১২
ফিরে এসে যে গপ্পোটা শোনালেন তার চুম্বকসার : চাঁদু রায় মিছে কথা বলেনি। পরেশ পালকে হত্যা করলে তার সমস্যার সমাধান হত না। দেড়-দু’বছর আগে যখন পরেশ, তার ব্ল্যাকমানির প্রথম ইনস্টলমেন্ট নিতে আসে তখন ইন্দ্রনারায়ণের উপস্থিতিতে সে চন্দ্রনারায়ণকে বলেছিল, ‘দেখুন, আপনি আমার বাবার বন্ধু। বাবা আপনার কীর্তিকাহিনী শোনাবার সময় বারবার ‘চাঁদুদা-চাঁদুদা’ বলছিলেন। ফলে আপনি আমার ‘জেঠু’! তাই আপনাকে বিপদে ফেলা আমার অধর্ম হবে। এজন্য একটা কথা গোড়াতেই জানিয়ে রাখছি : বাবা যা-যা বলেছিলেন তা একটা রিপোর্টের আকারে লিখে আমার ব্যাঙ্ক ভল্টে রেখে দিয়েছি। আর তার উপসংহারে লিখেছি যে, আমার যদি সন্দেহজনক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হয়, বা আমি খুন হয়ে যাই, তাহলে ইন্দ্রনারায়ণের বাগানের মালি শ্রীসুবল সাঁইয়ের অ্যালেবাইটা যেন ভাল করে যাচাই করা হয়।’
ব্যস! এক কিস্তিতেই মাৎ! পরেশ পাল বাপকা বেটা! এটা না করলে চাঁদু রায়ের মতো দক্ষ আর্চ ক্রিমিনালের কল্যাণে অনেক আগেই সে ফৌত হয়ে যেত। তার নাম পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যেত না। ঠিক যেভাবে উবে গেছে পরেশ পালের গাড়িটা।
সে যা হোক, জানুয়ারির নয় তারিখ সকালে পরেশ যখন দুই ভাইয়ের দরবারে পাসপোর্ট- ভিসার আর্জিটা পেশ করে তখন ইন্দ্রনারায়ণ জানতে চেয়েছিলেন, পরেশের সমস্যাটা কী। পরেশ বলেনি। ন্যাচারালি। সে বলতে যাবে কেন? কিন্তু সে যখন বেরিয়ে আসে তখন চন্দ্রনারায়ণ তাকে জনান্তিকে পাকড়াও করে। নির্জনে নিয়ে এসে বলে, বাবা পরেশ! তুমি জগদীশের ছেলে, আমারও পুত্রস্থানীয়। তোমার জ্যেঠা… এই আমি… তিন-তিনটে খুন করেও ফলস পাসপোর্টে বিদেশ যাবার চেষ্টা করিনি। তুমি কী এমন হরধনু ভঙ্গ করলে বলতো, যার জন্যে দেশান্তরী হতে চাইছ?
—আপনাকে তা জানিয়ে আমার কী লাভ?
—তুমি আমাকে চেন। যদি দাদাকে ব্ল্যাকমেলিং থেকে সত্যিই চিরতরে মুক্তি দিতে রাজি থাক, তাহলে আমিই তোমার মুশকিল আসান করে দিতে পারি।
—কী ভাবে?
—কী ভাবে’, তা কী করে বলব? মুশকিলটা কী জাতের তাই তো তুমি বলনি এখনো। আন্দাজ করছি, দু-একটা খুন করলে হয়তো তোমার মুশকিলটা আসান হতে পারে? তাই কি?
—আপনি আমার হয়ে সেটা করে দেবেন? দু-একটা নয়— মাত্র একটি খুন? সন্দেহটা বর্তাবে আমার উপর, তাই আমি খুব পাক্কা একটা অ্যালেবাই রাখব।
—আমি রাজি আছি। তবে কয়েকটা শর্ত আছে বাবা। প্রথম শর্ত : তোমার ব্যাঙ্ক ভল্টের কাগজখানা আমাকে দিয়ে যেতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত : তোমার অপরাধটা কী তা আমার কাছে স্বীকার করতে হবে। আমি তো প্রথমেই যাচাই করে দেখে নেব। আমি জানব তোমার সিক্রেট, তুমি জানই আমারটা। কেউ কাউকে তঞ্চকতা করতে পারব না। কেউ কাউকে ব্ল্যাকমেল করতে পারব না।
পরেশ একটু চিন্তা করে রাজি হয়ে যায়। চাঁদুর কাছে স্বীকার করে তার দুই বিয়ের কথা। চাঁদ নির্মলা রায়ের কথা জানত না। এবার ক্যামাক স্ট্রিটের এক ব্যাপারী সেজে টেলিফোন করে যাচাই করে জেনে নিল, নির্মলা রায় সুশোভন রায়ের স্ত্রী এবং সুশোভনই হচ্ছে পরেশ পাল। পরেশ এবার বলে, এই গোপন কথাটা জেনে ফেলেছে ওর স্ত্রী মানে নির্মলার এক বান্ধবী : বছর পঁচিশ বয়স। অবিবাহিতা। তার নাম…
চাঁদু বেঁকে বসে। বলে, এতক্ষণ বলনি কেন যে, যাকে খুন করতে হবে সে একটা পঁচিশ বছরের মেয়ে, যার বিয়ে পর্যন্ত হয়নি। একেবারে অরক্ষিতা!
—কেন? তাতে কী হল?
—সে তুমি বুঝবে না, পরেশ! আমাদের জমানা ছিল অন্যরকম! তিন-তিনটে খুন আমি করেছি। সবাই জোয়ান পুরুষ, তাদের প্রত্যেকের হাতেই মারণাস্ত্র ছিল। -একজন আবার তার মধ্যে পুলিশ অফিসার। আয়াম সরি- স্ত্রীলোককে খুন করতে পারব না! বিশেষ, যার বদলা নেবার মতো মরদ পর্যন্ত নেই!
পরেশ তিক্ত কণ্ঠে বলেছিল, আপনি আমার গোপন কথা জেনে নিয়ে ‘জেন্টলম্যান্স এগ্রিমেন্ট’ ভাঙছেন!
শুনে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিল চাঁদু রায়। বলেছিল, হ্যাঁগো! এর মধ্যে জেন্টেলম্যান আবার কোনটা? তুমি না আমি? তুমি কায়দা করে ব্ল্যাকমেল করছিলে, আমি কায়দা করে সেটা বন্ধ করে দিলাম। না, না, ‘জেন্টলম্যান’ বলে নয়, তুমি জগদীশের ছেলে এজন্যই একটা কথা বলি। তুমি বিপদে পড়েছ। জগদীশ নেই, আমি যদ্দূর সম্ভব তোমাকে সাহায্য করব। যদি চাও তোমাকে একটা রিভলভার যোগাড় করে দিতে পারি আজ, এখনি। কাজ হাসিল হলে ওটা আবার আমাকে ফেরত দিয়ে যাবে। তুমি কাকে মারছ, কেন মারছ তা আমি জানতে চাইব না।
চাঁদু রায়ই দারোয়ানের ঘর থেকে রিভলভারটা সরিয়েছিল। দারোয়ান জানে না কিন্তু ইন্দ্রনারায়ণের জ্ঞাতসারেই। তাই সে সত্যটা স্বীকার করেনি, অস্বীকারও করেনি। দাদাকে সে নতুন কোন বিপদে জড়িয়ে ফেলতে চায়নি।
গল্পের মাঝপথে বাধা দিয়ে কৌশিক বলে, তার মানে আপনার মতে, ইন্দ্রনারায়ণের রিভলভারটাই নানান হাতফেরতা হয়ে পৌঁছেছিল রজত গুপ্তের হাতে; দারোয়ান — চাঁদু রায়, পরেশ পালের হাতফেরতা হয়ে! সেক্ষেত্রে হত্যাকারী রজত গুপ্ত ছাড়া আর কেউ হতে পারে না।
—আমি কি সেটা অস্বীকার করেছি? আর হত্যাকারী না হলে রজত আদালতে বেহুদ্দো কনফেসই বা করবে কেন?
—কিন্তু তাহলে সে খুন করার পর অপরাজিতার জন্য অপেক্ষা করেছিল কেন?
—তুমিও যে মাইতির মতো শুরু করলে হে! সাক্ষীর এজাহার নেওয়া শেষ হওয়ার আগেই আর্গুমেন্ট! বলি গল্পটা আগে আমাকে শেষ করতে দাও! সেই ‘শ্রাবণী-গল্পটা’। সেই গল্পে রজতের কথা তো এখনো বলাই হয়নি।
রজত সাত তারিখ দুপুরে নির্মলার অ্যালবামে সুশোভনের ছবিটা দেখার পর থেকে নিশপিশ করছে! পরেশ পালকে কীভাবে ব্ল্যাকমেলিং করবে এটাই ওর তখন একমুখী চিন্তা। এই সময় রজত একটা চান্স নেয়। ইন্দ্রনারায়ণের প্রাইভেট সেক্রেটারিকে ফোন করে বড়কর্তার সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চায়। ওঁর একান্ত সচিব জানতে চান : ‘কী বিষয়ে আলোচনা করতে চান?’ রজত জবাবে বলেছিল : ‘পরেশ পাল’।
বিস্মিত একান্ত সচিব জানতে চায়, ‘তার মানে?’
—মানেটা আপনি না বুঝলেও চলবে, স্যার! হয়তো উনি বুঝবেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেই দেখুন না, কাইন্ডলি।
বেশ দু-তিন মিনিট টেলিফোনটা নীরব রইল। তারপর ও প্রান্ত থেকে রাশভারী কণ্ঠে ইংরেজিতে প্রশ্ন হল : ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী বলছি, কী চান আপনি?
—একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট, স্যার। দশ মিনিটের জন্য। অত্যন্ত জরুরি। ঐ পরেশ পালের বিষয়ে।
—কে পরেশ পাল? তার বিষয়ে কী কথা?
—সেটা স্যার, টেলিফোনে বলা যাবে না। তবে খবরটাতে আপনার ব্যবসায়ে প্রচণ্ড আর্থিক লাভ হবার সম্ভাবনা।
—অল রাইট। আপনি আজ সন্ধ্যা সাতটা পনেরয় আসবেন। সাতটা পনের থেকে পঁচিশ।
তৎক্ষণাৎ লাইনটা কেটে গেল। রজত গুপ্ত আহ্লাদে আটখানা। নিশ্চয় জ্যাকপট হিট করেছে। নাহলে ইন্দ্রনারায়ণের মতো ব্যস্ত মানুষ ওর মতো অজ্ঞাতকুলশীলকে দশ মিনিট সময় দিতেন না। আগামী সপ্তাহে নয়, একেবারে সেই দিনই সন্ধ্যায়! ঠিকই আন্দাজ করেছে সে : চাঁদু রায় ইজুক্যালটু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী।
কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা সাতটা পাঁচে সে রায়চৌধুরী ভিলায় উপস্থিত হল। ভ্যালে ওকে অপেক্ষাগারে নিয়ে গিয়ে বসালো। একা-সচিব জানতে চাইলেন, আপনার নাম? অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
রজত প্রথম প্রশ্নটা এড়িয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নটার জবাব দিল, আছে, সাতটা পনের থেকে দশ মিনিট।
একাত্ত-সচিব একটা রেজিস্টার খাতা বাড়িয়ে ধরে বলেন, এখানে আপনার নাম, ধাম, টেলিফোন নাম্বার সব এন্ট্রি করুন।
রজত জবাবে বললে, সরি! ওসব বোধহয় আপনার ‘বস’ পছন্দ করবেন না। ওঁকে ইন্টারকমে শুধু বলুন : পরেশ পাল!
‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রটায় কাজ হল। রজত এখনি নিঃসন্দেহ। ছপ্পড়-ফোঁড় সৌভাগ্য লাভ করেছে সে। ঘরে ঢুকল। প্রকাণ্ড বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ও প্রান্তে বসে আছেন ইন্দ্রনারায়ণ। কাকে যেন ফোন করছিলেন। বাক্যটা শেষ করলেন : ‘আপাতত এটুকুই… দ্যাটস অল!’
যন্ত্রটা নামিয়ে রজতের দিকে দৃকপাত করে বললেন, ইয়েস! সিট ডাউন। আমার সেক্রেটারি ইন্টারকমে জানালেন যে, আপনি নাকি ভিজিটার্স-রেকর্ডে স্বাক্ষর দেননি?
—ইয়েস স্যার! অহেতুক কোন রেকর্ড রাখার কী দরকার?
ইন্দ্রনারায়ণ ওকে আপাদমস্তক আর একবার দেখে নিয়ে বলেন, প্রথমে বলুন তো, আপনি ব্যক্তিটি কে?
রজত তার ভিজিটিং কার্ড একখানা বাড়িয়ে ধরে। সেটা উল্টেপাল্টে দেখে ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, রজত গুপ্ত, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর! সখের গোয়েন্দা নাকি?
—আজ্ঞে না। সখের নয়। প্রফেশনাল।
—ও। তা আপনার আইডেন্টিটিটা প্রমাণ করতে পারেন?
রজত বিনা বাক্যব্যয়ে তার হিপপকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা বার করে দেখালো। সেটা দেখে ফেরত দিয়ে ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, এবার বলুন, কী বলতে এসেছেন?
—ঐ পরেশ পালের বিষয়ে। ঘটনাচক্রে পরেশ পাল সংক্রান্ত একটা বিচিত্র তথ্য অতি সম্প্রতি আমি আবিষ্কার করেছি। পরেশ পাল একটা মারাত্মক অপরাধ করেছে— যার অকাট্য প্রমাণ আমার দখলে— সেটা পুলিশে রিপোর্ট করলে ওর নির্ঘাৎ জেল হয়ে যাবে…
ইন্দ্রনারায়ণের মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝপথেই ও থেমে পড়ে। ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, আর য়ু স্পিকিং গ্রিক, মিস্টার গুপ্ত? কে পরেশ পাল? আমার সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? আমাকে এসব কথা বলতে এসেছেন কেন?
রজত বুঝতে পারে না— এটা অভিনয়, না/সত্যি! পরেশ পালকে যদি না-ই চিনবেন তাহলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিলেন কেন? রেজিস্টারে সই না দিয়েও সে কেমন করে ওঁর ঘরে ঢুকল। তবে কি উনি নামটা মনে করতে পারছেন না? রজত বললে, পরেশ পাল, মানে বারাসাতের পরেশ। যে তিন-চার বছর আগে কী একটা কারখানায় মজদুরি করত। এই তিন-চার বছরে গাড়ি-বাড়ি করেছে। ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। নিশ্চয় ব্ল্যাকমেলিং-এ।
ইন্দ্রনারায়ণ বলেন, তার সম্বন্ধে কী জাতীয় খবর সংগ্রহ করেছেন আপনি?
—সে প্রশ্নটা স্যার, তখনি উঠবে, যদি পরেশ পালকে আপনি আদৌ লোকেট করতে পারেন।
—আয়াম সরি। তাকে আমি চিনতে পারছি না।
—আপনি কি সুশোভন রায়ের নামটা শুনেছেন?
ইন্দ্রনারায়ণ চটে ওঠেন। বলেন, লুক হিয়ার, ইয়ং ম্যান! আপনি এই ফিশিং এক্সপিডিশনে কেন বার হয়েছেন, তা আপনিই জানেন। আমি সুশোভন রায় কিংবা ঐ যে কী সাম পালের নাম বললেন, ওদের কাউকে চিনি না। আপনি যদি এঁদের কোন অপরাধের নিশ্চিত প্ৰমাণ সংগ্ৰহ করে থাকেন, তাহলে আমি পরামর্শ দেব সোজা থানায় চলে যান। এফ. আই. আর. লজ করে প্রমাণ করুন, আপনাকে প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার হিসাবে লাইসেন্স দেওয়া ভুল হয়নি। য়ু মে কাইন্ডলি লিভ মি অ্যালোন!
—আপনি খবরটায় ইন্টারেস্টেড নন?
উনি বেল বাজালেন। আদালি প্রবেশ করল ঘরে। উনি বললেন, কী ভাষায় বললে আপনি বুঝবেন মিস্টার রজত গুপ্ত, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার?
রজত উঠে দাঁড়ায়। উনি আদালিকে প্রশ্ন করেন, আর কেউ দেখা করার আছে?
সে কী জবাব দিল শুনবার মতো মনের অবস্থা ছিল না রজত গুপ্তের। সে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
রজত মনে মনে সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করেছিল, ইন্দ্রনারায়ণ হচ্ছেন চাঁদু রায়! পরেশকে সে বহুবার ও বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে আসতে দেখেছে। পরেশকে চোখের সামনে কারখানার মজদুর থেকে লাখপতি হতেও দেখেছে। ‘পরেশ পাল’-কে ইন্দ্রনারায়ণ চিনতে পারবেন না- এটা হতে পারে না। রজত মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ঐ দাম্ভিক আর্চ ক্রিমিনালের দম্ভ সে ভাঙবে! যেমন করেই হোক, পরেশ পালের কাছ থেকে তথ্যটা সে আদায় করবেই।
*****
তার মানে আমার কাহিনী অনুসারে রজত জানত পরেশ পাল বেমক্কা খুন হয়ে গেলে ইন্দ্রনারায়ণের মাধ্যমে তথ্যটা পুলিশ জানতে পারবে। কারণ ইন্দ্রনারায়ণ চাইবেন রজতের জেল বা ফাঁসি হয়ে যাক। উনি জানেন যে, রজত জানে চাঁদু রায়ের কথা! ওর ‘ভিজিটিং কার্ড রয়ে গেছে ইন্দ্রনারায়ণের কাছে। সেটা ফেরত নেওয়া হয়নি। পরেশ দু’দুবার তার অফিসে এসেছে, এই জানুয়ারি মাসেই, তার সাক্ষী যোগাড় করা কঠিন হবে না পুলিশের পক্ষে। তাই মাইতির নাকের ডগায় একটা রাঙামূলো ঝোলানোর প্রয়োজন হল। আমার বিশ্বাস, যে মুহূর্তে পরেশ স্বীকার করেছে— মিথ্যা করেই যে, ইন্দ্রনারায়ণই হচ্ছে চাঁদু রায়— সেই মুহূর্তেই রজত তাকে হত্যা করে! স্থির করে, এখন থেকেই সে নিজেই ইন্দ্রনারায়ণকে ব্ল্যাকমেল করবে। পরেশ পালকে উনি চেনেন না বলেছিলেন, এবার রজতও দেখে নেবে ‘চাঁদু রায়’ ব্যক্তিটিকে উনি চিনতে পারেন কি না। এবারও যদি তিনি বলতে চান যে, ভাজা-মাছের একটা পিঠই উনি চেনেন, ওপিঠকে দেখতে কেমন তা জানা নেই, তখন রজত ওঁর নাকের ডগায় মেলে ধরবে চাঁদু রায়ের দশটা আঙুলের টিপছাপের জেরক্স কপি। ন্যাকা সেজে বলবে, ‘কী যে বলেন স্যার? চাঁদু রায়কে চেনেন না? এই আপনারই মতো দেখতে। বিশ বছর ধরে পুলিশে তাকে খুঁজছে ফাঁসিকাঠ থেকে লটকাবে বলে! এবার কী পরামর্শ দেন স্যার? লালবাজারেই যাব, না কি পরেশ পালের সঙ্গে যে বন্দোবস্তটা ছিল আপনার — তাকে চিনুন বা না চিনুন..’
বেচারি রজত! অত কায়দা করে রিভলভারটা অপরাজিতাকে গছিয়ে দিল, পাছে সেটার কথা শেষ সময় মনে পড়ে যায় তাই রোমান্টিক রবিঠাকুরের কবিতা আউড়ে কুমারী মেয়েটির মনটা ঘুরিয়ে দিল, কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ও ভেবেছিল চাঁদু রায়’ প্রসঙ্গ এ মামলাতে আদৌ উঠবে না। কে ওঠাবে? হ্যাঁ, জানে ইন্দ্রনারায়ণ, কিন্তু সে তো ভাজা মাছের এক পিঠই চেনে। সে খুশিই হবে পরেশ বেমক্কা খুন হয়ে যাওয়ায়। এ মামলা মিটে গেলে তখন শুরু হবে রজত গুপ্তের নতুন খেল!
কৌশিক বলে, আপনি কখন বুঝতে পারলেন যে, ইন্দ্রনারায়ণ নয়, তাঁর বাগানের মালিটাই চাঁদু রায়?
—ঠিক যখন তোমাদের বুঝতে পারা উচিত ছিল। ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর একান্ত সচিব অপরাজিতাকে দেখেনি, অথচ সে পুলিশের কাছে যে বিবরণ দিয়েছে তা অভিজ্ঞ চোখের দৃষ্টিতে দেখা ডেসক্রিপশন! তথ্যগুলো সে সংগ্রহ করেছে বাগান মালির কাছে। কী করে হয়? গ্রাম্য ভাষায় যে কথা বলে সে আন্দাজ করতে পারবে মেয়েটির হাইট, ওয়েট? মনে রাখতে পারবে তার পোশাক, গাড়ির নম্বর? তখনি আমার মনে হয়েছিল, সুবল সাঁই একটি ছিপে রুস্তম! সাক্ষীর মঞ্চে তাকে দেখার পরেও কেন যে তোমরা চিনতে পারলে না তা আমি জানি না। রানু ওকে দেখেনি, কিন্তু সুকৌশলীর দুজনই দেখেছে। অবশ্য বিজনেস ওয়ার্ল্ডে ইন্দ্রনারায়ণের মালির মুখে দাড়ি-গোঁফ ছিল, চোখে ছিল সস্তা নিকেলের চশমা, মাথায় বারি। সুবল সাঁইয়ের সেসব কিছুই ছিল না। মাথায় ছিল কদম ছাঁট চুল। বিজনেস ওয়ার্ল্ডে ওর ছবি অসতর্কভাবে ছাপা হওয়াতেই চাঁদু রায় ভোল পাল্টে ফেলে বারাসাত চলে আসার আগে। তা হোক; চিনতে আমার অসুবিধা হয়নি।
কৌশিক বলল, আয়াম সরি, আমি কিন্তু চিনতে পারিনি।
সুজাতা বললে, আপনি তাহলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, আত্মরক্ষার্থে নয়, ব্ল্যাকমেলিং-এর অসপত্ন-অধিকার লাভের জন্য রজতই ডেলিবারেট মার্ডার করেছিল?
—না বুঝতে পারার কোন হেতু আছে কি?
—তাহলে সেটা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন না কেন?
—আমার কী গরজ? সে সব কথা তো নতুন করে উঠবেই যখন রজতের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস তুলবে। আমি আদালতে গিয়েছিলাম আইনের লক্ষ্যভেদ করতে! আমার দৃষ্টি স্থির ছিল সেই মীনাক্ষীর দিকে! যেই আমার সওয়ালে রজত সেলফ ডিফেন্স ও গুলি চালানোর কথা কবুল করল অমনি মাইতি সুড়সুড় করে এগিয়ে এল বলতে, ওরা কেস তুলে নিচ্ছে। আর তখনি জাজ এককথায় বেকসুর মুক্তি দিয়ে দিলেন মিঠুকে।
কৌশিক ঝুঁকে পড়ে বললে : কাকে? মিঠু! মিঠু কে?
সুজাতা নিঃশব্দে দৃঢ়ভাবে স্বামীর বাহুমূল চেপে ধরে।
বাসু হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে যান। তাকিয়ে দেখেন রানী দেবীর দিকে। চোখাচোখি হয় না। রানী নতনেত্রে কী যেন ভাবছেন।
বাসু উঠে দাঁড়ালেন। চারিদিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, আয়াম সরি! এঃ! ছি ছি! নামধাম সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আমি বোধহয় আজ একটু টিপসি হয়ে পড়েছি!
কেউ কোন জবাব দেয় না। একটা অস্বোয়াস্তিকর নীরবতা।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে বাসু এগিয়ে গেলেন ওয়াশ বেসিনটার দিকে। পা টলছে না কিন্তু। গ্লাসের অবশিষ্ট বাসন্তী রঙের পানীয়টুকু ঢেলে দিলেন ওয়াশ-বেসিনে। তারপর রানীর দিকে ফিরে বললেন, চল, শোবে চল। আজ বোধহয় একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছি।
সেই খণ্ডমুহূর্তে বাসুসাহেবের মনে পড়ল না ভুল ক্রিয়াপদটার কথা। মদ জিনিসটা সমুদ্রমন্থনে ওঠা হলাহলের মতো। অপরকে অমৃত খাওয়ানোর জন্য তা কণ্ঠনালিতে শুধু ঢেলেই দেওয়া যায়। খাওয়া যায় না।
‘খানা’ নেহী হায় জী, সিরেফ ‘পীনা’!
***