॥ ৫ ॥
প্রশ্ন জাগে। প্রশ্ন জাগে—এত জায়গা থাকতে হস্তিনাপুরে কেন? হস্তিনাপুর কুরু রাজাদের রাজধানী। কুরুবংশের রাজারা বংশানুক্রমে পাঞ্চালদের শত্রু। আগে আগে এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহও অনেক হয়েছে। কখনও ওঁরা যুদ্ধ জিতেছেন কখনও এঁরা। দ্রোণ যখন কুরু রাজধানীতে আসছেন, তখন পূর্ব রাজা শান্তনু বেঁচে নেই, তাঁর পুত্রেরাও অকালে স্বর্গত। শান্তনু কিংবা তাঁর বাবা প্রতীপের সময় থেকে পাঞ্চালদের সঙ্গে তেমন বড় কোনও যুদ্ধবিগ্রহ হয়নি বটে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা সব সময়েই ছিল। দ্রোণ সেই উত্তেজনার সুযোগটুকু সদ্ব্যবহার করলেন আপন আনুকূল্যের জন্য। দ্বিতীয়ত, ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণে দ্রোণের সংকল্প এখন দৃঢ়! পিতৃপিতামহের বৃত্তি, বিশেষত ব্রাহ্মণের বৃত্তি ত্যাগের পক্ষে পূর্ব পরিচিত পরিবেশ এবং আগের চেনা জায়গাটি কখনই সুবিধের হয় না। ফলে হস্তিনাপুর চলে আসাটা দ্রোণের ভবিষ্যৎ আশাপূরণের পক্ষে তথা নিজের অস্ত্র-সামর্থ্য প্রকাশের পক্ষে বেশি সুবিধেজনক জায়গা ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, নতুন জায়গায় এলে প্রথমে একটা আশ্রয় দরকার হয়। নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে প্রাথমিক অবস্থানের সুযোগ পেলে খানিকটা অবশ্যই গুছিয়ে নেওয়া যায়, হস্তিনাপুরে দ্রোণের সেই সুযোগটাও ভালরকম ছিল। দ্রোণের অনুগতা পত্নী কৃপীর যমজ ভাই কৃপ এখানে থাকেন এবং তিনি পূর্ব রাজা মহারাজ শান্তনুর কৃপাধন্য। সবচেয়ে বড় কথা হল, কৃপ এবং কৃপী পঞ্চাল রাজবংশেই জন্মেছিলেন এবং যে কোনও কারণেই হোক, তিনি পঞ্চালে থাকেন না, হস্তিনাপুরে থাকেন। কুরুদের রাজবাড়িতে তাঁর মর্যাদা এবং সম্মান সুবিদিত। ফলে প্রাথমিকভাবে হস্তিনাপুরে থাকাটাই দ্রোণের পক্ষে সুবিধে।
শুধু আশ্রয় এবং সুবিধেই নয়। সেই বাল্যবয়সে যে তাড়নায় তিনি অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন, যে ভাবনায় এক রাজপুত্রের সঙ্গে মেলামেশা করে রাজকীয় মর্যাদা এবং সুখের প্রত্যাশা করেছিলেন, সেই উচ্চাশা পূরণের সবচেয়ে সুযোগ থাকবে হস্তিনাপুরেই। অন্যদিকে পাঞ্চাল দ্রুপদ তাঁকে যে অপমান করেছেন, তার প্রতিশোধ নিতে হলেও হস্তিনাপুরই ছিল তাঁর আদর্শ বাসস্থান। আপন উচ্চাভিলাষ এবং প্রতিশোধস্পৃহা কার্যকর করার প্রয়াসে দ্রোণ এই প্রথম পদক্ষেপ নিলেন, যেখানে কোনও ভুল নেই।
নিস্তব্ধ আক্রোশে পঞ্চালরাজ্যের প্রান্তবাহিনী গঙ্গানদী পেরিয়ে মহামতি দ্রোণ সপুত্র-পরিবারে হস্তিনাপুরে এসে পৌঁছোলেন শ্যালক কৃপাচার্যের বাড়িতে। ধনুর্বেত্তা আচার্য হিসেবে দ্রোণকে তখন সবাই চেনে। এমনকী তিনি যদি কৃপাচার্যের বাড়িতে না উঠে নিজেই হস্তিনাপুরের কুরুপ্রধানদের কারও সঙ্গে দেখা করে কর্মপ্রার্থী হতেন, তাতেও যে তাঁর খুব অসুবিধে হত, তা নয়। পিতামহ ভীষ্ম দ্রোণকে চিনতেন আগে থেকেই, দ্রোণ তাঁর কাছেও গেলেন না। তিনি বোধ হয় আর প্রার্থী হয়ে কারও কাছে, যেতে চান না। একবার পরশুরামের কাছে, একবার দ্রুপদের কাছে প্রার্থী হয়ে গিয়ে তিনি তাঁর অভীষ্ট লাভ করেননি। যে দারিদ্র্য তাঁকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল, সেই দরিদ্রতার কারণ দেখিয়ে অর্থলাভের জন্য প্রার্থী হওয়াটা আর তাঁর ভাল লাগছিল না। দ্রোণ এবার চলবেন একান্ত আপন পুরুষকারের নির্দেশে। তিনি পুরুষকার প্রদর্শন করবেন এবং সেই পথে কেউ যদি ডেকে নিয়ে যায়, তবেই তিনি সেখানে যাবেন। অর্থাৎ তাঁর শক্তি এবং অস্ত্রকৌশল অন্যেরা যাচনা করুক প্রার্থীর মতো—এইরকম কোনও ভাবনায় তিনি কৃপাচার্যের বাড়িতে অবস্থান আরম্ভ করলেন গোপনে, আত্মপরিচয় আপাতত প্রচ্ছন্ন রেখে—ভারদ্বাজো’বসত্তত্র প্রচ্ছন্নং দ্বিজসত্তমঃ।
প্রচ্ছন্ন থাকলেও দ্রোণ কিন্তু কুরুরাজবাড়িতে প্রবেশের পথ খুঁজছিলেন অত্যন্ত সুকৌশলে। একটা সুবিধে তাঁর আগে থেকেই ছিল। তাঁর শ্যালক কৃপাচার্য পাণ্ডব কৌরবদের অস্ত্রশিক্ষায় নিযুক্ত হয়েছিলেন আগে থেকেই। কুরুবাড়ির প্রপিতামহ মহারাজ শান্তনু কৃপাচার্যকে লালন পালন করেছিলেন এবং এখনকার কুরুবাড়ির প্রধান পুরুষেরা কৃপাচার্যকে সম্মান করেন আচার্যের মর্যাদায়। গাঁয়েগঞ্জের একান্নবর্তী পরিবারের একেকজন শিক্ষিত অলস পুরুষ যেমন বাড়ির ছেলেপিলেদের প্রাথমিক শিক্ষার কাজে নিযুক্ত হতেন, কৃপাচার্যের অবস্থাও তেমনই। তিনি অলস নন বটে, কিন্তু সেই শান্তনুর আমল থেকে কুরুবাড়ির রাজপরিবারে থাকতে থাকতে তাঁর পদমর্যাদা যতই বাড়ুক, অস্ত্রগুরু হিসেবে তিনি এক নম্বরের ছিলেন না, অন্যদিকে কৌরব পাণ্ডবদের প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে আবার তিনি ছিলেন যথেষ্ট। প্রখ্যাত ধনুর্বিদ বীর হওয়ার দরুণ মহামতি ভীষ্ম কৃপাচার্যের অস্ত্র-ক্ষমতাও যেমন জানতেন, তেমনই তাঁর সীমাবদ্ধতার কথাও জানতেন।
যাই হোক, যতদিন কৃপাচার্যের থেকে মহত্তর অস্ত্রগুরু না মেলে, ততদিন অন্তত তাঁর কাছেই কুরুবাড়ির ছেলেদের শিক্ষা হোক, এই কথা ভেবেই ছেলেদের ভার কৃপাচার্যের ওপর ন্যস্ত করেছিলেন ভীষ্ম। কৃপাচার্য তাঁদের যথাবুদ্ধি যথাসাধ্য শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছিলেন, এরইমধ্যে ছেলেরা সকৌতুকে লক্ষ করল যে, তাঁদেরই বয়সি একটি প্রায়-যুবক গৌরবর্ণ ছেলে কৃপাচার্যের বাড়িতে এসে থাকতে আরম্ভ করেছে। ছেলেটি ভারী সুন্দর এবং এই বয়সেই সে অস্ত্রবিদ্যার কৌশল অন্য বালকদের চেয়ে ভাল জানে। ছেলেটি ভারী সুন্দর, যথেষ্ট মিশুকে এবং অসুয়াহীন। সে নিজে যতটুকু অস্ত্রবিদ্যা শিখেছে, সেটুকু সে অন্য ছেলেদের শিখিয়ে দিতে একটুও কুণ্ঠিত হয় না। ফলত এমন ঘটনা মাঝে মাঝেই ঘটতে লাগল যে, কৃপাচার্যের শিক্ষাদান শেষ হয়ে গেছে, তিনি বাড়ি ফিরে এসেছেন, তখন সেই গৌরবর্ণ বালকটি কুরুবাড়ির কয়েকটি উৎসাহী ছেলেকে কৃপাচার্যের আরদ্ধ পাঠ আরও ভাল করে বুঝিয়ে দিতেন, বা অভ্যাস করাতেন। লক্ষণীয়, এই উৎসাহী ছেলেগুলির মধ্যে পাণ্ডব ভাইরাই প্রধানত কৃপাচার্য চলে গেলেও সেই পাঠশালায় থেকে যেতেন এবং এই অবসরেই তাঁদের আরও একটু ভাল করে অস্ত্রপাঠ বুঝিয়ে দিতেন সেই যুবকপ্রায় ছেলেটি, যাঁর আসল পরিচয়—তিনি দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা—ততো’স্য তনূজঃ পার্থান্ কৃপস্যানন্তরং প্রভুঃ। অস্ত্রাণি শিক্ষয়ামাস…।
তখনও অন্যেরা কেউ তাঁর পরিচয় জানে না। পূর্ব পরিকল্পনা মতো কৃপ কিংবা অশ্বত্থামা কেউই দ্রোণের আগমনসংবাদ বা অশ্বত্থামার প্রকৃত পরিচয় পাণ্ডব কৌরব কারও কাছেই প্রকাশ করেননি—নাবুধ্যন্ত চ তং জনাঃ। পাণ্ডব ভাইরা ভাবতেন—কৃপাচার্যের কোনও আত্মীয় এসেছেন বাড়িতে, হয়তো কিছুদিন থাকবেন, হয়তো বা চলেও যাবেন। সত্যি কথা বলতে কী, তাঁদের এ ব্যাপারে খুব একটা কৌতূহলও ছিল না। কিন্তু দ্রোণের দিক থেকে তাঁর সযত্ন পদক্ষেপগুলি লক্ষ করুন। পুত্র অশ্বত্থামা কুরু রাজবাড়ির একাংশের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন, তিনি কিন্তু বাধা দিচ্ছেন না। অন্যদিকে রাজবাড়ির এই ছেলেগুলিকে শিষ্য হিসেবে পেলে তাঁর অর্থলাভ এবং মর্যাদা লাভের যে অফুরান সুযোগ আসবে, সেটা তিনি জানতেন বলেই তিনি একটা উপযুক্ত সময় খুঁজছিলেন, যে সময় তিনি সকলকে হতচকিত করে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে পারেন।
সেই সুযোগ এসেও গেল। পাণ্ডব-কৌরবেরা একদিন খেলতে খেলতে হস্তিনানগরের বাইরে চলে এসেছেন খানিকটা। এখানে খেলবার মতো বিস্তীর্ণ প্রান্তর আছে আর এই হস্তিনাপুর নগরের প্রান্তদেশেই বোধ হয় কৃপাচার্যের আবাসস্থল নির্দিষ্ট হয়েছিল। এখনকার দিনে যেমন ‘বল’ খেলা হয়, সেকালের দিনে তেমন বল ছিল না নিশ্চয়ই; কিন্তু গোলাকার বস্তু নিয়ে বালকদের খেলবার প্রবণতা চিরন্তন কাল ধরে এতটাই ‘ইনস্টিংটিভ্’ যে, বস্ত্রখণ্ড দিয়ে গোলাকার বল তৈরি করে খেলাটা সে যুগেও অসম্ভব ছিল না। আমরা কন্দুকক্রীড়ার নাম শুনেছি, সেটা গুলিখেলাও হতে পারে, বলও হতে পারে। মহাভারতের কবি এই গোলাকার বস্তুটির নাম দিয়েছেন ‘বীটা’ এবং এটাও বলের মতোই কোনও জিনিস। ছোটবেলায় গাঁয়েগঞ্জে বাতাবিলেবু দিয়ে বল খেলে যারা বলাভাব মিটিয়েছে, তারা অবশ্যই বুঝবে যে এই ‘বীটা’ বলের মতোই কোনও জিনিস এবং তা বাতাবিলেবু নাই হোক, কিন্তু বস্ত্রখণ্ডের তৈরি কোনও ‘গুটলি’ হওয়াই সম্ভব।
পাণ্ডব কৌরবরা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে ওই ‘বীটা’ নিয়ে খেলা আরম্ভ করেছিলেন এবং বীটার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের ছোটাছুটিও ভালই চলছিল—ক্রীড়ন্তো বীটয়া তত্র বীরাঃ পর্য্যচরন্ মুদা। হাত কিংবা পায়ের জোরে অথবা অনবধানে সেই খেলার বীটা এক সময় গিয়ে পড়ল একটি অন্ধকূপের মধ্যে। বীর বালকেরা অনেক চেষ্টা করলেন—লাঠির খোঁচা, ঢিল ছোঁড়া—অনেক কিছুই হল বীটা ওপরে তোলার জন্য, কিন্তু শেষপর্যন্ত কোনও উপায়ই তাঁরা বার করতে পারলেন না—ন চ তে প্রত্যপদ্যন্ত কর্ম বীটোপলব্ধয়ে। উৎকণ্ঠিত বালকেরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলেন। বীটা নেই, খেলা বন্ধ, অতএব এদিক ওদিক তাকানো, অপিচ নতুন খেলা আবিষ্কারের আগেই তাদের অনুসন্ধিৎসু চোখ গিয়ে পড়ল একটি বৃদ্ধপ্রায় মানুষের ওপর।
তাঁর গায়ের রং কালো, চাঁছাছোলা মেদবর্জিত শরীর, মাথার চুলে কেবলই কিছু পাক ধরেছে, তাঁর গলার উপবীত এবং সম্মুখের হোমকুণ্ডলী দেখে বালকেরা বুঝলেন—তিনি ব্রাহ্মণ—তে’পশ্যন্ ব্রাহ্মণং শ্যাম আপন্নপলিতং কৃশম্। ব্রাহ্মণের হোমযজ্ঞের প্রতি বালকদের যে খুব আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল, তা বোধ হয় না। তবে হ্যাঁ, খেলার বীটা হারিয়ে গেছে, হাতে অফুরান অবসর, তখন বনের প্রান্তে অগ্নিহোত্র করতে বসা একটি ব্রাহ্মণ দেখলেও বালকদের কৌতূহল হয়। কুরুবাড়ির রাজকুমারেরা ব্রাহ্মণকে ঘিরে তাঁর অগ্নিহোত্রের জোগাড়যন্ত্র দেখতে লাগলেন—ভগ্নোৎসাহ-কৃতাত্মানো ব্রাহ্মণং পর্য্যবারয়ন্।
দ্রোণ খুব স্বচ্ছ মনে আরণ্যক ব্রাহ্মণের তাগিদে এই উম্মুক্ত প্রান্তরের মধ্যে তাঁর নিত্য কর্ম সমাধা করতে এসেছেন, তা আমাদের মনে হয় না। কৃপাচার্যের বাড়িতে বসেই যথেষ্ট নিবিষ্টভাবে তিনি ওই অগ্নিহোত্র সমাধা করতে পারতেন। কাজেই এই যে তিনি বেরিয়ে প্রান্তরের মধ্যে অগ্নিহোত্র করতে বসেছেন, তা নিষ্কারণে নয়। হয়তো কুরুবালকদের ক্রীড়াকৌতুক, উন্মত্ত চিৎকার এবং পরিশেষে কূপগত বীটা উদ্ধারের প্রয়াস তাঁর কানে গিয়ে থাকবে। হয়তো তিনি চেয়েই ছিলেন—কোনও অজুহাতে রাজপুত্রদের সামনে উপস্থিত হতে। এতদিন প্রচ্ছন্নবাসের পর নিজের আত্মপ্রকাশের এই সুবৰ্ণসুযোগ তিনি ছেড়ে দিতে চাননি। অতএব অরণ্য প্রান্তরে এমন জায়গায় তিনি অগ্নিহোত্র করতে বসেছেন, যেখানে ক্রীড়াশীল বালকদের কৌতূহলী দৃষ্টি পড়বেই।
লোকদেখানাো কায়দায়—কী হয়েছে বাছারা সব, বামুনের যাগযজ্ঞের সময় তোমরা গোল করছ কেন—নিশ্চয় এমন কিছু বলতেই রাজপুত্রেরা বলে উঠলেন—এই দেখুন না, আমাদের খেলার বীটা কুয়োয় পড়ে গেছে। আমরা আর খেলতেই পারছি না। অসমাপ্ত খেলায় বালকদের বিষন্ন দেখে—অথ দ্রোণঃ কুমারাংস্তান্ দৃষ্টা কৃত্যবতস্তদা—একটু হেসেই কথা বললেন। হাসলেন এই ভেবে যে, ওই বীটা কুয়ো থেকে তুলে আনাটা তাঁর কাছে কোনও শক্ত কাজই নয়। অন্যদিকে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার এই তো সুযোগ। দ্রোণ বললেন—ধিক তোমাদের শক্তিতে। তোমরা না ক্ষত্রিয়ের জাত! এত বয়স হল, কীরকম অস্ত্রশিক্ষা হয়েছে তোমাদের যে, সুপ্রসিদ্ধ ভরতবংশে জন্মে বুজে যাওয়া কুয়ো থেকে একটা বীটা তুলে আনতে পারছ না—ভরতস্যান্বয়ে জাতা যে বীটাং নাধিগচ্ছত!
কুরুবাড়ির রাজপুত্রেরা ধিক্কার শুনে লজ্জায় মাথা নোয়ালেন। দ্রোণ এবার নিজের অস্ত্রকৌশল সম্পর্কে বালকদের মনে চরম বিস্ময় জাগানোর জন্য প্রথমেই তাঁর হাতের আংটিটি খুলে সেই মজা কুয়োর মধ্যেই ফেলে দিলেন। বালকেরা যখন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন, দ্রোণ তখন বললেন—দেখো, তোমাদের বীটা তো রয়েইছে, তার মধ্যে আমার আংটিটিও ওই কুয়োর মধ্যেই ফেলে দিলাম; এবার দেখো, কীভাবে দুটোই আমি তুলে আনি। যদি আনতে পারি, তবে আমাকে ভালরকম খাওয়াবে তো, বাছারা—উদ্ধরেয়মীষিকাভির্ভোজনং মে প্রদীয়তাম্।
খেলার সূত্রে কুরুবাড়ির ছেলেরা মাঝে মাঝেই এদিকে আসেন। ফলে কৃপাচার্যের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যে ছেলেটি তাঁদের অস্ত্রশিক্ষা দিতে আসেন, সেই অশ্বত্থামাকে যেমন কৃপাচার্যের আত্মীয় ভাবতে তাঁদের অসুবিধে হয় না, তেমনই দ্রোণকেও তাঁরা কৃপের বাড়িতেই দেখে থাকবেন বলে তাঁকেও কৃপের আত্মীয় ভাবতে অসুবিধে হয় না। এই সূত্র ধরেই পাণ্ডব কৌরবদের অগ্রজ যুধিষ্ঠির দ্রোণের কথার জবাব দিয়ে বললেন—কৃপাচার্যের যদি অনুমতি হয়, তবে এই একদিন কেন, আপনি প্রতিদিনই উত্তম ভোজন লাভ করবেন—কৃপস্যানুমতে ব্রহ্মন্ ভিক্ষামাপ্নুহি শাশ্বতীম্।
দ্রোণ হাসলেন। তারপর নলখাগড়ার বন থেকে কতগুলি খাগের তির বানিয়ে বললেন—এবার দেখো এর কেরামতি। এ ক্ষমতা অন্য কারও হবে না—অস্য বীৰ্য্যং নিরীক্ষধ্বং যদন্যস্য ন বিদ্যতে। আমার হাতের এই একমুঠি তিরের মধ্যে শুধু একটা দিয়ে আমি ওই বীটার গুলিকাটিকে বিদ্ধ করব। তারপর সেই তিরের পিছনে আরও একটা তির এবং তার পিছনে আরেকটা—এইভাবে তিরগুলি আমার হাতের নাগালে পৌঁছোলে তোমাদের বীটা আমি ওপরে তুলে আনব—তামন্যয়া সমাযোগে বীটায়া গ্রহণং মম। দ্রোণ যেমনটি বললেন, ঠিক সেইভাবেই বীটা তুলে আনলেন ওপরে। ঘটনা দেখে কুরুবাড়ির রাজপুত্রদের চোখ কপালে উঠল—তদবেক্ষ্য কুমারাস্তে বিস্ময়য়োৎফুল্ললোচনা। তাঁদের খেলার বীটা ওপরে উঠে এসেছে কিন্তু দ্রোণের হাতের আংটিটি তখনও পড়ে রয়েছে কুয়োর মধ্যেই। বালকরা বললেন—এবার আপনার আংটিটিও তুলে আনুন—মুদ্রিকামপি বিপ্রর্ষে শীঘ্রমেতাং সমুদ্ধর।
দ্রোণাচার্য আবারও হাতে তুলে নিলেন ধনুকবাণ। এই শরাসনের সন্ধানই তাঁর দেখানোর প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ এতেই বালকেরা চমকিত হবে এবং সেই চমৎকারই জুটিয়ে দেবে তাঁর বৃত্তি। দ্রোণ এমনভাবেই আংটির গায়ে শরাঘাত করলেন যাতে একের পর এক বাণ-পরম্পরায় বাণবিদ্ধ আংটি উঠে এল ওপরে। দ্রোণ আংটিটি বিস্ময়স্তব্ধ বালকদের হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন যেন কিছুই হয়নি। যেন এমনটি তিনি প্রায়ই করে থাকেন—দদৌ ততঃ কুমারাণাং বিস্মিতানাম্ অবিস্মিতঃ।
খেলার বীটা এবং আংটি তোলার কেরামতি দেখে রাজপুত্রেরা একযোগে দ্রোণকে বলল—আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন, বামুনঠাকুর! এমন ক্ষমতা কারও দেখিনি—অভিবন্দামহে ব্ৰহ্মণ্ নৈতদন্যেষু বিদ্যতে। সত্যি করে বলুন তো আপনি কে? কী আপনার পরিচয়? আর যেভাবে আপনি আমাদের উপকার করলেন, তাতে কীভাবেই আপনার প্রতিদান দেব—বয়ং কিং করবামহে? দ্রোণ দেখলেন এই সুযোগ। তিনি বললেন—বেশি কিছু করতে হবে না। তোমরা মহামতি ভীষ্মের কাছে গিয়ে বলো যে, আমি কী করেছি এবং তাঁর কাছে আমার অস্ত্রকৌশল বর্ণনা করার সঙ্গে সঙ্গে আমার চেহারার বর্ণনাটাও দিয়ো—আচক্ষধ্বঞ্চ ভীষ্ময় রূপেণ চ গুণৈশ্চ মাম্। তারপর আর তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। তিনি যা করার করবেন।
কুরুবাড়ির রাজকুমারেরা দ্রোণের প্রতি কৃতজ্ঞতায় পূর্বে ঘটা সমস্ত কাহিনী এবং তাদের বিস্ময়ের অতিরেকটুকুও সবিস্তারে জানাল। ভীষ্ম বুঝতে পারলেন—দ্রোণ পঞ্চাল ছেড়ে এসেছেন এবং এই মহান অস্ত্রবেত্তাই কুমারদের সবচেয়ে উপযুক্ত অস্ত্রগুরু হতে পারেন—যুক্তরূপঃ স হি গুরুরিত্যেবমনুচিন্ত্য চ। মনে মনে এ কথা ভেবে ভীষ্ম ডেকে পাঠালেন দ্রোণকে। রাজবাড়ির রাজকীয় সৎকারে দ্রোণকে সম্মান করে তাঁর পঞ্চাল ছেড়ে হস্তিনাপুরে আসবার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন—হেতুমাগমনে তত্র দ্রোণঃ সর্বং ন্যবেদয়ৎ—দ্রোণও তখন তাঁর জীবনের সমস্ত ঘটনা আনুপূর্বিকভাবে নিবেদন করলেন ভীষ্মের কাছে। অগ্নিবেশের অস্ত্রাশ্রমে পাঞ্চাল দ্রুপদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের সময় থেকে দ্রুপদের বন্ধুত্ব, তাঁর প্রতিজ্ঞা, দ্রোণের দরিদ্র অবস্থা, পুত্রের জন্ম, অশ্বত্থামার দুগ্ধবোধে পিষ্টরস সেবনে অন্যান্য বালকদের উপহাস, দ্রুপদের কাছে সপুত্র-পরিবারে দ্রোণের গমন, দ্রুপদের চরম অপমান—সবকিছু তিনি একের পর ঘটনা সাজিয়ে ভীষ্মের কাছে বলে গেলেন।
জীবনের দুঃখকষ্টগুলি অসহ্য হয়ে গেলে নিজেকে চরম অসহায় লাগে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই কষ্ট যদি সমব্যথী মানুষকে জানানো যায় এবং সে মানুষ যদি তা ধৈর্য ধরে শুনে প্রথম থেকেই সমব্যথার পরিচয় দিতে থাকেন, তবে তা ক্ষতস্থানে চন্দন লেপনের কাজ করে। দ্রোণের কাছে ভীষ্মের প্রত্যুত্তরটি সেইরকমই হল। দারিদ্র্য পীড়িত দ্রোণের জীবনকাহিনীর শেষে একটা হাহাকার ছিল। দ্রোণ বলেছিলেন, ভীষ্মের কাছে সানুনয়ে বলেছিলেন—আমি এখানে উপযুক্ত অস্ত্র-শিষ্য পাব বলে এসেছি—শিষ্যৈরর্থী গুণান্বিতৈঃ। কুরুবাড়ির রাজকুমারদের কাছে যে অস্ত্রশিক্ষা আপনি আশা করছেন, সে আশা আমি পূরণ করব। আপনার অভিলাষ পূর্ণ হবে। সেই জন্যই আমার হস্তিনাপুরে আসা। এবারে বলুন, আমি কী করতে পারি আপনার জন্য—ব্রহি কিং করবাণি তে। দ্রোণের অত্যাশ্চর্য অস্ত্র ক্ষমতার কথা ভীষ্ম আগে থেকেই জানতেন। কাজেই সেখানে তাঁর কোনও অপছন্দই নেই। অন্যদিকে দ্রোণকে শিক্ষক নিযুক্ত করার রাজনৈতিক তাৎপর্য কী, তাও ভীষ্মের অজানা নয়। পঞ্চাল রাজ্যের সঙ্গে হস্তিনাপুরের চিরন্তন শত্রুতার নিরিখে দ্রোণাচার্যের অস্ত্র শিক্ষা যদি কুরুবাড়ির রাজপুত্রদের পাঞ্চালদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে তোলে তা হলে ভীষ্মই পরিণামে লাভবান হবেন। অতএব ভীষ্ম দ্রোণকে ছাড়বেন কেন?
দ্রোণের করুণ কাহিনী শুনে ভীষ্ম তাঁকে সম্পূর্ণ আশ্বস্ততা দিয়ে বললেন—আপনি এখন নিশ্চিন্তে ধনুকের ছিলাটি আপনার ধনুক থেকে খুলে রাখুন এবং ভাল করে অস্ত্রশিক্ষা দিন এই বাড়ির রাজপুত্রদের—অপজ্যং ক্রিয়তাং চাপং সাধ্বস্ত্রং প্রতিপাদয়। আপনার ভোজন, আবাসনই শুধু নয়, কুরু রাজ্যের সমস্ত ভোগ্য বস্তু আপনার ভোগ্য হবে। কুরুদের এই যে রাজত্ব, ধনসম্পদ এবং রাজ্য—এগুলিতে আপনার অধিকারই শুধু নয়, আপনাকে রাজা বলে সম্মান করব আমরা। আপনি জানবেন—কুরুবাড়ির সকলেই আপনার অনুগত—ত্বমেব পরমো রাজা সর্বে চ কুরবস্তব—আপনি আমাদের হুকুম করবেন।
ভীষ্মের এই বক্তব্যের মধ্যে খানিকটা অতিরঞ্জনের গন্ধ পাওয়া যেতে পারে। বাস্তবে দ্রোণ কুরু রাজ্যের রাজত্ব লাভ করেননি হয়তো, কিন্তু এই আরম্ভ থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত যে সম্মান তিনি পেতে থাকবেন, তা রাজকীয় তো বটেই, একজন রাজার চাইতে তা কমও নয়। হয়তো এই সম্মান ব্রাহ্মণ বলেও খানিকটা, গুরু বলেও খানিকটা, হয়তো বা এ সম্মান খানিকটা পাঞ্চাল দ্রুপদের প্রতিজ্ঞাত সত্যের প্রতিপূরণও বটে—কুরূণামস্তি যদ্বিত্তং রাজ্যঞ্চেদং সরাষ্ট্রকম্—কিন্তু সবকিছু মিলিয়ে দেখতে গেলে সরাসরি রাজা না হয়ে উঠলেও দ্রোণ যেভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন, যে সম্মানের অভিলাষ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, তার অনেকটাই ভীষ্মের বক্তব্যে সুখলভ্য বলে মনে হল—যচ্চ তে প্রার্থিতং ব্রহ্মন্ কৃতং তদিতি চিন্ত্যতাম্। শর্ত ছিল শুধু একটাই—রাজকুমারদের ভাল করে অস্ত্রশিক্ষা দিতে হবে।
ভীষ্ম রাজবাড়ির সমস্ত বালকদের কাছে ডাকলেন। কৌরব এবং পাণ্ডব সকলকে ডেকে তিনি বিধিনিয়ম অনুসারে দ্রোণের হাতে দিয়ে বললেন—এই আপনার শিষ্যকুল। আপনি এঁদের ভার নিন। দ্রোণকে হস্তিনাপুরের রাজবাড়ির বিধিসম্মত আচার্য নিয়োগ করার পরেই দ্রোণ এবার একটু চিন্তিত হলেন। এতদিন তিনি তাঁর শ্যালক কৃপাচার্যের বাড়িতে আশ্রিত ছিলেন, এবং সেই কৃপাচার্যই এতদিন পাণ্ডব কৌরবের অস্ত্রশিক্ষার গুরু ছিলেন। দ্রোণ আচার্য নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃপাচার্যের বৃত্তিলোপের সম্ভাবনা। ভীষ্মের সঙ্গে সমস্ত কথাবার্তা শেষ হয়ে যাবার পর দ্রোণ এখন কৃপাচার্যের কথা ভেবে অস্বস্তি প্রকাশ করছেন। অথচ এই কাজটি করার জন্যই তিনি প্রথম থেকে প্রস্তুত হচ্ছেন, কৃপাচার্যের গৃহে প্রচ্ছন্নভাবে থেকেই তিনি প্রস্তুত হচ্ছিলেন এর জন্য। দ্রোণকে আমরা দোষ দিই না। ছোটবেলা থেকে যেভাবে তাঁর দিন কেটেছে, তারপর বৃত্তিত্যাগ, বন্ধু দ্রুপদের প্রত্যাখ্যান এবং সর্বোপরি তাঁর আজন্ম সাধন ধন দারিদ্র্য—এই সবকিছুর নিরিখে কৃপাচার্যের কথা তাঁর পক্ষে পূর্বাহ্নে ভাবনা করা সম্ভব ছিলও না হয়তো। কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁর জীবনের দুশ্চিন্তাপর্ব সম্পূর্ণ মিটে গেছে, সেই মুহূর্তেই তিনি কৃপাচার্যের ঋণের কথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন।
দ্রোণ বলেছেন—তা হলে কৃপের কী হবে? এতদিন তিনিই তো আচার্য হিসেবে ছিলেন। তিনি অস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি। অভিজ্ঞ লোকেরাও তাঁকে আচার্য হিসেবে মানেন। এখন আমি যদি কুমারদের আচার্য নিযুক্ত হই, তা হলে নিশ্চয় তাঁর মনে বড় কষ্ট হবে—ময়ি তিষ্ঠতি চেদ্বিপ্রো বৈমনস্যং গমিষ্যতি। কৃপের জন্য দ্রোণ যতই সমব্যথা প্রকাশ করুন, তিনি আসলে কুরুবাড়িতে কৃপের প্রতিষ্ঠা বুঝতেই পারেননি। কৃপ কুরুবাড়িতে আছেন প্রায় ভীষ্মের সময় থেকে। তিনি প্রায় ঘরের লোক। ভীষ্ম অবশ্য দ্রোণের অস্বস্তি বুঝে সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে বলেছেন—আরে কৃপ থাকুন কৃপের জায়গায়। তাঁর সম্মানও এতে নষ্ট হবে না আর তাঁর ভরণপোষণের কোনও সমস্যা হবে না এখানে—কৃপস্তিষ্ঠতু পূজ্যশ্চ্য ভর্তব্যশ্চ ময়া সদা। আমার নাতিদের শিক্ষার ভার আপনাকেই নিতে হবে। তাঁদের আচার্য হবেন আপনিই—ত্বং গুরুর্ভব পৌত্ৰাণামাচাৰ্য্যস্ত্বং মতো মম।