দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । এরা কারা—কবেকার—কোথাকার?
আমরা পৃথিবীর বোম্বেটেদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু এখন আমরা কেবল ইউরোপীয় বোম্বোটেদেরই গল্প বলব। প্রথমেই বলে রাখি, এই গল্পগুলির ঘটনাস্থল ইউরোপ নয়—আমেরিকা।
ঘটনাগুলি পড়বার আগে দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার মানচিত্রের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করুন।
উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে পানামা। তার বামে প্রশান্ত মহাসাগর ও ডাইনে আটলান্টিক মহাসাগর। এখন পানামায় খাল কেটে এই দুই মহাসাগরকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু যখনকার কথা বলছি (সপ্তদশ শতাব্দী) তখন এই খাল ছিল না। (পানামা খাল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কাটা হয়।)
আটলান্টিক মহাসাগরের এক অংশকে বলে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র। তারই ভিতরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ—হাইতি, জামাইকা, কিউবা প্রভৃতি। কিউবার বামদিকে হচ্ছে মেক্সিকো উপসাগর।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা প্রদেশকে স্পর্শ করেছে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে, তার চারিপাশের সমুদ্রবক্ষে ও নিকটবর্তী ভূভাগে ষোড়শ থেকে সপ্তদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে রোমাঞ্চকর রক্তাক্ত নাটকের একটানা অভিনয় হয়েছিল, কাল্পনিক উপন্যাসও তার কাছে হার মানে। কিন্তু সকলের কাছে আর একটু ধৈর্য প্রার্থনা করি, কারণ মূল গল্প শুরু করবার আগে স্থান-কাল-পাত্রের কথা আরও কিছু না বললে আসল ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না।
সর্বপ্রথমে কলম্বাস এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন। কলম্বাস নিজে স্পানিয়ার্ড ছিলেন না, কিন্তু স্পেনদেশের রানি ইসাবেলার আনুকূল্য লাভ করে এই অসমসাহসিক নাবিক নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য সমুদ্রযাত্রা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। অজানা সমুদ্রের উপর ক্ষুদ্র পোতে ভাসমান হয়ে, শত বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে, নিদারুণ কষ্ট সহ্য করে, তিনি ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত কোনও এক অজ্ঞাতনামা দ্বীপে (কলম্বাস এই দ্বীপটির নাম রেখেছিলেন ‘স্যান স্যালভেডর’, সম্ভবত আধুনিক ‘ওয়াটলিং দ্বীপ’।) উপস্থিত হয়েছিলেন; আর স্পেনদেশের রাজা ও রানির নামে দ্বীপটি দখল করে, সেখানে স্পেনের রাজপতাকা প্রাোথিত করেছিলেন। কাজেই স্পানিয়ার্ডরাই সর্বপ্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে দলে দলে এসে উপনিবেশ স্থাপন করবার সুবিধা পেয়েছিল। তারা কিন্তু অধিকৃত দ্বীপগুলি সব সময়ে শাসনে বা দখলে রাখতে পারত না। ফরাসি, ইংরেজ, ওলন্দাজ, পোর্তুগিজ প্রভৃতি জাতির দুঃসাহসিক লোকেরা মাঝে মাঝে দল বেঁধে জাহাজে চড়ে এসে ওই সকল দ্বীপে উৎপাত করত, আর এক-একটা দ্বীপ বা তার খানিকটা, স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে দখল করে বসত। এই সব কাজে বোম্বেটেদের সাহায্য নিতে তারা কিছুমাত্র সঙ্কোচবোধ করত না।
১৬২৫ খ্রিস্টাব্দে একদল দুঃসাহসিক ইংরেজ ও ফরাসি জল-ডাকাতি করে টাকা রোজগার করবার জন্যে সেন্ট ক্রিস্টোফার দ্বীপে এসে আড্ডা গাড়ে। তারা স্পানিয়ার্ডদের অধিকৃত হিস্পানিওলা বা হাইতি দ্বীপে (পূর্বে সমগ্র দ্বীপের নাম ছিল হাইতি বা হিস্পানিওলা। পরবর্তীকালে হাইতি দ্বীপের রাজধানী সান্টো ডোমিঙ্গোর নাম অনুসারে ওই দ্বীপের পূর্বখণ্ডের নামকরণ হয় ‘সান্টো ডোমিঙ্গো’ আর পশ্চিমখণ্ডের নাম ‘হাইতি’ থাকিয়া যায়।) লুঠতরাজ করত, আর লুট করা শূকরের মাংস শুকিয়ে চলতি সওদাগরি জাহাজে বিক্রি করত। ১৬৩০ খ্রিস্টাব্দে তারা টর্টুগা দ্বীপে চলে যায়। মেক্সিকোর উপসাগরের মুখে দশটি ছোট ছোট দ্বীপ আছে। সেগুলিকে টর্টুগা দ্বীপপুঞ্জ বলে। টর্টুগা দ্বীপ ও টর্টুগা দ্বীপপুঞ্জ যে এক নয়, তা মনে রাখা দরকার।
বোম্বেটেরা টর্টুগা দ্বীপে নতুন করে আড্ডা গাড়লে, ইউরোপের নানা দেশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন জাতির দুঃসাহসিক দুর্বৃত্তেরা এসে তাদের দলে ভিড়ে যেতে লাগল। এইরূপে বোম্বেটেরা দলে বেশ ভারী হয়ে উঠল। স্পানিয়ার্ডদের জাহাজ লুট করা বা তাদের দখলি দ্বীপে বা ভূভাগে এসে হানা দেওয়া তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়াল। স্পানিয়ার্ডরা অস্থির হয়ে উঠল।
সমুদ্রে ডাকাতি করে ফিরে তারা টর্টুগা দ্বীপে অথবা জামাইকা বা অন্য কোনও দ্বীপে এসে আশ্রয় গ্রহণ করত। তারপর দু-এক মাসের মধ্যেই মদ খেয়ে, জুয়া খেলে ও অন্যান্য বদখেয়ালিতে সব টাকা ফুঁকে দিয়ে তারা আবার নতুন শিকারের খোঁজে জাহাজে চড়ে বেরিয়ে পড়ত। এই সব দ্বীপের শাসনকর্তারা প্রায়ই ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের মতো হতেন না। বোম্বেটেরা তাঁদের সঙ্গে একটা পাকা বন্দোবস্ত করে ফেলত, নিজেদের পাপের টাকার খানিক অংশ ঘুষ দিয়ে তাঁদের মুখ বন্ধ করে রাখত। দু-একজন কড়া শাসনকর্তা তাদের যদি শাসনে রাখবার চেষ্টা করতেন, তাহলে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়াত। কারণ বোম্বেটের দল এতটা প্রবল ছিল যে, সকলে একসঙ্গে বিদ্রোহ প্রকাশ করে যেন-তেন-প্রকারেণ সাধু শাসনকর্তাকে সেখান থেকে না তাড়িয়ে ছাড়ত না। সময়ে সময়ে, শাসনকর্তা যেখানে শাসন করছেন, সেই দ্বীপ পর্যন্ত তারা কেড়ে নিত। কাজেই সাধুতা ছিল সেখানে ব্যর্থ।
ও সব দ্বীপে স্পানিয়ার্ডরাই সংখ্যায় ছিল বেশি। তাদের শূকরের ব্যবসাই ছিল প্রধান। তারা পাল পাল শূকর পুষত এবং এই সব শূকরের রক্ষিত মাংস তারা জাহাজে করে নানা দেশে চালান দিত। ওসব জায়গায় ফরাসি, ইংরেজ বা ওলন্দাজেরও অভাব ছিল না। তারা এখানে-সেখানে আড্ডা গেড়ে বসবাস করত, অনেকে তামাক বা আখের চাষ করত, আবার অনেকের শিকারই ছিল পেশা। স্পানিয়ার্ডরা ছিল ঘোর অত্যাচারী, তারা সুযোগ পেলে এদের উপরও অত্যাচার করতে ছাড়ত না; এরাও তাদের দু-চক্ষে দেখতে পারত না, অত্যাচারের নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিত। স্পানিয়ার্ড, ফরাসি, ইংরেজ, ওলন্দাজ—সবাই ওই সকল দ্বীপের আদিম অধিবাসী লাল মানুষদের বা আফ্রিকা থেকে চালানি নিগ্রোদের ক্রীতদাস করে রাখত।
অনেক শ্বেতাঙ্গকেও ইউরোপ থেকে লোভ দেখিয়ে, চুরি করে বা জোর-জবরদস্তি করে ধরে এনে ওসব দ্বীপে বিক্রি করা হত। শ্বেতাঙ্গরাই তাদের কিনত। কিন্তু মনিবদের অত্যাচার ছিল এত অমানুষিক যে, গোলামরা পালিয়ে গিয়ে বোম্বেটের দলে মিশে নিষ্ঠুর জঘন্য জীবনযাপন করাও বাঞ্ছনীয় বোধ করত।
তা হলেই অবস্থাটা কেমন দাঁড়িয়েছিল, দেখুন। স্পানিয়ার্ডরা অধিকাংশ দ্বীপের মালিক—তারা ঘোরতর অত্যাচারী; খেত-বাড়ির শ্বেতাঙ্গ মালিকরা অত্যাচারী, শিকারিরা অত্যাচারী; বোম্বেটেরা জলে অত্যাচারী, স্থলে অত্যাচারী; শ্বেতাঙ্গ ক্রীতদাসেরা প্রভুদের হুকুমে বা ব্যবহারে অত্যাচারী; লাল মানুষ বা নিগ্রো ক্রীতদাসেরা মনিবদের অত্যাচারে বা তাঁদের নিষ্ঠুর আদেশ পালনে অভ্যস্ত হয়ে অত্যাচারী। সর্বত্র অত্যাচার। শুধু অত্যাচার নয়, পাপের বীভৎস লীলা। সুরাপান, ব্যভিচার, জুয়াখেলা, লুঠতরাজ, মারামারি, কাটাকাটি, খুন, জখম, অগ্নিকাণ্ড—পাপ যত মূর্তিতে প্রকাশ পেতে পারে তাই। সপ্তদশ শতাব্দীর সভ্যতার চমৎকার এক পৃষ্ঠা!
বোম্বেটেদের রীতিনীতি সম্বন্ধেও দু-চার কথা বলে নিই, কারণ পরে আর বলবার সময় হবে না।
বোম্বেটেদের কোনও নতুন দল গঠিত হলে, সমুদ্রযাত্রা করবার আগে দলের সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হত, কবে তাদের জাহাজ ছাড়বে এবং কাকে কত বারুদ ও বন্দুকের গুলি আনতে হবে। তারপর যাত্রাকালের খাবার জোগাড় করবার ব্যবস্থা হত। তাদের প্রধান খোরাক ছিল শূকর ও কচ্ছপের মাংস। বোম্বেটেরা প্রায়ই জাহাজ ছাড়বার আগে ছলে-বলে-কৌশলে শূকর সংগ্রহ করত—যথামূল্যে শূকর কেনবার জন্যে কোনওদিনই তারা আগ্রহ প্রকাশ করত না।
তারপর পরামর্শসভায় স্থির হত, শিকার জুটলে কার ভাগে কত অংশ পড়বে। অবশ্য সবচেয়ে বেশি অংশ পেত কাপ্তেন, তারপর জাহাজের ডাক্তার। ছুতারমিস্ত্রীও অন্য লোকের চেয়ে বেশি অংশ লাভ করত। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও স্থির থাকত যে শিকার না জুটলে কারুর ভাগ্যে কিছুই জুটবে না।
যুদ্ধবিগ্রহে কেউ মারা পড়লে বা কারুর অঙ্গহানি হলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা থাকত। সবচেয়ে বেশি দাম ছিল ডান হাতের। তারপর যথাক্রমে বাম হাত, ডান পা ও বাম পায়ের দাম। সর্বশেষে, একটা চোখ বা হাতের বা একটা আঙুলের দাম ছিল সমান!
নিজেদের ভিতরে তাদের রীতিমতো একটা বোঝাপড়া ছিল। তাদের প্রত্যেককেই শপথ করতে হত যে, দল ছেড়ে সে পালাবে না বা লুঠতরাজের কোনও জিনিসও দলের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখবে না। কেউ অবিশ্বাসী হলে তখনই তাকে দল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত।
এমন যে অমানুষ ও হিংস্র পশুর দল, কিন্তু দলের ভিতরে তাদেরও পরস্পরের সঙ্গে স্নেহ, প্রেম ও সদ্ভাব ছিল যথেষ্ট। একের দুঃখকষ্টে অন্যে যথেষ্ট সহানুভূতি প্রকাশ করত তো বটেই, উপরন্তু সেই দুঃখকষ্ট দূর করবার জন্য টাকা দিয়ে, দেহ দিয়ে যে কোনওরকম সাহায্য করতেও নারাজ হত না।
আমরা অতঃপর গল্প শুরু করব। কিন্তু এই গল্প প্রধানত যাঁর বই থেকে নেওয়া হয়েছে তাঁরও পরিচয় দেওয়া দরকার। তাঁর নাম হচ্ছে আলেক্স অলিভিয়ার এক্সকুইমেলিন, জাতে তিনি ওলন্দাজ। তিনি ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। এক্সকুইমেলিন সাহেব আগে নিজেও একজন বোম্বেটে ছিলেন এবং এই পুস্তকে বর্ণিত অধিকাংশ ঘটনাই তাঁর চোখের সামনেই ঘটেছিল। কোনও কোনও ঘটনা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল এমন সব বোম্বেটের মুখে তিনি নিজের কানে শ্রবণ করেছিলেন। তিনি যা দেখেছেন ও যা শুনেছেন সমস্তই হুবহু লিখে ১৬৪৮-৮৫ খ্রিস্টাব্দে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। সে পুস্তকের এত আদর হয়েছিল যে, ইউরোপের অধিকাংশ ভাষাতেই তার অনুবাদ দেখা যায় এবং এতকাল পরেও তাঁর পুস্তকের নতুন সংস্করণ হচ্ছে। বোম্বেটের নিজের মুখেই বোম্বেটের কাহিনি শুনতে কার না আগ্রহ হয়? আর এক্সকুইমেলিন সাহেবের পক্ষে বিশেষ প্রশংসার কথা হচ্ছে এই যে, কোনও অন্যায়কেই কোথাও তিনি গোপন করেননি বা ফেনানো ভাষার আড়ালে অস্পষ্ট করে তোলবার চেষ্টা করেননি। তাঁর ভাষা সহজ ও সরল। এইজন্যেই তাঁর কথিত কাহিনিগুলির ঐতিহাসিক মূল্য সামান্য নয়।