॥ ৪ ॥
দ্রোণ যে এতকাল সুখে দুঃখে, ভাল মন্দে পঞ্চালেই বাস করেছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ভরদ্বাজের আশ্রম পঞ্চালের রাজধানী থেকে খুব বেশি দূরে নিশ্চয়ই ছিল না; তার প্রমাণ হয় নিত্যদিন ওই আশ্রমে বালক দ্রুপদের যাতায়াত থেকে—স নিত্যমাশ্রমং গত্বা দ্রোণেন সহ পার্যতঃ। আচার্য অগ্নিবেশের পাঠশালাও পঞ্চাল রাজ্যের সীমার মধ্যেই ছিল বলে মনে হয়। সেটা অন্য দেশভুক্ত হলে তার উল্লেখ করতে ভুলে যেতেন না মহাভারতের কবি। দ্রোণ পঞ্চাল রাজ্যের জাতক, পঞ্চাল রাজ্যেই বাল্য কৈশোর যাপন করে এখন যৌবনসন্ধিতে উপনীত দ্রোণ। কিন্তু পঞ্চাল রাজ্যের ভাবী রাজার কাছ থেকে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশ্বাস পেয়ে দ্রোণ যখন পিতার আশ্রমে ফিরে এলেন, তখন দেখলেন—পূর্ববৎ স্বাহা-স্বধা-বষট্কার-ধ্বনিতে সেই একইরকম চলছে আশ্রমের ক্রিয়াকর্ম। অসাধারণ অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত দ্রোণের কাছে এই যজ্ঞক্রিয়া এবং ব্রাহ্মণের ওঙ্কার-ঘোষ ভাল লাগল না মন্দ লাগল—সে বিষয়ে কোনও স্পষ্ট মন্তব্য নেই মহাভারতে। তবে আশ্রমে ফেরামাত্রই সেকালের অন্যান্য বেবুঝ পিতার মতো ভরদ্বাজ তাঁর প্রিয় পুত্র দ্রোণকে যে বিষয়ে উত্যক্ত করে তুললেন—তা হল বিবাহ।
দ্রোণ যে আপন বিবাহের ইতিকর্তব্যতা নিয়ে খুব বেশি ভেবেছিলেন, তা নয়, কিন্তু পিতা ভরদ্বাজ তাঁকে গৃহী হওয়ার জন্য যথেষ্ট অনুরোধ উপরোধ করেছিলেন, সে কথা বেশ বোঝা যায়। হয়তো ভরদ্বাজ বৃদ্ধ হয়েছিলেন এবং পুত্রের যৌবনলগ্নে পুত্রবধূর মুখ দেখে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্য বিপরীত, ভরদ্বাজের জীবৎকালে দ্রোণের বিবাহ-সংঘটনা হয়ে ওঠেনি। এমনও হতে পারে—দ্রোণ ভেবেছিলেন—পঞ্চাল রাজ্যের রাজসুখ খানিকটা করতলগত হলে তিনি বিবাহ করবেন। কেননা, তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, বন্ধু দ্রুপদের কাছ থেকে পাওয়া রাজসুখের আশ্বাস তিনি মনে মনে সর্বদা লালন করছিলেন—তস্য বাক্যমহং নিত্যং মনসা ধারয়ংস্তদা। কিন্তু মুশকিল ছিল, বন্ধু দ্রুপদ তখনও পঞ্চাল রাজ্যের রাজা হননি। তৎকালীন পঞ্চালরাজ পৃষত যখন মারা গেলেন, ঠিক তার পর পরই দ্রোণ-পিতা ভরদ্বাজেরও দেহান্ত হল।
হঠাৎ করে পিতার মৃত্যু ঘটে যাওয়ায় দ্রোণের মানসিক প্রস্তুতি এমন ছিল না যে, তিনি তখনই দ্রুপদের কাছে গিয়ে রাজসুখের অধিকার চাইবেন। বরঞ্চ পিতা যে তাঁকে বার বার বিবাহের ব্যাপারে উপরোধ করে গেছেন, সেই উপরোধ অনুরোধের কথাগুলিই তাঁকে পীড়িত করতে লাগল। অন্যদিকে পিতৃবিয়োগের ফলে দ্রোণের হৃদয়ে নেমে এল নিদারুণ শূন্যতা। জননীকে তিনি কোনওদিন দেখেননি, প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে পিতাই তাঁর সব কিছু। অতএব সাময়িকভাবে দ্রোণের মনে গভীর বৈরাগ্যের সৃষ্টি হল। অতি নিকট জনের মৃত্যু অনেক সময়েই এই বৈরাগ্যদীর্ণ হৃদয়ে নতুনভাবে আস্বাদনীয় হয়ে ওঠে। হয়তো এই কারণেই দ্রোণ তপস্যায় মন দিলেন। বৈরাগ্য সাধনের পক্ষে তাঁর পিতার আশ্রমের পরিবেশ এমনিতেই অনুকূল ছিল। অতএব পিতার মৃত্যুর পর সেই আশ্রমে বসেই দ্রোণ যোগ, ধ্যান, তপস্যায় চঞ্চল মন স্থির করার চেষ্টা করলেন—তত্রৈব চ বসন্ দ্রোণস্তপস্তেপে মহাতপাঃ।
তপস্যার ঐকান্তিকতায় অবশ্যই একসময় তাঁর মনের মালিন্য, অবসাদ এবং অনিষ্ট ভাবনাও যত কিছু ছিল, সব দূর হয় গেল বটে,—তপসা দগ্ধকিল্বিষঃ—কিন্তু মনের শূন্যতাটুকু গেল কি? যায়নি বলেই হয়তো বিবাহ করার জন্য পিতার সেই সানুনয় উপরোধ বাক্য আবারও তাঁকে পীড়িত করতে লাগল। ধন মান সম্পত্তির উচ্চচূড় অভিলাষ, যা তাঁকে এতদিন অস্ত্রশিক্ষার নিরলস সাধনায় প্ররোচিত করেছিল, তার ফলপ্রাপ্তির জন্য কর্মক্ষেত্রে নিজেকে প্রয়োগ করার প্রয়োজন ছিল খুব তাড়াতাড়ি। দ্রুপদ যখন পৃষতের মৃত্যুর পর পঞ্চালে রাজা হলেন, তখনই যদি দ্রোণ পঞ্চালে গিয়ে পৌঁছোতেন, তা হলে হয়তো নবাভিষিক্ত বন্ধু-রাজার পূর্বাশ্বাস কাজ করতেও পারত। কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য তাঁর নিজের পিতাও প্রায় সেই সময়ই স্বর্গবাসী হলেন—ভরদ্বাজোপি ভগবান্ আরুরোহ দিবং তদা। পিতার মৃত্যু, মানসিক অবসাদ এবং তার নিরসনের জন্য যোগ, ধ্যান, তপস্যা—এই সব কিছুতেই বড় দেরি হয়ে গেল দ্রুপদের কাছে যেতে। এখন আবার তিনি ওই একই বিলম্ব সূত্রে বিবাহ পর্বটাও সেরে নিতে চাইছেন। কার্য এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে খুব দেরি হয়ে গেলে আরও দেরি করার একটা অবসাদ পরম্পরা তৈরি হতে থাকে, দ্রোণেরও তাই হল।
পিতার কথায় এবং হয়তো পিতৃঋণ পরিশোধের জন্যই—ততঃ পিতৃনিযুক্তাত্মা পুত্রলোভাদ্ মহাযশাঃ—দ্রোণ বিবাহ করলেন। অবশ্য বিবাহের পাত্রীটি যে তাঁর খুব পছন্দ হল, তা বোধহয় নয়। ইতিহাস পুরাণে বিবাহপূর্বা পাত্রীর যে রূপ বর্ণনা থাকে, তা তো এখানে নেইই, বরঞ্চ স্বানুরূপ পাত্রী লাভের ব্যাপারে সমস্ত ইচ্ছা পূরণের অতি প্রকাশের মধ্যেই তাঁর সামান্য হাহাকারটুকুও লুকিয়ে আছে। দ্রোণ বলেছেন—আমি যাঁকে বিয়ে করলাম, তাঁর মাথায় চুল ছিল বড়ই কম, কিন্তু তিনি খুব জ্ঞানী এবং যথেষ্ট ব্রতচারপরায়ণা—নাতিকেশীং মহাপ্রাজ্ঞাম্ উপযেমে মহাব্রতাম্।
মহাকাব্যের যুগে ব্রাহ্মণবংশীয় মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র সাধারণ অবস্থায় বিবাহের জন্য সুন্দরী পাত্রী খুঁজে পাচ্ছিলেন না অথবা তিনি জ্ঞানী পণ্ডিতা রমণীকে বিবাহ করতে চাইছিলেন, এটা খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। মেয়েটির মাথায় একদম চুল ছিল না, কিন্তু তিনি খুব জ্ঞানী ছিলেন—এ কথাটির মধ্যেও অদ্ভুত এক বিপ্রতীপ সান্ত্বনা আছে। বস্তুত, চুল ছিল না—এই সামান্য শব্দটির তাৎপর্য শুধু কেশহীনতার মধ্যেই নয়; কেশহীনতা এখানে উপলক্ষণ মাত্র, আসলে বিবাহেচ্ছু দ্রোণের পাত্রীটি সুন্দরী ছিলেন না। কথাটা পরিষ্কার করে বোঝা যায় দ্রোণের অন্যান্য মন্তব্য থেকেও। বার বার তিনি বলছেন—বিয়ে করলে একটি ছেলে হবে আমার, সেই লোভেই আমি বিয়ে করেছি—সোহং পিতুর্নিয়োগেন পুত্র্লোভাদ্ যশস্বিনীম্। একই জায়গায় স্ত্রীর অসৌন্দর্যের সান্ত্বনা হিসেবেই তিনি যে তাঁর মহাপ্রাজ্ঞতা, কিংবা ব্রতনিয়ম আচার পরায়ণতার কথা বলেছেন, তা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। দ্রোণ আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। বলেছেন—আমার অগ্নিহোত্র ইত্যাদি নিত্য বৈদিক কর্ম এবং অন্যান্য যজ্ঞক্রিয়ায় তিনি যেমন আমার সহায়তা করেছেন, তেমনই আমার ইন্দ্রিয়সংযম কার্যেও তিনি আমার সহায়তা করেছেন সতত—অগ্নিহোত্রে চ সত্রে চ দমে চ সততং রতাম্।
ঠিক এইখানেই আমাদের কলিদুষ্ট মানসিকতায় একখানি জিজ্ঞাসা জাগে। আমাদের সময়ে এক বিদুষী রমণী পড়তেন আমাদের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যবশত তিনি দেখতে অসুন্দর অথবা বলা যায়, কুৎসিতই ছিলেন। পড়াশুনোর ক্ষেত্রেও খানিকটা আত্মম্ভরী ছিলেন তিনি। একদা এক বালক এ হেন মহিলা সম্বন্ধে কৌতূহল প্রকাশ করায় অন্য একটি বালক তাকে বলেছিল—থ্যাৎ! ও তো ‘ব্রহ্মচর্যের মেশিন’। তুই সরে পড়। অদ্ভুত কথা শুনে হতভম্ব বালক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল—এর মানে কী? অন্যতর বলল—বুঝলি না? যাকে দেখামাত্রই ব্রহ্মচর্যের উদয় হয়, ইন্দ্রিয় আপনিই সংযত হয়ে ওঠে, সেই মহিলাই হলেন ‘ব্রহ্মচর্যের মেশিন’। সেই বিদুষী রমণী এবং সেই হতভম্ব বালকের আর কোনও পরিণতি সম্বন্ধে আমি অবহিত নই। তবে এই কথাটাই এখানে সবচেয়ে জরুরি যে আপন স্ত্রীর প্রজ্ঞা এবং ব্রতনিয়মের গৌরবের চেয়েও দ্রোণের ইন্দ্রিয়সংযমে তাঁর সহায়তার সংবাদ বিবাহ নামক অনুষ্ঠানের গৌণ তাৎপর্যও বহন করে না, দাম্পত্য জীবনের প্রাথমিক মুগ্ধতার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। এরওপরে আছে সেই সান্ত্বনাবাক্য—বাবার কথায় এবং পুত্রলাভের ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমি বিবাহ করেছি।
দ্রোণের সামগ্রিক বিবাহভাবনা থেকে বোঝা যায় যে, বিবাহের বিষয়ে তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবেননি, আর ভাবেননি বলেই বিবাহের মাধ্যমে ধন মান আভিজাত্যের আকাঙ্ক্ষাও তিনি করেননি। যাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হল, সেই গৌতমকন্যা কৃপীর জন্মগৌরব তথা লালিত পালিত হওয়ার আভিজাত্যও কিছু নেই। কৃপাচার্য এবং কৃপী এই দুই যমজ ভাইবোন গৌতমবংশীয় ঋষি শরদ্বানের ঔরসে জন্মেছিলেন পিতার সাময়িক রতিতৃপ্তির বিকারে, অনেকটা প্রায় দ্রোণের মতোই। কিন্তু পার্থক্য ছিল এই যে, দ্রোণের পিতা ভরদ্বাজ জননীর পরিত্যক্ত শিশু দ্রোণকে নিজে মানুষ করেছিলেন, কিন্তু কৃপ এবং কৃপী জনক এবং জননী উভয়েরই পরিত্যক্ত। হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনু মৃগয়া করতে গিয়ে পরিত্যক্ত ওইদুটি শিশুকে আপন রাজধানীতে নিয়ে এসে মানুষ করেন। তিনি কৃপা করে এঁদের লালন করেছিলেন বলেই তাঁদের নাম কৃপ এবং কৃপী। পিতামাতা ছাড়া অন্য এক ব্যক্তির কৃপা-করুণা যাঁদের নামের মধ্যেই সংবৃত, তাঁদেরই একজনকে বিবাহ করলেন দ্রোণ।
এই বিবাহ-সংঘটনার মধ্যে আভিজাত্য বা অন্য কোনও কৌলীন্য না থাকলেও অন্যতর এক রহস্য অবশ্যই আছে। প্রথম কথা, কৃপ এবং কৃপীকে আমরা পঞ্চাল রাজ্যের জাতকজাতিকা বলে সন্দেহ করি, যাঁরা দৈবক্রমে হস্তিনাপুরের কুরুবংশীয় শান্তনুর লালন পালন লাভ করেছিলেন বলে কুরুবংশীয়দের কাছে জন্মগতভাবেই ঋণী। দ্বিতীয়ত লক্ষণীয়, কৃপ-কৃপীর পিতা শরদ্বান, ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও মহাভারতের কবির জবানীতে ব্রাহ্মণোচিত বেদ অধ্যয়নে তাঁর কোনও রুচি ছিল না—ন তস্য বেদাধ্যয়নে তথা বুদ্ধিরজায়ত। যে বিষয়ে শরদ্বানের রুচি ছিল, তা হল ক্ষত্রিয়ের বিদ্যা ধনুর্বেদ—যথাস্য বুদ্ধিরভবদ্ ধনুর্বেদে পরন্তপ।
ব্রাহ্মণ বংশে জন্মে যাঁরা বেদবিদ্যা ভুলে ধনুর্বেদ চর্চা করেছিলেন, তেমন ব্রাহ্মণরা যে ব্রাহ্মণ সমাজে খুব সুনামের অধিকারী হতেন না সেকালে, সে কথা ভারতবর্ষের সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সহজেই প্রমাণ করা যায়। ঠিক এইভাবে দেখলে—দ্রোণ অথবা কৃপ-কৃপীর সামাজিক মর্যাদা ছিল একইরকম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, নিজের স্বধর্ম এবং বৃত্তি ত্যাগের কারণেই উপযুক্ত ব্রাহ্মণ ঘরের কোনও কন্যাকে দ্রোণ বিবাহ করতে পারেননি। তাঁকে বিবাহ করতে হয়েছে নিজের পালটি ঘরে, যিনি ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও বেদপাঠে রুচি দেখাননি, রুচি দেখিয়েছেন ধনুর্বেদে। হয়তো এই সমস্যার জন্যই কুৎসিতা অল্পকেশিনী শারদ্বতী কৃপীকে বিবাহ করা ছাড়া দ্রোণের কোনও গত্যন্তর ছিল না।
যাই হোক, দ্রোণের নিজের ভাষা ব্যবহার থেকেই বুঝতে পারি, রমণীর সৌন্দর্য মাধুর্য নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা ছিল না। বিবাহের অভীষ্ট ফল হিসেবে তিনি একটি পুত্র চেয়েছিলেন, শারদ্বতী কৃপী সেই অভীষ্ট পুত্র প্রসব করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে দ্রোণের কোনও অভিযোগ ছিল না। পুনশ্চ স্বামীর যত্নসাধনে অথবা তাঁর নিত্যকর্মে হোম যজ্ঞের সহায়তায় কৃপী যে দ্রোণের সহধর্মচারিণী ছিলেন সে কথা বার বার সগৌরবে দ্রোণের মুখেই ঘোষিত হয়েছে।
দ্রোণের পুত্রের নাম অশ্বত্থামা। তিনি জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কান্নাটি যেমন করে কেঁদেছিলেন, তার সঙ্গে নাকি অশ্বের হ্রেষাধ্বনির একমাত্র তুলনা হয়। একটি শিশুর কান্নার সেই সামর্থ্য সাধারণত থাকে না, যাতে অশ্বধ্বনির সঙ্গে তার তুলনা চলে। হয়তো দ্রোণপুত্রের প্রথম ক্রন্দনধ্বনি অন্য শিশুর তুলনায় অনেক জোরালো ছিল এবং এই জোরের সংস্কৃত প্রতিশব্দ হল ‘স্থাম’। ‘স্থাম’ শব্দটির আদ্যবর্ণ ‘স’-কার ব্যাকরণের নিয়মে ত’ কার হয়ে যায়। তাই দ্রোণের ছেলের নাম হল অশ্বত্থামা। অর্থাৎ জন্মের সময়েই অশ্বের হ্রেষার মতো শব্দ করার সামর্থ্য দেখিয়েছিলেন তিনি—অশ্বস্যেবাস্য যৎ স্থাম নদতঃ প্রদিশো গতম্।
অশ্বত্থামাকে লাভ করে দ্রোণ অনন্ত বাৎসল্যের আস্বাদ পেলেন। পুত্রকে নিয়ে তাঁর আনন্দের অন্ত ছিল না। অল্প বয়সেই ছেলেটির শরীরস্বাস্থ্যও যেমন সুন্দর হয়ে উঠল, তেমনই প্রকাশ পেতে লাগল তাঁর তেজ। এই বয়সে সুগঠিতভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তাঁর দরকার ছিল উপযুক্ত খাদ্য এবং যথাযথ লালন। লালনের ব্যাপারে দ্রোণের কোনও ত্রুটি ছিল না। শুধু পুত্রলাভের আকাঙ্ক্ষাতেই যিনি বিবাহ করেছিলেন, সেই ব্যক্তি নিজের মতোই এক বীর পুত্র লাভ করলে তাঁর বৎসল হৃদয় যে কতটা পূর্ণ হবে তা বুঝতে পারি। তিনি নিজেই বলেছেন—পুত্র লাভ করে আমি ততটাই আনন্দ লাভ করেছিলাম, যতটা আনন্দ পেয়েছিলেন আমার বাবা আমাকে লাভ করে—পুত্রেণ তেন প্রীতো’হং ভরদ্বাজো যথা ময়া।
পরম অনুগামিনী স্ত্রী শারদ্বতী কৃপী আর হৃদয়-আনন্দন পুত্র অশ্বত্থামাকে নিয়ে দ্রোণের যে সংসার রচিত হয়েছিল, তাতে অর্থাভাব এমন বড় হয়ে ওঠার কথা ছিল না, যা কষ্টকর, অথবা লজ্জাকর হয়ে ওঠে। কথা ছিল না, কারণ দ্রোণ যদি পৈতৃক বৃত্তি ত্যাগ না করে যজনযাজন অধ্যয়ন অধ্যাপনায় মন দিতেন, তা হলে এখানে ওখানে যাগযজ্ঞ করে দক্ষিণায় পুষ্ট হয়ে তাঁর দিন চলে যেত। ভালভাবে না চললেও চলে যেত। অগ্নিবেশের অস্ত্র পাঠশালা থেকে ফিরে এসে তিনি যে সাময়িকভাবে সে চেষ্টা করেননি, তাও মনে হয় না। কারণ তাঁকে আমরা পিতার মৃত্যুর পর ব্রতনিয়ম তপশ্চর্যায় দিন কাটাতে দেখেছি। কিন্তু এইভাবে চললেও যজ্ঞ-দানের ক্ষেত্রে যাজন করার জন্য তাঁর যে কোনও যজমান তৈরি হয়নি, তা বেশ বোঝা যায়। পুত্র লাভের পর তাঁর অর্থকৃচ্ছ্রতা বাড়তে থাকে। ফলে ব্রাহ্মণের বৃত্তিতে অর্থ সংঘটনার কথা সম্পূর্ণ মন থেকে দূর করে দিয়ে অন্তত যা তিনি ভাল করে শিখেছেন সেই অস্ত্রবিদ্যায় কোনও অর্থলাভ ঘটে কি না, সেই চেষ্টায় ব্রতী হলেন দ্রোণ। পূর্বশিক্ষিত ধনুর্বেদ তিনি আরও ভাল করে অভ্যাস করতে লাগলেন—তত্রৈব চ বসন্ দ্রোণো ধনুর্বেদপরো’ ভবৎ।
আচ্ছা, কী পেতেন সেকালের ব্রাহ্মণরা? যজনযাজন করে কী দান দক্ষিণা পেতেন তাঁরা। আমাদের মনুমহারাজ খুব চাইতেন যাতে সমাজে ব্রাহ্মণদের কোনও আর্থিক কষ্ট না থাকে। অধ্যয়ন অধ্যাপনা করে যাঁরা দিন কাটাবেন, তাঁদের যাতে অন্নকষ্ট না হয়, তার জন্য তিনি চাপ সৃষ্টি করেছেন রাষ্ট্রশাসক রাজার ওপর। তিনি বলেছেন—রাজারা যেন বছরের নানান সময় অনেক অনেক যাগযজ্ঞ করেন—যজেত রাজা ক্রতুভিঃ—যাতে করে ব্রাহ্মণরা ভাল ভাল দক্ষিণা পান। এ হল এককে দিয়ে অপরকে রক্ষা করার চেষ্টা; শাসক সম্প্রদায়কে দিয়ে শিক্ষিত সম্প্রদায়কে রক্ষা করার চেষ্টা। তবে মনুমহারাজ এত চেষ্টা করলেও কজন রাজা আর বাজপেয় অশ্বমেধের মতো বড় বড় যজ্ঞ করতে পারতেন। তবে সাধারণ যাগযজ্ঞের প্রক্রিয়া ভারতবর্যের বিভিন্ন জায়গায় অবশ্যই চলমান ছিল এবং ব্রাহ্মণরাও দান দক্ষিণা পেতেন মন্দ নয়। তবে এই দান দক্ষিণার হিসেবটা যদি ভারতবর্ষের সামগ্রিক ব্রাহ্মণ সমাজের নিরিখে করা যায়, তবে কার কতটুকু দক্ষিণা মিলত তা আন্দাজ করা যায়। অন্তত ব্রাহ্মণের বৃত্তি যে খুব লাভজনক ছিল না, সেটা বেশ বোঝা যায়।
বস্তুত জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্রাহ্মণকে পরিশ্রম যত করতে হত, দান দক্ষিণা সেই অনুপাতে মিলত না। দু-চারজনে যাঁরা রাজার মন্ত্রী-অমাত্য হতেন তাঁদের কথা নিশ্চয়ই আলাদা, কিন্তু বেশিরভাগ ঋষি মুনির অর্থাভাব কেমন ছিল, তা সেই বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটিমাত্র বক্তব্য থেকেই প্রমাণ করা যায়। সেই যেখানে ব্রহ্মজিজ্ঞাসার বিশাল তর্কসভায় সমস্ত তাত্ত্বিকতা শিকেয় তুলে রেখে যাজ্ঞবল্ক্য যখন বলেছিলেন—আপাতত আমার প্রয়োজন এই গোরুগুলি—তখনই বোঝা যায় ব্রহ্মানুসন্ধানের মহান তত্ত্বের সঙ্গে জীবিকার জন্য ব্রাহ্মণের হাহাকারও কিছু ছিল। ব্রাহ্মণের প্রাপ্য সাধারণ দক্ষিণা বলতে ভূমি-হিরণ্যের দান সার্বত্রিক ছিল না, সাধারণ যজ্ঞিবাড়িতে একখানি পয়স্বিনী গাভী মেলাও অত সহজসাধ্য ছিল না। বিশেষত সে বামুন যদি বৃত্তিত্যাগী ব্রাহ্মণব্রুব হয়, তবে অন্যের দিক থেকে স্বতঃস্ফূর্ত দান পাওয়া তো দূরের কথা, চেষ্টা করেও একটি দুগ্ধবতী গাভী মিলত না।
দ্রোণের অবস্থা ছিল খুবই করুণ। তাঁর সংসার বড় হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। শারদ্বতী কৃপীর রূপ ছিল না বটে, কিন্তু তাঁর কোনও লোভও ছিল না। কিন্তু সংসারে যে শিশুপুত্রটি বড় হচ্ছে, তার শুধু জীবন রক্ষার জন্যই যে একটু দুধের প্রয়োজন—সেই প্রয়োজনটা দ্রোণকে বড় পীড়িত করছিল। দ্রোণ যেখানে থাকতেন, সেখানে তাঁর পাড়ায় ধনীলোক কেউ ছিল না, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা প্রতিদিন দেখতেন—বড়লোকের ঘরের ছেলেরা দুধ খায়—গোক্ষীরং পিবতো দৃষ্টা ধনিনস্তত্র পুত্রকান্। প্রতিদিনের এই দেখা থেকেই বালক অশ্বত্থামার মনে কষ্ট জমা হতে থাকে। একদিন তিনি পিতামাতার কাছে দুধ খাবার বায়না আরম্ভ করলেন। স্বাভাবিকভাবেই দুধ জুটল না এবং বালক অশ্বত্থামা না-পাওয়া দুধের জন্যই কেঁদে আকুল হলেন। এই ঘটনা দ্রোণের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল। মানসিক যন্ত্রণা তাঁকে অধীর করে তুলল—অশ্বত্থামা’রুদদ্বাল-স্তন্মে সম্মোহয়দ্দিশঃ।
তখনও পর্যন্ত দ্রোণ ভাবছেন—তিনি ব্রাহ্মণের ছেলে, অন্তত একখানি দুগ্ধবতী গাভী জোটানো তাঁর পক্ষে কঠিন হবে না কিছু। বিশেষত তখনও তিনি ব্রাহ্মণের বৃত্তি সম্পূর্ণ ত্যাগ করেননি। তখনও তিনি ধনুর্বেদের পরম আশ্রয়ে কোনও রাজার অধীনে অস্ত্র-জীবিকা গ্রহণ করেননি। তখনও একবার তাঁর শাস্ত্রের কথা মনে আছে। মনে আছে, শাস্ত্র বলে—ন স্নাতকো’বসীদেত—যজনযাজন আর অধ্যয়ন অধ্যাপনায় ব্যাপৃত ব্রাহ্মণ যেন নিন্দিত দান গ্রহণ করে ধর্মভ্রষ্ট না হন। অতএব দ্রোণ ব্রাহ্মণের বৃত্তি বজায় রেখেই কিছু দান লাভ করা যায় কি না সেই চেষ্টায় ছিলেন। বলা বাহুল্য, পঞ্চাল রাজ্যে সে চেষ্টা মোটেই সফল হল না। সে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত তিনি অনেক ঘুরলেন—তং দেশং বহুশো ভ্রমন্। তখনও পর্যন্ত তাঁর মনে দৃঢ় সংকল্প জাগরূক—পিতৃ পিতামহের বৃত্তি ছাড়বেন না। কোথাও যাজন করেই হোক অথবা ধনী কোনও ব্রাহ্মণ যিনি দান করতে ইচ্ছুক, এমন ঘর থেকেই একটি দুগ্ধবতী গাভীর দান তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন—বিশুদ্ধমিচ্ছন্ গাঙ্গেয় ধর্মোপেতং প্রতিগ্ৰহম্। কিন্তু মিলল না সেই দান।
আসলে যে যুগের কথা এখানে হচ্ছে সে যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে পঞ্চাল রাজ্যের সুনাম ছিল। মহাভারতেরই অন্যত্র কর্ণপর্বে বিভিন্ন দেশের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করবার সময় বলা হয়েছে—পঞ্চাল দেশের মানুষেরা বেদবিহিত ব্রাহ্মণ্য ক্রিয়াকলাপের জন্যই বিখ্যাত, আর কুরুদেশের লোকেরা বোঝে ধর্ম, নীতি, নিয়ম, শৃঙ্খলা—ব্রাহ্মং পাঞ্চালাঃ কৌরবেয়াস্তু ধর্মম্। এই পরিষ্কার কথা থেকেই বোঝা যায়—কেন তেমন চেষ্টা করা সত্ত্বেও দ্রোণের ভাগ্যে একটি দুধেল গাই পর্যন্ত জোটেনি। পঞ্চাল রাজ্যে দ্রোণকে চিনতেন না এমন লোক ছিল না। মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র বলে কথা, বেদ জানা খাঁটি বামুন ঘরের জাতক তিনি। কিন্তু যে মানুষ অগ্নিবেশ্যর আশ্রমে অতকাল ধরে অস্ত্রবিদ্যা শিখলেন, তাঁকে ব্রাহ্মণ্য প্রধান পঞ্চালবাসীরা রাজবৃত্তিতেই বেশি আগ্রহী বলে মনে করেছিলেন। এই আগ্রহ তাঁদের কাছে লোভের পর্যায়বাচী। তাঁরা ভেবেছিলেন যে, মহর্ষি ভরদ্বাজের কাছে যে অস্ত্রকৌশল বিনোদনমাত্র ছিল, ভারদ্বাজ দ্রোণের কাছে তা জীবিকা হয়ে গেছে। ‘ব্রাহ্ম’ পাঞ্চালদের কাছে এটা অসহ্য।
সত্যি কথা বলতে কী, রাজসুখের প্রতি দ্রোণের লোভ কিছু ছিলই, নইলে নিজের জীবনকাহিনী অধিকতর সকরুণভাবে ব্যাখ্যা করে তিনি পাঞ্চাল দ্রুপদের সমব্যথা আদায় করতেন না। পঞ্চাল দেশে ভারদ্বাজ দ্রোণের সম্মান কিছু কম হত না। অন্য পাঁচটা ব্রাহ্মণ যেভাবে বাঁচতেন, সেইভাবেই তিনি বাঁচতে পারতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের এই অনাড়ম্বর উত্তেজনাহীন জীবন দ্রোণ পছন্দ করেননি। এবং করেননি বলেই ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবিদ্যায় তিনি নিজেকে শিক্ষিত করেছিলেন চরমভাবে। পিতার মৃত্যু এবং বিবাহের অব্যবহিত পরেই হয়তো তিনি ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবৃত্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি, কিন্তু নিজেকে যেভাবে তিনি প্রস্তুত করেছিলেন, তাতে ব্রাহ্মণ্য-প্রধান পঞ্চালে তাঁর ব্রাহ্মণোচিত দানলাভের প্রতিকূলতা ছিল। যার ফলে পঞ্চাল দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরেও তিনি একটি দুগ্ধবতী গাভী দান হিসেবে পেলেন না কারও কাছে—অন্তদন্তং পরিক্রম্য নাধ্যগচ্ছং পয়স্বিনীম্।
দ্রোণের মানসিক দুঃখ চরমে উঠল যখন দ্রোণ দেখলেন—অশ্বত্থামার খেলার বন্ধুরা একদিন পিটুলিগোলা ফেনায়মান সাদা জল দেখিয়ে অশ্বত্থামাকে দুধ খাবার লোভ দেখান। লুব্ধ অশ্বত্থামাও সেই পিটুলিগোলা জল খেয়ে ধেই ধেই করে নেচে উঠলেন দুধ খেয়েছি বলে—পীত্বা পিষ্টরসং বালঃ ক্ষীরং পীতং ময়াপি চ। দ্রোণ দেখলেন—সত্যিকারের দুগ্ধপায়ী বালকেরা সাবহাসে অশ্বত্থামাকে ঘিরে নাচছে আর তাদের সঙ্গে নাচছে অশ্বত্থামা, সরল, অবোধ, দুগ্ধভ্রান্তি-বিমোহিত—তং দৃষ্টা নৃত্যমানন্তু বালৈঃ পরিবৃতং সুতম্। ওই অত টুকু টুকু ছেলেরা সব! তারা উপহাসের সুরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল—তোর বাপ গরিব, টাকাপয়সা উপায় করার ক্ষমতা নেই তোর বাবার—দ্রোণং ধিগস্তু অধনিনং যো ধনং নাধিগচ্ছতি। দ্রোণের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে গেল। গৃহস্থ হয়েও যে পিতা পুত্রের জন্য সামান্য দুধ জোগাড় করতে পারে না, এতটা বয়স পর্যন্ত যাঁর অর্থসম্বল বলতে কিছু নেই এবং অর্থাভাবের জন্যই যাঁর ছেলেকে নিজের সামনেই উপহাসাস্পদ হতে হয়, সেই দ্রোণের বুদ্ধি ঠিক থাকবে কী করে? আর কতদিন তিনি ব্রাহ্মণের বৃত্তিতে শ্রদ্ধা রেখে বসে থাকবেন। তাঁর বুদ্ধি বিচলিত হল—বুদ্ধিরচ্যবৎ।
যিনি পূর্বেই ব্রাহ্মণের বৃত্তিতে শ্রদ্ধা হারিয়ে ক্ষত্রিয়ের বিদ্যা শিক্ষা করেছিলেন, তাঁকে যদি ব্রাহ্মণের বৃত্তিতে স্থিত রাখতে চাইতেন ব্রাহ্মণেরা, তা হলে পঞ্চাল দেশের ব্রাহ্মণদের দিক থেকে আরও কিছু সমব্যথার প্রয়োজন ছিল, ধৈর্যেরও প্রয়োজন ছিল। সেই সমব্যথা এবং ধৈর্য ‘ব্রাহ্ম’ পাঞ্চালেরা দেখাননি। বরঞ্চ দ্রোণের অস্ত্রশিক্ষার উন্মাদনাকে তাঁরা নিন্দা করেছেন এবং সেই নিন্দার সঙ্গে তাঁরা ত্যাগও করেছেন দ্রোণকে—অপি চাহং পুরা বিপ্রৈবর্জিতো গর্হিতো ভূশম্। শুধুমাত্র অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য ব্রাহ্মণসমাজ যেভাবে দ্রোণকে বিসর্জন দিয়েছিলেন অথবা যেভাবে তাঁরা তাঁকে বৃত্তি ত্যাগের নিন্দাভাজন প্রতিপন্ন করে একটি গোরু পর্যন্ত পেতে দেননি, তাতে দ্রোণের দিক থেকে উলটো প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক। বৃত্তি ত্যাগের জন্য যাঁরা সমাজে নিন্দিত হতে থাকেন অথবা জাতিচ্যুতির জন্য যাঁদের নিজের সমাজেই বিব্রত হতে হয়, তাঁরা তখন পূর্ববৃত্তি এবং জাতির ওপরেই অভিমানী হয়ে ওঠেন। ব্রাহ্মণ্যের এই কঠিন শাস্তি দ্রোণকে ব্রাহ্মণ্যের ত্রুটি সন্ধানে প্ররোচিত করল।
দ্রোণের মনে হল—অন্নের জন্য যে ব্রাহ্মণকে পরের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়, অধ্যাপনা করে বা অন্যের যাজন করে যাঁদের দক্ষিণাভিমুখী হয়ে থাকতে হয়, অন্তত টাকাপয়সার জন্য তেমন জীবিকা তিনি গ্রহণ করবেন না। তেমন জীবিকা তাঁর কাছে পরের সেবাই বটে, পাপও বটে—পরোপসেবাং পাপিষ্ঠাং ন চ কুৰ্য্যাং ধনেচ্ছয়া। সত্যি কথা বলতে কী, শিক্ষা, জ্ঞান এবং ত্যাগ ধর্মের ওপর ব্রাহ্মণের জীবিকা নীতিগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও রাজা এবং অন্য ধনী ব্যক্তির দান গ্রহণ করে ব্রাহ্মণের জীবিকা চলত বলে এই দান প্রতিগ্রহের ব্যাপারটা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু লাগত, যেমনটি দানের প্রতি আগ্রহ দেখালে আজও সেই ব্রাহ্মণের ব্যবহার আমাদের কাছে দৃষ্টিকটুই লাগে। মহাভারতের অন্যত্রও ত্যাগ বৈরাগ্য এবং জ্ঞানান্বেষণের নীতির দ্বারা প্রধানত চালিত ব্রাহ্মণ্যের পাশাপাশি বৈদিক ক্রিয়াকর্মে নিরত ব্রাহ্মণদের অর্থলাভের সূক্ষ্মাভিসন্ধিটুকু স্বয়ং অর্জুনের মুখেই বসানো আছে।
অর্জুন অর্থলাভের বাস্তব প্রয়োজনের কথা বৈরাগ্য প্রধান যুধিষ্ঠিরকে বোঝানোর সময় বলেছিলেন—ব্রাহ্মণেরা অধ্যাপনার উদ্দেশেই অধ্যয়ন করেন। কিন্তু অধ্যাপনার পিছনে আছে অর্থ উপার্জনের ইচ্ছা। লব্ধ অর্থ দিয়ে তাঁরা নিজেরা যাগযজ্ঞ করেন বটে, কিন্তু অন্যের যাজনাকর্ম করার সময় অর্থলাভ করাটাই তাঁদের মূল উদ্দেশের মধ্যেই পড়ে—যজনাধ্যাপন প্রতিগ্রহৈ ব্রাহ্মণো ধনমর্জয়েৎ। ব্রাহ্মণের যাগযজ্ঞ করা এবং দক্ষিণা গ্রহণের প্রবৃত্তিকে আজকে যাঁরা আত্মভরণের অসদুপায় বলে চিহ্নিত করেন, তাঁরা অর্জুনের এই উক্তিতে খুশি হবেন বটে, তবে মনে রাখতে হবে—মহাভারতে অর্জুনের কথাই শেষ কথা নয়, মহাভারতের মূল অভিসন্ধিও সেটা নয়। অর্জুনকে এ কথা বলতে হয়েছে নিজের তাকালিক প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য। একইভাবে দ্রোণও যে সাময়িকভাবে ব্রাহ্মণ বৃত্তির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন, সে যেমন একদিকে ব্রাহ্মণ সমাজের অন্যায় প্রতিকূলতার জন্য, তেমনই তাঁর অন্তর্মূঢ় অর্থলাভের স্পৃহার জন্য। তিনি দরিদ্র ছিলেন বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণোচিত অভীষ্ট সত্ত্বগুণের অধিকারী ছিলেন না। আশ্চর্য ব্যাপার হল, যেখানে গুণকর্মের তারতম্যে চতুর্বর্ণের সৃষ্টি হত, সেই সমাজের প্রতিভূরা বুঝলেন না যে, দ্রোণ রজোগুণের জাতক। রজোগুণই তাঁকে ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্রশিক্ষায় প্ররোচিত করেছে, রজোগুণই প্রচুর অর্থস্পৃহা জাগিয়েছে তাঁর মনে এবং রজোগুণই একসময় তাঁকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলেছে ব্রাহ্মণোচিত যাজন, অধ্যাপন এবং প্রতিগ্রহে। দ্রোণের অন্তর্জাত গুণকর্মের প্রতি ব্রাহ্মণ সমাজের সমব্যথা এবং সমান হৃদয়তা ছিল না বলেই দ্রোণকে তাঁরা সামাজিকভাবে বর্জন করেছিলেন, যদিও এই বর্জন ছিল অনুচিত এবং অনৈতিক।
অন্যদিকে বালক বয়স থেকেই যে মানুষ অস্ত্রবিদ্যা শিখে অর্থলাভে প্ররোচিত হয়েছিলেন, তিনি যে কোন দ্বিধায় অসহায়ের মতো ব্রাহ্মণের বৃত্তিতে ফিরে আসার চেষ্টা করছিলেন, তাও আমরা বুঝি না। মস্তকে লজ্জাবস্ত্র ঠিক রেখে যেমন নৃত্যচারিতা সম্ভব হয় না, তেমনই অস্ত্রবিদ্যায় শিক্ষিত হয়ে ব্রাহ্মণ্যের আবরণটুকু যথাসাধ্য বয়ে বেড়ানোর মধ্যেও তাঁর কোনও গৌরব ছিল না। যে আবরণ ভেদ করা তাঁর অনেক আগেই উচিত ছিল, সেই ঔচিত্য পালন না করার ফলে ব্রাহ্মণের বৃত্তির ন্যক্কারজনক দিকটায় তাঁর নজর গিয়ে পড়ল। তিনি তাঁর পিতৃ-পিতামহের বৃত্তির প্রতি বিষ উদ্গিরণ করলেন—আমি অর্থের জন্য এই পাপিষ্ঠা বৃত্তি পরের সেবায় নিযুক্ত হব না। অর্থাৎ তিনি ক্ষত্রিয়ের স্বাধীন বৃত্তি গ্রহণ করবেন। হায়! দ্রোণ বুঝলেন না—ভবিষ্যতে তাঁকে যা করতে হবে তারমধ্যেও পরোপসেবার ঘৃণ্যতাটুকু থাকবেই।
পূর্ববৃত্তির ওপর দ্রোণের বিষোদগার এবং ক্ষত্রিয়বৃত্তির প্রতি অনুরাগ ঘোষণার পিছনে আরও একটি আপাতিক কারণ আছে দ্রোণের পক্ষে। বিবাহোত্তর জীবনে গৃহে তখন অর্থকৃচ্ছ্রতা চলছিল হয়তো এবং অশ্বত্থামার দুগ্ধভাবিত পিষ্টরস সেবনের ঘটনাও তখন ঘটে গেছে হয়তো। দ্রোণ তখন হঠাৎই একদিন একটা খবর পেলেন ব্রাহ্মণ পরম্পরায়। খবর পেলেন—মহাবলী ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরাম তাঁর এতকালের সমস্ত সঞ্চিত ধনরত্ন ব্রাহ্মণদের দান করে বনে চলে যাবেন ব্রাহ্মণেভ্যস্তদা রাজন দিসন্তং বসু সর্বশঃ। একবার পরশুরামকে দেখার শখ অনেকদিন থেকেই থেকে থাকবে দ্রোণের। একদিকে নিজের সঙ্গে পরশুরামের জীবনধারারও মিল খুঁজে পান তিনি। পরশুরামও ব্রাহ্মণ এবং সর্বশাস্ত্রে প্রবীণ কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তিনি ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করেছেন। এখানে অবশ্য অর্থলাভের স্পৃহা কিছু ছিল না, ক্ষত্রিয় জাতির প্রতি বংশগত প্রতিশোধস্পৃহায় ক্ষত্রিয় নিধনের জন্যই পরশুরাম কুঠার তুলে নিয়েছিলেন হাতে, স্কন্ধে তুলে নিয়েছিলেন ধনুক তূণীর। দ্রোণের ইচ্ছা ছিল পরশুরামের ধনদান লাভের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দিব্য অস্ত্রের সম্ভারও কিছু লাভ করা—স রামস্য ধনুর্বেদং দিব্যান্যস্ত্রাণি চৈব হি। শ্রুত্বা তেষু মনশ্চক্রে…।
দ্রোণ মহেন্দ্র পর্বতে রওনা হলেন। পরশুরাম সেখানেই থাকেন। দ্রোণ চললেন ব্রাহ্মণের গরিমায় শিষ্যসামন্ত সঙ্গে নিয়ে। যতই নিন্দিত হোন, তিনি মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র। পিতৃ-পিতামহক্রমে শিষ্যসামন্ত এখনও তাঁর অনুগামী হয়। অতএব ব্রতপরায়ণ শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে তিনি চললেন পরশুরামের উদ্দেশে মহেন্দ্র পর্বতে—বৃতঃ প্রায়ান্ মহাবাহু-র্মহেন্দ্ৰং পর্বতোত্তমম্। পরশুরাম বসে ছিলেন, শান্ত দান্ত ক্ষমাশীল ভঙ্গিতে। দ্রোণ সশিষ্য পরশুরামের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন—আমি মহর্ষি ভরদ্বাজের পুত্র দ্রোণ। আমি ধনলাভের ইচ্ছায় আপনার কাছে এসেছি—আগতং বিত্তকামং মাং বিদ্ধি দ্রোণং দ্বিজোত্তম। পরশুরাম দ্রোণের ইচ্ছাটা বোধহয় ভাল করে বুঝতে পারেননি প্রথমে। ভাল করে জিজ্ঞাসা করতে দ্রোণ এবার পরিষ্কার বললেন—আপনি ব্রাহ্মণকে ধনদান করছেন শুনলাম। আমার অর্থ দরকার, প্রচুর অর্থ দরকার, আমি আপনার কাছে সেই অর্থ চাইতে এসেছি—অহং ধনম্ অনন্তং হি প্রার্থয়ে বিপুলব্রত।
হায়! ব্রাহ্মণ কুলের অনভিজ্ঞ পুরুষ! দ্রোণ জানেন না যে, দানলাভের সংবাদ পেলে ব্রাহ্মণরা সেখানে আগে পৌঁছোন। বিকল্প জীবিকা নেই বলে অর্থের সন্ধান তাঁদের কাছে অনেক সময়েই প্রধান হয়ে পড়ে। দ্রোণ যতক্ষণে পরশুরামের কাছে পৌঁছেছেন, ততক্ষণে পরশুরামের দাতব্য ধনরত্ন সব শেষ হয়ে গেছে। অতএব সলজ্জে পরশুরাম দ্রোণকে জানালেন—ধনরত্ন যা ছিল সবই তো আমি পূর্বাগত ব্রাহ্মণদের দিয়ে দিয়েছি—ব্রাহ্মণেভ্যো ময়া দত্তং সর্বমেব তপোধন। তা ছাড়া অসংখ্য গ্রাম-নগরযুক্ত এই বসুন্ধরা, তাও আমি দিয়ে দিয়েছি মহর্ষি কশ্যপকে। এখন যা বাকি আছে, যা আছে এখনও অপ্রদত্ত, তারমধ্যে অবশিষ্ট আছে এই শরীর আর আছে অসাধারণ কতগুলি অস্ত্র—শরীরমাত্র মেবাদ্য ময়েদমবশেষিতম্। অস্ত্রাণি চ মহার্হানি শস্ত্রাণি বিবিধানি চ।
পরশুরামের বৃদ্ধ শরীর দিয়ে আর কী বা করবেন দ্রোণ। ধনসম্পত্তি, হিরণ্যভূমি তো কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু অসাধারণ দৈব অস্ত্র যা ছিল—সেগুলি অন্তত ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগবে দ্রোণের। সেই কথা ভেবেই দ্রোণ অবশিষ্ট সব দিব্য অস্ত্রের প্রয়োগ জেনে নিতে চাইলেন। শিখতে চাইলেন কীভাবে সেইসব প্রয়োগ করেও আবার সংবরণ করতে হয়। পরশুরাম তাঁর কাছে রাখা সমস্ত অস্ত্রের সংকেত, প্রয়োগ, সংবরণের অভিসন্ধি শিখিয়ে দ্রোণকে সেগুলি দান করলেন। পরশুরামের অস্ত্রসম্ভার লাভ করে দ্রোণের সামরিক পরাক্রম অনেক বেড়ে গেল। ব্রাহ্মণের বৃত্তি ত্যাগের সংকল্পও বোধ হয় এইসময় থেকেই তাঁর দৃঢ়তর হল।
এবারে লক্ষ করে দেখুন, কীভাবে দ্রোণ তাঁর জীবনের পরবর্তী পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেন। পরশুরামের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র লাভ করার পরেই দ্রোণ ঠিক করলেন—গতানুগতিক জীবনের শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি তাঁর অস্ত্রাশ্রমের প্রিয়সখা পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে যাবেন। তাঁর পিতা পৃষত স্বর্গত হয়েছেন, দ্রুপদ এখন পুরোদস্তুর রাজা। দ্রুপদ যেমন কথা দিয়েছিলেন, তাতে পঞ্চাল রাজ্যের রাজসুখে তাঁরও তো ভাগ পাবার কথা। অতএব দ্রোণ এবার স্ত্রীপুত্রকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন পঞ্চালের রাজধানীতে—সদারঃ সৌমকিং গতঃ।
মহাভারতের এক জায়গায় খবরটা এমন সহজভাবেই আছে বটে, তবে অন্যত্র আর এক জায়গায় দেখতে পাচ্ছি—পরশুরামের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভার লাভ করার পরেই—প্রতিগৃহ্য তু তৎ সর্বং…জগাম দ্রুপদং প্রতি। এর তাৎপর্য দু রকম হতে পারে। এক, পূর্বের কথা মতো দ্রুপদের রাজ্যাধিকারে ভাগ পেলে তাঁর অস্ত্রশিক্ষার উন্নত প্রযুক্তি প্রিয়সখার কাজে লাগাতে পারেন। দুই, কোনওভাবে যদি দ্রুপদ পূর্বের কথা অস্বীকার করেন, তবে পরশুরামের কাছে অস্ত্র-পাওয়া দ্রোণকে দ্রুপদ ভয়ের চোখে দেখবেন। মনে রাখা দরকার, মহাভারতের কবি এসব তাৎপর্যের কথা উল্লেখ করেননি। অতএব সরলভাবেই আমরা আপাতত দ্রোণের বিচার করব। ঠিক যেমনটি তিনি পরে তাঁর আত্মকাহিনী বলেছেন, সেইভাবে।
লোকপরম্পরায় দ্রুপদের রাজ্যাভিষেকের কথা শুনেই দ্রোণ ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। খুশির কারণ একটাই। তিনি ভেবেছিলেন—এবার তাঁর অভীষ্ট লাভ হবে—অভিষিক্তন্তু শ্রুত্বৈব কৃতার্থো’স্মীতি চিন্তয়ন্। পুত্ৰ-পরিবার সঙ্গে নিয়ে পঞ্চাল রাজধানীর পথে যেতে যেতে পাঞ্চাল দ্রুপদের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি মনে পড়ল। মনে পড়ল শেষ দিনের কথাও—রাজা হলে দ্রুপদ তাঁর প্রিয় বন্ধুকে আপন সম্পদের ওপর আত্মসম অধিকার দেবেন। এত কথা ভাবতে ভাবতেই পঞ্চালের রাজবাড়িতে উপস্থিত হলেন দ্রোণ। দ্রুপদের সঙ্গে যখন দেখা হল, তখন তিনি সিংহাসনে বসে আছেন। দ্রোণ সুউচ্চ সখা সম্বোধনে দ্রুপদকে উচ্চকিত করে দিয়ে বললেন—আমি তোমার বন্ধু বটে। মনে নেই আমাকে—সখায়ং বিদ্ধি মামিতি।
পাঞ্চাল দ্রুপদ অন্যায় করলেন। চিনেও তাঁকে চেনা দিলেন না দ্রুপদ। এমনটি হয়। নিজের চোখেই দেখেছি—এমনটি হয়। এককালে যারা অবিমিশ্র বন্ধুত্বের কথা বলেছে অনর্গল, কত সত্য, কত প্রতিজ্ঞা, কত আশ্বাস এবং কত কথামালা—আবার বছর কুড়ি পরে—তাদের সঙ্গে দেখা হলে সেই বন্ধুত্বের পুরাতন সত্যগুলি আর সজীব থাকে না। তখন যা সত্য ছিল, আন্তরিক ছিল, কালের ধূলায় মলিন হয়ে সেই সত্য, সেই আন্তরিকতা একেবারে অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। ভাবাবেগের সমস্ত তাড়না যেহেতু পরিণত বয়সে লুপ্ত হয়ে যায়, মানুষ তখন অনেক সময়েই কাজ করে তাৎক্ষণিক বাস্তববোধে। দ্রোণ যখন প্রকাশ্য রাজসভায় এসে দ্রুপদকে সখা সম্বোধনে সম্ভাষণ জানালেন, পাঞ্চাল দ্রুপদের মধ্যে তখন রাজকীয় সত্তা কাজ করছে। তিনি দরিদ্র ব্রাহ্মণকে একেবারেই আমল দিলেন না। সভার মধ্যে ওই সম্ভাষণ যেন অত্যন্ত হাস্যকর হয়েছে, সেইভাবেই যেন তিনি হেসে উঠলেন। মানুষের শরীরে কুৎসিত রোগের চিহ্ন প্রকাশ পেলে অন্য মানুষ তার সঙ্গে কথা বলবার সময় যেমন দূরত্ব বজায় রাখবার চেষ্টা করে, দ্রুপদ সেই দূরত্বে কথা বলতে আরম্ভ করলেন দ্রোণের সঙ্গে—স মাং নিরাকারমিব প্রহসন্নিদমব্রবীৎ! দ্রুপদের কথার ভাষাও ছিল অমার্জিত, অন্তত কাউকে একেবারে ‘ধান্দাবাজ’ মনে হলেও, যার সঙ্গে কোনও কালে প্রিয়ত্বের সম্বন্ধ ছিল, তার সঙ্গে মানুষ এইভাবে কথা বলে না।
দ্রুপদ বললেন—ব্রাহ্মণ! শিক্ষাদীক্ষা ভাল না থাকায় তোমার বুদ্ধি পরিপক্ক হয়নি—অকৃতেয়ং তব প্রজ্ঞা ব্রহ্মন্ নাতিসমঞ্জসা। ফলে কোন দেশের কোন রীতি, কোন সমাজে কোন ব্যবহার করতে হয় তাও তুমি জান না। দ্রুপদ এইটুকু বলেই থামলেন। তিনি যে দ্রোণকে চেনেন অথবা কোনও কালে চিনতেন, সে কথাও প্রকাশ হল না তাঁর প্রতি সম্বোধনে। ‘সখা’ সম্বোধনের প্রতিসম্বোধন ছিল শুধুই ‘ব্রাহ্মণ’। বরঞ্চ দ্রোণের দিক থেকে সখা সম্বোধনটুকু কত যে অন্যায় হয়েছে সেটা বোঝানোর জন্য দ্রুপদ বললেন—তুমি যে জোর করে আমাকে ‘সখা’ বলে ডাকলে, সে বিষয়ে উত্তর শোনো—কালে কালে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যেমন জীর্ণ জড় হয়ে ওঠে, পুরাতন বন্ধুত্বও তেমনই জীর্ণ হয় একসময়—সঙ্গতানীহ জীর্য্যন্তে। আগে যে একসময় তােমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, তার কারণ—আমরা একই উদ্দেশ্য নিয়ে একই জায়গায় থাকতাম বলে—সৌহৃদং মে ত্বয়া হ্যাসীৎ পূর্বং সামর্থবন্ধনম্। তা ছাড়া বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে—সাম্যান্ধি সখ্যং ভবতি—তখন আমরা গুরুর আশ্রমে সমান সমান ছিলাম, এখন নেই। তুমিই বলো, অব্রাহ্মণ কি কখনও ব্রাহ্মণের সখা হয়, অথবা রথচারী ব্যক্তি কি রথহীন ব্যক্তির সখা হয়? বন্ধুত্ব চিরকাল স্থায়ী হয় না, তখন কোনও কারণে তোমার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল, এখন তা নষ্ট হয়ে গেছে। সেই কালজীর্ণ বন্ধুত্বকে আশ্রয় করলে তোমার কাছে এখন তা ছলনা হয়ে দাঁড়াবে—মৈবং জীর্ণমুপাস্স্ব ত্বং সখ্যং ভবদুপাধিকৃৎ।
দ্রোণ মনে মনে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছিলেন। তবুও শেষ চেষ্টা সফল করার জন্য অথবা নিজের পুত্র পরিবারের সামনে নিজেরও অপমান ঢাকবার জন্যই তিনি নিশ্চয় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সেই অস্ত্রপাঠশালার দৈনন্দিন কথাবার্তা, স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন কোন অবসন্ন অবকাশে দ্রুপদ তাঁর বন্ধুকে রাজসুখ দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দ্রুপদ এসব প্রশ্নের সোজা উত্তর দেননি। কেবলই বলেছেন—তুমি নির্বোধ। দরিদ্র কখনও ধনীর সখা হয় না, মূর্খ কখনও পণ্ডিতের সখা হয় না, অথবা বলহীন ব্যক্তি কখনও বীরের সখা হয় না। সবচেয়ে বড় কথা—তুমি সেই পূর্বের বন্ধুত্ব এখন আবার ফিরে পেতে চাইছ। কেন—সখিপূর্বং কিমিষ্যতে? আমি যে রাজ্যের বিষয়ে তোমার কাছে কোনও অঙ্গীকার করেছি, এমন তো আমার স্মরণেও আসছে না—অহং ত্বয়া ন জানামি রাজ্যার্থে সংবিদং কৃতাম্।
দ্রুপদ পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন। রাজার রাজ্যপাট এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ মানুষকে অন্ধ করে তোলে বটে, তবে এত কঠিন ভাষায় দ্রুপদ দ্রোণকে কেন তিরস্কার করলেন, তা অনুমান করতে অসুবিধে হয়। একটা কথা অবশ্য এখানে না বললে নয়। দ্রুপদ যখন প্রিয় বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন—আমার যে রাজকীয় ভোগ, যে ধনসম্পদ লাভ হবে, তা তোমারও ভোগ্য হবে—মম ভোগাশ্চ বিত্তঞ্চ ত্বধীনং সুখানি চ। কিন্তু দ্রোণ বোধ হয় এই মুহূর্তে রাজকীয় ভোগসুখ বা ধন সম্পদের অধিকার চাননি, তিনি পূর্ব বন্ধুত্বের অঙ্গীকারে অর্ধেক রাজ্য চেয়ে বসেছেন দ্রুপদের কাছে, আর ঠিক সেই কারণেই দ্রুপদও এতটা অমার্জিত হয়ে উঠেছেন। রাজ্য না চাইলে দ্রুপদ হঠাৎ রাজ্যের প্রসঙ্গ তুলবেন কেন? কেন বলবেন—রাজ্যের ব্যাপারে কোনও কথা হয়নি তোমার সঙ্গে—ন জানামি রাজ্যার্থে সংবিদং কৃতাম্। পরেও যখন আমরা পাণ্ডব অর্জুনের কৃতিত্বে দ্রুপদকে মাথানত অবস্থায় দ্রোণের সামনে উপস্থিত দেখব, তখনও তিনি কিন্তু অর্ধেক পঞ্চালই জোর করে নিয়ে নিয়েছিলেন দ্রুপদের কাছ থেকে। কাজেই বন্ধুত্বের প্রতিজ্ঞা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্রোণ যদি হঠাৎ অর্ধেক রাজ্য দাবি করে থাকেন, তবে দ্রুপদের এই কঠিন ব্যবহার তখন খানিকটা সযৌক্তিকই হয়ে ওঠে। রাজকীয় ভোগসুখ, ধনসম্পদের অধিকার এক কথা, আর রাজ্যের অধিকার আর এক কথা। দ্রোণ এই অনুচিত দাবি করে থাকলে—দারিদ্র্যের তাড়নায় অথবা পূর্ব প্রতিজ্ঞার সুযোগ নিতে হয়তো তিনি তাই করেছেন—তা হলে দ্রুপদের দিক থেকেও তাঁর ওই অনুচিত ব্যবহার সযৌক্তিক হয়ে পড়ে।
দেখুন, এ বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। সেকালের দিনে একজন ক্ষত্রিয়ের মুখে প্রতিজ্ঞার অনেক মূল্য ছিল। বিশেষত পঞ্চালের মতো ব্রাহ্মণ্য প্রধান জনপদের ভাবী রাজা তাঁর বাল্যসখার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করেছেন, আর কয়েক বছর পরেই তিনি ছলনা করে সে প্রতিজ্ঞা উলটে দিলেন—এমন অসৎ ব্যবহার দ্রুপদের কাছে আশা করা যায় না। কাজের ফল দেখে যেহেতু কখনও কখনও কারণের অনুমান করা যায়, তাতেই অনুমান করি—দ্রোণ প্রতিজ্ঞাত বস্তুর চেয়ে বেশি কিছু চেয়েছেন। দারিদ্র্যের কারণেই হোক, অথবা ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণেই হোক, দ্রোণ দ্রুপদের কাছে রাজ্যের ভাগ চেয়েছেন। এতদিন অর্থ এবং জীবিকার সন্ধানে ঘুরে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে দ্রোণ এখন মরিয়া হয়ে উঠেছেন। অতএব খুব সহজে শুধু প্রতিজ্ঞাত সত্যের রূপায়ণে যা তাঁর প্রাপ্য হতে পারত—অর্থ, ধন, রাজসুখ—দ্রোণ তার চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি চেয়ে বসেছেন।
দ্রুপদ বলেছিলেন—আমি রাজা হলে আমার রাজ্য তোমারও ভোগ্য হবে—ত্বদ্ভোগ্যং ভবিতা রাজ্যম্। কথাটা আইনের দৃষ্টিতে যথেষ্ট পরিষ্কার—অর্থাৎ ভোগ স্বত্বের সঙ্গে দখলি স্বত্ব গুলিয়ে ফেলো না যেন। কী ধরনের ভোগ দ্রোণ পেতে পারেন অথবা দ্রুপদের রাজ্য কীভাবে দ্রোণের ভোগ্য হবে, সেটা তার পরের লাইনেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন দ্রুপদ। তিনি বলেছেন—মম ভোগাশ্চ—অর্থাৎ যা ভোগ করা যায় এমন। টীকাকার বলেছেন—ভোগ বলতে রাজকীয় ভোগ—হস্তী, অশ্ব, রথ ইত্যাদি যান ব্যবহারের সুখ। আর কী? ‘বিত্তঞ্চ’ অর্থাৎ উপার্জিত ধন এবং ‘সুখানি চ’ অর্থাৎ রাজারা যেসব বিলাসব্যসন ভোগ করেন সেই সুখ। এই প্রতিজ্ঞার প্রতিপক্ষে দ্রুপদ যখন দ্রোণকে প্রত্যাখ্যান করছেন, তখন বলছেন—রাজ্য নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার কোনও কথাই প্রতিজ্ঞাত হয়নি—অহং ত্বয়া ন জানামি রাজ্যার্থে সংবিদং কৃতাম্।
দ্রুপদের এই কঠোর প্রত্যাখ্যান শুনেই আমরা বুঝতে পারি যে, দ্রোণ কী চেয়েছিলেন এবং আরও বুঝতে পারি দ্রুপদ কেন তাঁর বন্ধুত্ব পর্যন্ত অস্বীকার করছেন। দ্রুপদ পূর্বপ্রণয়ের কথা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিয়ে দ্রোণকে বললেন—তুমি যখন প্রার্থী হয়ে এসেছ, তখন একরাত্রির উপযুক্ত সম্পূর্ণ ভোজন দিতে পারি তোমাকে, এর বেশি কিছু নয়—একরাত্ৰন্ত তে ব্রহ্মণ্ কামং দাস্যামি ভোজনম।
দ্রোণ চরমভাবে অপমানিত বোধ করলেন। দ্রুপদের দেওয়া সান্ধ্যভোজনের জন্য স্বাভাবিকভাবেই তিনি বসে রইলেন না। বরঞ্চ ‘ঠিক আছে, দেখে নেব’, ‘আমাকে অপমান করার ফল তুমি তাড়াতাড়িই বুঝবে’ ইত্যাদি ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা করে তিনি রওনা হলেন হস্তিনাপুর নগরের দিকে। রাগে অপমানে জ্বলতে জ্বলতে—মন্যুনাভিপরিপ্লুতঃ—পুত্ৰপরিবারকে সঙ্গে নিয়ে দ্রোণ আপন পরিকল্পনা অনুযায়ী হস্তিনাপুরের পথে পা বাড়ালেন—জগাম কুরুমুখ্যানাং নগরং নাগসাহ্বয়ম্।