দ্বি-বৈবাহিক কাঁটা – ৯

মধ্যাহ্ন বিরতির পর আদালত বসতেই নিরঞ্জন মাইতি এগিয়ে আসেন। জজসাহেবকে একটা অহেতুক বাও করে বললেন, এটিই আমার লাস্ট উইটনেস য়োর অনার : মিস্টার রজত গুপ্ত।

একজন পুলিশ অফিসার সংলগ্ন কক্ষের দ্বার খুলে দিলেন। ভি. আই. পি. পদক্ষেপে আদালতে প্রবেশ করলেন একজন সুদর্শন যুবাপুরুষ। স্যুটেড-বুটেড। সাক্ষীর মঞ্চে উঠে শপথবাক্য পাঠ করতে থাকে। এই অবসরে বাসু এগিয়ে এলেন আসামীর কাছে। অস্ফুটে বললেন, ‘অপ্রকাশ গুপ্ত?’

অপরাজিতা দাঁতে দাঁত চেপে বললে, ঐ বদমায়েশটার জন্যই আমার এত হেনস্থা! শয়তানটা আমার হাতে রিভলভারটা গছিয়ে দিয়ে…

বাসু ওর কর্ণমূলেই বললেন, স্থিরো ভব! ফরগেট হিম!’

—ভুলে যাব? ঐ নিমকহারাম বেইমানটাকে। কোনদিন ভুলব না!

বাসু ওর কানে কানে বললেন, ‘অন্য মনে চলি পথে, ভুলিনে কি ফুল, ভুলিনে কি তারা?’

মেয়েটি ম্লান হয়ে যায়। বাণবিদ্ধ হরিণীর মতো বাসুর দিতে তাকায়। উনি তার হাতে একটু চাপ দিয়ে ফিরে এসে বসেন নিজের আসনে। ইঙ্গিতে সুজাতাকে কাছে ডাকলেন। সে কাছে এলে বললেন, ঐ বসে আছে নির্মলা। ওর কাছে গিয়ে জেনে এস তো— ঐ ছোকরাই সেদিন ‘ক্যালকাটা ক্লেমস্ ব্যারো’র তরফে ওর বাড়িতে হানা দিয়েছিল কি না। আমার কাছে ফিরে এসে উত্তরটা জানাতে হবে না। আমি তোমার দিকে তাকালে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ জানাবে, কেমন?

সুজাতা ওদিকে এগিয়ে যায়।

মাইতি ততক্ষণে জেরা শুরু করে দিয়েছেন, নাউ মিস্টার গুপ্ত, নাম-ধাম তো বলেছেন, এবার বলুন আপনার প্রফেশনটা কী?

—আমি একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।

—ঐ যাকে চলতি বাংলায় বলে ‘গোয়েন্দা’, আর শরদিন্দুর মতো পণ্ডিতেরা বলতেন : ‘সত্যান্বেষী’? কেমন?

রজত গুপ্ত মৃদু হেসে বললে, তা বলতে পারেন।

—আপনার লাস্ট অ্যাসাইনমেন্ট কে দিয়েছিলেন? শেষ কাজটা?

—তাঁর নাম ছিল পরেশচন্দ্র পাল।

—ছিল? তিনি কি বেঁচে নেই?

—না। পরেশবাবু মারা গেছেন, তাঁর হত্যারহস্য নিয়েই তো এই মামলা হচ্ছে।

—তাই বুঝি? তা কবে তিনি আপনাকে এ কাজে এমপ্লয় করেন? কাজটা কী ছিল?

এ বছর ছয়ই জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দুপুরে। উনি আমার অফিসে এসে বললেন যে, পরদিন শুক্রবার সকালে ওঁর বারাসাতের বাড়িতে ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে একটি ভদ্রমহিলার দেখা করতে আসার কথা। উনি ঐ সময় কলকাতায় থাকতে পারছেন না। উনি জানতে চান— মহিলাটি আদৌ দেখা করতে এলেন কি না। মিস্টার পাল আমাকে সেই মহিলার একটি ফটোগ্রাফ দেখিয়ে বললেন, ‘ও ট্যাক্সি নিয়েও আসতে পারে অথবা নিজের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড চেপে, যার নম্বর WBF 9850।

—তারপর?

—আমি ওঁকে বললাম, ‘সে তো আপনি কলকাতায় ফিরে এসে আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।’ উনি আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, তাহলে আর পয়সা খরচা করে তোমাকে এমপ্লয় করব কেন?’

—তাই আপনি শুক্রবার, সাত তারিখ, সকালে পরেশ পালের বাড়ির কাছাকাছি লুকিয়ে রইলেন? কেমন?

স্পষ্টতই লিডিং কোশ্চেন। বাসু আপত্তি করলেন না। অপ্রয়োজনে। সাক্ষী বিস্তারিত বিবরণ দিল। ফটোতে দেখা মেয়েটি নির্দিষ্ট সময়ে ঐ স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি চেপেই এসেছিল। পরেশ পালের বাড়িতে ঘণ্টাখানেক থেকে ফিরে যায়। পরেশ পরে সাক্ষীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তথ্যটা জেনে নেয়।

—তারপর কী হল?

—তারপর সোমবার, দশ তারিখে মিস্টার পাল আবার দুপুরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন…

বাসু বাধা দেন, ইফ দ্য কোর্ট প্লিজ। প্রথমবার আমি বাদীপক্ষকে বাধা দিইনি, সময় সংক্ষেপের কারণে, কিন্তু বারে বারে এভাবে ‘হিয়ার সে’ রিপোর্ট বরদাস্ত করা চলে না।

মাইতি প্রতিবাদ করেন, এটা ‘রেজ জেস্টে র অংশমাত্র!

দায়রা জজ মাথা নেড়ে বললেন, নো কাউন্সেলর, আরও জোরালো এভিডেন্স ছাড়া এটাকে res gestae-র অংশ বলে মেনে নেওয়া চলে না। আপত্তি গ্রাহ্য হল।

মাইতি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ঠিক আছে। পরেশবাবুর নির্দেশানুসারে তুমি কী কী করলে বলে যাও?

রজত গুপ্ত বলতে থাকে, পরেশবাবুর নির্দেশানুসারে সে সোমবার দশ তারিখ সন্ধ্যা ছয়টার সময় তার নিজের গাড়ি নিয়ে বারাসাতে চলে আসে। পরেশ পাল তার গাড়ি নিয়ে রায়চৌধুরী ভিলার গেটের কাছাকাছি অপেক্ষা করছিল। সেটাই ছিল নির্ধারিত মিটিং পয়েন্ট। ওরা দুজনে দুখানা গাড়ি নিয়ে একটু নির্জনে সরে যায়। সেখানে পরেশবাবুর নির্দেশে ও নিজের গাড়ির নম্বর প্লেট দুটো বদলে ফেলে।

মাইতি জানতে চান : কেন?

—কেন বোঝাতে হলে আমাকে বলতে হয় আমার এমপ্লয়ার আমাকে কী বলেছিলেন; কিন্তু সে কথায় যে আদালতের আপত্তি। কী করে বোঝাব বলুন?

মাইতি অসহায়ভাবে বিচারকের দিকে তাকালেন।

বাসু বললেন, আমার মনে হয় আমার আপত্তি এখন উইথড্র করা উচিত। দিস হ্যাজ নাউ বিকাম পার্ট অব ‘রেজ জেস্টে’!

মাইতি বলেন, ‘থ্যাঙ্কু’! সাক্ষীকে বলেন, এবার বল, ‘কেন?’

রজত বলে, পরেশবাবু ওকে বলেছিলেন ঐ গাড়ি নিয়ে পুনরায় পরেশবাবুর বাড়ির কাছাকাছি থাকতে। সেদিনও রাত সাড়ে আটটায় সেই মেয়েটির আবার আসার কথা। এসেছে দেখলেই রজত ফিরে এসে একটা নির্দিষ্ট নির্জন স্থানে অপেক্ষা করবে। পরেশ পাল লুকিয়ে থাকবে আরও কিছুটা দূরে, রায়চৌধুরী ভিলার গেটের কাছাকাছি। রজত তার নিজের গাড়ির পিছনের চাকার হাওয়া বার করে দিয়ে অপেক্ষা করবে। ঐ মেয়েটির শহরে ফেরার এই একটাই রাস্তা। ফিরছে দেখলেই সে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে গাড়িটাকে রুখবে। অনুরোধ করবে তাকে একটা লিফ্ট দিতে— কয়েক কি. মি. দূরের একটা পেট্রল পাম্পে। সেখানে গিয়ে যাতে ও চাকায় হাওয়া দিয়ে নিতে পারে। পরেশ বলেছিল, পেট্রল পাম্পে ঐ মেয়েটি নির্ঘাৎ একটা জরুরি টেলিফোন করবে। তুমি যেমন করে পার লুকিয়ে থেকে শুনবে মেয়েটি কাকে টেলিফোন করে কী বলছে।

মাইতি বললেন, মিস্টার গুপ্ত! আপনি অনেক কিছুই বললেন, কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাবটা দিলেন না। গাড়ির নাম্বার প্লেট কেন বদলাতে হল?

—ও আয়াম সরি। পরেশবাবু চাননি যে, মেয়েটি বা কোন পথচারী আমার গাড়ির নম্বরটা মনে রাখে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে তদত্ত হলে আমার গাড়িটার কথা উঠলেও সেটাকে যাতে খুঁজে না পাওয়া যায়। এ জন্য দুটি নম্বর প্লেট উনি বানিয়েই এনেছিলেন। সে দুটি আমার গাড়িতে আমরা লাগিয়ে নিই।

—নম্বর প্লেটটা কত ছিল?

—WMW 1757।

—তারপর কী হল বলে যান।

রজত বলতে থাকে। সে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘মেয়েটি যদি গাড়ি না থামিয়ে আমাকে কাটিয়ে চলে যেতে চায়, তো আমি কী করব?’ পরেশ বলে, ওর পিছনের চাকায় ফায়ার করে গাড়িটা অচল করে দিও। ও বুঝতে পারবে না কেউ ফায়ার করেছে, ভাববে টায়ার বার্স্ট করেছে। গাড়ি থামাতে ও বাধ্য হবে।’ রজত তখন জবাবে জানায় যে, ওর কাছে ওর নিজের রিভলভারটা নেই। পরেশ বিরক্ত হয়। শেষে সে তার হিপ পকেট থেকে একটা ছোট্ট পয়েন্ট থ্রিটু রিভলভার বার করে রজতের হাতে দেয়। বলে, ‘এটা রাখ, কাজ খতম হলে ফেরত দিও।’ তারপর পরেশ ওকে বলে, সে রায়চৌধুরী ভিলার কাছাকাছি আবছায়ায় গাড়িটা পার্ক করে অপেক্ষা করবে রাত এগারোটা পর্যন্ত। রজত যেন এসে রিপোর্ট করে। একটা জোরালো বিদেশী ছোট্ট টেপ রেকর্ডারও পরেশ রজতকে দিয়েছিল। বলেছিল, মেয়েটি টেলিফোনে কথা বলতে শুরু করলেই তুমি তার কথা রেকর্ড করে নিও।

মাইতি বলেন, তারপর?

রজত বর্ণনা দেয়, কী ভাবে সে অপরাজিতাকে মাঝপথে রুখে দেয়। টায়ার ফাটাতে হয়নি, কিন্তু মেয়েটির বিশ্বাস উৎপাদন করার প্রয়োজনে তাকে রিভলভারটা হস্তান্তর করতে হয়। মাইতির প্রশ্নোত্তরে রজত আরও জানায় পরেশের কাছ থেকে রিভলভারটি হাতে পেয়েই সে প্রথামাফিক পরীক্ষা করে দেখে নেয় যে, তাতে ছয়টাই তাজা বুলেট ছিল। তারপর যা যা ঘটে— অর্থাৎ অপরাজিতা বাসুসাহেবকে ঠিক যা যা বলেছিল— তাই রজত তার জবানবন্দিতে বলে যায়। এমন কি মেয়েটির সঙ্গে তার শেষ দিকে যে রোমান্টিক কথাবার্তা হয়— রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি পর্যন্ত, অকপটে স্বীকার করে।

মাইতি বলেন, টেপ রেকর্ডারটা আপনার সঙ্গে আছে? থাকলে বাজিয়ে আদালতকে শোনান।

রজত তার হিপ পকেট থেকে ছোট্ট একটা টেপ রেকর্ডার বার করে বাজিয়ে শোনালো। দারুণ নিখুঁত যন্ত্রটা। স্পষ্ট শোনা গেল অপরাজিতার কণ্ঠস্বর— প্রথমে ইংরেজিতে ‘এটা কি এয়ারপোর্ট হোটেল?… আপনাদের ডাইনিং রুমের এক্সটেনশন নম্বরে আমাকে দিন… ইজ দ্যাট ডাইনিং রুম?… কুড আই টক টু মিস্টার পি. কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল? হি মাস্ট বি… ওয়েল, ইয়েস, ইয়েস। থ্যাঙ্কু।’ এরপর বাংলায় … ‘শুভসন্ধ্যা! আমি অপরাজিতা বলছি।… বারাসাত থেকে মাইল চারেক দমদমের দিকে একটা পেট্রল পাম্প থেকে।… এভরিথিং ফাইন স্যার, কেউ কিছু সন্দেহ করেনি।’—থেকে ‘এরকম লোককে তো গুলি করে মেরে ফেলা উচিত!’… এবং তারপর ‘আপনি চিন্তা করবেন না স্যার, আমার হাতে এখন একটা রিভলভার আছে। তাতে ছয়-ছয়টা তাজা বুলেট!’ পর্যন্ত।

মাইতি বললেন, এনাফ! আর শোনাতে হবে না।

রজত যন্ত্রটা সুইচ অফ করে দিল। বাসু আপত্তি জানালেন : আমরা পুরো টেকরেকর্ডিংটা শুনতে চাই!

মাইতি বলেন, বাকিটা এ মামলার পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক।

বাসু বলেন, সেটা হয় তো বাদীপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে।

বিচারক দুপক্ষের বাদানুবাদ থামিয়ে দিয়ে নির্দেশ দেন, বাকি একতরফা কথোপকথনটাও বাজিয়ে শোনাতে হবে। ফলে রজতকে সেটা শোনাতে হল। পরদিন সকালে সাড়ে দশটায় বাসুসাহেবের অফিসে আসবে বলে কথা দেওয়া পর্যন্ত। টেপ রেকর্ডারটা আদালতে জমা পড়ল।

মাইতি জানতে চান, তারপর কী হল?

রজত বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। অপরাজিতা আর রজত দুজন দুদিকে রওনা হওয়া পর্যন্ত। তখন রাত দশটা দশ।

মাইতি জানতে চান : তারপর কী হল?

—মিস্টার পালের ইন্সট্রাকশন ছিল ওঁকে যেন রিপোর্ট করি ঐ রায়চৌধুরী ভিলার গেটের কাছে। সেখানে উনি আমার জন্য রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। ভদ্রমহিলার গাড়ি বাঁকের মুখে মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল : রিভলভারটা ফেরত নেওয়া হয়নি। হয়তো সেজন্য পরেশবাবু রাগারাগি করবেন; কিন্তু ওঁর গাড়ির নম্বরটা আমার মনে ছিল; ফলে রিভলভারটা ফিরে পাওয়া কষ্টকর হবে না। তাই গাড়ি ঘুরিয়ে আমি রায়চৌধুরী ভিলার দিকে ফিরে আসতে থাকি। কিন্তু কিছু দূর থেকেই দেখতে পাই ঐ বাগানবাড়ির গেটের বিপরীত দিকে পার্কিং করা আছে ঐ মহিলার গাড়িখানা। WBF 9850— আমি বুঝতে পারি, ঐ মহিলাটিও ফিরে এসেছেন। বিদায়কালে আমি যেমন লক্ষ্য করেছিলাম যে, রায়চৌধুরী ভিলার কাছাকাছি, একটু আবছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে পরেশবাবুর ঐ 2457 নম্বর গাড়িটা, উনিও নিশ্চয় তা লক্ষ্য করেছেন। আমার আরও মনে হল, মহিলাটি পরেশবাবুর পরিচিতা। তাই স্ত্রীর উপস্থিতিতে উনি তার সঙ্গে দেখা করতে চান না। তার মানে ভদ্রমহিলাও পরেশবাবুর গাড়ির নম্বর জানেন। তাই আমি পুনরায় গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের বাড়ি চলে যাই। রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা হবে।

—সেই সময় পরেশচন্দ্রের WBF 2457 গাড়িটা ওখানে ছিল?

—ছিল। পরেশবাবুকেও দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলাম— গাড়ির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সিগ্রেট টানছেন।

—আসামীকে ঘটনাস্থলের কাছাকাছি দেখতে পাননি?

—নো স্যার। তিনি তাঁর নিজের গাড়ির ভিতর ছিলেন কি না জানি না। কারণ তাঁর গাড়ির সব আলো নেভানো ছিল। তবে তাঁকে কোথাও দেখতে পাইনি।

মাইতি বললেন, তারপর আপনার এমপ্লয়ারকে টেপ রেকর্ডিংটা কখন শোনালেন?

—কোথায় আর শোনালাম, স্যার? পরদিন তো পরেশবাবুর পাত্তাই পেলাম না কোথাও। তারপর সন্ধ্যার এডিশন ট্যাবলয়েড পেপারে দেখলাম পরেশচন্দ্র পাল খুন হয়েছেন ঐ রাত্রেই। রায়চৌধুরী ভিলার গেটের কাছাকাছি।

মাইতি এবার বাসুসাহেবের দিকে ফিরে পুনরায় একটি অহেতুক বাও করে বললেন, য়োর উইটনেস স্যার!

বাসু এগিয়ে এসে বললেন, মিস্টার গুপ্ত, পরেশবাবু যখন আপনাকে রিভলভারটা দেন তখন আপনি কি তার নম্বরটা দেখেছিলেন, বা টুকে রেখেছিলেন?

—না, স্যার।

—তাহলে আপনি বলতে পারেন না যে, পিপলস্ একজিবিট ‘A’-টাই সেই রিভলভার?

—হুবহু একই রকম রিভলভার দুটো।

—আপনি একজন লাইসেন্সড প্রাইভেট ডিটেকটিভ। সো, আই রিপিট : তাহলে আপনি কি হলপ নিয়ে বলতে পারেন যে, পিপলস্ একজিবিট ‘A’-টা সেই রিভলভার?

—না স্যার, তা বলতে পারি না।

—আপনাকে আপনার এমপ্লয়ার নির্দেশ দিয়েছিল মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমাতে, তার বিশ্বাস উৎপাদন করতে, যাতে সে আপনাকে পেট্রল পাম্প পর্যন্ত নিয়ে যায়, কারণ পরেশচন্দ্র জানত, পেট্রল পাম্পে টেলিফোন আছে। সেখানে গেলেই সে জরুরি প্রয়োজনে একটি ফোন করবে। ফোনে মেয়েটি কাকে কী বলল এইটুকুই পরেশবাবু চুরি করে জানতে চেয়েছিল, তাই নয় কি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই।

—সেজন্যই ওর কোলে রিভলভারটা ফেলে দিয়েছিলেন?

—হ্যাঁ। ওঁর বিশ্বাস উৎপাদন করতে।

—যাতে আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগটা পান?

—না। যাতে আমি আমার এমপ্লয়ারকে রিপোর্ট করতে পারি।

—এক মুঠো টাকার জন্য আপনি মিথ্যা করে বললেন যে, আপনার গাড়ির টায়ার বার্স্ট করেছে? সজ্ঞান মিথ্যাভাষণ?

—এটা আমার প্রফেশন, স্যার। আমাকে রোজগার করতে হয়! আমার সংসার আছে, আমার…

—আনসার দ্য কোশ্চেন : এক মুঠো টাকার জন্য আপনি বিশ্বাসঘাতকতা করতে প্রস্তুত, সজ্ঞান মিথ্যাভাষণে প্রস্তুত?

—কী আশ্চর্য! আপনি বুঝতে চাইছেন না, প্রফেশনের জন্য আমাকে অনেক কিছুই করতে হয়।

—মিস্টার গুপ্ত, আমি ক্রমাগত ঐ একই প্রশ্ন করে যাব, যতক্ষণ না আপনি আমার প্রশ্নের জবাবে সরাসরি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলেন। নাউ আনসার দ্য কোশ্চেন : এক মুঠো টাকা উপার্জনের জন্য আপনি আপনার উপকারীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে প্রস্তুত? সজ্ঞান মিথ্যাভাষণে প্রস্তুত?

রজত গুপ্ত গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মাইতি হঠাৎ উঠে দাঁড়ান : অবজেকশন, য়োর অনার। এটা সাক্ষীর একটা ‘কনক্লুশন’!

জাজ আনসারি বললেন, অবজেকশন ওভাররুল্ড। আনসার দ্যাট কোশ্চেন!

রজত বলল, তাই যদি আপনি আমাকে দিয়ে বলাতে চান, তো তাই বলছি : হ্যাঁ!

—একজ্যাক্টলি। তাই আমি তোমাকে স্বমুখে স্বীকার করাতে চাইছিলাম। যাতে তোমার চরিত্রটা আদালত সমঝে নিতে পারেন। এবার বল, বিশ্বাসঘাতকতা সম্পন্ন করার পর, টেপরেকর্ডারে তোমার উপকারীর কণ্ঠস্বর ধরে ফেলার পর, ওকে কেন রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি শুনিয়েছিলে? তখন তো দুমুঠো টাকা রোজগারের ধান্দা তোমার ছিল না?

রজতের মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে। বাসুর বাচনভঙ্গিতে, আপনি থেকে হঠাৎ তুমি’-তে অবতরণের অবজ্ঞায়। বলে, কী বলতে চাইছেন? রবীন্দ্রনাথের কী উদ্ধৃতি আমি শুনিয়েছি?

—না শোনাওনি। শুনেছ ‘অন্যমনে চলি পথে, ভুলিনে কি ফুল, ভুলিনে কি তারা?’ – শুনেছ, তা এনজয় করার অভিনয় করেছ, এবং তার আগে ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্ৰন্থী’ পংক্তিটার ইঙ্গিত দিয়েছ! কেন, মিস্টার সত্যান্বেষী? এই মিথ্যা রোমান্টিকতার দৃষ্টির পিছনে তো দুমুঠো টাকা রোজগারের ধান্দাবাজি ছিল না?

মাইতি পুনরায় আপত্তি তোলেন। এবার আপত্তি গ্রাহ্য হল।

বাসু বললেন, দ্যাটস্ অল!

মাইতি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, বাদীপক্ষের এই শেষ সাক্ষী। আমরা কনক্লুড করছি। এখন পরিষ্কার প্রমাণিত হল যে, এই সাক্ষী রাত দশটা কুড়ি মিনিটে পরেশ পালকে জীবিত অবস্থায় দেখেছে— রায়চৌধুরী ভিলার গেটের সামনে সিগারেট টানতে। দেখেছে, আসামীর গাড়িটা কাছাকাছি পার্ক করা আছে। তখন আসামীর এক্তিয়ারে রয়েছে একটা লোডেড রিভলভার। আসামী স্বমুখে স্বীকার করেছে সে রাতে তার হেপাজতে একটি লোডেড রিভলভার ছিল, যাতে ছয়টি তাজা বুলেট— আই রিপিট : ছয়-ছয়টি তাজা বুলেট!’ তার পরদিন সকালে আসামী অকুস্থলে পুনরায় এসে হাজির হয়। এটা মার্ডারারদের একটা সাধারণ ‘অবসেশন’— খুনের ঘটনাস্থলে ফিরে আসা সে যাই হোক, মালি সুবলচন্দ্রের সাক্ষ্যে আমরা জেনেছি, আসামী কালো মতন কোন ভারি বস্তু….

বাসু এ সময় বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, সহযোগী কি মামলার মাঝামাঝি আর্গুমেন্টটা চুকিয়ে ফেলতে চাইছেন?

মাইতি বললেন, না। আমি ‘সাম আপ’ করছিলাম মাত্র।

আনসারি বলেন, মিস্টার বাসু, আপনার কোন সাক্ষী আছে?

—আছে, য়োর অনার; কিন্তু তার পূর্বে আমি বাদীপক্ষের ঐ ‘সাম আপ’ আর শেষ সাক্ষী সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। আমার মতে : ঐ শেষ সাক্ষীটিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে গেল : আসামী নির্দোষ!

মাইতি উঠে দাঁড়ান। বলেন : তাই নাকি? সেটা কোন্ যুক্তিতে?

—বাদীপক্ষের উপস্থাপিত এভিডেন্স অনুসারে আসামীর চেয়ে সন্দেহের আঙুলটা যখন ঐ শেষ সাক্ষীর দিকেই বেশি করে নির্দেশ করছে। আসামী নাকি টেলিফোনে তার সলিসিটরকে বলেছিল যে, তার রিভলভারে ‘ছয়-ছয়টা তাজা বুলেট! কিন্তু আসামী রিভলভার সম্বন্ধে কী জানে? হয়তো সে শুধু সিনেমাতেই ঐ বস্তুটা দেখেছে। চেম্বার খুলে ইডেন্টেশন মার্ক লক্ষ্য করে কী ভাবে তাজা আর ব্যয়িত বুলেট চিনতে হয়, তা কি ঐ মেয়েটি জানে? কাউকে খুন করার বাসনা যদি থাকে তাহলে কেউ কখনো টেলিফোনে ওভাবে বড়াই করতে পারে? অপরপক্ষে এক্সপার্টের মতে, মৃত্যুর সময় সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত এগারোটা। ঐ সময়কালের মধ্যে এ দুনিয়ায় একজন, মাত্র একজন ব্যক্তি, নিজ স্বীকৃতিমতে নির্জনে মৃতব্যক্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। সেই ব্যক্তি ঐ শেষ সাক্ষী। নিজ স্বীকৃতিমতে সে সময় তার হাতে একটি রিভলভার। সে গোয়েন্দা, তার নিজের রিভলভার আছে। সে জানে, ‘ছয়-ছয়টা তাজা বুলেট’ কাকে বলে, কীভাবে তা চিনে নিতে হয়। নিজ স্বীকৃতিমতে দুটো টাকা উপার্জনের জন্য সে বিশ্বাসঘাতকতা করতে প্রস্তুত, মিথ্যা কথাও বলতে স্বীকৃত! অবশ্য দুই-এর বদলে চার টাকা পেলে সে হলফ নিয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারে কি না, তা আমরা জানি না। কিন্তু আমরা একথা নিশ্চিতভাবে জানি, সহযোগী, বাদীপক্ষের অ্যাডভোকেট, কলকাতা থেকে এতদূর ছুটে আসতে পারলেন অথচ সাহস করে একটা সহজ, সরল, প্রত্যাশিত প্রশ্ন সাক্ষীকে একবারও জিজ্ঞাসা করতে পারলেন না। কোট : বাপু হে! তুমিই কি পরেশ পাল ওরফে সুশোভন রায়কে খুন করেছ?— আনকোট!

বলেই বাসু আসন গ্রহণ করলেন।

যেন ‘সি-স’ খেলা। তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন মাইতি। বললেন, য়োর অনার, এটা কী হল? এমন অন্তঃসারহীন, অবাস্তব, অসম্ভব আর্গুমেন্ট আমি জীবনে শুনিনি।… ঠিক আছে, আমরা আদালতের কাছে আর্জি রাখছি, বাদীপক্ষকে তাদের কেস ‘রি-ওপেন’ করার অনুমতি দেওয়া হোক। তাহলে ঐ শেষ সাক্ষীটিকে আমরা সাক্ষীর মঞ্চে আর একবার তুলে ঐ বাহুল্য প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতে পারি।

বাসু সহাস্যে বললেন, প্রতিবাদী-তরফে এতে আপত্তির কিছু নেই।

মাইতি ঋষভ কণ্ঠে গর্জন করে ওঠেন : মিস্টার রজত গুপ্ত, প্লিজ। আপনি সাক্ষীর মঞ্চে আর একবার উঠে দাঁড়ান।

রজত গুপ্ত পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সাক্ষীর মঞ্চে উঠে দাঁড়ায়।

—তুমিই কি পরেশ পাল ওরফে সুশোভন রায়কে খুন করেছ?

—না!

—দ্যাটস্ অল! এবার তুমি নেমে আসতে পার!

—জাস্ট এ মিনিট বাসু উঠে দাঁড়িয়েছেন। বলেন কেস আপনি রি-ওপেন করেছেন, ফলে আমার জেরাটা বাকি আছে মাইতিসাহেব! মিস্টার গুপ্ত, আপনাকে মিস্টার পরেশচন্দ্র পাল প্রথম কবে গোয়েন্দাগিরিতে নিয়োগ করেছিলেন?

—অবজেকশন, য়োর অনার! এ প্রশ্ন আমরা আগেই করেছি এবং সাক্ষী তার জবাবও দিয়েছেন।

জাজ আনসারি বলেন, আই থিংক দ্য পি. পি. ইজ কারেক্ট। আপনি এ বিষয়ে কিছু বলবেন, মিস্টার বাসু?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। সহযোগীর প্রশ্নটা ছিল, —যতদূর আমার মনে আছে— ‘কবে তিনি একাজে আপনাকে এমপ্লয় করেন?’ আমার প্রশ্নটা ছিল ‘প্রথম কবে মিস্টার পাল ওঁকে গোয়েন্দা হিসাবে . নিয়োগ করেন?’

মাইতি বলেন, দুটো তো একই প্রশ্ন!

—আমি তা মনে করি না। ‘একাজে’ নিযুক্ত করার পূর্বেও মিস্টার পাল তাঁকে ‘অন্য কাজে’ নিয়োগ করে থাকতে পারেন। সাক্ষীর জবানবন্দিতে আমরা শুনেছি, পরেশচন্দ্র প্রথম সাক্ষাতেই সাক্ষীকে ‘তুমি’ সম্বোধন করছেন। কলকাতায় এত এত গোয়েন্দা থাকতে পূর্বপরিচয় ছাড়া পরেশবাবু কেমন করে ওঁকেই বা বেছে নিলেন এবং প্রথম সম্বোধনেই সমবয়সীকে কেন ‘তুমি’ সম্বোধন করলেন। এটা জানতে আমরা আগ্রহী।

বিচারক বললেন, কারেক্ট। অবজেকশন ইজ ওভাররুল্ড। প্রশ্নটার জবাব দিন

রজত এবার বলল, প্রায় তিন বছর আগে!

—হোয়াট! —চীৎকার করে ওঠেন মাইতি! কই, তুমি তো এ কথা আমাকে একবারও বলনি?

বাসু এদিকে ফিরে বলেন, আপনি কি ‘রি-ডাইরেক্ট’ শুরু করলেন, মিস্টার মাইতি? আমি, কিন্তু আমার জেরা শেষ করিনি।

মাইতি গুম হয়ে বসে পড়েন।

বাসু সাক্ষীর কাছে জানতে চাইলেন, প্রায় তিন বছর আগে মিস্টার পরেশ পাল আপনাকে দুই সেট ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে বলেছিলেন যে, কোন একজন ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে দিয়ে পরীক্ষা করাতে। তাই নয়?

— ইয়েস স্যার!

—আপনি পরীক্ষা করিয়ে দেখেছিলেন, সেই দুই সেট ফিঙ্গারপ্রিন্ট একই লোকের। ঠিক কি না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক।

—একসেট ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছিল দশটা আঙুলের টিপছাপের জেরক্স কপি, দ্বিতীয়টা কয়েকটি আঙুলের ছাপ। অ্যাম আই কারেক্ট?

— ইয়েস স্যার।

—আপনার দুরন্ত কৌতূহল জাগ্রত হল?

—হ্যাঁ, কিছুটা কৌতূহল জেগেছিল বৈ কি।

— না, না, কিছুটা কৌতূহল হলে আপনি ঐ দুই সেট টিপছাপের জেরক্স কপি করাবেন কেন? নাউ, বিফোর য়ু আনসার, মনে রাখবেন আপনি হলফ নিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন!

—আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার বেশ কিছুটা কৌতূহল হয়েছিল। —সেজন্যই দুই সেট জেরক্স কপি তৈরি করান?

—হ্যাঁ, ব্যাপারটা আমার কাছে সন্দেহজনক লেগেছিল।

—’সন্দেহজনক’ কী বলছেন? আপনি লাইসেন্সড গোয়েন্দা! স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন, ঐ দশটা আঙুলের ছাপ পুলিশ রেকর্ড থেকে সংগ্রহ করা কোন একজন দাগী আসামীর। তাই নয়?

—হ্যাঁ, সেটা অনুমান করা শক্ত নয়।

—সেজন্যই লাইসেন্সড গোয়েন্দা হওয়ার সুযোগে লালবাজারের রেকর্ড থেকে ঐ দাগী তসামীর পরিচয়টা জানবার চেষ্টা করেন এবং সাফল্যলাভ করেন?

—দেখুন স্যার… আমি… মানে…

—আনসার মি, ইয়েস’ অর ‘নো’! জ্ঞাতসারে মিথ্যা সাক্ষী দেবেন না। আই ওয়ার্ন য়ু!

—ইয়েস!

—সেই দাগী আসামীটির নাম ‘চাঁদু রায়’! কেমন?

—ইয়েস!

—আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, কীভাবে পরেশ পাল মাত্র তিন বছরের মধ্যে ফুলে- ফেঁপে উঠল। গাড়ি-বাড়ি বানালো। আপনি তিন বছর ধরে জানেন, পুলিশ জানে না, কিন্তু পরেশ পাল জানে; চাঁদু রায়ের বর্তমান পরিচয়টা কী? পরেশ ব্ল্যাকমেলিং-এ লাখপতি হচ্ছে!

সাক্ষী ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

—সেদিন থেকেই আপনি নিজেও পরেশ পালকে ব্ল্যাকমেলিং করতে শুরু করেন, হুমকি দিয়ে যে, আপনার কাছে যে জেরক্স কপি আছে তা লালবাজারে জমা দিলে পরেশ পালের ব্ল্যাকমেলিং-এর খেলা সাঙ্গ হবে। উপরন্তু পরেশের জেল হয়ে যাবে। তাই না?

—আমি ওরকম কিছু করিনি। আমি দৃঢ় আপত্তি জানাচ্ছি।

—তাই বুঝি? দৃঢ় আপত্তি? অলরাইট, এই তিনবছরে আপনি ওর কাছ থেকে কত টাকা নিয়েছেন?

—গোয়েন্দা হিসাবে শুধুমাত্র প্রফেশনাল ফি-টুকু।

—আই নো, আই নো! টাকার অঙ্কে সেটা কত? দশ হাজার?

—বললাম তো! আমার সার্ভিসের ফি-টুকু। টাকার অঙ্ক মনে নেই। -বিশ হাজার টাকা? তিন বছরে?

—হতে পারে।

—বছরে গড়ে দশ? তিন বছরে : ত্রিশ হাজার?

—বলছি তো, আমার মনে নেই…

—পঞ্চাশ হাজারের বেশি?

—না, না, অত হবে না।

—তবে অন্তত চল্লিশ হাজারের উপর?

—বলছি তো, আমার মনে নেই।

আদালতের দিকে ফিরে বাসু বলেন, য়োর অনার! পয়সা পেলে এই ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করতে রাজি, মিথ্যা কথা বলতে রাজি। ব্ল্যাকমেলিং যে করেন তা নিজ মুখে এখনি স্বীকার করলেন। এমন একটি গোয়েন্দা— সহযোগীর ভাষায় ‘সত্যান্বেষী’— নিহত ব্যক্তিকে জীবন্ত অবস্থায় শেষবার দেখেছেন। দেখেছেন নির্জনে এবং এমন একটা সময়ে, যখন অটোপ্সি সার্জেনের মতে মৃত্যুটা সংঘটিত হয়েছিল। আর ঐ সময় নিজ স্বীকৃতিমতে তাঁর হাতে ছিল মার্ডার ওয়েপন, যার নম্বরটা একজন প্রফেশনাল গোয়েন্দা হওয়া সত্ত্বেও তিনি অস্ত্রটা গ্রহণ করার সময় টুকে রাখেননি, অথচ সিলিন্ডার খুলে দেখে নিয়েছেন, তাতে ছয়-ছয়টা তাজা বুলেট! আমার আর কিছু বলার নেই। আদালত নিজ সিদ্ধান্তে আসবেন।

দায়রা জজ আনসারি সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ফিঙ্গারপ্রিন্টের কথাটা আপনি কী করে আবিষ্কার করলেন?

মাইতি বলে ওঠেন, স্রেফ আন্দাজে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ে, য়োর অনার

আনসারি ভর্ৎসনামিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, তাহলে বলতে হবে অদ্ভুত ওঁর টিপ। আন্দাজে অন্ধকারে উনি বুলস্ আইয়ের কেন্দ্রবিন্দুটা বিদ্ধ করেছেন। বলুন মিস্টার বাসু, হঠাৎ ফিঙ্গারপ্রিন্টের কথা কেন মনে এল আপনার?

বাসু উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনি আমাকে বলতে বাধ্য করলেন তাই বলি; বাদীপক্ষের অপদার্থতায়! সহযোগী তাঁর আর্গুমেন্ট করেননি, কিন্তু সকাল থেকে যে দশ-পনেরজন তাঁর তরফে সাক্ষী দিলেন তাঁদের সাক্ষ্য ‘সাম-আপ’ সমাপ্ত করেছেন। সে সময় আসামীর মোটিভ সম্বন্ধে তিনি একটিমাত্র বাক্যও উচ্চারণ করেননি। আমরা জেনেছি, অপরাজিতা কর আর সুশোভন রায় একই বাড়িতে থাকে। দীর্ঘদিন! এদের মধ্যে একে অপরজনকে কেন হত্যা করবে? কী উদ্দেশ্য? বাদীপক্ষ এ বিষয়ে নীরব! ফলে, আমাকে অন্যান্য বিষয়ে তদন্ত করতে হয়েছে- যে কাজ ছিল আরক্ষা বিভাগের, তাই আমাকে করতে হয়েছে। আর সেজন্যই আমি এমন অনেক তথ্য জানি, যা সহযোগী জানেন না।

আনসারি ঝুঁকে পড়ে বলেন, আপনি জানেন, কে, কোন্ উদ্দেশ্যে এই খুনটা করেছে?

বাসু ক্ষণকাল নতমস্তকে অপেক্ষা করে বললেন, এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কি প্রকাশ্য আদালতে শোভন হবে, য়োর অনার?

জাজ নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, আদালত বন্ধ হলে আপনারা দুজন, মিস্টার মাইতি এবং আপনি, আমার চেম্বারে দেখা করে যাবেন। নাউ, আপনি কি প্রতিবাদী পক্ষের কোন সাক্ষীকে মঞ্চে তুলবেন?

—আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার বিরুদ্ধে যিনি এক কোটি টাকার ড্যামেজ স্যুট করেছেন। তবে ঐ কারণেই প্রথম থেকে তাঁকে আমি ‘হোস্টাইল উইটনেস’ হিসাবে লিডিং প্রশ্ন করার আর্জি রাখছি।

দায়রা জাজ বললেন, ইয়েস, আপনি লিডিং প্রশ্ন করতে পারেন। দ্য উইটনেস, বাই ভার্চু অব হিজ ল-স্যুট, একজন হোস্টাইল উইটনেস।

বাসু বললেন, মিস্টার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, প্লিজ টেক য়োর সিট অন দ্য উইটনেস স্ট্যান্ড।