দ্বি-বৈবাহিক কাঁটা – ১০

১০

ইন্দ্রনারায়ণ উদ্ধত ভঙ্গিতে সাক্ষীর চেয়ারে গিয়ে বসলেন। শপথবাক্য পাঠ করলেন। কিন্তু বাসু কোন প্রশ্ন করার পূর্বেই উঠে দাঁড়ালেন মাইতি। বললেন, আমরা আদালতকে এই পর্যায়ে জানিয়ে রাখতে চাই, বর্তমান মামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে শুধু এমন প্রশ্নই আমরা অ্যালাও করব। ওঁর অপ্রাসঙ্গিক প্রতিটি প্রশ্নে অবজেকশন দেব!

জজ জানতে চাইলেন, জেরা শুরু হবার আগেই এমন একটা হুমকি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল কি?

—ইয়েস, য়োর অনার। সহযোগী শুধুমাত্র আইন বাঁচাতেই মিস্টার চৌধুরীকে উইটনেস-বক্সে তুলেছেন। বিনা প্রয়োজনে। শুধুমাত্র প্রমাণ করতে যে, তাঁর কোন কোন জিজ্ঞাস্য ছিল। এটা হচ্ছে ওঁর পরবর্তী মামলার খেসারত থেকে অব্যাহতি পাবার প্রচেষ্টা!.

আনসারি কী যেন বলতে গিয়েও বললেন না। বাসুসাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইয়েস, য়ু মে প্রসিড।

—মিস্টার চৌধুরী, আপনি বারাসাতের বাগানবাড়িটা কবে কিনেছেন?

মাইতি তৎক্ষণাৎ আপত্তি দাখিল করেন, অবেজেকশান য়োর অনার। ইররেলিভ্যান্ট অ্যান্ড ইম্মেটিরিয়াল। বর্তমান মামলার সঙ্গে এ প্রশ্নের কোন সম্পর্ক নেই।

জজ বললেন, অবজেকশন ইজ সাসটেইন্ড।

বাসুর পরবর্তী প্রশ্ন, আপনার উপাধি চৌধুরী, কিন্তু বাগানবাড়িটার নাম ‘রায়চৌধুরী ভিলা’। কেন? আপনি কি ওটা কোন রায়চৌধুরীর কাছে কিনেছিলেন?

মাইতি ঝাঁপিয়ে পড়ে আপত্তি জানালেন। তা গৃহীত হল।

—সুবলচন্দ্র সাঁই আপনার এস্টেটে কতদিন কাজ করছে?

মাইতি যথারীতি আপত্তি জানালেন। জজসাহেব এবার সেটি ওভাররুল করলেন। ইন্দ্রনারায়ণ জানালেন, সুবল ওঁর মালি হিসাবে প্রায় বিশ বছর চাকরি করছে। ঐ সঙ্গে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি আরও বললেন, আপনার এ প্রশ্নটাও কিন্তু বর্তমান মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়, মিস্টার পি. কে. বাসু, বার-অ্যাট-ল!

বাসু হাসি হাসি মুখে বললেন, তাই বুঝি? গোলা মানুষ তো? তাই আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তাহলে এবার এমন একটা প্রশ্ন করি, যা বর্তমান মামলার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।

—করুন?

—আপনি কতদিন ধরে জানেন যে, আপনার মালি ঐ শ্রীসুবলচন্দ্র সাই-এর আসল নাম শ্রীচন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী— যাকে পুলিশ মহলে জানে ‘চাঁদু রায়’ নামে? যে চাঁদু রায়কে পুলিশ পনের-বিশ বছর ধরে খুঁজছে একটা হত্যা মামলায় — জেল-ফেরার, হত্যা এবং ব্যাঙ্ক-লুট?

মাইতি যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছেন। লাফিয়ে ওঠেন তিনি, অবজেকশন দিতে। কিন্তু ইন্দ্রনারায়ণের মুখের দিকে তাকিয়ে তাঁর একটু দেরি হয়ে গেল। সামলে নিয়ে কোনক্রমে বললেন, অবজেকশন! ইনকম্পিটেন্ট, ইররেলিভ্যান্ট অ্যান্ড ইম্মেটিরিয়াল।

ঐ খণ্ডমুহূর্তের বিলম্বেই জজসাহেব কী যেন বুঝে নিলেন। তাকিয়ে দেখলেন সাক্ষীর দিকে। ইন্দ্রনারায়ণ যেন বজ্রাহত হয়ে বসে আছেন। জজসাহেব ধীরে ধীরে বললেন, দ্য অবজেকশন ইজ ওভাররুলড। আপনি প্রশ্নটার জবাব দিন, মিস্টার চৌধুরী।

ইন্দ্রনারায়ণ তখনো আত্মস্থ হতে পারেননি।

বাসু জানতে চান, আপনি আমার প্রশ্নটা বুঝতে পেরেছেন তো?

—ইয়েস!

—তাহলে জবাব দেবার আগে আপনাকে কয়েকটা কথা জানাই, এইটে হচ্ছে একটা স্ট্যাম্প প্যাড, এইটে চাঁদু রায়ের ফিঙ্গার প্রিন্টের জেরক্স কপি, আর ঐ বসে আছেন আপনার বাগানের মালি সুবলচন্দ্র সাঁই। এবার বলুন, কী বলবেন?

ইন্দ্রনারায়ণ একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে বললেন, বিশ বছর।

—আপনার সঙ্গে চন্দ্রনারায়ণের রক্তের সম্পর্ক আছে?

—ও আমার সহোদর ছোট ভাই।

—আপনারা আসলে ‘রায়চৌধুরী’, চন্দ্রনাথ ‘চাঁদু রায়’ হয়ে যাবার পর আপনি নিজে ‘রায়’টা বাদ দিয়ে শুধু ‘চৌধুরী’ পরিচয়টুকু বহন করেন। তাই না?

— ইয়েস।

—আপনি জানতেন, আপনার ভাইকে পুলিশে হত্যাপরাধে খুঁজছে। তাই তাকে মালি সাজিয়ে…

মাইতি উঠে দাঁড়িয়ে মাঝপথে বলে ওঠেন, ইফ দ্যা কোর্ট প্লিজ, এসব আলোচনা বর্তমান মামলার প্রসঙ্গে…

দায়রা জাজ আনসারিও তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলেন, মিস্টার পি. পি.! আপনি যদি কোন ‘অবজেকশন’ দেবার জন্য আদালতের কাজে বাধা দিতে উঠে থাকেন তবে আগাম জানিয়ে রাখছি তা নাকচ করা হল। এখানে আমরা দুই আইনজ্ঞ প্রতিযোগীর কুস্তির লড়াই দেখতে আসিনি। এসেছি সত্যান্বেষণে। প্লিজ সিট ডাউন অ্যান্ড ডোন্ট ইন্টারাপ্ট এগেন! আপনি বলুন, মিস্টার বাসু-

ইন্দ্রনারায়ণ বললেন, না, ওঁকে আর সওয়াল করতে হবে না। আমি নিজে থেকেই একটা জবানবন্দি দিতে চাই। ইন ফ্যাক্ট, কথাটা আর আমি চেপে রাখতেও পারছিলাম না। আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।

ইন্দ্রনারায়ণ তাঁর দীর্ঘ জবানবন্দিতে জানালেন :

ইন্দ্রনারায়ণের পিতৃদেব সূর্যনারায়ণ রায়চৌধুরী জমিদারী অ্যাবলিশন বাবদ ভাল টাকাই খেসারত পেয়েছিলেন। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র লেখাপড়া শিখে মানুষ হল বটে, কিন্তু কনিষ্ঠ চন্দ্রনারায়ণ কুসঙ্গে পড়ে অমানুষ হয়ে ওঠে। সূর্যনারায়ণ যখন স্বর্গারোহণ করেন তখন ইন্দ্রনারায়ণ সাবালক কিন্তু চন্দ্র নাবালক, কিশোর। ইন্দ্র আপ্রাণ চেষ্টাতেও ভাইকে সৎপথে রাখতে পারেননি। সে বাড়ি ছেড়ে পালায় অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। দীর্ঘদিন পরে জেল পালানো আসামী হিসাবে চাঁদু রায় তার দাদার কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেটা বোম্বাইয়ে। ইন্দ্রনারায়ণ ভাইকে আশ্রয় দেন। সে হয় ওঁর বাগানের মালি; সুবল সাঁই। বোম্বাইয়ে খোঁজাখুঁজিটা বেশি হচ্ছিল। তাই চাঁদুকে বারাসাতের বাড়ির মালি করে পাঠিয়ে দেন। একবার বিজনেস ওয়ার্ল্ড পত্রিকা থেকে ইন্দ্রনারায়ণের একটি কাভার স্টোরি ছাপার আয়োজন হয়। ওঁদের অসতর্কতায় প্রেস ফটোগ্রাফারের একটি ‘ক্যানডিড’ ফটোয় ইন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে চন্দ্রনারায়ণেরও একখানি ছবি উঠে যায়। ঐ ছবিটি হস্তগত হয় জগদীশ পালের, তার হাত থেকে ক্রমে পরেশ পালের। গত তিন বছরে পরেশ কয়েক লক্ষ টাকা ব্ল্যাকমেল আদায় করেছে। উপায় নেই— ভাইয়ের মুখ চেয়ে ইন্দ্রনারায়ণ টাকা জুগিয়ে গেছেন।

তারপর, এ বছর নাইস্থ জানুয়ারি, রবিবার, সকালে পরেশ এসে ইন্দ্রনারায়ণকে বলে সে একটা ভীষণ বিপদে পড়ে গেছে। সে ভারতবর্ষ থেকে পালাতে চায়। ইন্দ্রনারায়ণ তাঁর প্রভাব খাটিয়ে দু-একদিনের মধ্যে যদি ওকে একটি পাসপোর্ট এবং দক্ষিণ আমেরিকার যে কোন দেশের ভিসা জোগাড় করে দেন, আর প্যাসেজ মানি বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দেন তাহলে ও তাঁকে ব্ল্যাকমেলিং থেকে চিরমুক্তি দিয়ে যাবে। ইন্দ্রনারায়ণ তখন জানতে চান, পরেশ পালের বিপদটা কী। ও তা জানাতে রাজি হয় না। ফলে, ইন্দ্রনারায়ণও রাজি হন না। পরেশ পাল তখন চলে যায় তার মাসিক প্রাপ্য টাকাটা নিয়ে। ঐ দিনই দারোয়ানের হেপাজত থেকে রিভলভারটা চুরি যায়।

দীর্ঘ বিবৃতির শেষে বিচারকের দিকে ফিরে ইন্দ্রনারায়ণ বলেন, আয়াম সরি, য়োর অনার। বর্তমান হত্যা মামলার বিষয়ে আমি আর কিছুই জানি না; কিন্তু মৃত ব্যক্তি যে আমাকে গত তিন বছর ধরে শোষণ করে গেছে সেটা স্বীকার করছি। আমার ভাইয়ের পরিচয় গোপন করে আমি আইনত অপরাধী হয়েছি; কিন্তু সে আমার সহোদর ভাই। পিতার অবর্তমানে আমিই তার পিতৃতুল্য। চন্দ্রনারায়ণের বিচারের সময় এ অপরাধের জন্য বিচারক আমাকে যে শাস্তি দেবেন তা আমি মাথা পেতে নেব।

বাসু বললেন, দ্যাটস্ অল। পি. পি. কি এঁকে ক্রস করতে চান?

মাইতি কুঞ্চিত ভ্রূভঙ্গে কী যেন ভাবছিলেন। বললেন, নো কোশ্চেন্স!

বাসু বললেন, আদালত যদি অনুমতি করেন তাহলে বাদীপক্ষের একজনকে পুনরায় জেরা করতে চাই।

—কাকে?

—ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাগানের মালি, সুবলচন্দ্র সাঁইকে।

পি. পি. হাজরা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমাদের কোনও আপত্তি নেই। প্রসিকিউশন উপলব্ধি করেছেন যে, এ মামলার কোন কোন দিক উদ্ঘাটনের চেষ্টাই করা হয়নি। এইমাত্র আদালতে যে তথ্য উদ্ঘাটিত হল সে সম্বন্ধে আমরা যথোচিত ব্যবস্থা নেব। মিস্টার পি. কে. বাসু বাদীপক্ষের যে কোন সাক্ষীকে ক্রস করে সত্য উদ্ঘাটনে আমাদের সাহায্য করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।

জাজ আনসারি বললেন, থ্যাঙ্কু, কাউন্সেলার। এটাই আপনার অফিসের নীতি হওয়া উচিত। শ্রীসুবলচন্দ্র সাইকে সাক্ষীর মঞ্চে আর একবার উঠতে হবে।

সুবলচন্দ্রও বোধহয় বিশবছরের আত্মগোপনের গ্লানিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। শান্তচিত্তেই সে মেনে নিল তার দুর্ভাগ্যকে। ধীর পদক্ষেপে উঠে দাঁড়ালো সাক্ষীর মঞ্চে।

বাসু বললেন, আপনি চেয়ারে বসুন, মিস্টার রায়চৌধুরী।

ম্লান হাসল চাঁদু রায়। মাথা থেকে পাগড়িটা খুলে চেয়ারের হাতলে রাখল। তার মাথায় ছোট ছোট কদমছাঁট চুল। বসল চেয়ারে। বলল, বলুন?

—আপনি জানেন যে, আদালত এলাকার বাইরে গেলেই পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার করবে। আপনার দীর্ঘ আত্মগোপনের জীবন শেষ হল। আপনি জানেন, বিশ্বনাথ যাদব পুলিশ এনকাউন্টারে ঘটনাস্থলেই মারা যায় আর জগদীশ পাল দীর্ঘ দিন মেয়াদ খাটে। কিন্তু শেষ জীবনে জগদীশ বেচারি কাগজের ঠোঙা বানিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন করেছে। ছেলের কাছ থেকে বিশেষ কিছু পায়নি। সে হিসাবে আপনি অনেক বেশি ভাগ্যবান। আত্মগোপন করে থাকলেও সমাজের দৃষ্টির অন্তরালে জীবনকে নিশ্চয় উপভোগ করেছেন। অন্তত ঠোঙা বানিয়ে আপনাকে গ্রাসাচ্ছাদন করতে হয়নি।

চন্দ্রনারায়ণ বাধা দিয়ে বলেন, ভূমিকা ছেড়ে প্রশ্ন কী করবেন, সরাসরি জিজ্ঞেস করুন না? সঙ্কোচ করছেন কেন?

—ভূমিকা করছি এটুকু বোঝাতে যে, আপনার স্বীকারোক্তিতে আপনার অপরাধের ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। আমি আপনাকে ঐ তরুণী আসামীটির দিকে একবার তাকিয়ে দেখতে বলব। ওকে নিরপরাধ প্রমাণ করতে আমি এ আদালতে এসেছি। দু-একটি প্রশ্ন আপনার কাছে পেশ করতে চাই। আপনার কিছু অপরাধের স্বীকৃতিও আছে তার ভিতর…

চন্দ্রনারায়ণ দুঃসাহসিক হাসি হেসে বললেন, সেই অপরাধের স্বীকৃতির জন্য কি আমার দুইবার ফাঁসি হবার আশঙ্কা আছে, ব্যারিস্টার সাহেব?

বাসু ম্লান হেসে বললেন, আপনার এ জবাব লা-জবাব! আমার প্রথম প্রশ্ন সেক্ষেত্রে আপনিই কি পরেশ পাল ওরফে সুশোভন রায়কে গুলি করে মেরেছেন? আপনার দাদাকে ব্ল্যাকমেলিং-এর হাত থেকে চিরতরে রক্ষা করতে?

বাসুসাহেবের চোখে চোখ রেখে চন্দ্রনারায়ণ বললেন, না!

—এটা কি সত্য যে, জানুয়ারির নয় তারিখে, রবিবার সকালে, যেদিন পরেশ পাল আপনার দাদার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তার পাসপোর্ট-ভিসার আর্জি নিয়ে, সেদিন সে আলোচনায় আপনি উপস্থিত ছিলেন?

—হ্যাঁ, ছিলাম।

—সেদিনই দারোয়ানের ঘর থেকে রিভলভারটি চুরি যায়। তাই নয়?

—হ্যাঁ, পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী তাই বটে।

—আপনি জানেন, দারোয়ানের ঘর থেকে কীভাবে রিভলভারটা চুরি যায়?

চন্দ্রনারায়ণ বললেন, এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না, কারণ তাহলে আমি নিজেই নিজেকে ইনক্রিমিনেট করব!

বাসু বলেন, মিস্টার রায়চৌধুরী! আপনার তো দু’দুবার ফাঁসি হতে পারে না। রিভলভারটা আপনি নিজেই সরিয়েছিলেন এ কথা স্বীকার করতে এত আপত্তি কেন?

—আমি জবাব দেব না। কারণটা এইমাত্র বলেছি।

—আপনি চাইছিলেন, আপনার দাদাকে ঐ ব্ল্যাকমেলিং-এর নাগপাশ থেকে মুক্তি দিতে, কেমন?

—ন্যাচারালি! ইয়েস!

—আপনি ঐ রায়চৌধুরী ভিলা থেকেই নির্মলা রায়কে নয় তারিখে ফোন করেন এবং মিথ্যা করে বলেন যে, আপনি ক্যামাক স্ট্রিট থেকে বলছেন। অ্যাম আই কারেক্ট?

—আমি জবাব দেব না। একই হেতুতে!

—আমি বুঝতে পারছি, আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন না। কেন করবেন না, তাও আমি বুঝেছি। আপনি কি আমার এই শেষ প্রশ্নটার জবাব দয়া করে দেবেন?

—কী আপনার শেষ প্ৰশ্ন?

—আপনি কি জানতেন যে, পরেশ পালের দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু হলে, বিশেষ করে খুন হয়ে গেলে, আপনার দাদা মুক্তি পাবেন না?

চন্দ্রনারায়ণ এবার বললেন, ইয়েস! য়ু আর অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট!

বাসু বললেন, দ্যাটস্ অল, য়োর অনার।

মাইতি একেবারে চুপ করে গেছেন। চন্দ্রনারায়ণকেও রি-ডাইরেক্ট সওয়াল করলেন না। জাজ আনসারি প্রশ্ন করেন, মিস্টার বাসু, আপনার আর কোন সাক্ষী আছে?

—নো, য়োর অনার। কিন্তু আদালত অনুমতি দিলে বাদীপক্ষের আরও একজন সাক্ষীকে কিছু জেরা করতে চাই। মানে, নতুন যে সব তথ্য পাওয়া গেল তার ভিত্তিতে। আমার বিশ্বাস, তাতে এই হত্যারহস্যের আর একটা দিক উদ্ঘাটিত হয়ে যাবে।

জজসাহেব মাইতিকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গেলেন; কিন্তু তার পূর্বেই মাইতি উঠে দাঁড়িয়ে শ্লেষভরে বললেন, বাই অল মিনস্! আপনিই তো এখন আদালতের সুপার হিরো! বলুন কাকে সাক্ষীর মঞ্চে তুলব, স্যার?

—মিস্টার রজত গুপ্ত!

নিতান্ত অনিচ্ছায় রজত গুপ্তকে আবার সাক্ষীর মঞ্চে উঠে বসতে হল। বিচারক বললেন, আপনি আগেই শপথবাক্য পাঠ করেছেন, তাই দ্বিতীয়বার তা করানো হল না। আপনি যা বলবেন তা হলফ নিয়ে বলা বলেই ধরে নেওয়া হবে।

রজত বলল, আই নো, য়োর অনার!

বাসু বললেন, মিস্টার গুপ্ত, আপনি নিশ্চিত বুঝতে পারছেন মামলাটা এখন কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে। আপনি জানেন যে, আসামীকে সাক্ষীর মঞ্চে তুলে আমি যদি ঘটনার রাত্রির পূর্বাপর বর্ণনা দিতে বলি, তাহলে তার জবানবন্দির সঙ্গে আপনার জবানবন্দির অনেকটাই মিল হবে; কিন্তু শেষের দিকে কিছুটা মিলবে না। আদালত জানেন না, কিন্তু আপনি জানেন : কোথায় অমিল হবে। ঐ দশটা দশ-এর পর থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত ঘটনা মিলবে না। তাই নয়?

রজত এদিক-ওদিক তাকিয়ে জজসাহেবের দিকে ফিরে বলল, য়োর অনার! আমার নিজস্ব কোনও সলিসিটর নেই। থাকলে তিনিই বলতেন, এ প্রশ্নটি অবৈধ! এ প্রশ্নের জবাব সাক্ষীর কনক্লুশন। অ্যাম আই টু আনসার দ্য কোশ্চেন?

জজ মাথা নেড়ে বললেন, দ্য অবজেকশন ইজ ওয়েল টেকন। না, আপনাকে জবাব দিতে হবে না। মিস্টার বাসু, আপনি ওঁকে অন্য প্রশ্ন করুন।

বাসু বললেন, অলরাইট। যেহেতু আপনার স্বার্থ দেখবার জন্য আপনি কোনও আইনজীবীকে ইতিপূর্বে নিয়োগ করেননি এবং এখন আর তার সময়ও নেই, তাই আমি আপনাকে কোন প্রশ্নই করব না। আমি শুধু এখানে দাঁড়িয়ে এ হত্যাকাণ্ডটা কী করে ঘটেছে তার একটা সম্ভাব্য বর্ণনা দেব। আমার বক্তব্য বলা হয়ে গেলে আমি জানতে চাইব : আপনি কি আমার সঙ্গে একমত? জবাবে আপনি স্বচ্ছন্দে জানাতে পারেন যে, জবাব আপনি দেবেন না— কোনও আইনজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ না করে। কারণ জবাবটা আপনাকে হয়তো ‘ইনক্রিমিনেট’ করতে পারে! অর্থাৎ অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে পারে। অ্যাম আই ক্লিয়ার?

—ইয়েস।

—আদালত জানেন, আমরাও জানি আপনি আড়াই-তিন বছর আগেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, চাঁদু রায়ের বর্তমান পরিচয় পরেশ পাল জানে। পুলিশ জানে না। আপনি পরেশ পালের উপর নজর রাখেন। দেখেন, সে প্রায়ই রায়চৌধুরী ভিলায় যায়। আপনার সন্দেহ হল ‘ইন্দ্রনারায়ণই হচ্ছেন চাঁদু রায়। কিন্তু ইন্দ্রনারায়ণ এত উঁচুতলার মানুষ যে, আপনার পক্ষে নিশ্চিত প্রমাণ সংগ্রহ করা মুশকিল। আবার নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়া ব্ল্যাকমেলিং শুরু করা চলে না। যেহেতু পরেশ আপনাকে মাঝে মাঝে দু-পাঁচ হাজার টাকা ‘প্রফেশনাল ফি’ দিয়ে যাচ্ছিল তাই এতদিন কোন শো-ডাউনের প্রশ্ন ওঠেনি। তারপর নিতান্ত ঘটনাচক্রে পরেশ পাল নিজেই আপনাকে নিযুক্ত করল আর একটা কাজে। শুক্রবার সাত তারিখ সকালে পরেশ পালের বাড়ি থেকে কিছু দূরে গাড়িটা পার্ক করে ব্যাপারটা দেখলেন। আসামীর গাড়ির নম্বরটা যে আপনার স্মরণে ছিল, অথবা নোটবুকে লেখা ছিল একথা আপনি ডাইরেক্ট এভিডেন্সে নিজেই বলেছেন। আপনার চিন্তাটা তখনো একমুখী ‘চাঁদু রায়’! আপনার সন্দেহ হল ঐ মেয়েটিও পরেশ পালের ব্ল্যাকমেলিং-এর কথা কোনও সূত্রে জানতে পেরেছে। তাই মেয়েটি সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন। ঠিক যেভাবে পুলিশে আসামীর পাত্তা পেয়েছে, অর্থাৎ মোটর ভেইকেলস এবং ওর কোম্পানির সুবাদে। সেদিন দুপুরের মধ্যেই আপনি এসে হাজির হলেন সুশোভন রায়ের বাড়িতে। ক্যালকাটা ক্লেমস্ ব্যুরোর অফিসারের পরিচয়ে। …এ পর্যন্ত যা বলেছি, তা সহজেই প্রমাণ করা যাবে। এখনি নির্মলা রায়কে সাক্ষীর মঞ্চে তুললে সে আপনাকে শনাক্ত করবে। … সে যা হোক, ইতিপূর্বে আসামীর ফটো দেখেছেন, তাই সুনিশ্চিত হতে তার একটি ফটো দেখতে চাইলেন। নির্মলা ওদের ফ্যামিলি অ্যালবামটা এনে আপনার হাতে দিল। আপনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কারণ অ্যালবামের প্রথম ছবিটাই ওদের বিয়ের পর যুগলে তোলা! আপনি বুঝলেন, পরেশ পাল আর সুশোভন রায় একই ব্যক্তি। বিগেমির শিকার। দ্বিবিবাহের! তাতেই ও অপরাজিতার পিছনে লেগেছে। চাঁদু রায়ের কেস এটা নয়।… দশ তারিখে যখন পরেশ আপনাকে পুনরায় এনগেজ করল, ততক্ষণে আপনি আন্দাজ করেছেন যে, পরেশ ঐ মেয়েটিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায়। কারণ ঐ সেলস গার্লটি নিতান্ত ঘটনাচক্রে জানতে পেরেছে পরেশের দুই বিবাহের কথা। তাই পরেশ যখন আপনাকে সোমবার সন্ধ্যায় এক নির্জন স্থানে দেখা করতে বলল, তখন আপনি ভাবলেন যে, শো-ডাউনের সময় উপস্থিত।… আমার অনুমান ঐ নিরপরাধ মেয়েটি খুন হয়ে যাক এটা আপনি চাননি! আফটার অল, মেয়েটার দোষটা কী? পরেশ পালের অপরাধটা ঘটনাচক্রে জেনে ফেলা? এজন্যই আপনি বলেছিলেন, নিজস্ব রিভলভারটা আপনার সঙ্গে নেই। পরেশ তখন তার রিভলভারটা বার করে আপনাকে দেয়। আপনি তখন বুঝতে পারেন, মেয়েটিকে খুন করার জন্যই পরেশ রিভলভারটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। আপনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে অস্ত্রটা হাতে পেয়েই চেম্বার খুলে আপনি দেখে নেন তাতে ছয়-ছয়টা তাজা বুলেট আছে।… মিস্টার গুপ্ত! এ পর্যন্ত আমি যা বলেছি তা স্বীকার করুন বা না করুন, কিছু এসে যায় না। আমি সাক্ষী প্রমাণের জোরে এই তথ্যগুলি সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠা করব— একটি ব্যতিক্রম বাদে। আই মিন, কেন নিজের রিভলভার সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও আপনি কায়দা করে পরেশকে নিরস্ত্র করেছিলেন! আপনার মূল উদ্দেশ্য ছিল, আসামী মেয়েটিকে বাঁচানো, এটা আপনার স্বীকৃতি ছাড়া আমি প্রমাণ করতে পারব না।… এনি ওয়ে, এরপর আমি যা বলছি তা আমার আন্দাজ। আমি প্রমাণ দিতে পারব না। আমার ধারণা- রিভলভারটি হাতে পেয়েই আপনি ওকে বলেছিলেন, ‘লুক হিয়ার মিস্টার পাল! অহেতুক ঐ মেয়েটিকে খুন করবেন না। কারণ তাতে আপনার সমস্যার সমাধান হবে না। হবে না এজন্য যে, তথ্যটা আমিও জেনে ফেলেছি : আপনার দুটি বিয়ে। সুশোভন রায় হিসাবে আপনার স্ত্রী নির্মলা রায়; পরেশ পাল হিসাবে আপনার স্ত্রী শর্মিষ্ঠা পাল।’ হয়তো জবাবে পরেশ বলেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার বহুদিনের কারবার। না হয় টাকার অঙ্কে কিছু হেরফের হবে। কিন্তু ঐ মেয়েটি কেউটে সাপ। টাকা দিয়ে ওকে কেনা যাবে না। কাল সকালেই ও ব্যারিস্টার পি. কে. বাসুর কাছে গিয়ে সব ফাঁস করে দেবে। শুধু আজ রাতটুকু আমার হাতে আছে।’ আবার বলছি, এ আমার আন্দাজ : হয়তো জবাবে আপনি বলেছিলেন, ‘মিস্টার পাল! আপনার টাকা আর চাই না আমি। রাজাকে মুক্তি দেব, যদি ‘রাজার রাজার’ পরিচয়টা জানিয়ে দেন। বলুন : চাঁদু রায় কে?’… না, না মিস্টার গুপ্ত! ও ভুল করবেন না। বোবার শত্রু নেই! আপনি এই পর্যায়ে কোন কথা বলবেন না। শুধু শুনে যান।… হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম : বুকে উদ্যত রিভলভারটা দেখে পরেশ পাল জবাব দিতে বাধ্য হয়! স্বীকার করে। কিন্তু সে সময় আপনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে, ঐ অবস্থাতেও পরেশ পাল আপনাকে ডাহা মিথ্যে কথা বলেছিল। ও বলেছিল, ‘চাঁদ রায়ের বর্তমান পরিচয় ধনকুবের ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী’ আপনি ওর চালাকিটা বুঝতে পারেননি। পারেননি এজন্য যে, আপনার অবচেতন মন এই জবাবটাই প্রত্যাশা করেছিল।… আয়াম অলমোস্ট সার্টেন মিস্টার গুপ্ত, এ পর্যন্ত যা আমি বলেছি, তা নির্ভুল। কথোপকথনে হেরফের হতে পারে কিন্তু ঘটনা এই পর্যায় পর্যন্ত এসে থেমেছিল। কিন্তু তারপর ঘটনা দুটি ভিন্ন ধারায় বইতে পারে। দুটোই সম্ভবপর। আমি জানি না, কোনটা ঘটেছিল। প্রথম সম্ভাবনা : নামটা শুনেই আপনি ওকে গুলিবিদ্ধ করেন। তখন রাত প্রায় নয়টা। আসামীর গাড়ি তখনো আসেনি। আপনি একাজ করে থাকতে পারেন এজন্য যে, আপনার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরেশ পালের বেঁচে থাকার আর কোনও প্রয়োজন নেই। এরপর থেকে আপনি একাই ইন্দ্রনারায়ণকে দোহন করতে পারবেন।

দ্বিতীয় সম্ভাবনা : আপনি হয়তো এভাবে কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার করেননি। আপনি ‘বর্ন ক্রিমিনাল’ নন। আপনি আসামী মেয়েটিকেও খুন হতে দিতে চান না। ফলে হয়তো চাঁদু রায়ের পরিচয়টা জানতে পেরে বলেছিলেন : ‘থ্যাঙ্কু মিস্টার পাল, এখন থেকে আমরা দুজন পালা করে ইন্দ্রনারায়ণকে দোহন করব। একমাস আপনি, একমাস আমি।’ বলে, আপনি পিছন ফেরা মাত্র পরেশ পাল তার হিপ পকেট থেকে একটা ছোরা বরে করে আপনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রথম আক্রমণে সে লক্ষ্যভ্রষ্ট না হলে অকুস্থলে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় আপনার মৃতদেহটাই ওখানে পড়ে থাকার কথা। কিন্তু আপনি দারুণ ভাবে ‘ডাক’ করে ওকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করেন। গুলিবিদ্ধ হল তাই পরেশ পাল।… ওয়েল মিস্টার গুপ্ত! এটাই আমার থিয়োরি! এটাই আমার বিশ্বাস! আপনি বলতে পারেন— আমার থিয়োরিটা ভুল। অথবা বলতে পারেন; ‘আমি জবাব দেব না, যেহেতু জবাবটা আমাকে ইনক্রিমিনেট করবে।’… নাউ, হোয়াটস য়োর আনসার?

আদালতে আলপিন-পতন নিস্তব্ধতা। প্রায় পঁচিশ সেকেন্ড ধরে রজত নতনেত্রে চিন্তা করল। তারপর মুখ তুলে তাকালো। বলল, আজ্ঞে না। আমি জবাব দেব। আমি আত্মরক্ষা করতেই ওকে হত্যা করি। আপনি ঠিকই বলছেন। আমি পিছন ফেরা মাত্র ও ছোরা হাতে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি গুলি চালাতে বাধ্য হই। তারপর ছোরাটা ওর হিপ পকেটে গুঁজে দিয়ে ওর মৃতদেহটা জঙ্গলে টেনে আনি। আমার বাকি জবানবন্দিতে মিথ্যা কিছু নেই— একেবারে শেষ পর্যায়ে দশটা দশের পর আবার বারাসাত ফিরে এসে মিস করের গাড়ি ও পরেশ পালকে দেখার বর্ণনা ছাড়া।

—তার মানে আপনি যখন আসামীর কোলে রিভলভারটা ফেলে দেন, তখন তাতে পাঁচটা তাজা বুলেট ছিল? ব্যারেলের সামনেরটা ব্যয়িত?

—ইয়েস স্যার!

—দ্যাটস অল, য়োর অনার। ডিফেন্স কনক্লুডস হিয়ার।

জজসাহেব বললেন, প্রথামাফিক এখন দুপক্ষের আর্গু করার কথা। কিন্তু তার পূর্বে আমি পি. পি. এবং ডিফেন্স কাউন্সেলকে আমার বেঞ্চের কাছে সরে আসতে বলছি। কিছু গোপন পরামর্শ ছিল।

দুজনেই এগিয়ে গেলেন। আনসারি বললেন, মিস্টার পি. পি., মামলা এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সুবলচন্দ্র সাঁই ওরফে চাঁদু রায় এবং রজত গুপ্তকে এখনি অ্যারেস্ট করা দরকার। সেটা আপনি করবেন, না সু মোটো-কেস করে আদালত করবে?

পি. পি. মাইতি বলেন, নো, য়োর অনার! আপনি নিশ্চিত্ত থাকুন। আদালত ভাঙলেই আমরা যথাবিহিত ব্যবস্থা নেব। সশস্ত্র পুলিশ আদালত ঘিরে রেখেছে। আর এই সঙ্গেই আমরা জানাতে চাই প্রসিকিউশন মিস অপরাজিতা করের উপর মামলা প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। আপনি মামলা ডিসমিস করে ইচ্ছে করলে আসামীকে এখনি মুক্তি দিতে পারেন।

বাসু বললেন, থ্যাঙ্কু মিস্টার মাইতি।

মাইতি অদ্ভুত দৃষ্টি মেলে তাকালেন বাসুসাহেবের দিকে। তারপর প্রথামাফিক বললেন : য়ু আর ওয়েলকাম।

* * *

আদালত ভাঙল। সবাই বাইরে বার হয়ে আসছে। বাসুসাহেবের হাত ধরে অপরাজিতা— দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে আছে হাতখানা। ইন্দ্রনারায়ণ এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। বললেন, একটা কথা ছিল, মিস্টার বাসু!

ওঁরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন আদালতের করিডোরে। বাসুসাহেব, অপরাজিতা, কৌশিক, সুজাতা আর বাসুসাহেবের কিছু জুনিয়ার শিক্ষার্থী উকিল।

ইন্দ্রনারায়ণ অপরাজিতার দিকে ফিরে বলেন, আপনার উপর যে অন্যায়, অত্যাচার হয়েছে সে জন্য আমরা আংশিকভাবে দায়ী। আমাদের ক্ষমা করে যেতে হবে।

অপরাজিতা হাসতে হাসতে বলে, আজ কারও ওপর আমার কোনও রাগ নেই। বেশ তো, দিলাম ক্ষমা করে!

—ক্ষমা যে করেছেন তার প্রমাণ হিসাবে একটা অনুমতি দিতে হবে।

—কিসের অনুমতি?

—মিস্টার বাসুর ফিজটা আমাকে মেটাতে দিন!

গম্ভীর হয়ে গেল অপরাজিতা। সংক্ষেপে বলল, তা হয় না। আমার যেটুকু ক্ষমতা উনি তাই নেবেন।

বাসু বললেন, মিস্টার চৌধুরী, অপরাজিতার কাছ থেকে আমি কোন কিছুই নেব না। বিশেষ কারণে। কিন্তু আমাদের আর একটি কাজ বাকি আছে।

—কী কাজ?

—আসুন আমার সঙ্গে।

দলটা এগিয়ে গেল আদালতের আর এক প্রান্তে, সেখানে ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিল নির্মলা রায়। বাসু পিছন থেকে ডাকলেন, নির্মলা!

মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ালো। তার চোখে জল। বাসু বললেন, আদালতে সাক্ষী দেবার সময় তুমি বলেছিলে, সুশোভন তোমার জন্য যা কিছু রেখে গেছে তাতে তোমার অধিকার আছে কি না তা তুমি জান না। কারণ সুশোভন তোমার বৈধ স্বামী ছিল না। আমার এই কার্ডখানা রাখ। কোন দাবিদার বা পাড়ার মস্তান যদি তোমার সঙ্গে বাঁদরামো করতে আসে আমাকে একটা ফোন করে দিও। সুশোভনের সব কিছু এখন আইনত তোমার

ইন্দ্রনারায়ণও ঐ সঙ্গে তাঁর নামাঙ্কিত একটি কার্ড দিয়ে বললেন, প্রথম ধাক্কাটা সামলাবার পর যদি চাকরি-বাকরি করার ইচ্ছে হয়, তাহলে আমাকে একটা ফোন করবেন। আপনার দুর্দৈবের জন্যও আমি নিজেকে আংশিকভাবে দায়ী মনে করছি।

নির্মলার চোখ আবার অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

অপরাজিতা এগিয়ে এসে বললে, তোর বাড়িতে আমাকে থাকতে দিবি তো, নিমু? দেখলি তো, তোর বরকে আমি নিজের দাদার মতোই….

দুজনেই দুজনকে বাহুবন্ধে জড়িয়ে ধরল।

দুজনেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।