দ্বি-বৈবাহিক কাঁটা – ৮

বুধবার, উনিশে জানুয়ারি, সকালে বারাসাতে চব্বিশ পরগনা নর্থের দায়রা জজের আদালত বসল।

অভিজ্ঞ বিচারক টি. কে. আনসারি আদালতের উপর চোখ বুলিয়ে দেখলেন। আদালতে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তার কারণ একাধিক। প্রথমত, খুনী আসামী তরুণী, অবিবাহিতা, সেলস গার্ল। দ্বিতীয়ত, কাগজে নানান সাংবাদিক ঘটনাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেছেন। কেউ কেউ এ কথাও ইঙ্গিতে বলেছেন যে, নিহত ব্যক্তি নাকি হিন্দু ম্যারেজ-অ্যাক্টকে কদলী প্রদর্শন করে দু-দুটি বিবি পুষতেন— দুটি বিভিন্ন স্থানে। সাংবাদিকের মতে, নিহত ব্যক্তির বিশ্বাস ছিল, ‘নাল্পে সুখমস্তি’। মহিলা সেলস গার্লের দিকে তাই হাত বাড়িয়েছিলেন। ফলে ভূমৈব সুখম’ বস্তুটা কী তা অস্থিতে অস্থিতে বুঝতে পেরেছেন। তৃতীয়ত, বারাসাতের এক স্বনামখ্যাত ধনকুবের নাকি এক বিখ্যাত ব্যারিস্টারের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার সিভিল স্যুট এনেছেন। এই মামলারই সেটি এক শাখা মামলা।

বাদী-প্রতিবাদী প্রস্তুত কি না জেনে নিয়ে এবং আসামী তার চেয়ারে বসে আছে দেখে নিয়ে বিচারক লক্ষ্য করলেন, বাদীপক্ষে কলকাতার পাবলিক প্রসিকিউটর নিরঞ্জন মাইতিও উপস্থিত। যদিও জেলার পি. পি. সখারাম হাজরাও হাজিরা দিয়েছিলেন বাদীপক্ষে।

বিচারক বলেন, মিস্টার পি. পি., আপনি আপনার প্রথম সাক্ষীকে আহ্বান করতে পারেন।

তৎক্ষণাৎ তড়াক করে উঠে দাঁড়ান মাইতি সাহেব। একটি ‘বাও’ করে বলেন, ইফ দ্য কোর্ট প্লিজ, বিচার শুরু হওয়ার আগেই আমি একটি বিষয়ে হুজুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আদালতে একটি ‘মোশন’ পেন্ডিং আছে, এই মামলা সংক্রান্ত আবেদনই। বারাসাতের শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী হুজুরের কাছে আবেদন করেছেন তাঁর নামে যে সমন প্রতিবাদী পক্ষ থেকে জারি করা হয়েছে সেটা ‘কোয়াশ’ করতে।

—কী কারণ দেখিয়ে? —জানতে চাইলেন দায়রা জজ।

মাইতি বললেন, মিস্টার চৌধুরীর পক্ষের আইনজীবীরাও আদালতে উপস্থিত আছেন। কিন্তু সাধারণভাবে আমি আদালতে একথা পেশ করতে পারি যে, আবেদনকারীর মতে প্রতিবাদী পক্ষের ব্যরিস্টার মিস্টার পি. কে. বাসু তাঁর আদালত প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে মিস্টার চৌধুরীর পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামে বাধা সৃষ্টি করা ছাড়া প্রতিবাদীর অ্যাটর্নির আর কোন উদ্দেশ্য নেই। মিস্টার চৌধুরী আগামীকাল টোকিয়োতে একটি কনফারেন্সে যোগ দিতে আহূত হয়েছেন। সেটাকে বানচাল করাই মিস্টার বাসুর একমাত্র উদ্দেশ্য।

বিচারক বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, আপনার মতে মিস্টার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সাক্ষ্য আবশ্যিক?

—আমি তাই মনে করি, য়োর অনার

মাইতি পুনরায় বলেন, ইফ দ্য কোর্ট প্লিজ, মিস্টার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী না চেনেন আসামীকে, না নিহত ব্যক্তিকে। তাঁর বাড়ির দারোয়ান, মালি, একাত্তসচিব ইত্যাদি অনেকের সাক্ষ্য হয়তো প্রয়োজন হবে — বাদীর অথবা প্রতিবাদীর— কিন্তু মিস্টার চৌধুরীর সাক্ষ্যে প্রতিবাদীর আইনজীবী ঠিক কী প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন? তা জানালে আমরা তা স্টিপুলেট করে দিতে পারি।

বাসুর দিকে ফিরে জাজ আনসারি জানতে চান, আপনি এ বিষয়ে কী বলেন, মিস্টার বাসু? বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, য়োর অনার, এ প্রশ্নের জবাব দেবার পূর্বে আমি আদালতের কাছে জানতে চাইব, অ্যাডভোকেট মাইতিকে কেন এ কেস কন্ডাক্ট করতে কলকাতা থেকে ছুটে আসতে হয়েছে? পাবলিক মানি খরচ করে সরকার তো এ জেলায় একজন পাবলিক প্রসিকিউটার নিযুক্ত করেছেন। আমরা দেখতেও পাচ্ছি তিনি আদালতে উপস্থিত। তা সত্ত্বেও কেন ঐ সিনিরয় মোস্ট পি. পি.-কে কলকাতা থেকে এখানে এসে সওয়াল করতে হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব পেলে আমরা আদালতের প্রশ্নটির জবাব দিতে পারি।

দায়রা জজকে প্রশ্নটা করতে হল না। নিরঞ্জন মাইতি নিজে থেকেই বললেন, য়োর অনার! এই ফৌজদারী মামলার একটি দেওয়ানী শাখা গজিয়েছে। মিস্টার চৌধুরী একটি পৃথক মামলায় মিস্টার পি. কে. বাসুর বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার খেসারত দাবি করেছেন। এই মামলায় সমন ধরানোর জন্য ক্ষতিপূরণ।

বাসু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আদালত যে প্রশ্ন তুলেছেন সহযোগীই তার উত্তর দিয়েছেন। উনি চাইছেন, আমি আমার ডিফেন্স ট্যাকটিক্স আগেভাগে জানিয়ে দিই, আর মিস্টার চৌধুরী তাঁর বক্তব্যটা স্টিপুলেট করে অব্যাহতি পান। তাহলে পরবর্তী মামলাটা ওঁদের পক্ষে জেতা সহজ হবে।

জজসাহেব বললেন, মিস্টার চৌধুরী যদি বলেন গাছেরও খাব, তলারও কুড়াব তা তো চলবে না। হয় কেকটা খাবেন, নয় সঞ্চয় করবেন। তিনি মনস্থির করে আদালতকে জানান, তিনি কোনটা চাইছেন? সমন থেকে মুক্তি, না দেওয়ানী আদালতে খেসারতের দাবি। কোনটা?

দর্শক-আসনের প্রথম চেয়ারখানি দখল করে বসেছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ। সঙ্গে দুজন ব্যারিস্টার। কলকাতা থেকেই এসেছেন। ইন্দ্রনারায়ণ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, য়োর অনার, এই আদালতে প্রতিবাদী পক্ষ আমার উপর যে সামনস জারি করেছেন তা থেকে আমি অব্যাহতি চাই এবং লিগাল রাইটস অনুসারে যে কম্পেন্সেশনের মামলা লড়েছি তাও আমি চালিয়ে যেতে চাই।

বিচারক আনসারি তৎক্ষণাৎ বললেন, দ্য মোশান ইজ ডিনায়েড। মিস্টার চৌধুরীকে এ আদালতে অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না প্রতিবাদীপক্ষ তাঁকে সাক্ষীর মঞ্চে তোলেন। নাউ মিস্টার পি. পি., আপনি আপনার প্রথম সাক্ষীকে ডাকতে পারেন।

পি. পি. সখারাম হাজরা একের পর একজনকে সাক্ষী হিসাবে মঞ্চে তুলে ধীরে ধীরে তাঁর কেসটা গড়ে তুলতে থাকেন। প্রথমে এলেন একজন আমিন। ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি ও জমির স্কেলে আঁকা নকশা দাখিল করলেন। মৃতদেহটি কোথায় পাওয়া গেছে তা ঐ নকশায় দেখানো হয়েছে। এরপর এলেন ইন্সপেক্টর বরাট। তিনি জানালেন, এগারো তারিখ, বুধবার সকাল নয়টা নাগাদ বারাসাতের ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি থেকে লোকাল থানায় জানানো হয়, ওখানে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। পরে থানার নির্দেশে ঐ বাড়ি থেকেই হোমিসাইড সেকশনে সরাসরি একটি ফোন আসে। জানানো হয় যে, ঐ বাড়ির গেটের কাছে জঙ্গলের ভিতর একটি যুবকের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে আছে। খবরটা পেয়েই বরাট লোকাল থানায় যোগাযোগ করে। তদন্ত করার কথা বারাসাত থানার; কিন্তু যেহেতু মৃতদেহটি একজন ভি. আই. পি. -র বাগানবাড়িতে পাওয়া গেছে সে নিজেই কিছু লোকজন নিয়ে বারাসাতে চলে যায়। মিস্টার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে সে দেখা করেনি, প্রয়োজনও বোধ করেনি। যিনি টেলিফোনে খবর দিয়েছিলেন সেই একান্ত সচিব মিস্টার পল্লব চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা হয়। মৃতদেহটি সে পরীক্ষা করে। যুবক। বছর ত্রিশ বয়স। ঊর্ধ্বাঙ্গে গরম সোয়েটার, নিম্নাঙ্গে জিনস-এর প্যান্ট। তার পকেটে মানিব্যাগে এক হাজার বত্রিশ টাকা ছিল। এছাড়া সিগারেট কেস, লাইটার, রুমাল ছাড়াও হিপ-পকেটে ছিল আট ইঞ্চি ব্লেডের একটা তীক্ষ্ণ ছোরা— যার বোতাম টিপলে খাপ থেকে ব্লেডটা বার হয়ে আসে। আর ছিল তার ড্রাইভিং লাইসেন্স। তা থেকে জানা যায়, মৃতের নাম পরেশচন্দ্র পাল। মিস্টার পল্লব চ্যাটার্জি জানান যে, তিনি পৌনে নয়টা নাগাদ আসেন। আসতেই ঐ বাড়ির মালি জানায় যে, বাগানে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। তিনি সেটা স্বচক্ষে দেখে প্রথমে থানায় ও পরে হোমিসাইডে ফোন করেন। তিনি আরও জানান যে, সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ একটি মেয়ে একটা স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি চেপে চৌধুরীসাহেবের বাড়িতে আসে। বেল বাজানোতে বাড়ির মালি দরজা খোলে, কথাবার্তা বলে। সাহেব ঘুমোচ্ছেন শুনে মেয়েটি বলে দশটার পরে ফিরে আসবে। কিন্তু গেটের কাছাকাছি এসে মেয়েটি তার গাড়ি থামায়। গাড়ি থেকে নেমে আসে…

বাসুসাহেব আপত্তি জানালেন। বললেন, য়োর অনার, আমরা এতক্ষণ আপত্তি করিনি যেহেতু সাক্ষী দিচ্ছেন স্বয়ং ইনভেস্টিগেটিং অফিসার। কিন্তু ক্রমশই দেখা যাচ্ছে তিনি ‘হেয়ার-সে রিপোর্টের হিমালয় বানাতে শুরু করেছেন। আসামীর অনুপস্থিতিতে মিস্টার চ্যাটার্জি মালির কাছে কী শুনেছিলেন তা গ্রাহ্য হতে পারে না বর্তমান সাক্ষীর মুখে। সহযোগী ইচ্ছা করলে মিস্টার চ্যাটার্জি অথবা মালিকেই সাক্ষীর মঞ্চে তুলতে পারেন। তখন সেটা এরকম থার্ডহ্যান্ড রিপোর্ট হবে না।

বিচারক বললেন, অবজেকশান সাসটেইন্ড।

বরাট অতঃপর জানালো— মিস্টার চ্যাটার্জি মেয়েটির দৈহিক বর্ণনা দিয়েছিলেন। তার স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ির নম্বরটাও জানিয়েছিলেন। সেই সূত্র থেকেই বেলা পাঁচটা নাগাদ আসামীকে গ্রেপ্তার করা সম্ভবপর হয়। সার্চ করার সময় তেঁতুলগাছটার গুঁড়ির কাছে সে একটি পয়েন্ট থ্রি টু রিভলভার কুড়িয়ে পায়। তাতে পাঁচটা টাটকা এবং একটি ব্যয়িত বুলেট ছিল। সেটা সে তার ব্যাগ খুলে দেখায়।

বাসুর অনুমতি নিয়ে সেটি আদালতে পিপলস একজিবিট ‘A’ রূপে চিহ্নিত হয়ে নথিভুক্ত হল। ঐ সঙ্গে মৃতের পকেটে প্রাপ্ত সবকিছুই আদালতে নথিভুক্ত হল। পি. পি. বাসুকে বললেন : জেরা করতে পারেন।

বাসু বললেন, ইন্সপেক্টার বরাট, আপনি বললেন যে, চৌধুরীসাহেবের একান্তসচিব আসামীর পোশাক ও চেহারার বর্ণনা দিয়েছিলেন। তিনি ঠিক কী কী বলেছিলেন— মানে যতটা আপনার মনে আছে জানাবেন কি?

বরাট একটু বিজ্ঞের হাসি হেসে বললে, ‘মনে থাকাথাকির’ প্রশ্ন উঠছে না, স্যার। উনি যা-যা বলেছিলেন, আমি তখনি তা নোটবুকে টুকে নিয়েছিলাম। পড়ে শোনাচ্ছি, শুনুন : কোট শ্যামবর্ণা, সুঠাম চেহারা, চোখে চশমা নেই, বয়স পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে, উচ্চতা পাঁচ-দুই থেকে পাঁচ-তিন, ওজন অ্যারাউন্ড পঞ্চান্ন কেজি। পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, বেগুনী পাড়। ঐ বেগুনীরঙের ম্যাচিং ব্লাউজ। পায়ে মিডিয়াম হিল কালো জুতো। ও এসেছিল একটা নীলচে রঙের স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ডে চেপে। নম্বর : WBF 9850! —আনকোট!

বাসু বলেন, বাঃ! বেশ সিসটেমেটিক্যালি নোট রেখেছেন তো। এবার আমি জানতে চাইছি- আপনি ডাইরেক্ট এভিডেন্সে ‘ভাববাচ্যে’ জানিয়েছিলেন যে, খবরটা টেলিফোনে জানানো হয় মিস্টার চৌধুরীর বাড়ি থেকে। আমার প্রশ্ন : ফোনটা কে করেছিলেন? এবং ঠিক কটায়?

নোটবই দেখে বরাট বলল, ফোন করেন মিস্টার পল্লব চ্যাটার্জি পি. এ. টু মিস্টার চৌধুরী। সকাল নয়টা দশ মিনিটে। উনি বললেন, একটু আগে উনি ওখানে পৌঁছেছেন। মালির কাছে সব কিছু শুনে, নিজে প্রাথমিক তদন্ত করে তারপর উনি প্রথমে লোকাল থানায়, পরে তাদেরই নির্দেশে সরাসরি হোমিসাইডে ফোন করেছেন।

—মালির নামটা কী?

—সুবল।

—নামের পরে উপাধি-টুপাধি কিছু আছে?

—নিশ্চয় আছে। আমি লিখে রাখিনি।

—বুঝলাম। তারপর আপনি মোটর ভেইকেলসে যোগাযোগ করে জানতে পারেন যে, ঐ WBF 9850 গাড়িটা আসামীর, তাই তো?

—আজ্ঞে না। মোটর ভেইকেলস জানায়, ওটা একটা কোম্পানির গাড়ি। ইন ফ্যাক্ট ঐ কোম্পানিতেই কাজ করেন আসামী। সেখানে যোগাযোগ করে আমরা যাবতীয় সংবাদ সংগ্রহ করি।

বাসু জানতে চাইলেন, ঘটনাস্থলে যে রিভলভারটি পাওয়া যায় তার লাইসেন্স কার নামে খোঁজ নিয়েছিলেন কি?

—নিশ্চয়ই। এটা তো রুটিন কাজ। রিভলভারটি মাসছয়েক আগে কলকাতার সি. সি. বিশ্বাসের দোকান থেকে কিনেছিলেন বারাসাতের শ্রীইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। লাইসেন্স তাঁরই নামে, তবে ওটা বরাবর থাকত দারোয়ান মিশিরলালের কাছে। তার কেরিয়ার লাইসেন্স আছে।

—আপনি কি লাইসেন্স হোল্ডারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে তাঁর রিভলভারটা ঐ জঙ্গলে চলে যায়?

—আজ্ঞে না। আমি জানতে চাইনি। কারণ মিস্টার চৌধুরী আটই জানুয়ারি বারাসাত পুলিশ স্টেশনে এবং লালবাজারে আর্মস-অ্যাক্ট সেকশনে জানিয়েছিলেন যে, ওটা চুরি গেছে।

—এ নিয়ে আপনারা কি কোন তদন্ত করেছিলেন? কীভাবে, কবে, কখন সেটা চুরি গেল?

— আজ্ঞে আমি করিনি। এটা হোমিসাইডের কাজ নয়। যাঁর কাজ তিনি করেছিলেন কি না আমি জানি না।

—কী আশ্চর্য! আপনার কি কখনো সন্দেহ হয়নি যে, ওটা এ কেসের মার্ডার ওয়েপন হলেও হতে পারে?

—সন্দেহ কি বলছেন, স্যার? ব্যালিস্টিক এক্সপার্টের রিপোর্ট তো আমি নিজে চোখে দেখেছি। ওটাই তো মার্ডার ওয়েপন!

—তখনও আপনি মিস্টার চৌধুরীর জবানবন্দি নিলেন না?

—আজ্ঞে না। কারণ কবে, কীভাবে ওটা চুরি গেছে তা তো উনি আটই জানুয়ারি বিস্তারিত রিপোর্টে জানিয়েছেন।

বাসু বললেন, দ্যাটস অল, য়োর অনার।

এরপর সাক্ষী দিতে এলেন অটন্সি সার্জেন। তাঁর মতে মৃত্যু হয়েছে সোমবার, নয় তারিখ সন্ধ্যা ছয়টার পর এবং রাত এগারোটার আগে। মৃত্যুর হেতু একটি পয়েন্ট-থ্রিট বুলেট, যা নিহত ব্যক্তির হৃদপিণ্ড ভেদ করে শিরদাঁড়ায় আটকে যায়। বুলেটটি শবব্যবচ্ছেদের সময় উদ্ধার করে তিনি ব্যালিস্টিক এক্সপার্টকে হস্তান্তরিত করেন।

ব্যালিস্টিক এক্সপার্ট জানালেন তিনি নিঃসন্দেহ যে, অটপ্সি সার্জেনের কাছ থেকে পাওয়া বুলেটটি পিপলস্ একজিবিট ‘A’ চিহ্নিত রিভলভার থেকেই নিক্ষিপ্ত।

এরপর এক ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট এলেন সাক্ষী দিতে। মাইতির প্রশ্নের জবাবে জানালেন, ঐ পিপলস্ একজিবিট ‘A’ চিহ্নিত রিভলভারে দুটি ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে, যা নিঃসন্দেহে আসামীর দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনীর।

বাসু এঁদের কাউকেই কোন জেরা করলেন না!

পি. পি. উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, য়োর অনার, এবার আমরা নিহত ব্যক্তির পরিচয়টা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। মৃতের পকেট থেকে একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে, সেটি আদালতে ‘D’ চিহ্নিত এক্‌জিবিট। সে লাইসেন্স পরেশচন্দ্র পালের নামে। ফটো দেখে বোঝা যায় যে, সেটি নিহত ব্যক্তির। তবু সেটা প্রতিষ্ঠা করতে— করার প্রয়োজনও যে আছে, তা পরে আমরা ব্যাখ্যা করে দেখাব— আমাকে একটি অপ্রীতিকর কাজ করতে হচ্ছে। মৃত পরেশচন্দ্র পালের বিধবা শর্মিষ্ঠা পালকে আমি সাক্ষীর মঞ্চে উঠে বসতে বলছি।

সাদা কালো পাড় শাড়ি পরা সদ্যবিধবা শর্মিষ্ঠা পাল সাক্ষ্য দিতে ওঠে। প্রথামাফিক শপথবাক্য পাঠ করে। পি. পি.-র প্রশ্নের উত্তরে তার নাম, ঠিকানা জানায়। স্বীকার করে সে মৃত ব্যক্তির স্ত্রী। আট বছর আগে পরেশ পালের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। তার একটি পুত্রসন্তান আছে। স্বামীর মৃতদেহ সে দেখেছে এবং সৎকারেও অংশ নিয়েছে।

পি. পি. বলেন, মিস্টার বাসু, আপনি কি জেরা করবেন?

বাসু ও বাহুল্য প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সাক্ষীকে বলেন, মিসেস পাল, আমি চেষ্টা করব আমার জেরাকে যতদূর সম্ভব সংক্ষিপ্ত করতে, আর কম বেদনাদায়ক করতে। আপনি যখন পরেশবাবুকে বিবাহ করেন, তখন তিনি কী করতেন?

—কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন।

—কী কাজ?

—ঠিক কী কাজ জানি না। শ্রমিক হিসাবে কোনও সেকশনে কাজ করতেন।

—সে কাজ উনি কবে ছেড়ে দেন? তারপর কী করতেন?

—প্রায় তিন বছর আগে সে কাজ ছেড়ে দিয়ে উনি বিজনেস শুরু করেন। এখন তাই করতেন।

—কিসের বিজনেস?

—সেটা আমি জানি না। জানতে চাইলে উনি বিরক্ত হতেন। তবে বিজনেস থেকে ওঁর উপার্জন ভালই হত।

—পরেশবাবু মারা যাবার পর ওঁর খাতাপত্র ঘেঁটে আন্দাজ করতে পারেননি, উনি কিসের বিজনেস করতেন?

—না। খাতাপত্র বা হিসাব লেখার বই কিছুই খুঁজে পাইনি।

—কিন্তু ব্যাঙ্কের পাস বই, এন. এস. সার্টিফিকেট বা শেয়ারের কাগজ কিছু পেয়েছেন কি? পেলে সব কিছুর মোট অ্যাসেট কত হবে— নেহাত আন্দাজে?

পি. পি. আপত্তি করেন, এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। এভাবে বাসু ওঁকে বাধ্য করতে পারেন না সাক্ষীর অ্যাসেট কত তা জানাতে।

আদালতের নির্দেশের অপেক্ষা না রেখে বাসু বলেন, অলরাইট, আই উইথড্র। মিসেস পাল, আপনাদের গাড়ি ছিল তা আমরা জানি। আপনার বাড়িতে ফ্রিজ, টি.ভি. টু-ইন-ওয়ান, ভি. সি. পি. এই চারটি বস্তুর মধ্যে কোন্ কোটি আছে?

পি. পি. আবার আপত্তি করেন : অবজেকশন। অন দি সেম গ্রাউন্ডস।

জজসাহেব বলেন, এগুলি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বা শেয়ার সার্টিফিকেটের মত গোপনে রাখা যায় না। অবজেকশন ইজ ওভাররুল্ড! মিসেস পাল, আপনি ওঁর প্রশ্নের জবাব দিন।

—চারটিই আছে।

—বাড়িটা তো ভাড়া বাড়ি?

—আজ্ঞে না। উনি এটা কিনেছেন।

—মাত্র তিন বছর আগে যিনি ছিলেন কারখানার শ্রমিক, তিনি কীভাবে এত শীঘ্র এত সম্পদের মালিক হলেন তা জানবার কৌতূহল কখনো হয়নি আপনার?

—অবজেকশন য়োর অনার। সাক্ষীর প্রশ্নটি কনক্লুশন সংক্রান্ত।

বাসু এবারও বিচারকের নির্দেশের অপেক্ষা না করে বললেন, দ্যাটস অল য়োর অনার।

পি. পি.-র পরবর্তী সাক্ষী ইন্দ্রনারায়ণের বাগানের মালি। খেটো ধুতি, হাফ শার্ট, মাথায় পাগড়ি। জানা গেল তার নাম, সুবলচন্দ্র সাঁই। সে ঐ বাগানবাড়ির মালিই শুধু নয়। মালিকের অনুপস্থিতিতে সে হচ্ছে কেয়ারটেকার। ওর অধীনে আরও তিনজন মালি ও দারোয়ান আছে। একজন ঠাকুরও আছে। পি. পি. তার মাধ্যমে একটি বিশেষ তথ্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। জানতে চাইলেন, আসামীকে তুমি আগে কখনো দেখেছ?

—দেখেছি হুজুর। এগারো তারিখ সকালে, উনি যখন বেল বাইজে সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন।

—তোমার সঙ্গে তাঁর কী কী কথা হল, যতদূর মনে আছে বলে যাও।

সাক্ষী বর্ণনা দিল। অপরাজিতা বাসুসাহেবকে যা যা বলেছিল তাই। সাহেব বোম্বাই থেকে ফিরেছেন কি না, ইত্যাদি।

—তারপর কী হল?

—আমি ওঁরে বললাম, দশটা নাগাদ আইসতে। উনি গাড়ি করে গেটের পানে চলি গেলেন। আমি দরজা বন্ধ করলাম; কিন্তু পুরোটা নয়। ইকটুখান ফাঁক রেখে এর উপর নজর রাখলাম। যতক্ষণ না উনি গেট ছাড়ো চলি যান।

—তারপর কী দেখলে?

সাক্ষী পুলিশের কাছে জবানবন্দি দেবার সময় ইতিপূর্বে যা বলেছে, পুনরায় তাই বলল। —আসামী ঐ তেঁতুলগাছের দিকে কী ছুঁড়ে ফেলে দিল তা তুমি দেখনি?

—দেকিছি। কিন্তু অত দূর থেকে জিনিসডারে সনাক্ত করতে পারিনি। কালো মতন ভারি কোন দোব্য।

—সেটা কি একটা রিভলভার হতে পারে?

বাসু বলেন, অবজেকশন। ইটস্ এ কনক্লুশন অব দ্য উইটনেস।

সুবলচন্দ্র বোধকরি বুঝতে পারল না যে, এখন তার চুপ করে থাকার কথা। একবার বাসুসাহেবের দিকে দেখে নিয়ে পি. পি. কে বললে, হতিও পারে, নাও হতি পারে। হলপ নিয়ে তা আমি বলতে পারবনি বাবু।

জাজ রুলিং দিলেন, শেষ প্রশ্নটি অবৈধ। তার জবাবটাও। কেসের বিবরণ থেকে তা বাদ দিতে। পি. পি. বাসুকে বললেন, য়োর উইটনেস।

বাসু এগিয়ে এলেন। সুবলচন্দ্রকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, মিস্টার সাঁই, আপনি কী ভাবে আদালতে এসেছেন? চৌধুরীসাহেবের গাড়িতে চড়ে কি?

সুবল মরমে মরে গিয়ে বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর! কিন্তুক আমারে ‘আপনি’ বলি কথা বলবেন না।

বাসু ভ্রূক্ষেপ করলেন না। বললেন, আপনি নিশ্চয় ড্রাইভারের পাশের সিটে বসেছিলেন। আর চৌধুরীসাহেব, দুই ব্যারিস্টার নিয়ে পিছন দিকে। তাই নয়?

পি. পি. বলেন, অবজেকশন য়োর অনার। ইররেলিভ্যান্ট!

—অবজেকশন সাসটেইন্ড!

বাসু এবারও কর্ণপাত করলেন না। একই সুরে প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে গেলেন, এবার বলুন, ড্রাইভারের গায়ে যে শার্ট ছিল তার কী রঙ, প্যান্টের কী রঙ, তার পায়ে কী ছিল, চটি, কাবলি, না ফিতে বাঁধা জুতো? জুতো হলে কী রঙ?

পি. পি. পুনরায় দাঁড়িয়ে ওঠেন, অবজেকশন এগেন। সহযোগী প্রশ্নোত্তরকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?

এবার দায়রা জজ আনসারি বললেন, ওয়েল কাউন্সেলর, এসব প্রশ্ন আপনি কেন করছেন একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন কি?

—শিতার! তবে তার আগে একটা অনুরোধ আছে, য়োর অনার। ইন্সপেক্টর বরাট তাঁর নোট বই থেকে যেটুকু পাঠ করে শুনিয়েছিলেন সেটা কোর্ট-রেকর্ডারকে একবার পড়ে শোনাতে বলুন-

দায়রা জজের নির্দেশে কোর্ট-রেকর্ডার পড়ে শোনালো- ‘শ্যামবর্ণা, সুঠাম চেহারা, চোখে চশমা নেই, বয়স পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে, উচ্চতা পাঁচ-দুই থেকে পাঁচ-তিন, ওজন অ্যারাউন্ড পঞ্চান্ন কে.জি.। পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, বেগুনি পাড়। ঐ রঙেরই ম্যাচিং ব্লাউজ…

বাসু তাকে থামিয়ে দিলে বললেন, এনাফ! এনাফ!

জজসাহেবের দিকে ফিরে বাসু বললেন, বাদীপক্ষের মতে, আসামী যখন ডোরবেল বাজায় তখন থেকে সে যখন গেট পার হয়ে চলে যায় তখন পর্যন্ত একমাত্র এই সাক্ষী, মিস্টার সুবলচন্দ্র সাঁই, যিনি একটু গ্রাম্য উচ্চারণে কথাবার্তা বলেন, তিনি ছাড়া আর কেউ তাকে দেখেনি। মিস্টার : পল্লব চ্যাটার্জি তখনো অকুস্থলে এসে পৌঁছননি।… আপনি কি আরও ব্যাখ্যা চাইছেন, য়োর অনার?

—নো! দ্য অবজেকশন ইজ ওভাররুলড।

বাসু তৎক্ষণাৎ সাক্ষীর দিকে ফিরে বললেন, ঐ সঙ্গে আরও বলুন, আপনার পার্শ্ববর্তী সিটে উপবিষ্ট ড্রাইভারের বয়স কত আন্দাজ করছেন? উচ্চতা কত? ওজন কত কে. জি.?

সুবল সাঁই রীতিমতো বিহ্বল হয়ে পড়ে। বলে, মাপ করবেন হুজুর। আমি জানি না।

—দ্যাটস্ অল, য়োর অনার।

জাজ কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে সাক্ষীর দিকে তাকিয়েছিলেন। মনে হল, তিনি নিজেই সাক্ষীকে কিছু প্রশ্ন করবেন। তারপর মনস্থির করে তিনি নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্তই নিলেন। সুবল সাঁই গুটিগুটি নেমে এল সাক্ষীর মঞ্চ থেকে।

মাইতি তড়াক করে উঠে দাঁড়ান। বলেন, আমি রিডাইরেক্টে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

অগত্যা সুবল সাঁইকে আবার ডকে উঠে দাঁড়াতে হল।

মাইতি প্রশ্ন করেন, মেয়েটির গায়ে কী পোশাক ছিল তা তোমার মনে আছে?

সুবল নতনেত্রে বললে, কেন থাকবেনি? তাছাড়া এইমাত্র তো পেশকারবাবু পড়ে শোনালেন।

—মেয়েটি কী গাড়ি চেপে এসেছিল? কত নম্বর?

—আজ্ঞে স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড গাড়ি। নম্বরটা অ্যাদ্দিনে ভুলে গেছি। বোধহয় ডাবলু বি এফ ন-হাজার আটশ পঞ্চাশ।

—দ্যাটস্ অল। তুমি এবার নেমে এস, সুবল।

বাসু এগিয়ে আসেন, উঁহু, উঁহু! আমার রি-ক্রসটা যে বাকি। বলুন মিস্টার সাঁই, আপনার সাহেবের গাড়ির নম্বর কত, কী মেক?

—ডি এল ও জিরো টু থ্রি ফাইভ সেভেন। ক্যাডিলাক গাড়ি।

—আপনি চৌধুরীসাহেবের কাছে কত বছর চাকরি করছেন?

—তা পনের-বিশ বছর হবেনে।

—দ্যাটস অল!

পি. পি. এরপর সাক্ষী দিতে ডাকলেন বিরাটির নির্মলা রায়কে। ধীরপদে সে উঠে দাঁড়ালো সাক্ষীর মঞ্চে। তার পরিধানেও শাদা শাড়ি, শাদা ব্লাউজ। দুহাতে দুগাছি বালা ছাড়া গলায় বা কানে কিছু পরেনি। শপথবাক্য পাঠ হয়ে যাবার পর বিচারক বললেন, আপনি বসে বসে সাক্ষ্য দিন।

নির্মলা চেয়ারে বসল। আদালত কক্ষের চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে সে যেন বিশেষ একজনকে খুঁজছিল।

পি. পি. প্রশ্ন করেন, আপনার নাম শ্রীমতী নির্মলা রায়?

নির্মলা তার আয়ত চোখ দুটি তুলে বললে, ঠিক জানি না।

পি. পি. বলেন, তার মানে? নিজের নামটাও জানেন না?

নির্মলা বিচারকের দিকে ফিরে বললে, ধর্মাবতার। ছেলেবেলায়, স্কুল-কলেজে যখন পড়তাম তখন আমার নাম ছিল নির্মলা বসু। একজনকে রেজিস্ট্রি মতে বিয়ে করার পর শুনলাম আমার নাম হয়ে গেছে : নির্মলা রায়। এখন শুনছি, আইনত আমার সেই বিবাহটা সিদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে আমার নাম আইনত কী হয়েছে তা আমি তো ঠিক জানি না। ওঁর প্রশ্নের জবাবে হলফ নিয়ে কী বলব, বুঝতে পারছি না।

পি. পি. অ্যাডভোকেট হাজরা বলেন, আমার প্রশ্নে তুমি দুঃখ পেয়েছ, মা। এমনটা হবে তা আমি বুঝতে পারিনি। কিছু মনে কর না। এবার বল, তুমি যখন সুশোভন রায়কে রেজিস্ট্রি মতে বিবাহ কর, তখন তুমি জানতে না যে, সে বিবাহিত?

নির্মলা মাথা নিচু করে জবাব দিল, না।

—সেই বিয়েতে তোমার মা-বাবার সম্মতি ছিল না বলেই কি তোমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ে করতে হয়?

—আমার মা তখন বেঁচে ছিলেন না। বাবার অমত ছিল।

—বাবার কেন অমত ছিল?

বাসু আপত্তি জানালেন, প্রশ্নটি সাক্ষীর মতামত আহ্বান করা। কনক্লুশন।

প্রশ্নটি বাতিল হল।

পি. পি.-র প্রশ্নে নির্মলা স্বীকার করল, আর্থিক হেতুতে নয়, নিঃসঙ্গতার কারণে সে অপরাজিতাকে পেয়িং গেস্ট হিসাবে গ্রহণ করেছিল, কারণ তার স্বামী- অর্থাৎ যাকে সে স্বামী বলে মনে করত সে মাসের মধ্যে পনের দিনই ট্যুরে গিয়ে বাইরে রাত কাটাতো।

—আসামী অপরাজিতা কর কতদিন ধরে আছে তোমাদের বাড়িতে?

—প্রায় দেড় বছর, আমাদের বিয়ের প্রায় ছয়-মাস পর থেকে।

—এই দেড় বছরের ভিতর তুমি কি কখনো সুশোভনবাবু এবং তোমার বান্ধবীকে অবাঞ্ছনীয় ঘনিষ্ঠতায় একত্র অবস্থায় আবিষ্কার করেছিলে?

নির্মলা এবারও দৃঢ়ভাবে মাথা নেড়ে বললে, না!

—তোমার কি কখনো সন্দেহ হয়নি যে, তোমার চোখের আড়ালে ওরা অনৈতিক ঘনিষ্ঠতায় আসে?

বাসু তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ান : অবজেকশন, য়োর অনার! সাক্ষীর ‘সন্দেহ’ কোনও এভিডেন্স নয়। এটা কনক্লুশন মাত্ৰ

বিচারক বললেন, অবজেকশন ইজ সাসটেইন্ড।

পি. পি. এবার সুশোভনের আয়ের উৎস সম্বন্ধে জানতে চাইলেন। নির্মলা জানালো, তার স্বামীর উপার্জন বেশ ভালই ছিল। সে ব্যবসা করত। কীসের ব্যবসা তা ও জানে না। তবে দুই বছরের মধ্যে সে গাড়ি-বাড়ি করেছে, টি. ভি., ফ্রিজ কিনেছে। অবশ্য সে জানে না, ওর ‘তথাকথিত’ স্বামীর ছেড়ে যাওয়া গাড়ি-বাড়ি-ফ্রিজ-টিভির মালিকানা কার। তাতে ওর কতটা দাবি আইনে টিকবে।

পি. পি. জানতে চান, ওর কি কোনও রিভলভার ছিল?

—রিভলভার? ওর নিজের? আজ্ঞে না। আমি জানি না।

—তুমি ওর পজেশনে কখনো কোন রিভলভার দেখেছ কি? ওর হাতে বা স্যুটকেসে?

—হ্যাঁ, তা দেখেছি। একবার মাত্র। আলমারির চাবিটা খুঁজে না পাওয়ায় ওর অ্যাটাচি কেসটা হাতড়াচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা রিভলভার দেখতে পাই। ও তখন স্নান করছিল। পরে ও স্নানঘর থেকে বেরিয়ে এলে আমি জানতে চেয়েছিলাম, সেটা কার, কোত্থেকে এল। ও আমাকে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়।

—সেটা কতদিন আগে? কবে?

—এই মাসের প্রথম দিকে। তারিখ আমার মনে নেই।

—কিন্তু এটুকুও কি মনে নেই যে, উনি ট্যুর থেকে ফিরে আসার পর?

বাসু আপত্তি তোলেন, লিডিং কোশ্চেন!

বিচারক আপত্তি নাকচ করে দেন, বলেন, তাঁর মতে এটি সাক্ষীর স্মৃতিকে উজ্জীবন করার প্ৰচেষ্টা মাত্র।

নির্মলা এবার স্বীকার করে, হ্যাঁ, তাই বটে। রবিবার, নয় তারিখ দুপুরে, ও তখন বাথরুমে স্নান করছিল।

পি. পি. পিপলস্ এক্‌জিবিট A-টি দেখিয়ে বলেন, এই রিভলভারটা কি?

—হতে পারে। নাও পারে। ঐ রকমই দেখতে ছিল সেটা।

—তুমি ইতিপূর্বেই বলেছ যে, সোমবার, দশ তারিখ, তোমার বান্ধবী, আসামী অপরাজিতা কর, বেশ রাত করে বাড়ি ফেরে। সেদিন আসামী কি তোমাকে কিছু অপ্রত্যাশিত জিনিস দেখিয়েছিল? দেখিয়ে থাকলে সেটা কী?

—হ্যাঁ, দেখিয়েছিল। একটা রিভলভার।

—হুবহু ঐ একই রকম দেখতে? যেমন দেখেছিলে দুপুরে সুশোভনের অ্যাটাচি কেসে, এবং এখন আমি দেখাচ্ছি?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—আসামীর সঙ্গে সে সন্ধ্যায় তোমার কী কথোপকথন হয়? মানে, কেমন করে তোমার স্বামীর অ্যাটাচি কেসে দেখা ঐ রিভলভারটি তার হাতে এল?

—অবজেকশন, য়োর অনার! সাক্ষী যেকথা বলেননি সহযোগী তাঁর মুখে সে কথা বসিয়ে প্রশ্নটি করছেন!

পি. পি. তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করে বলেন, বেশ, আমি নতুন করে প্রশ্নটি পেশ করছি। আসামীর সঙ্গে সে সন্ধ্যায় তোমার কী কথোপকথন হয়, মানে কেমন করে একই রকম দেখতে একটি রিভলভার তার হাতে এল?

নির্মলা দীর্ঘ বর্ণনা দেয়। সে রাত্রে অপরাজিতা ফিরে এসে যা-যা বলেছিল। শুধু সে যে অপরাজিতাকে ধমক দিয়েছিল অবৈধ প্রেমে তার স্বামীর সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে— একথা বাদ দিল।

—তখন কি তোমার সন্দেহ হয়নি যে…

—অবজেকশন য়োর অনার। কনক্লুশন।

প্রশ্নটি যদিও পুরোপুরি পেশ করা হয়নি, তবু তা নাকচ হয়ে গেল।

পি. পি. জানতে চাইলেন, এগারো তারিখ, মঙ্গলবার দুপুরে, এ মামলার প্রতিবাদী পক্ষের ব্যারিস্টার মিস্টার পি. কে. বাসু কি তোমার সঙ্গে দেখা করেন?

—হ্যাঁ, করেন।

—তাঁর সঙ্গে একজন মহিলাও ছিলেন?

—ছিলেন। ‘সুকৌশলী’র মিসেস সুজাতা মিত্র।

—মিস্টার বাসু তোমার কাছে কী জানতে চাইলেন?

আবার বাধা দিলেন বাসুসাহেব, অবজেকশন য়োর অনার। ইনকম্পিটেন্ট, ইররেলিভ্যান্ট অ্যান্ড ইম্মেটিরিয়াল! প্রতিবাদী পক্ষের আইনজীবী কখন, কাকে, কোথায় কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন তার সঙ্গে এ মামলার কোন সম্পর্ক নেই।

পি. পি. বলেন, য়োর অনার। মিস্টার পি. কে. বাসু আসামীর অ্যাটর্নি!

বাসু বলেন, সো হোয়াট? তাতে কী হল? আমার বর্তমানে পাঁচ-সাত জন মক্কেল আছে। আমি যেখানে যা করছি, বলছি, তার জন্য ঐ দশজনই দায়ী? কে কত পার্সেন্ট? বাদীপক্ষ যদি প্রতিষ্ঠা করতে চান যে, আমি যা করছি তার জন্য বর্তমান আসামী দায়ী, তাহলে তাঁদের প্রথমে প্রমাণ করতে হবে যে, আমার কাজ সম্বন্ধে আসামীর পূর্বনির্দেশ— অন্ততপক্ষে পূর্বজ্ঞান- ছিল।

জাজ আনসারি বললেন, আই থিংক দ্য পয়েন্ট ইজ ওয়েল টেকেন। আপত্তিটা গ্রাহ্য হল।

পি. পি. হতাশ হয়ে বললেন, তাহলে আমার সওয়ালের এখানেই শেষ। উনি এবার জেরা করতে পারেন।

বাসু জেরা করতে উঠে বললেন, নির্মলা, তুমি মনে করে দেখ, বেশ ভেবে জবাব দাও। জানুয়ারি মাসের তিন তারিখ থেকে দশ তারিখের মধ্যে তোমার অপরিচিত কোন লোক কি তোমাদের বাড়িতে এসেছিল? তোমার স্বামী বা বান্ধবীর সন্ধানে? অথবা কোনও অপরিচিত লোক কি টেলিফোন করেছিল?

নির্মলা একটু ভেবে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, একজন অপরিচিত লোক দেখা করতে এসেছিলেন। সেটা শুক্রবার, সাত তারিখ দুপুরে। আর টেলিফোন একজন করেছিলেন— তিনি আমার অপরিচিত হলেও আমার স্বামীর, আই মিন সুশোভনের, পরিচিত।

—প্রথমে তুমি ঐ সাত তারিখ, শুক্রবারের দুপুরের কথা বল। যিনি দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর দৈহিক বর্ণনা দাও। কী কী কথোপকথন হল বলে যাও।

নির্মলার জবানবন্দি থেকে জানা গেল, দেখা করতে যিনি এসেছিলেন তিনি সুদর্শন, যুবাপুরুষ। বয়স আন্দাজ ত্রিশ। সে এসে জানতে চাইল, ‘অপরাজিতা কর কি এই বাড়িতে থাকেন?’ নির্মলা জবাবে বলেছিল, ‘থাকেন। কিন্তু এখন সে বাড়িতে নেই।’ ছেলেটি তখন জানতে চায় ওঁর গাড়ি কি স্ট্যান্ডার্ড হেরাল্ড, WBF 9850?’ এবার নির্মলা প্রতি প্রশ্ন করেছিল, ‘আপনি কে? কোথা থেকে আসছেন?’ ছেলেটি বলে, সে আসছে ক্যালকাটা ক্লেমস্ ব্যুরো থেকে। ঐ গাড়িটা একটি অ্যামবাসাডারকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে গেছে, তাই ও তদন্তে এসেছে। তখন নির্মলা বলে, ‘সে ক্ষেত্রে আপনি অপরাজিতার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেখা করতে আসবেন।’ ছেলেটি নির্মলাকে ধন্যবাদ দেয়, টেলিফোন নম্বরটা টুকে নেয়। তারপর বলে, ‘একটা অনুরোধ করছি, রাখবেন? আপনার ননদের কোন ফটো থাকলে আমাকে একবার দেখিয়ে দেবেন?’ নির্মলা ইতস্তত করে, তারপর ভাবে এতে অপরাজিতার কোন ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। সে বলে, ‘অপরাজিতা আমার ননদ নয়, পেইং গেস্ট। আচ্ছা, আপনি বসুন, আমি ফটো অ্যালবামটা নিয়ে আসি।’ নির্মলার হাত থেকে ফ্যামিলি ফটো অ্যালবামটা নিয়ে ছেলেটি পাতা উল্টে দেখে। অপরাজিতার ফটো কোনটা দেখে চলে যায়। এ নিয়ে পরে নির্মলা তার বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছিল। অপরাজিতা মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারেনি। বলেছিল, তার স্মরণকালে সে কোনও অ্যামবাসাডার গাড়িকে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায়নি। লোকটার কোন বদ মতলব আছে।

—বুঝলাম। সে ছেলেটি আর ফিরে আসেনি, বা ফোন করেনি?

—না।

—আর কোন অপরিচিত লোক সুশোভন বা অপরাজিতার খোঁজ করতে এসেছিল কি?

নির্মলা একটু ভেবে নিয়ে জবাবে বলল, না। আর কোন অপরিচিত লোক দেখা করতে আসেনি। তবে একজন অচেনা লোক টেলিফোন করেছিলেন। আগেই বলেছি, তিনি আমার অপরিচিত বটে, কিন্তু আমার স্বামীর পরিচিত।

—কী করে জানলে যে, তিনি তোমার স্বামীর পরিচিত?

—যেহেতু তিনি ক্যামাক স্ট্রিটের কোনও অফিস থেকে প্রথমে আমাকে ফোনে ধরে তারপর ফোনটা সুশোভনকে দেন। সুশোভন তখন ক্যামাক স্ট্রিটে ওঁর অফিসেই ছিল।

—সেটা কত তারিখ?

নির্মলা নতনেত্রে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলে, তারিখটা আমার মনে আছে, ঐ শেষ রবিবার, নয় তারিখ। বেলা এগারোটা নাগাদ।

—ঠিক কী কী কথা হয়েছিল, আনুপূর্বিক বলে যাও তো।

নির্মলা বলে, আমি তখন বাড়িতে একাই ছিলাম। টেলিফোন বাজতে সেটা তুলে নিয়ে বললাম, ‘হ্যালো?’ ওপাশ থেকে প্রশ্ন হল, ‘আপনি মিসেস রায় বলছেন কি?’ আমি কণ্ঠস্বরটা চিনতে না পেরে জানতে চাই, ‘আপনি কে?’ ও প্রান্ত থেকে ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি ক্যামাক স্ট্রিট অফিস থেকে বলছি। আপনি আমাকে চিনবেন না। এটা মিস্টার সুশোভন রায়ের বাড়ি? আমি তখন বললাম, ‘হ্যাঁ’। উনি বললেন, তাহলে মিসেস সুশোভন রায়কে একটু ডেকে দেবেন?’ তখন আমি বললাম, ‘আমিই মিসেস সুশোভন রায়।’ ভদ্রলোক বললেন, ‘থ্যাঙ্কু! এই নিন মিস্টার রায়ের সঙ্গে কথা বলুন।’

—তারপর?

—তারপর ও প্রান্তে টেলিফোনটা হাত বদল হল। ও— মানে সুশোভন, বললে, ‘নির্মলা, শোন আমি ক্যামাক স্ট্রিটের একটা অফিস থেকে বলছি। আমি বোধহয় ভুলে আলমারির ডুপলিকেট চাবিটা আলমারির গায়েই লাগিয়ে চলে এসেছি। ওটা তুলে রেখ।’ বলে ও লাইন কেটে দিল। আমি অনেক খুঁজেও আলমারির ডুপলিকেট চাবিটা খুঁজে পেলাম না। চাবিটা আসলে ওর অ্যাটাচি কেসেই ছিল। দুপুরে যখন এল তখন বলল, অ্যাটাচি কেসের উপরের পকেটে এমনভাবে ঢুকে গিয়েছিল যে, দেখতে পাচ্ছিল না।

মধ্যাহ্ন বিরতির সময় আসন্ন। জজসাহেব জানতে চাইলেন, বাদীপক্ষের আর কয়জন সাক্ষী বাকি আছেন? মাইতি জানালেন, একজন, বড়জোর দুজন।

জজসাহেব তখন আদালত মুলতুবি ঘোষণা করলেন। বেলা দুটোয় আবার আদালত বসবে। আসামী পুলিশের জিম্মাদারীতেই থাকল।

আদালত ভাঙল, কৌশিক এগিয়ে এসে বাসসাহেবের কানে কানে বলল, মাইতি একজন ‘সারপ্রাইজ স্টার উইটনেস’ লুকিয়ে রেখেছে তার আস্তিনের তলায়। আদালতের একটা ঘরে রাখা আছে সেই ‘এনোলা গে!’ আদালত বসলেই সে হিরোসিমায় অ্যাটম বমটা ঝেড়ে আসবে।

—হলো না মেনি? – বাসু জানতে চাইলেন।

—আজ্ঞে না। স্ত্রীলোক নয়। আমাদেরই বয়সী। হুলোই। তবে তাকে পর্দানসীন মেনির মতো পুলিশে ঘিরে রেখেছে। সাংবাদিকদের ওদিকে ভিড়তেই দিচ্ছে না।