৫
বলেছিলেন বটে যে, ধাবায় বসে গোস্ত-রুটি চিবাতে হবে সুজাতাকে, বাস্তবে অতটা নিষ্ঠুর হলেন না। গাড়িটা নিয়ে এসে উঠলেন এয়ারপোর্ট হোটেলের ডাইনিং রুমে। হেড-স্টুয়ার্ড এগিয়ে আসতেই বাসু বললেন, এই দেখ বালটিমোর, কতদূর থেকে তোমাদের টানে আবার এসে পড়েছি।
অ্যাংলো ইন্ডিয়ান স্টুয়ার্ড ওঁদের যত্ন করে বসালো। খাবারের অর্ডার নিয়ে গেল। খাবার সার্ভ করতে যেটুকু সময় লাগল তার মধ্যে উঠে গিয়ে বাসু বাড়িতে একটা ফোন করলেন। না, কোনও ডেভেলপমেন্ট হয়নি তারপর। থানা কেন অপরাজিতার খোঁজ করছে কৌশিক জানে না। সুজাতা মনে করিয়ে দিল। মামু, আপনার পকেটে সেই চিঠিখানা আছে কিন্তু যা আপনি খুলে পড়েননি।
বাসু বললেন, মনে আছে আমার। নতুন কোন পার্টি।
সুজাতা বললে, অনেকদিন পরে আপনার ভুল ধরেছি, মামু। আপনি চিঠির প্রেরককে চিনতে পারেননি। মিনতি দাসী মানে মেরীনগরের সেই মিন্টিদি, যাকে সমস্ত সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন পামেলা জনসন। আপনার মনে নেই! মরকতকুঞ্জের মিন্টিদি?
বাসু বললেন, তাই তো! সেই ‘সারমেয় গেণ্ডুকের’ মিণ্টি। রস, চিঠিখানা এই মওকায় পড়ে নিই।
ইতিমধ্যে সুজাতার জন্য একটা সিট্রা আর বাসুসাহেবের জন্য বিয়ার এসে গেছে। সঙ্গে ফিঙ্গার চিপস।
বাসু খামটা খুলে ওর গর্ভ থেকে বার করলেন একটা ফটোগ্রাফ আর মিনতির চিঠি। ফটোটা দেখেই আপন মনে বলে ওঠেন, গুড গড।
সুজাতার ঝুঁকে পড়ে বলে, কী? কার ফটো?
বাসু সেটা বাড়িয়ে ধরেন। সুজাতাও বলে, আশ্চর্য কোয়েন্সিডেন্স! আধঘণ্টার মধ্যে দুটি ভিন্ন ভিন্ন সূত্র থেকে একই লোকের ছবি হাতে এল।
বাসু প্রশ্ন করেন, তুমিও তাহলে চিনতে পারছ?
—নিশ্চয়ই। সুশোভন রায়ের। যদি না তার যমজ ভাইয়ের হয়।
—অথবা পরেশ পালের। দাঁড়াও, মিন্টির চিঠিখানা পড়ি।
যাঁরা মেরীনগরের মিনতি দাসীকে চেনেন না, তাঁদের জানিয়ে রাখা ভাল যে, মিনতি ছিল মিস পামেলা জনসনের শেষ জীবনের সঙ্গিনী, যাঁকে ঐ ভদ্রমহিলা তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। মিনতির লেখাপড়া বিশেষ হয়নি, কিন্তু মনটা সরল। মেরীনগরের সবাই তাকে ভালবাসে। চিঠিখানা মিনতি নিজে লেখেনি। কাউকে দিয়ে লিখিয়েছে। তলায় গোটা গোটা হরফে মিনতির স্বাক্ষরটা আছে। কাগজ সেই মরকতকুঞ্জের মনোগ্রাফ-করা দামী বন্ড পেপার। মিনতি এত কম চিঠি লেখে যে, পামেলা জনসনের সেই সখের কাগজ এখনো শেষ হয়নি।
মিনতি অশেষ প্রণাম জানিয়ে লিখেছে যে, বাসুসাহেবের পক্ষে কোন কাজই নাকি অসম্ভব নয়। তাই সে একটি ব্যাপারে ওঁর সাহায্যপ্রার্থী। মেরীনগরে মিনতির এক প্রতিবেশী খ্রীস্টান বৃদ্ধ দুদিন আগে মারা গেছেন। তাঁর মৃতদেহ স্থানীয় চার্চের ডেথ-চেম্বারে এমবাম করে রেখে দেওয়া হয়েছে। কারণ এই দুনিয়ায় বৃদ্ধের একটি মাত্র নিকট আত্মীয় আছে। তাঁর পুত্র। সে প্রতিমাসে বৃদ্ধের খোরপোশের টাকা পাঠাতো। বৃদ্ধের নাম জগদীশ পাল। তাঁর পুত্রের নাম কেউ জানে না। তবে মিনতি তাকে দেখলে চিনতে পারবে। মৃত বৃদ্ধের বাক্স ঘেঁটে পুত্রের একটি ফটোগ্রাফ পাওয়া গেছে। ফটোখানা মিনতি চিঠির সঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছে। মিনতি জানে, কলকাতা বিরাট শহর। সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস। যার নামটা পর্যন্ত জানা নেই, ফটো দেখে তাকে খুঁজে বার করা অসম্ভব। কিন্তু মিনতি একথাও জানে যে, পি. কে. বাসুর অসাধ্য কাজ কিছুই নেই। একটা মানুষ— ওরই প্রতিবেশী— ডেথ চেম্বারে পচছে, তাকে কবর দেওয়া যাচ্ছে না। খ্রীস্টান না হয়েও এটা মিনতির সহ্য হচ্ছে না। বাসুসাহেব যেন যথাকর্তব্য করেন। অন্তত ওর প্রতিবেশী জগদীশ পালের গোর দেওয়ার ব্যবস্থাটা যাতে ত্বরান্বিত হয়।
বাসু বলেন, ব্যস, উঠে পড় সুজাতা। এখনি মেরীনগর যাব।
সুজাতা বলে, ও মা সেকি! আপনি আইসক্রিমের অর্ডার দিয়েছেন যে, বিল এখনো আসেনি—
বাসু বলেন, আইসক্রিমটা ক্যানসেল করে দিই, বিল দিতে বলি, কি বল?
—না। আপনি একা মেরীনগর যান। তবে যাবার আগে বিল মিটিয়ে যাবেন। আমি মিনিবাসে বাড়ি ফিরে যাব।
—এ তো তোমার রাগের কথা।
—রাগের কথা তো বটেই। মুখের সামনে থেকে কেউ আইসক্রিম কেড়ে নিলে কি অনুরাগের কথা বার হয় মুখ দিয়ে?
অগত্যা আরও আধঘণ্টা দেরি হল। মেরীনগর এ পথেই যেতে হয়। জাগুলিয়ার মোড় থেকে বাঁক মেরে। কল্যাণীর কাছাকাছি। মেরীনগরে মিস পামেলা জনসনের মৃত্যুরহস্যের কিনারা করতে এসেছিলেন সত্তরের দশকে। পুরানো আমলের অনেকেই অবশ্য নেই— ডাক্তার পিটার দত্ত, মিস ঊষা বিশ্বাস ইত্যাদি। কিন্তু মিনতি আছে। তার চিঠি পেয়েছেন। হয়তো ডক্টর প্রীতম ঠাকুরও আছে। সে বলেছিল মেরীনগরেই ডাক্তারি প্র্যাকটিসে বসবে।
মরকতকুঞ্জে যখন গিয়ে পৌঁছলেন তখন বেলা সাড়ে তিনটে। এবার কিন্তু সারমেয় গর্জন শুনতে পেলেন না। মিনতি বাসুসাহেবকে দেখে দারুণ উচ্ছ্বসিত। ওঁদের দুজনকে যত্ন করে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালো। প্রথম প্রশ্নই জিজ্ঞেস করল : কী খাবেন বলুন? আজ রাতে এখানেই খেয়ে যেতে হবে কিন্তু!
বাসু বললেন, তা হয় না, মিনতি। আমি বরং বিকালবেলা তোমার কাছে চা পান করে যাব। তোমার চিঠিখানা আজই পেয়েছি, তৎক্ষণাৎ আমি ছুটে এসেছি; কারণ আমার মনে হচ্ছে, এ আমার কাজিন-ব্রাদার জগদীশদা, দেখলে চিনতে পারব। তোমার সঙ্গে চার্চের ফাদারের আলাপ আছে?
—থাকবে না? চার্চটা গড়ে দিয়েছিলেন তো এই মরকতকুঞ্জেরই মিস জনসনের বাবা, আমি সেই মরকতকুঞ্জেই থাকি। যদিও আমি খ্রীষ্টান নই, তবু উনি আমাকে খুব ভালভাবেই চেনেন, স্নেহ করেন, চলুন, আমিই নিয়ে যাব।
—বস, তার আগে জগদীশ পাল সম্বন্ধে তুমি কতটুকু কী জান বল দিকিন। আমি বুঝে নিতে চাই এই আমাদের সেই জগদীশদা কি না।
মিনতি বললে, আমি বাজি রেখে বলতে পারি তা নয়। কারণ জগদীশ পাল নিতান্ত গরিব ঘরের ছেলে। যৌবনে এই মরকতকুঞ্জেই বাগানের মালির কাজ করেছে। এখানকারই মানুষ। বিয়ে করে। একটি ছেলেও হয়। তারপর বউ-ছেলেকে ফেলে ও পালিয়ে যায়! ও আপনার দূরসম্পর্কের ভাই হতেই পারে না।
—এ সব কথা তোমাকে কে বলেছে?
—ঐ জগদীশ বুড়োই বলেছে। যখন মদের ঝোঁকে পুরানো দিনের গল্প করতে বসত।
শোনা গেল স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে ফেলে জগদীশ পালিয়ে যায়। মিস জনসন স্বামীত্যক্তাকে মালির ঘরেই থাকতে দেন। দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর জগদীশ যখন ফিরে আসে তখন তার স্ত্রীও মারা গেছে, মিস জনসনেরও দেহান্ত হয়েছে। ছেলেটা কোথায় গেছে কেউ জানে না।
সব কথা শুনে মিনতির দয়া হয়। জগদীশ বলেছিল, অর্থাভাবে জর্জরিত হয়ে কাউকে কিছু না বলে সে টাকা রোজগার করতে বোম্বাই চলে যায়। সেখান থেকে খালাসি হয়ে জাহাজ চেপে বিদেশে। বিভিন্ন দেশে সে ঘুরেছে। এখন ষাট বছর বয়সে সে চাকরি থেকে অবসর পেয়ে দেশে ফিরে এসেছে। মিনতির দয়ার শরীর। আউট-হাউসের সাবেক পোড়ো ঘরেই বৃদ্ধকে থাকতে দেয়। লোকটা কুকুর ভালবাসতো। সে একটা কুকুর পুষতে শুরু করে। রোজ সকাল-সন্ধ্যায় কুকুরকে চেন দিয়ে বেঁধে বুড়ো বেড়াতে নিয়ে যেত। একাই থাকত। তামাক খেত। মাঝে মধ্যে
মদ্যপানও করত।
বাসু বলেন, একটা কথা, ওর বাড়ি ভাড়া লাগত না। ইলেকট্রিক বিলও দিতে হত না; কিন্তু ও দুবেলা খেত কী করে? উপার্জন করত কিছু?
—আজ্ঞে না। জাহাজ কোম্পানি থেকে ওর নামে মাঝে মাঝে মানি অর্ডারে পেনশন আসত। দু-চারমাস অন্তর। কখনো দুশো, কখনো পাঁচশো।
বাসু বললেন, তার মানে তুমি কিছুই জান না। জাহাজ কোম্পানি মানি অর্ডারে কাউকে পেনশন পাঠায় না। অবসরপ্রাপ্তকে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে বলে এবং অ্যাকাউন্ট-পেরি চেক বা ড্রাফটে পেনশন দেয়। তাতে খরচ পড়ে কম। দ্বিতীয়ত, পেনশন মাসে মাসে আসে। দু-চার মাস অন্তর নয়। তৃতীয় কথা, পেনশনের পরিমাণ দুশো পাঁচশ হয় না। হতে পারে প্রতিমাসে দুশো তের টাকা, অথবা পাঁচশ সাতটাকা। তুমি বরং দেখ, প্রীতম সিং ঠাকুর তার বাড়িতে আছে কি না।
খবর পেয়ে ডক্টর প্রীতম সিং ঠাকুর দেখা করতে এলেন। জানা গেল, ডক্টর ঠাকুর এই মরকতকুঞ্জের একান্তে একটা তিন কামরা বাড়ি তৈরি করে এখানেই প্র্যাকটিসে বসেছেন। ওর ছেলে রাকেশ আছে আমেরিকায়। সেখানেই বিয়ে-থা করেছে। কিন্তু ওর ছোট মেয়ে আজও অবিবাহিতা। এম. এ., বি. এড. করে স্থানীয় স্কুলে পড়ায়। ও ডক্টর ঠাকুরের দেখভাল করে। কিছুটা পুরানো দিনের স্মৃতিচারণের পর বাসুসাহেব জানতে চাইলেন, ডক্টর প্রীতম ঠাকুর জগদীশ পাল সম্বন্ধে কী জানেন।
প্রীতম বলে, শেষ থেকে শুরু করি। লোকটা ছিল হার্ট-পেশেন্ট। আমার চিকিৎসাতেই ছিল। মারা গেছে দিন-তিনেক আগে। শুনেছি, যৌবনে সে এই মরকতকুঞ্জের মালি ছিল। বিয়ে করেছিল। তারপর বৌ আর শিশুপুত্রকে ফেলে পালায়। বোম্বাই ডকে গিয়ে খালাসির চাকরি নেয়। দেশ-বিদেশ ঘুরে বছর পাঁচেক আগে লোকটা ফিরে আসে। এসবের সত্যি-মিথ্যা জানি না, পালবুড়োর কাছেই শোনা কথা। মেরীনগরের অনেক প্রাচীন ব্যক্তিই ওকে সেই জগদীশ মালী বলে চিনতে পারেন। মিনতি ওকে ঐ আউট-হাউসে বিনা ভাড়ায় থাকতে দেয়।
বাসু বলেন, বুঝলাম। ওর বাড়ি ভাড়া লাগত না, ইলেকট্রিক বিল মেটাতে হত না। কিন্তু ও খেত কী? ওর উপার্জন কী ছিল?
প্রীতম মিনতির দিকে ফিরে বললে, তুমি কী জান?
মিনতি বলে, জগদীশ তো বলত, জাহাজ কোম্পানি ওকে পেনশন পাঠাতো!
প্রীতম বাসুসাহেবের দিকে ফিরে বললে, লোকটা ছিল ধূর্ত। ঐ রকম একটা খবরই সে রটিয়েছিল। মাঝে মাঝে ওর কাছে মানি-অর্ডারে টাকা আসত ঠিকই; কিন্তু পেনশন নয়!
—তুমি কেমন করে জানলে?
—নিতান্ত ঘটনাচক্রে। বছরখানেক আগে একবার ওর নামে যখন একটা মানি অর্ডার আসে তখন ও জ্বরে বেহুঁশ। মানি-অর্ডার পিয়নও আমার পেশেন্ট। টাকাটা আমাকে দিয়ে গেল। শ- চারেক টাকা। কোন জাহাজ কোম্পানি ওকে পেনশন দিচ্ছে না। পাঠাচ্ছে ব্যক্তিবিশেষ। মনে হল, প্রেরকের ঠিকানাটায় গোঁজামিল আছে। কুপনটা বাংলায় লেখা। প্রেরক বুড়োকে কোনও সম্বোধন করেনি। জানিয়েছিল যে, তার সে সময় টানাটানি যাচ্ছে, মাস তিনেক আর টাকা পাঠাতে পারবে না। বুড়ো যেন ঐ চারশ টাকায় তিন মাস চালিয়ে নেয়। নাম সই করেছিল ‘প’!
—আই সি! তোমার সন্দেহ হল নিশ্চয়।
—তা তো হলই। জগু আমার চিকিৎসাতেই ছিল। ভাল হয়ে ওঠার পর টাকা আর কুপন ওকে দিই। বলি, জগু! এই ‘প’-টি কে? সে কি তোমাকে ব্ল্যাকমেলিংয়ের খেসারতি টাকা পাঠাচ্ছে?
ও একেবারে লাফিয়ে ওঠে। বলে, ‘না ডাক্তারবাবু। ‘প’ আমার ছেলে— পরেশ ছোট্টবেলায় তাকে মায়ের কোলে ফেলে চলে গেছিলাম তো? তাই সবার কাছে স্বীকার করতে লজ্জা করে। ও বুড়ো বাপকে ক্ষমা করেছে। যখন যা পারে পাঠায়।’ জগু আমাকে অনুরোধ করেছিল ব্যাপারটা গোপন রাখতে। তাই আমি কাউকে কিছু জানাইনি। এখন ওর দেহান্ত হয়েছে। তাই সব কথা খুলে আপনাকে বললাম।
বাসু মিনতিকে প্রশ্ন করেন, জগদীশের মৃত্যুর পর ওর ঘরে কি কেউ ঢুকেছে? পরেশ তো আসেইনি। এলে বাপের সমাধি হয়ে যেত।
মিনতি জানাল, ঘরটা তালাবন্ধ পড়ে আছে। চাবি তার কাছে।
—চাবি নিয়ে এস। আমি ঘরটা একবার দেখব। তারপর চার্চে যাব। কেমন? আর শোন তোমার মালিকে বল, আমাকে একটা ছোট্ট ফুলের ‘ব্যুকে বানিয়ে দিতে। চার্চে গিয়ে জগুদার বুকপকেটে গুঁজে দিয়ে আসব।
প্রীতম বলে, ও লোকটা আপনার কাজিন ব্রাদার না হতেও পারে। ইন ফ্যাক্ট, না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
—নাই বা হল। তাই বলে যে লোকটা দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে চলেই গেছে তাকে কি একটা গোলাপ উপহার দেওয়া যায় না? জাস্ট আউট অব পিটি?
প্রীতম বলল, য়ু আর পার্ফেক্টলি কারেক্ট, স্যার। আমি তাহলে চলি। মীনার স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে এল।
প্রীতম ঠাকুর নিজের বাড়ির দিকে রওনা হল। মিনতি গেল ভিতরবাড়িতে আউট-হাউসের চাবির খোঁজে। সুজাতা এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার বলে, আপনি এবার কি মর্গে যাবেন?
বাসু বলেন, যাব। ‘মর্গে’ নয়, ওটা চার্চের ‘ডেথ-চেম্বার’। গৌরবে ‘ক্যাটাকুম্ব’ও বলতে পার।
সুজাতা বলল, সে যাই হোক, আমি বাপু ঐ মৃত্যুপুরীতে যেতে পারব না।
বাসু বললেন, এই জন্যেই বলেছিলাম তুমি তোমার মামিমার কাছে থাক, আমি কৌশিককে নিয়ে আসি। সে যা হোক, তোমার ভ্যানিটি ব্যাগে যে পিংক রঙের লিপস্টিকটা আছে, ওটা বার করে আমাকে দাও দেখি?
সুজাতা আঁৎকে ওঠে, লিপস্টিক! আপনি কী করবেন?
বাসু ধমকে ওঠেন, আরে এ তো মহা জ্বালা! সব কিছুরই কৈফিয়ৎ চায়। লিপস্টিক নিয়ে আবার কী করব? সবাই যা করে, তাই। ঠোঁটে মাখব! দাও, দাও, ক্যুইক! এখনি মিনতি এসে যাবে।
একটু পরেই মিনতি চাবিটা নিয়ে ফিরে এল। তার হাতে দুটো ফুলের ব্যুকে
বাসু বলেন, দুটো কেন? তুমিও একটা ফুলের ব্যুকে জগদীশকে দেবে নাকি?
—আজ্ঞে না। ঐ চার্চেই তো ম্যাডামের সমাধি আছে। চার্চে গেলেই আমি তাঁর জন্য কিছু ফুল নিয়ে যাই।
ওঁরা তিনজনে প্রথমে গেলেন আউট-হাউসে, জগদীশ পালের তালাবন্ধ ঘরে। কুকুরটা এখন নেই। তাই কোনও সারমেয় প্রতিবাদ শুনতে হল না। ছোট্ট এক কামরা ঘর। সংলগ্ন বারান্দাতে রান্নার আয়োজন। ঘরে একটা নেয়ারের খাটিয়া। ময়লা তোষক, চাদর, বালিশ। একটা প্যাকিং বাক্স। সেটা ছিল ওর টেবিল। লেখাপড়ার জন্য নয়, জিনিসপত্র রাখার। নস্যির ডিবে, গ্লাস, মাটির ভাঁড় অর্থাৎ অ্যাশট্রে। ঘরের বিপরীত অংশে একটা দেওয়াল আলমারি। পাল্লা নেই। তিন সারি কাঠের তাক। তাতে জগদীশের কিছু জামাকাপড়, কিছু বাসনপত্র— অধিকাংশই অ্যালুমিনিয়ামের বা হিন্ডেলিয়াম। নিচের তাকে কিছু খবরের কাগজ। বাসু মিনতির কাছে জানতে চাইলেন, জগদীশ কি খবরের কাগজ পড়ত?
—আজ্ঞে না। এগুলো ডাক্তারবাবুর বাড়ি থেকে ও চেয়ে আনত। পুরানো কাগজ। আমার বামুনদির কাছ থেকে ময়দার আঠা বানিয়ে আনত। ঠোঙা বানাতো। দোকানে বেচে আসত। যা দুপয়সা বাড়তি রোজগার হয় আর কি।
সুজাতা ঘরে ঢোকেনি। বাইরেই অপেক্ষা করছিল। বাসু খুঁটিয়ে দেখছিলেন ঘরের সবকিছু। হঠাৎ মিনতির দিকে ফিরে বললেন, তুমি ওর ছেলের একটা ফটো পেয়েছিলে। সেটা কোথায় পেয়েছিলে?
—ওর খাটিয়ার নিচে ঐ দেখুন একটা টিনের স্যুটকেস আছে। ঐটা থেকে।
বাসু নিচু হয়ে দেখলেন। হ্যাঁ, সেখানে একটা স্যুটকেস আছে বটে। টেনে আনলেন সেটাকে। তার ভিতরে জগদীশের কিছু জামাকাপড়, একটা পেনসিল, একটা বাতিল চশমা, দেশলাই, কিছু বিড়ি, দুটো শাদা পোস্টকার্ড, আর এক কপি ইংরেজি পত্রিকা : ‘বিজনেস ওয়ার্ল্ড’। প্রায় চার বছরের পুরানো। বাসু মিনতিকে জিজ্ঞেস করলেন, জগদীশ কি ইংরেজি জানত?
মাথা নেড়ে মিনতি বলল, না, নিশ্চয় না!
—দেন দিস ইজ মোস্ট ইনকম্প্যাটিবল অ্যান্ড মিস্টিরিয়াস!
—আজ্ঞে?
সুজাতা দ্বারের কাছ থেকেই কথোপকথন শুনছিল। বললে, হয়তো ডাক্তারসাহেবের বাড়ি থেকে ছবি দেখতে পত্রিকাটি এনেছিল। তারপর আর ফেরত দেওয়া হয়নি।
বাসু বললেন, এটা যদি স্টার ডাস্ট, ডেবনেয়ার, ইলাসট্রেটেড উইকলি বা স্পোর্টস-ওয়ার্ল্ড হত তাহলে হয়তো মেনে নিতাম। তাছাড়া ডক্টর ঠাকুরই বা বিজনেস ওয়ার্ল্ড কিনবে কেন? এটা তো ওর লাইনের নয়।
—হয়তো শেয়ার কেনাবেচার ঝোঁক আছে।
—নাঃ। খুঁটিয়ে দেখতে হচ্ছে পত্রিকা।
মিনতি বললে, কী দরকার? ওটা আপনি সঙ্গে করে নিয়েই যান না হয়। এমনিতে আমিও তো সব কিছু ঝেঁটিয়ে আঁস্তাকুড়েই ফেলে দেব।
বাসু পাতা উল্টাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা পাতায় দৃষ্টি আটকে গেল ওঁর। তৎক্ষণাৎ বললেন, সেই ভাল। এটা নিয়েই যাই।
চার্চটা মরকতকুঞ্জের থেকে দূরে নয়। চার্চ গেটের বাইরে সড়কের ওপর গাড়িটা রেখে ওঁরা তিনজনে পদব্রজে এগিয়ে গেলেন। মিনতি একটি ফুলের তোড়া বাসুসাহেবের দিকে বাড়িয়ে ধরে বললে, নিন ধরুন। ম্যাডামের কবরে আপনিই এটা দেবেন।
বাসু বলেন, বাঃ! আমি কেন? তুমিই তো বরাবর দাও।
—আমি তো প্রায়ই আসি। ওঁর কবরে ফুল দিই। আপনি অনেক-অনেক দিন পর আজ এসেছেন আমার ইচ্ছাপূরণের জন্য। কিন্তু মেরীনগরে প্রথম এসেছিলেন ম্যাডামের ইচ্ছাপূরণের জন্য। তাই নয়?
‘ইচ্ছাপূরণ।’ বাসুসাহেবের মনে পড়ে গেল সব কথা। ততক্ষণে ওঁরা এসে উপস্থিত হয়েছেন সেই বিশেষ সমাধির কাছে। সমাধি ফলকে লেখা আছে : ‘SACRED TO THE MEMORY OF/…PAMELA HARRIET JOHNSON/ …DIED MAY 1, 1970/…’THY WILL BE DONE’.
‘দাই উইল বি ডান’– ‘তোমারই ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী। ‘
বাসুসাহেব মাথা থেকে টুপিটা আগেই খুলেছিলেন। এবার ফুলের ব্যুকেটা নামিয়ে দিলেন সমাধির পাদমূলে।
ফাদার মার্লো মিনতির কাছে সব কিছু শুনে খুব অবাক হয়ে গেলেন। ইংরেজিতে বললেন, আমি নিশ্চিত, আপনি ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এতদূর এসেছেন ব্যারিস্টার সাহেব। জগদীশ পাল ভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, যাকে বলে নির্ভেজাল ‘হ্যাভ নট’! ও কোন ব্যারিস্টারের কাজিন-ব্রাদার হতেই পারে না।
বাসু হেসে বলেন, এতটা পেট্রল পুড়িয়ে এসেছি। দেখে যাব না? আপনি যদি অনুমতি করেন…
—ও শ্যিওর! আসুন আপনি আমার সঙ্গে। তা এঁরা দুজন…?
—না, ওরা এখানেই অপেক্ষা করুক। আমরা দুজনেই শুধু যাব। কিন্তু তার আগে আমি কিছু বড় ক্যান্ডল স্টিক কিনতে চাই। মা মেরীর মূর্তির সামনে দেব বলে।
—নিশ্চয়, নিশ্চয়! আসুন ভিতরে।
মা মেরীর মূর্তির পাদদেশে মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে বৃদ্ধ ফাদারের পিছু পিছু বাসুসাহেব এগিয়ে গেলেন চার্চের নিচে ভূগর্ভস্থ ‘ডেথ-চেম্বারে। কবরস্থ করার আগে মৃতদেহ এখানে রাখা থাকে। আপাতত মৃতদেহ মাত্র একটিই ছিল। সেটি আপাদমস্তক একটা শাদা চাদরে ঢাকা। ফাদার মোমবাতিটি বাড়িয়ে ধরলেন। তারপর ধীরে ধীরে মৃতের মুখের আবরণটি সরিয়ে দিলেন। বাসু ঝুঁকে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন : থ্যাংকস, ফাদার, আমার দেখা হয়েছে।
—আপনার কাজিন-ব্রাদার নয় তো?
—না ‘কাজিন’ নয়। নেভারদিলেস্ হি ইজ মাই ব্রাদার। এঁকে কবরস্থ করার যাবতীয় ব্যয়ভার আমি বহন করব। মোটামুটি ভদ্র ব্যবস্থায় ক্রিশ্চিয়ান সমাধিতে যা খরচ পড়ে!
ফাদারের ভ্রূকুঞ্চন হল। বলেন, আপনি কি ক্রিশ্চিয়ান নন?
—নো ফাদার! আয়াম এ হিন্দু!
—আশ্চর্য! তাহলে কেন এ খরচ দিচ্ছেন? বিশেষ এ লোকটা যখন আপনার কাজিন ব্রাদার নয়?
বাসু মোমবাতির মৃদু আলোয় হাসলেন। বললেন, কাজিন না হওয়ার অপরাধে ঐ মৃত ভ্রাতাটিকে প্রত্যাখ্যান করে যাওয়া বিশ্বভ্রাতৃত্বকে অবমাননা করা হত না কি?
ফাদার মার্লো বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে অস্ফুটে বললেন, গড ব্লেস য়ু, মাই চাইল্ড।
বাসু বললেন, ও হো! একটা ভুল হয়ে গেছে। কাজিন জগদীশের জন্য একটা ছোট্ট ফুলের ‘ব্যুকে এনেছিলাম। সেটা আমার ভাগ্নীর কাছে রয়ে গেছে।
মার্লো বললেন, এই মাত্র বিশ্বভ্রাতৃত্ব নিয়ে আপনি যে কথাটা বলেছেন তাতে আমি আপনার ইচ্ছাপূরণ করব। একটু অপেক্ষা করুন। আমি ব্যুকেটা নিয়ে আসছি। এখানে একা একা….
—সার্টেনলি নট! এ কক্ষটা তো স্বর্গতোরণের সম্মুখে ওয়েটিং রুম মাত্র। আমি অপেক্ষা করব। কোন অসুবিধা হবে না আমার।
আর একটি মোমবাতি জ্বেলে বাসুসাহেবের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আলখাল্লাধারী ধীর পদক্ষেপে ফিরে চললেন।
ফাদার মার্লো দৃষ্টিপথের বাইরে যাওয়া মাত্র বাসুসাহেব পকেট হাতড়ে বার করলেন তাঁর নোটবই আর সুজাতার লিপস্টিক। ক্ষিপ্রহস্তে মৃত জগদীশ পালের মৃত্যুশীতল দশটি আঙুলের ছাপ একে একে উঠে এল ওঁর নোটবইতে। আঙুল থেকে লিপস্টিকের দাগ মুছে দিয়ে আবার হাত দুটি শাদা চাদরের তলায় চালান করে দিলেন। আপাদমস্তক ঢাকা দেওয়া থাকল মৃতদেহ
ফাদার মার্লো ফুলের ‘ব্যুকে’ টা নিয়ে একটু পরেই ফিরে এলেন। বাসু জগদীশের চাদরটা সরিয়ে ওর হাফশার্টের বুক পকেটে ফুলটা লাগিয়ে দিলেন। তারপর দুজনে ফিরে এলেন অফিসে। গরিব ঘরের একটি খ্রীস্টানের মরদেহ ভদ্রভাবে সমাধিস্থ করতে যা খরচ হয় সে অর্থ বাসুসাহেব একটি চেক কেটে ফাদার মালোকে দিলেন। ফাদার বিদায়কালে বললেন, আমি শুনেছি, এই জগদীশ পালের একটি পুত্রসন্তান আছে, তাকে খবর দেওয়া যায়?
বাসু বললেন, না ফাদার। যায় না। আমি জানি, কাজিন জগদীশের সেই ছেলেটি সম্প্রতি মারা গেছে। ও আমার কাজিন নয় বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিতও নয়।
প্রত্যাবর্তন পথে মিনতির বাড়িতে চা-পান করতেই হল।
* * *
ফেরার পথে বাসু একটা পেট্রল পাম্পে দাঁড়িয়ে গাড়িতে আবার কিছু পেট্রল ভরে নিলেন। ঐ সুযোগে পর পর দুটো ফোন করলেন কলকাতায়। রানী দেবী জানালেন ইতিমধ্যে বলবার মতো কোনও খবর জমেনি। কৌশিক বাড়ি নেই। কোথায় কোথায় ঘুরছে। বিরাটিতে নির্মলার বাড়িতে ফোন করলেন। নির্মলাই ধরল। জানালো, ইতিমধ্যে থানা থেকে পুলিশ এসেছিল। অপরাজিতার বিষয়ে অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে গেছে তারা। –না, জিতা দুপুরে লাঞ্চ করতে আসেনি। নির্মলার স্বামী সুশোভনও কোন ফোন-টোন করেনি। তা সেটা ওর স্বভাবও নয়। কোনকালেই ট্যুরে গেলে বাড়িতে ফোন করে না।
বাসু সুজাতাকে বললেন, হয় পুলিশ মৃতদেহটা শনাক্ত করতে পারেনি, অথবা ইচ্ছে করেই খবরটা নির্মলাকে জানায়নি। কিন্তু অপরাজিতার পাত্তা পুলিশ পেল কী করে?
সুজাতা এ প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না। বাসু যতক্ষণ টেলিফোন করছিলেন ততক্ষণ সে ঐ ‘বিজনেস ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকাটি উল্টেপাল্টে দেখছিল। এখন প্রশ্ন করে, মামু : আপনি এ পত্রিকার মধ্যে কী একটা দেখেছেন, যা আমার নজরে পড়ছে না। কী বলুন তো?
—কিছু একটা যে দেখেছি তাই বা তুমি ধরে নিচ্ছ কেন?
—প্রথম কথা, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে আপনাকে চমকে উঠতে স্বচক্ষে দেখেছি। দ্বিতীয় কথা, কিছু একটা সূত্র না পেলে আপনি এ পত্রিকাটি সঙ্গে নিয়ে আসতেন না। বলুন ঠিক কি না?
বাসু গাড়ি চালাতে চালাতেই বললেন, বলছি। তার আগে বলতো, সুশোভন রায় ওরফে পরেশ পালের মৃতদেহটা কোথায় পাওয়া গেছে?
—বিরাটি পার হয়ে বারাসতের দিকে যেতে এক ধনকুবেরের বাগানবাড়ির গেটের কাছে জঙ্গলের ভিতর।
—হুঁ। সেই ধনকুবেরের নামটা কী?
—গুড গড! তাইতো! নামটা মনে ছিল না বলেই এতক্ষণ ধরতে পারিনি। এই ইস্যুর ‘বিজনেস ওয়ার্ল্ড’-এর কাভার স্টোরিটাই তো ঐ ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উপর।
বাসু বললেন, অদ্ভূত কোয়েন্সিডেন্স, নয়? বাপ আর বেটা মারা গেল আটচল্লিশ ঘণ্টার এদিক-ওদিক। ছেলের মৃতদেহ পাওয়া গেল যে ধনকুবেরের প্রমোদভবনের দ্বারপ্রান্তে সেই লোকের কাভার স্টোরি-সুশোভিত ইংরেজি ম্যাগাজিন পাওয়া গেল তার বাপের স্যুটকেসে যে বাপ ইংরেজি জানে না।
‘কিউরিঅসার অ্যান্ড কিউরিঅসার।’