৭
অপরাজিতা যে জামিন পাবে না এতটা আশঙ্কা করেননি বাসু। আজকাল দাগী মাস্তানেরাও ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে জামিন পেয়ে যায়— এক্ষেত্রে একটি মহিলা, যাঁর নামে কোন পুলিশ রেকর্ডই নেই, তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দেবেন না— এটা সত্যিই অপ্রত্যাশিত। বোধহয় তার হেতু আসামী কোন জবানবন্দি দিতে অস্বীকার করেছে। অবশ্য আসামী জামিন না পাওয়ায় বাসুসাহেবের আবেদনক্রমে বিচারক, পুলিসকে নোটিস দিয়েছিলেন সাতদিনের মধ্যে চার্জ ফ্রেম করে কেসে ফাইল করতে হবে। মোট কথা, বুধবার ঊনিশে জানুয়ারি মামলার প্রথম শুনানীর দিন পড়েছে। পুলিশ চার্জ ফ্রেম করে ফাইল করেছে— ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার : পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা।
মামলার নোটিস পাওয়ামাত্র বাসুসাহেব ধনকুবের ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উপর আদালতের সমন জারি করলেন। বারাসাতে দায়রা জজের আদালতে প্রতিবাদী পক্ষের সাক্ষী হিসাবে ইন্দ্রনারায়ণকে বুধবার, উনিশে জানুয়ারি উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে।
ইতিমধ্যে কৌশিক আরও নানান তথ্য সংগ্রহ করেছে। প্রথম কথা, রিভলভারটা খুঁজে পাওয়া গেছে। তাতে একটিমাত্র ডিসচার্জড বুলেট। ব্যালিসটিক এক্সপার্টের কী রিপোর্ট তা জানা যায়নি। সেটা গোপন রাখা হয়েছে। এমনকি রিভলভারের গায়ে অপরাজিতার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাওয়া গেছে কি না, তাও জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে, রিভলভারটা ক্রয় করেছিলেন স্বয়ং ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, প্রায় মাস ছয়েক আগে। ওঁর বাড়িতে সে সময় একটা চোর আসে। চুরি কিছু করতে পারেনি। দারোয়ানের তাড়া খেয়ে পালায়। সে সময় ইন্দ্রনারায়ণ পশ্চিম ভারতে ছিলেন। ফিরে এসেই ঐ লাইসেন্সটি করান। রিভলভার কেনেন, নিজের নামেই লাইসেন্স কিন্তু দারোয়ানের নামে কেরিয়ার লাইসেন্স করানো হয়।
বাসু সব শুনে বলেন, চমৎকার! সে রিভলভার অপরাজিতার কাছে গেল কী করে?
কৌশিক বলে, সে কৈফিয়ৎ তো আসামী দেবে!
—না! লাইসেন্স-হোল্ডার দেবে। কখন কী ভাবে সে রিভলভারটা হারায়। সে কি তৎক্ষণাৎ পুলিশে রিপোর্ট করেছিল? না করে থাকলে, কেন করেনি?
কৌশিক বলে, ইন ফ্যাক্ট, করেনি। দারোয়ান সেটা হারায়। ভয়ে স্বীকার করেনি। যতদূর মনে হয়, খরচপত্র করে চৌধুরীসাহেব একটা ব্যাকডেটেড রিপোর্ট লিখিয়ে এসেছেন। লোকাল থানায় এবং লালবাজারে আমর্স অ্যাক্ট সেকশনে। সত্যি-মিথ্যে জানি না। আর একটি দুঃসংবাদ আছে, মামু। আসামী ভেঙে পড়েছে। সে একটা জবানবন্দি দিয়েছে। যা আপনাকে বলেছে হুবহু তাই।
—পুলিশ কি সেই 1757 নম্বর গাড়িটা ট্রেস করতে পেরেছে?
কৌশিক বলে, সম্ভবত না। পুলিশের মতে আসামী যদি সত্যি কথা বলে থাকে তাহলে ঐ 1757 নম্বর প্লেটটা ফেক — জাল। আর আসামী যদি গল্পটা বানিয়ে বলে থাকে তাহলে 1757 নম্বর গাড়িটার মালিক কে, তা খোঁজার মানেই হয় না। তাছাড়া ঐ নম্বরের আগে WBA থেকে WBM পর্যন্ত কী আছে তা তো অপরাজিতাও বলতে পারছে না।
বাসু বললেন, বুঝলাম। কিন্তু পরেশ পালের মারুতি সুজুকি গাড়িখানা? সেটার কত নম্বর তা তো নির্মলাও জানে, শর্মিষ্ঠাও জানে। সেই গাড়িটা কোথায়?
কৌশিক বলে, সেটাও একটা চরম রহস্য। সে গাড়িটা হাওয়ায় উবে গেছে। পরেশ পাল ওরফে সুশোভন রায় ইন্দ্রনারায়ণের বাড়ির গেট পর্যন্ত নিশ্চয় নিজের গাড়ি চেপে যায়নি। কারণ, তাহলে গাড়িটা কাছে-পিঠে কোথাও না কোথাও থাকত। তা নেই।
বাসু বললেন, নট নেসেসারিলি। হয়তো কোনও গাড়ি-চোর সুযোগ বুঝে সেটা নিয়ে কেটে পড়েছে। এতদিনে নেপাল বর্ডার পার হয়েছে বা বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে।
কৌশিক বলে, তাও হতে পারে।
বাসু প্রশ্ন করেন, বাই-দ্য-ওয়ে! সিগারেট কেস দুটো এনেছ? আর লাইটার?
কৌশিক বলে, আজ্ঞে হ্যাঁ। একটা মামিমার টেবিলে রেখে এসেছি। এই নিন আপনারটা।
পকেট থেকে একটা ঝকমকে জার্মান সিলভারের মসৃণ সিগারেট কেস আর লাইটার বার করে দেয়। বাসু সিগারেট কেসটা খুলে দেখে বললেন, ইন্ডিয়া কিং? এই ব্র্যান্ডই খায় ও?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। তাই তো খবর।
বাসু রুমাল দিয়ে সিগারেট কেসটা ভাল করে মুছে ওঁর টেবিলের একান্তে রাখলেন। কৌশিক বলে, এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না, মামু? এ যেন সেই গোষ্ঠমামার ফাঁদ পাতার কায়দা : ‘দ্যাখ বাবাজি দেখবি নাকি … ধরা যাক, ইন্দ্রনারায়ণ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এল— মানে ঐ ‘সমন’ ধরানোর জন্য প্রতিবাদ জানাতে কিন্তু সে কি নিজের দুর্বলতা সম্বন্ধে সতর্কভাবে সচেতন নয়? সিগারেট কেস সে ছোঁবে?
বাসু বললেন, ও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে এ একেবারে নির্ঘাৎ। কারণ আঠারোই জানুয়ারি ওর টোকিও ফ্লাইট বুক করা আছে। একটা বিজনেস কনফারেন্সে যাচ্ছে ও। উনিশ তারিখ কলকাতায় থাকলে তার সমূহ লোকসান। সে একবার আমার সঙ্গে দরবার করতে আসবেই। আমি তাকে সিগারেট অফার করব। সে খুবই উত্তেজিত থাকবে। যদি ভুলে সিগারেট কেসটা ছোঁয় তাহলে তার আঙুলের ছাপ ওতে পড়বেই। লাইটারটাতেও পড়বে। যদি অতি সুকৌশলে সে ওটা এড়িয়ে যায় বা যদি হাতে গ্লাভস পরে দেখা করতে আসে তাতেও আমার সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত হবে।
ওঁরা দুজনে কথা বলছিলেন বাসুসাহেবের চেম্বারে। এই সময় টেলিফোন যন্ত্রটা সজীব হয়ে উঠল। পাশের ঘর থেকে রানী দেবী টেলিফোনে জানালেন, বারাসাত থেকে মিস্টার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এসেছেন। তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই। জানতে চাইলেন, বাসু কি পাঁচ মিনিটের জন্য সময় দিতে পারবেন?
বাসু কৌশিকের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ বন্ধ করে বললেন, ‘পড়-পড়-পড়, পড়বি পাখি, ধপ!’ তারপর টেলিফোনে জানালেন, ওঁকে বসতে বল। আমি যে ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলছি তাঁকে বিদায় করেই ওঁকে ডাকব। পাঁচ মিনিটের মধ্যে। জিজ্ঞেস কর, চা-কফি খাবেন কি না। নিশ্চয় বলবে, না। তখন বল, হ্যাভ আ স্মোক!
রানী বললেন, সে তো জানাই আছে। অলরাইট।
লাইন কেটে দিলেন। বাসু ঘড়ি দেখলেন। কৌশিক রুমাল দিয়ে ঝকঝকে সিগারেট কেসটা আবার মুছে দিয়ে ধীরপদে পিছনের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে কেটে পড়ল।
বাসু মিনিট পাঁচেক চোখ বুজে যেন ধ্যান করলেন। তারপর টেলিফোনটা তুলে নিয়ে পাশের ঘরে জানতে চাইলেন, ও কী করছে? বসে আছে? না পায়চারি করছে?
—দ্বিতীয়টা।
—সিগারেট কেসটা ছুঁয়েছে?
—না!
—ওকে ভিতরে পাঠিয়ে দাও।
পরমুহূর্তে দড়াম করে খুলে গেল রিসেপশনের দিকের দরজাটা। ঝড়ের বেগে প্রবেশ করলেন ধনকুবের ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। বাসুসাহেবের প্রায় সমবয়সী, কিছু ছোট হতে পারেন। থ্রি পিস দামী স্যুটে আপাদমস্তক টিপটপ। ডোর ক্লোজারের অমোঘ আকর্ষণে ওঁর পিছনে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে একজস্ট-ফ্যানটা চালু আছে।
আগন্তুক উচ্চকণ্ঠে বললেন, বাসু! আমার নাম ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। এর মানেটা কী? হিপপকেট থেকে এক গোছা কাগজ বার করে উনি টেবিলে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিলেন। সেটা আদালতের সমন
বাসু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাসলেন। বললেন, আমার রিসেপশনিস্ট ইতিমধ্যে নামটা জানিয়েছেন। অল রাইট চৌধুরী, আমার নাম পি. কে. বাসু! এভাবে ঝড়ের বেগে আমার ঘরে প্রবেশ করার কী অর্থ?
—কারণ তোমার আচরণে আমি উন্মাদ হয়ে গেছি।
বাসু বললেন, অল রাইট! এখনো যদি নিজেকে উন্মাদ বলে মনে কর, তাহলে একই রকম ঝড়ের বেগে ঐ দরজা দিয়েই উল্টোপথে বেরিয়ে যেতে পার। প্রবেশ আর প্রস্থান একই রকম ড্রামাটিক টেম্পোয় হবে! আর যদি আলোচনা করার ইচ্ছে থাকে তবে ঐ চেয়ারটায় বস। লেটস টক ইট ওভার।
—কথা বলতেই তো এসেছি সেই বারাসাত থেকে।
—তাহলে বস। ধীরে সুস্থে আলোচনা করা যাক!
—বসার কোন প্রয়োজন নেই। আমার বক্তব্য সামান্য। আমার যা বলার দাঁড়িয়ে বলতে পারব!
—অ্যাজ য়ু প্লিজ। তবে আপনি মাননীয় অতিথি। অযাচিত আমার বাড়িতে এসেছেন। আপনি না বসলে আমার বসাটা ভাল দেখায় না। ঠিক আছে, বলুন, আপনার বক্তব্য। না হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনব।
ইন্দ্রনারায়ণ সামনের সোফাটায় বসলেন। বললেন, লুক হিয়ার, মিস্টার বাসু। আপনি অহেতুক আমাকে এ কেসে জড়াচ্ছেন। আমি কেসটার বিন্দুবিসর্গও জানি না। তাছাড়া টোকিয়োতে আমার একটা অত্যন্ত জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। আমার প্লেনের টিকিট পর্যন্ত কাটা আছে!
বাসু বললেন, আয়াম সরি! বুঝতে পারছি, আপনার কিছুটা অসুবিধা হবে। হয়তো কিছুটা আর্থিক লোকসানও। কিন্তু বিবেচনা করে দেখুন, মিস্টার চৌধুরী! – এটা একটা ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার কেস। মেয়েটি তরুণী! তার ফাঁসিও হয়ে যেতে পারে।
—আমি তার কী করতে পারি? আমি তো এ কেসের বিন্দুবিসর্গও জানি না!
—সো কলড মার্ডার ওয়েপনটার লাইসেন্স আপনার নামে।
—তাতে কী? সেটা কিনেই আমি আমার দারোয়ানকে দিয়েছি। দায়দায়িত্ব সমস্ত সেই দারোয়ানের। সেটা সে কী ভাবে খোয়ালো…
—এগুলোই তো আদালতে প্রতিষ্ঠা করতে চাই! আপনার সাক্ষ্যটা অত্যন্ত প্রয়োজন!
—কী ভাবে? কী কারণে?
—বলছি! আপনি উত্তেজিত হয়ে থাকলে চলবে না। আমার বক্তব্যটা শুনুন। আর পরেও যদি মনে করেন যে আপনার সাক্ষ্যটাতে আসামীর কোন উপকার হবে না, তাহলে আমি আপনাকে অব্যাহতি দেব। প্লিজ সোবার ডাউন অ্যান্ড জাজ মাই আর্গুমেন্টস…
চৌধুরী বললেন, অল রাইট, বলুন?
—হ্যাভ আ সিগার…
ড্রয়ার টেনে একটা সিগারের প্যাকেট বার করেন।
চৌধুরী বলেন থ্যাংস, নো, আমি সিগার খাই না। সিগারেট খাই।— কোটের পকেটে হাত চালান।
বাসু তৎক্ষণাৎ বলেন, ইন্ডিয়া কিং চলবে?
—ওটাই আমার ব্র্যান্ড।
চৌধুরী এ পকেট সে পকেট হাতড়াতে থাকেন।
বাসু বলেন, ঐ সিগারেট কেসটাতে ইন্ডিয়া কিং আছে। আমার ভিজিটার্নদের জন্য। আমি নিজে পাইপ খাই। প্লিজ হেলপ য়োরসেলফ।
ইন্দ্রনারায়ণ অম্লানবদনে জার্মান সিলভারের সিগারেট কেস থেকে একটি ইন্ডিয়া কিং নিয়ে ধরালেন। বললেন, এবার বলুন?
—লোকটা খুন হয়েছে আপনার জমিতে। তার গাড়িটা চুরি গেছে আপনার বাড়ির সামনে থেকে। ফার্স্ট ইনফরমেশন দেওয়া হয়েছে আপনার বাড়ির টেলিফোন ব্যবহার করে। সো-কলড মার্ডার ওয়েপনের লাইসেন্স আপনার নামে। সেটা পাওয়া গেছে আপনার জমিতে। প্রতিবাদীর তরফে আপনার সাক্ষ্য অপরিহার্য!
ইন্দ্রনারায়ণ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, আই বেগ টু ডিফার! আমি নই; আমার বাড়ির অনেকে— মালি, দারোয়ান, এফ. আই. আর. যে করেছে সেই চ্যাটার্জি, এদের আপনি কাঠগড়ায় তুলতে পারেন। নিশ্চয় পারেন। আমাকে নয়। আয়াম সরি- আমি ব্যক্তিগতভাবে এ কেসের বিন্দুবিসর্গ জানি না। যে লোকটা খুন হয়েছে তাকে আমি চিনি না, জীবনে কখনো দেখিনি। যে মেয়েটিকে পুলিশে আসামী খাড়া করেছে তাকেও আমি চিনি না, জীবনে কখনো দেখিনি। আমার মালি যখন আসামীর সঙ্গে কথা বলে তখন আমি ঘুমোচ্ছি। আমি তাই প্রতিবাদী পক্ষে সাক্ষী দিতে পারব না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে আমাকে কাঠগড়ায় তুললে আপনার মক্কেলের ক্ষতিই হবে। এই আমার শেষ কথা। আমাকে আপনি অব্যাহতি দিন — বিনিময়ে আমি বাইরে…… থেকে প্রভাব খাটিয়ে যেটুকু সম্ভব আপনার উপকার করতে পারি করব, আই মীন, আপনার মক্কেলের।
বাসু বললেন, এই যদি আপনার শেষ কথা হয় তাহলে আমারও শেষ কথা : আয়াম সরি মিস্টার চৌধুরী। আদালতে আপনাকে হাজিরা দিতেই হবে। আমি সমনটা প্রত্যাহার করতে পারব না।
আধ-খাওয়া সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ইন্দ্রনারায়ণ। বললেন, আমি জানতাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি স্বেচ্ছায় আসিনি। আমার কোম্পানির আইন বিশারদেরা আমাকে বাধ্য করেছে এভাবে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রত্যাখ্যাত হতে। এর কী মর্মান্তিক ফলাফল হবে আপনি কি তা বুঝতে পারছেন?
—আয়াম সরি! না, মিস্টার চৌধুরী। একটু বুঝিয়ে বলুন না।
—আপনি আদালতের ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রির একটি অপূরণীয় ক্ষতি করছেন। কারণ টোকিয়োতে যে বাণিজ্যিক সম্মেলনে আমার আমন্ত্রণ হয়েছে তাতে আমি উপস্থিত থাকলে ভারতের বাণিজ্য লাভবান হবে। আমি আপনাকে সাবধান করে যেতে চাই, মিস্টার বাসু। আমি কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে কম্পেনসেশন ক্লেম করব।
বাসু সহাস্যে বললেন, ইটস য়োর প্রিভিলেজ অ্যান্ড উইদিন য়োর লিগাল রাইটস।
ইন্দ্রনারায়ণ আর কথা বাড়ালেন না। ঝড়ের বেগে চলে গেলেন।
ইন্দ্রনারায়ণের লিমুজিন দৃষ্টিপথের বাইরে যেতেই বাসুসাহেবের চেম্বারে হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন রানী, সুজাতা আর’কৌশিক।
কৌশিক বলে, শেষ পর্যন্ত কী হল গোষ্ঠমামা? ‘এই যাঃ! গেল ফসকে ঘেঁষে?’ সিগারেট কেসটা ছুঁলো না তো?
বাসু ধমকে ওঠেন, জ্যাঠামো কর না। ঐ সিগারেট কেস আর লাইটারটা সাবধানে উঠিয়ে নাও। দুটোতেই ইন্দ্রনারায়ণের আঙুলের ছাপ আছে। চাঁদুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট তো তুমি সংগ্রহ করেই রেখেছ। কতক্ষণের মধ্যে রিপোর্ট পাব?
কৌশিক বলে, স্ট্রেঞ্জ। আপনি সাকসেসফুল? ধরুন ঘণ্টা দেড়েক। আমি আপনার গাড়িটা নিয়ে বের হচ্ছি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে খবর দেওয়াই আছে। আঙুলের ছাপ বিষয়ে উনি কলকাতায় একজন অথরিটি। ফরেনসিক ইন্সটিটিউটে অধ্যাপনা করেন ঐ আঙুলের ছাপ বিষয়ে।
রানী বললেন, লোকটা এত সহজে তোমার ফাঁদে ধরা দেবে এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছে না বাপু। চাঁদু রায় পনের-বিশ বছর পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে আছে, সে জানে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট পুলিশ-রেকর্ডে সযত্নে রাখা আছে। সে জানে, তার গুলিতে পুলিসের একজন বড়কর্তা মারা গেছিল— পুলিস তাকে প্রতিহিংসা নিয়ে খুঁজছে, শুধু কর্তব্যবোধে নয়।
বাসু বললেন, দেখা যাক।
একটু পরেই বাইরের ঘরে বেল বাজল। সুজাতা দেখে এসে বলল, আদালতের প্রসেস- সার্ভার। আপনাকে কিছু কাগজপত্র দিতে চায়।
—আসতে বল।
প্রসেস-সার্ভার ভিতরে এসে নমস্কার করে বলল, আমার কোন অপরাধ নেবেন না, স্যার। আমি আদালতের নির্দেশে কাজ করি।
—জানি। কী কাগজ আছে? দাও!
—বারাসতের শ্রী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী আদালতের কাছে আবেদন করেছেন আপনার সমনটা নাকচ করতে, এছাড়া উনি আপনার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার একটা ড্যামেজ সিভিল স্যুটও এনেছেন— এই দাবি করে যে, আপনি ইচ্ছাকৃতভাবে, বিশেষ ব্যক্তিগত উদ্দেশে তাঁর বাণিজ্যিক ক্ষতি করতে আদালত প্রদত্ত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
বাসু বললেন, কী আনন্দ! দাও, কাগজগুলো সই করে দিই।
লোকটা কাগজপত্র সই করিয়ে নিয়ে চলে গেল। সুজাতা বলল, একটু কফি-ব্রেক করলে কেমন হয়?
বাসু বললেন, হোক!
কফি পান শেষ হতে হতেই টেলিফোনটা বাজল।
বাসুই হাত বাড়িয়ে তুললেন। আত্মপরিচয় দিতেই ও প্রান্ত থেকে কৌশিক বলল, মামু, দুঃসংবাদ আছে…
—বলো! সুসংবাদ আবার কবে দিতে পারবে তুমি?
—আমি ডাক্তার গোস্বামীর বাড়ি থেকেই ফোন করছি, মানে সেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট…
—বুঝেছি। এত শীঘ্র ফটো তুলে ডেভেলপমেন্ট হয়ে গেল?
—না মামু। উনি পাউডার-ডাস্টিং করেই বললেন, ফটো তুলে এনলার্জ করার দরকারই হবে না। ম্যাগনিফাইং গ্লাসেই বোঝা যাচ্ছে— এ দুটো ফিঙ্গারপ্রিন্টে কোন মিলই নেই। চোরে- চোরে মাস্তুতো ভাইয়ের সম্পর্ক আছে কি না জানি না — কিন্তু দুটো প্রিন্ট সম্পূর্ণ ভিন্ন গ্রুপের! ভিন্ন মানুষের!
বাসু জবাব দিলেন না।
কৌশিক বলে, কী বললাম বুঝতে পেরেছেন?
বাসু ক্র্যাডেলে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন। নীরবে।
রানী জিজ্ঞেস করলেন, ইন্দ্রনারায়ণ তাহলে চাঁদু রায় নয়?
—তাই তো দেখছি এখন! আশ্চর্য!
—এদিকে ইন্দ্রনারায়ণ তো তোমার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার খেসারত দাবি করে মামলা ঠুকেছেন। কী করবে?
বাসু পাইপে তামাক ঠেশতে ঠেশতে বললেন, মুম্বাই-এর বস্তিতে জগদীশের ছেড়ে আসা সেই ঝুপড়িটা খালি আছে কি না খোঁজ নিতে কৌশিককে মুম্বাই পাঠাব ভাবছি।
—মানে? কী হবে সে খোঁজে? -রানী দেবী হালে পানি পান না।
—মানে, বলছিলাম কি নিউ আলিপুরের বাড়িটা বেচলেও তো এক কোটি টাকা হবে না। ঐ বস্তিতে ঝুপড়ি ভাড়া নিতে হবে আর কি। তুমি আমি দুজনে বাকি জীবন না হলে থাকব কোথায়?