দ্বিতীয় জীবন

দ্বিতীয় জীবন

কয়েসের পিঠে একটা লাথি দিয়ে ছায়ামূর্তিটি বলল, ওঠ। শালা বেজন্মা কোথাকার। কয়েস উবু হয়ে অন্ধকার ঘরের কোনায় বসে ছিল। তার দুই হাত পিছনে শক্ত করে বাধা। কব্জিতে না বেঁধে কনুইয়ের কাছে বেঁধেছে। সস্তা নাইলনের দড়ি, চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে। লাথি খেয়ে সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, মানুষের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য হাত দুটোর খুব প্রয়োজন, হাত বাঁধা থাকায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে তাল সামলে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পিছন থেকে তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে ছায়ামূর্তিটি বলল, চল।

কয়েস শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

মানুষটি পিছন থেকে অত্যন্ত রূঢ় গলায় বলল, তোর শ্বশুরবাড়িতে হারামজাদা বাঞ্চত কোথাকার।

কয়েস কোনো কথা না বলে অন্ধকারে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আবার একটা ধাক্কা দিতেই সে হাঁটতে শুরু করে। বাইরে নির্জন অন্ধকার রাত। হেমন্তের হালকা কুয়াশা চারদিকে এক ধরনের অস্পষ্ট আবরণের মতো ঝুলে আছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত, অনেক দেরি করে চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎস্নার নরম আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েস চোখ তুলে তাকাল–দৃশ্যটি সম্ভবত সুন্দর কিন্তু সেটা সে বুঝতে পারছে না। সুন্দর জিনিস অনুভব করার জন্য যে রকম মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন সেটি তার নেই।

কয়েস হাঁটতে হাঁটতে পিছনের মানুষটিকে বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

পিছনের মানুষটি খেঁকিয়ে উঠে বলল, চুপ কর শালা। কথা বলবি না।

মাত্র একটা কথা।

মানুষটি ধমক দিয়ে বলল, চুপ।

কয়েস চুপ করে শীতের হিম কুয়াশায় আরো কিছুক্ষণ হেঁটে যায়, তারপর প্রায় মরিয়া হয়ে আরো একবার কথা বলতে চেষ্টা করে, ভাই, আপনাকে শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করি? একটা কথা।

পিছনের মানুষটা কোনো কথা বলল না। কয়েস আবার অনুনয় করে বলল, করি?

কী কথা?

আমাকে কী করবেন?

পিছনের মানুষটা কোনো কথা না বলে হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল। কয়েস আবার জিজ্ঞেস করল, কী করবেন?

রং করিস আমার সাথে? শালা তুই বুঝিস নাই কী করব?

কয়েস কোনো উত্তর দিল না, সে বুঝতে পারছে কিন্তু বিশ্বাস করতে চাইছে না। নিজের কানে একবার শুনতে চাইছে। সে আরো কয়েক পা নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে বলল, কী করবেন?

মানুষটি হঠাৎ রেগে গেল, রেগে চাপা গলাইয় চিৎকার করে বলল, শুনবি কী করব তোকে? শুনবি? শোন তা হলে। তোকে নিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড় করিয়ে মাথার মাঝে একটা গুলি করব। বুঝেছিস?

কয়েসের সারা শরীর অবশ হয়ে ওঠে, হঠাৎ করে তার মনে হয় সে বুঝি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। কষ্ট করে সে দুই পায়ের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে টেনে যন্ত্রের মতো হেঁটে যেতে থাকে। আরো কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কয়েস নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাকে কেন গুলি করবেন? আমি কী করেছি?

তুই কী করেছিস আমার সেটা জানার কথা না। আমাকে বলছে তোর লাশ ফেলতে, আমি তোর লাশ ফেলব।

কিন্তু আপনার খারাপ লাগবে না?

খারাপ? পিছনের মানুষটা হঠাৎ যেন খুব অবাক হয়ে গেল, খারাপ কেন লাগবে?

কারণ, আমি মানুষটা হয়তো খারাপ না। হয়তো আমি ভালো মানুষ। নির্দোষ মানুষ–

পিছনের মানুষটা আবার শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, তুই ভালো না খারাপ, দোষী না নির্দোষ, তাতে আমার কী আসে–যায়? আমাকে একটা কাজ দিয়েছে সেই কাজ করছি।

কেন করছেন?

পিছনের মানুষটা হঠাৎ ধৈর্য হারিয়ে বেঁকিয়ে উঠল, চুপ কর হারামজাদা। বকর বকর করিস না।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কয়েস আবার জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী?

পিছনের মানুষটা কয়েসের প্রশ্ন শুনে এত অবাক হল যে, রাগ হতে ভুলে গিয়ে হকচকিয়ে বলল, কী বললি?

আপনার নাম?

আমার নাম দিয়ে তুই কী করবি?

এমনি জানতে চাই।

জেনে কী করবি?

কিছু করব না। জানতে ইচ্ছে করছে। কয়েস অনুনয় করে বলল, বলবেন?

কয়েস ভেবেছিল মানুষটি তার নাম বলবে না, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটা উত্তর দিল, বলল, মাজহার।

কয়েস নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, এইটা কি আপনার সত্যি নাম?

মাজহার পিছন থেকে কয়েসকে রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে বলল, সেই কৈফিয়ত আমার তোকে দিতে হবে নাকি?

কয়েস ধাক্কা সহ্য করে নরম গলায় বলল, রাগ করবেন না মাজহার ভাই। আসলে এইটা আপনার সত্যি নাম না হলেও কোনো ক্ষতি নেই। কথা বলার জন্য একটা নাম লাগে, সেই জন্যে। এ ছাড়া আর কিছু না।

তোকে কথা বলতে বলেছে কে?

কেউ বলে নাই।

তা হলে?

তবু কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কিছু মনে নিবেন না মাজহার সাহেব।

কয়েস তার পিছনে দাঁড়ানো মানুষটিকে একবারও দেখে নি, মানুষটি দেখতে কী রকম সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। পায়ের শব্দ এবং মাঝে মাঝে কাপড়ের খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ করে মানুষটিকে দেখতে ইচ্ছে হল কয়েসের। হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে, সাথে সাথে মাজহার নাইলনের দড়ির বাড়তি অংশটুকু দিয়ে শপাং করে তার মুখে মেরে বসে। যন্ত্রণায় কাতর একটা শব্দ করল কয়েস, মাজহার হিস হিস করে বলল, খবরদার পিছনে মাথা ঘুরাবি না। খবরদার।

কয়েস মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে আর ঘুরাব না। আর ঘুরাব না।

দুইজন আবার চুপচাপ খানিকক্ষণ হেঁটে যায়। নির্জন রাস্তায় শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। দূরে কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। অনেক দূরে কোথাও একটি কুকুর ডাকল, হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটিকে কয়েসের কাছে কেমন জানি অতিপ্রাকৃত বলে মনে হতে থাকে। সে নিচু গলায় বলল, মাজহার সাহেব।

মাজহার কোনো উত্তর দিল না। কয়েস আবার ডাকল, মাজহার সাহেব।

কী হল?

আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

কী কথা?

আমাকে মেরে আপনি কী পাবেন?

টাকা।

কত টাকা?

সেটা শুনে তুই কী করবি?

জানার ইচ্ছা করছে।

জেনে কী করবি? তুই শালা আর দশ মিনিট পরে মরে ভূত হয়ে যাবি—

তবু শোনার ইচ্ছা করছে।

দুই।

দুই কী?

দুই হাজার।

কয়েস একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মাত্র দুই হাজার টাকার জন্য আপনি আমারে মারবেন?

মাজহার রেগে উঠল, তুই শালা কোন লাট সাহেব যে তোরে মেরে আমি দুই লাখ টাকা পাব?

কয়েস নরম গলায় বলল, আপনি আমারে ছেড়ে দেন মাজহার সাহেব, আপনারে আমি বিশ হাজার টাকা দিব।

মাজহার হা হা করে হেসে উঠল, তুই বিশ হাজার টাকা দিবি?

জে। দিব, খোদার কসম।

কীভাবে দিবি?

আপনি যেখানে বলবেন সেইখানে পৌঁছে দেব।

মাজহার কয়েসের পিছন থেকে তার মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল, তুই আমারে একটা বেকুব পেয়েছিস?

কেন মাজহার সাহেব? এই কথা বলছেন কেন?

তুই ছাড়া পেলে আর ফিরে আসবি? তুই শালা টিকটিকির বাচ্চা সোজা যাবি পুলিশের কাছে।

জি না মাজহার সাহেব। খোদার কসম যাব না। আপনার টাকা আমি বুঝায়ে দিব।

কাঁচকলা দিবি।

দিব মাজহার সাহেব। আল্লাহর কসম।

আচ্ছা যা–মনে করলাম তুই দিলি তাতে আমার লাভ কী? আমার পার্টির সাথে বেইমানি হল। সেই পার্টি আমারে ছেড়ে দিবে? আমারে আর কাজ দিবে?

কয়েস কোনো কথা বলল না।

তোরে মেরে আজ দুই হাজার টাকা পাব। সপ্তাহ দুই পরে আরেকটা কেস আসবে। আরো দুই আড়াই হাজার টাকা। মাসে দুই–তিনটা বান্ধা কেস। আমি তোর বিশ হাজার টাকার লোভে বান্ধা কাজ ফেলে দিব? আমারে তুই বেকুব পেয়েছিস?

মাজহার সাহেব আপনি চাইলে আপনাকে আমি চল্লিশ হাজার টাকা দিব। খোদার কসম।

চুপ কর শালা। কথা বলিস না। তুই শালা চল্লিশ হাজার কেন, চল্লিশ টাকার কেসও না।

মাজহার সাহেব! কয়েস কাতর গলায় বলল, বিশ্বাস করেন, আপনাকে সব টাকা আমি বুঝয়ে দিব। আপনি যেখানে চাইবেন, যেভাবে চাইবেন।

চুপ কর। মাজহার ধমক দিয়ে কয়েসকে থামানোর চেষ্টা করল।

কয়েস তবু হাল ছাড়ল না, অনুনয় করে বলল, বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর কেউ জানবে না। আমি একেবারে উধাও হয়ে যাব। দেশ ছেড়ে চলে যাব–আপনি আপনার বান্ধা কাজ করে যাবেন। কেউ একটা কথা জানবে না। খোদার কসম।

মাজহার কোনো কথা বলল না। কয়েস কাতর গলায় বলল, চল্লিশ হাজার না মাজহার সাহেব, আমি আপনাকে পুরো পঞ্চাশ হাজার টাকা দিব। এক শ টাকার নোট। পঞ্চাশ হাজার টাকা।

চুপ কর শালা, বেশি কথা বলিস না। তোর টাকায় আমি পিশাব করে দিই।

মাজহার সাহেব, আমাকে ছেড়ে দেন, আমি আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহর কাছে দোয়া করব।

নিজের জন্য দোয়া কর।

মাজহার সাহেব, বিশ্বাস করেন আমি কিছু করি নাই। আমি নির্দোষ। আমারে ভুল করে ধরেছেন, কী একটা ভুল হয়েছে। আমার স্ত্রী আছে, ছোট ছেলে আছে। দুই বছরের ছেলে–এতিম হয়ে যাবে। আমারে মারবেন না মাজহার সাহেব। আল্লাহর কসম

মাজহার পা তুলে কয়েসের পিঠে একটা লাথি দিয়ে বলল, চুপ কর হারামজাদা।

কয়েস তাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভাঙা গলায় বলল, মাজহার সাহেব। আপনার কাছে আমি প্রাণ ভিক্ষা চাই। শুধু আমার প্রাণটা ভিক্ষা দেন। আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকব। কেনা গোলাম হয়ে থাকব। সারা জীবনের জন্যে গোলাম হয়ে থাকব।

মাজহার কোনো কথা বলল না। কয়েস কাতর গলায় বলল, সারা জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব। আপনি যা চাইবেন তাই দিব আপনাকে। বিশ্বাস করেন, আমার সম্পত্তি যা আছে–

মাজহার খেঁকিয়ে উঠে বলল, কেন শালার ব্যাটা তুই ঘ্যানঘ্যান করছিস? তুই জানিস না ঘ্যানঘ্যান করে কোনো লাভ নাই? মানুষের ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান শুনে আমার কান পচে গেছে। এই নদীর ঘাটে আমি কত মানুষ খুন করেছি তুই জানিস?

জানি না মাজহার সাহেব। আমি জানতে চাইও না। আপনি একটা কম খুন করেন। মাত্র একটা। আপনার কসম লাগে।

মাজহার কোনো উত্তর দিল না, একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। তারা নদীর তীরে এসে গেছে। এই ঘ্যানঘ্যানে কান্না এখনই শেষ হয়ে যাবে। ব্যাটাকে কথা বলতে দেওয়াই ভুল হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কাউকে কথা বলতে দেবে না। মরে যাওয়ার আগে একেকজন মানুষ একেকরকম চিড়িয়া হয়ে যায় কী যন্ত্রণা!

মাজহার নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কয়েসের পিছনে হাত দিয়ে বলল, এইখানে দাঁড়া।

কয়েস দাঁড়িয়ে গেল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল সে তার জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে, হঠাৎ করে মনে হতে থাকে আর কিছুতেই বুঝি কিছু আসে–যায় না। চারদিকে নরম একটা জ্যোৎস্না, হেমন্তের হালকা কুয়াশা, নদীর পানিতে বহু দূরে গ্রামের টিমটিমে কয়েকটা আলোর প্রতিফলন, ঝিঁঝির একটানা ডাক কিছুই এখন আর তার চেতনাকে স্পর্শ করছে না।

মাজহার পিছন থেকে কয়েসের কাধ স্পর্শ করে বলল, হাঁটু গেড়ে বস।

কয়েস অনেকটা যন্ত্রের মতো হাঁটু গেড়ে বসল, সে আর কিছু চিন্তা করতে পারছে না। মাজহার কঠিন গলায় বলল, মাথা নিচু কর।

কয়েস মাথা নিচু করল। মাজহার এবার হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়াল, কয়েস একটা ধাতব শব্দ শুনতে পায়, চোখ না তুলেও সে বুঝতে পারে মাজহার তার হাতে রিভলবারটি তুলে এনেছে। মাজহার ভাবলেশহীন গলায় বলল, এখন মাথা উঁচু কর।

কয়েস মাথা উঁচু করল এবং এই প্রথমবার মাজহারকে দেখতে পেল, জ্যোৎস্নার আলোতে চেহারার সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো চোখে পড়ে না কিন্তু যেটুকু চোখে পড়ে তাতে কয়েসের মনে হল মানুষটি সুদর্শন। ছোটখাটো আকার, গলায় একটি কালচে মাফলার ঝুলছে। ডান হাতে একটা বেঢপ রিভলবার কয়েসের কপাল লক্ষ্য করে ধরে রেখেছে। জ্যোৎস্নার আবছা আলোতে মানুষটির চোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকু দেখে কয়েসের বুকের ভিতর শিরশির করে উঠল।

মাজহার নিচু গলায় বলল, দ্যাখ–তুই এখন নড়িস না তা হলে সোজা কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। চুপচাপ বসে থাক, কিছু বোঝার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। এই কাজ আমি অনেকবার করেছি, কীভাবে ঠিক করে করতে হয় আমি জানি। তোর উপরে আমার কোনো রাগ নাই, এইটা হচ্ছে একটা বিজনেস।

কয়েস কাঁপা গলায় বলল, মাজহার ভাই

মাজহার বাধা দিয়ে বলল, আমার নাম আসলে মাজহার না–

কথা শেষ করার আগেই মাজহার ট্রিগার টেনে ধরে। নির্জন নদীতীরে একটা ভোঁতা শব্দ হল। কয়েস সেই শব্দটি শুনতে পেল না কারণ বুলেটের গতি শব্দের চেয়ে বেশি।

.

ওর নামটা আসলে মাজহার নয়, ওর আসল নাম মাওলা। মাওলা বকশ। কয়েস অবাক হয়ে ভাবল, আমি সেটা কেমন করে জানলাম? ঝিঁঝি পোকার কর্কশ ডাক শোনা যাচ্ছিল, হঠাৎ করে সব নীরব হয়ে গেল কেন? কোনো কিছু শুনতে পাচ্ছি না কেন? তা হলে কি আমি মরে গেছি?

কয়েসের স্পষ্ট মনে আছে মাজহার নামের মানুষটা, যার আসল নাম মাওলা বকশ– তার কপালের দিকে একটা রিভলবার তাক করে ধরে রেখেছিল, ট্রিগার টানার পর সে একটা আলোর স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেল, তারপর সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেছে। তা হলে সে কি মরে গেছে? মরে গিয়ে থাকলে সে কেমন করে চিন্তা করছে?

কেউ একজন হাসল। কে হাসল? কেন হাসল? কয়েস নিজের এলোমলো ভাবটা বিন্যস্ত করে জেগে ওঠার চেষ্টা করে, কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে। জানতে চায়, আমি কোথায়?

কয়েস স্পষ্ট শুনতে পেল কেউ একজন বলল, আমি বলে কিছু নেই।

কয়েস চমকে ওঠে, কে কথা বলে?

কেউ না।

কেউ না?

না।

তুমি কে?

তুমি বলেও কিছু নেই। আমি তুমি বলে কিছুই নেই। সবাই এক।

কয়েস ছটফট করে ওঠে, আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

দেখা! দেখার মানে হচ্ছে কোনো কিছু থেকে প্রতিফলিত আলোর চোখের রেটিনায় এক ধরনের সংবেদন সৃষ্টি করা, যেটা মস্তিষ্ক ব্যাখ্যা করতে পারে। পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করে কিছু জৈবিক প্রক্রিয়ার ওপর। একটা জিনিস মানুষ দেখে একভাবে, পশুপাখি দেখে অন্যভাবে, কীটপতঙ্গ দেখে আবার সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। কাজেই তুমি যখন বলছ দেখতে পাচ্ছ তার অর্থ খুব অস্পষ্ট। দেখা ব্যাপারটি অস্পষ্ট! সত্যি কথা বলতে কী, দেখা ব্যাপারটি অত্যন্ত আদিম একটা প্রক্রিয়া–

কয়েস বলল, তবু আমি দেখতে চাই। মানুষের মতো দেখতে চাই।

বেশ! দেখতে চাইলেই দেখা যায়।

কয়েস দেখতে চাইল এবং হঠাৎ করে সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কয়েস একসাথে পুরো পৃথিবীটা দেখতে পায়। পৃথিবীর গাছপালা, নদী, সাগর, আকাশ–বাতাস, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, মানুষ, মানুষের বসতি, শহর নগরী সবকিছু দেখতে পেল। সবকিছু তার সামনে স্থির হয়ে আছে, যেন পুরো পৃথিবীটা তার সামনে স্থির হয়ে আছে। যেন পৃথিবীটাকে কেউ থামিয়ে দিয়েছে।

কয়েস অবাক হয়ে দেখে–সম্পূর্ণ নতুনভাবে দেখা, যেটি সে আগে কখনো দেখে নি। কয়েস নিজের ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে–সে তো এতকিছু এভাবে দেখতে চায় নি।

তা হলে কী দেখতে চেয়েছ?

আমি নদীতীরে মাজহার নামের মানুষটিকে দেখতে চেয়েছি। সে আমার মাথায় রিভলভার ধরে রেখেছিল। যার আসল নাম মাজহার নয়–যার নাম মাওলা। মাওলা বকশ–

বেশ।

কয়েস সাথে সাথে মাজহারকে দেখতে পেল। হাতে একটি বেঢপ রিভলভার চেপে নিয়ে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য। তার পায়ের কাছে একটি দেহ কুঁকড়ে শুয়ে আছে। দেহটিকে চিনতে পারল–তার নিজের দেহ। কয়েস অবাক হয়ে দেখল মাজহার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রিভলবারের নল থেকে যে ধোঁয়া বের হয়েছে সেটিও স্থির হয়ে আছে। আকাশে আধখানা চাঁদ তার মাঝে কোমল এক ধরনের কুয়াশা। নদীর পানি কাঁচের মতো স্থির। কয়েস আতঙ্কে কেমন যেন শিউরে উঠল। ভাবল, তা হলে কি আমি মরে গেছি?

কেউ একজন আবার নিচু গলায় হাসল। কে হাসে? কয়েস চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে চাইল তা হলে কি আমাকে মেরে ফেলেছে? আমি কি মৃত? আমি তুমি বলে কিছু নেই। আসলে জন্ম–মৃত্য বলেও কিছু নেই। এখানে সবাই মিলে একটি প্রাণ। একটি অস্তিত্ব। একটি প্রক্রিয়া।

প্রক্রিয়া?

হ্যাঁ। সেই প্রক্রিয়ার তুমি একটি অংশ। মাজহার একটি অংশ। মাজহার ইচ্ছে করলে আমি হতে পারে, তুমিও ইচ্ছে করলে মাজহার হতে পার। তোমরা আসলে একই মানুষ। একই প্রাণের অংশ। একই অস্তিত্বের অংশ।

কয়েস অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। যে মানুষটি তাকে হত্যা করেছে সেই মানুষটি এবং সে নিজে একই মানুষ? কিন্তু সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?

কারণ সময়কে থামিয়ে রাখা হয়েছে।

সময়কে চালিয়ে দেওয়া যাবে?

উত্তর পেতে তার একটু দেরি হল। দ্বিধান্বিত স্বরে কেউ একজন বলল, হ্যাঁ। যাবে।

কয়েস নিজের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। আশ্চর্য এক ধরনের শূন্যতা, আদি–অন্তহীন নিঃসীম এক ধরনের শূন্যতা। সে ক্লান্ত গলায় অনিশ্চিত স্বরে বলল, তুমি কে আমার সাথে কথা বলছ?

কেউ একজন হাসল। হেসে বলল, আমি কেউ না। আমার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি হচ্ছি তুমি। তুমি হচ্ছ আমি। তুমি নিজের সাথে কথা বলছ।

আমি নিজের সাথে কথা বলছি?

হ্যাঁ, তুমি নিজের সাথে কথা বলছ।

কয়েস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি আর মাজহার একই অস্তিত্ব?

হ্যাঁ। তোমরা একই অস্তিত্ব। তোমরা একই মানুষ।

আমি মাজহারকে বুঝতে চাই।

কী বুঝতে চাও?

কেমন করে সে এত নিষ্ঠুর হয়? এত অমানুষ হয়?

কেউ একজন আবার হাসল। হেসে বলল, তোমার বিশাল অস্তিত্বে এইসব অর্থহীন। এইসব তুচ্ছ! তোমার মুক্তি হয়েছে। তুমি জান এইসব হচ্ছে ছোট ছোট পরীক্ষা। ছোট ছোট কৃত্রিম প্রক্রিয়া–

কয়েস বাধা দিয়ে বলল, আমি তবু মাজহারকে বুঝতে চাই।

সেটি হবে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রক্রিয়া। অর্থহীন মূলাহীন একটি প্রক্রিয়া।

আমি তবু বুঝতে চাই।

কেউ একজন দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, বেশ।

হঠাৎ করে কয়েস আবিষ্কার করল সে আসলে কয়েস নয়, সে মাজহার। তার আসল নাম মাওলা বকশ। সে একটা জুটমিলের মেকানিক। তার একটি কমবয়সী স্ত্রী রয়েছে। বখে যাওয়া একটি পুত্র রয়েছে। মাজহারের শৈশবকে মনে পড়ল তার। শৈশবের দুঃসহ জীবন, অমানুষিক নির্যাতন, বেঁচে থাকার সম্রামের কথা মনে পড়ল। আনন্দহীন ভালবাসাহীন একটি নিষ্ঠুর জীবনের কথা মনে পড়ল। দুঃখ–কষ্ট–নির্যাতন আর অপমানে নিজেকে পাষাণ হয়ে যেতে দেখল। ঘৃণায় এবং জিঘাংসায় নিজেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখল। কয়েস তার নিজের সাথে, মাজহারের সাথে কথা বলল–তাকে বুঝতে চাইল। তাকে সে বুঝতে পারল না। তবুও সে তার মনের গহিনে, মস্তিষ্কের আনাচে–কানাচে, চেতনার সীমানায় ঘুরে বেড়াল। একসময় সে ক্লান্ত হয়ে বলল, আমি আর মাজহার হয়ে থাকতে চাই না।

বেশ। তুমি তা হলে কী হতে চাও?

আমি আমার নিজের থাকতে চাই।

নিজ বলে কিছু নেই। তোমার মুক্তি হয়েছে। তুমি এখন সব। তুমি এখন আমার বিশাল অস্তিত্বের অংশ। তুমি এখন

আমি কি সময়কে পিছু নিয়ে যেতে পারি?

পিছু?

হ্যাঁ।

কত পিছু?

আমার শেষ অংশটুকু। জীবনের শেষ অংশটুকু?

কী বলছ তুমি? সেটি অর্থহীন মূল্যহীন তুচ্ছ একটি পরীক্ষা। নগণ্য একটি প্রক্রিয়া।

আমি তবু আরো একবার সেটি দেখতে চাই। আরো একবার তার ভিতর দিয়ে যেতে চাই। আরো একবার

কী বলছ তুমি?

আমি সত্যি বলছি।

কিছুক্ষণ কোনো কথা বলল না। তারপর কেউ একজন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, বেশ।

.

হেমন্তের কুয়াশা ঢাকা পথে কয়েস হেঁটে যাচ্ছে। অন্ধকার নেমে এসেছে, জ্যোৎস্নায় এক ধরনের আলো–আঁধারের খেলা নেমে এসেছে। অনেক দূরে কোথাও একটা কুকুর ডাকল, ঝিঁঝি পোকা কর্কশ স্বরে ডাকছে।

কয়েসের হাত পিছন থেকে বাধা, নাইলনের দড়ি টান দিয়ে পিছনের মানুষটি বলল, এখানে দাঁড়া।

কয়েস হঠাৎ করে বুঝতে পারল সে তার জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে। হঠাৎ করে মনে হয় তার কিছুতেই কিছু আসে–যায় না। পিছনের মানুষটি বলল, হাঁটু গেড়ে বস। কয়েস হাঁটু গেড়ে বসল। পিছনের মানুষটা হেঁটে কয়েসের সামনে এসে দাঁড়াল। একটা ধাতব শব্দ শুনে কয়েস মাথা তুলে তাকাল। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে এই ব্যাপারটি আগে কখনো ঘটেছে। কখন ঘটেছে সে মনে করতে পারে না। মানুষটি হাতে একটি বেটপ রিভলবার নিয়ে তার কপালের দিকে তাক করে ধরে। নিচু গলায় বলে, দ্যাখ–এখন তুই নড়িস না। তা হলে সোজা কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। চুপচাপ বসে থাক

কয়েস বাধা দিয়ে বলল, মাজহার সাহেব–

মানুষটি থতমত খেয়ে থেমে যায়। ভুরু কুঁচকে সে কয়েসের দিকে তাকাল, বলল, কী বললি?

কিছু না। বলছিলাম কী, কিছুতেই আর কিছু আসে–যায় না। আপনার ওপর আমার কোনো রাগ নেই। আমি জানি এইটা একটা বিজনেস।

মানুষটা কয়েক মুহূর্ত রিভলবারটা ধরে রেখে ধীরে ধীরে হাতটা নামিয়ে আনে। একটা নিশ্বাস ফেলে সে নদীর দিকে তাকাল। তারপর অন্যমনস্কভাবে নদীর পানির দিকে এগিয়ে গেল। দূরে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে।

কয়েস নিচু গলায় ডাকল, মাওলা সাহেব। দড়িটা একটু খুলে দেবেন? হাতে বড় জোরে বেঁধেছেন।

মাজহার নামের মানুষটি, যার আসল নাম মাওলা বকশ, মাথা ঘুরিয়ে কয়েসের দিকে তাকাল, কাঁপা গলায় বলল, কী বললি?

আপনার নাম তো আসলে মাওলা বকশ। তাই না?

তুই কেমন করে জানিস?

আমি জানি। আপনি আর আমি তো আসলে একই মানুষ। তাই না?