১১
বিকেল পাঁচটা নাগাদ আদালত থেকে রানী দেবী একটি টেলিফোন পেয়েছিলেন : কে রানু? হ্যাঁ, খবর ভালই। অপরাজিতা বেকসুর খালাস হয়েছে। পরেশকে কে খুন করেছিল তাও জানা গেছে…
রানী জানতে চেয়েছিলেন, আর সেই এক কোটি টাকার খেসারতের মামলাটা?
—সেটার ডেট তো এখনো পড়েনি। তবে চিন্তা কর না, আমাদের দুজনকে বোম্বাইয়ের ঝোপড়িতে যেতে হবে না। ইন্দ্রনারায়ণ কেস উইথড্র করে নিচ্ছেন।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার মধ্যেই ওঁরা তিনজনে এসে উপস্থিত হলেন। বৈকালিক চা-খাবার খেতে খেতে সুজাতা আর কৌশিক পালা করে আদালতে অভিনীত নাটকটার চুম্বকসার শোনালো।
রাত্রে ডিনার টেবিলে খেতে এলেন ওঁরা মাত্র তিনজন। কৌশিক বলল, কই, মামু কই? –
রানী বললেন, ও আজ ডিনার খাবে না। মাংসের কাবাবের প্লেটটা নিয়ে ইজিচেয়ারে বসেছে। শিভাস রিগালের বোতল আর বরফের পাত্রটা নিয়ে। আজ আর আমি ‘না’ করতে পারলাম না।
সুজাতা বললে, দু-এক পেগ খান তাতে তো ডাক্তারের আপত্তি নেই, কিন্তু গোটা বোতল নিয়ে এভাবে বসলে …
রানী বলেন, আমি বলে বলে হার মেনে গেছি। যেদিন কেস জিতে ফেরে সেদিন ও যেন ছেলেমানুষ হয়ে যায়। আমি বাধা দিই না।
কৌশিক বলে, বুঝেছি! তাতেই মামু কেস জেতার জন্য জান কবুল লড়ে যান। আজ যদি রজত গুপ্ত নিজের থেকে স্বীকার না করত যে, আত্মরক্ষার্থে সে পরেশ পালকে… কথাটা তার শেষ হল না। ভিতরের দরজার দিকে তাকিয়ে মাঝপথেই থেমে গেল। তিনজোড়া চোখ তখন ভিতর দিকের দরজায় নিবদ্ধ। সেখানে উলেন গাউনটা গায়ে দিয়ে গ্লাস হাতে এসে দাঁড়িয়েছেন বাসু। ওখান থেকেই বলে ওঠেন, তাহলে কী হত তর্কচঞ্চু?
কৌশিক আমতা-আমতা করে, না, মানে তাহলেও আপনি শেষপর্যন্ত কেস জিততেন কিন্তু মামলা আজই ডিসমিস হয়ে যেত না। সব সমস্যার সমাধান একদিনেই হত না।
বাসু এসে বসলেন তাঁর নিত্যব্যবহৃত চেয়ারে। বিশু বুদ্ধি করে একটা প্লেট আর ছুরি-কাঁটা দিল। উনি ফর্কে করে একটা কপির বড়া নিজের প্লেটে তুলে নিয়ে ছুরি দিয়ে সেটাকে কাটতে কাটতে বললেন, তোমাদের বুঝি সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে?
রানী বললেন, ওদের হয়েছে কি না জানি না, আমার বাপু হয়নি! অবশ্য আমি সবই সেকেন্ড-হ্যান্ড রিপোর্ট পেয়েছি!
—তোমার মনে কী প্ৰশ্ন আছে?
—চাঁদু রায় বলেছিল, পরেশকে খুন করলেও তার সমস্যার সমাধান হবে না। এটা কেন? পরেশের বাবা জগদীশ মারা গেছে। চাঁদু রায়ের পরিচয় আর কেউ জানে না। এ ক্ষেত্রে পরেশকে হত্যা করার ‘মোটিভ’ চাঁদু রায়ের পক্ষে যে অত্যন্ত প্রবল। সে বর্ন ক্রিমিনাল! সে যেই বলল যে, খুনটা সে করেনি- অমনি মেনে নিলে তুমি?
—হ্যাঁ, নিলাম। কারণ দেখলাম চন্দ্রনারায়ণ তার সাক্ষ্যে একটাও মিছে কথা বলেনি। এমনকি দারোয়ানের ঘর থেকে রিভলভারটা কে চুরি করেছিল তা সে স্বীকার করেনি। অস্বীকারও করেনি।
কৌশিক বলে, দারোয়ানের হেপাজত থেকে রিভলভারটা পরেশ পালের হেপাজতে কেমন করে এল, এ সমস্যার সমাধানটাও অবশ্য হয়নি।
—দারোয়ানের হেপাজত থেকে ওটা এসেছিল তাই বা ধরে নিচ্ছ কেন? – জানতে চাইলেন বাসু!
কৌশিক কৈফিয়ত দেয়, বাঃ! পরেশ যখন দুপুরবেলা তার বাড়িতে স্নান করছে তখনই তো তার স্ত্রী, আই মিন নির্মলা, ওর অ্যাটাচি কেসে ওটা দেখতে পায়।
—ঐ একই রিভলভার তা বলা চলে না। একই রকম দেখতে একটা রিভলভার।
—বেশ, না হয় তাই হল। আমরা দু’দুজনের জবানবন্দিতে জেনেছি, ঐ একই রকম রিভলভার- দু’দুবার হাত বদলেছে ঐ সন্ধ্যায়। পরেশ দিয়েছে রজতকে। রজত দিয়েছে অপরাজিতাকে। এমনকি রাত্রে ঐ রিভলভারটা নির্মলা আবার দেখেছে। মানছি কেউই রিভলভারের নম্বর টুকে রাখেনি, কিন্তু এ রহস্যে একাধিক পয়েন্ট থ্রিটু-বোরের রিভলভারের কথাও কেউ কখনো বলেনি। ফলে, সিদ্ধান্তে আসা স্বাভাবিক যে, যেমন করেই হোক দারোয়ানের রিভলভারটাই ঘটনার দিন সকালে পরেশ পালের হস্তগত হয়েছিল! কী ভাবে হয়েছিল তা আমরা জানি না।
নৈশাহার তখন পঞ্চমাঙ্কের শেষ দৃশ্যে। বিশু মাংসের প্লেটগুলো উঠিয়ে নিয়ে গেল। এবার পুডিং পরিবেশনের পালা। পাত্রের শেষ তলানিটুকু কণ্ঠনালিতে ঢেলে দিয়ে বাসু বললেন, রিভলভারের প্রসঙ্গটাও না হয় আপাতত মুলতুবি থাক। আসল ব্যাপারটার কী সমাধান সাব্যস্ত হল? অর্থাৎ খুনটা করল কে? কখন? কেন?
সুজাতা বলে, বাঃ, ‘সাতকাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা কার বাবা!’ সে কথা তো আপনি নিজেই আদালতে প্রমাণ করে দিয়ে এলেন। রজত গুপ্ত কনফেসও করল!
—তা করল। কিন্তু সেই কনফেশনটা কি মেনে নেওয়া চলে?
—মানে! কেন নয়?
—পর পর যুক্তির বিশ্লেষণ যাচাই কর। প্রথম কথা : পরেশ পাল অত্যন্ত ঘাঘু ক্রিমিনাল। সে চাঁদু রায়ের মতো আর্চ ক্রিমিনাল’কে তিন বছর ধরে দোহন করেছে। সে রাতারাতি স্ট্রিকনিন জোগাড় করে স্থির মস্তিষ্কে স্ত্রীর বান্ধবীকে বিষ দিতে পারে। এ-হেন ঘড়িয়াল পরেশ পাল কি জানে না যে, পিঠে ছোরা খেলে একটা লোক মরতে দু-তিন মিনিট সময় নেবেই! রজতের পকেটে নয়, সে মুহূর্তে হাতে ছিল একটা লোডেড রিভলভার! ছোরা খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই সে প্রথম ফায়ারটা করবে— এবং মৃত্যুর আগে বাকি পাঁচটা গুলিতে পরেশ পালকে ঝাঁঝরা না করে সে মরবে না! ফলে রজতের ঐ কাহিনী কি বিশ্বাসযোগ্য? পরেশ রজতকে পিছন থেকে ছোরা নিয়ে আক্রমণ করতে এসেছিল? অ্যাবসার্ড!
সুজাতা বললে, এ কথাটা অবশ্য চিন্তা করার।
দ্বিতীয়ত, আত্মরক্ষার্থে ফায়ার করলে রজত কোন মহত উদ্দেশ্যে পরেশের মুঠি থেকে খুলে ছোরাটা তার হিপ পকেটে গুঁজে দেবে? তাই কেউ দেয়? নিজের সেলফ ডিফেন্সের প্রমাণ লোপাট করে?
এবার কৌশিক বলে, সে কথাও ঠিক। খুব সম্ভবত পরেশ যেমন জানত না যে, রজতের হিপ পকেটে তার নিজস্ব রিভলভারটা আছে, তেমনি ঘটনার সময় রজতও জানত না যে, পরেশের হিপ পকেটে একটা ছোরা আছে। জানলে, এবং ‘সেলফ ডিফেন্সের’ অজুহাত নেবার সম্ভাবনা ভবিষ্যতে দেখা দিতে পারে এটুকু অনুমান করলে— সে পরেশের হিপ পকেট থেকে ছোরা বার করে ওর মুঠিতে ধরিয়ে দিত! পকেটে ছোরা ভরে দিত না।
বাসু বললেন, কারেক্ট! তাছাড়া আরও একটা কথা ভেবে দেখার আছে। আত্মরক্ষার্থেই হোক অথবা ইচ্ছাকৃত হত্যাই হোক, রজত গুপ্ত যদি ঐ সময় পরেশকে হত্যা করত, তাহলে রজতের পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ কীরকম হবার কথা? তার প্রথম কাজ হত : রিভলভার থেকে তার নিজের আঙুলের ছাপ মুছে ফেলা। এটা সে করে থাক বা না থাক, রিভলভারে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছিল না। দ্বিতীয় কাজ : রিভলভারটা ঘটনাস্থলেই ফেলে রেখে অত্যন্ত দ্রুত গাড়ি নিয়ে কেটে পড়া। ভেবে দেখ। পরেশ ছাড়া আর কেউ ওদের নির্জন সাক্ষাতের কথা জানে না। ও নিজে থেকে এগিয়ে না এলে পুলিশ কোনদিনই ওর হদিস পেত না। ওর গাড়ির নম্বরটাও ছিল ফলস। কোন পথচারী নম্বরটা মনে রাখতে পারলেও রজতকে ধরা যেত না। তাহলে সে কেন এক্ষেত্রে পরেশের মৃতদেহের অদূরে অপরাজিতার জন্য অপেক্ষা করবে? অপরাজিতার গাড়ি আসার আগে ট্রাফিক-পেট্রল পুলিশের গাড়ি আসতে পারত। কোন মোটরিস্ট ওর জখম গাড়ি দেখে নিজে থেকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতে পারত! সেসব রিসক্ ও নেবে কেন?
সুজাতা বলে, সেটাও ঠিক কথা! অপরাজিতাকে তাহলে ও ঐভাবে ফাঁসাতে চাইবে কেন? তাহলে কি রজত খুন করেনি? এটা হতেই পারে না। সে ক্ষেত্রে সে আদালতে কনফেস করবে কেন?
রানী দেবী বলেন, তুমি এই সবগুলি অসঙ্গতির জবাব জান?
বাসু হেসে বললেন, হলফ যখন নেওয়া নেই তখন বলতে বাধা কী : জানি। জানি, বা না জানি আমি একটা জবর গপ্পো জানি। ঐ যে তুমি কী বল তাকে? আষাঢ়ে গপ্পো না শ্রাবণী গপ্পো! সেই গল্পটা বললে তোমরা দেখবে জিগ্স-ধাঁধার মতো সব কটা ফাঁক-ফোকর ভরাট হয়ে যাবে। কোন অসঙ্গতি থাকবে না।
সুজাতা বলে, তবে সেই গল্পটাই বলুন, শুনি।
ইতিমধ্যে বিশু প্লেটে-প্লেটে পুডিং পরিবেশন করতে শুরু করেছে। বাসু বললেন, আমাকে পুডিং দিস না রে। আর কপির বড়া দে বরং দু-একটা।
উঠে দাঁড়ালেন উনি। সবার উপর দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন, পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি। ভেবে দেখ! সব সমস্যার সমাধান হতে পারে এমন কোনও আষাঢ়ে গল্প তোমরা বলতে পার কি না। বাই-দ্য-ওয়ে, আমার ‘শ্রাবণী গল্পে’ এমন কোন নতুন ডাটা থাকবে না, যা তোমরা জান না।
রানী বলেন, কোথায় যাচ্ছ তুমি?
—আসছি, এখনি।
—আর খেও না।
চলতে শুরু করেছিলেন। থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন। পিছনে ফিরে বলেন, তুমি এ ভুল ক্রিয়াটা ব্যবহার কর কেন বলত? খানা নেহী হ্যায় জী, পীনা! ‘শিভাস রিগাল’ কেউ খায় না। পান করে।