দ্বি-বৈবাহিক কাঁটা – ৬

পরদিন ঘুম ভাঙতে ওঁর কিছু বেলা হল। বাইরে অকাল বর্ষণ হচ্ছে। প্রাতঃভ্রমণ আজ বাদ দিতে হয়েছে। প্রাতঃরাশ টেবিলে কৌশিককে না দেখতে পেয়ে সুজাতাকে প্রশ্ন করেন, তোমার কতাটি কোথায়?

—কাল অনেক রাত করে ফিরেছে। আবার আজ খুব সকালেই বেরিয়ে গেছে, বলেছে লাঞ্চে আসবে, একটা নাগাদ।

—ও কি ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো নিয়ে গেছে?

—হ্যাঁ, কালই যত্ন করে ওর অ্যাটাচি কেসে তুলে রাখল।

এইসময় বেজে উঠল টেলিফোন। বাসু সাড়া দিতেই ভবানীভবন থেকে ইন্সপেক্টর বরাট বললে, সরি টু ডিসটার্ব য়ু, স্যার। আপনার মক্কেল বলছে আপনার অনুপস্থিতিতে সে কোনও প্রশ্নের জবাব দেবে না।

—আমার মক্কেল! কে আমার মক্কেল?

—ঐ যে সুন্দরীটির নাম গতকাল আপনি আমাকে জানাতে রাজি ছিলেন না। বললেন, আইনে তার প্রভিশন্স নেই!

বাসু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, সরাসরি কথা বলুন ইন্সপেক্টর বরাট! আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনারা একজনকে অ্যারেস্ট করেছেন, যে ক্লেম করছে যে, সে আমার ক্লায়েন্ট। তার নাম কী?

—মিস অপরাজিতা কর।

—কোন কেসে তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে? কী চার্জ?

—চার্জ তো ফ্রেম হবে পরে। আপাতত তাকে আমরা উঠিয়ে এনেছি কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে, ঐ ইন্দ্রনারায়ণবাবুর গেটে প্রাপ্ত মৃতদেহটা সম্বন্ধে। তা উনি বলছেন, আপনার উপস্থিতি ছাড়া তিনি কিছুই বলবেন না।

—অলরাইট। আমি এখনি আসছি!

টেলিফোনের লাইনটা কেটে দিয়ে বাসু এদিকে ফিরে বললেন, ওরা অপরাজিতাকে স্পর্ট করল কী ভাবে? আশ্চর্য!

বাসু ভবানীভবনে হোমিসাইড লক-আপে চলে এলেন। অপরাজিতার সঙ্গে জনান্তিকে কথা হল। কোন সূত্র থেকে পুলিশ ওকে সন্দেহ করেছে তা অপরাজিতাও আন্দাজ করতে পারল না। তাকে পুলিশ খুঁজে পায় বেলা পাঁচটা নাগাদ। যে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে ওর যাওয়ার কথা ছিল সেখানে পৌঁছতেই অপেক্ষমাণ পুলিশে ওকে অ্যারেস্ট করে। তবে অপরাজিতা কোন কিছুই স্বীকার করেনি। কোনও জবানবন্দিও দেয়নি।

বাসু বললেন, দেবে না। ওরা তোমাকে কিছুতেই জামিন দেবে না। তোমাকে ক্রমাগত অনেক প্রলোভন দেখাবে। বলবে, আমরা জানি, আপনি খুন করেননি, আপনি নিরপরাধ, কিন্তু আপনি যেটুকু জানেন তা বলে দিন, এক্ষুনি আপনাকে ছেড়ে দেব। তুমি রাজি হয়ো না! ইন ফ্যাক্ট, তোমার জবানবন্দি এমনি বিচিত্র যে আমারই বিশ্বাস হচ্ছে না। তুমি কি কিছু গোপন করেছ, জিতা? অথবা কিছু মিছে কথা বলেছ?

অপরাজিতা দৃঢ়স্বরে বললে, না! আমি যা বলেছি তা আপনার কাছে যতই অবিশ্বাস্য মনে হোক, সেটাই সত্য! আদ্যন্ত সত্য!

—অলরাইট! আমি মেনে নিলাম। আগেও বলেছি, আবারও বলছি, সামান্যতম মিছে কথা বললেও তা তোমার কাছে ‘বুমেরাং’ হয়ে ফিরে আসতে পারে!… ঠিক আছে।

* * *

লাঞ্চে খেতে এল কৌশিক। বললে, অনেক খবর জমেছে। একে-একে বলি। প্ৰথম কথা, আপনি যখন হোমিসাইডকে প্রথম টেলিফোনে জানান যে, ইন্দ্রনারায়ণের গেটের কাছে একটি যুবকের মৃতদেহ পড়ে আছে, তার আগেই হোমিসাইড সেটা জেনেছে। আপনি যখন রিপোর্ট করছেন সে সময় ঘটনাস্থলে চার-পাঁচজন অফিসার সরেজমিনে তদন্ত চালাচ্ছে। সার্চ করছে। ফটো তুলছে।

বাসু বলেন, ফার্স্ট রিপোর্ট কে করে? কটার সময়?

—আপনি রিপোর্ট করেছিলেন প্রায় সাড়ে এগারোটার সময়, অপরাজিতা এখানে এসে আপনাকে সব কথা বলার পর। কিন্তু সকাল নটা দশ মিনিটে ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি থেকে হোমিসাইডকে জানানো হয় যে, ঐ বাড়ির গেটের সামনে একটা মৃতদেহ পড়ে আছে।

—কে জানায়? ইন্দ্রনারায়ণ?

—না! ইন্দ্রনারায়ণের একান্ত সচিব। আসলে বাগানের মালিটা দরজার ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য করছিল, অপরাজিতার প্রস্থান। হয় যুবতী নারী দেখার লোভে কিংবা দুরন্ত কৌতূহলে। সে দেখে, অপরাজিতা গেটের কাছে গাড়ি থামায়, নেমে আসে, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে। তারপর জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়ে। একটু পরেই ফিরে আসে। মেয়েটির হাতে কী একটা ভারি জিনিস ছিল, সেটা সে তেঁতুল গাছটা লক্ষ্য করে ছুড়ে ফেলে দেয়। গাড়ি চালিয়ে দ্রুত চলে যায়।

—বুঝলাম। তারপর?

—মালিটার কৌতূহল হয়। অপরাজিতার গাড়ি চলে যেতেই সে নিজে এগিয়ে আসে তদন্তে। মৃতদেহটাকে আবিষ্কার করে। ঐ সময়েই গাড়ি নিয়ে এসে পড়েন চৌধুরীসাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি পল্লব চট্টোপাধ্যায়। মালিটা তাঁকে সব কথা জানায়। মৃতদেহটা দেখায়। একটু আগে একটি মেয়ে একটা গাড়ি নিয়ে এসে সাহেবের খোঁজ করছিল, তাও জানায়। মালিটার মনে হয়েছিল, তেঁতুলতলার দিকে মেয়েটি কী একটা জিনিস ছুড়ে ফেলে। সেটা রিভলভারও হতে পারে। মিস্টার চ্যাটার্জি বলেন, তোমরা খোঁজাখুঁজির চেষ্টা কর না, প্রথমেই চল পুলিশে ফোন করে ব্যাপারটা জানাই। যা করার ওরাই করবে।

বাসু জানতে চান, মালিটার নাম কী?

—তা জানা হয়নি। খোঁজ নিলেই অবশ্য জানা যাবে।

বাসু বললেন, বুঝলাম। ফিঙ্গার প্রিন্টের কোন হদিস হল?

—হয়েছে। গোয়েন্দা দপ্তর ভীষণ কৌতূহলী : আপনি কী করে এই টিপছাপ সংগ্রহ করলেন। হয়তো স্বয়ং আই. জি., ক্রাইম আপনার কাছে জানতে চাইবেন।

—তার মানে, ফিঙ্গার প্রিন্ট একজন কুখ্যাত দাগী আসামীর? আর্চ ক্রিমিনাল? যাকে পুলিশে এতদিন খুঁজছে?

—আজ্ঞে না। তাহলে খুলেই বলি। আমি ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে এ তথ্য পেয়েছি, এটুকু জানিয়ে যে, টিপছাপগুলো কার, তা আমি জানি না; কিন্তু যে জানে তাকে জানি। ওরা আন্দাজ করেছে সে ব্যক্তি আপনি। কিন্তু পুলিশের কোন জুনিয়ার স্টাফ আপনাকে অ্যাপ্রোচ করতে সাহস করছে না। আই. জি., ক্রাইম দিল্লি গেছেন। কাল ফিরবেন। হয়তো কাল আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

—তুমি কতটুকু কী জানতে পেরেছ?

কৌশিক দীর্ঘ একটি কাহিনী শোনালো :

বিশ বছর আগে মুম্বাইয়ের ক্রুফোর্ড মার্কেটে একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয় প্রায় দশ লাখ টাকা। পুলিশ ডাকাতদের ধরে; কিন্তু টাকাটার হদিস পায় না। তিনজন মূল আসামীরই যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আসামী তিনজনের নাম : বিশ্বনাথ যাদব, জগদীশ পাল আর চাঁদু রায়। একজন বিহারী, দুজন বাঙালি। বছর তিনেক মেয়াদ খাটার পর তিনজনই জেলের পাঁচিল টপকে পালায়। পাঁচিলের বাইরে ডাকাতদলের পার্টির লোক ছিল। জিপ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ঠিক তখনি পাগলা ঘণ্টি বাজে। পুলিশে তাড়া করে। ঘটনাচক্রে সে রাত্রে পুলিশের এক বড়কর্তা জেলখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। তিনিই দু-তিনখানি জিপ নিয়ে ওদের তাড়া করেন। তারপর কিছুটা হিন্দি সিনেমার কেরামতি। দুপক্ষই গুলি চালায়। বিশ্বনাথ যাদব এবং ডাকাতদলের জিপ ড্রাইভার ঘটনাস্থলেই মারা পড়ে। আহত জগদীশ পাল ধরা পড়ে; কিন্তু চাঁদু রায় পালিয়ে যায়। ঐ এনকাউন্টারে একজন কনস্টেবল আর ঐ পুলিশের বড়কর্তাটি মারা যান। ‘সেই থেকে বিভিন্ন স্টেটের পুলিশ এবং সি. বি. আই. আর্চ ক্রিমিনাল চাঁদু রায়কে খুঁজছে। জগদীশ পাল দীর্ঘদিন মেয়াদ খেটে ছাড়া পায়। বোম্বাইয়ের একটা বস্তিতে অতি দীনহীনভাবে বাস করতে থাকে। বছরখানেক নজর রেখে পুলিশের ধারণা হয়, জগদীশের সঙ্গে চাঁদুর কোনও যোগাযোগ বর্তমানে নেই। তাছাড়া অপহৃত ঐ টাকার পাত্তাও জগদীশ জানে না। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা গেল, জগদীশ সেই মুম্বাই বস্তি থেকে উধাও। পুলিশের ধারণা, ইচ্ছে করেই বছরখানেক জগদীশ পাল মুম্বাইয়ের ঐ বস্তিতে কৃচ্ছ্রসাধন করেছে। পুলিশের সন্দেহভঞ্জন করতে। আমি কাল আপনার দেওয়া ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়ে হাজির হবার দুঘন্টার মধ্যে ওরা ঐ ফিঙ্গারপ্রিন্ট শনাক্ত করে। নিঃসন্দেহে জগদীশ পালের। আমাকে খুব চাপাচাপি করে। এটা এভিডেন্স, আমি গোপন করতে পারি না। যেহেতু আমি লাইসেন্সড গোয়েন্দা, ইত্যাদি। আমি বাধ্য হয়ে বলেছি— আমি জানি না, আপনি কোথা থেকে কীভাবে এগুলো সংগ্রহ করেছেন। আপনার নামটা জানিয়ে দেওয়ার পর ওরা আমাকে নিষ্কৃতি দেয়। এখন বেড়ালের গলায় কে ঘণ্টাটা বাঁধবে এই নিয়ে ওরা গবেষণা করছে। সম্ভবত আই. জি., ক্রাইম দিল্লি থেকে ফিরে এসে আপনাকে ফোন করবেন। আমার ধারণা, পুলিশের কেস রেডি। ওরা দু-এক দিনের মধ্যেই আসামীর বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করবে।

—মাইতির হিসাব মতো হত্যাকারী অপরাজিতা কর?

—তাছাড়া কে? মালিটা স্বচক্ষে দেখেছে তাকে রিভলভারটা ছুড়ে ফেলতে। পুলিশ তেঁতুলতলা থেকে সেটা নিশ্চয় উদ্ধার করেছে। তাতে যদি অপরাজিতার আঙুলের ছাপ থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কারণ, যতদূর মনে হয়, ব্যালিসটিক এক্সপার্ট কম্পারিজিন মাইক্রোস্কোপে প্রমাণ করবেন যে, রিভলভারের এক্সপেন্ডেড বুলেটটা…

বাসু বাধা দিয়ে বলেন, তোমাকে ও নিয়ে পণ্ডিত্বেমি করতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করে যাও। ইন্দ্রনারায়ণের গতিবিধির ওপর তোমার লোক নজর রাখছে তো?

—হ্যাঁ, ডবল শিফটে।

—না, ওটা ট্রিপল শিফট করে দাও। তিন-আষ্টা চব্বিশ। সর্বক্ষণ ইন্দ্রনারায়ণ কোথায় থাকছে, কার কার সঙ্গে দেখা করছে, আমি বিস্তারিতভাবে জানতে চাই।

—সুজাতা বলে, আমি একটা আন্দাজে ঢিল ছুড়ব মামু? ওয়াইল্ড গেস্?

—ছোড়!

—আপনি ফর্মুলাটা তৈরি করে ফেলেছেন এভাবে : শ্রীমান চাঁদু রায় ইকুয়াল্ট ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী!

বাসু বললেন, উঃ! কী দারুণ গোয়েন্দা! শোন বাপু! এটা আর এখন আন্দাজে ঢিল ছোড়ার পর্যায়ে নেই। এটা এখন দুয়ে দুয়ে চার! জগদীশ জেল থেকে ছাড়া পাবার পর আর তার পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সন্ধান পায় না। পনের-বিশ বছরে দুনিয়াটা আদ্যোপান্ত পাল্টে গেছে। পুলিশের নজর এড়াতে নয়, হয়তো সত্যিই অর্থাভাবে জগদীশ মুম্বাইয়ের বস্তিতে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। ও আন্দাজ করেছিল, লুণ্ঠিত টাকাটা মূলধন করে চাঁদু এতদিনে হয়তো কোটিপতি। কিন্তু চাঁদু নিজের খোল-নলচে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছে। তাকে চেনা যাচ্ছে না। আমার আন্দাজ, জগদীশ বইয়ের স্টলে গিয়ে ‘বিজনেস ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকার পাতা ওল্টাতো। প্রতি সংখ্যাতেই এক- একজন বিজনেস ম্যাগনেটের ওপর ওতে তখন ছবিসহ কভার স্টোরি ছাপা হত। জগদীশ বইয়ের স্টলের একান্তে দাঁড়িয়ে প্রতিটি সংখ্যার পাতা উল্টে ছবি দেখত। হয়তো স্টলওয়ালাকে বিড়ি-টিড়ি খাইয়ে বন্ধুত্ব পাতিয়েছিল। জগদীশের অবস্থা তখন ‘ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর’। তারপর একদিন — বছর চারেক আগে— ক্ষ্যাপা পরশ পাথরটা খুঁজে পেল। ফটো দেখে চাঁদুকে চিনতে পারল। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকায় ঐ সংখ্যাটা কিনে ফেলল। টিকিট কেটে বা না কেটে যেমন করেই হোক, চলে এল কলকাতায়। ওর মতো ভ্যাগাবন্ডের পক্ষে কোটিপতির সাক্ষাত পাওয়া নিতান্ত অসম্ভব। কিন্তু ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রটা জগদীশ ঘটনাচক্রে শিখে ফেলেছে। ইন্দ্রনারায়ণের লেটার বক্সে সে চিঠি ফেলে দিল। ব্ল্যাকমেলিং-এর প্রস্তাব। না হলে জগদীশ সোজা চলে যাবে লালবাজারে। চাঁদুর ফিঙ্গারপ্রিন্ট সযত্নে রাখা আছে লালবাজারে।

রানী বললেন, তুমি যা বলছ, তার একটাই বিরুদ্ধ-যুক্তি। জগদীশ যদি চাঁদু রায়ের সন্ধান পেত এবং দেখত যে সে ইন্দ্রনারায়ণ, তাহলে সে মেরীনগরে এককামরা ঘরে ঠোঙা বানাতো না, কলকাতায় ফ্ল্যাটবাড়ি কিনত। টিভি, ফ্রিজ আর গাড়ি কিনত!

কৌশিক বললে, আই এগ্রি!

বাসু বললেন, তোমার যুক্তিপূর্ণ সওয়ালের জবাবটা দিই রানু : আমার আন্দাজটা পুরোপুরি সত্যি না হলেও মোটামুটি সত্য হতে পারে! ধরা যাক, ঘটনাপ্রবাহ অন্যরকম হয়েছিল। হয়তো জগদীশ মুম্বাইয়ের বিজনেস ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটি দেখেনি। স্ত্রী-পুত্রের খোঁজ নিতে মেরীনগরে এসেছিল প্রথমে। মিনতির বদান্যতায় মাথাগোঁজার আশ্রয় পায়। ইতিমধ্যে হয়তো তার একটা হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। সে প্রায়-অথর্ব। যেহেতু পরেশ পালের বাল্যজীবন কেটেছে মেরীনগরে তাই পরেশের কোন বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে হয়তো জগদীশ তার পুত্র পরেশ পালের বারাসাতের ঠিকানাটা জোগাড় করতে পারে। ধরা যাক, কাকতালীয়ভাবে ঐ সময়েই সে ‘বিজনেস ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটি হাতে পায়। ও নিজে হার্ট পেশেন্ট। তাই ছেলেকে চিঠি দেয়। পরেশ জানত, বাবা জেলখাটা আসামী — কিন্তু একথাও জানত যে, ব্যাঙ্ক-লুটের কয়েক লক্ষ টাকার হদিস পাওয়া যায়নি। হয়তো জগদীশ সেকথার ইঙ্গিত দিয়েই পুত্রকে দেখা করতে বলেছিল। এ পর্যন্ত যা বলেছি তা কি কোন কারণে অসম্ভব মনে হচ্ছে তোমাদের কারও কাছে? কী? রানু? কৌশিক?

কেউ কোন জবাব দেয় না।

—ধরা যাক, পরেশ এসে বাপের সঙ্গে দেখা করল। চাঁদু রায়ের বর্তমান পরিচয় জেনে গেল। ব্ল্যাকমেলিং শুরু করল জগদীশ নয়, পরেশ। বাবাকে মাঝে মাঝে দয়া করে দু-তিনশ টাকা মনি-অর্ডার করে। তাই নখদন্তহীন জগদীশ যে একদিন চলন্ত জিপ থেকে পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময় করেছে— সে ডাক্তারের বাড়ি থেকে পুরানো কাগজ নিয়ে এসে ঠোঙা বানায়। পুত্রের ভিক্ষায় টিকে থাকে। আর এদিকে পরেশ পাল শুধু শর্মিষ্ঠাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। নতুনত্বের স্বাদে নির্মলাকে বিয়ে করে বসে। বাড়ি বানায়, গাড়ি কেনে, দু-দুটি সংসারের খরচ চালায়। আর হয়তো সেই কারণেই মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে চাঁদু রায়ের দুই শত্রু- বাপ ও বেটা, মৃত্যুবরণ করে।

সুজাতা বলে, আপনি কি সন্দেহ করছেন, ‘আপনার কাজিন ব্রাদার’ জগদীশ পালের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি?

—না, তা সন্দেহ করছি না। কিন্তু এটা আশঙ্কা করছি যে, চাঁদু রায়ের চর যেই সংবাদ নিয়ে আসে যে, মেরীনগরে জগদীশ পালের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে সেই মুহূর্তেই চাঁদু ব্যবস্থা করে পরেশ পালের অস্বাভাবিক মৃত্যুর — এমন কায়দায় যাতে হত্যাপরাধটা বর্তায় অপরাজিতার স্কন্ধে। তাহলেই সে বাকি জীবন নিশ্চিন্ত।

কৌশিক বলে, আপনি এখন কী করতে চান?

—ইন্দ্রনারায়ণকে নজরবন্দি রাখতে। পুলিশ শুনছি রেডি। আমার মক্কেল জামিন পায়নি। সম্ভবত দু-চারদিনের মধ্যেই দায়রা জজের আদালতে কেসটা উঠবে। নোটিস পাওয়া মাত্র আমি ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উপর আদালতের সমন জারি করতে চাই। রানু, তুমি নোটবইটা নিয়ে এস তো— আমি এখনি ডিকটেশনটা দিয়ে তৈরি হয়ে থাকতে চাই। যাতে মুহূর্তমধ্যে তারিখ বসিয়ে সমনটা ধরানো যায়!

কৌশিক বলে, কিন্তু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী একজন বিজনেস ম্যাগনেট, সেন্ট্রাল ক্যাবিনেটের অনেকের সঙ্গে তাঁর দহরম-মহরম।

—সো হোয়াট? সে তো হর্ষদ মেহতারও ছিল। ইন্দ্রনারায়ণ কি ভারতীয় নাগরিক নয়?

—কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মামলার সঙ্গে তাঁর যে কোনও সম্পর্ক নেই!

—আপাতদৃষ্টিতে না থাকলে দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলাতে হবে। সেটা আমার দায়িত্ব। তুমি চিন্তা কর না। ও- ভাল কথা! একটা তথ্য আমি জানতে চাই। ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী কি ধূমপান করে? করলে কী?— পাইপ, চুরুট না সিগারেট? যদি চুরুট বা সিগারেট হয় তাহলে কী ব্র্যান্ড?

এসব তথ্য জেনে আপনার কী লাভ?… আচ্ছা আচ্ছা… আয়াম, সরি…. আপনি রাগ করবেন না— আমি জেনে নিয়ে আপনাকে জানাব।