দ্বি-বৈবাহিক কাঁটা – ৪

কৌশিককে নিয়ে তখন বাসুসাহেব রওনা দিলেন বিরাটির দিকে। রানীকে বলে গেলেন, তুমি আর সুজাতা লাঞ্চ সেরে নিও। আমাদের ফিরতে হয়তো বিকেল হয়ে যাবে। আমরা দুপুরে পথে কোথাও লাঞ্চ সেরে নেব।

সুজাতা বললে, আপনার ভাগ্নে এবার বরং বাড়িতে থাক, মামিমাকে সঙ্গ দেবে। সদ্যবিধবার কাছে যাচ্ছেন, আমি গেলেই…

বাসু বলেন, বেশ তুমিই চলো। কিন্তু তুমি যা ভাবছ তা নাও হতে পারে। ভ্রামরা হয়তো এয়ারপোর্ট হোটেলে লাঞ্চ খাব না। পথের ধারে কোন ধাবায় গোস্ত-রুটি খাব।

কৌশিক হো-হো করে হেসে ওঠে। বলে, বসুন মামু, গাড়িটা বার করি। তেল কম ‘আছে কিন্তু, নিয়ে নেবেন।

বাসু আর সুজাতা তৈরি হয়ে গাড়িতে উঠতে যাবেন এমন সময় এল এক ক্যুরিয়ার পিয়ন। বাসুসাহেবের নামাঙ্কিত খাম। প্রেরকের ঘরে নামটা লেখা আছে মিনতি দাসী, মেরীনগর। রানী দেবী সই করে খামটা নিলেন। বাসু বললেন, খুলো না। দাও পকেটে রাখি। সময়মতো পড়ে নেব। নতুন কোনও কেস হবে। পড়লেই চিন্তাধারা বিক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।

গাড়ি নিয়ে ওঁরা যখন বিরাটিতে অপরাজিতার ঠিকানায় এসে পৌঁছলেন তখন বেলা পৌনে একটা। ডোরবেল বাজাতে দরজা খুলে দিল নির্মলা নিজেই। একটু অবাক হয়ে বললে, কাকে খুঁজছেন?

বাসু বললেন। তুমি নির্মলা তো? নির্মলা রায়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…

—না, মা, আমাকে তুমি আগে কখনো দেয়নি। আমার নাম পি. কে. বাসু, আমি হাইকোর্টে ক্রিমিনাল সাইডে …

ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নির্মলা বলে, আপনি ব্যারিস্টার? কাঁটা সিরিজের পি. কে. বাসু? বাসু বললেন, তা বলতে পার…. আমি এসেছি তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি আলোচনা করতে। আমার সঙ্গের এই মেয়েটি….

এবারও বাধা দিয়ে নির্মলা বললে, জানি, সুকৌশলীর সুজাতা। আসুন, আসুন, ভিতরে এসে বসুন।

সুজাতার খুব খারাপ লাগছিল। বিশেষ করে নির্মলার সিঁথিতে জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর। ও বোধহয় এখনি স্নান করে প্রসাধন করেছে। বেচারি জানে না, এই ওর শেষবারের মতো সধবা- শৃঙ্গার!

বৈঠকখানায় ওঁদের বসিয়ে নির্মলা বললে, বলুন? ঠাণ্ডা কিছু খাবেন?

—না! আমি তোমার সঙ্গে অপরাজিতা করের বিষয়ে কিছু কথা বলতে এসেছি।

—জিতা! কেন তার কী হয়েছে? সে কোথায়?

—অপরাজিতা তোমাদের এ বাড়িতেই ভাড়া আছে। তাই না?

—না, ভাড়াটে নয়। পেয়িং গেস্ট। শয্যা আর প্রাতঃরাশ। রাত্রে মাঝে মাঝে ডিনার করি আমরা একই সঙ্গে, কখনো বা লাঞ্চও খাই; কিন্তু সেসব হিসাবের বাইরে। কেন বলুন তো?

—ও তো ভ্যাকুয়াম ক্লিনার আর ওয়াটার পিউরিফায়ার বিক্রি করতে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়?

—আজ্ঞে হ্যাঁ।

—কাল সন্ধ্যারাতে সে কোথায় গেছিল তুমি জান?

—ওর ক্লায়েন্টের নাম-ঠিকানা জানি না। কিন্তু বাড়িটা রায়চৌধুরী ভিলার কাছাকাছি। বারাসাত যেতে রায়চৌধুরী ভিলা পড়ে চেনেন?

—চিনি। ও ফিরে এসে রাত্রে তোমাকে অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল, তাই নয়? নির্মলা একটু চিন্তা করে নিয়ে বলল, জিতা, আই মিন অপরাজিতা কি আপনার ক্লায়েন্ট?

—ইয়েস! সে আমার মক্কেল।

নির্মলা আবার একটু ইতস্তত করে বললে, কিছু মনে করবেন না, স্যার- কিন্তু আপনি যে সত্যিই সেই পি. কে. বাসু তা আমি কেমন করে বুঝব?

বাসু নিঃশব্দে হিপ পকেট থেকে ওঁর ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বার করে দেখালেন। বললেন, আমি কিছু মনে করিনি, নির্মলা। বরং এটা যাচাই না করে যদি তোমার নিকটতম বান্ধবীর গোপন কথা আমাকে বলে ফেলতে তাহলেই আমি তোমাকে নিরেট ভাবতাম। এবার বল?

নির্মলা সবিস্তারে গতরাত্রের অভিজ্ঞতার কথা বলে গেল। রিভলভারের কথাও গোপন করল না। অপরাজিতা যা বলেছে, হুবহু তাই।

বাসু বললেন, তুমি চেম্বারটা খুলে দেখলে তাতে ছয়টা বুলেট আছে?

—আজ্ঞে না। রিভলভার কী ভাবে খুলতে হয় আমি জানি না। জিতাই খুলে দেখালো, ছয়- ছয়টা তাজা বুলেট।

—’তাজা’ বুলেট? কেমন করে বুঝলে?

—আজ্ঞে? আমি আপনার প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

— বলছি কি, ছয়টাই যে ‘তাজা’ বুলেট তা বুঝলে কেমন করে? একটা ব্ল্যাংক কার্টিজ ছিল কি ছিল না, কোনও বুলেট এক্সপেন্ডেড মানে ব্যয়িত বুলেট কি না তা বুঝলে কী করে?

নির্মলা সলজ্জে স্বীকার করে এর আগে কখনো কোনও রিভলভার সে স্পর্শ করে দেখেনি। সিনেমায় আর টিভিতে দেখেছে শুধু। এসব বিষয়ে ওর কোনও ধারণাই নেই।

বাসু বললেন, তোমাকে খুলেই বলি নির্মলা, তোমার বান্ধবী অপরাজিতা একটা ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে।

ওর মুখচোখ শুকিয়ে ওঠে। বলে, ঐ রিভলভারটার ব্যাপারে?

—হ্যাঁ। তোমার কি মনে হয়নি যে, ঐ রিভলভারে কেউ একটা খুন করে তোমার বান্ধবীর কাছে গছিয়ে দিতে পারে? যাতে হত্যাপরাধ তার উপর বর্তায়?

রীতিমতো শুকনো মুখে নির্মলা স্বীকার করে ও আশঙ্কা তার আদৌ হয়নি।

—তোমার কতাটি কোথায়?

সুজাতা এই নৃশংস প্রশ্নটা সহ্য করতে পারল না। উঠে গেল দেওয়ালে একটা গ্রুপ ফটো কাছ থেকে দেখতে।

নির্মলা স্বীকার করল, ওর স্বামী ট্যুরে গেছে। মাসের মধ্যে দিন-পনের তাকে বাইরে থাকতে হয়। স্বামীর ব্যবসাটা কিসের তা ও জানে না। না, কোনও লোক ব্যবসা-সংক্রান্ত কাজে ওর স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে কখনো আসে না। বা টেলিফোন করে না। কিন্তু এসব কথা কেন উঠছে?

বাসু বলেন, তোমার কৌতূহল হয় না?

—হয়, কিন্তু জিজ্ঞেস করলেই ও প্রচণ্ড ধমক দেয়। বলে রোজগার করার দায়িত্ব আমার, সংসার চালানোর দায়িত্ব তোমার। অত কৌতূহল ভাল নয়।

—কতদিন বিয়ে হয়েছে তোমাদের?

—দুবছর এখনো হয়নি।

বাসু একটু ইতস্তত করে বললেন, তুমি আমার মেয়ের বয়সী। একটা কথা খোলাখুলি জানতে চাইছি, কিছু মনে কর না, মা। তোমার মনে কি কখনো কোনও সন্দেহ জাগেনি যে, তোমার পিছনে ওরা দুজনে গোপনে….

বাসু অর্থপূর্ণভাবে বাক্যটি অসমাপ্ত রাখলেন।

নির্মলা মাথা নিচু করে স্বীকার করল, সন্দেহ হয়, হয়েছে! আপনি কি কিছু জানেন?

বাসু বললেন, অপরাজিতার বয়ফ্রেন্ডকে আমি দেখেছি। তোমার স্বামীর কোনও ফটো আমাকে দেখাতে পার?

নির্মলা তখনি উঠে গেল। সুজাতা অস্ফুটে বললে, উফ্! কী নৃশংস আপনি! মেয়েটা এখনো জানে না ও বিধবা হয়েছে আর আপনি…

বাসু চাপা ধমক দেন, শাট আপ! আইনত নির্মলার বিয়েই হয়নি। ও বিধবা হবে কোত্থেকে? সুজাতা জবাব দেবার সুযোগ পেল না। তার আগেই নির্মলা ফিরে এল ফ্যামিলি অ্যালবাম নিয়ে। সুশোভনের একাধিক ফটোগ্রাফ আছে অ্যালবামে। প্রথম পাতাতেই ওদের যুগল ফটো। বিয়ের পরেই তোলা। বাসু বললেন, না, এই ছেলেটি অপরাজিতার সেই বয়ফ্রেন্ড নয়।

এমন সময় ঝঝন্ করে বেজে উঠল টেলিফোনটা। বাসু খপ্ করে চেপে ধরলেন নির্মলার হাত। বললেন, থানা থেকে হতে পারে। আমি দেখছি।

এগিয়ে এসে টেলিফোনটা তুলে নিয়ে নাম্বারটা ঘোষণা করলেন। ও প্রান্ত থেকে একটি মহিলাকণ্ঠে মোলায়েম প্রশ্ন হল, জিতা আছে, অপরাজিতা?

—আপনি কে বলছেন?

ওপ্রান্তবাসিনী ধমকে ওঠে, আপনি কে?

বাসু প্রতিধ্বনি করেন, আপনি কে?

এবার ও প্রাপ্তে টেলিফোনটা হাত বদল হয়। গম্ভীর কণ্ঠে কেউ ঘোষণা করে, লোকাল থানা থেকে বলছি। মিস অপরাজিতা কর কি বাড়িতে আছেন?

—না নেই।

—তিনি কোথায় গেছেন?

—তা তো জানি না।

—আপনি কে?

—এ প্রশ্ন অবান্তর!

বাসু বাঁ হাত দিয়ে ক্র্যাডলটা টিপে দিলেন। লাইনটা কেটে গেল। টেলিফোনটা ধারক অঙ্গে বসালেন না, পাশে নামিয়ে রাখলেন। বললেন, নির্মলা, আপাতত তোমার ফোনটা এনগেজড হয়ে থাক। না হলে থানা থেকে আবার এখনি বিরক্ত করবে। অবশ্য নিষ্কৃতি তোমার নেই। একটু পরেই ওরা গাড়ি নিয়ে আসবে। তোমার জবানবন্দি নেবে। আমরা চলি-

—ওরা জিজ্ঞেস করলে আমি কি স্বীকার করব যে, আপনি এসেছিলেন? আপনিই ফোনে কথা বলেন?

—নিশ্চয়ই। আদ্যন্ত সত্যি কথা বলবে।