-বাহিনীতে যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হিসেবে ভীষ্ম এবং দ্ৰোণ নিজেরা যথেষ্ট বড় যোদ্ধা বলেই বুঝেছিলেন যে, অর্জুন-ভীমের মিলিত আক্রমণ যদি কৃষ্ণের বুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে তাঁদের পরাজিত করা মোটেই সহজ হবে না। কৌরববাহিনীর মুখ্য পুরুষেরা বিরাট রাজার বাড়ি থেকে যে শিক্ষা পেয়ে এসেছিলেন, সেই শিক্ষার কথা অন্য কারও মনে না থাকলেও দ্রোণ-ভীষ্মের তা মনে ছিল এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবার বাস্তববোধও তাঁদের ছিল। অতএব ধৃতরাষ্ট্রের দূতিয়ালি করতে গিয়ে ভীম-অর্জুন-যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে যে সন্দেশ বয়ে আনলেন সঞ্জয়, তাতে প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পিতামহ ভীষ্ম।
কৃষ্ণ এবং অর্জুনের মাহাত্ম্য ভীষ্ম ব্যক্ত করেছেন অলৌকিকতার ঐশ্বর্যে। প্রতিতুলনায় কৌরববাহিনীর মধ্যে সবসময়ই যিনি পাণ্ডবদের মৌখিক আড়ম্বরে উৎখাত করে ছাড়ছেন, সেই কর্ণকে খানিকটা হীন প্রতিপন্ন করে ধৃতরাষ্ট্রকে বাস্তব বোঝাতে চেষ্টা করলেন ভীষ্ম। কর্ণ স্বভাবসিদ্ধভাবেই এইসব পাণ্ডব-প্রশংসার কঠিন প্রতিবাদ করলেন এবং ভীষ্মের কাছে তিনি তার জবাবও পেলেন। দ্রোণাচার্য কিন্তু এইসব তুলনা-প্রতিতুলনার মধ্যে গেলেন না। অর্জুন বা কৃষ্ণের অলৌকিক কোনও মহিমাও তিনি স্থাপন করলেন না। কর্ণকেও তিনি গ্রহণ করলেন না। শুধু ভীষ্ম যে পাণ্ডবদের প্রাপ্য মিটিয়ে দেবার কথা বলেছিলেন, সেই জায়গায় তাঁকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে যুদ্ধের চাইতে সন্ধিই যে কৌরবদের উপযোগী ব্যবহার হবে, সেটা বুঝিয়ে দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। এক্ষেত্রে কোনও অলৌকিকতার আখ্যান অথবা কোনও অতিমানুষ ভাবনায় অর্জুনের কথা বলেননি দ্রোণাচার্য। কিন্তু তিনি তাঁর শিষ্যটিকে চেনেন। সঞ্জয়ের মাধ্যমে অর্জুন যেভাবে কৌরবদের ভীতি প্রদর্শন করেছিলেন, সেগুলি যে ফাঁকা আওয়াজমাত্র নয়, কর্ণের মৌখিকতার বিপরীতে অর্জুন যে তাঁর বাক্য কার্যে পরিণত করবেন—এই দৃঢ় বিশ্বাসের কথা দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন দুটিমাত্র কথায়। তিনি বললেন—অর্জুনের মতো ধনুর্ধর পুরুষ এই জগতে দুটি পাওয়া যাবে না—ন হ্যস্য ত্রিষু লোকেষু সদৃশো’স্তি ধনুর্ধরঃ।
সঞ্জয়ের কাছে সব কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্র যে দ্রোণের কথা হৃদয়ঙ্গম করেননি, তা নয়। কিন্তু অন্ধ পুত্রস্নেহ এবং দুর্যোধন কর্ণের বাগাড়ম্বর তাঁকে সত্য এবং বাস্তব বুঝতে দেয়নি। দুর্যোধনকে বোঝাতে চেয়েও তিনি পারেননি। আর শুধু ধৃতরাষ্ট্র কেন, দ্রোণ তাঁর মন্ত্রিত্বের মর্যাদা থেকে এবং ভীষ্ম তাঁর পিতামহের মর্যাদা থেকে দুর্যোধনকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন। যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব শুরু হয়ে গেল। এখন দ্রোণ বড় অসহায় বোধ করেন। একদিন ব্যক্তিগত জীবনের স্বার্থ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার জন্য তিনি কুরুবাড়িতে এসে উঠেছিলেন। তাঁর জীবনের দুঃখ এবং অপমানের বৃত্তান্ত শুনে ভীষ্মই তাঁকে প্রথম নিযুক্ত করেছিলেন কুমারদের শিক্ষার কাজে। সেই কুমারেরা আজ বড় হয়ে নিজেদের মধ্যেই শত্রুতা আরম্ভ করেছে। বড় অসহায় বোধ করেন দ্রোণ। ব্যক্তিজীবনের চরিতার্থতা অনেককাল আগেই তাঁর হয়ে গেছে। কিন্তু সেই থেকে কুরুবাড়িতে বাস করতে করতে কুরুদের সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দের সঙ্গে তিনি এমনভাবেই জড়িয়ে গেছেন যে, এখান থেকে যাবার কথা তাঁর আর মনেও হয়নি।
কিন্তু সেই পাণ্ডবদের বনে যাবার কাল থেকে ঘটনাপ্রবাহ এমনভাবেই চলছে যে, তাঁর অন্যত্র চলে যাওয়াটা সৌজন্যের খাতিরেই আর সম্ভব হয়নি। এতকাল তিনি কুরুবাড়িতে থেকেছেন, এখন হঠাৎ কোনও অজুহাতে চলে যেতে চাইলেও একটা প্রশ্ন উঠবে যে, ভবিষ্যতে পাণ্ডবদের সম্ভাব্য সম্মিলিত আক্রমণের কথা প্রায় নিশ্চিত জেনেও তিনি এই সময়ে কুরুদের ছেড়ে চলে গেলেন। তা ছাড়া কৃতজ্ঞতার ব্যাপারও তো একটা আছে। তিনি যখন ব্যক্তিগত স্বার্থে পাঞ্চাল দ্রুপদকে শিষ্যদের মাধ্যমে বেঁধে এনে অপমান করেছিলেন, সেদিন তো কুরুবাড়ির শাসককুল একবারও তাঁকে দোষ দিয়ে বলেনি যে, দ্রোণের জন্যই পাঞ্চালদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা হল।
দ্রোণ জানেন—পাণ্ডবরা ভবিষ্যতে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলে তাঁদের মিত্রশক্তির অন্যতম প্রধান হিসেবে দ্রুপদ অবশ্যই যুদ্ধ করতে আসবেন। কিন্তু কুরুদের ঘরে বাস করে যে দ্রুপদকে তিনি নিজের কারণে কুরুদের শত্রুতে পরিণত করেছেন, এখন তাদের বিপদকালে কুরুদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন, এমন অকৃতজ্ঞ তিনি নন। তিনি কুরুদের সঙ্গে আছেন, থাকবেনও। তাঁর সমস্যাটাই আলাদা। মহামতি ভীষ্মের কাছে কুরুকুলের ইতিহাস তিনি সমস্ত শুনেছেন, তিনি নিজেও ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনদের সঙ্গে কম দিন জড়িয়ে নেই। কিন্তু সব শুনে, সব বুঝে নিজের সত্য দৃষ্টিতেই তিনি বুঝতে পারেন যে, পাণ্ডবদের প্রতি অবিচার চলছে অনেক দিন ধরে। এই অবিচারের অবসান তিনি চান। বিশেষত পাণ্ডব অর্জুন, তাঁর প্রিয়তম শিষ্য পাণ্ডব অর্জুন তাঁর প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁরই সঙ্গে যুদ্ধ করবেন—এমনটি তিনি সইবেন কী করে!
তবু জানেন তিনি, সইতেই হবে। কৌরব-পাণ্ডবের এক পিতামহ ভীষ্মকে যেমন সইতে হচ্ছে, তেমনই কৌরব-পাণ্ডবের এক আচার্য দ্রোণকেও তেমনই সহ্য করতে হবে। ভীষ্ম এবং দ্রোণের সমস্যা প্রায় সমান। দুজনে কথাও বলেন প্রায় একসঙ্গে, হয় আগে, নয় পরে। দুজনের কথার মিলও হয় যথেষ্ট। সামান্য সংকোচ যেটুকু কাঁটার মতো মাঝে মাঝে বেঁধে, সেটা হল—ভীষ্ম কুরুবাড়িতে রক্তের সম্বন্ধে পরম আত্মীয়, কিন্তু তিনি এখানে বহিরাগত। শিক্ষক এবং আচার্যের সম্বন্ধে তিনি কুরুবাড়িতে যথেষ্ট সম্মানিত বটে, তবু কুরুবাড়ির আধুনিক কর্তাদের সঙ্গে তাঁর যখন মতবিরোধ ঘটে, তখন এই বহিরাগতের সত্তা একভাবে তাঁর মনের মধ্যে ক্রিয়া করতে থাকে। তিনি তখন সত্যিই বড় অসহায় বোধ করতে থাকেন।
কৃষ্ণ যখন কুরুসভায় আসলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্তিম প্রয়াস নিয়ে সেখানে অন্যদের সঙ্গে মন্ত্রী হিসেবে দ্রোণও উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণের চেষ্টা যখন ব্যর্থ হওয়ার মুখে তখন ভীষ্ম কঠিন ভাষায় দুর্যোধনকে শান্তির প্রস্তাব মেনে নিতে বলেন। ভীষ্ম বলার পরেই দ্রোণাচার্য ওঠেন কথা বলতে। এখানে কুরুবাড়ির আত্মীয় না হয়েও তিনি পরম যত্নে কুরুবাড়ির মর্যাদাময় ইতিহাসের কথা শুনিয়েছেন দুর্যোধনকে। তৎকালীন নিয়মবিধি অনুযায়ী পাণ্ডবদের রাজ্য পাওয়াটা যে যথেষ্টই ন্যায়সঙ্গত—একথা বলতে তাঁর এতটুকু সংকোচ হয়নি। কুরুবাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয় হারানোর ভয় অথবা দুর্যোধনের পক্ষপাতী কর্ণ-শকুনিদের তিরস্কারের ভয়ে সত্য কথা বলতে ভয় পাননি দ্রোণাচার্য।
দ্রোণাচার্য বলেছেন—এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশের সুস্থিতির প্রয়োজনে মহারাজ শান্তনু যা করেছেন, মহামতি ভীষ্ম যা করেছেন, পাণ্ডবদের পিতা পাণ্ডুও তাই করেছেন। পাণ্ডু বনে চলে যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র রাজা হয়েছেন বটে, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক, বিদুর এবং ভীষ্মের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছাড়া ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে এই কুরু রাজ্যের শাসন চালানো সম্ভবপর ছিল না। দ্রোণ ধৃতরাষ্ট্রের অন্ধত্বের কথা স্পষ্টতই বলছেন না, তা বলা তাঁর শোভা পায় না; কিন্তু কুরুমুখ্য দুই ব্যক্তি, ভীষ্ম এবং বিদুরের অবদান ছাড়া ভরতবংশের অস্তিত্ব অকল্পনীয় বলেই তাঁদের কথাই যে দুর্যোধনের শোনা উচিত, সেটা দ্রোণাচার্য খুব ভাল করেই বুঝিয়ে দিলেন। দ্রোণ বললেন—ধৃতরাষ্ট্র রাজা হয়েছিলেন বটে, কিন্তু এই বৃহৎ কুরু রাজ্যের আয়-ব্যয় এবং কোশ-সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি সামলেছেন বিদুর। রাজশাসনের অন্যান্য বিভাগীয় কর্মে যে সমস্ত রাজভৃত্যরা নিযুক্ত আছেন, তাঁদেরও পরিচালনার ভার ছিল বিদুরের ওপরেই—কোশসংবননে দানে ভৃত্যানাঞ্চান্ববেক্ষণে। অন্যদিকে এই রাজ্যের পররাষ্ট্র বিষয়ক সমস্ত কাজকর্ম—সন্ধি-বিগ্রহ ইত্যাদি—এই সমস্ত বিষয় দেখাশোনা করতেন ভীষ্ম—সন্ধিবিগ্রহসংযুক্তো রাজ্ঞং সম্বাহনক্রিয়াঃ। এমন দুটি মহান ব্যক্তিত্বের পরিচালনায় যে কুরুকুল বর্ধিত হয়েছে, সেই বংশে জন্মে দুর্যোধন, তুমি যে কেন এই জ্ঞাতিভেদ ঘটাতে চাইছ, তা আমি বুঝতে পারছি না। তুমি পাণ্ডব ভাইদের সঙ্গে মিলে একসঙ্গে এই কুরু রাজ্য ভোগ করো—সম্ভূয় ভ্রাতৃভিঃ সার্ধং ভুঙ্ক্ষ ভোগান্ জনাধিপ।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সেই বহিরাগত ব্যক্তির অন্তর্গূঢ় যন্ত্রণা দ্রোণাচার্যকে গ্রাস করল। কেউ যদি এখন বলে—কর্ণ অথবা শকুনি, দুর্যোধন অথবা দুঃশাসন—কেউ যদি বলে—ওরে কেরে ব্যাটা তুই। ভরতবংশের ক্ষতিবৃদ্ধি নিয়ে তুই এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেন? তুই কি এই বংশের কেউ যে, শান্তনু, ভীষ্ম অথবা পাণ্ডু ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে তুই এত মাথা ঘামাচ্ছিস। দ্রোণাচার্যের কাছে এর জবাব নেই। কিন্তু এতকাল কুরুবংশের মন্ত্রিত্ব করে, এতকাল এই বংশের ভাল-মন্দের বিষয়ে মন্ত্রণা দিয়ে তিনিও তো বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। তিনি এই কুরুবাড়ি ছেড়ে যেতেও পারবেন না, অথচ ভাইতে-ভাইতে এই শত্রুতাচরণ তাঁর ভালও লাগছে না। বহিরাগত ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও যেখানে শান্তির সমস্ত প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে তিনি চুপ করে থাকেন কী করে? এতকাল এই বংশের বন্ধনে জড়িয়ে আছেন বলেই তিনি সত্য কথা বলবেন। নইলে অকৃতজ্ঞতা হবে আরেকভাবে।
আবাসিক বহিরাগতের সমস্ত যন্ত্রণা হৃদয়ে নিয়েই দ্রোণাচার্য তাই বললেন—দেখো দুর্যোধন! আমি ভয় পেয়ে কিছু বলছি না—ব্রবীম্যহং ন কার্পণ্যাৎ। ভাবটা এই—উচিত কথা বলছি বলে এই কুরুবাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার ভয়েও বলছি না, আবার যুদ্ধ লাগলে কুরুদের হয়ে যুদ্ধে প্রাণ দেবার ভয়েও বলছি না। দ্রোণাচার্য আরও পরিষ্কার করে বললেন—দুর্যোধন! তুমি ভেবো না যে, অর্থের লোভে আমি সত্য-উচ্চারণ থেকে বিরত থাকব। এই বাড়ির রাজকুমারদের অস্ত্র শিক্ষক হিসেবে, আচার্য হিসেবে যে বৃত্তি আমি ভোগ করি সে বৃত্তি দেন ভীষ্ম। অতএব আমি তাঁর খাই, তোমার নয়—ভীষ্মেণ দত্তমশ্নামি ন ত্বয়া রাজসত্তম। আমার জীবনে এমন সময় কখনও আসবে না, যখন কুরুবাড়ির বৃত্তি লাভের জন্য তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। আর এটাও সঙ্গে সঙ্গে মনে রেখো—ভীষ্ম যেখানে যে ভাবনায় ভাবিত, দ্রোণও সেখানে সেই ভাবনাতেই থাকবেন। অতএব ভীষ্ম যা বলেন তাই করো—যতো ভীষ্মস্ততো দ্রোণো যদ্ভীষ্ম-সস্ত্বাহ তৎ কুরু।
আসলে দ্রোণ সেই প্রথম দিনটির কথা ভোলেননি। সেই যেদিন তিনি কুরুবাড়িতে এসে নিজের কষ্টক্লিন্ন জীবনকাহিনী ভীষ্মের কাছে বলে জীবনের প্রথম সমব্যথীর মুখ দেখেছিলেন, তাঁকে তিনি জীবনেও ভোলেননি। মহাভারতের কোথাও স্পষ্টত উচ্চারিত না হলেও বুঝতে পারি—হয়তো ভীষ্মের দাক্ষিণ্য এবং তাঁরই বুদ্ধি-ব্যবহারে দ্রোণাচার্য কুরুসভার অন্যতম মন্ত্রণাদাতা নিযুক্ত হয়েছিলেন। হয়তো বা তাঁরই সবিনয় অনুরোধে দ্রোণ অর্ধেক পঞ্চালের রাজত্বমোহ ত্যাগ করে কুরুবাড়িতেই থেকে গেছেন সারা জীবন। আজকে দ্রোণের কথা থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কুরুবাড়ির অর্বাচীন শাসকদের অভীষ্ট পূরণ করে তাঁর নিজের ভবিষ্যতের জীবিকার পথ প্রশস্ত করার জন্য অন্যায়ভাবে তাঁদের অনুকূল কথা তিনি বলবেন না। রাজবাড়ির কুলবৃদ্ধ পিতামহ হিসেবে ভীষ্ম যে অর্থবৃত্তি লাভ করেন, তা থেকেই তাঁর জীবিকা চলে। সেটা যত সামান্যই হোক, তবু তার মধ্যে সমব্যথা এবং সম্মান আছে বলেই তিনি ভীষ্মের পথেই চলবেন, অন্য কারও নয়।
দ্রোণাচার্য দুর্যোধনের কাছে এটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি যে, কৌরব-পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ভীষ্মের সঙ্গে তাঁর একাত্মতা আছে। তিনি যেমন দু-পক্ষের এক পিতামহ, দ্রোণও তেমনই দুই পক্ষের একই আচার্য, কাজেই সম্বন্ধটা সমান—সমমাচাৰ্য্যকং তাত তব তেষাঞ্চ মে সদা। এইসমস্ত সমতার কথা বলেও পাণ্ডব অর্জুনের প্রতি তাঁর একান্ত পক্ষপাতের কথাও প্রকারান্তরে উল্লেখ করতে ভোলেননি দ্রোণ। অর্জুনের সঙ্গে যে তাঁর আত্মার সম্বন্ধ আছে সেই স্নেহাতিশয্য প্রকট করতে তাঁর দ্বিধা হল না একটুও। দ্রোণ বললেন—আমার অশ্বত্থামা আমার কাছে যেমন, আমার অর্জুনও আমার কাছে তেমনই—অশ্বত্থামা যথা মহ্যং তথা শ্বেতহয়ো মম। যে কুরুবাড়ির তিনি মন্ত্রী, যে বাড়িতে তিনি এতকাল আছেন, সেইখানে দাঁড়িয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলতে পারেন না যে, কুরুদের জয় তিনি চান না, কিন্তু ধর্ম এবং ন্যায়চারিতার অভিধায় তিনি যা বলতে চাইলেন, তার মানে দাঁড়ায়—পাণ্ডবদেরই জয় হবে। তিনি বললেন—বেশি বকবক করে লাভ নেই—ধর্ম যেখানে জয়ও সেখানে—বহুনা কিং প্রলাপেন যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ।
দ্রোণাচার্যের কাছে এ অতি অদ্ভুত এক দ্বৈরথ। তিনি কুরুবাড়ির অন্ন গ্রহণ করেন অথচ এই বাড়ির আধুনিক শাসকদের কাজকর্ম, ব্যবহার তিনি একেবারেই পছন্দ করতে পারছেন না। তিনি মুখে যতই বলুন—আমি ভীষ্মের খাই-পরি, তোদের নয়, কিন্তু মনে মনে তিনি জানেন—রাজপিতামহ হিসেবে স্বয়ং ভীষ্মও বৃত্তিভোগীই বটে, ভীষ্ম রাজা নন। তাঁর ভরণপোষণ, ইচ্ছাপূরণ কুরুবাড়ির মূল রাজকোষ থেকেই। অতএব কোনও সময় ভীষ্মও যেমন বলতে পারেন না যে, তিনি স্বাধীনজীবিক, তেমনই দ্রোণও বলতে পারেন না যে, কুরুবাড়ির অন্নের সঙ্গে তাঁর কোনও সংস্পর্শ নেই। আর ঠিক এই কারণেই দুর্যোধনকে তিনি যতই তিরস্কার করুন, তিনি দুর্যোধনের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবেন না—একথা তাঁর পক্ষে বলা সম্ভবই নয়। যেমন সেটা বলা সম্ভব ছিল না ভীষ্মের পক্ষেও।
সত্যি কথা বলতে কী, দুর্যোধনও বোধহয় দুই বৃদ্ধের ওই দুর্বলতার কথা ভালভাবেই জানতেন। এবং জানতেন কৃষ্ণও। কৃষ্ণের দৌত্যকালে দ্রোণ-ভীষ্ম অনেক তিরস্কার-ভর্ৎসনা করেছেন দুর্যোধনকে। কিন্তু তাঁরা যেহেতু একবারও দুর্যোধনকে এই হুমকি দেননি যে,—আমাদের কথা না শুনলে আমরা কিন্তু তোমার পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করতে পারব না—তাতে একদিকে যেমন দুর্যোধন মনে মনে খুশি হয়েছেন, তেমনই অন্যদিকে দৌত্যকর্মে নিযুক্ত কৃষ্ণ এতে অসুখী হয়েছেন। কৃষ্ণ খুব চেয়েছিলেন যে, কুরুসভার এই দুই ‘ভেটারান্’ একবার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করুন যে, তাঁরা দুর্যোধনের কারণে যুদ্ধ করবেন না, তাতে দুর্যোধনকে দুবার ভাবতে হত অন্তত। দ্রোণ কিংবা ভীষ্ম—শুধু ব্যক্তিমাত্র নন, এঁদের যে কোনও একজনের হুমকির মূল্য অনেক। ভেবে দেখুন—দুর্যোধনের পক্ষে যাঁরা সেনাপতি নিযুক্ত হয়েছেন পরবর্তীকালে, তাঁদের অর্ধেকের বেশি জনকে দুর্যোধন ব্যবহারই করতে পারতেন না, যদি এঁদের যে কোনও একজন সরে দাঁড়াতেন দুর্যোধনের পাশ থেকে। ভীষ্ম যদি সরে দাঁড়াতেন, তা হলে দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা—এঁরা কেউ যেমন যুদ্ধ করতেন না কৌরবপক্ষে, তেমনই দ্রোণ রুখে দাঁড়ালেও কৃপ, অশ্বত্থামা সরে থাকতেন। হয়তো ভীষ্ম নয়, কেননা কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করার আরও যুক্তি আছে তাঁর সপক্ষে।
দুর্যোধনের প্রতি শত তিরস্কার নিক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও দ্রোণ-ভীষ্মের দিক থেকে ওই শেষ হুমকিটি অনুক্ত থাকায় কৃষ্ণ বেশ ক্ষুন্ন হয়েছিলেন। পাণ্ডবদের সামনে তিনি বলেও ফেলেছিলেন—আরে দুর দুর! এক বিদুর ছাড়া দ্রোণ-ভীষ্ম সকলেই ওই দুর্যোধনের পেছন পেছন চলছেন—সর্বে তমনুবর্তন্তে ঋতে বিদুরমচ্যুত। কৃষ্ণ বললেন—কই দ্রোণ-ভীষ্ম কেউ তো আসল কথাটা বললেন না। একবারও তো বললেন না—আমরা তোমার পক্ষে যুদ্ধ করব না—ন চ ভীষ্মো ন চ দ্রোণো যুক্তং তত্রাহতু র্বচঃ। তাই বলছিলাম—আসল জায়গায় ওঁরা সবাই আছেন দুর্যোধনের পেছনে।
দ্রোণাচার্যের মনের কথা অথবা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বোধ কী করে বুঝবেন কৃষ্ণ। যে মানুষটিকে যৌবনাধিক বয়স পর্যন্ত পুত্র পরিবারের গ্রাসাচ্ছাদনের ভাবনা নিয়ে দিন কাটাতে হয়েছে এবং কুরুবাড়ির আশ্রয় লাভ করে যিনি অর্থ, প্রতিপত্তি এবং সম্মানের নিশ্চিন্ত আস্বাদ লাভ করেছেন, তাঁর ভাবনা এবং কৃষ্ণের ভাবনা নিশ্চয়ই এক হবে না। তা ছাড়া এও সেই প্রাচীন মূল্যবোধ, বয়সের ব্যবধানে ব্যবহিত ব্যক্তির কাছে যা আপাতত একেবারেই মূল্যহীন। কৃতজ্ঞতা এবং কৃতজ্ঞতাই হল এমনই এক মূল্যবোধ, যা এক একজন মানুষকে শুধু পূর্বকৃত উপকারের স্মরণ, মনন এবং অনুধ্যানের নাগপাশে বেঁধে রাখে। দ্রোণের মতো মানুষ, যিনি কুরুদের অন্নে প্রতিপালিত, কুরুদের প্রাথমিক সহায়তায় যাঁর ধন, মান, যশ এবং বেঁচে থাকা, তিনি কী করে, কোন মূল্যবোধে বলতে পারেন—না দুর্যোধন! আমি তোমার পক্ষে যুদ্ধ করব না। পরান্নপ্রতিপালিতের এই আন্তর মূল্যবোধ স্বাধীন কৃষ্ণের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, তিনি বোঝেনওনি।
আবার এই মূল্যবোধেরই আরও এক বিচিত্র দংশন দ্রোণাচার্যকে অন্যদিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। শুধুমাত্র পরাশ্রয়ী হওয়ার ঋণ মেটাতে গিয়ে তিনি এক অহংকারী, অসূয়াপরায়ণ, পররাজ্যগ্রাসী ব্যক্তির পক্ষে যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। দ্রোণাচার্য এই বাধ্যতার প্রায়শ্চিত্ত করেছেন অন্যভাবে এবং সেটাও কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের একাত্মতায়। যুদ্ধ যখন নিশ্চিত হয়ে গেল, তখন সকালবেলায় উঠেই এই দুই বৃদ্ধের প্রত্যেক দিনের নিত্যকর্ম ছিল পাণ্ডবদের জয় কামনা করা। হয়তো বোঝাতে চাইতেন যে, কর্তব্যের অনুরোধে প্রতিপক্ষের হয়ে ‘মেকানিক্যালি’ একটা যুদ্ধ করলেও দ্রোণ-ভীষ্মের অন্তর পড়ে আছে পাণ্ডবদের দিকেই।
কথাটা ভীষ্ম তেমন পরিষ্কার করে না বললেও নিজের এই মানসিক দ্বৈরথ এবং যন্ত্রণা সম্পূর্ণ প্রকট করে দিতে দ্রোণাচার্যের বাধেনি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তখন আরম্ভ হয়ে গেছে। ভীষ্মের সেনাপতিত্বে কৌরববাহিনী পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য প্রস্তুত। এই সময় যুধিষ্ঠির গুরুজনের আশীর্বাদ গ্রহণ করার জন্য উপস্থিত হলেন ভীষ্মের কাছে এবং আচার্য দ্রোণের কাছে। আচার্যের মানসিক অবস্থা তখন বলবার নয়। তাঁকে দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করতে হচ্ছে, অথচ যুধিষ্ঠিরের পক্ষ তাঁর অভিপ্রেত। যুধিষ্ঠির যখন ভাইদের সঙ্গে এসে আচার্য দ্রোণকে প্রণাম করে যুদ্ধ করার জন্য তাঁর অনুমতি ভিক্ষা করলেন, দ্রোণ তখন একটু অভিমান করেই বললেন—তুমি এসেছ, ভাল হয়েছে। নইলে অভিশাপ দিতাম তোমাকে—শপেয়ং ত্বাং মহারাজ। এখন আমি সানন্দে অনুমতি দিচ্ছি, তুমি যুদ্ধ করো এবং জয়লাভ করো।
এই কয়েক মুহূর্ত পরে যাঁদের সঙ্গে তিনি প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন, তাঁদের তিনি বললেন—বলো কী চাও আমার কাছে—ব্রুহি ত্বমভিকাঙ্ক্ষিতম্। বুঝতেই পারছ, আমাকে এইভাবেই যুদ্ধ করতে হবে, অতএব এই যুদ্ধে বিরত হওয়ার অনুরোধ ছাড়া আর যা চাও তুমি বলো—এবং গতে মহারাজ যুদ্ধাদন্যৎ কিমিচ্ছসি। দ্রোণকে এইসব মুহূর্তেই বড় অসহায় লাগে। অন্নঋণ পরিশোধের যুক্তি মাথায় নিয়ে তিনি সমস্ত কালের সমস্ত মানুষের জীবিকার্জনের অসহায়তার কথাটি উল্লেখ করেছেন। দ্রোণ বলেছেন—মানুষ অর্থের দাস, কিন্তু অর্থ কারও দাস নয়। আমার কাছে এই ভয়ংকর সত্যটা এতটাই প্রযোজ্য যে, ওই অর্থের দায়েই আমি কৌরবদের কাছে আবদ্ধ আছি—বদ্ধো’স্মি অর্থেন কৌরবৈঃ। তবে জেনে রেখো—কৌরবদের হয়ে যুদ্ধ করলেও আমি সব সময় তোমাদেরই জয় আকাঙ্ক্ষা করি—যোৎস্যে’হং কৌরবস্যার্থে তবাশাস্যো জয়ো ময়া।
অন্যায় কর্মকারী হওয়া সত্ত্বেও সেই দুর্যোধনের পক্ষেই যুদ্ধ করার মধ্যে দ্রোণের যে নিরুপায় অসহায়তা আছে, দ্রোণ নিজেই তার নাম দিয়েছেন ক্লীবত্ব—ব্রবীম্যেতৎ ক্লীববত্ ত্বাম—যে ক্লীবত্ব কাটিয়ে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিলে তিনি পরান্ন-ঋণের দায়ে দায়ী হয়ে থাকবেন চিরকাল। এই দায়টুকু বাদ দিয়ে শুধু যুদ্ধ জয়ের আশীর্বাদ করেই দ্রোণ ক্ষান্ত হননি, যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি তাঁর মৃত্যুর উপায়ও বলে দিয়েছেন। এই উপায় বলার সময় যোদ্ধা হিসেবে তাঁর আত্মসচেতনতা দেখলে আশ্চর্য হতে হবে। দ্রোণ বৃদ্ধ হয়েছেন বটে, কিন্তু চিরকালীন অস্ত্রপরিশীলন তাঁকে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত করেছিল যে, স্বয়ং ভীষ্ম পর্যন্ত বলেছিলেন—অনেকগুলি যুবকের সম্মিলিত অস্ত্ৰক্ষমতার চাইতেও দ্রোণের শক্তি অনেক বেশি—বৃদ্ধো’পি যুবভির্বরঃ।
দ্রোণ নিজের এই ক্ষমতা সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন। অতএব যুধিষ্ঠির যখন জিজ্ঞাসা করলেন যে, কীভাবে তাঁকে জয় করা সম্ভব হবে, তখন দ্ৰোণ পরিষ্কার বলে দিলেন—আমার হাতে যতক্ষণ অস্ত্র আছে, বাপু, ততক্ষণ আমাকে মারা সম্ভব হবে না—ন তে’স্তি বিজয়স্তাবদ্ যাবদ্ যুধ্যাম্যহং রণে। এমন শত্রুও এখনও জন্মায়নি, বাপু! যে রথে দাঁড়িয়ে থাকতেও আমাকে হত্যা করবে। তবে হ্যাঁ, আমি যদি অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করি এবং অচেতন হয়ে যাই, তবেই আমাকে মারা যাবে। আর আমি অস্ত্র ত্যাগ করব তখনই, যখন কোনও ভয়ংকর দুঃসংবাদ শুনব। যার কথা বিশ্বাস করা যায় এমন মানুষ যদি আমাকে কোনও দুঃসংবাদ দেন, তবে নিশ্চয়ই আমি অস্ত্র ত্যাগ করব এবং আমাকে মারাও যাবে তখনই—শস্ত্রং চাহং রণে জহ্যাং শ্রুত্ব তু মহদপ্রিয়ম্।