দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ । অভিনেতা দিগবিজয়ী
মহাবীর আলেকজান্ডার। শতাব্দীর পর শতাব্দী যাঁর নামগানে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, প্রতীচ্যের যিনি প্রথম দিগবিজয়ী, এশিয়া আফ্রিকা ও ইউরোপে যাঁর প্রভাব আজও কেউ ভোলেনি, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কেমন ধারা লোক ছিলেন? আগে সেই পরিচয়ই দিই।
বয়সে তিনি ছাব্বিশ বৎসর পার হয়েছেন মাত্র—যে-বয়সে নেপোলিয়নও পৃথিবীতে অপরিচিত এবং যে বয়সে বাঙালির ছেলে কলেজের বাইরেকার জগতে গিয়ে দাঁড়ালে প্রায় শিশুর মতোই অসহায় হয়ে পড়ে! এই ছাব্বিশ বৎসরের যুবক দিগবিজয়ী গ্রিস, মিশর, পারস্য ও ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশে জয়পতাকা উড়িয়ে ঝড়ের মতো ছুটে চলেছেন ভারতবর্ষের দিকে।
দীর্ঘদেহ, বিরাটবক্ষ, গৌরবর্ণ,—বাল্যকাল থেকে নিয়মিত ব্যায়ামে দেহের প্রত্যেক মাংসপেশি পুষ্ট ও লোহার মতো শক্ত! মাথায় দুলছে সিংহের কেশরের মতো স্ফীত, কুঞ্চিত ও সুদীর্ঘ কেশমালা; প্রশস্ত ললাট—কিন্তু চুলের তলায় তার অধিকাংশ করেছে আত্মগোপন; মেঘের মতো কালো ভুরুর ছায়ায় বড় বড় দুই চক্ষে মাঝে মাঝে জ্বলছে স্বপ্নসংগীতের ইঙ্গিত; টানা, উন্নত নাক; দৃঢ়-সংবদ্ধ ওষ্ঠাধরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞার ভাব! এই বীর্যবান অথচ কমনীয় যুবকের দেহকে আদর্শ রেখে গ্রিক ভাস্কররা দেবতার মর্মরমূর্তি গড়বার চেষ্টা করেছিলেন। সে-সব মূর্তি আজও বিদ্যমান।
কিন্তু আলেকজান্ডার নিরেট কাঠগোঁয়ার যোদ্ধা ছিলেন না। অমর গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল ছিলেন তাঁর শিক্ষাগুরু। অস্ত্রচালনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মস্তিষ্কচালনাও করতে শিখেছিলেন।
আলেকজান্ডারের চরিত্র ছিল অদ্ভুত। কখনও তিনি হতেন পাহাড়ের মতো কঠোর, কখনও বজ্রের মতো নিষ্ঠুর, আবার কখনও বা শিশুর মতো কোমল! নিজেকে তিনি ভাবতেন সর্বশক্তিমান দেবতার মতো এবং সেইজন্যে অনেক সময়েই পৌরাণিক দেবতার পোশাক পরে থাকতেন। এই অহমিকার জন্যেই আলেকজান্ডার যাত্রাপথের নানা স্থানে করেছিলেন নিজের নামে নব নব নগরের প্রতিষ্ঠা। অনেকের মতে, আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরের নাম আলেকজান্দ্রিয়ারই অপভ্রংশ।
ভারতবর্ষ আক্রমণ করবার আগে, আশপাশের শত্রুনাশ করে যাত্রাপথ সুগম করবার জন্যে আলেকজান্ডার দিগবিজয়ী রূপে প্রায় মধ্য এশিয়ার বুক পর্যন্ত গিয়ে পড়েছিলেন—কোথাও কেউ তাঁর অগ্রগতি বাধা দিতে পারেনি।
আলেকজান্ডার যখন তুর্কিস্থানের বিখ্যাত শহর সমরখন্দে বিশ্রাম করছেন, সেই সময়েই আমরা প্রথম যবনিকা তুলব।
শিবিরের এক অংশে একাকী বসে আলেকজান্ডার একমনে বই পড়ছেন।
বই পড়তে তিনি বড় ভালোবাসেন। স্বদেশ থেকে বহুদূরে এসে পড়ে, পথে-বিপথে হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে ঘূর্ণি হাওয়ার মতো ছুটোছুটি করে এতদিন তিনি বই পড়বার সময়ও পাননি এবং বইয়ের অভাবও ছিল যথেষ্ট। সম্প্রতি সে অভাব মিটেছে, গ্রিস থেকে তাঁর হুকুমে ইস্কিলাস, এইরিপিদেস ও সোফোক্লেস প্রভৃতি কবি এবং অন্যান্য পণ্ডিতদের রচিত নানারকম চিত্তাকর্ষক গ্রন্থ এসে পড়েছে।
আলেকজান্ডার সানন্দে বই পড়তে পড়তে শুনতে পাচ্ছেন, শিবিরের বাইর থেকে মাঝে মাঝে জাগছে বুকেফেলাসের—অর্থাৎ ‘ষণ্ডমুণ্ডে’র হ্রেষা-রব!
এই ষণ্ডমুণ্ড হচ্ছে আলেকজান্ডারের বড় আদরের ঘোড়া,—একে তিনি কখনও নিজের কাছ থেকে তফাতে রাখতেন না।
ষণ্ডমুণ্ডের সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয়ের কাহিনিও রীতিমতো গল্পের মতো।
তাঁর পিতা ফিলিপ তখন মাসিডনিয়ার রাজা এবং আলেকজান্ডার তখন ছোট্ট এক বালক!
একজন অশ্ব ব্যবসায়ী মহা তেজিয়ান এক ঘোড়া নিয়ে এল রাজা ফিলিপের কাছে বিক্রয় করতে।
ঘোড়াকে পরীক্ষা করবার জন্যে ফিলিপ তাঁর পল্টনের জনকয় পাকা ঘোড়-সওয়ারকে আহ্বান করলেন। কিন্তু কোনও সওয়ার তার পিঠে চড়বার চেষ্টা করলেই সেই তেজি ঘোড়া এমন ভয়ানক খেপে ওঠে যে, কেউ ভরসা করে আর তার কাছে এগুতেই চাইলে না।
ফিলিপ বললেন, ‘এ তো ভারি বদমেজাজি ঘোড়া দেখছি! এ আপদ এখনই দূর করে দাও।’
এতটুকু ছেলে আলেকজান্ডার তখন এগিয়ে এসে বললেন, ‘মহারাজ, আপনার সওয়াররা ঘোড়া চেনে না তাই এমন চমৎকার ঘোড়ার পিঠে চড়তে পারছে না।’
ফিলিপ বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আলেকজান্ডার! তোমার ছোট মুখে এতবড় কথা শোভা পায় না! তুমি কি নিজেকে আমার সওয়ারদেরও চেয়ে পাকা বলে মনে করো?’
আলেকজান্ডার দৃঢ়স্বরে বললেন, ‘আজ্ঞে হাঁ মহারাজ। আমি বাজি রেখে এখনই ওই ঘোড়ার পিঠে চড়তে রাজি আছি।’
পল্টনের পাকা ঘোড়সওয়াররা শিশুর মুখ-সাবাসি শুনে সকৌতুকে অট্টহাস্য করে উঠল।
ফিলিপ বললেন, ‘বেশ, চেষ্টা করে দেখ।’
আলেকজান্ডার ঘোড়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি এতক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলেন যে, মাটির উপরে নিজের ছায়া দেখেই ঘোড়াটা চমকে চমকে উঠছে। তিনি প্রথমে পিঠ চাপড়ে তাকে আদর করলেন। তারপর লাগাম ধরে ঘোড়ার মুখটা সূর্যের দিকে ফিরিয়ে দিলেন, কাজেই সে আর নিজের ছায়া দেখতে পেল না। তারপর অনায়াসেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে তাকে যথেচ্ছভাবে চারিদিকে ছুটোছুটি করিয়ে আনলেন।
বুড়ো বুড়ো সেপাই-সওয়ারদের মুখ চুন, মাথা হেঁট!
ফিলিপ প্রথমটা বিস্ময়ে অবাক হয়ে রইলেন, তারপর অভিভূত স্বরে আলেকজান্ডারকে ডেকে বললেন, ‘বাছা, নিজের জন্যে তুমি মস্ত কোনও রাজ্য জয় করো, আমার এ ক্ষুদ্র মাসিডন তোমার যোগ্য নয়।’
ফিলিপ সেইদিনই বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর ছেলে বড় সহজ ছেলে নয়! তাঁর অনুমানও সত্য হয়েছিল। কারণ ওই ষণ্ডমুণ্ডেরই পিঠে চড়ে আলেকজান্ডার পরে সারা বিশ্বজয় করেছিলেন।
আজ শিবিরের বাইরের সেই ষণ্ডমুণ্ডই মাঝে মাঝে হ্রেষা-রব করে তার প্রভুকে জানিয়ে দিচ্ছিল যে, এতক্ষণ তাকে ভুলে থাকা উচিত নয়—মনিবকে পিঠে নিয়ে মাঠে-বাটে ছুটোছুটি করবার জন্যে তার পাগুলো নিশপিশ করছে যে! কিন্তু আলেকজান্ডার কাব্যরসে মগ্ন হয়ে তখন অন্য জগতে গিয়ে পড়েছেন—কল্পনালোকে বিচরণ করা ছিল তাঁর চিরদিনের স্বভাব। এই কল্পনাই দেখিয়েছে তাঁকে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন!
কল্পনা চিরদিনই প্রত্যেক মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু শতকরা ছিয়ানব্বই জন লোক কেবল স্বপ্ন দেখেই খুশি থাকে, সেই স্বপ্নকে সফল করবার জন্যে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে তারা চায় না। আলেকজান্ডারের প্রকৃতি ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। কাজে ফাঁকি দিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন না, স্বপ্নের মধ্যেই থাকত তাঁর নতুন নতুন কাজের বীজ।
আচম্বিতে শিবিরের বাইরে উঠল জনতার বিপুল কোলাহল, আলেকজান্ডার বই থেকে মুখ তুলে গোলমালের কারণ অনুমান করবার চেষ্টা করলেন।
শুনলেন, নানা কণ্ঠে চিৎকার হচ্ছে—’আমরা ভারতবর্ষে যেতে চাই না!’—’ভারতবর্ষ আক্রমণ করে আমাদের কোনও লাভ নেই!’ ‘কে জানে সেখানে আমাদের অদৃষ্টে কী আছে?’
আলেকজান্ডার সচমকে ভাবলেন,—একি বিদ্রোহ? তাঁর নিজের হাতে গড়া বহু যুদ্ধবিজয়ী এই মহাসাহসী গ্রিক সৈন্যদল, যাদের মুখ চেয়ে তিনি নিজে কত আত্মত্যাগ করেছেন, যারা তাঁরই দৌলতে কোনওদিন পরাজয়ের মুখ দেখেনি,—তারাও আজ ভারতবর্ষের ভয়ে ভীত, তাঁর কথাও শুনতে নারাজ?
এই সেদিনের কথা তাঁর মনে পড়ল। প্রখর সূর্যকরে জ্বলন্ত এশিয়ার তপ্ত বুক মাড়িয়ে সসৈন্যে তিনি অগ্রসর হয়েছেন,—বাতাসে অগ্নিদাহের জ্বালা, জলবিন্দুশূন্য পথ আকাশের শেষ সীমায় কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ জানে না, মাঝে মাঝে শুষ্ক শৈল, লোকালয়ের চিহ্নমাত্র নেই!
কয়েকজন সৈনিক যখন একটি গর্তের মধ্যে একটুখানি জল আবিষ্কার করলে,—তখন সেই বিপুল বাহিনীর হাজার হাজার লোকের দেহ দারুণ পিপাসায় ছটফট করছে! চারিদিকে জলাভাবে হাহাকার!
ইস্পাতের শিরস্ত্রাণ খুলে জনৈক সৈনিক জলটুকু সংগ্রহ করলে। কিন্তু সে জল একজনমাত্র লোকের পক্ষে যথেষ্ট নয়!
সৈনিক বললে, ‘এ জল মহারাজকে উপহার দেব। রাজার দাবি আমাদের আগে।’
সৈনিকরা জলপূর্ণ শিরস্ত্রাণ নিয়ে এল—আলেকজান্ডারের কণ্ঠ তখন তৃষ্ণায় টাটা করছে।
মহারাজা সাগ্রহে তাড়াতাড়ি সৈনিকের হাত থেকে শিরস্ত্রাণ টেনে নিয়ে ঠোঁটের কাছে তুললেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নজরে পড়ল, তৃষ্ণার্ত সৈনিকরা হতাশ ভাবে শিরস্ত্রাণের দিকে তাকিয়ে আছে!
আলেকজান্ডার ঠোঁটের কাছ থেকে শিরস্ত্রাণ নামিয়ে ভাবলেন, ‘সকলেরই ইচ্ছা জলটুকু পান করে, অথচ এই জল মাত্র একজনের যোগ্য। কিন্তু আমি রাজা বলে এই জল যদি পান করি, তাহলে এত লোকের তৃষ্ণার জ্বালা আরও বাড়িয়ে তোলা হবে!’
আলেকজান্ডার তখনই শিরস্ত্রাণ উপুড় করে ধরলেন এবং দেখতে দেখতে শুকনো মাটি তা নিঃশেষে শুষে নিলে।
মহারাজার উদারতা ও স্বার্থত্যাগ দেখে হাজার হাজার কণ্ঠ তাঁর নামে জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।
আলেকজান্ডার সৈনিকদের কণ্ঠে এমনি জয়ধ্বনি শুনতেই অভ্যস্ত ছিলেন,—কিন্তু তাদেরই কণ্ঠে জেগেছে আজ বিদ্রোহের বেসুরো চিৎকার!
বাপ যেমন ছেলেদের চেনে, আলেকজান্ডারও তেমনই তাঁর সৈন্যদের ধাত চিনতেন। কাজেই কিছুমাত্র সঙ্কুচিত না হয়ে তখনি তিনি তাঁবুর বাইরে গিয়ে দেখলেন সেখানে অনেক গ্রিক এসে বৃহৎ এক জনতার সৃষ্টি করেছে এবং তাদেরই পুরোভাগে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর অদ্বিতীয় বন্ধু ক্লিটাস।
বন্ধু ক্লিটাস—জীবনরক্ষক ক্লিটাস! আলেকজান্ডারের মনে পড়ল ছ’বছর আগেকার একদিনের কথা। গ্রানিকাশের রণক্ষেত্রে যখন দুজন পারসি সেনাপতি একসঙ্গে তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং যখন তাদের উদ্যত অস্ত্রের কবল থেকে আলেকজান্ডারের মুক্তি পাওয়ার কোনও উপায়ই ছিল না, তখন এই মহাবীর ক্লিটাসই সেখানে আবির্ভূত হয়ে সিংহবিক্রমে তাঁর প্রাণরক্ষা করেছিলেন। সেইদিন থেকেই ক্লিটাস হয়েছেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু।
আলেকজান্ডার তাঁবুর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাপার কী, ক্লিটাস?’
ক্লিটাস বললেন, ‘সৈন্যরা কেউ ভারতবর্ষে যেতে রাজি নয়।’
‘কেন?’
‘ওরা বলছে, গৌগেমেলার রণক্ষেত্রে দরায়ূসের সেনাদলে ওরা ভারতীয় সৈন্যদের যুদ্ধ করতে দেখেছে। দূর বিদেশে পরের জন্যে তরবারি ধরে সেই কয় শত ভারতীয় বীর যে কৃতিত্ব দেখিয়েছিল, ওদের আজও তা মনে আছে। আজ আমরা চলেছি তাদেরই স্বদেশে—যেখানে সংখ্যায় হব আমরা তুচ্ছ, আর তারা হবে অগণ্য। ওরা তাই ভয় পেয়েছে, হাজার হাজার মাইল পথ পেরিয়ে শত শত নদী, বন, পাহাড়ের ওপারে সেই দুর্গম ভারতবর্ষে যাবার ইচ্ছা ওদের নেই।’
আলেকজান্ডার ঘৃণাভরে বললেন, ‘গ্রিক সেনার ভয়! দেবাশ্রিত আমার সৈন্য, ভারতবর্ষের নামে তাদের ভয় হয়েছে! ক্লিটাস, তুমিও কি ওদের দলে?’
‘হাঁ সম্রাট! আমারও মত হচ্ছে, এই মিথ্যা দুঃসাহস দেখিয়ে আমাদের কোনওই লাভ হবে না!’
আলেকজান্ডার পরিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘শোনো ক্লিটাস! শোনো সৈন্যগণ! আমাদের আর ফেরবার কোনও উপায়ই নেই। আমাদের স্বদেশ আজ বহুদূরে, আমাদের চতুর্দিকে আজ বিদেশি শত্রু! আমরা যদি আজ দেশের দিকে ফিরি, তাহলে শত্রুরা ভাববে আমরা তাদের ভয়েই পালিয়ে যাচ্ছি। আজ আমাদের বাহুবল দেখে যে লক্ষ লক্ষ শত্রু মাথা লুকিয়ে আছে, তারা তখন চারিদিক থেকে পঙ্গপালের মতো বেরিয়ে গ্রিক সৈন্যদের আক্রমণ করে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। শত্রুর শেষ রেখে ফিরতে গেলে আমাদের কারুকে আর বাঁচতে হবে না। বিশেষ, ভারতবর্ষ হচ্ছে পারস্য সাম্রাজ্যের অংশ, এখন তাকে জয় করতে না পারলে আমাদের দিগবিজয়ও ব্যর্থ হয়ে যাবে!’
ক্লিটাস বললেন, ‘কিন্তু ভারতবর্ষে গিয়ে তাকে জয় করতে না পারলে আমাদের কী অবস্থা হবে?’
আলেকজান্ডার ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘সে কথা ভাবব আমি। তোমাদের কর্তব্য আমার আদেশ পালন করা।’
ক্লিটাস বললেন, ‘নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও আপনার আদেশ পালন করতে হবে?’
‘হাঁ, সেইটেই হচ্ছে সৈনিকের ধর্ম। মৃত্যুর চেয়েও বড় সেনাপতির আদেশ।’
হাজার হাজার সৈনিক হঠাৎ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘অন্ধের মতো আমরা কারুর আদেশ পালন করব না—আমরা কেউ ভারতবর্ষে যাব না।’
কিন্তু লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ নিয়ে যাঁরা খেলা করতে পারেন, জনতার হৃদয় জয় করবার অনেক কৌশলই তাঁদের জানা থাকে।
আর একজন দিগবিজয়ী—নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, মিষ্টি কথায় কারুকে বশ করতে না পারলে পাগলের মতো খেপে উঠতেন এবং তাঁর সেই প্রচণ্ড রাগ দেখে অবাধ্যরা মুষড়ে পড়ে বাধ্য না হয়ে পারত না। অথচ নেপোলিয়ন স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করে গেছেন, সেসব রাগ তাঁর লোক দেখানো মৌখিক অভিনয় মাত্র, মনে মনে হেসে বাইরে তিনি করতেন ক্রোধ প্রকাশ।
দিগবিজয়ী আলেকজান্ডারও ছিলেন অভিনয়ে খুব পটু। ক্রুদ্ধ স্বরেও যখন ফল হল না, তখন তিনি ভিন্ন উপায় অবলম্বন করলেন। অত্যন্ত নিরাশ ভাবে দুঃখ-ভাঙা স্বরে ধীরে ধীরে বললেন, ‘সৈন্যগণ! আমি সম্রাট বটে, কিন্তু তোমাদের সঙ্গে করেছি বন্ধুর মতো আচরণ! তোমাদের জন্যে আমি আমার ক্ষুধার অন্ন, তৃষার জল এগিয়ে দিয়েছি, তোমাদের গৌরবের জন্যে আমি সিংহাসনের বিলাসিতা ছেড়ে বারবার সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ছুটে গিয়েছি। তোমরা কেবল আমার বন্ধু নও, আমার সন্তানের মতো। তোমাদের কোনও প্রার্থনাই আমি অপূর্ণ রাখতে পারব না। ভারতবর্ষ জয় করা ছিল আমার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কিন্তু তোমরা যখন অসম্মত, তখন আমারও রাজি না হয়ে উপায় নেই। বেশ, তোমরা যা চাও তাই হবে। আজ থেকে আমিও আর তোমাদের সেনাপতি নই—তোমরাও হলে স্বাধীন! আমি তোমাদের ত্যাগ করলুম, আমাকে এখানে একাকী রেখে তোমরা গ্রিসে ফিরে যাও। আমার আর কোনও বক্তব্য নেই’—বলতে বলতে তাঁর দুই চোখ ছলছলে ও কণ্ঠ অশ্রুরুদ্ধ হয়ে এল।
বীরত্বের অবতার ও গ্রিসের সর্বেসর্বা সম্রাট আলেকজান্ডারের এই কাতর দীনতা ও আর্তস্বর সৈন্যরা সহ্য করতে পারলে না, তারা এককণ্ঠে বলে উঠল, ‘সম্রাট—সম্রাট! আপনি আমাদের ত্যাগ করবেন না, আপনার সঙ্গে আমরা মৃত্যুর মুখেও ছুটে যেতে প্রস্তুত! আমরা ভারতবর্ষে যাব—আমরা ভারতবর্ষে যাব!’
আলেকজান্ডারের মুখে আবার হাসির রেখা ফুটল, উচ্ছ্বসিত স্বরে তিনি বললেন, ‘এই তো আমার সৈন্যদের যোগ্য কথা! ক্লিটাস, হতভম্বের মতো আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখছ কী? যাও, আমার সৈন্যদের জন্যে আজ বিরাট এক ভোজের আয়োজন করো গে! কালই আমরা ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করব।’
হাজার হাজার সৈন্যের মুখ থেকে তখন বিদ্রোহের সমস্ত চিহ্ন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তারা একসঙ্গে অসি কোশমুক্ত করে শূন্যে আস্ফালন করতে করতে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বলে উঠল, ‘জয়, সম্রাট আলেকজান্ডারের জয়! ভারতবর্ষ, ভারতবর্ষ! পঞ্চনদের তীরে!’